দক্ষিণ এশিয়ায় মাদ্রাসাশিক্ষা: প্রাক-ঔপনিবেশিক এবং ঔপনিবেশিক আমল

সারসংক্ষেপ

এই প্রবন্ধে দ্বাদশ শতাব্দী থেকে শুরু করে ১৯৪৭ সালে ঔপনিবেশিক শাসন শেষ হওয়া পর্যন্ত সময়ে দক্ষিণ এশিয়ায় মাদ্রাসার (ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান) ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে। এই প্রবন্ধে দেখানো হয়েছে যে দক্ষিণ এশিয়ায় মোগলরাসহ (১৫২৬-১৮৫৭) অনেক প্রাক-ঔপনিবেশিক শাসকই নানান ধরনের শিক্ষার প্রসার এবং মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানে মূল ভূমিকা পালন করেছিলেন। তবে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের নীতি (১৭৫৭-১৯৪৭) মাদ্রাসাশিক্ষার ওপর সবচেয়ে স্থায়ী প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছিল। প্রত্যক্ষভাবে তাদের নীতিসমূহ মাদ্রাসাগুলোর কাঠামো, কার্যক্রম এবং পাঠ্যসূচির ওপর প্রভাব ফেলেছিল এবং পরোক্ষভাবে, ওলামা ও মুসলিম সম্প্রদায়কে সাড়া দেওয়ার জন্য প্ররোচনা দিয়ে মাদ্রাসাশিক্ষার বহিরাবয়ব এবং উপাদান নির্ধারণ করে দিয়েছিল। এই প্রবন্ধে বিভিন্ন ধারার মাদ্রাসাশিক্ষার ভূমিকা এবং বিভিন্ন প্রধান মাদ্রাসার পাঠ্যসূচি ও রাজনীতির মধ্যকার আন্তসম্পর্ক যাচাই করা হয়েছে। এই প্রবন্ধে দেখানো হয়েছে যে প্রতিষ্ঠান এবং ধারণা হিসেবে মাদ্রাসা অনেকটা পথ অতিক্রম করে এসেছে, মাদ্রাসাগুলোর বহিরাবয়ব এবং আধেয়সমূহ নানান পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে এবং প্রতিষ্ঠান হিসেবে মাদ্রাসাগুলো এখনো সমাজের সঙ্গে অনেকাংশে সম্পৃক্ত আছে।

মুখ্য শব্দগুচ্ছ: শিক্ষা, পরিচয়, মাদ্রাসা, দক্ষিণ এশিয়া।

ভূমিকা

যদিও অনেক মুসলিম রাষ্ট্রে এবং নানান নামে (যেমন ইন্দোনেশিয়ায় পেসানট্রেন) ইসলামিক শিক্ষা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান লক্ষ করা যায়, তবে দক্ষিণ এশিয়া, মাদ্রাসাশিক্ষার দীর্ঘ ঐতিহ্যসহ যেখানে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মুসলিম জনসংখ্যার বাস, সাম্প্রতিক সময়ে অন্য যেকোনো অঞ্চলের চেয়ে বেশি নজর কেড়েছে। আরবি ভাষাভাষি অঞ্চলে মাদ্রাসা শব্দটি দ্বারা কোনো নির্দিষ্ট ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে নির্দেশ করা হয় না, বরং নানান পর্যায়ের বিদ্যালয়কে মাদ্রাসা নামে অভিহিত করা হয়। তবে আরবি ভাষাভাষি না এ রকম সমাজে এই শব্দ ভিন্ন অর্থে ব্যবহূত হয় এবং প্রায়ই ওলামাদের (শাব্দিক অর্থে পণ্ডিত, একবচনে আলিম) প্রশিক্ষণের জন্য এক বিশেষ ধরনের প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশ করে। দক্ষিণ এশিয়ায় মাদ্রাসা বলতে এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বোঝানো হয় যেখানে কোরআন, হাদিস (মহানবী মুহাম্মদ (সা.)-এর বাণী), ফিকাহ্ (আইনশাস্ত্র) এবং আইনের ওপর পাঠদান করা হয়। অর্থাত্, যেসব বিদ্যালয় ইসলামিক পাঠ্যক্রম অনুসরণ করে, সে বিদ্যালয়গুলোকে মাদ্রাসা বলা হয়। যদিও মাদ্রাসা শব্দটি বর্গীয় অর্থে প্রাথমিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষা পর্যন্ত সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ব্যবহূত হয়, তবে মুসলিম বিশেষজ্ঞদের কাছে মাদ্রাসা দ্বারা প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ের অর্থাত্ দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বোঝায়। যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একাদশ এবং দ্বাদশ শ্রেণির সমমানের পাঠ্যক্রম প্রদান করে, সেগুলোকে দারুল উলুম (শাব্দিক অর্থে জ্ঞানের আবাস) বলা হয়। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সমমানের পাঠ্যক্রম প্রদানকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে জামেয়া বলা হয়। এই প্রবন্ধে আমি মাদ্রাসা দ্বারা ওপরে উল্লেখিত সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করব।

এই প্রবন্ধে প্রাক-ঔপনিবেশিক এবং ঔপনিবেশিক আমলে দক্ষিণ এশিয়ায় (ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ) মাদ্রাসার ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার মাদ্রাসাশিক্ষার ইতিহাস এই অঞ্চলের বাইরে ঘটা অনেক ঘটনার সঙ্গে নানাভাবে সংযুক্ত, কিন্তু মাদ্রাসাগুলোর বিকাশ এবং ভূমিকা এই অঞ্চলের ঐতিহাসিক ও সামাজিক অবস্থার দ্বারা নির্ধারিত হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় মোগলরাসহ (১৫২৬-১৮৫৭) অনেক প্রাক-ঔপনিবেশিক শাসকই শিক্ষার প্রসার এবং মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানে মূল ভূমিকা পালন করেছিলেন। তবে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের নীতি (১৭৫৭-১৯৪৭) মাদ্রাসাশিক্ষার ওপর সবচেয়ে স্থায়ী প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছিল। প্রত্যক্ষভাবে তাদের নীতিসমূহ মাদ্রাসাগুলোর কাঠামো, কার্যক্রম এবং পাঠ্যসূচির ওপর প্রভাব ফেলেছিল এবং পরোক্ষভাবে ওলামা ও মুসলিম সম্প্রদায়কে সাড়া দেওয়ার জন্য প্ররোচনা দিয়ে মাদ্রাসাশিক্ষার বহিরাবয়ব এবং উপাদান নির্ধারণ করে দিয়েছিল। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব প্রতিক্রিয়া মুসলিম পরিচয় ধারণাকেন্দ্রিক ছিল, ফলে প্রতিক্রিয়াগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক সক্রিয়তা মেশানো ছিল।

এই প্রবন্ধে চারটি অংশ রয়েছে। প্রথম অংশে ভারতে মোগল শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে কীভাবে এই প্রতিষ্ঠান দানা বেঁধে উঠছিল তা দেখা হয়েছে। এরপরের অংশে মোগল শাসনামলে এই প্রতিষ্ঠানের বিকাশ আলোচিত হয়েছে। এরপর আমি দেখিয়েছি যে ব্রিটিশ উপনিবেশাধীন ভারতে মাদ্রাসাশিক্ষার ইতিহাস রাষ্ট্রের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতির, বিশেষত ১৯ শতকের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমি মনে করি, ঔপনিবেশিক শাসনামলে মাদ্রাসা সম্পর্কে বোঝার ক্ষেত্রে ঔপনিবেশিক প্রশাসনের শিক্ষানীতি, মোগল সাম্রাজ্যের পতনের পর পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক কাঠামোয় নিজেদের অবস্থান নির্ণয়ে মুসলমানদের প্রচেষ্টা এবং ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে পরিচয়ের রাজনীতির উত্থান—এই তিনটি প্রধান ফ্যাক্টর বিবেচনায় নিতে হবে।

গোড়াপত্তন

১৫২৮ সালে ভারতে মোগল শাসন শুরুর পূর্ব পর্যন্ত ভারতে মাদ্রাসাসহ ইসলামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রচলিত থাকলেও সেগুলোর সুনির্দিষ্ট কোনো ধরন ছিল না। যেহেতু ব্যবসা, অভিবাসন, ধর্মপ্রচার ও সামরিক আক্রমণের মতো নানা পন্থায় ইসলাম ভারতে এসেছে তাই, মাদ্রাসাগুলোর প্রকৃতি, ক্ষেত্র এবং ভূমিকা অঞ্চলভেদে ভিন্ন ছিল এবং তা মুসলিম ও স্থানীয় সম্প্রদায়ের মধ্যকার পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়ার ধরনের ওপর নির্ভর করত। যেমন ৭১১ সালে মুহাম্মদ বিন কাশিম এবং একাদশ শতাব্দীতে গজনির মাহমুদ উপমহাদেশের উত্তরাংশে আক্রমণ করেন। দস্যুদের দ্বারা আরব বাণিজ্য জাহাজ আক্রান্ত হলে বিন কাশিম সিন্ধ আক্রমণে প্ররোচিত হন, এর দ্বারা এটা প্রমাণিত হয় যে সামরিক সংঘর্ষের বহু পূর্ব থেকেই বাণিজ্য সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। অন্যদিকে, ভারতের পূর্বাংশে; বিশেষত বাংলায় সপ্তম শতকের শুরু থেকেই সুফি, দরবেশ এবং পুণ্যাত্মাদের আগমন শুরু হয়েছিল (সাকলাইন, ১৯৯৩: ৩)।১

কিছু ঐতিহাসিকের মতে, বিন কাশিমের আক্রমণের পর আরব বিশেষজ্ঞরা সিন্ধের বিখ্যাত শহরে—যেমন দেবাল এবং নতুন শহরে যেমন মনসুরা, যা ৭২৮ থেকে ৭৩৮-এর মধ্যে স্থাপিত হয়েছিল—আসেন।২ কিছু মতানুসারে যেখানে ‘বিশেষজ্ঞরা দামেস্কের মতো হাদিস, তাফসির (কোরআনের ব্যাখ্যা) এবং ফিকাহ্ সাহিত্যের ওপর বক্তৃতা দিতেন সেখানেই মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল’ (কাউর, ১৯৯০: ১৭)। কিন্তু এই দাবিকে সমর্থন করে এমন খুব কম প্রমাণই আছে। মুহাম্মদ ঘুরি দ্বাদশ শতাব্দীর শেষাংশে ভারতে তুর্কি শাসনের সূত্রপাত করেন। এই ঘুরিকেই প্রথম ১১৯১ সালে আজমিরে মাদ্রাসা স্থাপনের কৃতিত্ব দেওয়া হয় এবং এই মাদ্রাসাকে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক মাদ্রাসা হিসেবে বিবেচনা করা হয় (কাউর, ১৯৯০: ১৮; সিকান্দ, ২০০৫: ৩৩)।

১১৫৩-১১৫৪ সালে যখন তুর্কিরা গজনি দখল করে, তখন অনেক অভিজাত গজনি ও খুরাসান থেকে পালিয়ে লাহোর শহরে চলে যান। এই শরণার্থীদের মধ্যে বিশেষজ্ঞরাও ছিলেন। তাঁদের উপস্থিতি স্থানীয় সংস্কৃতি এবং শিক্ষাকে প্রভাবিত করেছিল (সিদ্দিকি, ২০০৫: ৮)।

দিল্লি সালতানাতের, যা ১২০১ থেকে ১৫২৮ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল, অনেক শাসকই শিক্ষা এবং ধর্মীয় শিক্ষণের প্রতি প্রশংসা প্রদর্শন করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন মসজিদ ও ধর্মীয় শিক্ষা কেন্দ্র নির্মাণ করেছিলেন এবং কেউ কেউ রাজধানী দিল্লিসহ তাঁদের শাসনাধীন এলাকায় মাদ্রাসা স্থাপন করেছিলেন। তাঁর শাসনের প্রথম দিকে শামসুদ্দিন ইলতুতমিশ (বা আলতামাস ১২১১-১২৩৬) দিল্লিতে প্রথম মাদ্রাসা স্থাপন করেন এবং মাদ্রাসা-ই-মুয়িজ্জি নামকরণ করেন। তুঘলক সাম্রাজ্যের (১২৯০-১৩০২) শাসকদের মধ্যে মুহাম্মদ বিন তুঘলক (১৩২৫-১৩৫১) মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার কাজে সবচেয়ে বেশি উত্সাহী ছিলেন। তাঁর শাসনামলে দিল্লিতে প্রায় ১,০০০ মাদ্রাসা ছিল (আহমদ, ১৯৬৪: ৪৪; কাউর, ১৯৯০: ২১; সিকান্দ, ২০০৫: ৩৩)।

যদিও এই মাদ্রাসাগুলো শুধু একজন শাসক দ্বারা স্থাপিত হয়নি, তবে মাদ্রাসাগুলো একই উদ্দেশ্যে নিয়োজিত ছিল—রাষ্ট্রীয় চাকরির জন্য মানুষকে শিক্ষিত করা—এবং এসব মাদ্রাসা মুসলিম বিশ্বে সুপ্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসাগুলোর প্যাটার্ন সূক্ষ্মভাবে অনুসরণ করত।

বৃহত্তর অর্থে পড়াশোনার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো ছিল: ১. ব্যাকরণ, ২. সাহিত্য, ৩. যুক্তিবিদ্যা, ৪. ইসলামিক আইন এবং এর মূলনীতিসমূহ, ৫. কোরআনের ব্যাখ্যা, ৬. হাদিস, ৭. অতীন্দ্রিয়বাদ, ৮. স্কলাস্টিসিজম (ধর্মীয় দর্শন)। পাঠ্যবইয়ের অনেক টেক্সটই বাগদাদের মূল বিদ্যালয়ের টেক্সটের অনুরূপ ছিল, তবে পরবর্তী সময়ে বুখারা এবং মধ্য এশিয়ার খোয়ারিজমের বিশেষজ্ঞদের টেক্সটও বইগুলোতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল (নায়ার, ২০০৩:২০১)।৩

এসব মাদ্রাসার পাঠ্যসূচি, বিশেষত যেসব মাদ্রাসা উত্তরে অবস্থিত ছিল; আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের পতনের পর ভারতে আগত বিশেষজ্ঞদের দ্বারা প্রভাবিত ছিল। এ সময় মোগলরা এই ইসলামি শাসনের মূল কেন্দ্র এবং মাদ্রাসাগুলো লুণ্ঠন করেছিল। এই বিশেষজ্ঞদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি অংশ হানাফি মাজহাব অনুসরণ করত। এর ফলে অনেকগুলো মাদ্রাসাও হানাফি মাজহাব অনুসরণ করছিল (সিকান্দ, ২০০৫: ৩৩)। কিন্তু গোটা ভারতের ক্ষেত্রে এ কথা প্রযোজ্য নয়, কারণ, যেমনটি আগে বলা হয়েছে, মাদ্রাসাগুলোর প্রকৃতি অঞ্চলভেদে বেশ ভিন্ন ছিল।

সময়ের পরিক্রমায় দিল্লিভিত্তিক শাসন দুর্বল হতে শুরু করলে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যসংবলিত বেশ কিছু আঞ্চলিক সাম্রাজ্যের উত্থান ঘটেছিল। দক্ষিণে, স্বাধীন মুসলিম রাজ্য দক্ষিণাপথ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। দক্ষিণাপথের দক্ষিণাংশে অবস্থিত বাহমনি সালতানাত (বা বাহমনি সাম্রাজ্য) ১৩৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়ে প্রায় ২০০ বছর স্থায়ী হয়েছিল এবং বেশ কয়েকটি মাদ্রাসা স্থাপনের জন্য পরিচিত ছিল। এসব মাদ্রাসার প্রথমটি মাহমুদ শাহ ১৩৭৮ সালে নির্মাণ করেছিলেন (কাউর, ১৯৯০: ২৪)। সবচেয়ে বিখ্যাত মাদ্রাসাটি শামসুদ্দিন মুহাম্মদ শাহ বাহমনির (যিনি মুহাম্মদ শাহ তৃতীয় লাস্কারি নামেও পরিচিত, ১৪৬৩-১৪৮২) প্রধানমন্ত্রী খাজা মাহমুদ গাওয়ানের নির্দেশনায় বিদারে ১৪৭২ সালে নির্মিত হয়েছিল। এই মাদ্রাসার সুনাম সবচেয়ে বিখ্যাত ধর্মতাত্ত্বিক, দার্শনিক এবং বিজ্ঞানীদের আকর্ষণ করেছিল। এই মাদ্রাসার একটা উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, যা ভারতের অন্যান্য মাদ্রাসা থেকে ভিন্ন, এটি শিয়া মতবাদ সংহত করার প্রত্যাশায় নির্মিত হয়েছিল এবং এটি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিল। মাহমুদ গাওয়ানের নামানুসারে নামাঙ্কিত এই মাদ্রাসা পারস্যের স্থাপত্যকলার এক অত্যুজ্জ্বল নিদর্শন ছিল। নানান বর্ণনা অনুসারে দক্ষিণে মাদ্রাসাগুলোর পাঠ্যসূচিতে ধর্মীয় এবং সেক্যুলার উভয় ধরনের বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল। সাধারণত এর একটি বড় কারণ হচ্ছে শিক্ষা খাতে শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা। উদাহরণস্বরূপ, মাহমুদ শাহ প্রতিষ্ঠিত প্রথম মাদ্রাসায় এতিমদের শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল, থাকা এবং খাবারের খরচ রাষ্ট্র বহন করত এবং অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরকারি ভর্তুকি দেওয়া হতো।

বাংলায় দিল্লির সালতানাতের সময় ইসলামি শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ শুরু হয়, কিন্তু এর ভিত্তি পূর্ববর্তী সময়ে সুফি ও দরবেশদের আগমনের সময়েই নির্মিত হয়েছিল। সাধারণত সুফি এবং দরবেশরা এই অঞ্চলের বাইরে থেকে আসতেন এবং তাদের খানকা হতে (তাদের বসবাস এবং প্রার্থনার স্থান) সমন্বিত শিক্ষা কেন্দ্র তৈরি করতেন (ল, ১৯১৬: ১৯)। এসব জমায়েত, যা আরবে ইসলামের প্রাথমিক অবস্থায় হলখার সদৃশ ছিল, প্রাথমিকভাবে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ছিল এবং নির্দিষ্টভাবে কোরআন ও সুন্নাহর শিক্ষা আলোচিত হতো। এসব জমায়েত কোনো ভাষায় অক্ষরজ্ঞান বা প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়ার নিমিত্তে পরিচালিত হতো না। শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় এসব খানকা সুফি ও দরবেশদের এবং তাদের স্থানীয় অনুসারীদের পৃষ্ঠপোষকতার ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল ছিল। ফলে কোনো সুফি বা দরবেশ কোনো স্থান ত্যাগ করলে, তাঁর সঙ্গে তাঁর খানকা, বিশেষত শিক্ষার উদ্দেশ্যে হওয়া জমায়েতও বন্ধ হয়ে যেত এবং তাঁর নতুন গন্তব্য আরেকটি খানকা বা শিক্ষা জমায়েত শুরু হতো। সময়ের পরিক্রমায় এসব খানকার কিছু কিছু প্রাথমিক শিক্ষার কেন্দ্রে পরিণত হয়, তখন এগুলোর নাম হয় মক্তব। মসজিদে এবং যেসব মুসলিম নিজেদের ঘরে জায়গা দিতে পারতেন, সেখানেও মক্তব তৈরি হতো।

এটা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে মক্তবগুলো চালু হওয়ার আগে বাংলায় একটি দেশজ শিক্ষাপদ্ধতি বিকশিত হচ্ছিল। প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান ছিল টোল, প্রাথমিকভাবে এখানে হিন্দুধর্মীয় রীতিনীতি শেখানো হতো। এসব প্রতিষ্ঠান ছিল শিশুদের স্বাক্ষরতা এবং ধর্মীয় শিক্ষাদানের সামাজিক উদ্যোগ। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান একজন ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠত এবং এই ব্যক্তিকে বলা হতো গুরু (সংস্কৃত ভাষায় এর অর্থ শিক্ষক)। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা সংস্কৃত ভাষা শেখার জন্য একটি উল্লেখযোগ্য সময় ব্যয় করত। বাংলায় দ্বাদশ শতাব্দীর পর বিকাশ লাভ করা আরেক ধরনের প্রতিষ্ঠান হচ্ছে পাঠশালা। পাঠশালার পাঠ্যসূচি তুলনামূলক সেক্যুলার ছিল। ভাষা, মৌলিক গণিত, কৃষি ও নৌকা নির্মাণ দক্ষতা এবং এ রকম বিষয়গুলো দিয়ে পাঠ্যক্রম সাজানো হতো। ফলে দেখা যাচ্ছে, বাংলা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বেশ আগেই বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে প্রথমে মক্তব এবং পরে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১১৯৭ সালে ইখতিয়ার বিন বখতিয়ার খিলজির সামরিক অভিযান বাংলায় পৌঁছার আগে পর্যন্ত মক্তব এবং মাদ্রাসাগুলো সম্প্রদায়ভিত্তিক এবং সম্প্রদায়ের পৃষ্ঠপোষকতানির্ভর প্রতিষ্ঠান ছিল। বখতিয়ার খিলজি বাংলায় তাঁর শাসন বিস্তার করার পর রংপুরা নামে নতুন একটি শহর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং সেখানে অল্প সময়ের মধ্যে কয়েকটি মাদ্রাসা স্থাপন করেছিলেন (কাউর, ১৯৯০: ৩০)। তাঁর উত্তরসূরিরা তাঁকে অনুসরণ করেন এবং আরও অনেক মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁরা বিভিন্ন মক্তবে তাঁদের সাহায্যও বৃদ্ধি করেছিলেন (রহিম, ১৯৮২: ১৬৪)।

এরপরের আলোচনায় দেখানো হয়েছে যে দিল্লির সালতানাতের অধীনে ইসলামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যে বিস্তার শুরু হয়েছিল, তা সালতানাতের ক্রমদুর্বলতা এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক কাঠামোর উত্থান সত্ত্বেও অব্যাহত ছিল। এই বিস্তারের একটি কারণ ছিল আঞ্চলিক শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা, তবে তা একমাত্র কারণ ছিল না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ধর্মপ্রচারকদের উপস্থিতির কারণে এবং অন্য ক্ষেত্রে শিশুদের শিক্ষাদানের নিমিত্তে সামাজিক উদ্যোগ হিসেবে মাদ্রাসার উত্থান ঘটে।

এটা উল্লেখযোগ্য যে এসব মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কোনো একক আদর্শ কাঠামো অনুসরণ করা হয়নি এবং এসব মাদ্রাসা স্বায়ত্তশাসন ভোগ করত। পাঠ্যসূচি নির্ধারণে মাদ্রাসাগুলো সম্পূর্ণ স্বাধীন ছিল। উপরন্তু, ‘প্রেরিত’ এবং ‘যৌক্তিক’ উভয় ধরনের বিজ্ঞানই এসব মাদ্রাসায় শেখানো হতো। এ ক্ষেত্রে যুক্তি ছিল, এই দুটি বিজ্ঞান কোনো না কোনোভাবে পরস্পরের বিরোধী বা সমকালীন অন্যান্য মুসলিম সমাজের মতো মধ্যযুগের ভারতীয় মুসলিম শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মীয় এবং সেক্যুলার বিশ্বের মধ্যকার বিদ্যমান স্পষ্ট পার্থক্য অনুপস্থিত ছিল (সিকান্দ, ২০০৫: ৩৪)।

উভয় ধরনের বিজ্ঞানশিক্ষা মাদ্রাসা স্নাতকদের রাজসভা এবং প্রশাসনের নানান বিভাগে চাকরি লাভের ক্ষেত্রে সাহায্য করেছিল। মাদ্রাসা ছাড়াও মক্তব স্থাপনও আলোচিত হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান বাল্যশিক্ষা বা কিন্ডারগার্টেনের সমমানের ছিল, কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানে শুধু কোরআন মুখস্থ করা শেখানো হতো।

মোগল সাম্রাজ্যের (১৫৫৬-১৮৫৮) অধীনে মাদ্রাসা

মোগল সাম্রাজ্যের (১৫৫৬-১৮৫৮) সময় মাদ্রাসার সংখ্যা অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। মোগল সাম্রাজ্য প্রায় ২০০ বছর উত্কর্ষের শিখরে ছিল এবং এর বিস্তৃতি একটি মহাদেশের চেয়ে কম ছিল না। এর প্রাথমিক কারণ ছিল শাসক নিরপেক্ষভাবে রাজসভার সমর্থন প্রদান। মোগল সাম্রাজ্যের অধীনে, বিশেষত ১৬০০ শতাব্দীতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার পেছনে আরও দুটি বিষয়ের ভূমিকা রয়েছে। প্রথমত, ক্ষমতার এককেন্দ্রিক সংহতকরণ এবং ফলে কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্রের ফলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা; দ্বিতীয়ত, প্রভাবশালী ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে একই সঙ্গে সুফি এবং ওলামাদের ক্রমবর্ধমান প্রভাব। সার্বিকভাবে মাদ্রাসাগুলো সম্রাট এবং সাধারণ মানুষ সবার কাছ থেকেই পৃষ্ঠপোষকতা ও শ্রদ্ধা পেত।

মোগল আমল দুটি বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ছিল: শিক্ষাক্ষেত্রে দুটি পরস্পরবিরোধী ধারার উপস্থিতি এবং একটি ঐতিহ্যকে মাদ্রাসা পাঠ্যসূচির সঙ্গে একত্রীকরণ। শিক্ষাক্ষেত্রে একটি ধারা সমাজের একটি বড় অংশকে শিক্ষার সুযোগ দিতে নিয়োজিত ছিল এবং অন্য একটি ধারা ওই একই জনগোষ্ঠীকে সমকালীন অন্যান্য অঞ্চলে, বিশেষত ইউরোপে ঘটে যাওয়া প্রযুক্তিগত উন্নয়নের জ্ঞান থেকে বিরত রাখত। মাদ্রাসাশিক্ষার ক্ষেত্রে মাকুলাত (যৌক্তিক বিজ্ঞান) ঐতিহ্যকে অবহেলা করে বারবার মানকুলাত (প্রকাশিত/প্রেরিত জ্ঞান) ঐতিহ্যকে সংহত করা হয়েছিল। মজার বিষয় হচ্ছে, সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রথম দিকে মাকুলাতের অধ্যয়নই ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হয়েছিল।

প্রভাবশালী ঐতিহাসিক বয়ান অনুসারে শিক্ষা বিস্তার মোগল শাসকদের অন্যতম প্রাধান্যপ্রাপ্ত বিষয় ছিল। নরেন্দ্র নাথ ল, মুসলিম শাসনাধীন ভারতে শিক্ষার ওপর তাঁর বীজগর্ভ কাজের উপসংহারে বলেন, ‘প্রায় সব মোগল শাসকই মানুষের শিক্ষা এবং জ্ঞানের বিস্তারের বিষয়ে খুবই আগ্রহী ছিলেন’ (ল, ১৯১৬: ১৯০)। শাসকেরা নানান স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছিলেন। বাবরের (১৫২৬-১৫৩০) রাজকীয় নথি থেকে দেখা যায় যে শিক্ষাকে প্রজাদের প্রতি রাষ্ট্রের কর্তব্য হিসেবে বিবেচনা করা হতো। অনেক মানুষের কাছে শিক্ষাকে সহজলভ্য করতে আকবর (১৫৫৬-১৬০৫) নেতৃত্বস্থানীয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি একটি ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পরিবেশন দপ্তর’ স্থাপন করেছিলেন এবং গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাপদ্ধতি সংস্কার কার্যক্রম চালু করেছিলেন (ইকরাম, ১৯৬৪: ১৫৪)।

জাহাঙ্গীর (১৬০৫-১৬২৭) একটি আইন প্রবর্তন করেছিলেন। এই আইন অনুসারে কোনো ধনী ব্যক্তি বা ধনী পরিব্রাজক যদি উত্তরাধিকারী না রেখে মৃত্যুবরণ করতেন, তবে তাঁর সব সম্পত্তি রাজকোষে জমা করা হতো এবং তা মাদ্রাসা ও আশ্রম নির্মাণ এবং মেরামতের কাজে ব্যবহার করা হতো। জান জাহান খান তাঁর তারিখই-জান-জাহানু-এ বর্ণনা করেছেন যে ‘জাহাঙ্গীর ৩০ বছর পাখি এবং জন্তু বাস করত এমন মাদ্রাসাও মেরামত করেছিলেন এবং সেগুলোকে ছাত্র ও শিক্ষকে পূর্ণ করে দিয়েছিলেন’।৪ শিক্ষাক্ষেত্রে সম্রাট শাহজাহানের (১৬২৭-১৬৫৮) সবচেয়ে প্রশংসিত কাজ হচ্ছে ১৬৫০ সাল নাগাদ দিল্লিতে ইম্পেরিয়াল কলেজ স্থাপন (ল, ১৯১৬: ১৯০)। মোগল আমলে রাজকীয় সাহায্যের সঙ্গে সঙ্গে সমাজের অভিজাত ও ধনী ব্যক্তিরাও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করত। ফলে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর বিস্ময়কর বিকাশ ঘটে এবং রাজসভায় ওলামারা একটি সম্মানজনক স্থান দখল করে। প্রায়ই সামরিক অভিযানের সময় রাজারা পণ্ডিতদের সঙ্গে নিয়ে যেতেন।৫

রাষ্ট্র এবং ওলামাদের মধ্যকার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক মোগল সাম্রাজ্যের একক কোনো বৈশিষ্ট্য ছিল না, অটোমান এবং সাফাভিদ সাম্রাজ্যেও এই একই বৈশিষ্ট্য দেখা যায় এবং তা শুধু রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতার প্রতি ঝোঁকের ফসলও ছিল না। নিজ পেশায় সফলতা লাভ এবং নিজের ধর্মীয় ধারণা ও মতামতের বাস্তবায়ন তত্ত্বাবধান করতেও ওলামারা রাষ্ট্রের অংশ হতে আগ্রহী ছিলেন (মেটকাফ, ১৯৮২: ২১-২২)। তবে এই সম্পর্ক সব সময় অনুকূল ছিল না, আসলে মাঝে মাঝে সম্রাট এবং ওলামাদের মধ্যে বিরোধ দেখা দিত।

যদিও শিক্ষা, শিল্পকলা, সংগীত এবং স্থাপত্যকলার পৃষ্ঠপোষকতা করা মোগল শাসকদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ছিল, তবে তাঁরা নতুন জ্ঞান ও প্রযুক্তি রপ্ত করতে উত্সাহী ছিলেন না এবং সমকালীন আবিষ্কারগুলো ব্যবহারে পিছিয়ে ছিলেন। সাইয়্যিদ নাকি হুসেইন জাফরির মতে, ‘নতুন ধারণা এবং প্রযুক্তি গ্রহণের বিষয়ে বলতে গেলে, মোগলরা...অত বেশি আগ্রহী ছিলেন না’ (জাফরি, ২০০৬: ৪৬)। জাফরি তার যুক্তির সমর্থনে যে উদাহরণগুলো দিয়েছেন সেগুলো হলো পর্তুগিজ মিশনারিদের একটি প্রতিনিধিদল যখন আকবরকে ছাপানো কাগজ উপহার দিয়েছিল, তখন আকবর ছাপাখানা স্থাপনে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন এবং ফরাসি রাজকীয় প্রতিনিধিদল যখন জাহাঙ্গীরকে যান্ত্রিক ঘড়ি উপহার দিয়েছিল, তিনি তখন এই ঘড়ির প্রতি ঔদাসীন্য দেখিয়েছিলেন। ‘এই দুটি উদাহরণ শুধু এ জন্য দেওয়া হলো যে যাতে বোঝা যায় শাসক এবং ক্ষমতা একটি জাতির অগ্রাধিকারের তালিকা কীভাবে পরিচালিত এবং প্রভাবিত করে’ (জাফরি, ২০০৬: ৪৭)। জাফরি আরও বিশ্বাস করেন যে অন্যান্য অঞ্চলের পূর্বেকার মুসলিম শাসকদের সঙ্গে তুলনা করলে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যত্যয় ছিল (জাফরি, ২০০৬: ৪৭)।

সুতরাং, মোগল শাসনামলে শিক্ষার বিস্তার সত্ত্বেও, শিক্ষার উপকরণসমূহে হালনাগাদ জ্ঞান, বিশেষত প্রযুক্তিগত জ্ঞান, প্রতিফলিত হতো না। এর প্রাথমিক কারণ ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ইউরোপীয় ভাষাগুলো শিক্ষা দিতে অসম্মত ছিল।

মোগল সাম্রাজ্যের প্রাথমিক দিনগুলোতে সবার জন্য শিক্ষার প্রসারে যে রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতার ধারা ছিল তা সময়ের বিবর্তনে পাল্টে যায় এবং মোগল আমলের শেষ দিকে তা সহধর্ম বিশ্বাসীদের প্রতি পৃষ্ঠপোষকতায় পরিবর্তিত হয়। ‘[ভারতীয়] ইতিহাসে সম্ভবত প্রথমবার, আমরা আকবরের মতো একজন মুসলিম শাসক দেখতে পাই, যিনি অকপটে হিন্দু এবং মুসলমান উভয়েরই শিক্ষা বিস্তারের বিষয়ে উদগ্রীব ছিলেন’ (ল, ১৯১৬: ১৬০)। আকবর মাদ্রাসাসহ নানান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন ও পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন, যেখানে হিন্দু ও মুসলমান শিক্ষার্থীরা একসঙ্গে শিক্ষা গ্রহণ করত। হিন্দু শিশু এবং যুবরা যাতে তাদের ধর্ম এবং সংস্কৃতি সম্পর্কে শিখতে পারে, সেটা নিশ্চিত করতে রাজসভা নিয়মানুগ নীতিমালা অনুসরণ করত। মুসলিম পণ্ডিতদের মতো হিন্দু পণ্ডিতেরাও প্রায় সমান রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেতেন। এই কাজগুলো আকবরের অন্য নীতিমালা এবং অন্য ধর্মের প্রতি তাঁর আচরণের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। যেমন হিন্দু তীর্থযাত্রীদের ওপর কর এবং জিজিয়া (অমুসলিমদের ওপর মাথাপিছু কর) মওকুফ। তিনি যেসব ইবাদতখানা (প্রার্থনার স্থান) নির্মাণ করেছিলেন সেগুলোতে বিভিন্ন ধর্মের পণ্ডিতদের মধ্যে বিতর্ককে তিনি উত্সাহিত করতেন। আকবর দ্বিন-ই-ইলাহি (ঐশ্বরিক বিশ্বাস) নামে একটি নতুন ধর্ম প্রচলনের চেষ্টা করেছিলেন এবং এর পেছনে আকবরের, অন্যান্যের মধ্যে, হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যকার বিদ্যমান পার্থক্য কমানোর ইচ্ছাও প্রতিফলিত হয়। (আকবরের ভূমিকা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে ব্যাভেরিজ [১৯৭৭] অনূদিত আবুল ফজলের তিন খণ্ডের আকবরনামা দেখুন)।

জাহাঙ্গীরের শাসনামলে পাঠ্যসূচির পরিবর্তন হয়, বিশেষত যুক্তিবাদী শিক্ষাক্রমের ওপর জোর দেওয়া চলতে থাকে, কিন্তু তা গোঁড়া ওলামাদের বাধার সম্মুখীন হয়েছিল। কিছু ওলামা, যেমন আকবরের শাসনামলে শাইখ আবদউল-হক মানকুলাত ঐতিহ্যের পুনর্জাগরণ ঘটানোর চেষ্টা করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে শাইখ আবদউল-হক ‘আকবরের রাজসভার অসংযত পরিবেশ থেকে বাঁচতে’ হিজাজে পালিয়ে গিয়েছিলেন (রবিনসন, ২০০১: ১৪)।

আকবর এবং জাহাঙ্গীরের বিপরীতে, আওরঙ্গজেবের শাসনামল মোগল সাম্রাজ্যের একটি কম সহিষ্ণু পর্বের প্রতিনিধিত্ব করে। আওরঙ্গজেব হিন্দুদের শিক্ষার বিষয়ে খুব একটা চিন্তিত ছিলেন না। ১৬৬৯ সালে তিনি হিন্দুদের বিদ্যালয় এবং মন্দির ধ্বংস করতে প্রাদেশিক গভর্নরদের আদেশ দিয়েছিলেন (ফারুকি, ১৯৩৫:১১৭; উদ্ধৃত হয়েছে, ইকরাম, ১৯৬৪: ১৯৯)। তিনি মুসলিম যুবকদের শিক্ষায় উত্সাহিত করতে এবং ইসলামিক শিক্ষা ছড়িয়ে দিতে সাগ্রহে চেষ্টা করেছিলেন (লেইন-পোল, ১৯৯০)। মুসলিম শিক্ষার্থীরা বৃত্তি হিসেবে রাজকীয় সাহায্য পেতেন। রাজা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে আর্থিক সাহায্য দিতেন এবং কোনো কোনো সময় প্রতিষ্ঠানকে স্থায়ীভাবে সাহায্য করার জন্য জায়গির দেওয়া হতো। আওরঙ্গজেব, যিনি তাঁকে তাঁর শিক্ষকদের প্রদত্ত শিক্ষা নিয়ে অসন্তুষ্ট ছিলেন, তাঁর শাসনামলে অসংখ্য মাদ্রাসা স্থাপন করেছিলেন (বার্নিয়ার, ১৯১৪: ১৫৬)।

আকবরের শাসনামলে সবচেয়ে তাত্পর্যপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল প্রাথমিক স্তরে শিক্ষাপদ্ধতির পরিবর্তন এবং মীর ফতেউল্লাহ সিরাজির পৃষ্ঠপোষকতায় পাঠ্যসূচির সংস্কার। প্রথম উল্লেখিত পরিবর্তনের লক্ষ্য ছিল মক্তবের শিক্ষায় নিছক মুখস্থের পরিবর্তে অনুশীলনের মাধ্যমে শেখার চর্চা চালু করা। আকবর, তাঁর আইন-ই-আকবরিতে (১৯০৭) একটি পদ্ধতির প্রস্তাব করেছিলেন, যেখানে বোঝার ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল: ‘শিক্ষার্থীর এমনভাবে যত্ন নিতে হবে, যাতে সে নিজেই সবকিছু বুঝতে পারে; তবে শিক্ষক তাকে (শিক্ষার্থীকে) কিছুটা সাহায্য করতে পারে’। মাদ্রাসা পাঠ্যসূচির সংস্কার প্রধানত মীর ফতেউল্লাহ সিরাজির অবদান ছিল। সিরাজি একজন পণ্ডিত ছিলেন, যিনি প্রাথমিকভাবে ১৫০০ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ইরানের সিরাজ শহর থেকে দক্ষিণাঞ্চলীয় এক মুসলিম সালতানাতে চলে এসেছিলেন। সংস্কারের পরে মাদ্রাসা পাঠ্যসূচিতে নীতিশাস্ত্র, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, কৃষি, ওষুধ, যুক্তিবিদ্যা এবং প্রশাসনের মতো বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। বৈয়াকরণ (ব্যাকরণ), বিদায়ন্ত (দর্শন)সহ সংস্কৃতের অধ্যয়ন এবং পতান্জালির (যোগশাস্ত্র) শিক্ষা দেওয়ারও পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল (ল, ১৯১৬: ১৬১-১৬২; সুফি, ১৯৪১: ৫৩)। অষ্টাদশ শতকের ঐতিহাসিক আলী আজাদ বিলগ্রামির ভাষ্যমতে, আকবরের রাজসভায় সিরাজির পৌঁছানোর পর ‘মাকুলাতের অধ্যয়ন বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল’ এবং ইকরামের মতে ‘আকবরের শাসনামলে “মানসিক বিজ্ঞানসমূহ”—যুক্তিবিদ্যা, দর্শন এবং দার্শনিক ধর্মতত্ত্ব—এক নতুন গুরুত্ব ধারণ করেছিল’ (বিলগ্রামি, উদ্ধৃত হয়েছে হুসেইন, ২০০৫: ২৫; ইকরাম, ১৯৬৪: ২৩৮)।

আকবর যে সমন্বয় প্রচেষ্টা এগিয়ে নিতে চেয়েছিলেন, আওরঙ্গজেবের আমলে এসে তা পিছু হটে; কারণ তিনি রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম ঐতিহ্যবাহী ইসলামিক রীতিনীতি অনুসারে করার চেষ্টা করেছিলেন এবং ‘উত্তরাধিকারের জন্য বিরোধের সময় তার লেখা কিছু চিঠিতে তিনি দাবি করেছিলেন যে তিনি যে কাজ করছেন তা “সত্য বিশ্বাস এবং রাজ্যের শান্তির জন্য”’ (ইকরাম, ১৯৬৪: ১৮৯)। তবে আওরঙ্গজেবের আমলের একটি ঘটনা যুক্তিবাদী বিজ্ঞান অধ্যয়নের ঐতিহ্যকে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল: লক্ষেৗতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে ফারাঙ্গি মহল স্থাপন।৬ যে ভবনে ফারাঙ্গি মহল অবস্থিত ছিল, তা ইতিপূর্বে এক ইউরোপীয় বণিকের মালিকানাধীন ছিল এবং আওরঙ্গজেব এই ভবনটি মোল্লা কুতুবুদ্দিন সিহালবির পরিবারকে দান করেছিলেন। সিহালবি ছিলেন যুক্তিবাদী বিজ্ঞানের এক অগ্রগণ্য পণ্ডিত এবং অনেক বিষয়ে রাজসভা তাঁর কাছ থেকে পরামর্শ গ্রহণ করত। ভূমিসংক্রান্ত দ্বন্দ্ব্বে ১৭০০ শতকের শেষের দিকে তাঁর মৃত্যু হলে রাজা এই ভবনটি সিহালবির পরিবারকে দান করেন। সিহালবির তৃতীয় পুত্র মোল্লা নিজামুদ্দিন সিহালবি ১৮০০ শতকের শুরুর দিকে এই স্থানটিকে একটি শিক্ষাকেন্দ্রে পরিণত করেছিলেন। মোল্লা নিজামুদ্দিন একটি পাঠ্যসূচির গোড়াপত্তন করেছিলেন, যা পরবর্তী সময়ে দারসে-নিজামি নাম ধারণ করেছিল। এই পাঠ্যসূচি যুক্তিবাদী বিজ্ঞানসমূহকে শিক্ষার মূল বিষয়ে পরিণত করেছিল। রবিনসন দারসে-নিজামির মূল বৈশিষ্ট্যগুলোর ওপর জোর দিয়ে বলেন:

নিছক মুখস্থ করে শেখার চেয়ে শিক্ষার্থীদের চিন্তা করতে উত্সাহিত করার মাধ্যমে এই পাঠ্যসূচি তাঁদের মাদ্রাসার সাধারণ শিক্ষা আরও দ্রুতগতিতে শেষ করতে সক্ষম করেছিল। একই সঙ্গে তাঁরা কোনো সমস্যার মূলে পৌঁছান, যুক্তি প্রদর্শন এবং আইনশাস্ত্র ব্যবহারে নমনীয়তার জন্য খ্যাতি লাভ করেছিলেন (রবিনসন, ২০০১: ১৪-১৫)।

দুটি বিষয় এখানে উল্লেখযোগ্য। প্রথমত, ফারাঙ্গি মহল কোনো সংগঠিত মাদ্রাসা ছিল না (১৯০৫ সাল পর্যন্ত), বরং ফারাঙ্গি মহল পরিবারের সদস্যরা তাঁদের কাছে যেসব শিক্ষার্থী আসত তাদের নিজেদের ঘরেই শিক্ষা দিতেন (রবিনসন, ২০০১: ৭১)। দ্বিতীয়ত, পাঠ্যক্রম থেকে প্রকাশিত জ্ঞান, মানকুলাত, বাদ পড়ে যায়নি, কিন্তু ‘পাঠ্যসূচির ধর্মীয় অংশটি ক্লাসিক্যাল টেক্সটের সমন্বয়ে গঠিত ছিল’ (নায়ার, ২০০৩: ২২৩)।

আওরঙ্গজেবের প্রকাশ্যে গোঁড়া ইসলাম অনুকরণকে বিবেচনায় নিলে, ফারাঙ্গি মহল স্থাপনে তাঁর সমর্থন, বলতে গেলে, কৌতূহলের বিষয়ই বটে। একই রকম উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, আওয়াধের নবাবদের ভূমিকা; যারা ফারাঙ্গি মহলের অস্তিত্ব বজায় রাখা এবং দারসে-নিজামি পাঠ্যসূচি গৃহীত হওয়া সম্ভবপর করে তুলেছিল। এটা মনে রাখা ভালো যে নবাবরা শিয়া ছিলেন। এটাও অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে মাদ্রাসাগুলোতে প্রাণ সঞ্চারে আওরঙ্গজেবের প্রাথমিক সহযোগিতা কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছিল এবং যেসব শিক্ষার্থী ফারাঙ্গি মহলে পড়তে আসত, তাদের থাকার খরচ মোগল শাসকেরাই বহন করতেন।

১৮০০ শতকের প্রথম নাগাদ ফারাঙ্গি মহল ভারতের অন্যতম বড় শিক্ষাকেন্দ্রে পরিণত হয় এবং লক্ষেৗর বাইরে থেকেও অনেক শিক্ষার্থী সেখানে পড়াশোনা করতে আসত। গোটা ১৮০০ শতক এবং ১৯০০ শতকের প্রথম ভাগে ফারাঙ্গি মহল থেকে শুরু হওয়া যুক্তিবাদী ঐতিহ্য বিস্তৃতি লাভ করে এবং দারসে-নিজামি মাদ্রাসাশিক্ষার কার্যত আদর্শ পাঠ্যসূচিতে পরিণত হয়। শুরু থেকেই নিজামি পাঠ্যসূচির ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতার দুটি কারণ ছিল: প্রথমত, এটা শিক্ষার্থীদের চাকরি পেতে, বিশেষত সরকারি চাকরি পেতে সক্ষম করেছিল। ‘এটা [দারসে-নিজামি] যে দক্ষতাগুলো শিক্ষা দিত সেগুলোর, ১৭০০ এবং ১৮০০ শতকে ভারতের ক্রমবর্ধমান বাস্তবধর্মী ও জটিল আমলাতন্ত্রে চাহিদা ছিল’; দ্বিতীয়ত, ফারাঙ্গি মহল পরিবারের সদস্যরা গোটা ভারত ‘রাজসভা থেকে রাজসভায়, এক পৃষ্ঠপোষকের কাছ থেকে অন্য পৃষ্ঠপোষকের কাছে শিক্ষাদানের সুযোগের খোঁজে’ ভ্রমণ করতেন এবং নিজেদের শিক্ষাদানে নিয়োজিত রাখতেন। এভাবেই দ্রুতগতিতে শিক্ষার্থীসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল (রবিনসন, ২০০১: ৫৩, ২৩)।৭

মোগল সাম্রাজ্যের পরবর্তী দিনগুলোতে যুক্তিবাদী বিজ্ঞান অধ্যয়নের জনপ্রিয়তা ক্ষয় হতে শুরু করে এবং ১৮০০ শতকে মানকুলাত ঐতিহ্য—যে ঐতিহ্যে প্রেরিত বিজ্ঞানের ওপর জোর দেওয়া হয়—যুক্তিবাদী বিজ্ঞানের জায়গা দখল করা শুরু করে। এটা অনেকাংশে শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভির (১৭০৩-১৭৬২) চিন্তা এবং তিনি যেখানে ১২ বছরেরও বেশি সময় শিক্ষা দিয়েছিলেন, সেই মাদ্রাসা-ই-রাহিমিয়ার ভূমিকার ফলে সম্ভব হয়েছিল।৮ তবে মাদ্রাসাটি দৃষ্টি আকর্ষণ করে, যখন শাহ ওয়ালিউল্লাহর ছেলে শাহ আবদ আল-আজিজ (১৭৪৬-১৮২৩) এর প্রধান হন।

১৭১৯ সালে বাবার মৃত্যুর পর, ১৭ বছর বয়সে শাহ ওয়ালিউল্লাহ মাদ্রাসার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। অতি অল্প বয়সে নিজের পাণ্ডিত্যের পরিচয় দেওয়ার কারণেই, শাহ ওয়ালিউল্লাহ জীবনের এই পর্যায়ে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান হতে পেরেছিলেন। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পর, ওয়ালিউল্লাহ তাঁর বাবার কাছ থেকে যুক্তিবিদ্যা, ফিকাহ, হাদিস, তিব (পূর্বাঞ্চলীয় চিকিত্সাবিজ্ঞান), বীজগণিত, গণিত এবং বাগ্মিতার জ্ঞান নিয়েছিলেন (শাহ ওয়ালিউল্লাহর জীবন এবং কাজ সম্পর্কে জানতে দেখুন, জালবানি [১৯৬৭], রিজভি [১৯৮০] এবং গাজী [২০০৪]। সংক্ষিপ্ত বর্ণনার জন্য দেখুন, মেটকাফ [১৯৮২: ৩৫-৪৩])। ১২ বছর শিক্ষকতা করার পর ১৭৩১ সালে তিনি আরবে গিয়েছিলেন; সেখানে তিনি আড়াই বছর অবস্থান করেন এবং মদিনার হাদিসবিষয়ক পণ্ডিত মুহাম্মদ হায়া আল-সিন্ধির (মৃত্যু ১৭৫০) অধীনে অধ্যয়ন করেন।৯ ভারতে ফিরে আসার পর, লেখালেখিতে আত্মনিয়োগ করার আগে তিনি মাদ্রাসা-ই-রাহিমিয়াতে তিন বছর শিক্ষকতা করেছিলেন।

শাহ ওয়ালিউল্লাহ মাদ্রাসা-ই-রাহিমিয়ার সৃষ্ট একজন মানুষ ছিলেন, কিন্তু তাঁর ধারণা অনুসারেই মাদ্রাসার পাঠ্যসূচি গঠিত হয়েছিল। তিনি তাঁর সমকালীন এবং তারপরের মুসলিম জ্ঞানসাধনায় স্থায়ী প্রভাব ফেলেছিলেন। তিনি অল্প কয়েকজন পণ্ডিতদের মধ্যে একজন, যাঁর ধারণাসমূহ এখনো ইসলামিক কর্মী এবং পণ্ডিতদের মধ্যকার বিতর্কের বিষয়। ওয়ালিউল্লাহর ভাবনার প্রাথমিক বিষয় ছিল সে সময়কার মুসলমানের নৈতিক এবং রাজনৈতিক অধঃপতন। ওয়ালিউল্লাহ আওরঙ্গজেবের পর মোগল সাম্রাজ্যের বিভেদ, ছোট রাজ্যগুলোর উত্থান, নাদির শাহর আক্রমণ (১৭৩৯) এবং মুসলমানদের মধ্যে ধর্মপরায়ণতার অভাবকে মুসলিম সম্প্রদায়ের সংকট হিসেবে দেখেছিলেন এবং এ অধঃপতনের কারণগুলো ব্যাখ্যা করেছিলেন। তিনি আইনশাস্ত্র, সুফিজম, হাদিস গবেষণা এবং ওলামা ও রাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্কের মতো বিষয়সহ অন্য আরও অনেক বিষয়ের ওপর বিস্তৃতভাবে লেখালেখি করেছিলেন (দাল্লাল, ১৯৯৩)। তিনি ফার্সিতে কোরআনের অনুবাদও করেছিলেন। ওয়ালিউল্লাহ হাদিস গবেষণার ওপর জোর প্রদান, মাকুলাতকে সম্পূর্ণ অস্বীকৃতি, ওলামাদের ওপর গ্রিক দার্শনিকদের প্রভাবের এবং মুসলমানদের স্থানীয় প্রথাগুলোকে বিদাত (অবৈধ প্রবর্তন) হিসেবে সমালোচনা, তাঁর অনুসারীদের মধ্যে এবং মাদ্রাসা-ই-রাহিমিয়াতে প্রকাশিত বিজ্ঞানসমূহের অধ্যয়নকে জোরদার করেছিলেন। এসব কাজের গুরুদায়িত্ব ছিল তাঁর ছেলে আবদ আল-আজিজের ওপর, যিনি ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতকে দারুল হরব (যুদ্ধকবলিত স্থান) ঘোষণা করেছিলেন।

ফলে, মোগল শাসনামলের শেষ নাগাদ মাদ্রাসাশিক্ষার পাঠ্যসূচিতে মানকুলাত ঐতিহ্য তার প্রভাবশালী অবস্থান আবার ফিরে পেয়েছিল। এটা বলা হচ্ছে না যে তত দিনে মাকুলাত ঐতিহ্য বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল, কারণ তখনো ফারাঙ্গি মহল চালু ছিল এবং বিভিন্ন মাদ্রাসায় দারসে-নিজামি পাঠ্যসূচির বিভিন্ন সংস্করণ অনুসরণ করা হতো। তবে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে শাহ ওয়ালিউল্লাহর ধারণাসমূহের অনুসারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছিল। যা হোক, এটা স্বীকার করা প্রয়োজন যে মোগল আমলে মাদ্রাসাগুলো এবং ওলামারা প্রকাশিত ধারার জ্ঞানের অধ্যয়নে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলেন; ‘তাদের অবদান এমনকি মুসলিম বিশ্বেও গুরুত্বপূর্ণ’ (জাফরি, ২০০৬: ৫১)।

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে মাদ্রাসা

ঔপনিবেশিক প্রশাসনের শিক্ষানীতি, মোগল সাম্রাজ্যের পতনের পর পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক কাঠামোয় নিজেদের অবস্থান নির্ণয়ে মুসলমানদের প্রচেষ্টা এবং ভারতে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে পরিচয়ের রাজনীতির উত্থান, ঔপনিবেশিক ভারতে মাদ্রাসাগুলোর প্রকৃতি, প্রসার এবং ভূমিকাকে গুরুত্বপূর্ণভাবে প্রভাবিত করেছিল। ফলে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ভারতে মাদ্রাসার ইতিহাস তত্কালীন ভারতের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি; বিশেষত ঊনবিংশ শতকের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল এবং তা অবশ্যই ওপরে উল্লেখিত তিনটি ফ্যাক্টরকে বিবেচনায় রেখে আলোচিত হতে হবে।

পলাশীর যুদ্ধের নয় বছর পর, এ যুদ্ধে রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে ইংরেজ বাহিনীর হাতে বাংলার নবাব পরাজিত হয়েছিলেন এবং ভারতে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের সূচনা হয়েছিল, ১৭৬৫ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার রাজনৈতিক ক্ষমতা গ্রহণ করেছিল।১০ ১৭০৭ সালে আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর, দিল্লিকেন্দ্রিক মোগল সাম্রাজ্য চরম অধঃপতনের মুখে পড়েছিল এবং রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বস্তুত অকার্যকর হয়ে গিয়েছিল। পরিণতিতে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নীতিগত পদক্ষেপগুলো, প্রাথমিকভাবে যা ভারতের পূর্বাংশের (বাংলা, বিহার এবং ওডিশা) জন্য কার্যকর ছিল, ভবিষ্যতে গোটা ভারত শাসন করার বুনিয়াদ নির্মাণ করেছিল।

যদিও ১৮১৩ সালের চার্টার অ্যাক্টের মাধ্যমে শিক্ষাক্ষেত্রে ঔপনিবেশিক প্রশাসনের সরাসরি এবং প্রলম্বিত হস্তক্ষেপ শুরু হয়, তবে তা রীতিমতো বিতর্কের পর এবং অন্য অনেক পদক্ষেপের ফলে সম্ভব হয়েছিল। শাসনভার গ্রহণের প্রাথমিক দিনগুলোতে কোম্পানি শিক্ষা খাতের সঙ্গে নিজেদের দূরত্ব বজায় রেখেছিল। এর ফলে রাষ্ট্রীয় সংশ্লিষ্টতার বাইরে সামাজিক পৃষ্ঠপোষকতায় এবং সরাসরি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় মোগল আমলে পাঠশালা, মক্তব বা মাদ্রাসার মতো যেসব ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়েছিল, সেগুলো কাজ চালিয়ে নিয়ে যেতে পারছিল। নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালুর উদ্যোগও নেওয়া হয়েছিল। এ উদ্যোগগুলো প্রধানত খ্রিষ্টান মিশনারিরা নিতেন। উদাহরণস্বরূপ, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সমীহ জাগানো রাজনৈতিক সত্তায় পরিণত হওয়ার আগেই, ১৭০২ সালে কলকাতায় প্রথম মিশনারি বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়। পলাশীর যুদ্ধের পরপরই রবার্ট ক্লাইভ কলকাতায় স্কুল খোলার জন্য মাদ্রাজের এক মিশনারি কর্মীকে আমন্ত্রণ জানান। ১৭৫৯ সালে, দ্বিতীয় বছরে স্কুলটিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৭৪ জনে, যেখানে প্রথম বছর এই স্কুলের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৪৮ জন (ইসলাম, ২০০২: ২৭)।

যা হোক, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মিশনারি কর্মকাণ্ডের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখত, ধর্মান্তরিতকরণের বিরোধিতা করত এবং কোম্পানি নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের মধ্যেই মিশনারি কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ রেখেছিল (আলি, ১৯৬৫; লেয়ার্ড, ১৯৭২)। মিশনারি কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে কোম্পানির অনুমতি নেওয়া প্রয়োজন হতো এবং একই সঙ্গে নানা পন্থায় কোম্পানি মিশনারি কর্মকাণ্ডকে নিরুত্সাহিতও করত। এই নীতি অবশ্যই স্বেচ্ছাপ্রণোদিত ছিল:

ধর্মীয় বিশ্বাসে অনধিকারচর্চা ভারতীয় প্রজাদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে—এই ভয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তার প্রজা এবং ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের কাছে এটা পরিষ্কার করেছিল যে বিদ্যমান ধর্মীয় বিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ বা খাটো করতে কোম্পানি ভারতে আসেনি (শেঠ, ২০০৭: ২৭-২৮)।

তা সত্ত্বেও, পরবর্তী বছরগুলোতে মিশনারিরা শিক্ষানীতিকে প্রভাবিত করেছিল, বিশেষত শিক্ষাদানের মাধ্যম বিষয়ে। উপরন্তু, মিশনারিদের উপস্থিতি এবং কর্মকাণ্ড হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছিল এবং সংস্কার আন্দোলনগুলোকে ত্বরান্বিত করেছিল।

কোম্পানির ধর্মীয়ভাবে নিরপেক্ষ থাকার ঘোষণা সত্ত্বেও, শিক্ষাক্ষেত্রে কোম্পানি সরাসরি সম্পৃক্ত হয় ১৭৮০ সালে ওয়ারেন হেস্টিংসের, বাংলার গভর্নর জেনারেল, পৃষ্ঠপোষকতায় কলকাতায় মাদ্রাসা স্থাপনের মধ্য দিয়ে। মাদ্রাসা স্থাপনের পেছনে যৌক্তিকতা বর্ণনা করে হেস্টিংসের দেওয়া বিবৃতিতে দেখা যায় যে এই সিদ্ধান্তের পেছনে রাজনৈতিক বিবেচনা চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছিল। মাদ্রাসাটি স্থাপন করা হয়েছিল কলকাতার মুসলমানদের সন্তুষ্ট করতে...মুসলমান ভদ্রলোকদের ছেলেদের রাষ্ট্রীয় দায়িত্বপূর্ণ এবং আকর্ষণীয় চাকরির জন্য যোগ্য করে গড়ে তুলতে এবং কোর্ট অব জাস্টিসের জন্য দক্ষ কর্মকর্তা তৈরি করতে, যেখানে পদ খালি হলে যোগ্যতার সনদপত্র আছে এ রকম মাদ্রাসার ছাত্রদের নিয়োগ দেওয়া হবে (উদ্ধৃত হয়েছে, নায়েক এবং নুরুল্লাহ, ২০০০: ৩০)।

হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্য আলাদা আইন প্রয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১৭৭২ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস এবং উইলিয়াম জোনস ‘মুসলমানদের জন্য কোরআনের আইন এবং হিন্দুদের জন্য শাস্ত্রের আইন’ প্রয়োগ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন (উদ্ধৃত হয়েছে, রুডলফ এবং রুডলফ, ২০০১: ৩৩-৩৬)।

কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় পাঠ্যসূচি হিসেবে দারসে-নিজামি গৃহীত হয় এবং ১৭৯০ সাল পর্যন্ত তা অনুসরণ করা হয়। কলকাতা মাদ্রাসার দারসে-নিজামি অনুসরণ করা ১৮০০ শতকে ফারাঙ্গি মহল কর্তৃক সূচিত এই পাঠ্যক্রমের উপযোগবাদিতারই নজির। তবে, ১৭৯১ সালে প্রথম প্রিন্সিপালের বরখাস্তের পর পাঠ্যসূচিতে পরিবর্তন আসে। কোম্পানি ১৭৯১ সালে বেনারসে সংস্কৃত কলেজ এবং ১৮০০ সালে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ স্থাপনেও সহায়তা করে। এই পদক্ষেপগুলো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রাতিষ্ঠানিক অবশ্যপালনীয় শর্ত ছিল না।

১৮১৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নবায়িত চার্টারে ভারতীয় প্রজাদের শিক্ষার দায়িত্ব অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই চার্টারে শর্ত রাখা হয় যে দেশজ ভাষাগুলোকে প্রতিস্থাপিত না করেও, ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় ইংরেজি শিক্ষা দেওয়া যেতে পারে। আশা করা হয়েছিল যে ইংরেজি নৈতিক আইনকে জোরদার করার পথ হিসেবে প্রাচ্যবিদ্যার সঙ্গে সহাবস্থানে থাকতে পারবে। ইংরেজির এই অন্তর্ভুক্তি ছিল চার্লস গ্রান্টের ১৭৯২ সালে করা একটি গবেষণার ফল। গবেষণাটির শিরোনাম ছিল: ‘গ্রেট ব্রিটেনের এশিয়া মহাদেশীয় প্রজাদের মধ্যে সামাজিক অবস্থার পর্যবেক্ষণ, বিশেষত নৈতিকতার নিরিখে এবং এটির উন্নয়নের উপায়সমূহ’ (১৭৯৩ সালে প্রকাশিত)। তাঁর প্রতিবেদনে গ্রান্ট জোর দিয়ে বলেছিলেন যে ভারত অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে এবং তাদের দুর্দশার জন্য হিন্দুরাই (এর দ্বারা তিনি ভারতীয়দের বুঝিয়েছিলেন) দায়ী। গ্রান্টের মতে, ‘আমাদের আলো এবং জ্ঞান প্রদানই তদের বিশৃঙ্খলা নিরাময়ের সবচেয়ে ভালো পথ প্রমাণিত হতে পারে’ (উদ্ধৃত হয়েছে, ম্যাককুলি, ১৯৬৬: ১১)। ‘আলো’ দ্বারা গ্রান্ট খ্রিষ্টধর্ম এবং ‘জ্ঞান’ দ্বারা ইংরেজিকে বুঝিয়েছিলেন। ফলে, তাঁর পরামর্শগুলো ছিল শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি ভাষার প্রচলন; স্থানীয় এলিটদের শিক্ষার জন্য বিদ্যালয় স্থাপন করা, এই এলিটরাই পরবর্তী সময়ে সাধারণ মানুষের মাঝে শিক্ষা ছড়িয়ে দিতে পারবে এবং প্রাতিষ্ঠানিক ভাষা হিসেবে ফার্সির পরিবর্তে ইংরেজির প্রচলন (গার্গ, ২০০৩)।

যদিও কোম্পানির ভারতীয় প্রজাদের শিক্ষা প্রদানের দায়িত্ব ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বোর্ড অব ডিরেক্টরস গ্রহণ করেছিল, তবে তারা গ্রান্টের প্রস্তাবগুলো গ্রহণ করেনি। তবে ১৮৫৪ সালে গ্রান্টের প্রস্তাবসমূহের একটি উপাদান, ‘নিম্নমুখী পরিস্রবণ’ তত্ত্ব, গ্রহণ করা হয় এবং ক্রমাগত অনুসরণ করা হয়। কলকাতায় ১৮১৭ সালে হিন্দু কলেজ এবং ১৮২৪ সালে সংস্কৃত কলেজ স্থাপনের উত্সাহে পরিস্রাবণ নীতি প্রতিফলিত হয়। দুটি কলেজই এলিট শ্রেণির সন্তানদের আকর্ষণ এবং অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষার জন্য স্থাপন করা হয়েছিল। ১৮২৪ সালে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় একটি ইংরেজি কোর্স চালুর সিদ্ধান্ত (যা ১৮২৬ সালে বাস্তবায়ন করা হয়) বিদ্যালয়গুলোতে ইংরেজি চালু করার পথে প্রশাসনের ধীর পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়। ১৮৫১ সাল পর্যন্ত কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় একটি ইংরেজি কোর্স পড়ানো হতো।

পরিশেষে ১৮৩৫ সালে চার্লস গ্রান্টের প্রস্তাবসমূহ বাস্তবে পরিণত হয় এবং এর পেছনে থমাস ম্যাকলের ‘এডুকেশন মিনিট’র অবদান অনস্বীকার্য। তবে অবশ্যই এডুকেশন মিনিট ছিল অ্যাংলিসিস্ট এবং ওরিয়েন্টালিস্টদের বৃহত্তর বিরোধের একটি ফল এবং এতে ওরিয়েন্টালিস্টরা জয়ী হয়েছিল (এই বিরোধ সম্পর্কে জানতে দেখুন, জাস্টোপিল এবং ময়ার, ১৯৯৯)। এই বিতর্কের কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল: শিক্ষাব্যবস্থা (স্থানীয় বনাম পশ্চিমা) এবং শিক্ষার মাধ্যম (স্থানীয় ভাষা বনাম ইংরেজি)। মিনিটে পশ্চিমা শিক্ষা এবং ইংরেজিকে সমর্থন করা হয়েছিল। শিক্ষা বিষয়ে প্রশাসনের উদ্দেশ্যসমূহ স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছিল:

এখন আমাদের অবশ্যই একটি শ্রেণি তৈরি করার জন্য সর্বোচ্চ কাজ করতে হবে, যারা আমাদের এবং আমরা যে কয়েক মিলিয়ন মানুষকে শাসন করি তাদের মাঝে ব্যাখ্যাকার হিসেবে কাজ করতে পারবে; এমন ব্যক্তিদের একটি শ্রেণি, যারা রক্তে-বর্ণে ভারতীয়, কিন্তু রুচি, মতামত, নৈতিকতা এবং প্রজ্ঞায় ইংরেজ (ম্যাকলে, মিনিট অব এডুকেশন, ১৮৩৫: ১৪)।

গভর্নর জেনারেল উইলিয়াম বেন্টিংক এই মিনিট তত্ক্ষণাত্ অনুমোদন করেছিলেন, এর ফলে ১৮৩৫ সাল ভারতে শিক্ষার ইতিহাসে সন্ধিক্ষণে পরিণত হয়।১১ এই নীতি গ্রহণের তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে মাদ্রাসা এবং অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা রহিত করা হয়।

তবে সবচেয়ে জোরালো আঘাত আসে ১৮৩৫ সালে, যখন দাপ্তরিক এবং উচ্চ আদালতের ব্যবহারিক ভাষা হিসেবে ফার্সির পরিবর্তে ইংরেজির প্রচলন হয়। ১৮৩৭ সালে নিম্ন আদালতের ভাষা হিসেবে আঞ্চলিক ভাষাগুলোর ব্যবহার শুরু হয়। এই দুটি সিদ্ধান্ত মাদ্রাসায় ফার্সিতে শিক্ষাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা কমিয়ে দিয়েছিল। ১৮৪৪ সালে গভর্নর জেনারেল হেনরি হার্ডিঞ্জ ঘোষণা করেন যে শুধু যেসব ব্যক্তি পশ্চিমা ঢঙের শিক্ষা এবং ইংরেজির জ্ঞান রাখেন, তাঁরাই সরকারি চাকরি বা জনজীবনে পেশা নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত হবেন। ফলে তাত্ক্ষণিকভাবেই ফার্সির উপযোগিতা এবং মাদ্রাসা-শিক্ষিত তরুণদের কাজ পাওয়ার সুযোগ শূন্যের কোটায় নেমে আসে। সাধারণ মানুষের কথা বাদ দিলেও এলিটদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারে স্বল্প সফলতার কারণে ১৮৫০-এর দশকে পরিস্রবণ নীতি পুনর্নিরীক্ষণের সম্মুখীন হয় এবং একটি পরিবর্তন সূচিত হয়। ১৮৫৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চার্টার নবায়নের পর, ব্রিটিশ সংসদ ভারতীয় শিক্ষার অবস্থা যাচাই করতে একটি তদন্তের ব্যবস্থা করেছিল, এ রকম তদন্তের মধ্যে এটি ছিল সর্বপ্রথম। ফলে ১৮৫৪ সালে উডের ডিসপ্যাচ প্রকাশিত হয়। এটির নামকরণ হয়েছিল ভারতের বোর্ড অব কন্ট্রোলের প্রেসিডেন্ট চার্লস উডের নামে। উডের ডিসপ্যাচে শিক্ষাক্ষেত্রে সীমিত সফলতায় হতাশা প্রকাশ করা হয়েছিল এবং প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষার জন্য একটি পরিকল্পনা প্রস্তাব করা হয়েছিল। প্রস্তাবিত পরিকল্পনায় পরিস্রাবণ নীতি রহিত করার প্রস্তাব করা হয়, সরকারকে সর্বস্তরে শিক্ষার দায়িত্ব নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয় এবং বেসরকারি বিদ্যালয়গুলোকে অনুদান প্রদানের মাধ্যমে দেশজ বিদ্যালয়গুলোকে পশ্চিমা ঢঙের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করার প্রস্তাব করা হয়। দ্রুততার সঙ্গে এসব পরামর্শ বাস্তবায়ন করা হয়েছিল এবং এসব পদক্ষেপ ভারতের শিক্ষা খাতের চেহারা পাল্টে দিয়েছিল। শিক্ষার পশ্চিমাকরণ ‘সরকারের পদক্ষেপের’ পরিবর্তে ‘জনসাধারণের কার্যক্রমে’ রূপ নেয়, ইংরেজি শিক্ষার বিস্তার ঘটে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাঠামোর পরিবর্তন ঘটে। এসব পরিবর্তনের ফলে গতানুগতিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো, বিশেষত মাদ্রাসাগুলো, প্রান্তিক হয়ে পড়ে। কারণ অনুদান পাওয়ার শর্তগুলো ছিল গণিত, বিজ্ঞান এবং ভাষাকেন্দ্রিক পাঠ্যসূচি গ্রহণ করতে হবে। ধর্মবিষয়ক সব আলোচনা একটি পৃথক ‘ধর্ম’ ক্লাসে সরিয়ে নিতে হবে। শিক্ষকদের আনুষ্ঠানিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ নেওয়ারও শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়। এর ফলে শিক্ষক পেশাটি স্থানীয় সম্মানিত ব্যক্তিদের হাত থেকে, এরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধর্মীয় পণ্ডিত ছিলেন এবং শিক্ষকতা তাঁদের প্রাথমিক পেশা ছিল না, ধীরে ধীরে পেশাদার সার্বক্ষণিক শিক্ষকদের হাতে চলে যায় এবং এসব পেশাদার শিক্ষকের ঔপনিবেশিক কর্তৃপক্ষের দেওয়া শিক্ষক প্রশিক্ষণ সনদ ছিল (ল্যাঙ্গর, ২০০৫: ১৬২)।

প্রাথমিক বছরগুলোতে অনুদানের সিংহভাগই পেত মিশনারি বিদ্যালয়গুলো, যা মাদ্রাসাগুলোর জন্য আরেক ধরনের হুমকি ছিল। এর প্রভাব গতানুগতিক সেক্যুলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যেমন বাংলার পাঠশালাগুলোতেও অনুভূত হয়েছিল। এটা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ কারণ মিশনারি স্কুলগুলো সেক্যুলার প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছিল। এটা এখন চমত্কারভাবে নথিভুক্ত যে মিশনারি কর্মীরা গভীরভাবে বিশ্বাস করত ‘কম বয়সী ছেলেমেয়েদের ধর্মান্তরিত হতে প্রস্তুত করতে শিক্ষা অবদান রাখতে পারে’ (শেঠ, ২০০৭: ৩০)। অন্য কথায় মিশনারিদের জন্য শিক্ষা ছিল প্রিপারেশিও ইভানজেলিকা (শসপেলের জন্য প্রস্তুতি)।

ইংরেজি শিক্ষার সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রশাসনের শিক্ষানীতির ওপর মিশনারিদের প্রভাবের পরিচায়ক। চার্চ অব স্কটল্যান্ডের আলেকজেন্ডার ডাফ শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি প্রচলনের ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন এবং নিছক মুখস্থ করার সমালোচক ছিলেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত স্কুল পরবর্তী সময়ে স্কটিশ চার্চ কলেজে পরিণত হয় এবং অন্যান্য মিশনারি স্কুলের জন্য আদর্শ হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে। স্কুলটি ১৮৩৫ সালে ইংরেজি মাধ্যমে পশ্চিমা শিক্ষায় রাষ্ট্রীয় তহবিল বরাদ্দের সিদ্ধান্তেও প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করেছিল।

দীর্ঘমেয়াদে ঔপনিবেশিক প্রশাসনের শিক্ষানীতি, বিশেষত প্রশাসনের পশ্চিমা শিক্ষার (সেক্যুলার শিক্ষা হিসেবে লেবেল লাগানো) ওপর জোর দেওয়া দুটি উপায়ে প্রভাব বিস্তার করেছিল। প্রথমত, এটা শিক্ষাকে দুটি বর্গে ভাগ করে—সেক্যুলার এবং ধর্মীয়। যোগিন্দার সিকান্দ যথাযথভাবে যেমনটা বলেছেন, শিক্ষার দ্বিখণ্ডনের ওপর জোর দেওয়ার মাধ্যমে ধর্মকে ব্যক্তিপরিমণ্ডলে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল এবং ধর্মকে ‘জীবন এবং কর্মের স্বতন্ত্র পরিমণ্ডল হিসেবে, যা অন্যান্য একই ধরনের সংজ্ঞায়িত পরিমণ্ডলগুলো থেকে স্পষ্টভাবে স্বতন্ত্র বা বিচ্ছেদযোগ্য’ চিহ্নিত করেছিল (সিকান্দ, ২০০৫: ৬৫)। ফলে সাধারণ শিক্ষার বিপরীতে মাদ্রাসাকে ধর্মীয় শিক্ষা প্রদানের ভূমিকায় অবতীর্ণ করা হয়েছিল। এই দ্বিখণ্ডায়নকে, ধর্মীয় বনাম সেক্যুলার, ঐশ্বরিক বনাম ইহজাগতিক হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল এবং ওলামাদের জ্ঞানভাষ্যে এটাকে দ্বীনের শিক্ষা (ধর্মীয়/ঐশ্বরিক) এবং দুনিয়ার শিক্ষা (ক্ষণস্থায়ী) হিসেবে অনূদিত হয়েছিল। মজার বিষয় হচ্ছে, ঔপনিবেশিক প্রশাসন এবং ওলামারা উভয়ই এই বিষয়গুলোর মধ্যে মূলত আলোকায়ন-উত্তর কঠোর কম্পার্টমেন্টালাইজেশন (কুঠরিবদ্ধকরণ) অ্যাপ্রোচ ব্যবহার করেছিল, যদিও বিষয়গুলোর গুরুত্ব পরস্পরের কাছে ঠিক বিপরীত ছিল। কিন্তু ওলামাদের কাছে এটি উপনিবেশবাদ প্রতিরোধের একটি প্রক্রিয়াও ছিল: ‘দ্বীনদুনিয়া পার্থক্যকে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের একটি রূপ হিসেবে ব্যাখ্যা করা উচিত, যা “অভ্যন্তরীণ বিশ্বকে” পশ্চিমা অনধিকার প্রবেশ থেকে রক্ষার একটি প্রচেষ্টা’ (হাসান, ২০০৬: ৬১)। অভ্যন্তরীণ বিশ্বকে রক্ষার এই প্রচেষ্টার ভিত্তি ছিল এর শ্রেষ্ঠত্ব, সার্বভৌমত্ব এবং জীবনে এর মুখ্যতার বিষয়ে উপলব্ধি। দক্ষিণ এশিয়ায় আজ পর্যন্ত এই মনোভাব অপরিবর্তিত রয়েছে।

দ্বিতীয় প্রভাব হচ্ছে ধর্মীয়-রাজনৈতিক সক্রিয়তার জন্য একটি নতুন সামাজিক পরিমণ্ডল তৈরি করা। ধর্মীয় শিক্ষার প্রান্তিকীকরণ এবং বিদ্যালয়ে প্রকাশ্য ধর্মীয় টেক্সটের অবলুপ্তি, তাদের নিজেদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে নতুন জনসাধারণের কাছে পৌঁছাতে ধর্মীয় আন্দোলনগুলোর সামনে একটি পরিমণ্ডল তৈরি করেছিল। ঊনবিংশ শতকে মুসলিম সম্প্রদায়ের পরিচয়ের রাজনীতিতে মাদ্রাসাগুলো এই ভূমিকা পালন করেছিল।

মোগল সাম্রাজ্যের বিখণ্ডায়ন নিয়ে মুসলিম সম্প্রদায়ের একদল যখন বিলাপ করা শুরু করে এবং পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যখন নিজেদের অবস্থান নির্ণয়ের চেষ্টা করছিল, তখনই ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে পরিচয়ের প্রশ্নটি ভারতে একটি স্বতন্ত্র আলোচ্য বিষয়ে রূপ নেয়। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের ব্যর্থতার ফলে মুসলিম সম্প্রদায়ের জ্ঞানভাষ্যে (ডিসকোর্স) প্রাধান্য বিস্তার করলেও, এই প্রক্রিয়া অনেকাংশে শাহ ওয়ালিউল্লাহর বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্যে শুরু হয়েছিল। যাঁরা শাহ ওয়ালিউল্লাহর কার্যপদ্ধতির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করতেন এবং এমনকি যাঁরা বিষয়টিকে সম্পূর্ণ ভিন্ন অবস্থান থেকে ব্যাখ্যা করতেন, তাঁদের সবারই সাধারণ এবং সহজ প্রশ্ন ছিল: কেন ইসলামিক শাসনের পতন হয়েছে? ‘ইসলামের হারানো গৌরব’ কীভাবে ফিরে পাওয়া যাবে? এসব প্রশ্ন সাধারণভাবে ধর্মকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল। বিশেষত ইসলাম এ ক্ষেত্রে পরিচয়ের নির্দেশক এবং সামাজিক সীমানা নির্দেশক হিসেবে কাজ করছিল। তবে বিষয়টি ব্যতিক্রমী ছিল না, কারণ ‘সংকটের সময়গুলো ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের জন্ম দেয়, যেহেতু মানুষ তখন প্রশ্ন করে তাদের ধর্মীয় সম্প্রদায়ের পার্থিব গৌরব কেন বিলীন হয়েছে’ (ল্যাঙ্গর, ২০০৫: ১৭২)। এই সংস্কার আন্দোলনগুলো প্রায়ই নানান রূপ ধারণ করে এবং বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে। ঊনবিংশ শতকের (এবং বিংশ শতকের) ভারতের ক্ষেত্রে মুসলিম সংস্কার আন্দোলনগুলো, অন্যান্যের মধ্যে, সাম্প্রদায়িক ও পুনর্জাগরণবাদী সক্রিয়তাবাদ এবং শিক্ষা আন্দোলনে রূপ নিয়েছিল (বিস্তারিত দেখুন, রিটজ, ২০০৬: ৫২-৮১)। এই আন্দোলনগুলো নানানভাবে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত ছিল। কিন্তু, আমাদের উদ্দেশ্য অনুসারে মুসলিম জাগরণ এবং পরিচয়ের রাজনীতির বাহন হিসেবে শিক্ষাবিষয়ক আন্দোলন, বিশেষত মাদ্রাসাগুলো আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

যদিও ১৮৭০ সালে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা স্থাপনকে দক্ষিণ এশিয়ায় মাদ্রাসাশিক্ষার আধুনিক যুগের সূচনা হিসেবে বর্ণনা করা যায়, তবে মুসলমানদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি এবং রাজনৈতিক সক্রিয়তা উত্সাহিতকরণে এই মাদ্রাসার ভূমিকা সীমিত ছিল, বিশেষত যদি এটিকে অন্যান্য গোষ্ঠী উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা, যেমন ঊনবিংশ শতকে উত্তর ভারতে প্রতিষ্ঠিত দেওবন্দ মাদ্রাসা এবং দারুল উলুম নাদওয়াতুল ওলামার সঙ্গে তুলনা করা হয়। যেমনটি আগে বর্ণনা করা হয়েছে, কলকাতা মাদ্রাসার প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল ঔপনিবেশিক প্রশাসনে যোগ দেওয়ার জন্য মুসলমানদের যোগ্য করে গড়ে তোলা। শুরু থেকেই মাদ্রাসাটি দারসে-নিজামি নামের পাঠ্যসূচি অনুসরণ করছিল। মাদ্রাসাটির ব্যবস্থাপনা পর্যবেক্ষণের জন্য সরকার কর্তৃক নিয়োগকৃত তদন্ত কমিটির সুপারিশে ১৮৫৩ সালে পাঠ্যসূচিতে কিছু পরিবর্তন করা হয়েছিল। তবে মাদ্রাসাটির লক্ষ্য প্রায় একই থেকে গিয়েছিল, ফলে সামাজিক সক্রিয়তায় প্রতিষ্ঠানটি এবং এর ওলামাদের ভূমিকা পালনের ক্ষেত্র খুবই সংকীর্ণ হয়ে গিয়েছিল।

একই শতকের শেষের দিকে কলকাতা মাদ্রাসার অনুকরণে আরও চারটি মাদ্রাসা স্থাপন করা হয়েছিল: ১৮৭১ সালে হুগলিতে, ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং রাজশাহীতে ১৮৭৩ সালে। বিংশ শতকের প্রথম ভাগে মাদ্রাসার সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায়। প্রাথমিকভাবে স্কুলের পাঠ্যসূচিতে ইংরেজি অন্তর্ভুক্ত করার প্রেরণা এবং মাদ্রাসাগুলোতে আর্থিক সহায়তা দেওয়া চালিয়ে যাওয়ার ফলে ১৯১৫ সালে মাদ্রাসা পাঠ্যসূচিতে একটি বড় পরিবর্তন আসে, ফার্সির পরিবর্তে অবশ্যপাঠ্য হিসেবে ইংরেজির অন্তর্ভুক্তি এবং পাঠ্যসূচিতে গণিত, ভূগোল, ইতিহাস এবং শারীরিক শিক্ষার প্রচলন করা হয়। যে মাদ্রাসাগুলো এই সংশোধিত পাঠ্যসূচি গ্রহণ করে, সেগুলোকে সংশোধিত (বা নতুন-সূচি) মাদ্রাসা বলা হতো। পুরোনো-সূচি মাদ্রাসা এবং নতুন-সূচি মাদ্রসাগুলো ভিন্ন ভিন্ন পাঠ্যসূচি অনুসরণ করায়, এই পরিবর্তন কলকাতা মাদ্রাসার পাঠ্যক্রম অনুসরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে দুটি ধারা সৃষ্টি করেছিল। সরকারের নীতি ছিল নতুন-সূচির মাদ্রাসাগুলোকে আর্থিকভাবে সহায়তা করা।

এই পরিবর্তনগুলো গুরুত্বপূর্ণ হলেও ওলামাদের কাছ থেকে খুব কমই সাড়া পেয়েছিল। কারণ এর মধ্যেই দেওবন্দে শুরু হওয়া একটি স্বতন্ত্র মাদ্রাসার ধারা, এর প্রভাব বিস্তার করা শুরু করেছিল। এই মাদ্রাসার লক্ষ্য ছিল মুসলিম সচেতনতা, ক্ষমতায়ন এবং সক্রিয়তা তৈরি করা।

ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক বিদ্রোহের ১০ বছর পর দিল্লির ১০০ মাইল উত্তরের ছোট শহর দেওবন্দে ১৮৬৬ সালে দারুল উলুম মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। মাদ্রাসাটি জনসাধারণের মধ্যে দেওবন্দ মাদ্রাসা নামে পরিচিত। এই মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মাওলানা মুহাম্মদ কাসিম নানৌতভি (১৮৩৩-১৮৭৭) এবং মাওলানা রশিদ আহমেদ গাঙ্গোহি (১৮২৯-১৯০৫)। ১৮৬৬ সাল দেওবন্দ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা এবং এটিকে ১৮৬৭ সালে উলুম পর্যন্ত উত্তীর্ণকরণ সমসাময়িক রাজনীতির প্রতি গোঁড়া ওলামাদের সচেতন পদক্ষেপ ছিল। যদিও মাদ্রাসাটি দারসে-নিজামি পাঠ্যসূচির একটি সংশোধিত সংস্করণ গ্রহণ করছিল, তবে এটি শাহ ওয়ালিউল্লাহর বুদ্ধিবৃত্তিক ধারা চালিয়ে নিয়ে যেতে মনস্থ করেছিল। ফলে এটির পাঠ্যসূচিতে মাকুলাতের (যৌক্তিক বিজ্ঞানসমূহ) পরিবর্তে মানকুলাতের (প্রকাশিত জ্ঞান) ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল: ‘পাঠ্যসূচির কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল ফিকাহ’ (সিকান্দ, ২০০৫: ৭৪)। দেওবন্দি ওলামারা আধুনিক শিক্ষা, বিশেষত ইংরেজির বিরোধী ছিলেন কি না তা বিতর্কের বিষয়; তবে এটি বিতর্কের ঊর্ধ্বে যে তারা যেটিকে ‘ইসলামিক শিক্ষা’ বিবেচনা করত, তার বিশুদ্ধতা প্রশ্নে তারা আপস করতে রাজি ছিল না। দেওবন্দ মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা এবং পৃষ্ঠপোষকেরা ব্যক্তি হিসেবে মুসলমানদের আধ্যাত্মিক জাগরণ এবং সার্বিকভাবে সম্প্রদায় হিসেবে মুসলমানদের একটি রাজনৈতিক মুক্তি আন্দোলনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। শাস্ত্রবাদী ভাবধারার দেওবন্দের ওলামাদের মতে, মুসলিম সম্প্রদায় ঔপনিবেশিক শক্তির হুমকির সম্মুখীন ছিল এবং এই হুমকি নিজেদের মধ্য থেকেও তৈরি হচ্ছিল। সৈয়দ আহমদ খান কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত আলীগড়ের অ্যাংলো-মোহামেডান কলেজের আধুনিকতাবাদী প্রচেষ্টাসমূহ এবং সংস্কারবাদী উদার মুসলিম নেতাদের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে—এই নেতারা ইংরেজি শিক্ষা এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রশাসনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার পক্ষপাতী ছিলেন—একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হতো। উপরন্তু, দেওবন্দিরা সুফি ধারা এবং শিয়া মতবাদসহ লোকজ ইসলামের বিরোধিতা করত। দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতারা, নানৌতভি এবং গাঙ্গহি, শিয়া বিশ্বাসের সত্যনিষ্ঠতাকে বহুবার চ্যালেঞ্জ করেছিলেন এবং এর বিরুদ্ধে বিস্তর লেখালেখি করেছিলেন। দেওবন্দের ওলামারা হানাফি মাজহাবের অনুসারী। তাঁরা জোর দিয়ে বলেন যে তাকলিদের যেকোনো ধরনের বিচ্যুতি অত্যন্ত শঙ্কার বিষয় এবং এটিকে অবশ্যই মোকাবিলা করতে হবে, কারণ তা বিদাতের (নবপ্রবর্তিত বিষয়) চেয়ে কম শঙ্কার নয়। দেওবন্দিদের কাছে ইজতিহাদের সব পথ চূড়ান্তভাবে বন্ধ। একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা দেওবন্দি ওলামাদের একটি স্বতন্ত্র ভিন্নতা দেয় তা হলো, দেশাচার বিষয়ে তাদের অবস্থান:

দেওবন্দিরা লোকজ ইসলামের বিরোধিতা করেছিল, যেখানে দরবেশের মধ্যস্থতা একটি বড় জায়গা দখল করে ছিল। একটি অতীন্দ্রিয়বাদী ক্রমে দীক্ষা গ্রহণকে পরিত্রাণ লাভের উপায় বিবেচনা করা হতো এবং অলৌকিক ঘটনা ও এ রকম বিষয়গুলোকে ভবিষ্যদ্বক্তা এবং দরবেশদের প্রামাণিক ও অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে দেখা হতো। তাঁরা পুরোপুরিভাবে অতীন্দ্রিয়বাদের বিরোধিতা করতেন না কিন্তু যুক্তি দেখাতেন যে ইসলামি আইন (শরিয়া) মেনে চলাই হচ্ছে অতীন্দ্রিয় পরমানন্দ লাভের উপায়। (রহমান, ২০০৪)

প্রথম দিককার মাদ্রাসাগুলো ঢিলেঢালাভাবে সংগঠিত থাকলেও, দেওবন্দের সম্প্রসারিত প্রশাসনিক কাঠামো ছিল: একজন রেক্টর (সরপরাস্ত), একজন আচার্য্য (মুহতামিম) এবং একজন প্রধান অধ্যাপক (সদর মুদাররিস) (রহমান, ২০০৪)। মাদ্রাসায় ক্রমাধিকারতান্ত্রিক কাঠামো গ্রহণ, শিক্ষার পশ্চিমা ধারণার বিজয় প্রমাণ করে। পরিকল্পিত পাঠ্যসূচির উপস্থিতি, ভর্তি এবং স্নাতকত্ব লাভের জন্য নিয়মিত আবশ্যিক শর্ত, পরিকল্পিত পরীক্ষা পদ্ধতি, মাদ্রাসার নিজস্ব ভবন (যেখানে আগের মাদ্রাসাগুলো কোনো একটি মসজিদের অংশ ছিল) এবং ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন মেটানোর জন্য একটি সুসংগঠিত আমলাতন্ত্র, এসব বিষয় আদিরূপাত্মক মধ্যযুগীয় মাদ্রাসার মানসের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল, যা দেওবন্দ অনুকরণ করবে বলে ধারণা করা হচ্ছিল। কাঠামোগত বৈচিত্র্যের জন্য দারসে-নিজামির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করা যেতে পারে, তবে এটা মনে রাখা ভালো যে ফারাঙ্গি মহলের ওলামারা তাদের কর্মকাণ্ডকে কখনো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়নি এবং দেওবন্দ মাদ্রাসা ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা অনুসরণের পরিবর্তে এর বিরুদ্ধাচরণ করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু এসব বৈশিষ্ট্যকে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ওলামাদের মানিয়ে নেওয়ার সামর্থ্য হিসেবেও ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। প্রকৃত পক্ষে, ওলামারা দেওবন্দকে বিস্তৃত জনগণকে সেবাদানকারী পথপ্রদর্শক ইসলামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে সাহায্য করেছিল।

প্রতিষ্ঠার প্রথম দিনগুলোতে দেওবন্দ বেশি সক্রিয়তা তৈরি করতে পারেনি, তবে মাওলানা মাহমুদুল হাসান (১৮৫১-১৯২০) হাল ধরার পর প্রতিষ্ঠানটি সামাজিক এবং রাজনৈতিক আন্দোলনের অগ্রভাগে চলে আসে। মাওলানা হাসানকে, যিনি মাদ্রাসাটির প্রথম ছাত্র ছিলেন, প্রায়ই শাইখুল হিন্দ (ভারতের নেতা) নামে ডাকা হতো। তিনি সামারাতুত তারবিয়া (প্রশিক্ষণের ফল) নামে একটি সংগঠন স্থাপন করেছিলেন, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহের জন্য জামিয়াতুল আনসার গঠন করেছিলেন এবং স্বাধীনতা আন্দোলনকে আন্তর্জাতিকীকরণের একটি ব্যর্থ প্রচেষ্টার সঙ্গেও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। ১৯১৯ সালে দেওবন্দ মাদ্রাসা দুটি অতিশয় সক্রিয় রাজনৈতিক সংগঠন, জামিয়াত-ই-খিলাফত-ই-হিন্দ (সর্বভারতীয় খিলাফত সম্মেলন) এবং জামিয়াত-ই-উলামা-ই-হিন্দ (ভারতের ধর্মীয় পণ্ডিতদের সংগঠন) প্রতিষ্ঠায় প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল (কাশমি, ২০০১)।

সক্রিয়তাবাদ ছাড়াও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেওবন্দের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। ফলে দূর-দূরান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা এই মাদ্রাসায় পড়তে আসতে শুরু করে এবং এই মাদ্রাসার অনুকরণে অনেক মাদ্রাসা স্থাপিত হয়। মেটকাফ উল্লেখ করেছেন যে দেওবন্দ মাদ্রাসা এবং দেওবন্দ থেকে ২০ মাইল দূরে শাহরানপুরে এর অনুরূপ মাদ্রাসায় অনেক দূর থেকে; এমনকি বাংলা থেকেও অসংখ্য শিক্ষার্থী পড়তে আসতেন (মেটকাফ, ১৯৮২: ১৩৫)। তবে উগ্র পদক্ষেপ, তাকলিদ বিষয়ে দেওবন্দি ওলামাদের দৃঢ় অবস্থান, তাদের নীতিনিষ্ঠতা এবং ধর্মীয় পাঠের ক্ষেত্রে নিজেদের ব্যাখ্যাকেই সহি বলে জোর প্রদান করায় সুন্নি মুসলিম সম্প্রদায়ের নানান অংশ থেকে মাদ্রাসাটি সমালোচনার শিকারও হয়। ‘ইসলামের জন্য হুমকির’ অব্যবহিত উেসর বিষয়ে ভিন্নতা, সর্বতোভাবে মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ চিন্তার বিষয়, অন্যান্য চিন্তাধারাসম্পন্ন গোষ্ঠীর উত্থানের অন্যতম মূল কারণ ছিল। ফলে নতুন মাদ্রাসাও স্থাপিত হয়েছিল।

ঊনবিংশ শতকের শেষ দিকে মাওলানা আহমেদ রেজা খান (১৮৫৫-১৯২১)-এর নেতৃত্বে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত (সুন্নাহ এবং সম্প্রদায়ের জনগণ), যা সাধারণত বেরলভী নামে পরিচিত, এর উত্থান এ রকম একটি উদাহরণ। মাওলানা আহমেদ রেজা খান মধ্য ভারতের উত্তরাঞ্চলে (বর্তমান উত্তর প্রদেশ) ব্যারাইলী নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কখনো কোনো প্রাতিষ্ঠানিক মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেননি। তিনি তাঁর বাবা মাওলানা নাকি আলীর, যিনি একজন হাদিসের পণ্ডিত ছিলেন, তত্ত্বাবধানে চিরাচরিত দারসে-নিজামি পাঠ্যসূচি মোতাবেক পড়াশোনা করেন। ১৪ বছর বয়সে তিনি তাঁর বাবার কাছ থেকে ফতোয়া লেখার দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং বাকি জীবন তিনি এই কাজ চালিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি দুবার হজব্রত পালন করেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি মুখস্থ করার অসাধারণ ক্ষমতা এবং পাণ্ডিত্যসহ অন্যান্য অনন্য গুণাবলি প্রদর্শন করেছিলেন। ১৯০০ সালে পাটনায় সমমনা ওলামাদের সভায় আহমেদ রেজাকে ১৪০০ হিজরির মুজাদ্দিদ (নবায়নকারী) ঘোষণা করা হয়েছিল। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠায় কয়েকবার ব্যর্থ হওয়ার পর ১৯০৪ সালে ব্যরাইলীতে তিনি মাদ্রাসা মানজার আল-ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে সফল হয়েছিলেন। অন্য একটি স্কুল, ১৮৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত লাহোরের দারুল উলুম নুমানিয়াহ আহমেদ রেজার চিন্তাধারা অনুসরণ করত এবং নিজেদের বেরলভী বলে পরিচয় দিত।

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, যেমনটা এর নাম থেকে বোঝা যায়, এটাই শুধু সত্যিকারভাবে সুন্নাহর (রসুলের প্রথা এবং আচার-আচরণ) প্রতিনিধিত্ব করে এবং একইভাবে সত্য সুন্নি মুসলিম ধারার প্রতিনিধিও তারা। বেরলভীরা দেওবন্দিদের মতো হানাফি মাজহাবের অনুসারী হওয়া সত্ত্বেও তারা সুফি ধারার গ্রহণযোগ্যতা, দরবেশদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং চিরাচরিত আচার-আচরণগুলোর বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেন। দেওবন্দিরা এই বিষয়গুলোর বিরোধিতা করলেও, বেরলভীরা এসব আচার পালনে মানুষকে উত্সাহিত করে: ‘আহমেদ [রেজা] খানের ধর্মতাত্ত্বিক লেখালেখির একটি বড় অংশ এটা প্রমাণ করতে নিয়োজিত ছিল যে আধ্যাত্মিক পরামর্শদাতা এবং পথপ্রদর্শক (পীর) হিসেবে বেরলভীদের অতীন্দ্রিয়বাদী চর্চাগুলো ইসলামিক আইন বা রাসুলীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ’ (রিটজ, ২০০৬: ৯১)।

মতের এই ভিন্নতা ১৯০০ শতকের শেষভাগে এবং বিংশ শতকের প্রথমাংশে তিক্ত দ্বন্দ্বের রূপ ধারণ করে। এ সময় দেওবন্দ এবং বেরলভী ফতোয়া যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল। জাতীয় রাজনীতির বিবেচনায়, বেরলভীরা রক্ষণশীল আচরণ করেছিল। তারা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরোধিতা করলেও, গণ-আন্দোলনসমূহ যেমন দেওবন্দিদের সমর্থিত ১৯২০-এর দশকের অসহযোগ আন্দোলন থেকে নিজেদের দূরে রেখেছিল। পরবর্তী বছরগুলোতেও বেরলভী এবং দেওবন্দিদের অবস্থানসমূহ পরস্পর বিপথগামী এবং বিরোধাত্মক ছিল। দেওবন্দিরা পাকিস্তান আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিল, অন্যদিকে বেরলভীরা মুসলিম লীগকে সমর্থন দিয়েছিল।

দেওবন্দি এবং বেরলভীদের মধ্যে বিদ্বেষপূর্ণ সম্পর্ক এবং উচ্চমার্গীয় বিতর্ক, যা মাঝে মাঝে শিষ্টাচারপূর্ণ থাকত না, এটা দৃশ্যমান করে যে ১৯০০ শতকের শেষাংশে মুসলিম সম্প্রদায়ের মাঝে একটি বিভেদ প্রকট হয়ে উঠছিল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যতটা ‘সত্য পথের’ দিকে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রয়াসের স্থান ছিল, ততটাই নিরবচ্ছিন্ন তর্কের মাধ্যম হিসেবে পরিণত হয়েছিল। অতএব, এই মাদ্রাসাগুলোর প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল সত্যিকার মুসলমানিত্বকে এবং ইতিহাসের সংকটময় সন্ধিক্ষণে মুসলিম সম্প্রদায়ের ভূমিকা সংজ্ঞায়িত করা। এই পুনঃসংজ্ঞায়ন এবং সম্প্রদায়গত পার্থক্যসমূহে মাদ্রাসাগুলো অবশ্যই ভূমিকা রেখেছিল। তবে এটা মাদ্রাসাগুলোর একমাত্র ভূমিকা ছিল না। পক্ষান্তরে, পার্থক্যসমূহের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান এবং একটি মধ্যপন্থা গ্রহণ করার প্রচেষ্টাও চালানো হয়েছিল।

পার্থক্যসমূহের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের প্রচেষ্টা, বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিপাদনের বিভিন্ন ধারাকে ঐক্যবদ্ধকরণ এবং সম্প্রদায়গত পার্থক্যসমূহকে ছাপিয়ে যাওয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ ছিল ১৮৯৩ সালে মাওলানা মুহাম্মদ আলি মুঙ্গেরির (১৮৪৬-১৯২৭) নেতৃত্বে পণ্ডিতদের একটি সংগঠন, নাদোয়াতুল ওলামা, প্রতিষ্ঠা করা। এই সংগঠনের প্রাথমিক উদ্দেশ্যগুলো ছিল: মাদ্রাসার পাঠ্যসূচি এবং শিক্ষাদান পদ্ধতির সংস্কারসাধন, সাধারণ স্বার্থের ভিত্তিতে মুসলিম সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ করা এবং মুসলিম পরিচয়ের সচেতনতা জাগিয়ে তোলা। শুরুটা সত্যিকার অর্থেই অনুকূল এবং ঐক্যবদ্ধ ছিল। সংগঠনটি প্রায় সব মতাবলম্বীর প্রতিনিধিদের ঐক্যবদ্ধ করতে সমর্থ হয়েছিল। সুন্নিদের যেকোনো ধরনের উদ্যোগ থেকে দূরে থাকলেও, এমনকি শিয়ারাও এখানে যোগ দিয়েছিল। সংগঠকদের বিশ্বাস ছিল, সংগঠনটি পুরোনো ধারণাসমূহ এবং নতুন বাস্তবতার মধ্যে সেতুবন্ধের কাজ করবে। এর ফলে গোটা সম্প্রদায়ের সক্রিয়তাবাদের সাধারণ ভিত্তি তৈরি হবে। কিন্তু শিগগিরই একতার এই আশা উবে যায়, অনেক দল ভিন্ন হয়ে যায় এবং বেরলভীরা সংগঠন এবং এর ধারণার বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা করা শুরু করে। এই সমালোচনাসমূহের কাছে মাথা না নুয়ে, সংগঠনের প্রধান নেতারা ১৮৯৬ সালে একটি মাদ্রাসা স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ফলে দারুল উলুম নাদোয়াতুল ওলামা (সংক্ষেপে নাদোয়া) প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তী সময়ে ১৯০৫ সালে শিবলি নোমানি নাদোয়ায় যোগদান করেন। নোমানি ছিলেন একজন বিখ্যাত পণ্ডিত, যিনি এর আগে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে মোহামেডান অ্যাংলো-ওরিয়েন্টাল কলেজে (সাধারণভাবে আলীগড় কলেজ নামে পরিচিত) পড়িয়েছিলেন। শিবলি নোমানি মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠার প্রায় ১০ বছর পর এতে যোগদান করেছিলেন, তবে তাকে এই সংগঠন (নাদোয়াতুল ওলামা) এবং মাদ্রাসার অনুপ্রেরক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

যদিও নাদোয়া দেওবন্দি ওলামাদের সঙ্গে একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখত এবং পশ্চিমা-শিক্ষিত এলিটদের সক্রিয় সমর্থন পায় বলে ধারণা করা হতো। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি, যেমনটি এর প্রতিষ্ঠাতারা আশা করেছিলেন, একটি সামুদয়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে সফল হয়নি। উর্দুর পরিবর্তে, যে ভাষাটি দেওবন্দ মাদ্রাসা জনপ্রিয় করে তুলেছিল, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে আরবির প্রতি আগ্রহ পুনরুদ্দীপিত করতে নাদোয়া সফল হয়েছিল। আরবির গুরুত্ব তুলে ধরতে নাদোয়ার প্রচেষ্টা প্রধানত এর সঙ্গে আরবি-ভাষী ওলামাদের—বিশেষত মিসরীয় সংস্কারবাদী ওলামা—যোগাযোগের ফল ছিল। নোমানি ১৮৯২ সালে তার মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকা ভ্রমণের সময় এসব সংস্কারবাদীর সঙ্গে দেখা করেছিলেন। এটা প্রায়ই উল্লেখ করা হয় যে নোমানির শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের এই ধারণা বিখ্যাত সালাফিস্ট মুহাম্মদ আবদু (১৮৪৯-১৯০৫) দ্বারা প্রভাবিত (হার্টাং, ২০০৬: ১৪১)। এমনকি নোমানি মাদ্রাসাটি ছেড়ে যাওয়ার পরও সালাফিস্টদের সঙ্গে নাদোয়ার এই যোগাযোগ অবিচ্ছিন্ন ছিল। বিশ শতকের মধ্য ভাগে সালাফিয়া আদর্শে তাদের অবদান সংরক্ষণের জন্য একটি আরবি জার্নাল প্রকাশের কাজে, নাদোয়া মিসরীয় সালাফিস্টদের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করেছিল।

নাদোয়ার জন্য নির্মিত পাঠাগার এবং এর বিপুল সংগ্রহ সক্রিয়তাবাদের চেয়ে ইসলামি জ্ঞানের বুদ্ধিবৃত্তিক ধারার প্রতি এর গুরুত্বারোপের সাক্ষী। উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রকৃতি সত্ত্বেও বা এই উচ্চাকাঙ্ক্ষার কারণে, এই প্রকল্পটি যেমনটি আশা করা হয়েছিল, তেমনটি সফল হতে পারেনি।

দারুল উলুম নাদোয়াতুল ওলামা তাদের পাঠ্যসূচি এবং শিক্ষাপদ্ধতিতে সংস্কারবাদী ওলামাদের চাওয়া অনেক পরিবর্তন সংযোজন করেছিল। এই পরিবর্তনগুলোর মধ্যে ছিল: পাঠ্যসূচিতে আধুনিক ইতিহাস এবং কথ্য আরবির সংযোজন এবং মুখস্থ করা ও শিক্ষকদের মতামত অন্ধভাবে অনুসরণের পরিবর্তে বুদ্ধিবৃত্তিক বিতর্কে উত্সাহিতকরণ। তবে ‘দৃষ্টিভঙ্গি প্রধানত রক্ষণশীল এবং অপ্রগলভভাবে উন্মুক্ত থেকে গিয়েছিল’ (রিটজ, ২০০৬: ২৭৫)। সংস্কারের পদক্ষেপগুলো ধীরগতি হয়ে যায় এবং ১৯১৩ সালে শিবলি নোমানি মাদ্রাসাটি ছেড়ে যাওয়ার পর তা পুরোপুরি স্থগিত হয়ে যায়; যদিও মাদ্রাসাটি টিকে আছে এবং ভারতে একটি নির্দিষ্ট মাত্রার সম্মান লাভ এবং প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হয়েছে।

উপসংহার

পূর্ববর্তী ঐতিহাসিক আখ্যান এটা প্রমাণ করে যে একটি ধারণা এবং প্রতিষ্ঠান হিসেবে মাদ্রাসা দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে এসেছে। এর বহিরাবয়ব এবং আধেয়গুলো অনেক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গিয়েছে এবং প্রতিষ্ঠান হিসেবে মাদ্রাসাগুলো এখনো সমাজের সঙ্গে অনেকাংশে সম্পৃক্ত আছে। স্থান ও কালের ভিত্তিতে মুসলিম সম্প্রদায়ের চাহিদাগুলো এসব মাদ্রাসা স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। দক্ষিণ এশীয় মাদ্রাসাগুলোর ইতিহাস আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে মাদ্রাসা এবং রাষ্ট্র এবং সমাজের মধ্যে মিথষ্ক্রিয়ার কোনো একক ধরন নেই। উদাহরণস্বরূপ রাষ্ট্র একসময় মাদ্রাসাগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে এবং অন্য সময় মাদ্রাসাগুলো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ক্রোধের শিকার হয়েছে।

স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে জন্মলগ্ন থেকেই মাদ্রাসাগুলো বিবাদের ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। প্রাথমিকভাবে ইসলামিক চিন্তাধারার সাম্প্রদায়িক পার্থক্যগুলোর মধ্যে, কখনো শিয়া এবং সুন্নিদের মধ্যে বা অন্য সময় সুন্নিদের বিভিন্ন মাজহাবের মধ্যে। ঊনবিংশ শতকের শেষাংশের ভারতে এই বিতর্ক একই মাজহাবের বিভিন্ন উপদলে (বা মাশলাক, পন্থাসমূহ) ছড়িয়ে পড়ে (যেমন দেওবন্দি এবং বেরলভীদের মধ্যে বিতর্ক, এদের উভয়ই হানাফি মাজহাবের অনুসারী)। তীব্র বিদ্বেষপূর্ণ আচরণ সত্ত্বেও কিছুটা গতিশীলতা, যেমন সমসাময়িক বুদ্ধিবৃত্তিক বিতর্কের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে এবং নতুন পরিস্থিতির আলোকে ক্লাসিক্যাল টেক্সটগুলোর ব্যাখ্যা প্রদানে প্রতিষ্ঠানগুলোর চলমান প্রচেষ্টা বিদ্যমান ছিল।

ঔপনিবেশিক আমলে দক্ষিণ এশিয়ায় মাদ্রাসার ইতিহাস থেকে প্রাপ্ত পাঠ অনেক দিক থেকেই শিক্ষামূলক। মাদ্রাসাগুলোর প্রকৃতি এবং লক্ষ্য শুধু মুসলিম সম্প্রদায়ের অন্তঃস্থ ঘটনাপ্রবাহের দ্বারাই রূপায়িত হয়নি। বরং অন্যান্যের মধ্যে ঔপনিবেশিক প্রশাসনের নীতিমালা, অন্যান্য সম্প্রদায় যেমন খ্রিষ্টান মিশনারি এবং আর্য সমাজের চ্যালেঞ্জ এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের সদস্যদের উদীয়মান রাজনৈতিক ব্যবস্থার অংশ হতে চাওয়াও নিয়ামক ভূমিকা পালন করেছিল।

মাদ্রাসা এবং ওলামাদের রাজনৈতিক সক্রিয়তা, মাদ্রাসাগুলোয় যার সৃষ্টি, সম্প্রদায়ের পরিচয়ের সংজ্ঞায়ন এবং পুনঃসংজ্ঞায়নের তাড়নায় চালিত ছিল, বিশেষত প্রতিকূল পরিস্থিতিগুলোতে। তাদের সাফল্য বা ব্যর্থতা ছাড়াও, এই ঘটনাপ্রবাহ ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার ভিত্তিভূমি তৈরি করেছিল। এই পরিবর্তন উপমহাদেশকেও বিভক্ত করেছিল এবং একটি নতুন রাষ্ট্রের, পাকিস্তানের, অভ্যুদয় হয়েছিল।

তথ্যসূত্র:

১.         তবে রিচার্ড ইটনের মতে সর্বপ্রথম যোগাযোগ স্থাপিত হয় একাদশ শতাব্দীতে। ইটনের মতে এই সময় তুর্কিভাষী বংশোদ্ভূত সুফিরা এখানে আসেন (ইটন, ১৯৯৩)।

২.         কিছু মতানুসারে শহরটি বিন কাশিমের ছেলে আমর নির্মাণ করেছিলেন। স্বল্প সময়ের মধ্যেই এটি সিন্ধের অন্যতম উদীয়মান শহরে পরিণত হয়েছিল। ৯৫৭ সালের মধ্যে এটি বেশ বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল।

৩.        কিছু বিশেষজ্ঞ জোর দিয়ে বলেন যে, পাঠ্যসূচিতে যৌক্তিক বিজ্ঞান যেমন: অলংকারশাস্ত্র, যুক্তিবিদ্যা এবং ধর্মতত্ত্ব ইত্যাদি বিষয়ে জোর প্রদানের ধারা শুরু হয় সিকান্দার লোদির শাসনামলে (১৪৮৯-১৫১৮) (সুফি, ১৯৪১:৩৩)।

৪.         জান জাহান খান, তারিখই-জান-জাহান, এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল, কলকাতায় পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়।

৫.         অবশ্য কিছু পণ্ডিত রাজসভা কর্তৃক শিক্ষাকে পৃষ্ঠপোষকতা করার দাবির সাথে দ্বিমত পোষণ করেন। উদাহরণস্বরূপ, সাইয়্যিদ নাকি হুসেইন জাফরির (২০০৬:৪৯) মতে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের ক্ষেত্রে শাসকদের শুধু বিক্ষিপ্ত প্রচেষ্টা ছিল; সম্ভবত, ইউরোপের অভিজাতদের মতো দেশীয় অভিজাতদের কাছে এ বিষয়টি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত ছিল না।

৬.        এখন পর্যন্ত ফিরিঙ্গি মহলের উপর সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য গবেষণা করেছেন রবিনসন (২০০১)।

৭.         মেটকাফ বর্ণনা করেছেন, ‘কাজি এবং মুফতি—যেসব কর্মকর্তা মুসলিম আদালতে প্রয়োজন হয়—তৈরি করা ছিল ফারাঙ্গি মহলের বিশিষ্টতা’ (মেটকাফ, ১৯৮২:৩০)।

৮.        ১৮৯০ সালে বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত আলোচ্য মাদ্রাসাটির নির্দিষ্ট কোনো নাম ছিল না। চালু থাকার সময় মাদ্রাসাটি এর প্রধানদের (সদর মুদাররিস) নামানুসারে পরিচিত ছিল। উদাহরণস্বরূপ, যখন শাহ ওয়ালিউল্লাহ মাদ্রাসাটির প্রধান ছিলেন, তখন এটি মাদ্রাসা-ই- শাহ ওয়ালিউল্লাহ নামে পরিচিত ছিল এবং যখন তার ছেলে শাহ আবদ আল-আজিজ মাদ্রাসাটির প্রধান ছিলেন, তখন মাদ্রাসাটি মাদ্রাসা-ই-শাহ আবদ আল-আজিজ নামে পরিচিত ছিল (আশরাফ, ২০০৫:৬৩-৬৪)।

৯.         এটা উল্লেখ করা গুরুত্বপূর্ণ যে, ১৮০০ শতকের ইসলামিক পণ্ডিত মুহাম্মদ ইবন আবদ আল-ওহাব (১৭০৩-১৭৮৭), যিনি সাধারণত ওহাবিজমের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে পরিচিত; তিনিও হায়া আল-সিন্ধির ছাত্র ছিলেন। কোনো কোনো গবেষক জোর দিয়ে বলেন যে, এর ফলে শাহ ওয়ালিউল্লাহ এবং আবদ আল-ওহাবের মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক সংলগ্নতা দেখা যায় (ভল, ১৯৭৫:৩২-৩৯)।

১০.       যদিও ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শাসক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, কিন্তু দিল্লিকেন্দ্রিক সাম্রাজ্য এটা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেনি। ১৭৬৫ সালে কোম্পানিকে দেওয়ানি দেওয়া হয়, অর্থাত্ বাংলা, বিহার এবং ওডিশায় মোগল সাম্রাজ্যের পক্ষে কোম্পানিকে রাজস্ব আদায়ের অধিকার দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে এই অঞ্চলের রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ হিসেবে কোম্পানিকে আনুষ্ঠানিক ক্ষমতা এবং স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

১১.       সাধারণ বিভাগের কাউন্সিলে ভারতের গভর্নর জেনারেলের সিদ্ধান্ত, নাম্বার. ১৯, ৭ মার্চ, ১৮৩৫, ইন্ডিয়া জেনারেল কনসাল্টেশনস পি/১৮৬/৮৮(২)। 

গ্রন্থসূত্র:

            Abul Fazl Allami (1907) The Ain I Akbari, trans. H Blochmann and HS Jarrett, Volume I: Chapter 202, Ain 25: The regulation of education. Calcutta: The Asiatic Society of Bengal. Available at:

            http://persian.packhum.org/persian/main?url=pf%3Ffile%3D00702051%26ct%3D0

            Ahmad K (1968) Muslim tradition in education. Islamic Education (Journal of All Pakistan Islamic Education Congress) November–December: 21–64.

            Ali MM (1965) The Bengali Reaction to Christian Missionary Activities 1833–1857. Chittagong: Mehrab Publications.

            Ashraf M (2005) Madrasa-i-Rahimiah: Growth and pattern of educational curriculum, origin and character of Islamic education. In: Husain SM Azizuddin (ed) Madrasa Education in India: Eleventh to Twenty First Century. New Delhi: Kanishka Publishers, 59–75.

            Bernier F (1914) Travels in the Mogul Empire A.D. 1656–1668, translated by A Constable. London: H. Milford, Oxford University Press.

            Beveridge H (trans.) (1977) The Akbar Nama of Abul-Fazl. 3 vols. Reprint Edition. Delhi: Ess Ess Publications. (Originally published in Calcutta by the Royal Asiatic Society of Bengal, 1902–1939.)

            Dallal A (1993) The origins and objectives of Islamist revivalist thought, 1750–1850. Journal of the American Oriental Society 113(3) (July–September): 341–359.

            Eaton R (1993) The Rise of Islam and the Bengal Frontier, 1204–1760. Berkeley: University of California Press.

            Faruki Z (1935) Aurangzeb and His Times. Bombay: DB Taraporevala Sons.

            Garg BR (2003) Charles Grant: The Forerunner of Macaulay’s Educational Policy. Ambala Cantonment, India: Associated Publishers.

            Ghazi MA (2004) Islamic Renaissance in South Asia (1707–1867): The Role of Shah Wali Allah and His Successors. New Delhi: Adam Publishers.

            Hartung J-P (2006) The Nadwat al-‘ulama: Chief patron of Madrasa education in India and a turntable to the Arab world. In: Hartung J-P and Reifeld H (eds) Islamic Education, Diversity, and National Identity: Dini Madaris in India Post-9/11. New Delhi: Sage, 135–157.

            Hassan F (2006) Madaris and the challenges of modernity in colonial India. In: Hartung J-P and Reifeld H (eds) Islamic Education, Diversity, and National Identity: Dini Madaris in India Post-9/11. New Delhi: Sage. New Delhi: Sage, 56–72.

            Husain SM Azizuddin (2005) Mir Fahullah Shirazi’s contribution for the revision of the syllabi of Indian madrasas during Akbar’s reign. In: Husain SM Azizuddin (ed) Madrasa Education in India: Eleventh to Twenty First Century. New Delhi: Kanishka Publishers, 24–36.

            Ikram SM (1964) Muslim Civilization in India, Ainslie T Embree (ed). New York: Columbia University Press.

            Islam S (2002) Prosohongo: Shiksha (Issue: Education, in Bengali). Dhaka: Shikshabarta Prokashona.

            Jafri SNH (2006) A modernist view of Madrasa education in late Mughal India. In: Hartung J-P and Reifeld H (eds) Islamic Education, Diversity, and National Identity: Dini Madaris in India Post-9/11. New Delhi: Sage, 39–55.

            Jalbani GN (1967) Teachings of Shah Waliyullah of Delhi. Lahore: Sh. Muhammad Ashraf.

            Kaur K (1990) Madrasa Education in India: A Study of Its Past and Present. Chandigarh: Centre for Research in Rural and Industrial Development.

            Laird MA (1972) Missionaries and Education in Bengal 1793–1837. Oxford: Clarendon Press.

            Lane-Poole S (1990) Aurengazeb and the Decay of the Mughal Empire. New Delhi: Low Price.

            Langohr V (2005) Colonial education systems and the spread of local religious movements: The case of British Egypt and Punjab. Contemporary Studies in Society and History 47(1) (January): 161–189.

            Law NN (1916) Promotion of Learning in India during Muhammadan Rule by Muhammadans. London: Longman’s Green

            Macaulay’s Minute on Education (1835) Report of the Saddler’s Commission. Appendix 2, Vol. 6. Calcutta: Calcutta University.

            McCully BT (1966) English Education and the Origins of Indian Nationalism. New York: Columbia University Press.

            Metcalf BD (1982) Islamic Revival in British India: Deoband, 1860–1900. New Delhi: Oxford University Press.

            Naik JP and Nurullah S (2000) A Students’ History of Education in India: 1800–1973. Bombay: Macmillan India.

            Nayyar AH (2003) Madrassah education frozen in time. In: Hoodbhoy P (ed) Education and the State: Fifty Years of Pakistan. Karachi: Oxford University Press, 215–250.

            Qasmi MB (2001) Recounting Untold History, Darul Uloom Deoband: A Heroic Struggle against the British Tyranny. Mumbai: Markazul Ma’arif Education and Research Center.

            Rahim MA (1982) Banglar Samajik o Sangskritk Itihash [Social and Cultural History of Bengal, in Bengali]. Vol 1 Dhaka: Bangla Academy.

            Rahman T (2004) The madrassa and the state in Pakistan. Himal February. Available at: www.himalmag.com/2004/february/essay.htm

            Reetz D (2006) Islam in the Public Sphere, Religious Groups in India, 1900–1947. New Delhi: Oxford University Press.

            Rizvi SAA (1980) Shah Wali-Allah and His Times. Canberra: Ma’rifat Publishing House.

            Robinson F (2001) The ‘Ulama of Farangi Mahall and Islamic Culture in South Asia. New Delhi: Permanent Black.

            Rudolph SH and Rudolph LI (2001) Living with difference in India: Legal pluralism and legal universalism in historical context. In: Larson GJ (ed) Religion and Personal Law in Secular India: A Call for Judgment. Bloomington: Indiana University Press.

            Saklain G (1993) Bangladesher Sufi Sadhak [Sufis and Holy Men of Bangladesh, in Bengali]. Dhaka: Islamic Foundation Bangladesh.

            Seth S (2007) Secular enlightenment and Christian conversion: Missionaries and education in colonial India. In: Kumar K and Oesterheld J (eds) Education and Social Change in South Asia. New Delhi: Orient Longman, 27–43

            Siddiqui IH (2005) Madrasa-education in medieval India. In: Husain SM Azizuddin (ed) Madrasa Education in India: Eleventh to Twenty First Century. New Delhi: Kanishka Publishers, 7–23.

            Sikand Y (2005) Bastions of the Believers: Madrasas and Islamic Education in India. New Delhi: Penguin.

            Sufi GMD (1941) Al Minhaj: The Evolution of Curriculum in the Muslim Educational Institutions of India. Lahore: Sh. Muhammad Ashraf.

            Voll JO (1975) Muhammad Hayya al-Sindi and Muhammad ibn Abd al-Wahab: An analysis of an intellectual group in eighteenth-century Medina. Bulletin of the School of Oriental and African Studies 38(1): 32–39.

            Zastoupil L and Moir M (eds) (1999) The Great Indian Education Debate: Documents Relating to the Orientalist–Anglist Controversy, 1781–1843. Richmond, Surrey: Curzon.