দরিদ্রবান্ধব স্থানীয় সরকার ও ইউনিয়ন পরিষদ নেতাদের রাজনৈতিক হিসাবনিকাশ

সারসংক্ষেপ

এই প্রবন্ধের মূল দৃষ্টিপাত থাকবে ইউনিয়ন পরিষদ পর্যায়ে জোগানের দিকটির ওপর, যেমন ইউপি নেতাদের প্রণোদনা। সেটা হতে পারে তাঁদের আচরণের জন্য বরাদ্দ পুরস্কার বা শাস্তি। এটি ইউনিয়ন পরিষদ পর্যায়ে অন্তর্ভুক্তিমূূলক, অংশগ্রহণমূলক ও দরিদ্র্যবান্ধব শাসনব্যবস্থা সৃষ্টি ও শক্তিশালীকরণে ইউনিয়ন পরিষদ নেতাদের প্রণোদনাগুলো কীভাবে রাজনৈতিকভাবে নির্ধারিত হয় তা বিশ্লেষণ করবে। এ ছাড়া এই প্রবন্ধে দেখা যাবে কীভাবে নতুন আইন (যেমন ইউনিয়ন পরিষদ আইন ২০০৯) এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা প্রতিষ্ঠানগুলো (যেমন: ওয়ার্ড সভা, উন্মুক্ত বাজেট, স্ট্যান্ডিং কমিটিসমূহ ইত্যাদি) ইউপি নেতাদের মধ্যে এই ধরনের প্রণোদনা তৈরিতে সাহায্য করেছে (বা করেনি)।

মুখ্য শব্দগুচ্ছ: ইউনিয়ন পরিষদ, নেতা, শাসনব্যবস্থা, ইউনিয়ন পরিষদ আইন ২০০৯, এলিট রাজনৈতিক সমঝোতা, ত্রুটিপূর্ণ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা।

প্রারম্ভিক কথা

সম্প্রতি স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা এবং স্থানীয় পর্যায়ে শাসনব্যবস্থা প্রক্রিয়ায় নাগরিকদের সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ তাত্পর্যপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় ইউনিয়ন পরিষদই সর্বনিম্ন প্রশাসনিক স্তর। ১৯৭০-এর দশক থেকেই ইউনিয়ন পরিষদ চালু রয়েছে। ১ জন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, ৯ জন সাধারণ সদস্য (মেম্বার) এবং সংরক্ষিত আসনের ৩ জন নারী সদস্য নিয়ে মোট ১৩ জন সদস্যের সমন্বয়ে এই ব্যবস্থা গঠিত হয়। বিভিন্ন আইন ও বিধির মাধ্যমে ধীরে ধীরে ইউনিয়ন পরিষদে ক্ষমতা প্রদান করা হলেও অন্তর্ভুক্তিমূলক ও দরিদ্রবান্ধব শাসনব্যবস্থার উন্নয়নে এসব আইন ও বিধির প্রভাবটি মিশ্র রয়ে গেছে। স্থানীয় সরকারব্যবস্থা, বিশেষ করে ইউনিয়ন পরিষদগুলো রাজনৈতিক এলিটবেষ্টিত থাকে। এর ফলে অতিমাত্রায় দুর্নীতি, নাগরিকদের চাহিদার প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করা এবং শাসনব্যবস্থায় নাগরিকদের অন্তর্ভুক্তি বা অংশগ্রহণের অনুপস্থিতি জনমনে উদ্বেগের জন্ম দেয়।

২০০৯ সালে আগের সংস্কারগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ইউনিয়ন পরিষদ বিধি ২০০৯ প্রণয়ন করা হয়। ইউনিয়ন পরিষদকে একটি কার্যকর ও জনস্বার্থ রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করতে এই আইনে অনেক বাধ্যবাধকতা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। নাগরিক অংশগ্রহণের গুরুত্ব নিশ্চিত করে বলা হয় যে প্রত্যেক নির্বাচনী ওয়ার্ডে নাগরিকদের যুক্ত করতে একটি করে ওয়ার্ড সভা গঠন করা হবে। নাগরিকদের অধিকার এবং তাদের প্রতি ইউনিয়ন পরিষদের দায়িত্ব বর্ণিত একটি নাগরিক ঘোষণাপত্র রয়েছে। তবে এই আইনের প্রভাব এখনো সুষ্ঠুভাবে বিশ্লেষণ করা হয়নি।

বর্তমান প্রবন্ধের বিষয়বস্তুটি সুনির্দিষ্ট। এখানে শাসনব্যবস্থা প্রক্রিয়ার জোগানের দিকটি বা ইউপি নেতাদের প্রণোদনাগুলো১ দেখা হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদ পর্যায়ে অন্তর্ভুক্তিমূূলক, অংশগ্রহণমূলক ও দরিদ্রবান্ধব শাসনব্যবস্থা সৃষ্টি ও শক্তিশালীকরণে ইউনিয়ন পরিষদ নেতাদের প্রণোদনাগুলো কীভাবে রাজনৈতিকভাবে নির্ধারিত হয় তা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এ ধরনের শাসনব্যবস্থা গরিবদের ‘আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক ক্ষেত্রে প্রত্যাখ্যান ও বৈষম্যের’ ব্যাপারে সোচ্চার হতে সাহায্য করে এবং অংশগ্রহণের ক্ষেত্র তৈরি করে দেয়। এর ফলে অতিদরিদ্র জনগণ তাদের অধিকার দাবি করতে পারে এবং সরকারকে দায়বদ্ধ করতে পারে (হিন্টন ২০১০, পৃ. ৫)। এই প্রবন্ধের আলোচনায় দেখানো হয়েছে, কীভাবে নতুন আইন (যেমন ইউনিয়ন পরিষদ আইন ২০০৯) এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা প্রতিষ্ঠানগুলো (যেমন: ওয়ার্ড সভা, উন্মুক্ত বাজেট, স্ট্যান্ডিং কমিটিসমূহ ইত্যাদি) ইউপি নেতাদের মধ্যে দরিদ্রবান্ধব শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় প্রণোদনা তৈরিতে সাহায্য করেছে (বা করেনি)।

এই প্রবন্ধের প্রেক্ষাপটটি তিনটি ইউনিয়ন পরিষদের শাসনব্যবস্থা প্রক্রিয়া। যে তিনটি ইউনিয়ন পরিষদ থেকে উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে তা হলো নীলফামারী জেলার বতলাগাড়ি ও খোকশাবাড়ি ইউনিয়ন এবং লালমনিরহাট জেলার সারপুকুর ইউনিয়ন।

তাত্ত্বিক কাঠামো

এই গবেষণায় রাজনৈতিক সমঝোতা (Political Settlement) ও ত্রুটিপূর্ণ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা (Imperfect Political Market) তত্ত্বের আলোকে দেখানো হয়েছে ইউনিয়ন পরিষদ নেতাদের প্রণোদনার পেছনে রাজনৈতিক নির্ধারকগুলো কী। ডি জন ও পাটজেলের (২০০৯ পৃ. ৪) মতে, ‘রাজনৈতিক সমঝোতা’ মানে হলো ‘বিবদমান সামাজিক গোষ্ঠী ও সামাজিক শ্রেণিগুলোর মধ্যে ক্ষমতার বণ্টন বা ভারসাম্য...।’ এলিট-রাজনৈতিক সমঝোতায় এলিট গ্রুপগুলো নিজেদের মধ্যে দর-কষাকষি করে এ ধরনের একটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠা করে। এখানে সব পক্ষকে সন্তুষ্ট করেই সম্পদের ভাগাভাগি হয়। যেকোনো এলিট-রাজনৈতিক সমঝোতার (বা এলিট ও নন-এলিটের মধ্যে) গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সম্পদের ভাগাভাগি এমন হতে হবে যেন প্রত্যেক পক্ষই তার সামাজিক অবস্থান ও ক্ষমতা অনুযায়ী ভাগ পায়। এটা খানের (২০১০, পৃ. ৮) দেওয়া রাজনৈতিক সমঝোতার সংজ্ঞায় স্পষ্টভাবে দেখানো হয়েছে: রাজনৈতিক সমঝোতা বলতে ‘কতগুলো প্রাতিষ্ঠানিক ও বণ্টন সম্পর্কিত ছাড় বোঝায়, যেখানে অন্তর্নিহিত ক্ষমতা ও সুবিধা উভয়েরই বণ্টন নিশ্চিত করা হয়’। আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠানগুলো এ ধরনের অর্থনৈতিক সুবিধাগুলোর বণ্টনকে সমর্থন করে থাকে। আসলে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে অনানুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠানই এ ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখে। রাজনৈতিক সমঝোতা বলতে একটা প্রাতিষ্ঠানিক ভারসাম্য বোঝায়, যেখানে প্রভাবশালী গোষ্ঠীগুলোর সুবিধাপ্রাপ্তি অবশ্যই নিশ্চিত করতে হয়।

খানকে অনুসরণ করে ক্ষমতাকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়, ক্ষমতাবান বলতে বোঝায় ‘দ্বন্দ্ব চলাকালীন কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সম্পৃক্ত হওয়া ও টিকে থাকার সক্ষমতা’ (পৃ. ৪)। ‘উন্নয়নশীল দেশগুলোতে রাজনৈতিক সমঝোতার মধ্যে নিহিত ক্ষমতার বণ্টন বহুলাংশে নির্ভর করে অনানুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠানের ওপর, বিশেষ করে অর্থনৈতিক সুবিধা বরাদ্দকারী পেট্রন-ক্লায়েন্ট নীতিমালার’ ওপর (প্রাগুক্ত)। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সমঝোতা মানে হলো পুরোপুরি ক্লায়েন্টভিত্তিক রাজনৈতিক সমঝোতা। বাংলাদেশের মতো প্রতিযোগিতামূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্লায়েন্টভিত্তিক রাজনৈতিক সমঝোতাও প্রতিযোগিতামূলক হয়। আর এটাই প্রাসঙ্গিক এলিট বা নন-এলিট গোষ্ঠীগুলোর প্রণোদনাকে বহুলাংশে নির্ধারণ করে দেয়।

‘ত্রুটিপূর্ণ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা’ পদ্ধতি রাজনীতিবিদ (জনপ্রতিনিধি) ও নাগরিকদের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে তিন ধরনের ত্রুটির ওপর জোর দেয়। এগুলো হলো: নাগরিকদের প্রতি রাজনীতিবিদদের করা প্রতিজ্ঞায় বিশ্বাসযোগ্যতার ঘাটতি; রাজনীতিবিদদের সক্ষমতা যাচাই করার জন্য ভোটার/নাগরিকদের প্রয়োজনীয় তথ্যের ঘাটতি এবং ভোটার/নাগরিকদের মধ্যে সামাজিক বিভাজন ও বিভক্তি, যা বিভিন্ন ধরনের আত্মপরিচয়ের রাজনীতির মাধ্যমে প্রকাশ পায় (কিফার ও খামেনি, ২০০৫)।

এ ধরনের ত্রুটি নির্বাচনী জবাবদিহির গতিশীলতাকে তাত্পর্যপূর্ণভাবে প্রভাবিত করে। এসব গতিশীলতা সেবা বা পাবলিক গুডস (সমাজের সকলকে মুনাফা ছাড়া প্রদত্ত পণ্য বা সেবা) প্রদানে রাজনীতিবিদদের প্রণোদনা কাঠামোকে সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ করে, বা দরিদ্রবান্ধব এবং অন্তর্ভুক্তিমূূলক/অংশগ্রহণমূূলক শাসনব্যবস্থা তৈরিতে তাদের ‘রাজনৈতিক ইচ্ছা’ সৃষ্টি করে (নাও করতে পারে)। ত্রুটিপূর্ণ রাজনৈতিক বাজার ভোটার/নাগরিকদের সবাইকে সমানভাবে প্রভাবিত করে না। এলিট, দরিদ্র, নারী ও সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলো তাদের ভিন্ন ভিন্ন অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও আদর্শিক সম্পদের পরিমাণ অনুযায়ী এই ত্রুটি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে। হতে পারে তা ইতিবাচক, নেতিবাচক বা দুটোরই সংমিশ্রণ।

এসব ত্রুটির প্রভাবকে আবার বৃহত্তর কাঠামোগত উপাদান নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। এগুলো হলো দল-রাষ্ট্র বা দল-সমাজ সম্পর্কের ধরন (‘দলতান্ত্রিক’২ অথবা দলতান্ত্রিক নয়); রাজনীতির ধরন ‘কর্মসূচিভিত্তিক’ কি না (যেমন যেখানে রাজনীতিবিদেরা বা দল বিশেষ নীতিগত অবস্থান নেয় এবং নির্দিষ্ট নির্বাচনী এলাকায় পূর্ববর্তী নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির জন্য তা পূরণের চেষ্টা করে) বা ‘ক্লায়েন্টভিত্তিক’ কি না (যেমন দল/রাজনীতিবিদেরা তাদের এলিট পৃষ্ঠপোষকদের নির্দিষ্ট চাহিদা পূরণেই অনেকাংশে ব্যস্ত থাকে, কারণ এসব এলিট বহুসংখ্যক ক্লায়েন্ট জোগাড় করার ক্ষমতা রাখে; রাজনীতিবিদদের অবস্থান এসব এলিটের স্বার্থ অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়)।

জনগণের প্রতিনিধিগণ ও নাগরিকদের মধ্যে দায়বদ্ধতার প্রকৃত ধরন বিশ্লেষণ করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ‘জবাবদিহি’ হলো ক্ষমতাবানেরা নিজে থেকেই যখন তাদের কাজের জন্য দায়ী হতে বা দায়িত্ব নিতে বাধ্য থাকে। কাগজে-কলমে ইউপি নেতারা মূলত ‘নির্বাচনী জবাবদিহি’র মাধ্যমে নাগরিকদের কাছে দায়ী থাকে, যা ‘উল্লম্ব জবাবদিহি’ (Vertical acountability) হিসেবে পরিচিত। এই ধরনের জবাবদিহি সময়মতো নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নাগরিকদের দাবি-দাওয়া প্রকাশ করার মাধ্যমে বজায় রাখা হয়। নির্বাচনী জবাবদিহির মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিদের কেবল নির্দিষ্ট সময় পরপর সঠিক পথে পরিচালিত করার সুযোগ প্রদান করে (বাংলাদেশের ইউপির ক্ষেত্রে প্রত্যেক পাঁচ বছরে একবার)। কিন্তু দুটি নির্বাচনের মধ্যবর্তী সময়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দায়বদ্ধ করতে পারে না। সামাজিক জবাবদিহি নির্বাচনী জবাবদিহির সীমাবদ্ধতাকে দূর করতে পারে। নাগরিকেরা বা সিভিল সোসাইটি সংগঠন যখন সরাসরি নির্বাচিত নেতাদের জবাবদিহি নিশ্চিত করে, সেটাকে সামাজিক জবাবদিহি বলে। এর ফলে নাগরিকেরা জবাবদিহি, নেতাদের কর্মদক্ষতা পর্যবেক্ষণ এবং নীতি সিদ্ধান্ত ও উন্নয়ন বাজেটের ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে দর-কষাকষি এবং সেবা প্রদান প্রণালিগুলো নিয়মিত দাবি করতে পারে।

কার্যকরী নির্বাচনী জবাবদিহি প্রক্রিয়া

ভবিষ্যত্ নির্বাচনে জিততে শক্তিশালী প্রণোদনা: কীভাবে তা নির্বাচনী জবাবদিহিতাকে প্রভাবিত করে?

বেশির ভাগ ইউপি নেতার জন্য নির্বাচনে জয়লাভ করাটা একবারের বিষয় নয়। এই মর্যাদা ধরে রাখতে এবং পরবর্তী নির্বাচনগুলোয় জয়লাভ করতে তাঁরা বেশ ভালোই উত্সাহী। এই প্রণোদনা জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে তাঁদের আচরণ ও কাজকে অনেকাংশে প্রভাবিত করে। এর মানে হলো বিভিন্ন ধরনের প্রভাবশালী মধ্যবর্তী বা মূল সমর্থক গোষ্ঠী, ভোট ব্যাংক এবং ‘অবশিষ্ট’ সাধারণ ভোটারদের দাবি মেনে নেওয়ার রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা তাদের জন্য অগ্রাধিকারমূলক কাজ হয়ে ওঠে (দাবিগুলো প্রায়ই সাংঘর্ষিক ও চূড়ান্তভাবে জয়, না হয় পরাজয়ের মতো)। এটা আরও বেশি জটিল হয় যখন দাবিগুলো শ্রেণি ভেদাভেদ, ধর্মীয় পরিচয়, আঞ্চলিকতা (দেশি), আত্মীয় ও গোষ্ঠী এবং স্থানীয় বিবেচনার বিষয় দ্বারা প্রভাবিত।

একজন চিরাচরিত ইউপি চেয়ারম্যানের জন্য ভোটারদের ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও সামষ্টিক চাহিদা পূরণে ভারসাম্য রক্ষার কাজটি করতে বিভিন্ন কৌশলগত বিষয় বিবেচনা করতে হয়। এই কাজের মধ্যে অনেক সংবেদনশীল বিষয়ও রয়েছে। যেমন খুব বিপদে থাকা (যৌতুক বা অসুস্থতা) কোনো ব্যক্তির চাহিদা মেটানো (প্রয়োজনে দান করা) বা নির্বাচনে জেতার স্বার্থে সমাজে প্রভাবশালী এলিটদের সঙ্গে ভালো আন্তসম্পর্ক রক্ষা করা (ব্যক্তিগত সামাজিক মূলধন রক্ষা ও বৃদ্ধি করা)। এ ক্ষেত্রে নির্দয়ভাবে গরিব ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থকেও তারা এড়িয়ে যায় (যেমন মধ্যস্থতার সময় অতিমাত্রায় পক্ষপাতিত্ব গ্রহণ করা বা গরিবদের বঞ্চিত করে সচ্ছল আত্মীয়স্বজনকে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর সুবিধা দেওয়া)। এটা বলা প্রয়োজন, কোন মধ্যস্থতায় পক্ষপাতিত্ব করাটা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। বেশির ভাগ ইউপি নেতাই পক্ষপাতিত্ব করলেও তাঁরা চান না ধরা পড়ুক। কারণ সমাজে তাঁরা ‘ন্যায্য ও সুষ্ঠু’ হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করতে চান যখন আনুষ্ঠানিক [গ্রাম্য আদালত, সালিসি পরিষদ (Arbitration Council)৩] ও অনানুষ্ঠানিক (সালিস৪) ন্যায়বিচার-সম্পর্কিত কাজ করে। ইউপি নেতাদের জন্য নির্বাচনে জিততে হলে পছন্দনীয় ক্লায়েন্ট গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সুবিধা বণ্টন করে দিতে হবে এবং নিজেকে সমতা ও সুষ্ঠুতার প্রতীক বলে দাবি করলে পক্ষপাতহীন কাজ করতে হবে। এই দুটোর মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা তার জন্য জরুরি এবং নিয়ত চ্যালেঞ্জও বটে। কিন্তু ইউপি নেতাদের জন্য এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, কারণ রাজনৈতিক ভবিষ্যত্ ও নির্বাচনী সফলতা এই ভারসাম্য বজায় রাখার ওপর নির্ভর করে।

নির্বাচনে জয়—দলীয় সংশ্লিষ্টতা কি প্রভাব রাখে?

নির্বাচনে জেতার জন্য দলীয় সংশ্লিষ্টতা খুব কমই ভূমিকা রাখে (ইউপি নেতাসহ উত্তরদাতাদের মূল্যায়ন দেখে বোঝা যায় এটা মোটামুটি ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ভূমিকা রাখে)। এ ছাড়া এটুকু শুধু ইউপি চেয়ারম্যানের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য যা অন্য ইউপি সদস্যদের বেলায় আবার খাটে না। সংসদীয় নির্বাচনের সঙ্গে এর বেশ পার্থক্য রয়েছে। কারণ সংসদীয় নির্বাচনে দলীয় সংশ্লিষ্টতাই জয়ের জন্য মুখ্য ভূমিকা রাখে। উপজেলা নির্বাচনের ক্ষেত্রেও দলীয় পরিচয় কিছুটা ভূমিকা রাখে। এমনকি একজন ইউপি নেতার জন্যও স্থানীয় উপজেলা চেয়ারম্যান বা এমপির সঙ্গে দৃশ্যমান সম্পর্ক থাকলে তার রাজনৈতিক বা নেটওয়ার্ক মূলধন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হয়। প্রমাণাদি দেখে মনে হয় নির্বাচনে জেতার সম্ভাবনা বেড়ে যায় যদি কোনো ইউপি নেতার উপজেলা চেয়ারম্যান বা এমপির সঙ্গে রাজনৈতিক মিল থাকে, কারণ ভোটাররা দেখতে চান নেতার রাজনৈতিক নেটওয়ার্ক কেমন।

ইউপি নেতার কর্মসাধন (Performance) সম্পর্কে ভোটারদের ধারণা

গবেষণা এলাকার একজন ইউপি নেতা বলেন যে ইউনিয়ন পরিষদের শাসনপ্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে চলছে কি চলছে না, সেটা নিয়ে মানুষের তেমন আগ্রহ নেই। শুধু যখন কোনো উন্নয়ন প্রকল্প আসে বা সেবা প্রদান-সম্পর্কিত কর্মসূচি আসে, তখন তারা ইউপির শাসনব্যবস্থা প্রক্রিয়া নিয়ে আগ্রহী হয়ে পড়ে। জনগণের সঙ্গে ইউপির সম্পর্ক শুধু দৃশ্যমান সেসব কর্মসূচির সঙ্গে, যেগুলোকে মানুষ তাদের স্বার্থের সঙ্গে জড়িত বলে মনে করে। এলিটদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো, সিদ্ধান্ত প্রণয়ন-প্রক্রিয়ায় তাদের কার্যকরী নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে নিজের লোকদের সুবিধা প্রদান করতে পারা। অন্যদিকে গরিবদের মূল ভাবনা হলো, সুবিধা দেওয়ার তালিকায় তাদের নাম উঠল কি না সেটা। আবার এলিটরা যখন ইউপি নেতাদের কর্মদক্ষতা মূল্যায়ন করতে চায়, তখন বুঝতে হবে তারা তাদের পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়াটা নিশ্চিত করতে চায়। গরিবদের জন্য অগ্রাধিকারমূলক বিষয় হলো বিভিন্ন কল্যাণমূলক প্রকল্প বণ্টন-প্রক্রিয়ায় সুষ্ঠুতা ও সমতার বিষয়গুলো কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে কি না।

বর্তমানে ইউপি নেতাদের কর্মদক্ষতা-সম্পর্কিত জ্ঞান আগের তুলনায় ভোটারদের মধ্যে বেশি। এর কারণ হলো বিভিন্ন ইউপি-সম্পর্কিত আইন প্রণয়ন (২০০৯ আইন, স্ট্যান্ডিং কমিটিগুলোতে নাগরিকদের অন্তর্ভুক্ত করার বিধান); উন্নয়ন কর্মসূচিতে সামাজিক দায়বদ্ধতা পদ্ধতি চালু করা (যেমন এলজিএসপির জন্য গণসমাবেশ); তথ্যপ্রযুক্তির সূচনা ও ইউপির মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন (ওয়ার্ড সভা, স্ট্যান্ডিং কমিটি, উন্মুক্ত বাজেট আলোচনা ইত্যাদি) এবং এনজিও কর্তৃক নাগরিক/সুবিধা গ্রহণকারীদের সংঘবদ্ধ করা। ইউপির উন্নয়ন বরাদ্দ প্রদানের ক্ষেত্রে স্ট্যান্ডিং কমিটিগুলো এখন সামাজিক ও রাজনৈতিক এলিট, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত (স্কুলশিক্ষক, সামাজিক কর্মী) ও এনজিও কর্তৃক নির্ধারিত দরিদ্রতর শ্রেণি থেকে ‘স্বভাব নেতাদের’ নিয়োজিত করা। এই ব্যক্তিগুলো সাধারণ মানুষের জন্য মূল মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। এরা সাধারণ মানুষকে ইউপি নেতাদের কর্মদক্ষতা সম্পর্কে তথ্য প্রদান করে, বিশেষ করে সম্পদ বণ্টন-সম্পর্কিত তথ্য। মধ্যবিত্ত সামাজিক নেতারা সুবিধা গ্রহণকারী ব্যক্তিদের তালিকা প্রণয়নে দুয়ারে দুয়ারে যায়। তাই তারা এসব তালিকা প্রণয়নে স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু তথ্যের নির্ভরযোগ্য মাধ্যম। আরেকটি তথ্যের মাধ্যম হলো ইউপি কার্যক্রমে এনজিও কর্মসূচি। বিশেষ করে নারীরা ইউপি কার্যাবলি সম্পর্কে জানতে পারে এনজিওগুলোর মাধ্যমে। এনজিও কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ফোরাম ধীরে ধীরে নাগরিকদের গুরুত্বপূর্ণ সচেতনতা তৈরির আশ্রয় হয়ে উঠছে। ইউপি কার্যাবলি ও সভ্যদের কর্মদক্ষতা সম্পর্কে জানার ক্ষেত্রে অন্যান্য অপ্রাতিষ্ঠানিক পন্থাও রয়েছে। এগুলো হলো জনশ্রুতি এবং উন্নয়ন বরাদ্দে যারা ইউপি কার্যাবলির সঙ্গে অনেক বেশি জড়িত হতে চায় তাদের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য।

 ভোটার/নাগরিকদের ভাবনা/দাবি: ভোটাররা কোন বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দেয়?

নেতাদের প্রতি ভোটারদের প্রত্যাশার একটি স্পষ্ট শ্রেণিভিত্তিক কাঠামো আছে। এই কাঠামোটি সেবা প্রদান ও পাবলিক গুডস দেওয়ার ক্ষেত্রে ইউপি নেতাদের প্রণোদনা কাঠামোকে বুঝতে সাহায্য করে। অতিদরিদ্ররা বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী সম্পর্কিত সেবা (যেমন: ভিজিডি, ভিজিএফ, বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতা, কাজের বিনিময়ে টাকা, ৪০ দিনের কর্মসংস্থান কর্মসূচি ইত্যাদি) এবং বিভিন্ন ধরনের ত্রাণ কর্মসূচি নিয়ে ভাবে। মজার বিষয় হলো কাজের বিনিময়ে খাদ্য ও ৪০ দিনের কর্মসংস্থান কর্মসূচির বাড়তি প্রভাব রয়েছে। এসব কর্মসূচির ফলাফল হলো নতুন নির্মিত বা সংস্কারকৃত অবকাঠামো, সড়ক, কালভার্ট ইত্যাদি। এসব অবকাঠামোর ব্যাপারে মধ্যবিত্ত এবং গ্রামের ধনী যারা মূলত ব্যবসায় জড়িত, তাদের মধ্যে বেশ আগ্রহ রয়েছে। তাই অবকাঠামোগত উন্নয়নের সঙ্গে জড়িত সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচিগুলোও পাবলিক গুডস এবং এদের চাহিদা অর্থনৈতিক শ্রেণিগুলোর মধ্যে প্রভাব ফেলে।

টেবিল ১: বিভিন্ন শ্রেণির ভোটারদের চাহিদার ধরন

শ্রেণি/গোষ্ঠী

চাহিদার ধরন

সম্পৃক্ততা ও বাড়তি প্রভাবের ধরন

গ্রামীণ ধনিক ও এলিট ভোটার

পাবলিক গুডস: সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ, সেচব্যবস্থা; স্কুল/মসজিদ নির্মাণ স্থান নির্ধারণ; আইনশৃঙ্খলা রক্ষা

উচ্চমাত্রা: এই বিষয়গুলোতে পরামর্শ প্রত্যাশা করে

মধ্যবিত্ত শ্রেণি ভোটার

সারে ভর্তুকি, কৃষি পণ্যের জোগান, গভীর নলকূপ স্থাপন; আইনশৃঙ্খলা রক্ষা

উচ্চমাত্রা

গরিব ভোটার

সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী; চাকরি কর্মসূচি

উচ্চমাত্রা: চাকুরি কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হতে আগ্রহী

তথ্যসূত্র: লেখকদ্বয়

গ্রামীণ সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভোটারদের জন্য মূল চিন্তার বিষয় হলো সার ও অন্যান্য কৃষিপণ্যসংক্রান্ত ভর্তুকি। তারা আশা করে ইউপি নেতারা এসব জিনিস ও নলকূপের জোগান সহজতর করবেন। ধনিক শ্রেণি স্থানীয় পাবলিক গুডসের বৃহত্ জোগান আশা করে (এলাকায় সড়ক ও কালভার্ট এবং সেচব্যবস্থা নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ)। তারা এটাও ভাবে যে ইউপি নেতা স্কুল/মাদ্রাসা এবং মসজিদ/মন্দির, নলকূপ ইত্যাদি নির্মাণের স্থান নির্ধারণের সময় তাদের সঙ্গে পরামর্শ করবেন। এ ছাড়া তারা চায় ইউপি নেতারা তাদের সঙ্গে সামাজিক পরামর্শ করবেন, যেন তাদের ক্লায়েন্ট/অনুসারী, আত্মীয়স্বজনেরা পাবলিক গুডস এবং সেবার ‘যথাযথ’ অংশ পেতে পারে। মধ্যবিত্ত ও ধনিক শ্রেণি উভয়েরই আইনশৃঙ্খলার ব্যাপারে যথেষ্ট ভাবনা রয়েছে। এই শ্রেণিগুলোর অগ্রাধিকার দাবি হলো সামাজের প্রয়োজনীয় সম্পত্তির সুরক্ষা। ইউপি নেতাদের মধ্যেও ছোটখাটো চুরি ও অর্থনৈতিক অপরাধ কমানোর তাগিদ রয়েছে, যেন তারা এলিটদের মধ্যে নিজেদের বৈধতা রক্ষা করতে পারে।

অসম রাজনৈতিক ও সামাজিক সামর্থ্যসম্পন্ন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ভিন্ন ভিন্ন দাবি-দাওয়ার ফলে ইউপি নেতাদের জন্য একটি জটিল প্রণোদনা কাঠামো তৈরি হয়, যা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইউপি নেতৃত্বের ভূমিকাকে জটিল করে ফেলে। নিচের আলোচনায় দেখা যাবে, ভূমিকা রাখার ধরন ও পরিমাণ অনেকাংশে নির্ভর করে কাঠামোগত বিষয়গুলোর ওপর। এই কাঠামোগত বিষয়গুলো হলো স্থানীয় ও বৃহত্তর এলিট রাজনৈতিক সমঝোতার ধরন যেখানে ইউপি নেতারা সম্পৃক্ত এবং এজেন্সির উপাদানগুলো, যেমন সংশ্লিষ্ট নেতৃত্বের রাজনৈতিক দক্ষতা, যা দিয়ে রাজনৈতিক-কাঠামোগত উপাদানের মারপ্যাঁচের মাধ্যমে প্রভাবিত করা যায়।

কে জিতে নির্বাচনে?

যেসব ইউপি নেতার মধ্যে নিম্নোক্ত কিছু ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য থাকে তাদের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। এগুলো হলো ব্যক্তিগত নেতার বেশি পরিমাণ সামাজিক মূলধন৫(সামাজিক পরিচিতি সম্পর্ক ইত্যাদি), দ্বন্দ্ব মেটানোর ক্ষেত্রে সক্রিয় ও দক্ষ এবং কমিউনিটি সদস্যদের ব্যক্তিগত কল্যাণমূলক চাহিদা পূরণে বেশি সংবেদনশীল ও সক্ষম। নেতাদের বংশগত মর্যাদাও (পারিবারিক ঐতিহ্য, আত্মীয়তা) গুরুত্বপূর্ণ। যদি সম্ভাব্য নির্বাচনী প্রার্থী রাজনৈতিক জীবনে সফল হতে চায়, তাহলে ওপরে বর্ণিত সবগুলো গুণ প্রাথমিকভাবে থাকতে হবে। এই শর্তগুলো প্রয়োজনীয়, তবে যথেষ্ট নয়।

আরও যেসব শর্ত পূরণ করতে হবে, তা অনেক বেশি রাজনৈতিক-কৌশলগত ধরনের। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হলো নেটওয়ার্ক মূলধন। নেটওয়ার্ক মূলধন এলিট অংশের কিছু উপাদানের সঙ্গে এবং শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির সঙ্গে ভালো নেটওয়ার্ক রক্ষা করার মাধ্যমে নিশ্চিত হয় এবং এই শ্রেণিগুলো ইউপি নেতা ও কমিউনিটির মধ্যে যোগাযোগকারী হিসেবে কাজ করে। যেকোনো প্রার্থীর জন্য নির্বাচনী প্রক্রিয়ার এসব গোষ্ঠী ‘মূল সমর্থক গোষ্ঠী’ হিসেবে বিবেচিত এবং তাদের ক্লায়েন্ট গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে প্রবেশ করাটা নির্বাচনে জেতার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। এ ধরনের ব্যক্তিদের ‘মূল সমর্থক গোষ্ঠী’ ধরা হয়, কারণ তারা রাজনৈতিক বিনিয়োগকারী (ভোট ব্যাংকগুলো নিশ্চিত করে) এবং বিভিন্ন সামাজিক ও ক্লায়েন্ট গ্রুপগুলোর পৃষ্ঠপোষক, যে গ্রুপগুলো আঞ্চলিকতা, ধর্মীয় পরিচয়, আত্মীয়তা ও স্থানিকতার ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়। এসব সামাজিক বিভক্তি সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকা নির্বাচনে জয়ী হতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। খোকশাবাড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচনী কৌশল সম্পর্কে বলেন, এখানে নির্বাচনে জিততে হলে স্থানীয় সামাজিক বৈশিষ্ট্যগুলো বিবেচনায় নিতে হবে, যারা স্থানীয় এলাকার নয় তাদের মানুষ ভোট দিতে চায় না।

অন্য বিষয়গুলো যা ভূমিকা রাখে তা হলো ধর্মীয় পরিচয় (আমাদের গবেষণায় হিন্দু ও মুসলিম) এবং অভিবাসীরা যে এলাকা থেকে এসেছে সে অনুযায়ী আঞ্চলিক পরিচয় (এ ক্ষেত্রে টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, কোচবিহার [ভারত] ইত্যাদি)। নির্বাচনী হিসাবনিকাশে জটিলতাটি ইউপি নির্বাচনের একজন নারী প্রার্থীর ঘটনা থেকে অনুমান করা যায়। খোকশাবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদে একজন নারী প্রার্থী তাঁর আঞ্চলিক/স্থানীয় এলাকা থেকে সমর্থন পেয়েছিলেন, এমনকি বিরোধী রাজনৈতিক দল থেকেও। আত্মীয়তা ও আঞ্চলিক বিষয়গুলো সরাসরি দলীয় বিবেচনাকে স্পষ্টতই ছাপিয়ে গিয়েছিল। প্রকৃত নির্বাচনী হিসাবনিকাশে জেন্ডারবিষয়ক গুরুত্বও রয়েছে। নারী প্রার্থীর ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলো চায় তাদের ‘লোকেরা’ সংরক্ষিত আসনগুলো ধরে রাখুক; তাই তারা নির্দিষ্ট কিছু রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী পরিবার থেকে আসা নারীদের সমর্থন দেয়, যাদের নির্বাচনে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এলিট পরিবারগুলো তাদের নারীদের নির্বাচনে আসতে দেয় সম্মান এবং ইউপিতে আরও বেশি প্রবেশাধিকার পাওয়ার জন্য। স্বামীরা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে। তাই তাদেরও নারী প্রার্থিতা সমর্থন করার জোরালো কারণ রয়েছে, যা তাদের ব্যক্তিগত প্রভাব ও সম্পদের নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। প্রশ্ন হলো, কীভাবে এলিট পৃষ্ঠপোষকেরা, যারা ‘মূল নির্বাচনী ক্ষেত্র’ হিসেবে কাজ করে, তাদের স্ব স্ব ক্লায়েন্ট গ্রুপগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে? ক্লায়েন্টদের আনুগত্য (ভোট দেওয়ার পছন্দ হিসেবে) অর্থনৈতিক নির্ভরতার মাধ্যমে বজায় রাখা হয়। গরিবেরা পৃষ্ঠপোষকদের ভূমিতে বসবাস করে, তাদের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে সারা বছর কাজ করে (বাণিজ্যিক ফার্ম, শিল্প-কারখানা), চাষাবাদের জন্য জমি লিজ নেয়, চরম দুঃসময়ে ঋণ অথবা দান করা অর্থ পায় (বিয়ে, যৌতুক, অসুস্থতা ইত্যাদি) এবং সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী, দ্বন্দ্ব মীমাংসা ইত্যাদিতে পৃষ্ঠপোষকদের রাজনৈতিক প্রভাবের ওপর নির্ভর করে। আমাদের মূল তথ্যদাতারা পর্যবেক্ষণ করেছেন যে ভোটারদের একটি বড় অংশ (বতলাগাড়ি ইউনিয়নের আনুমানিক ৩০ শতাংশ) এসব অর্থনৈতিক নির্ভরতা ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে বিভিন্ন পৃষ্ঠপোষকদের প্রতি অনুগত থাকে। কিন্তু এই অবস্থা এখন কমে যাচ্ছে, কারণ চাকরির খোঁজে গ্রামবাসী অন্যান্য অঞ্চলে চলে যাচ্ছে। নির্বাচনে বিজয়ী হতে কর্মসক্ষমতা (সেবা প্রদানের সামগ্রিক মান, প্রকল্প বাস্তবায়নের হার ও মান ইত্যাদি) কম গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ভোটাররা এসব বিষয়ে খুব কমই মনোযোগ দেন। একজন ইউপি সচিব বলেন:

সাধারণত পূর্ববর্তী ইউপি নেতা ও বর্তমান নেতাদের কর্মসাধনের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। যেমন আগের এবং বর্তমানের উভয় নেতারাই রিলিফের চাল চুরি করে, বিনা মূল্যে সেবা দেওয়ার পরিবর্তে টাকা দাবি করে এবং দুর্নীতিতে যুক্ত হয় ও উন্নয়নের অর্থ অপব্যবহার করে। নির্বাচিত নেতারা তাদের সাধারণ কর্মসক্ষমতা বা ব্যক্তিগত সততা দিয়ে মূল্যায়িত হন না।

ইউপি চেয়ারম্যানের ক্ষেত্রে ভোটারদের প্রণোদনার এই ব্যাখ্যা অনেকাংশেই সত্য। কিন্তু ইউপি সদস্যরা অনেকাংশেই তাদের ব্যক্তিগত সততা এবং সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী বরাদ্দে কর্মসক্ষমতার ভিত্তিতে মূল্যায়িত হয়। আমাদের গবেষণার ইউপিগুলোয় ধারাবাহিক নির্বাচনে ইউপি চেয়ারম্যানের তুলনায় সদস্যদের অর্জন অনেক বেশি। ইউপি সদস্যদের কর্মসক্ষমতা ও ব্যক্তিগত সততা অবলোকন করা সহজ, কারণ তারা কমিউনিটির কাছাকাছি থাকে। এ ছাড়া সেবার ধরন (যেমন নিরাপত্তাবেষ্টনী বণ্টন সদস্যদের নিয়মিত গরিবদের কাছে নিয়ে যায়) এবং সশরীরে যোগাযোগ (বিভিন্ন দৈনন্দিন কাজে) করার মাত্রাও ভূমিকা রাখে, যা সাধারণ মানুষ প্রত্যাশা করে। এসব পর্যবেক্ষণ ইউপি চেয়ারম্যানের ক্ষেত্রে তত প্রযোজ্য নয়। এর ফলে ভোটার হিসেবে সাধারণ নাগরিকদের ইউপি চেয়ারম্যানের কর্মসক্ষমতা ও ব্যক্তিগত সততা সম্পর্কে তুলনামূলক তথ্য ঘাটতি রয়েছে। এর মানে এই নয়, গরিব নাগরিকেরা চেয়ারম্যানের সক্ষমতা এবং ব্যক্তিগত সততার ব্যাপারে কম সচেতন (যেমনটি উপরে ইউপি সচিবের উদ্ধৃতি পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে), বরং চেয়ারম্যান সম্পর্কে সঠিক মূল্যায়ন করার মতো জ্ঞান তাদের নেই। এটা চেয়ারম্যানকে সম্ভবত এলিট ভোট ব্যাংকে (টাকার রাজনীতি, এলিট আত্মীয়তা নেটওয়ার্ক ইত্যাদি) এবং স্বল্প আকারে প্রভাবহীন নাগরিকদের ওপর মনোযোগ দিতে এবং রাজনৈতিকভাবে অধিক বিনিয়োগ করতে প্রণোদনা জোগায়। ইউপি চেয়ারম্যানের কাছে নির্বাচনী জবাবদিহি দরিদ্রদের চেয়ে অন্য গোষ্ঠীর প্রতি বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়।

এর মানে হলো যেটি নির্বাচনে জিততে ভূমিকা রাখে তা হলো কীভাবে প্রার্থী তার রাজনৈতিক সম্পর্ক (মূলত পৃষ্ঠপোষকতা-সংক্রান্ত সুবিধা বরাদ্দ প্রক্রিয়ার ভিত্তিতে) ‘মূল নির্বাচনী ক্ষেত্রে’র সঙ্গে সম্পাদন করে এবং ‘মূল সমর্থক গোষ্ঠীর’ সদস্যরা কৌশলগত হিসাবনিকাশের পর বর্তমান প্রার্থীদের

বিপরীতে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের সমর্থন দেয়। বর্তমান প্রার্থী এবং প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী উভয়কেই আগে থেকে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয় ও মূল সমর্থক গোষ্ঠীর ব্যক্তিদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে এসব উদ্যোগ থামাতে হয়। সম্পর্ক গড়ে ওঠে পৃষ্ঠপোষকতার সুবিধা ভাগাভাগি এবং আক্ষরিক অর্থেই এসব ব্যক্তির আনুগত্য ক্রয়ের ভিত্তিতে।

খোকশাবাড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বলেন: ‘যারা চেয়ারম্যানের জন্য প্রচারণা চালিয়েছিল তারা তাদের এলাকার অনুসারীদেরও বস্তুগত সুবিধা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। নির্বাচিত চেয়ারম্যানকে অবশ্যই সেসব ব্যক্তির অনুসারীদের প্রতি যেসব প্রতিজ্ঞা করা হয়েছিল সে ব্যাপারে নজর দিতে হবে, অন্যথায় তার বৈধতা থাকবে না।’ আনুগত্য ক্রয়ের শেষের কৌশলটি স্থানীয় নির্বাচনে ক্রমবর্ধমান অর্থের রাজনীতি চালু করেছে। টাকা দিয়ে ভোট ব্যাংক (মূল সমর্থক গোষ্ঠী) ও সাধারণ ভোটারদেরও কেনার ঘটনা বাড়ছেই। ৩০ লাখের উপরে (বেশির ভাগ উপাত্ত নিজ উদ্যোগে করা) পরিমাণ টাকাও সাম্প্রতিক নির্বাচনে ব্যয় হয়েছে। এটা বলতে হবে যে টাকার রাজনীতিটা অনেকগুলো কৌশলের মধ্যে একটি, যা নির্বাচনে জিততে হলে ব্যবহার করতে হয়। আবার কিছু কিছু প্রার্থী সাম্প্রতিক নির্বাচনে অনেক টাকা ব্যয় করেও জিততে পারেননি।

পেট্রন-ক্লায়েন্টভিত্তিক দায়বদ্ধতা প্রক্রিয়া

ইউপি নেতাদের জবাবদিহি আনুষ্ঠানিক নির্বাচনী প্রক্রিয়া বা সরাসরি জবাবদিহির মাধ্যমে নিশ্চিত হয়। আনুষ্ঠানিক জবাবদিহির প্রক্রিয়াও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ, যা সর্বব্যাপী বিরাজমান পেট্রন-ক্লায়েন্ট ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রবাহিত হয়। এটা আবার শ্রেণি, গোষ্ঠী ও আত্মীয়, ধর্মীয় গ্রুপ, আঞ্চলিকতা এবং স্থানীয়তাভিত্তিক পরিচয়ের মতো বিভিন্ন সামাজিক বিভক্তির কারণে টিকে থাকে। খুব বৃহত্ভাবে বলতে গেলে, ক্লায়েন্টভিত্তিক জবাবদিহি পদ্ধতি ‘সামাজিক বাধ্যবাধকতা ও রাজনৈতিক হিসাব’—দুটোর ওপর ভিত্তি করে চলে, যদিও বাস্তব ক্ষেত্রে একটি আরেকটিকে ছাপিয়ে যায়।

‘সামাজিক বাধ্যবাধকতা’ ভিত্তিক পৃষ্ঠপোষকতা বরাদ্দ-প্রক্রিয়া ‘পূর্ব রাজনৈতিক’ এবং প্রাচীন প্রথা, মূল্যবোধ এবং প্রত্যাশার দ্বারাও অনেকাংশে পরিচালিত হয়। এগুলোও আবার গোষ্ঠী ও আত্মীয়, আঞ্চলিক ও ধর্মীয় পরিচয় এবং স্থানীয় যুক্তি যেমন পাড়া ও প্রতিবেশীভিত্তিক পরিচয়ের সমাজতত্ত্ব দ্বারা গঠিত। যেসব নেতা এক বা একাধিক এসব সামাজিক গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে তারা বংশগত পরিচয়ের ভিত্তিতে যতটা নির্বাচনী রাজনৈতিক ও নৈতিক সমর্থন পায়, কৌশলগত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিবেচনায় ততটা পায় না এবং গোষ্ঠী প্রতিনিধিত্বকারীদের সমর্থন কম-বেশি নিশ্চিত (ভোট ব্যাংক অনুযায়ী)। এটা বতলাগাড়ি চেয়ারম্যানের ক্ষেত্রে আংশিক এবং খোকশাবাড়ি ইউনিয়নের নারী প্রার্থীর জন্য সম্পূর্ণ প্রযোজ্য।

অনেকটা আদর্শিকভাবে প্রতিনিধিত্বশীল নেতৃত্ব প্রকৃত সামাজিকভাবে নির্ধারিত সম্মতিতে ভোটব্যাংকগুলোকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পদ বরাদ্দের মাধ্যমে সহযোগিতা করতে বাধ্য। তাই নেতারা বংশভিত্তিক নির্বাচনী এলাকার কাছে দায়বদ্ধ থাকে এবং ভোটের বিনিময়ে সংশ্লিষ্ট কমিউনিটি নেতাদের অন্যান্য রাজনৈতিক ও সামাজিক সমর্থন দেয় (যা বিচারব্যবস্থা-সম্পর্কিত সেবা প্রদানে খুবই দরকার)। নির্ধারিত সুবিধাভোগীরা হলো সাধারণ গরিব এবং এগুলো সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী-সম্পর্কিত সুবিধা (ভিজিডি, ভিজিএফ, বয়স্ক ও বিধবা ভাতা, ৪০ দিন কর্মসংস্থান ইত্যাদি)। তাই যোগ্য গরিবদের একটি অংশ বংশভিত্তিক জবাবদিহি নেটওয়ার্কে থেকে কিছু সুবিধা নিশ্চিত করতে সক্ষম। মনে রাখতে হবে যে সামাজিক বাধ্যবাধকতাভিত্তিক জবাবদিহিকে প্রায়ই গোষ্ঠী ও আত্মীয়দের আদর্শভিত্তিক দেখাশোনা করার প্রতিশ্রুতি দ্বারা বৈধতা দেওয়া হয়, যারা একই সঙ্গে ‘যোগ্য গরিবও’। ইউপি নেতাদের চালাকিটা হলো, বন্ধু বা পরিবারের সদস্য, যারা ধনিক শ্রেণি, তাদের প্রকাশ্যে সুবিধা প্রদান এড়িয়ে যাওয়া। একজন ইউপি চেয়ারম্যান বলেন,

গরিব পারিবারিক সদস্য বা বন্ধুদের সাহায্য করাটা কোনো অন্যায় না...প্রত্যেকেরই আত্মীয়স্বজন আছে...যদি তাদের স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় ইউপি সম্পদ দেওয়া হয়, কেউ সমালোচনা করবে না...প্রশ্ন আসবে তখনই, যখন কোনো সচ্ছল আত্মীয় সুবিধা পায়।

‘রাজনৈতিক হিসাবভিত্তিক’ জবাবদিহি প্রাথমিকভাবে এলিট ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির সঙ্গে জড়িত, যাদের কাছে ইউপি নেতৃত্ব রাজনৈতিকভাবে দায়বদ্ধ। কারণ এ গোষ্ঠীগুলো নির্বাচনের সময় নেতাদের সমর্থন দিয়েছিল।

এখানে পৃষ্ঠপোষক সুবিধা বণ্টন (স্থানীয় পাবলিক গুডস, সেবা, নিরাপত্তাবেষ্টনী) কৌশলগত রাজনৈতিক সুবিধা বিনিময়ের ভিত্তিতে হয়, যা বংশগত বিবেচনাবহির্ভূত। এ ক্ষেত্রে পৃষ্ঠপোষকতা সুবিধা বরাদ্দ মূলত পাবলিক গুডসে দেওয়া হয় (অবকাঠামো, স্কুল, মসজিদ/মন্দির ইত্যাদি) যেখানে এলিট রাজনৈতিক বিনিয়োগকারীরা অনানুষ্ঠানিক সমঝোতার অংশ হিসেবে উন্নয়ন প্রকল্পের স্থান বাছাইয়ের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারে। রাজনৈতিক হিসাবভিত্তিক পৃষ্ঠপোষকতা সুবিধা বরাদ্দ গরিবদেরও উপকারে আসে, যারা এলিটদের পৃষ্ঠপোষকতা সুবিধা গ্রহণকারী ক্লায়েন্ট। গরিবদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী বরাদ্দের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক হিসাবভিত্তিক এলিট-নিয়ন্ত্রিত পৃষ্ঠপোষকতা নেটওয়ার্ক অনুসরণ করে এবং যেসব গরিব কোনো এলিট নেটওয়ার্কের অংশ নয়, তারা বাদ পড়ে।৬ তাই দেখা যায়, এই জবাবদিহি পদ্ধতি গরিবদের একটি অংশকে অন্তর্ভুক্ত করে যারা অন্যথায় কোনো পৃষ্ঠপোষকতা নেটওয়ার্ক ব্যবস্থার অংশ নয়। কারণ তারা জবাবদিহির বংশগত পরিচয়ভিত্তিক নেটওয়ার্কের অংশ নয়।

স্থানীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক সমঝোতার গতিপ্রকৃতি

ইউপি পর্যায়ে এলিট রাজনৈতিক সমঝোতা সাধারণত স্থানীয় এলিটদের প্রণোদনা ও স্বার্থের মতৈক্যের মাধ্যমে হয়। অধ্যায় ২-এ যেমনটি বলা হয়েছিল যে কার্যকর ও দীর্ঘস্থায়ী হতে হলে যেকোনো এলিট রাজনৈতিক সমঝোতাকে এমন হতে হবে যেখানে অবশ্যই ব্যক্তি বা সামষ্টিক এলিটদের ক্ষমতা ধরে রাখার ভারসাম্য প্রতিফলিত হয় এবং প্রণোদনাটি এমন হতে হবে যা সংশ্লিষ্ট অ্যাক্টরদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। স্থানীয় এলিটদের সমষ্টি বিভিন্ন ইউনিয়ন অনুযায়ী ভিন্ন হয়, কিন্তু স্বাভাবিকভাবে তারা সবাই রাজনীতিবিদ, অনেক জমির মালিক, ব্যবসায়ী, শিক্ষক, সাবেক সরকারি কর্মকর্তা ইত্যাদি। এসব ব্যক্তির সাধারণত গুরুত্বপূর্ণ কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে: তারা উচ্চ মর্যাদাশীল পরিবারের সদস্য: যেমন তাদের সামাজিক বংশ মর্যাদাভিত্তিক খ্যাতি রয়েছে, তাদের উল্লেখযোগ্য সম্পদ রয়েছে এবং সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে সংঘাত মেটাতে তাঁদের প্রয়োজনীয় সামাজিক প্রভাব রয়েছে।

অনেক এলিট ব্যক্তি ওপরের তালিকার দুই বা ততোধিক ভূমিকা পালন করেন। এসব ব্যক্তিই ওপরে বর্ণিত ইউপি নেতাদের জন্য ‘মূল নির্বাচনী ক্ষেত্র’ বলে বিবেচিত হয়। এলিট রাজনৈতিক সমঝোতায় রাজনৈতিক এলিটদের বেশি দর-কষাকষি দক্ষতা থাকে এবং ইউপি নেতাদের জন্য একটি চিরন্তন চ্যালেঞ্জ হলো স্থানীয় ও জাতীয় উভয় এলিটদের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাদের কার্যত স্বাধীনতা বজায় রাখা। একটি ইউনিয়নে স্থানীয় এলিটদের মধ্যে (এলিট ভারসাম্য) স্থিতিশীল ও কার্যকর শাসনব্যবস্থার জন্য ন্যূনতম শর্ত হলো একটি প্রকৃত রাজনৈতিক ও সামাজিক মতৈক্য। ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান ইউপির নাগরিকদের জন্য বিশেষ করে গরিবদের কল্যাণের ক্ষেত্রে এর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে। যেমন দ্বন্দ্ব নিরসনে কোনো আনুষ্ঠানিক (গ্রাম্য আদালত, সালিসি পরিষদ) বা অনানুষ্ঠানিক ফোরামে (সালিস) যেকোনো রায় প্রতিদ্বন্দ্বী এলিটদের মধ্যে একটি প্রকৃত সামাজিক ও রাজনৈতিক মতৈক্যের মাধ্যমে হতে হবে। অন্যথায় এসব রায় বাস্তবায়নযোগ্য হবে না বা ‘সুষ্ঠু ও ন্যায্য’ বলে বিবেচিত হবে না। এটা সম্ভাব্য বড় আকারের দ্বন্দ্বের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সত্য, যেটির আন্তসম্প্রদায় দিক রয়েছে এবং যা সাম্প্রদায়িক স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। আইনশৃঙ্খলার কার্যকর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক এলিটদের মধ্যে সমন্বয় জরুরি। তাই একটি স্থিতিশীল এলিট-রাজনৈতিক সমঝোতা স্থানীয় কমিউনিটির স্থায়ী শান্তি ও সম্প্রীতি অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ বলে বিবেচিত হয়।

স্থানীয় পর্যায়ে এলিট-রাজনৈতিক সমঝোতা থাকলে উপজেলা চেয়ারম্যান ও এমপির কাছ থেকে বেশি পরিমাণে সম্পদ আদায় নিশ্চিত করা সহজ হয়। এসব স্থানীয় পর্যায়ে সমঝোতার ফলে প্রাপ্ত সম্পদ বরাদ্দ নিয়ে এলিটরা জিরো-সাম (একজনের লাভ, অন্যের ক্ষতি) সংঘর্ষে জড়ায়, যার মাধ্যমে ইউনিয়ন পর্যায়ে ক্ষমতাসীন দলীয় নেতারা গরিবদের জন্য বরাদ্দকৃত উন্নয়ন সম্পদ বহুলাংশে নিয়ে নেয়। এলিট-রাজনৈতিক সমঝোতার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো এটি উন্নয়ন প্রকল্পসংশ্লিষ্ট সামষ্টিক কর্মসমস্যা (কালেকটিভ অ্যাকশন প্রবলেম) সমাধানে সাহায্য করে। যেমন সাধারণত স্কুল বা মসজিদ অথবা সড়ক সম্প্রসারণের জন্য জমি পাওয়া খুব কঠিন। এ ছাড়া এসব উন্নয়ন প্রকল্পে বিশাল আকারে জমি দরকার হয়। ইউপি নেতাদের জন্য এলিটদের উদ্বুদ্ধ করে জমি দান পাওয়া একটা মারাত্মক সমস্যা। এলিট সমঝোতা স্থিতিশীল এবং কম জিরো-সামভিত্তিক হলে এসব সমস্যা কম হয়। সামাজিক এলিট চাপের ফলে (রাজনৈতিক ও সামাজিক উভয়ই) অন্য ব্যক্তিরা সহজেই কমিউনিটির কাজের জন্য দান করে।

বেশির ভাগ এলিট নেতৃত্ব (বিশেষ করে ইউপি চেয়ারম্যান) বিভিন্ন রাজনৈতিক কৌশলের মাধ্যমে একটি কার্যকর পর্যায়ের স্থিতিশীল ও পজিটিভ-সাম এলিট মতৈক্য বজায় রাখতে চায়। এই কৌশলগুলো হলো সহযোগিতা, সহযোজন, মানিয়ে নেওয়া ও ছাড় দেওয়া এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক/সাম্প্রদায়িক বিভক্তিগুলোর মধ্যে জোট গঠন করা—ভিন্ন ভিন্ন সাফল্যের মাত্রায়। এ সাফল্য নির্ভর করে এজেন্সি বা ব্যক্তিগত নেতাদের রাজনৈতিক/সামাজিক প্রভাব বিস্তারের দক্ষতার ধরনের ওপর এবং বৃহত্তর কাঠামোগত বিষয়ের ওপর: যেমন ইউপি এবং তার উচ্চ পর্যায়ের প্রশাসনিক এককের মধ্যে সম্পর্কের ধরন। এটাকে বলে ইউপি এবং ওপরের স্তরে (উপজেলা, জেলা পর্যায়ে) রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনের মধ্যে প্রকৃত রাজনৈতিক মিলন। বতলাগাড়ি ইউনিয়নের একজন সামাজিক এলিট, ইউপি নেতাদের (মূলত ইউপি চেয়ারম্যান) রাজনৈতিক/ সামাজিক প্রভাব বিস্তারকারী সক্ষমতার ব্যাপারে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন:

[রাজনৈতিকভাবে চতুর নেতা] এলিটদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখে...তাদের সঙ্গে দেখা হলে সুহূদ্যতা বিনিময় করে...এলিটদের স্থানীয় দ্বন্দ্ব নিরসনে বিচার প্যানেলে আমন্ত্রণ জানায়, উন্নয়ন/সেবা প্রদান কাজ করার আগে পরামর্শ করে এবং এসব কাজে তাদের যুক্ত করে...এবং সাধারণত ইউপির শাসনব্যবস্থা প্রক্রিয়ায় তাদের পরামর্শ গ্রহণ করে।

স্থিতিশীল ও পজিটিভ-সাম এলিট-রাজনৈতিক সমঝোতার সুবিধা শুধু ইউপি নেতৃত্বই ভোগ করে না। সম্পর্কটা পরস্পর নির্ভরশীল। সামাজিক এলিটরাও এই মূল্যবান সামাজিক রাজনৈতিক সম্পদ স্থানীয় পাবলিক গুডস (অবকাঠামো, স্কুল, মসজিদ/মন্দির) থেকে শুরু করে বিশেষ সুবিধা পেতে ব্যবহার করে থাকে। বিশেষ সুবিধাগুলো হলো তাদের গরিব গোষ্ঠী ও আত্মীয়ের জন্য অর্থনৈতিক সম্পদের ব্যবস্থা করা এবং নিজেদের আত্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে কঠিন ও সংবেদনশীল দ্বন্দ্ব নিরসন করা, বিশেষ করে যেসব দ্বন্দ্ব শুধু তাদের নৈতিক ও রাজনৈতিক কর্তৃত্বের মাধ্যমে মেটানো সম্ভব নয়।

বৃহত্তর রাজনৈতিক সমঝোতা এবং ইউপি নেতাদের ওপর এর প্রভাব

ইউপি শাসনব্যবস্থাও বৃহত্তর রাজনৈতিক সমাজের মধ্যে প্রোথিত। অনেকাংশেই, ইউপি নেতৃত্বের রাজনৈতিক ক্ষেত্রটি উপজেলা চেয়ারম্যান ও স্থানীয় এমপির ক্লায়েন্টভিত্তিক রাজনৈতিক ধরন দ্বারা নির্ধারিত হয়। প্রাসঙ্গিক প্রশ্নগুলো হলো কোন দল স্থানীয় রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে? ইউপির শাসনব্যবস্থা প্রক্রিয়ায় এমপি/উপজেলা চেয়ারম্যানের ভূমিকা কী? ইউপি নেতৃত্ব কি দলীয় নেতাদের অধস্তন নাকি তারা নির্দিষ্ট পরিমাণ স্বাধীনতা বজায় রাখতে পারে? এই বৃহত্ পরিসরে কি ভারসাম্যপূর্ণ রাজনৈতিক সমঝোতা রয়েছে (এখানে কি নিচু স্তরের রাজনৈতিক সমঝোতার মতো একটি এলিট মতৈক্য রয়েছে, যা একটি পজিটিভ-সাম এলিট প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করে এবং যেখানে সচরাচর দেওয়া-নেওয়ার পদ্ধতি কাজ করে)?

আমাদের গবেষণা বলে যে ইউপি নেতৃত্বের রাজনৈতিক ক্ষেত্রটি উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত হয় স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে বিশেষ করে, উপজেলা পর্যায়ের আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনের সঙ্গে ইউপি নেতৃত্বের সম্পর্কের ধরনের ভিত্তিতে। আমলাতন্ত্রের ওপর ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক দলের প্রভাব থাকায় (দলতন্ত্রের একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দিক) রাজনৈতিক সমাজ এবং আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনের মধ্যে পার্থক্য করা ধীরে ধীরে কঠিন হয়ে পড়েছে। যার ফলে ইউপির ওপর প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ হচ্ছে, যার স্ববিরোধী দিকও রয়েছে। স্ববিরোধী দিকগুলো হলো নিরপেক্ষ আমলাতান্ত্রিক যৌক্তিকতার একটি মিশ্রণ (অনেক কিছুর মধ্যে কার্যকরী জবাবদিহি পদ্ধতি প্রতিপালন করা ও চর্চা করা এবং ইউপিতে নিরপেক্ষ আমলাতান্ত্রিক তদারকি নিশ্চিত করা) এবং দলীয় রাজনীতি (আমলারা সহজেই রাজনৈতিক নির্দেশ মেনে চলে এবং দলীয় পদ্ধতিতে আইন প্রয়োগ করে)। বতলাগাড়ি ইউনিয়ন পরিষদে এমন মিশ্রণ উল্লেখযোগ্যভাবে চোখে পড়ে (ভারসাম্যপূর্ণভাবেই হয় বলে প্রমাণ পাওয়া যায়)। অন্য দুটি ইউপিতে ভারসাম্যটি আমলাতন্ত্রের দলীয় বিবেচনার প্রতি ঝুঁকে বলে মনে হয়। এ ধরনের আমলাতান্ত্রিক হস্তক্ষেপ ইউপি পর্যায়ে একটি জটিল জবাবদিহির প্রক্রিয়া তৈরি করে। নিচের টেবিলে আমাদের গবেষণার তিনটি ইউপিতে বৃহত্তর রাজনৈতিক সমঝোতার কাঠামোগত বৈশিষ্ট্য ও গতিপ্রকৃতিগুলো সংক্ষেপে দেওয়া হয়েছে।

টেবিল ২: তিনটি ইউনিয়ন পরিষদে বৃহত্তর রাজনৈতিক সমঝোতা

শাসনব্যবস্থা নির্দেশক

বতলাগাড়ি ইউপি

খোকশাবাড়ি ইউপি

সারপুকুর ইউপি

নির্বাচনী শক্তি/ইউপি চেয়ারম্যানের জনপ্রিয়তা

রাজনৈতিক কাজের মেয়াদ অনেক দীর্ঘ (১৫ বছর)। দু্বার নির্বাচিত কিন্তু দায়িত্ব পালন বাধাগ্রস্ত হয়েছে

রাজনৈতিক কাজের মেয়াদ মধ্যম (৭.৫ বছর)। দুবার নির্বাচিত কিন্তু দায়িত্ব পালন বাধাগ্রস্ত হয়েছে

রাজনৈতিক কাজের মেয়াদ অনেক দীর্ঘ (১৬.৫ বছর)। চারবার নির্বাচিত কিন্তু দায়িত্ব পালন বাধাগ্রস্ত হয়েছে

দলীয় সংশ্লিষ্টতা

প্রকাশ্যে নির্দলীয় (গোপনে গোপনে বিএনপিপন্থী)

আওয়ামী লীগ

বিএনপি

বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান

বিএনপি

জাতীয় পার্টি

আওয়ামী লীগ

বর্তমান এমপি

আওয়ামী লীগ

আওয়ামী লীগ

জাতীয় পার্টি

সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে সম্পর্ক

কর্মকর্তাদের সঙ্গে শক্তিশালী ও কার্যকর নেটওয়ার্ক। অনেক এনজিও কর্মসূচি ইউপি নেতাদের উপজেলা প্রশাসনে ভালো অবস্থান করে দিয়েছে, যা প্রশাসন ও ইউপি নেতাদের মধ্যে একটি সহযোগিতার সংমিশ্রণ ঘটিয়েছে। এ ছাড়া ইউপি নেতাদের জেলা সমিতির সভাপতি হিসেবে তিনি উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে  বিশেষ সম্মান পান। এসব বিষয়ের কারণে, ইউপি সহজেই প্রশাসন থেকে সেবা ও কারিগরি সহায়তা পেয়ে থাকে। ফলে এটি ইউপির সম্পদ ও সেবা প্রদানে দক্ষতা বৃদ্ধি করেছে। নির্দিষ্ট রাজনৈতিক সমঝোতা উন্নয়ন দক্ষতার একটি শুভচক্র তৈরি করেছে। রাজনৈতিক সমঝোতা শাসক বদলের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় না।

ইউপি-আমলাতন্ত্র সম্পর্কটি নির্দলীয়/যৌক্তিক ভারসাম্য ও রাজনৈতিক বিবেচনার ওপর নির্ভরশীল।

ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে রাজনৈতিক সাদৃশ্য ও কিছু গুরুত্বপূর্ণ জ্যেষ্ঠ আমলার সঙ্গে ইউপি চেয়ারম্যানের বন্ধুত্ব থাকার ফলে সম্পর্কটা স্বাচ্ছন্দ্যময় ও একধরনের অশুভ আঁতাতের মতো। এখন অনেক সম্পদ পেয়ে থাকে কিন্তু এই ধরনের সুবিধা অনেক নড়বড়ে, যেহেতু ক্ষমতাসীন দলের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কর্মকর্তারা বদলি হয়ে থাকেন।

ইউপি-আমলাতন্ত্র সম্পর্কটি দলীয় বিবেচনার ওপর নির্ভরশীল।  

সরকারের তিনটি ভিন্ন ভিন্ন পর্যায়ে তিনজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির রাজনৈতিক মিল না থাকায় সম্পর্কটি বেশ দুর্বল। আমলাতন্ত্র থেকে সম্পদ পাওয়ার ক্ষেত্রে বিদ্যমান রাজনৈতিক সমঝোতার নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে।

ইউপি-আমলাতন্ত্র সম্পর্কটি দলীয় বিবেচনার ওপর নির্ভরশীল।  

ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে ইউপির সম্পর্ক

ইউপি চেয়ারম্যানের আত্মীয় নেটওয়ার্কের ভিত্তিতে একটি পজিটিভ-সাম সম্পর্ক। রাজনৈতিক সমঝোতা দল পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় না যেহেতু আত্মীয়তার বন্ধনের ফলে সব বড় রাজনৈতিক দলেই তাদের লোক রয়েছে।

ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জোরালো ও লাভজনকভাবে (সম্পদপ্রাপ্তিতে) সম্পৃক্ত। রাজনৈতিক সমঝোতা দল পরিবর্তনের ওপর নির্ভরশীল।

ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে দুর্বল, জিরো-সাম ও অলাভজনকভাবে (সম্পদপ্রাপ্তিতে) সম্পৃক্ত। অবস্থাটি ইতিবাচকভাবে সম্ভাবনাময় যদি ক্ষমতার পরিবর্তন ইউপি চেয়ারম্যানের পক্ষে যায়।

সূত্র: লেখকদ্বয়

টেবিল ২-এর প্রমাণাদি দেখে বোঝা যায় যে তিনটি ইউপির শাসনব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে ভিন্ন। অংশগ্রহণমূলক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসনব্যবস্থা দেখা যাচ্ছে বতলাগাড়িতে বেশি, যেখানে উন্নয়ন বরাদ্দ ও সেবা প্রদানে এক ধরনের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি রয়েছে (সুবিধাপ্রাপ্ত দরিদ্র হিসেবে)। অংশগ্রহণমূলক শাসনব্যবস্থা কিছুটা দেখা যায় খোকশাবাড়িতেও, কিন্তু স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাহ্যিক রাজনৈতিক প্রভাবের ফলে বহুলাংশে ছাড় দেওয়া হয়ে থাকে। এ দুটির তুলনায়, সারপুকুরের শাসনব্যবস্থা প্রক্রিয়াটি মোটেও অংশগ্রহণমূলক নয় এবং সেবা প্রদান ও উন্নয়ন বরাদ্দের ক্ষেত্রে খুব কম জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা দেখা যায়। শাসনব্যবস্থার কর্মসক্ষমতার পার্থক্যকে আমরা কীভাবে দেখব? রাজনৈতিক সমঝোতার পদ্ধতি কি এই পার্থক্য ব্যাখ্যা করতে পারে?

তিন ইউপির মধ্যে তুলনা

শাসনব্যবস্থার গুণগত মানে ভিন্নতা থাকলে নির্বাচনী জবাবদিহি কোনো ভূমিকা রাখে না। সব চেয়ারম্যানই নির্বাচনে ভালো ফল অর্জন করেছে। তিনটি ইউপির মধ্যে পার্থক্যের কারণ হলো ইউপি-রাজনৈতিক সমাজ ও ইউপি-আমলাতন্ত্রের সম্পর্ক। স্থানীয় শাসনব্যবস্থার বিভিন্ন স্তরে দলীয় সংশ্লিষ্টতার ধরন, ইউপি শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতাসীন দলের ভূমিকা এবং ইউপি ও আমলাতন্ত্রের সম্পর্কের ধরন তিন ইউপিতে ভিন্ন ভিন্ন শাসনব্যবস্থা হওয়ার কারণ ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে কাজে লাগবে।

বতলাগাড়ি ইউপির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সমঝোতার মূল বৈশিষ্ট্য হলো চেয়ারম্যান কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রকাশ্যে যুক্ত নন। এর ফলে অন্য দুই চেয়ারম্যানের তুলনায় এই চেয়ারম্যান দলতান্ত্রিক ক্ষমতাকাঠামোয় দর-কষাকষি ও পরিচালনার ক্ষেত্রে অনেক বেশি সুবিধা পায়। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক এলিটদের (উপজেলা, এমপি পর্যায়ে) সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বতলাগাড়ির চেয়ারম্যানের তুলনামূলক স্বাধীনতা থাকায় তিনি অপেক্ষাকৃত বেশি সমতাপূর্ণ ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় উন্নয়ন বরাদ্দ ও সেবা প্রদান-প্রক্রিয়ার পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা করতে পারে। যে ক্ষেত্রে চেয়ারম্যান সরাসরি কোনো দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন, সেখানে উন্নয়ন সিদ্ধান্তের রাজনীতি নির্ধারিত হয় স্থানীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে এবং সীমিত আকারে বৃহত্তর পর্যায়ে রাজনৈতিক বিবেচনার দ্বারা। এই ব্যাখ্যাটি অনেকাংশে গরিবদের সেবা প্রদানের সঙ্গে সম্পৃক্ত শাসনব্যবস্থা প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে সত্য এবং সীমিত আকারে উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন ও বরাদ্দের সঙ্গে সম্পৃক্ত শাসনব্যবস্থার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

বৃহত্তর পর্যায়ে রাজনৈতিক সমঝোতা বতলাগাড়ি ইউপি চেয়ারম্যানের প্রণোদনাকে খুব কম প্রভাবিত করে এবং দর-কষাকষির শর্তগুলো তার জন্য অসম হয়ে যায়। বতলাগাড়ির চেয়ারম্যানের মতো যারা স্থানীয় কমিউনিটিতে বংশগত কারণে ঐতিহাসিকভাবেই উচ্চপদস্থ/সমর্থিত, তারা রাজনৈতিক সমাজের ক্ষমতাবান সদস্যদের সঙ্গে দর-কষাকষির ক্ষেত্রে সুখ্যাত এবং রাজনৈতিক মূলধন হিসেবে বিবেচিত। বড় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বতলাগাড়ির চেয়ারম্যানের প্রভাব বিস্তারের সুযোগ রয়েছে, যেহেতু তার আত্মীয় নেটওয়ার্ক সব দলেই আছে। চেয়ারম্যান তাঁর অদ্বিতীয় ক্ষমতা এবং সামাজিক অবস্থানকে ব্যবহার করে ইউপিকে আরও এক্সক্লুসিভ ও অস্বচ্ছ উপায়ে পরিচালিত করতে পারত। কিন্তু তিনি স্থানীয় রাজনৈতিক ও সামাজিক এলিটদের একত্র করে একজন মতৈক্য প্রতিষ্ঠাকারী হতে চেয়েছেন। উন্নয়ন-প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণকে উত্সাহিত করার মাধ্যমে তিনি এমন শাসনব্যবস্থা চালু করেছেন, যা এনজিও ও সরকার উভয়কেই তার ইউপির সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে আগ্রহী করেছে। এর ফলে তিনি অনেক সম্পদ জোগাড় করতে পেরেছেন। এর সবই আবার সেবা প্রদান ও সুপ্রকল্প ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে দক্ষতা উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছে। ভালো নেতৃত্ব ও বাহ্যিক সহায়তার শুভচক্রের ফলে এমন একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও দক্ষ ইউপি শাসনব্যবস্থার উদ্ভব হয়েছে, যাকে সরকার রোল মডেল বলে মনে করে থাকে। মজার ব্যাপার হলো বতলাগাড়ির চেয়ারম্যান আরবিএনএস-কেয়ারের মতো এনজিওকে সাফল্যের জন্য দায়ী মনে করেন, যাদের কর্মসূচি তাঁর ইউপির সঙ্গে উপজেলা আমলাতন্ত্রের ভালো নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করেছে এবং সরকারি কর্মকর্তা ও অন্যান্য আশপাশের ইউপি থেকে সদস্যদের আমন্ত্রণ জানিয়ে তার ইউপি সম্পর্কে ভালো ধারণা তৈরিতে সাহায্য করেছে।

খোকশাবাড়ি ইউপি চেয়ারম্যান ক্ষমতাসীন দলের এমপির সঙ্গে হুবহু রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা থাকায় কৌশলগতভাবে প্রথাগত সুবিধা ভোগ করে। একটি দলতান্ত্রিক রাজনৈতিক বিন্যাসে, এমন সঠিক রাজনৈতিক মিল সরকারি সম্পদের প্রাপ্তি সহজভাবে নিশ্চিত করে, কিন্তু ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের লোকদের কথা ধরলে চেয়ারম্যানের জন্য স্বাধীন রাজনৈতিক ক্ষেত্র তৈরি কঠিন হয়ে পড়ে। যদিও সম্পদের সহজলভ্যতার ফলে খোকশাবাড়ি ইউপি প্রথাগত ক্লায়েন্টভিত্তিক পৃষ্ঠপোষকতা নেটওয়ার্কের বাইরে যোগ্য গরিবদের জন্য অনেক সম্পদ বরাদ্দ করতে পেরেছে, কিন্তু উন্নয়ন বণ্টন ও সেবা প্রদানসংক্রান্ত শাসনব্যবস্থা প্রক্রিয়া তত স্বচ্ছ নয়, বহুলাংশে এক্সক্লুসিভ এবং ক্ষমতাসীন দলের এলিট কর্তৃক অনেক বেশি প্রভাবিত হয়ে থাকে।

খোকশাবাড়ি ইউপির ওপর ক্ষমতাসীন দলের নিয়ন্ত্রণ (এ ক্ষেত্রে বলা যায়, অগ্রহণযোগ্য নিয়ন্ত্রণ) একটি ঘটনা থেকে বোঝা যাবে। খোকশাবাড়ি ও বতলাগাড়ি ইউপির বয়স্ক ব্যক্তিরা বয়স্ক ভাতা নিয়ে আসতে নিয়মিত জেলা সদরে (নীলফামারী) যেত, কারণ ব্যাংকগুলো সেখানে রয়েছে। বৃদ্ধ মানুষের জন্য এই প্রক্রিয়া বেশ কষ্টসাধ্য ও দীর্ঘ (সারা দিন লাগে)। উভয় চেয়ারম্যানই ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে অনুরোধ করে যেন কমপক্ষে তাদের দুজন লোককে নিয়মিত পাঠিয়ে এখানে বয়স্ক ভাতা বণ্টন করে দিয়ে যায়, যাতে বয়স্করা শহরে যাওয়ার দীর্ঘ ভ্রমণ থেকে রেহাই পায়। দুই ইউনিয়নেই কিছু স্বেচ্ছাসেবক মিলে বয়স্ক ব্যক্তিদের কাছ থেকে ২০ টাকা করে নিয়ে ব্যাংকের লোকদের জন্য দুপুরের খাবার ব্যবস্থা করে। খোকশাবাড়ি ইউনিয়নে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা (আওয়ামী লীগ এ ক্ষেত্রে) শিগগিরই ইউপি চেয়ারম্যানের ওপর এই মহত্ ব্যবস্থা বন্ধ করতে দুটি যুক্তি তুলে ধরল: চেয়ারম্যান তাদের এ ব্যাপারে জানায়নি এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো দুপুরের খাবারের জন্য যে টাকা তোলা হলো তার ভাগ দেয়নি। রাজনৈতিক নেতাদের চাপে এই প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু অন্যদিকে, বতলাগাড়ি ইউপি সফলভাবে এই ব্যবস্থা চালু করেছে এবং এখনো চলছে। চেয়ারম্যান তাঁর রাজনৈতিক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে স্থানীয় দলতন্ত্রের খারাপ প্রভাব থেকে এই ব্যবস্থাকে রক্ষা করেছে। খোকশাবাড়ি ইউপিতে দলতন্ত্রের প্রভাব মানে হলো সরকার থেকে সম্পদপ্রাপ্তি নিশ্চিত করাটা সরকার বদলের ওপর নির্ভরশীল, যা বতলাগাড়িতে নয়। সরকারের অনিশ্চয়তার ফলে সামাজিক জবাবদিহি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়মিত হতে পারে না এবং এদের দায়িত্বও প্রশ্নবিদ্ধ থাকে।

সারপুকুরে দেখা যায়, যখন বৃহত্তর রাজনৈতিক সমঝোতা না থাকে তখন কী ঘটতে পারে। বর্তমান সমঝোতাটা বিশৃঙ্খলাপূর্ণ, কারণ সব গুরুত্বপূর্ণ কর্তাব্যক্তির মধ্যে রাজনৈতিক আদর্শে মিল নেই (ইউপি ও উপজেলা চেয়ারম্যান, এমপি)। ইউপি চেয়ারম্যান ও এমপির মধ্যে রাজনৈতিক বৈসাদৃশ্যের ফলে দলতান্ত্রিক প্রেক্ষাপটে সরকারের কাছ থেকে যে সর্বোচ্চ সম্পদ পাওয়া যায় তা সম্ভব হচ্ছে না। ইউপি চেয়ারম্যান তাঁর যেটুকু সীমিত নেটওয়ার্ক রয়েছে তা দিয়ে উপজেলা প্রশাসন থেকে কিছু পেতে হলে সংগ্রাম করতে হয়। উন্নয়ন বরাদ্দগুলো তিনটি ভিন্ন রাজনৈতিক অ্যাক্টরদের (ইউপি চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান এবং এমপি) রাজনৈতিক ক্লায়েন্টভিত্তিক বিবেচনায় তদর্থক পদ্ধতিতে ব্যবস্থাপনা ও বণ্টন করা হয়। এই তিনটি রাজনৈতিক অ্যাক্টরের মধ্যে কোনো সংঘবদ্ধ রূপ পাওয়া দুষ্কর। আমরা আগে আলোচনা করেছি যে এ ধরনের একটি সংঘবদ্ধ রূপ বতলাগাড়িতে পাওয়া যায়।

বতলাগাড়ি চেয়ারম্যান বলেন, সাধারণত ইউপি বিশৃঙ্খলাপূর্ণ শাসনব্যবস্থা প্রক্রিয়া দ্বারা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বড় অ্যাক্টরদের (এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনও, ইউপি চেয়ারম্যান) মধ্যে জবাবদিহি সীমানাগুলো বোঝা কঠিন এবং তাদের নিজ নিজ আনুষ্ঠানিক ভূমিকা কার্যত অনানুষ্ঠানিক ভূমিকা দ্বারা বদলিয়ে ফেলা হয়েছে। যেখানে এমপির সংসদে আইন প্রণয়ন করার কথা ছিল, সেখানে তিনি অনানুষ্ঠানিকভাবে টেস্ট রিলিফের (টিআর) বণ্টনে যুক্ত এবং কাজের বিনিময়ে খাদ্যের (কাবিখা) অর্থ তদারক ও বরাদ্দে ব্যস্ত। টিআর ও কাবিখা প্রদানের নির্দেশ দাপ্তরিকভাবে ইউএনওর পরিবর্তে উপজেলা চেয়ারম্যানের ওপর ন্যস্ত। ইউএনও তাঁর ঊর্ধ্বতনের কাছে কিছু মাত্রায় আনুষ্ঠানিক জবাবদিহি করে থাকে, কিন্তু উপজেলা চেয়ারম্যান কারও কাছেই কার্যকরভাবে দায়বদ্ধ নয়। আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক জবাবদিহি কাঠামোর এই ধরনের গুলিয়ে যাওয়াটা বৃহত্তর এলিট রাজনৈতিক সমঝোতাকে কিছুটা অস্থিতিশীল ও অনিশ্চিত করে ফেলেছে। শুধু বিভিন্ন এলিট স্বার্থের দক্ষ পরিচালনার মাধ্যমে একজন চেয়ারম্যান যোগ্য গরিবদের জন্য সেবা প্রদান ও উন্নয়ন বরাদ্দ ব্যবস্থাপনা করতে পারে। এই প্রক্রিয়ায় অনেক সমঝোতা করতে হয় ক্ষমতাবান এলিটদের সঙ্গে এবং ফলে সেবা প্রদান-সম্পর্কিত শাসনব্যবস্থা প্রক্রিয়া অনেক বেশি ছাড় দেওয়া হয় ও কম অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়।

দ্বৈত কর্তৃত্ব ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসনব্যবস্থা

আমাদের বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলতে চেয়েছি যে যদি স্থানীয় ও বৃহত্তর রাজনৈতিক সমাজে ইউপি প্রোথিত থাকে তাহলে তা ইউপি শাসনব্যবস্থা ও ইউপি নেতাদের প্রণোদনার ধরনকে প্রভাবিত করে। প্রভাবের ধরন ভিন্ন হয় এবং এই ভিন্নতা স্পষ্ট এলিট রাজনৈতিক সমঝোতার ওপর নির্ভর করে ঘটে থাকে। সাধারণভাবে, তিনটি ইউপিই রাজনৈতিক এলিট ও ইউপি নেতাদের দ্বৈত কর্তৃত্বের ওপর নির্ভরশীল। একটি ইউপির একজন সদস্য বলেন, ‘যদিও ইউপির নির্বাচনী রাজনীতিতে দলগুলোর কোনো প্রভাব নেই, কিন্তু সেবা প্রদান ও সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে তাদের ভালো প্রভাব রয়েছে।’ দ্বৈত কর্তৃত্ব কাঠামোয় উভয় ধরনের অ্যাক্টররাই সম্পদের ওপর তাদের দাবির বৈধতা পাওয়ার চেষ্টা করে। খোকশাবাড়ি ইউপি চেয়ারম্যান বলেন, ইউপি সদস্যরা ‘স্থানীয় জনগণের আসল প্রতিনিধি’ হিসেবে তাঁদের কর্তৃত্ব ফলাতে চেষ্টা করেন।

অন্যদিকে রাজনৈতিক এলিটরা ‘সরকারের প্রতিনিধি’ হিসেবে তাঁদের কর্তৃত্ব দেখান (পড়ুন ক্ষমতাসীন দল)। দলতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে, রাজনৈতিক এলিটদের দাবি বেশ গুরুত্ববহ। আমাদের সাধারণ পর্যবেক্ষণ হলো ইউপি পর্যায়ে এই প্রকৃত দ্বৈত কর্তৃত্ব চেয়ারম্যানকে স্বাধীনভাবে গরিবদের সেবা করতে বাধাগ্রস্ত করে। যোগ্য গরিবেরা ভোগান্তিতে পড়ে, যেহেতু তাদের চিহ্নিত করা ও সেবা করার জন্য (নির্বাচনী প্রণোদনা) রাজনৈতিক এলিটদের চেয়ে ইউপি সদস্যরা বেশি দক্ষ ও সক্রিয়। কিন্তু বৃহত্তর রাজনৈতিক বিন্যাসে ইউপি সদস্যদের অসম শক্তির ফলে তারা গরিবদের জন্য আনীত সম্পদে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। ইউপি পর্যায়ে কার্যত কর্তৃত্ব কাঠামোয় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক এলিটদের প্রভুত্ব দরিদ্রবান্ধব ও অংশগ্রহণমূলক সেবা প্রদান ও সম্পদ বরাদ্দ পদ্ধতি প্রতিষ্ঠায় বড় রকম চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। রাজনৈতিক এলিটদের প্রভুত্বের ফলে যোগ্য গরিবদের থেকে ইউপিভিত্তিক সম্পদ ক্ষুদ্র রাজনৈতিক ক্লায়েন্টদের কাছে চলে যায়।

তিনটি ইউপিতেই লক্ষণীয় হলো স্থানীয় পর্যায়ের ক্ষমতাসীন দলীয় রাজনৈতিক নেতাদের সুবিধা দেওয়ার জন্য ইউএনও ইউপি চেয়ারম্যানদের ওপর অনেক চাপ সৃষ্টি করে। ফলে এই নেতারা এর সুবিধা নিচ্ছেন। চেয়ারম্যানকে দক্ষভাবে নীতি ক্ষেত্রে একসাথে অনেকগুলো কঠিন কাজ সম্পাদন করতে হয়, যে ক্ষেত্রটিতে ইউপি থেকে উন্নয়ন সম্পদ দখল করতে সব বড় রাজনৈতিক দলের নেতারা দর-কষাকষি প্রক্রিয়ায় জড়িত থাকেন।৭ ইউপি ও রাজনৈতিক সমাজের মধ্যে সম্পর্কের বৃহত্তর দিকটি মাথায় নিলে, সমমনা এলিটদের মধ্যেও কাজের সম্পর্ক প্রত্যেক ইউপিতে স্পষ্ট এলিট-রাজনৈতিক সমঝোতার ধরন অনুযায়ী ভিন্ন হয়। কার্যত সমমনা এলিট সম্পর্কও ইউপি সদস্যদের নেতৃত্ব দক্ষতার ওপর নির্ভর করে (নেতাদের সুদক্ষ পরিকল্পনা দক্ষতা, তাদের জোট করার কৌশল, চ্যালেঞ্জিং কাঠামোগত বাধা থাকার পরও)। এ জন্য ব্যক্তিগত নেতাদের ‘এজেন্সি’ও গুরুত্বপূর্ণ।

রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে সহজ এলিট-রাজনৈতিক সমঝোতা ও সমমনা এলিটদের সম্পর্ক খোকশাবাড়ি ইউপির ক্ষেত্রে দেখা যায়। এখানে ইউপি চেয়ারম্যান ও এমপির রাজনৈতিক মিল রয়েছে (দুজনেই আওয়ামী লীগ)। স্থানীয় রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে এমপিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অ্যাক্টর। এমপিকে নিজের রাজনৈতিক পক্ষে রাখতে পারা মানে সম্পদ নিয়ন্ত্রণ ও পৃষ্ঠপোষকতা সুবিধা বণ্টনের নোংরা স্থানীয় পর্যায়ের রাজনীতি চালনা করার অনেক সুবিধা পাওয়া। খোকশাবাড়ি ইউপি চেয়ারম্যানের জন্য ইউপি সদস্যদের দ্বৈত কর্তৃত্ব ও স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের এলিটদের সঙ্গে বোঝাপড়া করা তুলনামূলক সহজ। এটা তার রাজনৈতিক পরিচয় ও এমপির সমর্থনের জন্যই। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে সহজতর এই এলিট সমঝোতা মূলত ক্ষমতাসীন দলের নেতৃত্বের জন্য সুবিধাজনক, কিন্তু গরিবদের জন্য খুব কমই ইতিবাচক। অন্য দুই ইউপির ক্ষেত্রে সমমনা এলিটদের সম্পর্কের বিবর্তনটা অনেক বেশি কঠিন, যেখানে চেয়ারম্যানদের ও এমপিদের রাজনৈতিক পরিচয় ভিন্ন ভিন্ন। ফলে সম্পদ নিয়ন্ত্রণের রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা অনেক বেশি জটিল ও অনিশ্চিত হয়ে গেছে এবং এর ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে। এমন প্রমাণ পাওয়া যায় যে যোগ্য গরিবদের জন্য সম্পদ বরাদ্দের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব সারপুকুর ইউপিতে বেশি এবং তা বতলাগাড়িতে কম। কারণ হলো বতলাগাড়ি ইউপি চেয়ারম্যানের জোট ও মতৈক্য তৈরির দক্ষতা।৮

জেন্ডার, ইউপি নারী সদস্যদের প্রণোদনা এবং স্থানীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক সমঝোতা

বিভিন্ন রাজনৈতিক নির্ধারকের মাধ্যমে কীভাবে নারী প্রতিনিধিদের রাজনৈতিক এজেন্সি গঠিত হয় এবং কীভাবে এসব নির্ধারক গরিব নারীসহ নারী সদস্যদের স্থানীয় ভাবনার প্রতি মনোযোগী করতে প্রণোদনা জোগায়, তা বোঝার জন্য একটি আলাদা বিশ্লেষণ প্রয়োজন। জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে জেন্ডার-সম্পর্কিত রাজনৈতিক সমঝোতার গবেষণা তুলনামূলকভাবে কম; এদের বেশির ভাগই নারীর প্রতিনিধিত্ব, কোটা ও নীতি-প্রক্রিয়ায় জেন্ডারকে কেন্দ্রে আনার উপর আলোকপাত করে (নাজনীন ও মাহমুদ, ২০১২)।

যদিও ইউপি পর্যায়ে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে সংরক্ষিত আসন রাখার বিধান নারীদের স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচনে অনেক বেশি প্রতিযোগিতা করার সুযোগ করে দিয়েছে (ফ্রাঙ্কেল, ২০০৩, খান ও অ্যারা, ২০০৬), আমাদের উপাত্ত দেখাচ্ছে যে কোনো নারীর নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে তা নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করে আত্মীয়তা, পরিবারের রাজনৈতিক মূলধন, রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা ইত্যাদি। এই গবেষণা ফলাফল বিদ্যমান গবেষণাগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ (দেখুন খান ও মহসিন, ২০০৮; নাজনীন ও অন্যান্য, প্রকাশিতব্য)। মূল বিষয়টা হলো নারীরা কি এখানে স্বাধীন অ্যাক্টর (যেটা বহুলাংশে পুরুষ সদস্যদের থাকে), নাকি তাদের পরিবারের ক্ষমতাচর্চার একটা মাধ্যম? যদিও আত্মীয়স্বজন এবং অন্যান্য বংশগত সংশ্লিষ্টতা নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই নির্বাচনে জয়ের জন্য এবং শাসনব্যবস্থার সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য মূল নিয়ামক, কিন্তু নারী ইউপি সদস্যদের পরিবার নারীদের রাজনৈতিক এজেন্সি প্রভাবিত করতে বড় ভূমিকা রাখে। যা হোক, স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচিত নারীদের প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচনা করার পদ্ধতির ক্ষেত্রে ধীর একটা পরিবর্তন ঘটছে।

সব ইউনিয়নেই ইউপি চেয়ারম্যানরা এবং সদস্যরা নারীদের তাদের পরিবারের ‘প্রক্সি’ প্রতিনিধি হিসেবে দেখে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সংরক্ষিত আসনে নারী সদস্যদের পরিবার ও স্থানীয় এলিট/রাজনৈতিক নেতারা নির্বাচনে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য প্ররোচিত করে এবং নির্বাচনী প্রচারণায় সাহায্য করে। সাহায্য করার পেছনে মূল কারণ থাকে স্বার্থসিদ্ধি। এসব নারী প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কাছ থেকে সমর্থন পায় তাদের বংশগত মর্যাদার জন্য (কোথা থেকে তার পরিবার এসেছে, আত্মীয় সম্পর্ক), কারণ এর ফলে সংরক্ষিত আসনগুলো জিতলে তাদের কমিউনিটি বা নিজের লোকের হাতেই যেন থাকে। রাজনৈতিক দলগুলো এই নারীদের সমর্থন দেয়, কারণ তাদের পরিবার এসব রাজনৈতিক দলের অন্তর্গত। নারীদের জন্য স্থানীয় সমর্থন আদায়ে ‘গোষ্ঠী’ ও ‘দেশি’রা মূল ভূমিকা পালন করে। সেবা প্রদান ও স্বার্থ প্রতিনিধিত্ব সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত প্রণয়নে যেসব নারী ইউপি সদস্য রয়েছে তারা এসব বিষয়ে বেশি গুরুত্ববহ। এসব নারীর পরিবারগুলোও সাধারণত তাদের প্রার্থিতাকে সমর্থন দেয়, কারণ এর মাধ্যমে পরিবারগুলো ইউপি সিদ্ধান্ত প্রণয়নের কেন্দ্রে প্রভাব ও প্রবেশ বৃদ্ধি করতে পারে। সাক্ষাত্কার প্রদানকারী বেশির ভাগ ইউপি নেতা বলেন যে নারী সদস্যদের স্বামীরাই সভা ও কমিউনিটিগুলোতে সক্রিয়। মজার ব্যাপার হলো, যদিও দৃশ্যত ইউপি নেতারা নারী নেত্রীদের সক্ষমতা সম্পর্কে নেতিবাচক, কিন্তু তারা এটা বলেনি যে নারীরা স্বভাবগতভাবেই কম সক্ষম (প্রাকৃতিকভাবেই দুর্বল)। সব সাক্ষাত্কার গ্রহণকারীই সামাজিক বাধা যেমন জেন্ডার শ্রম বিভাজন, নারীর সামাজিক গতিশীলতার ওপর বিধিনিষেধ, বিভিন্ন কমিউনিটিতে জেন্ডার-সম্পর্কিত আদর্শ এবং রাতে চলাফেরাকে দেখিয়েছে নারীদের কার্যকরভাবে ইউপি রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে না পারার পেছনে কারণ হিসেবে। এসব সামাজিক বাধা দেখলে দেখা যাবে যে সমাজ যেভাবে জেন্ডার পক্ষপাতিত্বকে বিশ্লেষণ করে তার পদ্ধতিতে একটা পরিবর্তন হচ্ছে।

নারী ইউপি নেত্রীরা সালিসে ভূমিকা রাখেন, বিশেষ করে যেসব ক্ষেত্রে ‘নারীঘটিত বিষয়’ থাকে (বিয়ে, তালাক, পারিবারিক নির্যাতন ইত্যাদি)। এ বিষয়গুলো পৃষ্ঠপোষকতা সুবিধা বণ্টন ও সম্পদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে যায় না। তার ওপর এ ঘটনাগুলোকে ‘ব্যক্তিগত’ সমস্যা হিসেবে দেখা হয় (একজন পুরুষ তার স্ত্রীর প্রতি সহিংস) যা স্থানীয় জেন্ডার ক্ষমতাকাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করে না। এ জন্য সালিসে নারী ইউপি নেত্রীদের অংশগ্রহণকে পুরুষরা বাধা দেয় না। সালিসে নারীদের অন্তর্ভুক্তির জন্য পুরুষদের সমর্থন নারীদের উপস্থিতি যেমন বৃদ্ধি করে, পাশাপাশি সম্ভবত একটা ‘ডেমোনস্ট্রেশন ইফেক্ট’ও তৈরি করে (যেমন নারীরা পুরুষদের জায়গাগুলোতেও আসতে পারে; (ম্যানসব্রিজ, ১৯৯৯); এটা জেন্ডার ভূমিকা ও জেন্ডার সম্পর্কের সঙ্গে আবর্তিত স্থানীয় রাজনৈতিক সমঝোতাকে চ্যালেঞ্জ করে না। এর মাধ্যমে বোঝা যায় যে নারী প্রতিনিধিত্বের যে বিধান রয়েছে, তার মাধ্যমে নারী ইউপি নেত্রীদের জন্য সৃষ্টি হওয়া ক্ষেত্রটির সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এই ফলাফলগুলোও বিদ্যমান গবেষণার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ (দেখুন নাজনীন ও তাসনিম, ২০১০)।

এমন ঘটনাও রয়েছে যেখানে নারী ইউপি সদস্য ও চেয়ারম্যান/পুরুষ সদস্যের মধ্যে দ্বন্দ্ব বেধেছে। একটা ঘটনায়, ইউপি নারী সদস্যের পাওয়া প্রকল্প বরাদ্দ চেয়ারম্যান নিয়ে নেন। তখন নারী সদস্য সভা বর্জন করে তার প্রতিবাদ জানান এবং কমিউনিটিকে জানান কেন তিনি সভা বর্জন করেছেন। এর ফলে ইউপি চেয়ারম্যানের ওপর একটা পরোক্ষ চাপ তৈরি হয়, যেন তিনি স্বীকার করেন যে তিনি ভুল করেছেন এবং ভবিষ্যতে আর করবেন না (খোকশাবাড়ি ইউপি)। কিন্তু এসব ঘটনা খুবই কম। নারীদের সময়ে সময়ে বিভিন্ন প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করার আইনি বাধ্যবাধকতা থাকার ফলে ইউপি চেয়ারম্যানরা এসব প্রকল্পে কীভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে তা নিয়ন্ত্রণ করতে সংরক্ষিত আসনের নারীদের ব্যবহার করেন। ইউপি সচিব ও সাক্ষাত্কার গ্রহণকারীরা নিচের কারণগুলো উল্লেখ করেছেন কেন চেয়ারম্যান নারীদের এভাবে কাজে লাগাতে পারেন: নারীদের জ্ঞান কম; তাঁরা জেন্ডার শ্রম বিভাজন থাকার ফলে সভায় অনুপস্থিত থাকেন; নারীদের স্বামীরা চেয়ারম্যানের সঙ্গে বোঝাপড়া করে ফেলতে পারেন এবং নারীদের তা মেনে নিতে বাধ্য করতে পারেন ইত্যাদি। আমাদের ফলাফলে দেখা যায়, উপজেলায় নির্বাচিত নারীনেত্রী ও ইউপিতে নির্বাচিত নারীনেত্রীদের মধ্যে যোগাযোগ সম্পূর্ণ অনুপস্থিত, কমপক্ষে খোকশাবাড়ি ও সারপুকুর ইউনিয়নে। তাই নারীনেত্রীদের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে নারী অধিকার ও স্বার্থরক্ষার সম্ভাবনা বর্তমানে খুব কম। নারী ইউপি নেত্রীরা বলেন যে সরকারের নারীবিষয়ক অধিদপ্তরের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ ছিল এবং এই অধিদপ্তরের সঙ্গে যুক্ত বিদ্যমান আমলাতান্ত্রিক চ্যানেলের মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ে তারা বিভিন্ন নারীবিষয়ক প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। যা হোক, অন্যান্য সরকারি বিভাগ নারী প্রতিনিধি যুক্ত করতে কোনো বিশেষ প্রচেষ্টা নেয়নি। নারী প্রতিনিধিদের জন্য এর মানে হলো আমলাতান্ত্রিক চ্যানেল ব্যবহার করে রাজনৈতিক চাপ মোকাবিলা করার সম্ভাবনাও কম। এটা আরও নির্দেশ করে যে ‘নারীর বিষয়গুলো’ একটি অধিদপ্তরের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে।

ওপরের সবকিছু দেখে মনে হয়, নারী ইউপি নেত্রীদের জেন্ডার অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসনব্যবস্থা প্রদানের সম্ভাবনা অনেক কম, যদিও নারীদের জন্য অনেক দিক উন্মোচিত হয়েছে (সালিস) এবং জনগণের দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন হচ্ছে। এখানে মূল বিষয়টি হলো কীভাবে এসব নারী ইউপি নেত্রীর জেন্ডার-সম্পর্কিত বিষয়গুলোর প্রতি মনোযোগী করতে ব্যবহূত প্রণোদনাগুলোকে শক্তিশালী করা যায়। কোন কোন চ্যানেল সৃষ্টির মাধ্যমে নারী ইউপি নেত্রীদের বৃহত্তর নেটওয়ার্কের সঙ্গে এবং স্থানীয় নারী নির্বাচনী এলাকার সঙ্গে কার্যকরভাবে যুক্ত করা যায় (দেখুন অধ্যায় ৭; ওয়ার্ড সভার ওপর আলোচনা)।

ইউপি-সম্পর্কিত সাম্প্রতিক আইন, বিধি ও সামাজিক জবাবদিহি প্রতিষ্ঠান কি নেতাদের প্রণোদনায় কোনো পরিবর্তন নিয়ে আসছে?

সরকার সাম্প্রতিক সময়ে ইউপিকে শক্তিশালী করতে নতুন আইন ও নীতি প্রণয়ন করেছে এবং ইউপি শাসনব্যবস্থা প্রক্রিয়ায় নাগরিকদের অংশগ্রহণের জন্য বিভিন্ন ফোরাম তৈরি করেছে। সবচেয়ে বিখ্যাত হলো ২০০৯ আইনের বাস্তবায়ন, বিভিন্ন স্ট্যান্ডিং কমিটির কাজের পুনরুজ্জীবন এবং স্ট্যান্ডিং কমিটির ব্যবস্থাপনা সংগঠনের সংবিধানের জন্য সভা আহ্বান করা বাধ্যতামূলক দেখিয়ে পরিপত্র পাঠানোর নীতি। ইউপি শাসনব্যবস্থা ও প্রক্রিয়ায় এসব নীতি ও প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন ইউপি সদস্যদের আচরণকে প্রকৃত অর্থে প্রভাবিত করেছে, তাদের জন্য নতুন প্রণোদনা সৃষ্টি করেছে। এসব নতুন সংযোজন অন্য স্টেকহোল্ডারদের ক্ষমতাও বাড়িয়েছে, যারা ইউপি প্রশাসনের বাইরে থাকলেও উন্নয়ন বরাদ্দ ও পৃষ্ঠপোষকতা সুবিধা বণ্টনের প্রক্রিয়ার ক্ষমতা বিন্যাসের অন্তর্ভুক্ত।

নাগরিকদের, বিশেষ করে অসংগঠিত গরিবদের স্বার্থ, প্রণোদনা ও সামগ্রিক কর্মসক্ষমতাও পরিবর্তিত হয়েছে। এই পরিবর্তন ইউপি নেতৃত্বকে যেমন বাধাগ্রস্ত করেছে, তেমনি সুবিধাও দিয়েছে এবং গরিবদের ব্যাপারে ইউপি নেতৃত্বের জন্য জটিল প্রণোদনা সৃষ্টি করেছে। এর মানে রাজনৈতিক সমঝোতার অভ্যন্তরীণ গতিপ্রকৃতির ধরন শুধু এলিটদের মধ্যেই পরিবর্তিত হয়নি, এলিট ও গরিবদের মধ্যেও হয়েছে। স্বার্থ ও অ্যাক্টরদের এই নতুন কাঠামো বিন্যাসে বৃহত্তর ও স্থানীয় এলিট-রাজনৈতিক সমঝোতার গতিপ্রকৃতি দ্বারা নির্ধারিত হয়। নিচে আমরা শাসনব্যবস্থার গতিপ্রকৃতিতে পরিবর্তন এবং ইউপি নেতৃত্ব, স্থানীয় এলিট এবং গরিব নাগরিকদের প্রণোদনায় পরিবর্তন ও ইউপিতে নতুন আইন ও প্রাতিষ্ঠানিক নীতি বাস্তবায়নের আলোকে আলোচনা করব।

ওয়ার্ড সভা ও অন্যান্য সামাজিক জবাবদিহি ফোরাম

ইউপি আইন ২০০৯-এর একটা গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো ওয়ার্ড সভার সূচনা, যা ইউপি পর্যায়ে যেকোনো সামাজিক জবাবদিহি ফোরামের চেয়ে বেশি আকারে নাগরিকদের যুক্ত করে। ওয়ার্ড সভার কার্যক্রম উন্নয়ন বরাদ্দের ধরন ও বিভিন্ন ধরনের সেবার ক্ষেত্রে ইউপি নেতৃত্ব ও স্থানীয় নাগরিকদের মধ্যে তথ্যগত অসমতা কমিয়েছে। তথ্যের এই প্রাতিষ্ঠানিক চ্যানেলের সুবিধা নাগরিক ও ইউপি নেতারা উভয়ই পেয়েছেন।

গরিব নাগরিক ও নারীদের সুবিধা এবং অংশগ্রহণের সীমাবদ্ধতা

ওয়ার্ড সভা হওয়াতে নাগরিকেরা (মূলত গরিব ও নারী) প্রত্যাশার চেয়ে কম সেবা পাওয়া এবং সেবার অপব্যবহার সম্পর্কে তাদের হতাশা ব্যক্ত করতে পারেন। নাগরিকেরা সামষ্টিকভাবে ইউপি নেতাদের সেবাসম্পর্কিত কর্মসক্ষমতার ব্যাপারে ব্যাখ্যা দাবি করতে পারেন। মোট কথা, ওয়ার্ড সভার ফলে দরিদ্র নাগরিকদের জন্য ভীতিহীনভাবে তাদের দাবি পেশ করার সুযোগ কাঠামো তৈরি হয়েছে, যেহেতু গরিব ও নারীরা ইউপি নেতাদের সংঘবদ্ধ হয়ে সামষ্টিকভাবে খোলামেলা চ্যালেঞ্জ করতে পারছেন। গরিবদের জন্য এসব সামাজিক জবাবদিহি ফোরাম রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ, যেহেতু উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনও এবং মাঝে মাঝে ডেপুটি কমিশনার (জেলা প্রশাসনের সিইও) এসব জায়গায় উপস্থিত থাকেন, যা ইউপি নেতাদের ওপর জবাবদিহি চাপ বাড়িয়ে দেয়। ওয়ার্ড সভায় পেট্রননির্ভর গরিবদের সামষ্টিক কর্মপন্থার রাজনৈতিক সুবিধা স্পষ্ট, যদিও এসব সুবিধাকে অতিরঞ্জিত করা যাবে না। গবেষণায় দেখা যায়, মানুষ ভয় পায় এই ভেবে, যদি নেতাদের এখন চ্যালেঞ্জ করে, তাহলে পরে তার প্রতিশোধ নিতে পারে। কেউ কেউ মনে করে যে যদি এখন তারা সামষ্টিক ফোরামগুলোতে বেশি দাবি করে এবং সমালোচনা করে তাহলে বিদ্যমান পৃষ্ঠপোষকতা নেটওয়ার্ক থেকে তাদের নাম বাদ পড়তে পারে। তাই এখন মুখ বন্ধ রেখে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখলে ভবিষ্যতে প্রথাগত অনানুষ্ঠানিক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ক্রমাগত সুবিধা পাওয়া ভালো।

এতত্সত্ত্বেও, আমাদের সব শ্রেণির মূল তথ্যদাতাদের বক্তব্যের ভিত্তিতে দেখা যায়, ওয়ার্ড সভা অভিযোগ প্রকাশের এবং অধিকার আদায় ও কর্মসক্ষমতা এবং অপূর্ণ প্রতিজ্ঞার জন্য ইউপি নেতাদের জনসম্মুখে দায়বদ্ধ করার ক্ষেত্রে একটা জনপ্রিয় স্থান হয়ে গেছে। এটা সুচিন্তিত ও প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রেরও একটি স্থান, যা এখনো গ্রামীণ দরিদ্রদের কাছে দুষ্প্রাপ্য। এনজিওগুলো এসব প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করে দৃঢ়ভাবে অধিকার এবং নাগরিকত্বের ধারণাগুলো গরিবদের বোঝাতে পারছে। অধিকারসংক্রান্ত ধারণা জেন্ডার রাজনীতির ক্ষেত্রে বিশেষভাবে আবর্তিত হচ্ছে।

স্থানীয় ওয়ার্ড সভা এবং অন্যান্য জায়গায় নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রায় প্রত্যেক তথ্যদাতা ফোরামগুলোতে নারীদের দৃশ্যমানতা নিয়ে মন্তব্য করেছে। তারা এটাও বলেছে যে নারীরা দাবিগুলো সামষ্টিকভাবে তুলে ধরে। বিশেষ করে গরিব নারীরা এসব ফোরাম থেকে লাভবান হয়েছে। এটা মনে রাখা প্রয়োজন যে মধ্যবিত্ত বা এলিট শ্রেণি থেকে কদাচিত্ কোনো নারীকে ওয়ার্ড সভায় দেখা গেছে।

যা হোক, দরিদ্র নারীদের অংশগ্রহণ আরও বিশ্লেষণের দাবি রাখে। নারীরা অংশগ্রহণ করতে পারে (সম্ভবত পুরুষেরা আরও কম) কারণ সভা অনুষ্ঠিত হয় এমন সময়ে যখন নারীরা আসতে পারে (বিকেলের ঠিক আগে)। এনজিও কর্তৃক নারী গ্রুপগুলোকে সংঘবদ্ধ করা ও তথ্যের অধিকার ও প্রশিক্ষণ নারীদের জনসভায় অংশগ্রহণ করতে সক্ষম করেছে। অন্য কারণগুলো সম্ভবত এলিট ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির নারীদের মধ্যে সামাজিক রক্ষণশীলতা (পর্দা), জনসমাবেশে দরিদ্র নারীদের সঙ্গে মিশতে তাদের অনীহা এবং এ জন্য যে এলিট/মধ্যবিত্ত শ্রেণির নারীরা পুরুষতান্ত্রিক নিয়মনীতি দ্বারা বেশি বাধাগ্রস্ত (স্থানীয় কমিউনিটি মিটিংয়ে অংশগ্রহণের জন্য পুরুষ অভিভাবকের কাছ থেকে অনুমতি পাওয়া কঠিন)।

গরিব নারীদের অধিক অংশগ্রহণের ফলাফল হলো যেসব দাবি ওয়ার্ড সভায় উঠত তা গরিব ও নারীদের জন্য বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক ছিল। একটি জনপ্রিয় দাবি হলো বাড়ির আঙিনায় সস্তা ল্যাট্রিন সুবিধা। অন্য সংশ্লিষ্ট দাবিগুলো হলো ইউপি নেতারা কার্যকর পদক্ষেপ নেয়: পরিবারে সহিংসতা কমাতে; যৌতুক প্রথা থামাতে; বাইরে/কর্মক্ষেত্রে নারীদের যৌন নির্যাতন থেকে রক্ষা করতে; বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে; নারী ও পুরুষের মধ্যে অসম মজুরি বিষয়ে মনোযোগ দিতে; নারীদের উত্পাদন দক্ষতা তৈরিতে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে। জেন্ডার-সংশ্লিষ্ট এমন অনেক দাবি ইউপি নেতাদের জন্য সুখকর নয়। এর কারণ সমাজের পুরুষতান্ত্রিক প্রথাগত প্রেক্ষাপট।

মূল প্রশ্নটি এখানে নারীদের অংশগ্রহণের মান। আমাদের কোনো পদ্ধতিগত প্রমাণ নেই যে কীভাবে ইউপি নেতারা এ ধরনের দাবিগুলোকে গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করে এবং কীভাবে জেন্ডার বৈষম্যমূলক ব্যবস্থায় কিছু নৈতিক নীতিবাক্য উচ্চারণের প্রচলিত শব্দগুচ্ছের বাইরে এগুলোকে দেখে থাকে। ইউপি নেতাদের বা কমিউনিটির ওপর নারীদের প্রভাব (প্রভাব ব্যবহার করে এবং স্বার্থসংশ্লিষ্ট দর-কষাকষির সামর্থ্য বিচারে) ওয়ার্ড সভাতে তাদের দৃশ্যমান সংখ্যক উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও সীমিত। ইউপি নেতারা হতে পারে যৌতুকের বিরুদ্ধে বা নারীদের ল্যাট্রিনের প্রয়োজনের কথা বলছেন, কিন্তু মূল বিষয় হলো প্রয়োজনগুলো মেটানো হয় কি না বা গ্রামে জেন্ডার বৈষম্যমূলক কার্যকলাপ পরিবর্তনে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয় কি না। খোকশাবাড়ি ইউপি সচিব বলেন যে যেহেতু ওয়ার্ড সভায় এলিট বা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির নারীদের অংশগ্রহণ নেই, ইউপি নেতারা কদাচিত্ এসব ফোরামে উঠে আসা জেন্ডারবিষয়ক দাবি বাস্তবায়নে ব্যবস্থা নেন। অভ্যন্তরীণ এমন বিজ্ঞ একজন যখন এমন মন্তব্য করেন তখন বুঝতে হবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ও প্রক্রিয়ায় নারীদের অন্তর্ভুক্তি তাঁদের দৃশ্যমানতা বৃদ্ধি করবে কিন্তু তার মানে এই নয় যে প্রভাবও বৃদ্ধি পাবে (তাদের স্বার্থ নিশ্চিত করার সামর্থ্য)। এনজিওগুলোর জন্য চ্যালেঞ্জ হলো নারীদের এসব ক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্তির মধ্যে সংযোগ তৈরি করা, যেন তা স্থানীয় পর্যায়ে জেন্ডার স্বার্থসংশ্লিষ্ট দর-কষাকষিতে প্রভাব রাখতে পারে।

এতত্সত্ত্বেও, ওয়ার্ড সভার মতো নির্দিষ্ট ফোরামে এসব জেন্ডার-বিষয়ক দাবি বৃদ্ধি পাওয়া মানে হলো ভবিষ্যতে স্থানীয় রাজনীতিতে নতুন ধারা তৈরি করবে। এটা দেখার বিষয় যে ভবিষ্যতে জেন্ডার রাজনীতির এই নতুন ধারাটি নারী ইউপি নেত্রীদের জন্য কী অবদান রাখতে পারে।

মোটামুটি, নতুন এই ফোরামগুলো থেকে সম্ভাবনা এবং জনপ্রতিনিধিদের থেকে বেশি পরিমাণে জবাবদিহি নিশ্চিত করার ক্ষমতা অনুমান করা যায়। প্রাথমিক গবেষণায় (নিচে দেখুন) মিশ্র ফলাফল দেখা যায় (ইউপি নেতাদের ওপর দৃশ্যমান ও বিশ্বাসযোগ্য চাপ, কিন্তু অপূর্ণ দাবি, ইউপি নেতাদের সাড়া না দেওয়া, এসব ফোরামে প্রভাব এবং এ সম্পর্কে নাগরিকদের সমালোচনা)। দেখা যায়, নির্দিষ্ট প্রকল্প সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা মানেই প্রকল্পের কার্যাবলি পরিবর্তনের সামর্থ্য বোঝায় না। ওয়ার্ড সভায় সক্রিয় হলে জনমতকে আমলে নেওয়া এবং তাদের কার্যাবলি পরিবর্তনের পরিবর্তে ইউপি নেতার উদ্বেগগুলোতে মনোযোগ দেওয়া এবং অস্থিরতা কমানোর পন্থা হিসেবে দেখে থাকে।

ইউপি নেতাদের সুবিধা

আগেই বলা হয়েছে যে ওয়ার্ড সভার সুবিধা ইউপি নেতারাও পেয়ে থাকেন। বতলাগাড়ি ইউপি চেয়ারম্যান তার উক্তির মাধ্যমে এটি স্বীকার করে বলেন যে ‘ওয়ার্ড সভা হলো ইউপি সদস্য ও চেয়ারম্যানের সঙ্গে জনগণের একটি সংযোগের মাধ্যম’। ওয়ার্ড সভা ইউপি নেতাদের জনগণ, বিশেষ করে গরিবদের কাছ থেকে তথ্য পাওয়া ও তাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করার একটি চমত্কার সুযোগ। আমাদের সঙ্গে কথা বলেছে এমন বেশির ভাগ ইউপি নেতাই বলেছেন যে ওয়ার্ড সভা ও প্রাক/উন্মুক্ত বাজেট আলোচনার মতো ফোরামগুলো নেতা হিসেবে তাদের কাজের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিক্রিয়া পেতে এবং এর ভিত্তিতে সংশোধনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সহায়তা করে। সবচেয়ে সাধারণ পর্যবেক্ষণ হলো সামাজিক জবাবদিহি ফোরামগুলো তাদের নির্বাচনী প্রতিজ্ঞা রাখতে না পারার কারণ কী তা ভোটারদের কাছে ব্যাখ্যা দেওয়ার সুযোগ দেয়, বিশেষ করে বিভিন্ন অপূর্ণ প্রতিজ্ঞার পেছনে বাজেট ঘাটতির ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করতে পারে। এই ধরনের যোগাযোগমূলক ব্যবস্থা নেতাদের এবং ভোটারদের মধ্যে অস্থিরতা কমায়। ইউপি নেতারাও কার্যকরী সিদ্ধান্ত প্রণয়নে প্রয়োজনীয় উপাদান পান এবং আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো বাজেট প্রস্তুতির উপাদানের মাধ্যমে তাঁরা সুবিধা পেয়ে থাকেন। অনেক নেতা বলেন যে ইউপি বাজেটের বেশির ভাগ উপাদান আসে ওয়ার্ড সভা থেকে।

ইউপি নেতারা প্রাক বা উন্মুক্ত বাজেট আলোচনার মতো অন্যান্য সামাজিক জবাবদিহি ফোরাম থেকেও একই রকম কৌশলগত সুবিধা পেয়ে থাকেন। আগেই বলা হয়েছে, ইউএনও এবং উপজেলা চেয়ারম্যানও এসব অধিবেশনে উপস্থিত থাকেন। আলোচনা-প্রক্রিয়ার সময় তাঁরা জানতে পারেন যে নির্দিষ্ট বড় অবকাঠামোগত প্রকল্পগুলো শুধু স্থানীয় এলিটদের রাজনৈতিক বিবেচনায়ই হচ্ছে না, বরং এর পেছনে জনদাবিও রয়েছে। এসব তথ্য ইউপি নেতাদের বিশেষ অর্থ বরাদ্দ পেতে তাদের লবিংকে শক্তিশালী করে এবং উপজেলা পর্যায় থেকে কারিগরি সহায়তা পেতে সাহায্য করে, বিশেষ করে যেসব প্রকল্প অনেক ব্যয়বহুল এবং অনেক দিন ধরে ঝুলে আছে সেসব প্রকল্পের জন্য। উন্নয়ন বিষয়ে ব্যবহূত শব্দ যেমন যৌথ উত্পাদনকে৯ উন্মুক্ত বাজেট সহজতর করেছে, যদিও এমন কোনো প্রমাণাদি নেই যেখানে দেখা যায় যে ইউপি পর্যায়ে এসব যৌথ উত্পাদন প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ১০ হয়েছে। এটা মূলত সরকারি কর্তৃপক্ষ ও ব্যক্তি বা নাগরিক কর্তৃক গৃহীত যৌথ উদ্যোগ। আমাদের গবেষণা ইউপিগুলোতে এই ধরনের যৌথ উত্পাদন হয়েছে উন্মুক্ত বাজেট অধিবেশনে অগ্রাধিকার প্রকল্পগুলোর দর-কষাকষির মাধ্যমে। যখন কোনো ইউপি নেতা জনদাবিভিত্তিক কোনো প্রকল্পের জন্য বাজেটসংকটে ভোগেন তখন তিনি তা উন্মুক্ত বাজেট অধিবেশনে পেশ করেন, যেন নাগরিকেরা তা বাস্তবায়নে অবদান রাখতে পারে (আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি এবং শ্রম দিয়ে)। যেমন খোকশাবাড়ি ইউনিয়নে নাগরিকদের সদয় অবদানের (অনেক মানুষের কাছ থেকে বাঁশ এবং আর্থিক সহায়তাও পাওয়া গিয়েছিল) মাধ্যমে একটি সেতু বানানো হয়েছিল।

ইউপি আইন ২০০৯-এর অনিচ্ছাকৃত প্রভাব

ইউপি শাসনব্যবস্থা প্রক্রিয়ায় ২০০৯ সালের ইউপি আইনের দুটি ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে। এগুলো মূলত ভালো অর্থবহ নীতির পরিবর্তে অনিচ্ছাকৃত প্রভাব ফেলেছে। প্রথমত, এখানে অনাস্থা প্রস্তাবের বিধান রয়েছে। এই নীতিতে বলা আছে যে যদি ১২ জন সদস্যের মধ্যে ৯ জন কোনো বিষয়ে অনাস্থা প্রস্তাব আনে, তাহলে ইউপি চেয়ারম্যান কাজ করার অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। বিধানটি অবশ্যই আনা হয়েছে যেন চেয়ারম্যানের যথেচ্ছ ব্যবহার ও সম্ভাব্য অপব্যবহার বন্ধ করা যায়। বাস্তবে এই আইনটি ইউপি সদস্যদের ইউপি চেয়ারম্যানের সঙ্গে অবৈধ বা অযথা সুবিধা আদায়ে দর-কষাকষি করতে সক্ষম করেছে। আমাদের গবেষণার একটি ইউনিয়নে দেখা গেছে, কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির নিয়মের বাইরে যেখানে একজন ব্যক্তি ৩০ কেজি চাল পাওয়ার কথা সেখানে সদস্যরা এক ব্যক্তিকে ২৪ কেজি চাল দেওয়ার জন্য চেয়ারম্যানের কাছে দাবি জানান এবং বাদবাকি ছয় কেজি চাল অবৈধভাবে ইউপি সদস্যদের দিতে বলেন যেন পরে তা বাজারে বিক্রি করতে পারেন বা তাঁদের আত্মীয়-গোষ্ঠীর মধ্যে বণ্টন করে দিতে পারেন। সামষ্টিক চাপ এবং অনাস্থা প্রস্তাবের ভয়ে চেয়ারম্যানের এই দাবি মেনে না নিয়ে আর কোনো বিকল্প ছিল না। একইভাবে, ইউপি সদস্যরা রাজনৈতিকভাবে কৌশলগত স্থানে অবকাঠামো নির্মাণে চেয়ারম্যানকে চাপ দিয়েছেন। এলজিএসপি-সংক্রান্ত অর্থের ক্ষেত্রে সদস্যরা চেয়ারম্যানকে অনাস্থা প্রস্তাবের ভয় দেখিয়ে চাপ দিয়েছেন যেন তাঁদের ইচ্ছা অনুযায়ী অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়। একজন ইউপি চেয়ারম্যান বলেন, ২০০৯ ইউপি আইন হওয়ার পর থেকে তিনি যা সহ্য করছেন তা ভালো আইন এবং নীতির অনিচ্ছাকৃত প্রভাব—‘সরকার অবশ্যই জনগণের সুবিধার জন্য আইনটি প্রণয়ন করেছিল...কিন্তু মাঠ পর্যায়ে বাস্তবতা ভিন্ন।’

সরকারি পরিপত্রের ক্ষেত্রে একই রকম অনিচ্ছাকৃত প্রভাব পড়েছে। পরিপত্রে বলা আছে, যেকোনো প্রকল্পের জন্য কমিউনিটি থেকে বাছাইকৃত ব্যক্তিদের স্ট্যান্ডিং কমিটিগুলোয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং ইউএনও কর্তৃক অনুমোদিত হতে হবে। এটা অবশ্যই প্রকল্প ব্যবস্থাপনা এবং উন্নয়ন বরাদ্দ-প্রক্রিয়ায় কমিউনিটির জ্ঞানটিকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের জন্য করা হয়েছিল এবং ইউপির শাসনব্যবস্থা প্রক্রিয়া এবং কমিউনিটির কাছে ইউপির জবাবদিহির ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে করা হয়েছিল। বাস্তবে যা ঘটে তা হলো ইউএনও চেয়ারম্যানকে এড়িয়ে স্থানীয় নেতাদের (ক্ষমতাসীন দলের) কাছে জিজ্ঞেস করে নাম পছন্দ করা হয়। আসলে ইউএনও স্থানীয় এমপির নির্দেশ অনুযায়ী স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করে নামগুলো তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেন। তাই স্বচ্ছতা ও সামাজিক জবাবদিহি নিশ্চিতে ব্যর্থ হন এবং একটি অনিচ্ছাকৃত প্রভাব হিসেবে, এই নীতি ইউপি প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় এলিটদের নিয়ন্ত্রণকে শক্তিশালী ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করে ফেলে। আমরা যেসব ইউপি নেতাকে জিজ্ঞেস করেছি যে তাঁরা কাদের অন্তর্ভুক্ত করতেন, তখন তাঁরা বলেন যে তাঁদের বাছাই করার সুযোগ থাকলে নেতৃত্ব গুণাবলিসম্পন্ন ব্যক্তিদের স্ট্যান্ডিং কমিটিগুলোতে অন্তর্ভুক্ত করত। এটা সম্ভাব্যভাবে সময়ের আবর্তে ইউপি ব্যবস্থায় একটা অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসনব্যবস্থার আশ্রয়স্থল খুলে দিতে পারত।

ইউপি আইন ২০০৯-এ নারীদের বেশি করে কমিটিগুলোতে অংশগ্রহণের বিধান আছে। এখানেও নারীদের বাছাই করার দায়িত্ব হলো ইউএনওর ওপর। ইউএনওর ওপর ক্ষমতাসীন দলের এলিটদের রাজনৈতিক প্রভাব মানে হলো নারীদের নাম বাছাই করা হবে রাজনৈতিক বিবেচনায়। ফলে যেসব নাম ইউপিতে পাঠানো হয় সেগুলো হয় স্থানীয় রাজনৈতিক এলিটদের স্ত্রী বা কমিউনিটির রাজনৈতিকভাব সুবিধা পাওয়া এলিট নারীরা। এসব নারী সাধারণত সার্বক্ষণিক গৃহবধূ। স্বাভাবিকভাবে ইউপি বিষয়ে সক্রিয় অংশগ্রহণের খুব কম সময়ই তাঁদের আছে। কমিটিতে তাদের প্রকৃত ভূমিকা অনেকটা লোক দেখানো। এসব নারীকে কমিটিতে নিলে ইউপিতে অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসনব্যবস্থা তৈরির ক্ষেত্রে বিঘ্ন ঘটে। যদিও অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসনব্যবস্থা ছিল ইউপি আইন ২০০৯-এর মূল উদ্দেশ্য।

সামাজিক জবাবদিহি প্রতিষ্ঠানগুলো কি অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসনব্যবস্থা উন্নয়নে ইউপি নেতাদের প্রণোদনাকে পরিবর্তন করছে?

ইউপি পর্যায়ে সামাজিক জবাবদিহি প্রতিষ্ঠান ও নীতিগুলো কি অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসনব্যবস্থা উন্নয়নে ইউপি নেতাদের প্রণোদনাকে পরিবর্তন করছে? এ ক্ষেত্রে এনজিওগুলোর কি কোনো ভূমিকা আছে, থাকলে সেটা কী? আগেই আলোচনা করা হয়েছে যে ইউপি নেতাদের ওয়ার্ড সভা বা উন্মুক্ত বাজেট আলোচনার মতো সামাজিক জবাবদিহি ফোরামগুলোকে সমর্থন করা এবং সক্রিয়ভাবে তাতে অংশগ্রহণ করার পেছনে কারণ রয়েছে। কিন্তু যে তিনটি ইউনিয়ন থেকে আমাদের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে, সেখানে দেখা যায় এসব ফোরামে অংশগ্রহণ করলে ইউপি নেতাদের লাভ ও লোকসান দুটোই হয়। রাজনৈতিক হিসাবের অংশ হিসেবে তারা লাভের চেয়ে লোকসানটা বেশি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে।

সামাজিক জবাবদিহি প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে ইউপি নেতাদের লাভ হয়ে থাকে। ইউপি নেতাদের জন্য অনুমিত লোকসানগুলো হলো কর্মসক্ষমতা এবং অপূর্ণ নির্বাচনী প্রতিজ্ঞা সম্পর্কে জনগণের তদন্তের মতো ‘অপ্রয়োজনীয়’ ঝামেলা; প্রকল্প বাছাই এবং উন্নয়ন বরাদ্দের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সমঝোতা ফাঁস হয়ে যাওয়ার সম্ভাব্য ঝুঁকি এবং বিভিন্ন ধরনের সামাজিক বিধান/নিরাপত্তাবেষ্টনী সম্পর্কিত সেবা প্রদানের সাথে সংশ্লিষ্ট উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতি প্রকাশ হয়ে যাওয়ার সম্ভাব্য ঝুঁকি।১১ মোটামুটি ইউপি নেতা এবং যেকোনো জনপ্রতিনিধিই জবাবদিহি বাধ্যবাধকতার অধীনে যেতে অনিচ্ছুক, বিশেষ করে এসব সামাজিক জবাবদিহি ধরনের যেগুলো অনেক বেশি খোলামেলা এবং উচ্চ কর্তৃপক্ষের কাছেও দুর্নীতি ধরা পড়তে পারে। এ ধরনের অনিচ্ছা তাদের প্রকৃত আচরণের এবং প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসক্ষমতায় প্রকাশ পায়। এগুলো নিচে আলোচনা করা হয়েছে।

সামাজিক জবাবদিহি প্রতিষ্ঠান/ফোরামগুলো সম্পর্কে প্রথম যে ব্যাপারটি মনে রাখা দরকার তা হলো তাদের কার্যত অকার্যকরী অবস্থা। ইউপি আইন ২০০৯ নাগরিকদের প্রতি ইউপির প্রত্যক্ষ জবাবদিহি এবং সাড়া প্রদানের প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্র তৈরি করেছে। আমাদের গবেষণায় দেখা যায়, এসব প্রতিষ্ঠান আনুষ্ঠানিক ও আচারসর্বস্ব রয়ে গেছে। ওয়ার্ড সভা বা উন্মুক্ত বাজেট অধিবেশন ডাকা হয় আইনের আনুষ্ঠানিক নির্দেশ প্রতিপালন করার জন্য। আমাদের অনেক গরিব ও এলিট তথ্যদাতার মতে, এমন আইনের বাধ্যবাধকতা ছাড়া ইউপি নেতারা এই কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়ন করতেন না। যদিও নাগরিকেরা, বিশেষ করে নারীরা, এসব কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হতে পেরেছে, তবুও তারা অনেকটা আচারসর্বস্বভাবে কাজ করে। স্ট্যান্ডিং কমিটিগুলোর মিটিং অনেক বেশি অনিয়মিত। যেহেতু রাজনৈতিক এলিটরা মূলত প্রকল্প চিহ্নিতকরণ, অর্থ বরাদ্দ এবং বাস্তবায়ন-প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে, তাই স্ট্যান্ডিং কমিটিগুলো অনেক বেশি লোক দেখানো ভূমিকা পালন করে। এনজিও এবং এনজিও কর্তৃক সংঘবদ্ধ নাগরিক গ্রুপগুলোর চাপের মুখে কমিটি মিটিং হলেও সিদ্ধান্তগুলো খুব কমই বাস্তবায়ন হয়। আমাদের তথ্যদাতাদের (এলিট ও দরিদ্র উভয়ই) অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যে যদি এনজিওগুলো কমিউনিটি ছেড়ে চলে যায় তাহলে এ ধরনের মিটিং অনুষ্ঠিতই হবে না এবং যদিও আইনি বাধ্যবাধকতার কারণে হয় তাহলে এগুলো হবে অনেক বেশি প্রতীকী।

আমাদের গবেষণা ইউপিগুলোতে সামাজিক জবাবদিহি উদ্যোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য (বা সীমাবদ্ধতা) হলো এগুলো গরিবদের শুধু নিরাপত্তাবেষ্টনী সংক্রান্ত ইউপি শাসনব্যবস্থা প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করে। সম্পদ বরাদ্দ ও অবকাঠামো উন্নয়ন/রক্ষণাবেক্ষণ-সংক্রান্ত শাসনব্যবস্থায় সামষ্টিক সামাজিক প্রহরী হিসেবে গরিব নাগরিকদের অংশগ্রহণ খুবই নগণ্য। ইউপি সদস্যরা রাজনৈতিক এলিটদের সঙ্গে সম্পদ বরাদ্দের জন্য আঁতাত/সহযোগিতা করে, যার ন্যূনতম আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক বাধা থাকে না, কারণ জবাবদিহি পদ্ধতি কার্যত অনুপস্থিত। সেটা হোক ওপর থেকে নিম্নমুখী আমলাতান্ত্রিক জবাবদিহি (দলতন্ত্র এবং বহুলাংশে রাজনৈতিকীকৃত আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে ছাড় দেওয়া হয়ে থাকে) বা নিচ থেকে ঊর্ধ্বগামী সামাজিক জবাবদিহি (যেহেতু এনজিওগুলো খুব কমই গরিব নাগরিকদের এগুলোতে যুক্ত করে, তাই কার্যকরী নাগরিক সম্পৃক্ততা থাকে না)।

তিন ইউনিয়নের তুলনা

খোকশাবাড়ি ইউনিয়নের ইউপি সচিবের মন্তব্যে সামাজিক জবাবদিহি প্রতিষ্ঠানের অকার্যকর অবস্থা এবং এসব প্রতিষ্ঠানকে প্রতিপালন করার ক্ষেত্রে ইউপি নেতাদের প্রণোদনার অভাব স্পষ্টভাবে বোঝা যায়:

ওয়ার্ড সভা পরিচালনা করে কী লাভ? ইউনিয়ন প্রতিনিধিরা যা ইচ্ছা তাই করবে... [ওয়ার্ড সভায়] আমন্ত্রিত লোকজন কোনো মতৈক্যে পৌঁছাতে পারে না [নিরাপত্তাবেষ্টনী বরাদ্দের ব্যাপারে]। যেমন ধরুন ভিজিডি কার্ড। প্রত্যেক ইউনিয়নের ২০টি কার্ড পাওয়ার কথা। যখন কার্ড কারা পাবে সে বিষয়ে তালিকা তৈরির জন্য সবাইকে আমন্ত্রণ জানানো হলো [ওয়ার্ড সভায়], তারা ৫০টি নাম সুপারিশ করল...কোনো মতৈক্যেই পৌঁছা যাবে না...শেষ পর্যন্ত চেয়ারম্যান এবং সদস্যরা প্রকৃত তালিকা প্রণয়ন করেছিল।

তার পর্যবেক্ষণটি এলিট নাগরিক, স্বভাব নেতা এবং অন্যান্য মধ্যবিত্ত শ্রেণির শিক্ষিত নাগরিকদের সমন্বয়ে গঠিত আমাদের মূল তথ্যদাতাদের সঙ্গে মিল পাওয়া যায়।

স্ট্যান্ডিং কমিটির কার্যত আচারসর্বস্ব/আনুষ্ঠানিক কাজের ধরন সম্পর্কে ইউপি সচিবের পর্যবেক্ষণটি নিম্নরূপ:

যেহেতু স্ট্যান্ডিং কমিটি থাকা বাধ্যতামূলক, তাই আমাদের নামমাত্র এসব কমিটি রয়েছে। এগুলো সত্যিকার জনস্বার্থে কোনো কাজে আসে না...আমি ৬ বছর ধরে ইউপিতে কাজ করছি। সব মিলিয়ে স্ট্যান্ডিং কমিটির ৬টি সভাও অনুষ্ঠিত হয়নি...আলাদাভাবে কোনো সভা হয় না (কমিটির)...কমিটির আলোচনাগুলো হয় ইউপির মাসিক সভার অংশ হিসেবে।

সামাজিক জবাবদিহি ফোরামে অংশগ্রহণের ধরন সম্পর্কে ইউপি সচিব বলেন:

ধনী ও ক্ষমতাবান এলিটরা এগুলোতে আসেনই না। ইউপি নেতৃত্বের কাছে যেসব ব্যক্তি উপকারে আসেন বলে মনে হয় এবং যাঁরা মনে করেন তাঁদের আসা উচিত (নেতাদের প্রতি আনুগত্য দেখাতে) তাঁরাই আসছেন। তাঁরা আসেন তাঁদের নির্দিষ্ট স্বার্থের জন্য (সামষ্টিক স্বার্থের জন্য নয়)। এঁরা বেশির ভাগই দরিদ্র বা অতিদরিদ্র।

সচিব আরও বলেন যে ইউপি নেতারা আগেভাগে যাই পরিকল্পনা করুক না কেন (তালিকা প্রণয়ন, বরাদ্দের স্থান ইত্যাদি), তা এসব ফোরামে অনুমোদিত হয়ে যায়। এটি সারপুকুর ইউনিয়নের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রযোজ্য। সারপুকুরে আমাদের বেশির ভাগ মূল তথ্যদাতা সামাজিক জবাবদিহি প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়াগুলোকে আনুষ্ঠানিক আচারসর্বস্ব বলে চিহ্নিত করেছে। তাঁরা বলেন, ইউপি নেতাদের সামাজিক জবাবদিহি প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রণোদনা নেই বললেই চলে। ইউপি আইন ২০০৯ ভিত্তিক বিধি ও নীতি এই প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রমের অভাবের জন্য দায়ী। আগের ইউপি জবাবদিহি পদ্ধতিগুলোকে কমবেশি কাজে লাগাত, কিন্তু বর্তমান পরিষদ এটা করে না বললেই চলে। এসব ফোরামে ইউপি সদস্যদের অংশগ্রহণও অনেক কম। আমাদের একজন মূল তথ্যদাতার বর্ণনা শুনলে এসব ফোরামের ব্যবহারের পরিধি এবং প্রাতিষ্ঠানিক কায়দা মেনে নেওয়ার আচারসর্বস্ব প্রকৃতি বোঝা যাবে (এই তথ্যদাতা একজন স্বভাব নেতা এবং ১৩টি স্ট্যান্ডিং কমিটির মধ্যে একটির সদস্য):

এক বছর আগে আমার প্রতিবেশী ও একজন নারী ইউপি সদস্যের কাছ থেকে শুনলাম যে আমাকে স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য করা হয়েছে। আমি জানি যে আমি ট্যাক্স কমিটির সদস্য। এই পর্যন্ত আমাকে ৩ বার সভায় আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আমাকে সাধারণত শেষ মুহূর্তে আমন্ত্রণ জানানো হয়, যখন সভায় অংশগ্রহণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে তিনটি সভার মধ্যে আমি একটিতে যোগ দিতে পেরেছিলাম। সভায় দেখলাম অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে আলোচনা করার কোনো আগ্রহই নেই। আচারসর্বস্বভাবে অংশগ্রহণকারীদের কাছ থেকে দস্তখত নিয়ে সভা শেষ হয়ে গেল। যদিও আমি সভায় যোগ দিয়েছি একবার, কিন্তু অন্য সভার জন্যও (সম্ভবত মিথ্যা সাজানো সভা) সভার উপস্থিতি খাতায় দস্তখত করেছি। নারী ইউপি সদস্যরা আমার বাড়িতে এসে নিয়মিত দস্তখত সংগ্রহ করে।

আরেকজন কমিটি সদস্য বলেছেন তিনি আগের ইউপি পরিষদের সভায় দুবার যোগ দিয়েছিলেন। একবার তিনি গিয়েই চলে এসেছিলেন, কারণ আর কেউ সেখানে যাননি। আমাদের আরও দুজন তথ্যদাতা রয়েছেন যাঁরা সারপুকুরে স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য (একজন ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় এবং অন্যজন অর্থ কমিটিতে)। তাঁরা নিজেদের নামেই কমিটির সদস্য ভাবেন, কারণ এই পর্যন্ত কখনোই তাঁদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। তাঁদের দুজনকেই কেয়ারের SETU ও PRODUCE প্রকল্পের মাধ্যমে অ্যাডভোকেসি করায় কমিটিতে সদস্য করা হয়েছিল। এটা প্রমাণ করে স্থানীয় পর্যায়ের প্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠানে শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় এনজিওগুলোকে কোন ধরনের এবং কী পরিমাণ রাজনৈতিক বাধার সম্মুখীন হতে হয়।

ইউপি সদস্যদের অনিচ্ছা থেকেও বোঝা যায় যে তাঁরা সামাজিক জবাবদিহি ফোরামগুলোতে মানুষকে আমন্ত্রণ জানাতে উদ্যোগ নেন না। এনজিও কর্মকর্তারা এবং এনজিওর সঙ্গে সম্পৃক্ত (বিশেষ করে কেয়ারের কর্মসূচি) স্বভাব নেতারা আমন্ত্রণের কাজটি করেন। অন্য দুটি ইউপির একই অবস্থা। আমাদের মূল তথ্যদাতারা মনে করেন, ইউপি নেতারা উদ্যোগ নিলে ফোরামগুলোতে আরও বেশি মানুষ আসত।

অন্য দুই ইউপির তুলনায় বতলাগাড়ি ইউনিয়নে সামাজিক জবাবদিহি প্রতিষ্ঠানগুলো ভালো করছে। গণফোরামগুলোতে এগুলো বিশেষভাবে সত্যি (ওয়ার্ড সভা, প্রাক-বাজেট ও উন্মুক্ত বাজেট আলোচনা), কিন্তু স্ট্যান্ডিং কমিটির (যেগুলো রাজনৈতিক এলিট ও ইউপি চেয়ারম্যানের ছাড় দেওয়ার ধরনের ক্ষেত্রে কমিটির স্বাধীনতা বিচারে অন্য দুই ইউপির থেকে আলাদা নয়) তা সত্য নয়। যেমন যদিও বতলাগাড়িতে স্ট্যান্ডিং কমিটিগুলোর কাজের অবস্থা তুলনামূলক অন্য দুই ইউনিয়নের চেয়ে ভালো, তবুও এটাকে মধ্যম মানের বলা যায়। এই ইউনিয়নের ইউপি সচিবের মতে, ১৩টি স্ট্যান্ডিং কমিটির মধ্যে ৭টি বর্তমানে কার্যকর। বতলাগাড়ি ইউপিতে গণসামাজিক জবাবদিহি ফোরামের সভা নিয়মিত বিরতিতে অনুষ্ঠিত হয় এবং এগুলোতে স্বভাব নেতারা, গরিব নাগরিক ও কিছু এলিটও সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়।

দুষ্ট ও শুভচক্র

ইউনিয়ন পরিষদের জোগানের দিকটি দেখলে ইউপি নেতার (ইউপি চেয়ারম্যান) গতিশীল ভূমিকাটি দেখা যায়। বতলাগাড়ি ইউপি সেবা প্রদান কর্মসক্ষমতা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসনব্যবস্থার ক্ষেত্রে অনেকটা ভিন্ন হওয়ার এটাও বড় কারণ। ইউপির সুনাম বজায় রাখার পেছনে চেয়ারম্যানের জোরালো প্রণোদনা রয়েছে। মূলত সরকার ও এনজিওসহ গুরুত্বপূর্ণ স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে তার ইউপিকে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও দরিদ্রবান্ধব শাসনব্যবস্থার রোল মডেল হিসেবে দেখাতে চায়। তার অর্জনগুলো শুধু প্রতীকী বা ব্যক্তিগত নয় (রাজনৈতিক এলিটদের মধ্যে মর্যাদা, অহমের সন্তুষ্টি), বস্তুগত ও রাজনৈতিকও বটে। সরকার ও এনজিওর কাছে সুনাম থাকায় বছরের পর বছর আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা পেয়ে আসছে। এটা তার রাজনৈতিক মূলধনও বৃদ্ধি করেছে। আমাদের মূল তথ্যদাতাদের মতে, তার ভবিষ্যত্ নির্বাচনে জেতার সম্ভাবনাও উজ্জ্বল। স্থানীয় ও বৃহত্তর রাজনৈতিক সমঝোতার নির্দিষ্ট ধরন ইউপি চেয়ারম্যানকে পেট্রন-ক্লায়েন্ট রাজনীতির দুর্বলীকরণ প্রভাব, আত্মীয়-গোষ্ঠীর রাজনীতি এবং সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী বরাদ্দের ক্ষেত্রে দুর্নীতি থেকে সামাজিক জবাবদিহির গণফোরামগুলোকে রক্ষা করার প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক ক্ষেত্র প্রদান করে (আমাদের মূল তথ্যদাতাদের মতে, বতলাগাড়িতে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কার্ড খুব কমই বিক্রি হয়।১২ কিন্তু এই চর্চা অন্য দুই ইউপিতে ব্যাপকভাবে ঘটে)।

বতলাগাড়িতে পার্থক্য করে দেওয়া আরেকটি বিষয় হলো (জোগানের দিক থেকে) এই ইউপিতে ব্যাপক হারে এনজিও নেতৃত্বাধীন শাসনব্যবস্থা কার্যক্রম। আমাদের বেশির ভাগ মূল তথ্যদাতা, চেয়ারম্যানসহ সবাই বতলাগাড়িতে সামাজিক জবাবদিহি পদ্ধতি প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে এনজিওগুলোর (বিশেষ করে কেয়ার) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা বলেন। এনজিওর ভূমিকা শুধু ইউপির ব্যবস্থাপনা/লজিস্টিক সহায়তায় সীমাবদ্ধ নয়। নাগরিকদের একত্র করতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এনজিওগুলো নাগরিকদের নিচ থেকে উঠে আসা চাপগুলো তুলে ধরেছে। বতলাগাড়ি ইউপি সচিব বলেন, এই ইউপির শাসনব্যবস্থা ভালো হওয়ার কারণ হলো সামাজিক জবাবদিহি প্রতিষ্ঠান যেমন স্বভাব নেতাদের সমিতি, প্রতিবেশী উন্নয়ন কমিটি এবং গ্রাম উন্নয়ন কমিটি থেকে সত্যিকার চাপ থাকার পাশাপাশি এনজিওগুলোর চাপ। এনজিওর মূল অবদান হলো নাগরিকদের ইউনিয়ন পরিষদমুখী করতে সংঘবদ্ধ করা। অন্য দুই ইউনিয়নে যেখানে নাগরিকেরা ইউপি সম্পর্কে নিষ্ক্রিয় ও সমালোচনামুখর, বতলাগাড়িতে নাগরিকেরা তাদের সামষ্টিক জীবনে ইউপির ইতিবাচক ভূমিকা নিয়ে বেশ আশাবাদী। ইউপির সঙ্গে তাদের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ (এনজিওর প্রবল প্রচেষ্টায়) ইউপিকে অন্তর্ভুক্তিমূলক উপায়ে সেবা প্রদানে সর্বদা চাপে রেখেছে। এই ব্যাপারটি বতলাগাড়ি ইউপি সচিব বেশ জোর দিয়ে বলেন।

অন্যদিকে অন্য দুই ইউনিয়নে সামাজিক জবাবদিহি ফোরামগুলোতে উঠে আসা দাবিগুলোর প্রতি ইউপি নেতাদের নিষ্ক্রিয়তা ইউপির প্রতি মানুষের সমালোচনা ও অবিশ্বাস তৈরি করেছে। প্রতিজ্ঞা যা করা হতো তা পূরণ হতো না এবং ইউপি নেতাদের সততা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে রাগান্বিত ইউপি নেতারা (যেমন সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর কার্ড বিতরণে দুর্নীতি) তা নিরুত্সাহিত করত। নেতাদের এসব দৃষ্টিভঙ্গি মানুষের এই ধরনের গণফোরামগুলোর অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দিহান করে তুলেছে। এসব কারণে দেখা যায়, মানুষজন সামষ্টিক ফোরামকে এড়িয়ে ব্যক্তিবিশেষ ইউপি নেতাদের সঙ্গে সুবিধা আদায়ে আঁতাত গড়তে চায়। যেমন যখন মানুষ দেখত যে অবাস্তব নামের তালিকা করা হয়েছে ওয়ার্ড সভাতে, তখন তারা বুঝত যে কিছু নাম গোপনে বাদ পড়ে যাবে। এই ধারণার কারণে অনেকেই গোপনে ইউপি নেতাদের কাছে যায়, যেন তাদের নাম তালিকায় থাকে। তখন আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে নাম রাখা হয়। এসব গোপন লেনদেনের খবর মানুষের কাছে ছড়িয়ে পড়লে তারা সামাজিক জবাবদিহি ফোরাম সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে পড়ে এবং এদের বৈধতাও নষ্ট হয়ে যায়। খোকশাবাড়ি ও সারপুকুর ইউনিয়নের মানুষ এভাবে প্রাতিষ্ঠানিক অদক্ষতার এক দুষ্টচক্রে আটকে পড়েছে এবং সততার অভাব আস্থার সংকট তৈরি করেছে, যা এসব প্রতিষ্ঠানের পতনকে ত্বরান্বিত করছে।

কিন্তু বতলাগাড়ি ইউপি এই দুষ্টচক্র থেকে রক্ষা পেয়েছে বলে মনে হয়। দক্ষ নেতৃত্ব, সুবিধাজনক এলিট রাজনৈতিক সমঝোতা, ইউপি ও স্থানীয় সরকারের মধ্যে লাভজনক আঁতাত এবং উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি সময়ের জন্য সামাজিক জবাবদিহির অবকাঠামো তৈরি করতে ব্যাপক এনজিও হস্তক্ষেপ সম্ভবত এ ক্ষেত্রে অবদান রেখেছে। সৌভাগ্যজনক অবস্থা, নেতাদের রাজনৈতিক সুচিন্তা এবং বাইরের এজেন্সিগুলোর সহায়তায় সুস্থ সমন্বয় বতলাগাড়িতে একটি শুভচক্র তৈরি করেছে।

উপসংহারমূলক বিশ্লেষণ এবং নীতি সুপারিশ

নিচের টেবিলে সংক্ষেপে ইউপি নেতাদের প্রণোদনার রাজনৈতিক নির্ধারকগুলো এবং বৃহত্তর রাজনৈতিক সমঝোতা, ক্লায়েন্টভিত্তিক জবাবদিহি এবং দরিদ্রবান্ধব শাসনব্যবস্থায় সামাজিক জবাবদিহি পদ্ধতির ওপর আগের অধ্যায়গুলোর আলোচনা দেওয়া হয়েছে।

টেবিল ৩: রাজনৈতিক নির্ধারকসমূহ, ইউপি নেতাদের প্রণোদনার ধরন এবং দরিদ্রবান্ধব শাসনব্যবস্থা

রাজনৈতিক নির্ধারকসমূহ

ফলে ইউপি নেতাদের প্রণোদনা

দারিদ্র্যবান্ধব শাসনব্যবস্থায় প্রভাব

স্থানীয় এলিট রাজনৈতিক সমঝোতা

  • ইউপি নেতাদের স্থিতিশীল রাজনৈতিক সমঝোতা বজায় রাখার জোরালো আগ্রহ সব সংশ্লিষ্ট এলিট অ্যাক্টরদের প্রণোদনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
  • স্থিতিশীল পিএস ইউপি নেতাদের উপজেলা চেয়ারম্যান ও এমপির কাছ থেকে অধিক সম্পদ আহরণ নিশ্চিত করে। বেশি সম্পদ থাকলে গরিবদের সম্পদ পাওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়
  • বেশি সম্পদ থাকলে ইউপি নেতারা নেতিবাচক স্থানীয় এলিট রাজনীতির প্রভাব থেকে সেবা প্রদানের প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়াকে গরিবদের কাজে লাগাতে পারে।
  •  স্থিতিশীল রাজনৈতিক সমঝোতা থাকলে সুষ্ঠু ও ন্যায্য উপায়ে দ্বন্দ্ব মেটানো যায়, যার মাধ্যমে গরিবদের ওপর কল্যাণমূলক প্রভাব পড়ে।
 

বৃহত্তর এলিট রাজনৈতিক সমঝোতা

  • যখন জাতীয় রাজনৈতিক অ্যাক্টরদের (মূলত এমপি) সঙ্গে ইউপি নেতৃত্বের রাজনৈতিক মিল থাকে তখন ইউপি নেতৃত্ব রাজনৈতিক এলিটদের ইউপির উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান ও কর্মসূচিকে রাজনৈতিক এলিটদের হাতে দিয়ে দেয়। কিন্তু যদি তা না থাকে তাহলে ইউপি নেতারা উন্নয়ন কার্যক্রমকে সম্ভাবনাময়ভাবে বাহ্যিক রাজনৈতিক প্রভাব থেকে আলাদা করতে পারে। এটা ইউপি নেতাদের গরিবদের স্বার্থ অগ্রসরে রাজনৈতিক ক্ষেত্রটি কাজে লাগানোর জন্য দরিদ্র্যবান্ধব প্রণোদনার ওপর নির্ভর করে (রাজনৈতিকভাবে এবং কমিউনিটিতে আদর্শগতভাবে লাভবান হওয়া এবং প্রশাসনের উচ্চ স্তর থেকে বেশি পরিমাণে সম্পদ নিশ্চিত করার প্রত্যাশার ভিত্তিতে)।

 

 

 

 

  • বৃহত্তর পর্যায়ে এলিট রাজনৈতিক সমঝোতার ক্ষেত্র রাজনৈতিক সাদৃশ্য দারিদ্র্যবান্ধব শাসনব্যবস্থাকে সহায়তা করে না।
  • ইউপি প্রতিষ্ঠানগুলোতে (স্ট্যান্ডিং কমিটি, উন্মুক্ত বাজেট ইত্যাদি) গরিবদের অংশগ্রহণের জন্য রাজনৈতিক ক্ষেত্র ক্ষমতাসীন দলের এলিটদের প্রভাবের কারণে হারিয়ে যেতে পারে।
  • এসব রাজনৈতিক ক্ষেত্র গরিবদের অংশগ্রহণ প্রাতিষ্ঠানিক করার ক্ষেত্রে ভালোভাবে কাজে লাগানো যায়, যদি নেতারা স্থানীয় এলিটদের থেকে স্বাধীন থাকতে পারে এবং দারিদ্র্যবান্ধব শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় প্রণোদনা থাকে

অনানুষ্ঠানিক/ক্লায়েন্টভিত্তিক জবাবদিহি

  • এটা ইউপি নেতাদের তাঁদের বৈধতা সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণে আত্মীয়তা এবং অন্যান্য বংশ পরিচয়ভিত্তিক নির্বাচনী এলাকার ওপর নির্ভর করতে উত্সাহিত করে।

 

 

 

 

 

  • যেসব গরিব বংশপরিচয়ভিত্তিক পৃষ্ঠপোষকতা নেটওয়ার্কের অংশ নয় তাদের বঞ্চিত করা হয়।
  • এটা বাইরের এজেন্সিগুলোর (এনজিও, নাগরিক সমাজ) জন্যও কর্মসূচিভিত্তিক রাজনীতি এবং নাগরিক হিসেবে গরিবদের অধিকারের দাবি আদায়ে গরিবদের সংঘবদ্ধ করাটা কঠিন করে ফেলে।

সামাজিক জবাবদিহি ফোরামের সূচনা

  • বাধা দেওয়া বা নষ্ট করার পরিবর্তে, ইউপি নেতাদের প্রণোদনা হলো সামাজিক জবাবদিহি প্রতিষ্ঠান ও ফোরামগুলোকে সহযোগিতা/প্রভাবিত করা, যা ফসল পাওয়া দিয়ে শুরু হয়।
  • ইউপি নেতাদের এসব ফোরামকে কাজে লাগানোর আরেকটি অন্যতম প্রণোদনা হলো নির্দিষ্ট কৌশলগত সুবিধা আদায় (কেন নির্দিষ্ট কিছু প্রতিজ্ঞা পূরণ করা যায়নি তা ব্যাখ্যা করা, বাজেট সীমাবদ্ধতা, প্রকল্পের পেছনে গণদাবি দেখিয়ে সমর্থন আদায় করা, সহ-উত্পাদন ইত্যাদি)

 

 

 

 

 

 

  • গরিব ও ইউপি নেতাদের মধ্যে তথ্যগত অসমতা দূর করা
  • সামাজিক জবাবদিহি ফোরামগুলো প্রত্যক্ষভাবে নেতাদের দায়বদ্ধতা শুধরাতে ভূমিকা রাখে
  • ওয়ার্ড সভার মতো ফোরামগুলো গরিব নাগরিকদের নাগরিক হিসেবে দাবি তোলা এবং অধিকার আদায়ে সহায়তা করে
  • স্ট্যান্ডিং কমিটিগুলো গরিবদের ইউপি নীতি প্রক্রিয়ায় তাদের বক্তব্য তুলে ধরতে সম্ভাব্য ক্ষেত্র তৈরি করে
  • নারীরা জেন্ডারবিষয়ক দাবি পেশ করতে পারে

সূত্র: লেখকদ্বয়

তিনটি ইউপিতে আমাদের গবেষণা ফলাফল অন্যান্য প্রাসঙ্গিক নীতি পর্যবেক্ষণ ও বাংলাদেশের স্থানীয় শাসনব্যবস্থার ওপর একাডেমিক গবেষণার সঙ্গে বৃহত্তর ক্ষেত্রে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আমরা আগে জেন্ডারসংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক সমঝোতার ওপর কিছু কাজের কথা উল্লেখ করেছি। স্থানীয় পর্যায়ে সামাজিক বাধ্যবাধকতার ওপর করা গবেষণায় কীভাবে ক্লায়েন্টভিত্তিক রাজনীতি দরিদ্রদের সম্পদ বিতরণে স্থানীয় এলিট প্রণোদনা গঠন করে তার একই ঝোঁক দেখায়। কিছু গবেষণায় পাওয়া যায়, কীভাবে স্থানীয় পর্যায়ে প্রকৃত এলিট বহুলাংশে স্থানীয় প্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলোর শাসনব্যবস্থা প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে (CGS and BRAC RED 2006; Hossain and Osman, 2007; Hossain 2007; BDI, BRAC, NFPCSP 2009; Alim and Sulieman 2009; Ahmad 2007; MacLoughlin and Bately 2012)। নির্বাচনী পৃষ্ঠপোষকতা নেটওয়ার্কের বাইরে যোগ্য গরিবদের জন্য সম্পদ বরাদ্দ নিশ্চিত করতে ভূমিকা রাখা সামাজিক বাধ্যবাধকতাভিত্তিক জবাবদিহির ওপর গবেষণালব্ধ পর্যবেক্ষণ অন্য গবেষণাতেও পাওয়া যায়:

প্রতিযোগিতামূলক ক্লায়েন্টভিত্তিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক এলিটদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি থাকলেও মূলত পৃষ্ঠপোষকদের বাধ্যবাধকতাই (সামাজিক, প্রথাগত, নৈতিক) সীমিত জবাবদিহি নির্ধারণ করে, যা সামাজিক দায়বদ্ধতার ক্ষেত্রে গরিবেরা স্থানীয় রাজনৈতিক এলিটদের কাছ থেকে আদায় করতে সক্ষম (বিদ্যমান গবেষণার বিস্তারিত বিশ্লেষণের জন্য দেখুন (হোসেন ২০১২, পৃ.৩৪)। এই গবেষণায় বর্ণিত স্থানীয় ও বৃহত্তর এলিট-রাজনৈতিক সমঝোতার ধারণা অন্য আরেকটি পর্যায়ের (জাতীয় নীতি পর্যায়ের) এলিট-রাজনৈতিক সমঝোতার মধ্যে প্রোথিত। জাতীয় পর্যায়ের সমঝোতাটি দরিদ্রবান্ধব উন্নয়ন কৌশলের ওপর জাতীয় রাজনৈতিক এলিটদের স্থায়ী ও দীর্ঘমেয়াদি মতৈক্য। সামাজিক সুরক্ষার ক্ষেত্রে এই এলিট সমঝোতার মূল বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নরূপ:

স্বৈরতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক উভয় প্রকার ধারাবাহিক সরকারগুলোই নীতি ও তত্পরবর্তী বরাদ্দ প্রদানের মাধ্যমে নির্দিষ্টকৃত গরিবদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর ব্যবস্থার প্রতি প্রতিশ্রুত ছিল।

এই খাতের জোরালো নীতি ধারাবাহিকতা সব সরকারের আমলেই ছিল, যা অন্য খাতে দেখা যায় না। প্রকৃতপক্ষে আগের সরকারের আমলে আসা কর্মসূচি শুধু অব্যাহতই রাখা নয় তা বাড়ানোও হয়েছে।

কিছু নীতিকে রাজনৈতিকভাবে খুবই সংবেদশীল মনে করা হয় এবং সব সরকারের জন্যই বৈধতার গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক মনে করা হয়। যেমন সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থার দ্রুত বাস্তবায়নের মাধ্যমে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও দুর্ভিক্ষ থেকে রক্ষা পাওয়া (হাসান ২০১২, পৃ.৩৩)।

জাতীয় পর্যায়ে এ ধরনের এলিট-রাজনৈতিক সমঝোতা গ্রামীণ এলাকায় সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী সম্পর্কিত কার্যাবলিতে ব্যাপক বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিত করেছে। ক্ষমতায় কোন ধরনের শাসকগোষ্ঠী রয়েছে তা বিবেচ্য বিষয় ছিল না। যা হোক, এই গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, জাতীয় পর্যায়ে দরিদ্রবান্ধব উন্নয়নে এলিট সমঝোতার প্রকৃত সফলতার (নীতি বাস্তবায়নে) অনুরূপ অদম্য দরিদ্রবান্ধব প্রতিশ্রুতি স্থানীয় পর্যায়ে ছিল না। এই গবেষণায় প্রমাণসহ দেখানো হয়েছে কেন এমন জাতীয় পর্যায় এলিট প্রতিশ্রুতি সম্পূর্ণরূপে স্থানীয় এলিটদের প্রণোদনাকে প্রভাবিত করতে পারে না। স্থানীয় রাজনৈতিক সমঝোতার কঠিন অবস্থা মানে হলো দরিদ্রবান্ধব উন্নয়ননীতি ও শাসনব্যবস্থা প্রক্রিয়ার প্রকৃত ধরন জাতীয় পর্যায়ের নীতি বাস্তবায়নকারী এলিটদের প্রত্যাশিত আদর্শ চেহারা থেকে অনিবার্যভাবে উল্লেখযোগ্য হারে বিচ্যুত হবে। স্পষ্টতই ‘ব্যষ্টিক রাজনীতির’ (ম্যাকলাফলিন ও বেটলি ২০১২) ধারণা প্রয়োজনীয়, যা সেবা প্রদান পর্যায়ে অ্যাক্টরদের প্রণোদনা নির্ধারণ করে (দেখুন টেবিল ৩ এবং পূর্ব আলোচনা)।

‘ত্রুটিপূর্ণ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার’ বিশ্লেষণী মাধ্যম দিয়ে দেখলে বোঝা যায়, কীভাবে স্থানীয় ইউপি নেতাদের প্রণোদনা কাঠামো গঠিত হয় এবং দরিদ্রবান্ধব ও অংশগ্রহণমূলক শাসনব্যবস্থার বিবর্তনে এর প্রভাব কী। ‘কর্মসূচিভিত্তিক রাজনীতি’ না থাকায় রাজনীতিবিদেরা (এখানে ইউপি নেতৃত্ব), যারা একটা প্রতিযোগিতামূলক ক্লায়েন্টভিত্তিক বিন্যাসে চলছে, তাদের জোরালো দাবিহীন ভোটারদের প্রতি বিশেষ করে বৃহত্ দরিদ্র গোষ্ঠীর প্রতি বিশ্বাসযোগ্য প্রতিশ্রুতি দেওয়ার ক্ষেত্রে তুলানামূলক কম তাগিদ থাকে। মূল নির্বাচক, যারা ভোট ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ করে তাদের বিশেষ সুবিধা ও পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে তাদের আনুগত্য নিশ্চিত করার মাধ্যমে ভোট নিশ্চিত করা হয়। ফলাফলে দেখা যায়, এটা ইউপি চেয়ারম্যানের ক্ষেত্রে বেশি সত্য এবং বিভিন্ন কারণে ইউপি সদস্যদের ক্ষেত্রে ততটা সত্য নয়।

রাজনীতিবিদ ও নির্বাচকমণ্ডলীর মধ্যে তথ্যগত অসমতা থাকার ফলেও রাজনৈতিক বাজার ত্রুটিপূর্ণ বলা যায়। তথ্যগত অসমতার ক্ষেত্রে বৃহত্ দরিদ্র জনগোষ্ঠী এলিটদের চেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ে। যদিও গরিবেরা কম জ্ঞাত থাকে। আমাদের গবেষণায় দেখা যায়, তারা এখন আগের চেয়ে তাদের ইউপি প্রতিনিধিদের কর্মসক্ষমতার ব্যাপারে বেশি জানে। এর মূল কারণ হলো নতুন তৈরি হওয়া সামাজিক জবাবদিহি ফোরামগুলো এবং বাহ্যিক এজেন্সিগুলোর (এনজিও) অ্যাডভোকেসি বাংলাদেশের গ্রামীণ শাসনব্যবস্থার চাহিদার দিকটি এখন বহুলাংশে ‘হাত-ধরা নাগরিকদের’ দ্বারা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। গরিবদের জন্য যত কম তথ্যগত বৈষম্য থাকবে ততই তারা সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী বরাদ্দ প্রক্রিয়ায় শাসনব্যবস্থায় অর্ধবহভাবে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পাবে। এর মানে হলো বণ্টন-প্রক্রিয়ায় কম দুর্নীতি হবে। বতলাগাড়িতে এই রকম একটি প্রক্রিয়া ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে। অন্য দুই ইউনিয়নে ক্লায়েন্টভিত্তিক রাজনীতির ব্যাপকতার মানে হলো সামাজিক জবাবদিহি অবকাঠামো এবং এনজিও নেতৃত্বাধীন সংঘবদ্ধকরণ প্রক্রিয়ার প্রভাব স্বচ্ছ, দরিদ্রবান্ধব, অংশগ্রহণমূলক শাসনব্যবস্থা প্রদানে ইউপি নেতৃত্বের প্রণোদনায় খুব সীমিত।

ভোটারদের মধ্যে সামাজিক বিভক্তি ও বিভাজনও ত্রুটিপূর্ণ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা তৈরি করে। আমাদের ইউপিগুলোতে কমিউনিটি বিভিন্ন পরিচয়ে বিভক্ত (আত্মীয়তা, আঞ্চলিকতা, স্থানিকতা) এবং ভোটের ধরন বহুলাংশে প্রাচীন আনুগত্যের দ্বারা প্রভাবিত। এই বিভক্তির ফলে ইউপি নেতারা খারাপ কাজ করলে শাস্তি দেওয়ার যে নির্বাচনী জবাবদিহি পদ্ধতি রয়েছে, তা দুর্বল করে ফেলেছে। ব্যক্তিগত বা সামষ্টিক কর্মসক্ষমতার চেয়ে বংশগত বিষয়গুলোই নেতৃত্ব বিচারে গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি হয়ে গেছে। ফলে, ভোটারদের বিভক্তি নেতাদের ভোটারদের পরিচয়ের ভিত্তিতে সম্পদ বণ্টনে রাজনৈতিক প্রণোদনা প্রদান করে।

নিচে টেবিল ৪-এ ‘ত্রুটিপূর্ণ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার’ দিক থেকে নির্বাচনী জবাবদিহির গতিপ্রকৃতি সংক্ষেপণ করা হয়েছে এবং নীতি ও কর্মসূচিমূলক কৌশল ও প্রভাব চিহ্নিত করা হয়েছে।

টেবিল ৪: নির্বাচনী জবাবদিহির গতিপ্রকৃতি

রাজনৈতিক নির্ধারকসমূহ

এলিট নাগরিকেরা

দরিদ্র নাগরিকগণ

দারিদ্র্যবান্ধব শাসনব্যবস্থার প্রভাব

ইউপি নেতাদের করা প্রতিজ্ঞার বিশ্বাসযোগ্যতার মাত্রা

এলিটদের জন্য অনেক বেশি

দরিদ্রদের জন্য কম থেকে মাঝারি

  • ইউপি চেয়ারম্যানের ক্ষেত্রে কম
  • ইউপি সদস্যদের ক্ষেত্রে মাঝারি

বহুলাংশে নেতিবাচক:

  • ইউপি শাসনব্যবস্থায় দরিদ্র্যদের অর্থবহ অংশগ্রহণ এগিয়ে নেওয়া/সহজ করার ক্ষেত্রে ইউপি নেতাদের প্রণোদনা কম

ইউপি নেতা ও ভোটারদের মধ্যে তথ্যগত অসমতার মাত্রা

কম

ইউপি চেয়ারম্যানের ক্ষেত্রে বেশি। ইউপি সদস্যদের ক্ষেত্রে মাঝারি

শাসনব্যবস্থার ওপর মিশ্র প্রভাব

ভোটার বিভক্তির ফলে যারা সুবিধা পায়

এলিটদের জন্য বেশি সুবিধা

যেসব গরিবের প্রভাবশালী পৃষ্ঠপোষক রয়েছে তাদের জন্য মাঝারি ধরনের সুবিধা। আর যেসব গরিবের কোনো পৃষ্ঠপোষক নেটওয়ার্ক নেই তাদের জন্য কম সুবিধা

শাসনব্যবস্থার ওপর মিশ্র প্রভাব

টেবিল ৪-এ দেখা যায় যে ইউপি নেতাদের নির্বাচনী প্রতিজ্ঞাকে গরিবদের চেয়ে এলিটদের কাছে বেশি বিশ্বাসযোগ্য। এই পার্থক্যটি নির্বাচনী জবাবদিহির পরিপ্রেক্ষিতে উভয় অ্যাক্টরদেরই কৌশলগত গুরুত্বের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যাবে। এই বিষয়ে আমাদের আলোচনা থেকে দেখা যায়, ইউপি নেতাদের এলিট ভোটব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা প্রয়োজন এবং ইউপির উন্নয়ন কার্যক্রমের সুন্দর বাস্তবায়নের জন্যও এলিট মতৈক্য প্রয়োজন। যে জন্য এসব এলিটের কাছে করা প্রতিজ্ঞা ভাঙাটা বেশ অসম্ভব বলা যায়। অন্যদিকে, কোনো ধরনের জোরালো ভূমিকাহীন গরিব ভোটারদের ক্লায়েন্টভিত্তিক রাজনীতিতে কম গুরুত্বপূর্ণ ধরা হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ইউপি চেয়ারম্যান গরিবদের কাছ থেকে ‘ব্লক’ ভোট আদায়ে এলিটদের ওপর নির্ভর করতে পারে। তাই গরিবদের কাছে করা প্রতিজ্ঞা ভাঙাটা রাজনৈতিকভাবে বাস্তবসম্মত। এই ব্যাখ্যাটা সম্ভবত ইউপি চেয়ারম্যানের ক্ষেত্রে বেশি প্রযোজ্য, যদিও ইউপি সদস্যদের ক্ষেত্রে ততটা প্রযোজ্য নয়। ইউপি সদস্যদের নির্বাচনী প্রতিজ্ঞার ব্যাপারে অনেক সংবেদনশীল হতে হয়, কারণ তারা কাজ করে বেশির ভাগ বস্তুগত সেবা নিয়ে (যেমন নিরাপত্তাবেষ্টনী)। গরিবেরা তাদের নির্বাচনী প্রতিজ্ঞা সব সময় মূল্যায়ন করতে পারে। এই নির্বাচনী হিসাব-নিকাশের কারণে ইউপি নেতাদের অংশগ্রহণমূলক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় প্রণোদনা কম। নেতাদের এই প্রণোদনা কাঠামোকে ধরে নিলে একটি গুরুত্বপূর্ণ অ্যাডভোকেসি কৌশল (এনজিওগুলোর জন্য) হতে পারে নীতি প্রণয়ন ও সম্পদ বরাদ্দ-প্রক্রিয়ায় ইউপি নেতা ও গরিবদের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগকে উন্নত করা ও এগিয়ে নেওয়া।

এলিটদের ক্ষেত্রে তথ্যগত অসমতা এত বেশি নয়, কারণ তারা ইউপির তত্ত্বাবধানের সংশ্লিষ্ট আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যুক্ত। আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো ইউপি নেতারা অনানুষ্ঠানিকভাবে এলিটদের সঙ্গে পরামর্শ করেন। অন্যদিকে গরিবদের ইউপির তদারকি ব্যবস্থায় এই ধরনের কোনো আনুষ্ঠানিক অংশগ্রহণ নেই এবং ইউপি নেতারাও তাদের অনানুষ্ঠানিক পরামর্শের জন্য আমন্ত্রণ করেন না বললেই চলে। তবে বলা চলে, নতুন আইন এবং এনজিও নেতৃত্বাধীন সংঘবদ্ধকরণ প্রক্রিয়ার পাশাপাশি সম্প্রতি প্রতিষ্ঠিত সামাজিক জবাবদিহি পদ্ধতি কিছুটা তথ্যগত অসমতা কমিয়েছে। তবে মনে রাখতে হবে, গরিবেরা শুধু নীতি প্রণয়নের সময়ই কিছু বিষয় জোগান দিতে পারে (প্রাক ও উন্মুক্ত বাজেট আলোচনা), কিন্তু বাস্তবায়নের সময় আর সম্ভব হয় না। যে কারণে নেতাদের কর্মসক্ষমতার সঙ্গে সম্পৃক্ত তথ্য তাদের আওতার বাইরে থেকে যায়। আগেই বলা হয়েছে যে গরিবেরা আগের চেয়ে ইউপি সদস্যদের কর্মসক্ষমতার ব্যাপারে অনেক বেশি জ্ঞাত থাকে। তথ্যগত অসমতা ইউপির উন্নয়নমূলক কার্যাবলির সঙ্গে সম্পৃক্ত তথ্য শিক্ষা যোগাযোগ (আইইসি) কর্মসূচি পরিচালনার মাধ্যমে দূর করা যেতে পারে (অথবা এখন যেখানে এই কর্মসূচি রয়েছে সেখানে এর মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে)। আইইসি শুধু নীতি প্রণয়ন ও সম্পদ বরাদ্দ-প্রক্রিয়াতেই আলোকপাত করলে চলবে না, তা বাস্তবায়ন-প্রক্রিয়াতেও করতে হবে।

টেবিল ৩-এ দেখানো হয়েছে যে ভোটার বিভক্তি এলিট এবং দরিদ্রদের ভিন্নভাবে প্রভাবিত করে। মনে রাখতে হবে যে গরিবেরাও কিন্তু সবাই একইভাবে ভোগান্তির শিকার হয় না। যেসব গরিব এলিট নেটওয়ার্কের আওতায় থাকে তারা কম ভোগে, কিন্তু যারা এসব কোনো নেটওয়ার্কের মধ্যে নেই তাদেরই বেশি ভোগান্তি সহ্য করতে হয়। এর কিছুটা সমাধান করা সম্ভব যদি ক্লায়েন্টভিত্তিক রাজনীতির ধরন রূপান্তর করা যায়। এ ধরনের রূপান্তর সম্ভবত দীর্ঘমেয়াদে ঘটবে যখন দেশের শিক্ষা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে। কিন্তু অন্তর্বর্তী এই সময়ে কর্মসূচিভিত্তিক রাজনীতির মাধ্যমে ক্লায়েন্টভিত্তিক রাজনীতিকে, কমপক্ষে সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে, দমিয়ে রাখতে স্বল্প বা মধ্যমেয়াদি কৌশল নিতে হবে।

সবচেয়ে কঠিন এবং কৌশলী বিষয় হলো কীভাবে বৃহত্তর রাজনৈতিক সমঝোতাকে দেখা হবে। এখানে জাতীয় ও স্থানীয় উভয় পর্যায়ের রাজনৈতিক অ্যাক্টররা এবং রাষ্ট্র-সমাজ সম্পর্কযুক্ত। রাষ্ট্র-সমাজ সম্পর্কটা মূলত দলীয় রাজনীতির ওপর নির্ভরশীল। উন্নয়ন এনজিওগুলোর জন্য এই বৃহত্তর রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থা ক্ষেত্রটি নীতি ক্ষেত্রে মারাত্মক উভয়সংকট তৈরি করে। এই গবেষণায় দেখা যায়, একদিকে ইউপি নেতাদের প্রণোদনাকে দরিদ্রবান্ধব করতে হলে যেকোনো কৌশলকেই বৃহত্তর রাজনৈতিক সমঝোতাটা বুঝতে হবে। বাহ্যিক অ্যাক্টর হিসেবে এনজিওগুলোকে ইউপি নেতাদের জন্য একটি রাজনৈতিক ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে, যেন নেতারা এই সমঝোতার মধ্যে প্রভাব ফেলার সামর্থ্য অর্জন করতে পারেন। এই সামর্থ্য ইউপি নেতাদের সেবা প্রদান ব্যবস্থাপনায় স্থানীয়/জাতীয় রাজনৈতিক নেতাদের প্রভাব এড়াতে সহায়তা করবে, যা সম্পূর্ণ দলীয় বিবেচনায় হবে না। অন্যদিকে, এনজিওগুলোর এসব কাজ তাদের রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ দ্বন্দ্বে ফেলে দেবে এবং সম্ভবত ‘রাজনৈতিক সমাজের’ নৈতিকভাবে অস্পষ্ট ও নোংরা রাজনীতিতে গভীরভাবে যুক্ত করে ফেলবে (করব্রিজ ও অন্যান্য ২০০৫)। বাস্তবে, এনজিওগুলো এসব রাজনীতি এড়িয়ে চলে এবং বৃহত্তর রাজনৈতিক সমাজের ক্লায়েন্টভিত্তিক রাজনীতিতে কৌশলগত সহাবস্থান করতে চায়। এসব কৌশল যদিও স্বল্পমেয়াদে গরিবদের সংঘবদ্ধ করতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এনজিওগুলো গরিবদের জন্য এমন স্থায়ী রাজনৈতিক ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে না, যার ভিত্তিতে গরিব নাগরিকেরা স্বাধীন সামষ্টিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।

প্রত্যাশিত ব্যাপারটি হলো, রাজনৈতিকভাবে অর্থবহ এনজিও কৌশল মানে হলো গ্রামীণ সমাজে কর্মসূচিভিত্তিক রাজনীতি সৃষ্টি করার জন্য সামাজিক ভিত্তি তৈরি করার উদ্দেশ্যে গরিব নাগরিকদের সংঘবদ্ধ করা (এভাবে ত্রুটিপূর্ণ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার প্রভাব কমানো)। এই ধরনের ‘বড়’ রূপান্তরিত রাজনীতি সম্ভবত বাস্তবে তৈরি করা কঠিন। এনজিও, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক এনজিওগুলোর এ ধরনের প্রয়োজনীয় বিশেষ ক্ষমতা মনে হয় নেই। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে সম্প্রতি এনজিওগুলো যেসব সামাজিক জবাবদিহি কৌশল নিচ্ছে, কর্মসূচিভিত্তিক রাজনীতির মৌলিক ভিত্তি তৈরির ক্ষেত্রে তার কার্যকর প্রভাব রয়েছে। যেমন তথ্যগত অসমতা কমিয়েছে এবং গরিব নাগরিকদের সামষ্টিক ব্যবস্থা প্রতিপালন করা হচ্ছে, যা শুধু গরিবদের সামষ্টিক দাবি প্রকাশেই সাহায্য করছে না, বরং বংশগত ধরনের ভিত্তিতে গরিবদের সামাজিক বিভক্তিগুলোর মধ্যে সংঘবদ্ধ করছে। এমন ‘ছোট’, বর্ধমান ও কম বিবদমান রূপান্তরিত রাজনীতি রাজনৈতিক এলিটদের ভীতিগ্রস্ত না করে অনুসরণ করা যেতে পারে। গরিবদের জন্য রূপান্তরমূলক রাজনীতি অনুসরণের এমন স্বল্প সংস্কার কৌশল পজিটিভ-সাম হবে (ইতিবাচক ফলাফল নিয়ে আসবে)। এর দুটি কারণ: প্রথমত, স্বল্প সংস্কার কৌশলের লক্ষ্য থাকে গরিবদের জন্য আকাঙ্ক্ষিত সেবাপ্রাপ্তি, যা গরিবদের সামষ্টিক ব্যবস্থায় যুক্ত হতে প্রণোদনা সৃষ্টি করে। দ্বিতীয়ত, এই কৌশল গরিবদের মধ্যে নাগরিকত্বের মূল্যবোধ সৃষ্টি করে (অধিকারের ভিত্তিতে সম্পদপ্রাপ্তির প্রণোদনা)। দীর্ঘমেয়াদে এগুলো রাজনীতির ধরনে উল্লেখযোগ্য রূপান্তর ঘটাবে।

অনুবাদ: খলিলউল্লাহ্

টীকা ও তথ্যসূত্র

১.         এই প্রবন্ধটি কেয়ার বাংলাদেশের জন্য গবেষণা প্রতিবেদন আকারে প্রণয়ন করা হয়েছিল। সেটিকেই লেখকদ্বয় প্রবন্ধ আকারে প্রতিচিন্তার জন্য প্রস্তুত করেছেন।

২.         প্রণোদনা বলতে ‘মানুষ তার নিজের বা অন্যের কাজের জন্য যে পুরস্কার বা শাস্তি দেওয়া হয়’ তা বোঝায় (Ostrom 2002, cited in Mcloughlin and Bately 2012, p. 6).

৩.        গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যখন ‘রাজনৈতিক দলগুলো আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে একচেটিয়াকরণ করে ফেলে এবং সমাজকে দলীয় বিচারে রাজনৈতিকীকরণ করে’, তখন এটাকে দলতন্ত্র (partyarchy) বলে (কপেজ ১৯৯৪, পৃ.১৯)। বাংলাদেশে দলতন্ত্রের বিস্তৃত বিশ্লেষণের জন্য দেখুন, হাসান (২০১২)।

৪.         গ্রাম্য আদালত ইউনিয়ন পরিষদভিত্তিক একটি সীমিত এখতিয়ারসম্পন্ন আদালত; সালিশি পরিষদ শুধু পারিবারিক আইন নিয়ে বিচারকাজ করে।

৫.         অনানুষ্ঠানিক কমিউনিটি/গ্রাম পর্যায়ের মধ্যস্থতা।

৬.        ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সামাজিক নেটওয়ার্ক ও যোগাযোগ।

৭.         কোনো নেটওয়ার্কের বাইরে বা বিরোধী এলিটদের নেটওয়ার্কের অন্তর্ভুক্ত এবং অধিবাসী, এমন একজন বলেন, ‘আমি বর্তমান নেতাকে ভোট দিইনি তাই আমি কিছু পাই না’।

৮.        এ ক্ষেত্রে একজন চেয়ারম্যান তাঁর কঠিন অবস্থার কথা জানান এভাবে: ‘সাত দিনের মধ্যে আমাদের একটি পূর্ণাঙ্গ ভিজিডি কার্ডের তালিকা দরকার, দলীয় লোকেরা বলছেন যে তাদের পছন্দের লোকদের রাখতে হবে...এমনকি বিরোধী দলও এটার অংশ...আমি তাদের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করতে পারি না’।

৯.         ‘সরকারি প্রতিনিধিদের’ উন্নয়ন বরাদ্দের ওপর প্রভাব বোঝা যায় এটা থেকেই যে বতলাগাড়ি ইউপি এ বছর মোট ১৯ টন গমের মধ্যে আওয়ামী লীগ নেতাদেরই দিয়েছে ৩ টন (টিআর কর্মসূচির সঙ্গে সম্পর্কিত, ইউপি সচিবের মতে)। ইউপি ও রাজনৈতিক এলিটদের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য থাকায় বতলাগাড়ি ইউনিয়নের একটা সুনাম রয়েছে। এতেই বোঝা যায় অন্য দুই ইউপিতে কী অবস্থা যেখানে এলিট-রাজনৈতিক সমঝোতা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ন্ত্রণে।

১০.       ‘যৌথ উত্পাদন হলো সেবার ক্ষেত্রে সরকারি এজেন্ট ও ব্যক্তিগত নাগরিক উভয়েরই যৌথ ও প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা’ (Macloughlin and Bately 2012, p. 42)

১১.       সরকারি সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিকীকৃত যৌথ উত্পাদন হয় রাষ্ট্রীয় এজেন্সিগুলো এবং নাগরিকদের সংগঠিত সামাজিক গ্রুপগুলোর মধ্যে নিয়মিত, দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্কের মাধ্যমে, যেখানে উভয়ই উল্লেখযোগ্য সম্পদ প্রদান করে।

১২.       এলিট এবং দরিদ্র উভয় শ্রেণির তথ্যদাতারাই বলেন যে ইউপি নেতারা বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতিতে যুক্ত হয়—বিশেষ করে ভিজিডি ও ভিজিএফ কার্ড বিক্রি করা এবং বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প থেকে উল্লেখযোগ্য ‘কমিশন’ আদায় করা।

গ্রন্থপঞ্জি:

            Ahmad, S. (2007), Social Safety Nets in Bangladesh, World Bank, Dhaka

          Alim, A and Sulaiman, M. (2009), Polli Shomaj and 100-day Employment Generation Programme: Measuring the Targeting Effectiveness in Beneficiary Selection, BRAC RED

          BDI, BRAC and NFPCSP. (2009), Study on the First Phase of the 100-Day Employment Generation Program, Dhaka,

          www.bracdevelopmentinstutute.org/publications

          CGS and BRAC RED. (2006), The State of Governance in Bangladesh, BRAC University

          Coppedge, M. (1993),Strong Parties and Lame Ducks, Stanford University Press, Stanford, California

          Corbridge, S., Williams, G., Srivastava, S. and Veron, R. (2005) .Seeing the State: Governance and Governmentality in India. Cambridge

          Di John, J. and Putzel, J. (2009), ‘Political Settlements Issues Paper’, June, Governance and Social Development Resource Centre (GSDRC), International Development Department, University of Birmingham, http://www.gsdrc.org/docs/open/EIRS7.pdf.

          Frankl, E. (2004) ‘Quotas and Empowerment: The Use of Reserved Seats in Union Parishad as an Instrument for Women’s Political Empowerment in Bangladesh’, Working Paper Series No. 4, Department of Political Science, University of Stockholm, www.statsvet.su.se/quotas

          Hassan, M. (2012), Dynamics of Political Settlements in a Semi Mature Limited Access Order

          The Case of Bangladesh, Draft (forthcoming as an ESID working paper from University of Manchester)

          Hinton, R. (2010) Promoting Inclusive Governance in Bangladesh: Empowering the Extreme Poor, CARE-Bangladesh

          Hossain, N. (2007), The Politics of What Works: the Case of the Vulnerable Group Development Programme in Bangladesh, CPRC Working Paper 92, BRAC

          Hossain, N. and Osman, F. (2007), Politics and Governance in the Social Sectors in Bangladesh, 1991-2006, RED, BRAC

          Khan, M. (2010) ‘Political Settlements and the Governance of Growth-Enhancing Institutions’.Mimeo.

          Khan, M. R. and Ara, F. (2006) ‘Women, Participation and Empowerment in Local Government: The Bangladesh Union Parishad Perspective’, Asian Affairs, Vol. 29, No. 1, pp. 73-92.

          Khan, Z. R. and Mohsin, A. (2008) ‘Women’s Empowerment through Local Governance: Emerging Issues and Debates’, paper presented at Pathways of Women’s Empowerment Research Programme Consortium Mid Term Review Conference, Cairo, 20-24 January. www.parthways-of-empowerment.org

          Mansbridge, J. (1999) ‘Should Blacks represent Blacks and Women Represent Women? A Contingent “Yes”’, The Journal of Politics, Vol. 61, No. 3, pp. 628-57.

          McLoughlin, C. and Bately, R. (2012) The Politics of What Works in Service Delivery: An Evidence-based Review, Effective States and Inclusive Development research center (ESID) Working Paper 6, University of Manchester,

          http://www.effectivestates.org/_assets/documents/esid_wp_06_

mcloughlin-bately.pdf

          Nazneen, S. and Tasneem, S., 2010, ‘A Silver Lining: Women in Reserved Seats in Local Government in Bangladesh,’ IDS Bulletin, Vol 41, no 5, pp 35-42

          Nazneen, S. And Mahmud, S. (2012) ‘Gendered Politics of Securing Inclusive Development’, Effective States and Inclusive Development Research Centre (ESID) Working Paper No. 13, University of Manchester.

          http://www.effective-states.org/_assets/documents/esid_wp_13_

nazneen-mahmud.pdf

          Nazneen, S., Ehsan, I., and Hasan, B. (Forthcoming), ‘Exceptional Women?: Reserved Councillors in Municipal Corporations in Bangladesh,’ in M. Tadros, ed., Negotiating Women’s Pathways of Political Power, Zed Books: London