মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধাপরাধ ও জেনোসাইড: অমীমাংসিত বিষয় ও মানবতার দায়

দ্য লিবারেশন ওয়ার—মোহাম্মদ আইয়ুব ও কে সুবরামনিয়াম, এস চান্দ অ্যান্ড কো. (প্রাইভেট) লি.: নয়াদিল্লি, ১৯৭২। ওয়ার ক্রাইমস অ্যান্ড জেনোসাইড: দ্য ট্রায়াল অব পাকিস্তানি ওয়ার ক্রিমিনালস—বি এন মেহরিস, ওরিয়েন্টাল পাবলিশার্স: নয়াদিল্লি, ১৯৭২

সমসাময়িক বাস্তবতায় অনেক সময় স্মৃতি বা ঘটমান অতীত রোমন্থন করা অপরিহার্য হয়ে ওঠে। বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে সংঘটিত জেনোসাইড, যুদ্ধাপরাধ বা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচার, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচারকার্য পরিক্রমা এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে এই বিচারযজ্ঞের ন্যায্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বেশ কয়েক বছর ধরে ব্যাপকভাবে বাংলাদেশে এবং আন্তর্জাতিক মহলে আলোচনা, সমালোচনা ও পর্যালোচনা হয়ে আসছে। এই নিবন্ধে সামগ্রিকভাবে বর্তমান পরিস্থিতি বিচারে কোনো পর্যালোচনা করা হচ্ছে না, বরং ১৯৭২ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং জেনোসাইড ও যুদ্ধাপরাধের বিচারবিষয়ক দুটি গ্রন্থের কিছু অধ্যায়বিশেষের পর্যালোচনা করা হবে।

বি এন মেহরিস তাঁর ওয়ার ক্রাইমস অ্যান্ড জেনোসাইড: দ্য ট্রায়াল অব পাকিস্তানি ওয়ার ক্রিমিনালস গ্রন্থে ‘যুদ্ধাপরাধের বিচার বিষয়টি সব সময় খুব বিতর্কিত ও জটিল’ ভাববাচ্য দিয়ে মুখবন্ধের সূচনা করেছেন। গ্রন্থটি ১৯৭২ সালে দিল্লির ওরিয়েন্টাল পাবলিশার্স কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছিল। ২৫ মার্চ-১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১, নয় মাসে বাংলাদেশের ওপর কোনো পূর্ব ঘোষণা ব্যতীত পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর অতর্কিত সামরিক হামলা, রাষ্ট্রীয় শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিস্থাপনের নামে বিরোধী রাজনৈতিক মত-পথের অনুসারী ও ধর্মীয় ও নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘুদের ওপর পরিকল্পিত আক্রমণ এবং তাদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত করার যে নৃশংস প্রয়াস লক্ষ করা গেছে, সে বাস্তবতায় যুদ্ধাপরাধ ও জেনোসাইডের জন্য পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে জুলাই, ১৯৭২ প্রকাশিত জে এন মেহরিসের গ্রন্থটি সবিশেষ তাত্পর্যপূর্ণ। অন্যদিকে, মোহাম্মদ আইয়ুব ও কে সুবরামনিয়াম বিরচিত দ্য লিবারেশন ওয়ার গ্রন্থের মুখবন্ধের সূচনা বাক্য হচ্ছে, ‘রাষ্ট্রপতি নিক্সন কংগ্রেসে তাঁর পেশকৃত পররাষ্ট্রনীতি-বিষয়ক প্রতিবেদনে ১৯৭১ সালের সমস্যা দক্ষিণ এশিয়াকে পরিবর্তিত করেছে এবং আমরা ১৯৭২ সালে বর্তমানের নব্য পরিস্থিতিতে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জগুলোর ব্যাপারে সচেতন।’ এই গ্রন্থটি ১৯৭২ সালে নয়াদিল্লির এস চান্দ অ্যান্ড কো. (প্রাইভেট) লি. কর্তৃক প্রকাশিত হয়। মুখবন্ধের উদ্বোধনী বাক্যটির মর্মার্থ বিশ্লেষণের মাধ্যমে স্পষ্টতরভাবে ধারণা করা যায়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে শুধু বাংলাদেশ নয়, পাকিস্তান ও ভারত এবং তত্কালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও গণচীনের স্বার্থ জড়িত ছিল। গ্রন্থটির তাত্পর্য শুধু ওই সময়ে উত্থাপিত বিষয়ের সমসাময়িকতায় নয়, বর্তমানের সমকালীন প্রেক্ষাপটেও সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

বি এন মেহরিস তাঁর গ্রন্থকে চারটি অধ্যায়ে—আন্তর্জাতিক আইনে যুদ্ধাপরাধ এবং জেনোসাইড, উল্লেখযোগ্য যুদ্ধাপরাধ ও জেনোসাইডের বিচারসমূহ: বিচারপ্রক্রিয়ার পরিসংখ্যান এবং মানদণ্ড, পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারসম্পর্কিত কিছু সমস্যা ও প্রশ্ন এবং সামগ্রিক পর্যবেক্ষণে বিভক্ত করেছেন। অন্যদিকে মোহাম্মদ আইয়ুব এবং কে সুবরামনিয়াম তাঁদের গ্রন্থকে তিনটি পর্বে—প্রতিদ্বন্দ্বিতা, সংঘর্ষ এবং মুক্তিযুদ্ধ—বিভক্ত করে পর্যালোচনা করেছেন। অধ্যায়বিন্যাস পর্যবেক্ষণে গ্রন্থদ্বয়ের বিষয়গত প্রাধান্য স্পষ্টতর হয়ে ওঠে। মোহাম্মদ আইয়ুব এবং কে সুবরামনিয়ামের গ্রন্থ অনুসারে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম ও মুক্তিযুদ্ধের সম্ভাবনার বীজ ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের মধ্যে নিহিত ছিল। পাশাপাশি ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানে কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ব্যর্থতা, উপর্যুপরি সামরিক হস্তক্ষেপ এবং পাকিস্তানের ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন দুটি ভূখণ্ডের মধ্যে মৌলিক ভিন্নতা ও ক্রমবর্ধিত বৈষম্যও পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভিত্তি ও তথাকথিত ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ ভিত্তিক জাতীয় ঐক্যকে ক্ষয়িঞ্চু ও পতনমুখী করে। অন্যদিকে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে পরিচালিত মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ ও জেনোসাইডের অপরাধের জন্য আন্তর্জাতিক আইন, প্রাগুক্ত বিচার অভিজ্ঞতা এবং প্রচলিত বিষয়সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক অধ্যাদেশ ও বিচারব্যবস্থায় পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্ন, বিচারের দাবির ন্যায্যতা, বিচার-প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ, বিচারের সম্ভাবনা ও উদ্যোগ বিষয়ে নাতিদীর্ঘ আলোচনা করা হয়েছে।

দুটি গ্রন্থের সমন্বিত পর্যালোচনার সার্থকতা নিয়ে দোদুল্যমানতা থাকলেও গ্রন্থিত বিষয়গুলোর মধ্যে সূত্র ও পরিণামগত সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্নের কোনো অবকাশ নেই। দুটি গ্রন্থ ১৯৭১ সালে বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বেআইনি ও অনৈতিক আক্রমণ এবং আত্মরক্ষা ও অস্তিত্ব রক্ষায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রচিত হয়েছে। গ্রন্থ দুটিতে আলোচিত অধ্যায়ভিত্তিক বিষয়বস্তুগুলোর ভিন্নতা রয়েছে কিন্তু বিষয়গুলোর মধ্যে গভীর আন্তসম্পর্ক বিদ্যমান।

পাকিস্তানের জন্ম এবং বাংলাদেশে জেনোসাইডের বিষবৃক্ষ রোপণ

আইয়ুব এবং সুবরামনিয়ামের গ্রন্থের প্রথম ভাগে কীভাবে ধর্মান্ধতার ভ্রান্তির ওপর ভিত্তি করে ধর্মান্ধ ও ধর্মভীরু দুই ধরনের ধর্মানুসারীর বিশ্বাসকে পুঁজি করে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ নামক ফানুস জাতীয়তাবাদের জন্ম ও বিকাশের বিষয়টি উপস্থাপন করা হয়েছে। বস্তুত, এই ফানুস জাতীয়তাবাদের ওপর নির্ভর করে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান নামে একটি তাসের দেশ তৈরি করা হয়েছিল। রাষ্ট্রটির ধর্ম ভিন্ন কোনো ভিত্তি-কলাম ছিল না। পাকিস্তান নামক ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা রাষ্ট্রটির মেয়াদ ক্ষণস্থায়ী হবে তার আলামত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ভারতীয় উপমহাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিবিদ এবং ভারতীয় আধুনিক জাতীয়তাবাদের অগ্রজ প্রবক্তা মাওলানা আবুল কালাম আজাদ তাঁর আত্মজীবনী ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম গ্রন্থে উল্লেখ করেছিলেন, ‘জিন্নাহ ও তাঁর অনুসারীরা বুঝতে পারছেন না যে, ভৌগোলিক অবস্থান তাঁদের বিরুদ্ধে...এই দুই অঞ্চলের মধ্যে (পশ্চিম পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ) কোনো ধরনের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ স্থাপনের সুযোগ নেই। অঞ্চল দুটির অধিবাসীরা একে অপর থেকে যেকোনো বিচারে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, শুধু ধর্মীয় পরিচয় ব্যতিরেকে। ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক, ভাষাতাত্ত্বিক এবং সাংস্কৃতিক মৌলিক পার্থক্য সত্ত্বেও ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে ঐকমত্য স্থাপনের প্রচেষ্টা জনগণের সাথে ধোঁকাবাজি ব্যতীত কিছু নয়।...সর্বাপেক্ষা আশাবাদী ব্যক্তিও আশা করবে না যে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান তাদের সকল মতপার্থক্য ভুলে গিয়ে একটি জাতিতে পরিণত হবে? (আইয়ুব ও সুবরামনিয়াম, পৃ. ১)

পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মত্রুটির সাথে ১৯৭১ সালে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) সংঘটিত জেনোসাইডের কার্যকারণ সম্পর্ক রয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানের নৃগোষ্ঠীগুলোর অন্যতম পাঞ্জাবিরা পাকিস্তান সামরিক বাহিনী ও কেন্দ্রীয় রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করত। পাঞ্জাবিদের মধ্যে বিশেষত যারা সামরিক বাহিনী বা প্রশাসনে কর্মরত তাদের মধ্যে একধরনের বর্ণবাদী ও আমিত্ব মানসিকতা লক্ষ করা যায়। বাঙালিদের তারা নৃতাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয়ভাবে এবং আর্থসামাজিক মর্যাদায় নিম্নবর্গের বিবেচনা করত। বাঙালি মুসলিমদের তারা সনাতন ধর্মাবলম্বী নিম্নবর্গের মুসলিম মনে করত। ১৯৭১ সালে বাঙালিদের হেয় করে দেখার মনোভাব জেনোসাইডের মতো মানব ইতিহাসের নিকৃষ্ট অপরাধ করতে প্রবৃত্ত করেছিল বলে অনুমেয়। ১৯৭১ সালে ব্যাপক হারে বাঙালি নারীদের ধর্ষণের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল বাঙালির জন্মপরিচয় পরিবর্তন করে তাদের নিম্নশ্রেণি থেকে মধ্যশ্রেণিতে উত্তীর্ণ করা। জেনোসাইডের সর্বজনীন সংজ্ঞায়নে বলা হয়েছে, কোনো রাজনৈতিক, নৃতাত্ত্বিক, সামাজিক বা ধর্মীয় জাতিগোষ্ঠীকে সমূলে অথবা আংশিকভাবে ধ্বংস বা নিধনের জন্য পরিকল্পিতভাবে হত্যা বা হত্যাচেষ্টা বা তাদের অস্তিত্ব বৈশিষ্ট্য বিলীন করতে শারীরিক অথবা মানসিক আগ্রাসন জেনোসাইড হিসেবে পরিগণিত হবে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তানের আগ্রাসী সামরিক অভিযানে জেনোসাইড সংজ্ঞায়নে বর্ণিত সব বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান ছিল।

পাকিস্তান রাষ্ট্রের গঠনকাঠামোর সমস্যার কারণে রাজনৈতিক পরিকাঠামোতে আঞ্চলিক ও সাম্প্রদায়িক স্বার্থগুলোকে সম্মিলিতভাবে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হয়নি (আইয়ুব ও সুবরামনিয়াম, পৃ. ২)। পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমাজে এক অঞ্চলের নেতৃত্বের অন্য অঞ্চলের প্রতি সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় উচ্চমার্গীয় ও প্রভুত্ববাদী আচরণ বর্ণবাদী রূপ পরিগ্রহ করে। আইয়ুব খান এই বর্ণবাদকে তাঁর মৌলিক গণতন্ত্রের নামে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তানিদের সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘এ দেশের জনসংখ্যার সিংহভাগ ভারতীয় গোত্রভুক্ত। পাকিস্তানের জন্মের পূর্বে এদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না। তারা এ যাবত্ হিন্দু বর্ণপ্রথা, মুঘল, পাঠান ও ব্রিটিশদের দ্বারা শাসিত হয়ে আসছে। ফলে তাদের মধ্যে এখনো হিন্দুয়ানি সংস্কৃতি এবং ভাষাতাত্ত্বিক প্রভাব রয়েছে। তারা সব সময় নতজানু জাতি এবং মানসিকভাবে তারা এখনো নব্য-স্বাধীনতার সাথে মানিয়ে নিতে প্রস্তুত নয়’ (আইয়ুব ও সুবরামনিয়াম, পৃ. ২-৩)। পূর্ব বাংলার মানুষের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের এ ধরনের আচরণ আতে ঘা সৃষ্টি করে। অথচ পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য জাতীয়তাবাদের অর্থনৈতিক উপাদান পূর্ব বাংলার মুসলিম সম্প্রদায়ই জোগান দিয়েছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে সাংস্কৃতিক ও ভাষাতাত্ত্বিক পার্থক্য সত্ত্বেও শুধু অবিভক্ত ভারতবর্ষে অর্থনৈতিক বৈষম্য ও শোষণের কারণে পূর্ব বাংলার জনগণ, বিশেষত মুসলিম সম্প্রদায় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাকে সমর্থন করেছিল (পৃ. ৩)। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর অবশ্য নব্য শাসকগোষ্ঠীর পূর্বসূরিদের মতো শাসন ও শোষণ অব্যাহত রাখলে অল্প সময়ের মধ্যে পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্ত ও কৃষক সমাজের স্বপ্নের সলিল সমাধি ঘটে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের আগে ব্রিটিশরাজে অন্তত সমতার প্রশ্নে কিছু সহযোগিতা পাওয়া যেত। পূর্ব বাংলার মুসলিম সমাজ কলকাতাকেন্দ্রিক বাবুদের ‘ভদ্রলোক’ বলে বিদ্রূপ করলেও পাকিস্তান রাষ্ট্রে নিজেরা ‘ভদ্রলোক’ রূপে আবির্ভূত হয়। পূর্ব বাংলার মুসলিম সমাজ পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের শাসকশ্রেণিকে ‘অভদ্র’ মনে করত, কারণ তারা রবীন্দ্রসংগীত বা কবি কাজী নজরুল ইসলামের সৃষ্টি সম্পর্কে জানত না, বুঝত না, কদর করত না (আইয়ুব ও সুবরামনিয়াম, পৃ. ৪)। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানিরা নিজেদের ইন্দো-ইসলামি সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী হিসেবে বাঙালিদের নিম্নশ্রেণির এবং রাজনৈতিকভাবে বিদ্রোহী মনোভাবাপন্ন মনে করত। পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যে পরস্পরের প্রতি প্রতিক্রিয়াশীল দৃষ্টিভঙ্গি ক্রমশ সাগরসম ব্যবধান ও বিরোধিতা তৈরি করে এবং ভৌগোলিকভাবে দূরবর্তী অঞ্চল দুটির মধ্যে সম্পর্কের সেতু নির্মাণের আদৌ কোনো সুযোগ অবশিষ্ট ছিল না (আইয়ুব ও সুবরামনিয়াম, পৃ. ৫)। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি ঘটনাপরম্পরায় অনিবার্যভাবে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে। পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিরোধিতা শুধু সাংস্কৃতিক নয়, বরং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণেও ত্বরান্বিত হয়েছে। আইয়ুব ও সুবরামনিয়াম তাঁদের গ্রন্থে পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সামগ্রিক শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্যের একটি তুলনামূলক ছক উপস্থাপন করেছে (আইয়ুব ও সুবরামনিয়াম, পৃ. ৩৫)। তাঁরা পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্যের একটি ছকচিত্রও তাঁদের গ্রন্থে উপস্থাপন করেছেন (আইয়ুব ও সুবরামনিয়াম, পৃ. ৪২)। ভিয়েনা স্টাডির ১৯৫৮-৬৮ সময়কালের পরিসংখ্যান অনুসারে, পাকিস্তানের মোট রপ্তানির ৪১ শতাংশ হতো পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অথচ মোট আমদানির ৭০ শতাংশ আমদানি করা হতো পশ্চিম পাকিস্তানের প্রয়োজনে। অথচ পূর্ব বাংলার পাকিস্তানের মোট রপ্তানিতে অংশগ্রহণ ছিল ৫৯ শতাংশ কিন্তু মোট আমদানির মাত্র ৩০ শতাংশ যেত পূর্ব পাকিস্তানে (আইয়ুব ও সুবরামনিয়াম, পৃ. ৪২)। বাজেটের ৭৭ শতাংশ বরাদ্দ থাকত পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য এবং অবশিষ্ট পূর্ব বাংলার জন্য। পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের দর্শন ছিল ‘লোভীদের সামাজিক প্রয়োজনীয়তা’ ভিত্তিক। যার ফলে জাতীয় অর্থনীতির অসমতা আরও সম্প্রসারিত হয় (আইয়ুব ও সুবরামনিয়াম, পৃ. ৪৫)। পূর্ব বাংলার পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে গণ-অসন্তুষ্টির প্রধান নিয়ামক ছিল কৃষিক্ষেত্রে বৈষম্য। তত্কালীন সময়ে পূর্ব বাংলার একটি বৃহত্ অংশ কৃষিনির্ভর অর্থনৈতিক জীবনে যুক্ত ছিল। পূর্ব বাংলার কৃষকেরা যেখানে ব্যাপক ধান উত্পাদনের মাধ্যমে ‘সবুজ বিপ্লব’ ঘটিয়েছিল, সেখানে পূর্ব বাংলার জন্য কৃষি উপকরণ যেমন: বীজ, সার, চাষ ও সেচের যন্ত্রপাতির সীমিত সরবরাহ কৃষকদের জীবন ও জীবিকাকে দুর্বিষহ করে তোলে (আইয়ুব ও সুবরামনিয়াম, পৃ. ৪৬-৪৭)। রাজনৈতিক আদর্শগত ভিন্নতা এবং রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রশ্নেও ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পাকিস্তানে কখনো আঞ্চলিক এবং জাতীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক সমাজে দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা এবং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশ সম্ভব হয়নি। পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিতে পাঞ্জাবের কর্তৃত্ব বিস্তার এবং পাঞ্জাবি সামরিক-আমলাতান্ত্রিক সভ্যদের অন্যদের, বিশেষত পূর্ব বাংলার মুসলিম সমাজের প্রতি বৈরী মনোভাব ও প্রতিক্রিয়াশীল আচরণ শুধু জাতিগত ঘৃণা ও হিংসা বৃদ্ধি করেছে। জাতিগত এই অসহিঞ্চুতা বাংলাদেশ জেনোসাইডের প্রধান উপজীব্য জাতিগত ঘৃণা পাঞ্জাবি-নিয়ন্ত্রিত পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে বাঙালি জাতিকে নৃশংসভাবে নিশ্চিহ্ন করতে প্রণোদিত করে। পাকিস্তানের রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং অর্থনৈতিক কাঠামো পূর্ব বাংলার স্বার্থবিরোধী ছিল (আইয়ুব ও সুবরামনিয়াম, পৃ. ৩০)। আইয়ুব খানকে উত্খাতে গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলার জনগণ ইসলামাবাদের প্রতি তাদের অনাস্থা জ্ঞাপন করে। ১৯৫০-এর দশকে আওয়ামী লীগ তরুণ নেতৃত্বের হাত ধরে নবরূপে আবির্ভূত হয়। ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা দাবি আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির পাশাপাশি বঞ্চনা ও শোষণে অতিষ্ঠ জনগণের খণ্ডিত অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বপ্নগুলোকে এবং রাজনৈতিকভাবে জাতীয়তাবাদী চেতনায় সংগঠিত করে এবং নব্য জাতি হিসেবে নতুন আত্মপরিচয়ে পরিচিত করে তোলে। ১৯৬৯ সালে ছাত্র-শ্রমিকদের আওয়ামী লীগের ৬ দফাসহ ১১ দফা এবং আইয়ুববিরোধী গণ-অভ্যুত্থান আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তাকে উচ্চশিখরে নিয়ে যায়। ১৯৭০ সালের পাকিস্তানে প্রাদেশিক ও জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তার প্রতিফলন ঘটে (আইয়ুব ও সুবরামনিয়াম, পৃ. ৭৩-৯২)। পূর্ব বাংলায় আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা যত বৃদ্ধি পেয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠী, ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণকারী আমলা ও সামরিক সদস্যদের মধ্যে পূর্ব বাংলার জনগণের প্রতি অসহিঞ্চুতা ও ঘৃণা তত বেড়েছে (আইয়ুব ও সুবরামনিয়াম, পৃ. ৯৪-১১০)। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রাপ্তি সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি, কালক্ষেপণ এবং আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিভ্রান্তিকর ও উসকানিমূলক বিদ্বেষী প্রচারণা চালান পাকিস্তানের তত্কালীন সামরিক প্রশাসক এবং পশ্চিম পাকিস্তানে পাঞ্জাবিদের পছন্দের দল হিসেবে আবির্ভূত পিপলস পার্টির কান্ডারি জুলফিকার আলী ভুট্টো। জুলফিকার আলী ভুট্টো তাঁর পূর্ব কর্মসূত্রে পাঞ্জাবি-নিয়ন্ত্রিত পাকিস্তানের আমলাতন্ত্র ও সামরিক প্রশাসনের সঙ্গে ব্যক্তিগত সুসম্পর্কের ফায়দা নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর দল আওয়ামী লীগকে নিষ্ক্রিয় করতে সচেষ্ট হন। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের তত্কালীন সামরিক প্রশাসনকে পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং কর্মী ও সমর্থকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণে ইন্ধন জোগান। পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে জাতিগত, ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক পার্থক্য এবং অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক বৈষম্য জাতিগত ঘৃণা, পারস্পরিক মতবিরোধ তৈরি করে এবং গণতান্ত্রিক ও মানবিক সহমর্মিতা ও সহযোগিতার অপমৃত্যু ঘটায়। অবিভক্ত পাকিস্তানের শাসকশ্রেণির স্বৈরাচারী ও বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি এবং আচরণের জন্য পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে মতৈক্যের শেষ সম্ভাবনাও নস্যাত্ হয়ে যায় ।

বাংলাদেশ জেনোসাইডের সংক্ষিপ্তসার

বাংলাদেশে পাকিস্তানের সামরিক অভিযান যে পূর্বপরিকল্পিত ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৭১ সালে দ্য টেলিগ্রাফ-এর দক্ষিণ এশীয় সংবাদদাতা ডেভিড লোসাকের বক্তব্যে, ‘১৯৭১ সালের শুরুর দিকে করাচি থেকে ঢাকাগামী পাকিস্তানের আন্তর্জাতিক বিমানের ফ্লাইটে আসন খালি পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার ছিল...রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান অভিযানের জন্য দীর্ঘ সময় ধরে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন...ইতিমধ্যে ২০ হাজার পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্য পূর্বাঞ্চলে পাঠানো হয়েছে।...জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তাদের পরিকল্পনা অনুসারে দখলদার সেনাবাহিনীর জনবল ৩৫-৪০ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৬০ হাজার করা হয়েছে এবং ৩ হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে সৈন্যদের তাদের নতুন কর্মস্থলে যোগদান করতে হয়েছে।’১

পাকিস্তানি সামরিক অভিযান শুরু হওয়ার কিছুদিনের মধ্যে ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ান-এ দেওয়া সাক্ষাত্কারে শেখ মুজিবুর রহমানের অর্থবিষয়ক উপদেষ্টা রেহমান সোবহান বলেন, ‘আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে বাঙালি জাতীয়তাবাদের শক্তির যে পরিচয় পাওয়া গেছে, তা বিবেচনায় রেখে দুই বছর ধরে সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা রচনা করা হয়।...লে. জেনারেল ইয়াকুবের স্থলে পাঞ্জাবি জেনারেলদের মধ্যে ভয়ংকর হিসেবে পরিচিত লে. জেনারেল টিক্কা খান ৭ মার্চ দায়িত্ব গ্রহণ করেন।’২

২৫ মার্চ, ১৯৭১ থেকে বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানিরা যে নৃশংস হামলা শুরু করে তার প্রস্তুতি কয়েক মাস ধরে চলছিল। ৭ মার্চ, ১৯৭১ ওয়ার্কিং পিপলস ডেইলি (রেঙ্গুন) প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, জাহাজ ও বিমানে করে পূর্ব পাকিস্তানে বিপুল পরিমাণে সমরাস্ত্র ও জনবল পাঠানো হচ্ছে (আইয়ুব ও সুবরামনিয়াম, পৃ. ১৩৮)। ১৯৭১ সালের শুরুতে পূর্ব পাকিস্তানে চারটি ব্রিগেড ছিল কিন্তু ২৫ মার্চের মধ্যে ব্রিগেড সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যায়। ২৫ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানে পাঞ্জাবি ও বেলুচ সেনাদের ২৭টি ব্যাটালিয়ন অবস্থান নিয়েছিল। ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর হামলা শুরু হলে কোনো পক্ষের আর পিছু হটার বা বিকল্প পন্থায় বিরোধ নিষ্পত্তির শেষ সুযোগটুকুও শেষ হয়ে যায়। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর হামলা শুরুর পর জীবন বাঁচাতে ভারতে আশ্রয়প্রার্থী শরণার্থীদের প্রথম দলটি ছিল আওয়ামী লীগের কর্মী এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের সদস্যদের। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ধারণা অনুযায়ী, পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দু বা সনাতন ধর্মাবলম্বী সম্প্রদায় মূলত ভারতের নাগরিক। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর হামলার অন্যতম লক্ষ্য ছিল সনাতন ধর্মাবলম্বীদের নিধন।৩ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর হামলা থেকে জীবন রক্ষার্থে এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে ভারতে আশ্রয়প্রার্থী সনাতন ধর্মাবলম্বী শরণার্থীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৬ আগস্ট, ১৯৭১ ভারতীয় পরিসংখ্যান অনুযায়ী আগত শরণার্থীদের মধ্যে প্রায় ৭০ লাখ সনাতন ধর্মাবলম্বী, প্রায় ৬ লাখ মুসলিম ধর্মাবলম্বী এবং প্রায় ১ লাখ অন্যান্য ধর্মাবলম্বী ছিল।৪ পাকিস্তানের ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ জেনোসাইডে যদি বাংলাদেশ দাবিকৃত নিহতের সংখ্যা অর্ধেকও ধরা হয় তবুও এটি বিশ্ব ইতিহাসে অন্যতম নৃশংসতম জেনোসাইড। এত স্বল্প সময়ে এত মানুষ হত্যার ঘটনা আগে কোনো জেনোসাইডে ঘটেনি। অথচ দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিশ্বের তত্কালীন মোড়ল ও মানবাধিকারের কান্ডারি রাষ্ট্রগুলোর অভিব্যক্তি, মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোসেফ সিসকোর ভাষায়, ‘সম্পূর্ণভাবে অভ্যন্তরীণ বিষয়’ (মেহরিস, পৃ. ২)। বাংলাদেশে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর হামলায় নিহত মানুষের সংখ্যা হিরোশিমায় ৭৫ বার পারমাণবিক হামলা চালানো হলে যে পরিমাণ মানুষ নিহত হবে তার সমান। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বাংলাদেশে জেনোসাইড ও যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত করেছে তার প্রমাণ মেলে বিদেশি পর্যবেক্ষকদের বয়ানে। বিদেশি পর্যবেক্ষকেরা তালিকা অনুসারে পাকিস্তানি সামরিক সদস্যদের অনেক বাঙালিকে আটক করতে দেখেছেন, যাঁদের পরে কোনো হদিস পাওয়া যায়নি বলে তাঁরা জেনেছেন। বিশ্বব্যাংকের মাঠপর্যায়ের অনুসন্ধানী দলের প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশের শহরগুলোর পরিস্থিতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইউরোপে কৌশলগত বোমা হামলার পর শহরগুলোর মতো।৫

১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী এবং আলবদর, আলশামস ও রাজাকার নামে পরিচিত বাংলাভাষী ও উর্দুভাষী দোসরদের সমন্বয়ে গঠিত বেসামরিক সশস্ত্র দলগুলো কর্তৃক সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ ও জেনোসাইডের জন্য প্রাগুক্ত ট্রাইব্যুনালগুলোর আদলে বিচার এবং দণ্ডাদেশ প্রদান যুক্তিযুক্ত কি না তা একটি গুরুতর প্রশ্ন হিসেবে আবির্ভূত হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে যা ঘটেছে, তা বিশ্বের মানবিক মনোভাবাপন্ন দেশগুলোর সরকার ও জনগণকে আচম্বিত করেছে। মাত্র ৯ মাসের মধ্যে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করলেও, বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার জন্য চরম মূল্য দিতে হয়েছে। দখলদারির সময় পাকিস্তানি সৈন্যরা বাংলাদেশের সর্বত্র হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। শিশু, যুবা, নারী, বৃদ্ধ কেউ তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করেছে, গ্রাম অবরুদ্ধ করে সব গ্রামবাসীকে হত্যা করেছে। হত্যার সাথে সাথে তারা হাজার হাজার যুবতী, কিশোরীকে ধর্ষণ করেছে, বহু নারীকে শিবিরে আটকে রেখে ধর্ষণ করেছে দিনের পর দিন। এসব নারী যাতে আত্মহত্যা না করতে পারে সে জন্য অনেক শিবিরে তাদের বিবস্ত্র রাখা হতো। পাকিস্তানিরা বাঙালি ও এদেশীয় সংখ্যালঘুদের নিম্নস্থ মানুষ মনে করত। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ধর্ষণকে বাঙালি জাতির মান উন্নয়ন-প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করত। তাদের প্রত্যাশা ছিল তাদের নির্যাতনের কারণে অন্তঃসত্ত্বা বাঙালি নারীদের গর্ভজাত সন্তানেরা বাংলাদেশে উন্নত মুসলিম নাগরিক হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানের ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের ধারক ও বাহক হবে। সাধারণ সেনাসদস্য থেকে সামরিক কর্মকর্তা নিয়াজি পর্যন্ত সবাই এই জঘন্য কাজে অংশ নিয়েছে। পাকিস্তানিদের অত্যাচার, উত্পীড়নে প্রায় ১ কোটি লোক শরণার্থী হয়ে আশ্রয় নিয়েছে ভারতে। পাকিস্তানিদের এসব জঘন্য কাজে মদদ দিয়েছে শান্তি কমিটির লোকজন, সাহায্য-সহযোগিতা করেছে আলবদর, আলশামস ও রাজাকার নামে গঠিত বাহিনীগুলো। সহযোগিতা করেই তারা ক্ষান্ত হয়নি, নিজেরাও পাকিস্তানি সৈন্যদের মতো খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠনসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে অংশ নিয়েছে। শত্রুমুক্ত হওয়ার প্রাক্কালে রাজাকার, আলশামস, আলবদর বাহিনী পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তাদের নীলনকশা অনুসারে দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের গুম ও হত্যা করে।

পরিসংখ্যান ও নৃশংসতার বিচারে বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে সংঘটিত জেনোসাইড, যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ ছিল জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা হামলা বা ভিয়েতনামে মার্কিন আগ্রাসন কিংবা হিটলার যুগে জার্মানিতে ইহুদি নিধনের অপেক্ষা লোমহর্ষক। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের বৃহত্তর নৃগোষ্ঠী বাঙালিসহ অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে পরিচালিত নিধনযজ্ঞকে তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত করা যায়। প্রথম পর্যায় শুরু হয় ঢাকাতে মার্চের শেষভাগে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান মারফত জানা যায়, মার্চের শেষ সপ্তাহে ঢাকাতে পাকিস্তানি সেনারা লাগাতার হত্যাযজ্ঞ ও সন্ত্রাস চালিয়েছে। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশি শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবী সমাজ। এ সময়কালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ অন্তত শতাধিক শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থানরত সব ছাত্রী নিখোঁজ ছিল। দ্বিতীয় পর্যায়ের নিধনযজ্ঞ ঢাকা অভিযানের পরপর শুরু হয়। পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষ নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ সমস্যার স্থায়ী সমাধান হচ্ছে আওয়ামী লীগের প্রতি সহানুভূতিশীল সম্পূর্ণ বাঙালি সমর্থকগোষ্ঠীকে ধ্বংস করা। পাকিস্তানিদের বাঙালি জনগোষ্ঠী ধ্বংসের পাঁয়তারা যে পূর্বপরিকল্পিত ছিল, সে বিষয়ে আরও নিশ্চিত হওয়া যায় পাকিস্তানিদের বর্বরতা সম্পর্কে মার্কিন সিনেটর অ্যাডলি স্টিভেনসন বলেছিলেন, ‘বাঙালি সংস্কৃতি ধ্বংসের জন্য সুপরিকল্পিত কৌশল।’৬ বস্তুত, পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষের বাঙালি নিধন আক্ষরিক অর্থে জেনোসাইড ছিল। কারণ, এ ক্ষেত্রে পরিকল্পনানুসারে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে নৃতাত্ত্বিক, ধর্মীয় ও ভাষাগতভাবে ভিন্নতাহেতু স্বতন্ত্র জাতিগোষ্ঠীর লোকদের ধ্বংসের লক্ষ্যে হত্যা, ব্যাপকভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে। ডিসেম্বরে বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সামরিক বাহিনীর যৌথ বাহিনীর অভিযান শুরু হওয়ার পর তৃতীয় পর্যায়ের নিধনযজ্ঞ শুরু হয়। পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের আলবদর ও রাজাকারদের সমন্বয়ে গঠিত আধা সামরিক বাহিনী তাদের সামরিক ব্যর্থতার হতাশাপ্রসূত ক্ষোভ ও জিঘাংসা চরিতার্থ করতে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের গুম ও হত্যা করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শেষে নিখোঁজ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে শুধু ২০০ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা সম্ভব হয়। অনেকের মৃতদেহ ও শেষ অবস্থান সম্পর্কে আজ পর্যন্ত কোনো খবর পাওয়া যায়নি। পরিকল্পিতভাবে ব্যাপক হারে এ ধরনের গুমের ঘটনার নজির কেবল আর্জেন্টিনা ও চিলির ‘ডার্টি ওয়ারে’ পাওয়া যায়।৭ সন্দেহাতীতভাবে বাংলাদেশে বাঙালিদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী পরিচালিত নৃশংস হামলাকে ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। ন্যুরেমবার্গ সামরিক ট্রাইব্যুনালের বিচারে ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এ ধরনের অপরাধের জন্য দায়ী অক্ষশক্তির সামরিক কর্মকর্তাদের শাস্তির বিধান করা হয়। ট্রাইব্যুনাল নািস সামরিক কর্মকর্তাদের ইহুদিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আগে ও যুদ্ধের সময় হিটলার কর্তৃক পরিকল্পিত জেনোসাইডের বাস্তবায়নে যুক্ত থাকার জন্য দোষী সাব্যস্ত করে দণ্ড দেয়। আর জে রামেল তাঁর ডেথ বাই গভর্নমেন্ট (১৯৯৪) গ্রন্থে বাংলাদেশ জেনোসাইড সম্পর্কে বলেন, শুধু ২৬৭ দিন ধরে মানুষের মৃতের সংখ্যা ছিল অবিশ্বাস্য। বাংলাদেশ পত্রিকার সূত্রমতে এবং তদন্ত কমিটি প্রকাশিত শুধু আঠারো জেলার মধ্যে পাঁচটির পরিসংখ্যান অনুসারে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কুমিল্লায় পঁচানব্বই হাজার, ঢাকায় এক লাখ, খুলনায় এক লাখ পঞ্চাশ হাজার, যশোরে পঁচাত্তর হাজার এবং চট্টগ্রামে এক লাখ বাঙালিকে হত্যা করেছে। আঠারো জেলার প্রাথমিক পরিসংখ্যান অনুসারে, মোট নিহত ব্যক্তির সংখ্যা ছিল ১২,৪৭,০০০ (মেহরিস, পৃ. ৩)। হতাহতের সংখ্যা তত্ত্বের বিচার কিংবা উদ্দেশ্যের বিচারেও বাংলাদেশে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সামরিক অভিযানের নামে যে বাঙালি পরিচয়ে পরিচিত জাতিকে নিশ্চিহ্ন করতে চেষ্টা করেছে, তা অনস্বীকার্য।

পাকিস্তান সরকার অধিকাংশ বিদেশি সংবাদদাতাকে পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগে বাধ্য করলেও তাঁদের অনেকে বাংলাদেশ পরিস্থিতির সংবাদ গোপনে সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছিলেন (মেহরিস, পৃ. ১১১)। পাকিস্তান সরকার ৩৫ জন বিদেশি সাংবাদিককে বহিষ্কারের বিষয়টি ২৮ মার্চ, ১৯৭১ নিউইয়র্ক টাইমস-এ গ্রেস লিকটেনস্টেইনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস ও রয়টার্সের দুজন সাংবাদিক এই সময় হোটেলে উপস্থিত ছিলেন না। প্রতিবেদনে দ্য টাইমস-এর স্যুয়েনবার্গের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, যখন তিনি ওই এলাকার ভারপ্রাপ্ত লে. কর্নেলকে তাঁদের ঢাকা ত্যাগের নির্দেশ প্রদানের কারণ জানতে চান তখন অফিসারের মন্তব্য ছিল, ‘আমরা তোমাদের নিরাপত্তা ঝুঁকির জন্য তোমাদেরকে চলে যেতে বলছি। এখানে অনেক রক্তারক্তি হবে।’ দ্য টাইমস-এর পক্ষ থেকে পাকিস্তান সরকারের কাছে পাঠানো একটি টেলিগ্রামে স্যুয়েনবার্গ এবং অন্য সাংবাদিকদের সঙ্গে পাকিস্তান সামরিক প্রশাসনের অশোভন আচরণের তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়।৮ ৩১ মার্চ, ১৯৭১ গার্ডিয়ান-এ প্রকাশিত ‘দ্য ম্যাসাকার ইন পাকিস্তান’ শিরোনামে প্রকাশিত সম্পাদকীয়তে উল্লেখ করা হয়, ‘...বাঙালিরা মারা যাচ্ছে...ঢাকার ভাগ্যে যা ঘটছে তা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ...সবার এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া উচিত।’৯

আন্তর্জাতিক আইনে যুদ্ধাপরাধ ও জেনোসাইড

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, বিশেষত জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে জেনোসাইড-বিষয়ক ঘোষণা স্বাক্ষরের পর আন্তর্জাতিক অপরাধসংক্রান্ত আইনের প্রয়োজনীয়তা ও প্রায়োগিক গুরুত্ব বৃদ্ধি পায় (মেহরিস, পৃ. ৪)। আন্তর্জাতিক আইনানুসারে অপরাধের সংজ্ঞায়নের সঙ্গে কোন ধরনের ব্যবস্থার মাধ্যমে এ ধরনের অপরাধের বিচার হবে তা সম্পর্কিত। সর্বজনীন আইনের লঙ্ঘনের (ডেলসিটি জুরিস জেনথাম) বিষয়টি আন্তর্জাতিক আইনের ক্লাসিক্যাল দলিল প্রস্তুতকারীদের দ্বারা স্বীকৃত এবং বিভিন্ন দেশের সংবিধান ও রাষ্ট্রীয় ঘোষণাপত্র প্রণয়নে প্রয়োগ হয়ে আসছে (মেহরিস, পৃ. ৪)। ১৯ শতকে প্রচলিত ঘোষণাপত্রসমূহ অনুসারে রাষ্ট্রীয় আদালতগুলোর শুধু অপরাধের বিচারের বিচারিক ক্ষমতা ছিল কিন্তু অপরাধের সংজ্ঞায়ন বহুলাংশে আন্তর্জাতিক আইনের ঘোষণাপত্রসমূহের ওপর নির্ভরশীল ছিল (মেহরিস, পৃ. ৫)। কুইন্সি রাইট আন্তর্জাতিক আইনের মূলনীতিগুলো বিশ্লেষণ এবং অপরাধ আইন অনুসারে আন্তর্জাতিক আইনের বিরুদ্ধে অপরাধের সংজ্ঞায়নে বলেছেন, ‘আন্তর্জাতিক আইনের বিরুদ্ধে অপরাধ হলো এমন ধরনের আইন পরিপন্থী কার্যক্রম, যা আন্তর্জাতিক আইনের দ্বারা সংরক্ষিত সর্বজনীন কিছু অধিকার অথবা আইন লঙ্ঘন সম্পর্কিত ধারণা, এবং এ ধরনের পরিপন্থী কার্যক্রম কোনো রাষ্ট্রের প্রচলিত অপরাধ আইনের দ্বারা বিচার্য নয় (মেহরিস, পৃ. ৫)।’ ১৯৭০-এর দশকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের অন্তত ছয়টি মতবাদ প্রচলিত ছিল। ওই সময়কাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক আইনে অপরাধসংক্রান্ত আইন বিবর্তিত হয়নি। জাতিসংঘে কিছু রাষ্ট্রের ভেটো নামক বিশেষ ক্ষমতা অনেকাংশে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের প্রয়োগকে পক্ষপাতদুষ্ট এবং অন্তঃসারশূন্য করে ফেলে। যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রশ্ন আন্তর্জাতিক আইনজ্ঞদের মধ্যে বিতর্কের জন্ম দেয়। ন্যুরেমবার্গ বিচারের মূলনীতিগুলোর ন্যায্যতার প্রশ্নে আইনজ্ঞদের মধ্যে পরিস্থিতি বিচারে দুটি তাত্ত্বিক ধারা তৈরি হয়। প্রথম ধারা অনুসারে, বিশ্বে কোনো সর্বজনীন আন্তর্জাতিক আইনব্যবস্থা নেই, যার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আইনের প্রয়োগ করে আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার করা সম্ভব। অন্য ধারা অনুসারে, ক্ষতিগ্রস্ত জাতি বা গোষ্ঠীর অবশ্যই তার বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের জন্য বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। ন্যুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালে বিজেতা ও বিজিতদের যুদ্ধে ভূমিকার ওপর ভিত্তি করে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার করা হয়। এই ধারাটি আমেরিকার আইনজ্ঞরা বিশেষভাবে সমর্থন করেন এবং ন্যুরেমবার্গ ও টোকিও ট্রাইব্যুনালের বিচারের বৈধতা ও ন্যায্যতার প্রশ্নে তাঁরা বিজয়ী ন্যায় প্রতিষ্ঠিত, এই যুক্তি দিয়ে থাকেন।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে জেনোসাইড মানব ইতিহাসে পুরোনো একটি বিষয়। পশ্চিমা সভ্যতার ইতিহাস খ্রিষ্টানদের বিরুদ্ধে রোমের জেনোসাইডের মাধ্যমে তা সূচিত হয়েছে (মেহরিস, পৃ. ২৭)। অবশ্য পশ্চিমা বিশ্বের মতানুসারে হিটলারের ইহুদিদের বিরুদ্ধে হোলকাস্ট সর্বাপেক্ষা নৃশংস জেনোসাইড। মাত্রার বিচারে বাংলাদেশের জেনোসাইড কোনো অংশে হোলকাস্টের চেয়ে কম নৃশংস ছিল না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিশ্বরাজনীতির মেরুকরণের মারপ্যাঁচে এবং অস্বীকৃতির রাজনীতির কুটিল ষড়যন্ত্রে বাংলাদেশ জেনোসাইড বিশ্বসমাজে অজানা রয়ে গেছে।

বিশ্বের উল্লেখযোগ্য যুদ্ধাপরাধের বিচার ও বাংলাদেশের করণীয় এবং স্মরণীয়

বিশ্ব ইতিহাসে যুদ্ধাপরাধের বিচার নতুন কোনো বিষয় নয়। গ্রিক পৌরাণিক কাহিনি ও মধ্যযুগে যুদ্ধাপরাধের বিচারের একাধিক নজির পাওয়া যায়। প্রাচীন গ্রিসে অনেক যুদ্ধবন্দী যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত হওয়ার পর মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন (মেহরিস, পৃ. ৩৬)। ইউরোপের ত্রিশ বর্ষব্যাপী যুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক আইনের বিবর্তনে বিপ্লব ঘটে। এই বিপ্লব যুদ্ধাপরাধের বিচারের ইতিহাস পরিবর্তন করে। আঠারো শতকের মধ্যভাগে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে অনেক ব্যক্তির আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের জন্য বিচার করা হয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ ১৭৯৬ সালে ব্রিটিশ আদালত একজন কর্মকর্তাকে ফরাসি বন্দীদের নষ্ট ও খারাপ খাবার পরিবেশনার মাধ্যমে ব্রিটিশ রাজকে কলঙ্কিত করার কারণে দণ্ডিত করে (মেহরিস, পৃ. ৩৭)। বাংলাদেশের পাকিস্তানি সামরিক ও বেসামরিক যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে স্বাধীনতার পর যে বিচার-প্রক্রিয়ার উদাহরণ ছিল তার মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের জন্য অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত লিপজিগ ট্রাইব্যুনাল, ন্যুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনাল, টোকিও ট্রাইব্যুনাল, ইতালিতে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ট্রাইব্যুনাল উল্লেখযোগ্য (মেহরিস, পৃ. ৩৭-৫৮)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য অধিকাংশ ট্রাইব্যুনাল ছিল সামরিক কিন্তু যেসব দেশ এই বিচারের ব্যবস্থা করেছিল তাদের অধিকাংশ সে সময়ে বেসামরিক ও গণতান্ত্রিক সরকারের শাসনাধীনে ছিল। মূলত যুদ্ধাপরাধ সাধারণত সামরিক ও সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত হয়, এই চিন্তাধারা থেকে সামরিক ট্রাইব্যুনালগুলো গঠন করা হয়েছিল বলে অনুমেয়। পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশের কোনো স্বতন্ত্র সামরিক বাহিনী ছিল না। একটি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নামে শুধু একটি সামরিক রেজিমেন্ট ছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে সামরিক বাহিনী তখনো শৃঙ্খলিতভাবে ও কাঠামোবদ্ধভাবে গড়ে ওঠেনি, কারণ প্রাক্তন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্যরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তরে অবস্থান করছিল। এরূপ পরিস্থিতিতে স্বভাবতই বাংলাদেশ সাংবিধানিক এখতিয়ার অনুসারে আইন প্রণয়ন করে বেসামরিক আদালতের মাধ্যমে পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার প্রয়াস পায়।

যুদ্ধাপরাধী ও যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রশ্ন

যুদ্ধ একটা অস্বাভাবিক অবস্থা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে যা হয়েছে তা শুধু জেনোসাইড শব্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এর মধ্যে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, সাম্প্রদায়িক হত্যাকাণ্ড এবং নির্বিচারে গণহত্যাও রয়েছে। ১৯৭১-৭২ সালে আমাদের দেশে আন্তর্জাতিক সাংবাদিকেরা এবং পরবর্তী সময়ে সফরকারী বিদেশি পর্যবেক্ষক দলগুলো তাদের প্রতিবেদনে বাংলাদেশে চরম মাত্রায় জাতিগত গণহত্যা হয়েছে বলে উল্লেখ করেছে। সফরকারীরা বিভিন্ন শরণার্থী শিবির, নির্যাতিতদের জবানবন্দি শোনার পর আন্তর্জাতিক আইনজ্ঞরা ১৯৭২ সালে নিশ্চিত করেছেন যে বাংলাদেশে পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম বৃহত্তম জেনোসাইড সংঘটিত হয়েছে।

যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়টি সব সময় জটিল ও কুটিল। মধ্যযুগ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বিভিন্ন পরিসরে ও পরিমণ্ডলে যুদ্ধাপরাধের বিচার করা হয়েছে। আঠারো শতকে আন্তর্জাতিক অপরাধের জন্য অনেক ব্যক্তির বিচার হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বেসরকারি উদ্যোগে আন্তর্জাতিক আইনের প্রশাসক হিসেবে আন্তর্জাতিক আদালত গঠন করে জাতীয় আইন ও বিধি পরিপন্থী অপরাধের বিচারের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করা হয়েছে। বিশ্ব ইতিহাসে অবশ্য সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধাপরাধ বিচারের বিচারিক আদালত হচ্ছে ন্যুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনাল এবং টোকিও ট্রাইব্যুনাল। অবশ্য নািস যুদ্ধাপরাধী অ্যাবলফ আইকম্যানের বিচার যুদ্ধাপরাধ বিচারের অনন্য উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হবে। এই ট্রাইব্যুনালদ্বয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিচারিক অধিকার, এখতিয়ার এবং ট্রাইব্যুনালের গঠন-প্রক্রিয়া নিয়ে অনেক প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। যেমনটি ঘটছে এখন বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের ক্ষেত্রে। এই ট্রাইব্যুনালগুলোর রায়সমূহও বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রদত্ত রায়গুলোর মতো বিভিন্ন ধরনের সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। ন্যুরেমবার্গ ও টোকিও ট্রাইব্যুনালের অভিজ্ঞতার পর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত দুর্বিষহ ঘটনামালা এবং পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী যে ধরনের নৃশংসতার উদাহরণ সৃষ্টি করেছে তাতে করে যুদ্ধাপরাধ ও জেনোসাইডের পুনঃপাঠ অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে।

হামুদুর রহমান কমিশনের প্রতিবেদন মোতাবেক পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীর মোট সংখ্যা ছিল ৯০ হাজার ৩৬৮, যার মধ্যে স্থলবাহিনীর ৫৪ হাজার ১৫৪ জন, নৌবাহিনীর ১ হাজার ৩৮১ জন, বিমানবাহিনীর ৮৩৩ জন, পুলিশসহ প্যারামিলিটারির ২২ হাজার জন, বেসামরিক ১২ হাজার লোক ছিল। বাংলাদেশ জাতিসংঘ স্বীকৃত রাষ্ট্র না হওয়ায়, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে স্বাক্ষরিত আত্মসমর্পণের দলিল ও জাতিসংঘ কর্তৃক ২১ ডিসেম্বর তারিখে গৃহীত ৩০৭ (১৯৭১) নম্বর রেজল্যুশন মোতাবেক জেনেভা কনভেনশন ১৯৪৯-এর আওতায় প্রায় এক সপ্তাহের মধ্যে সব যুদ্ধবন্দীকে নিয়ে যাওয়া হয় ভারতে।

বাংলাদেশ সরকার প্রথম থেকে যুদ্ধাপরাধ-বিষয়ক জেনেভা কনভেনশন অনুসারে কেবল যুদ্ধাপরাধ ও জেনোসাইডের দায়ে অভিযুক্ত পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দী এবং তাদের দোসরদের বিচারে সংকল্পবদ্ধ ছিল। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপর বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২ সালের জুলাই মাসের মধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরুর নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়।১০ বাংলাদেশ সরকার পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর দোসর ও রাজাকার এবং যুদ্ধবন্দী যেসব সামরিক কর্মকর্তা ও সদস্যের বিরুদ্ধে প্রাথমিক পর্যায়ে অভিযোগ পাওয়া গেছে, তাদের বিরুদ্ধে আরোপিত অভিযোগ তদন্ত এবং বিচার-প্রক্রিয়া শুরুর প্রয়াস নেয়। পাকিস্তানের তত্কালীন জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও সামরিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল টিক্কা খানকে হুকুমের আসামি করার পরিকল্পনা নেয়। বাংলাদেশ সরকার ন্যুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনাল এবং জাতিসংঘের জেনোসাইড কনভেনশনের ভিত্তিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ নেয়। বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ বিচারে প্রধান অন্তরায় ছিল তখন পর্যন্ত পাকিস্তান জেনোসাইড কনভেনশন স্বাক্ষর করেনি। অন্যদিকে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল এবং প্রতিশোধস্পৃহার কারণে যাতে কোনো যুদ্ধবন্দীর জীবন বিপন্ন না হয় সে জন্য পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীদের ভারতীয় বাহিনীর হেফাজতে রাখা হয়েছিল। বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগকে ঘিরে বেশ কিছু প্রশ্ন উত্থাপিত হয়:

ষ          যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বাংলাদেশের আইনি এখতিয়ার আছে কি?

ষ          বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে ন্যুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনাল ও আইকম্যানের মামলা উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করার যথার্থতা কতটুকু?

ষ          বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে কী ধরনের প্রক্রিয়া এবং আইনি রূপরেখা অনুসরণ করা হবে?

বাংলাদেশ সরকার পাকিস্তান সরকারকে যুদ্ধাপরাধ ও জেনোসাইডের দায়ে অভিযুক্ত যারা পাকিস্তানে অবস্থান করছে তাদের বাংলাদেশ সরকারের কাছে হস্তান্তর করার জন্য চাপ সৃষ্টির প্রয়াস নেয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে এম কামারুজ্জামান ১৯৭১ সালের ২৪ ডিসেম্বর ঘোষণা করেন, বাংলাদেশ ৩০ জন শীর্ষস্থানীয় পাকিস্তানি সরকারি কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেছে এবং গণহত্যায় সহযোগিতার জন্য অচিরেই তাদের বিচার হবে। শেখ মুজিবুর রহমান ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের বন্দিত্ব ঘুচিয়ে দেশে ফেরার পর আমেরিকান ব্রডকাস্টিং করপোরেশন বা এবিসিকে দেওয়া সাক্ষাত্কারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে বলেন, ‘আমি অবশ্য তাদের বিচার করব। কোনো দেশ কি ৩০ লক্ষ লোকের হত্যাকারীদের (বিনা বিচারে) মুক্তি দিতে পারে?’ স্বাধীনতার পরপর বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে সরকারি ও বেসরকারি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি বাড়ি বাড়ি গিয়ে শুমারির মাধ্যমে হতাহতের সংখ্যা লিপিবদ্ধ করার কার্যক্রম শুরু করে। ১২ সদস্যবিশিষ্ট সরকারি তদন্ত কমিটির সভাপতি আবদের রহমান মার্চ, ১৯৭২ অদ্যাবধি সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে নিহত ব্যক্তির সংখ্যা তিন লাখে পৌঁছেছে বলে সংবাদমাধ্যমগুলোকে জানান। বাংলাদেশে ১৫ জানুয়ারি, ১৯৭২ বুদ্ধিজীবীরা জেনোসাইড ও পৈশাচিক নিপীড়নের দায়ে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজি ও মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলির বিচার দাবি করেন (মেহরিস, পৃ. ১০৯)। বাংলা একাডেমির তত্কালীন পরিচালক কবির চৌধুরী বলেন, ‘এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য হচ্ছে অবিলম্বে এসকল যুদ্ধাপরাধীকে শাস্তি প্রদানের জন্য তাদের অপরাধ তদন্তে তদন্ত কমিশন গঠনের জন্য জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের ওপর চাপ সৃষ্টি করা।’১১ তিনি আরও বলেন, ‘পাকিস্তানি সেনারা এবং তাদের দোসররা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে ছাত্র, শিক্ষক, ডাক্তারসহ বহু বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছে।’১২ তিনি এই হত্যাকাণ্ডকে পরিকল্পিত এবং জেনারেল নিয়াজি ও রাও ফরমান আলিসহ অন্য পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তাদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছে বলে অভিযোগ করেন। তিনি ভারতের হেফাজতে থাকা অভিযুক্ত পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তাদের বিচার দাবি করেন। কবির চৌধুরীসহ আন্দোলনকারীরা ওয়ার্ল্ড জুরিস্ট অ্যাসোসিয়েশন, ওয়ার্ল্ড পিস কাউন্সিল, সোভিয়েত রাষ্ট্রপতি লরেড ব্রেসনেভ, হ্যারল্ড উইলসন, সিনেটর অ্যাডওয়ার্ড কেনেডিসহ অন্যান্য বিশ্বনেতাকে দায়ী পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের বিচারে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের দাবি জানিয়ে চিঠি দেন (মেহরিস, পৃ. ১০৯)। ভারত সরকার জেনোসাইড, যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের জেনেভা ঘোষণা অনুসারে অব্যাহতি পাওয়া সমীচীন নয় বলে জাতিসংঘকে অভিহিত করে। এসব অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আন্তর্জাতিক আইন ও সংক্ষুব্ধ ক্ষেত্রের বিধি অনুসারে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ বাহিনীর কাছে বাংলাদেশের পক্ষে হেফাজতে দেওয়ার দাবি জানানো হয় (মেহরিস, পৃ. ১০৮)। জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সামার সেন ভারত সরকারের এই অবস্থানের বিষয়টি জাতিসংঘ মহাসচিব কার্ট ওয়াডহেইমকে ১৪ জানুয়ারি, ১৯৭২ প্রেরিত চিঠিতে অবহিত করেন।১৩ ২১ জানুয়ারি, ১৯৭২ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের মাটিতে সংঘটিত জেনোসাইডের বিচারকল্পে ট্রাইব্যুনাল গঠনের জন্য জাতিসংঘের প্রতি অনুরোধ জানান (মেহরিস, পৃ. ১১০)। উল্লেখ্য, তত্কালীন সময়ে জাতিসংঘ যেহেতু ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রস্তাব বিবেচনা করেনি, সেহেতু বর্তমান প্রেক্ষাপটে নৈতিকভাবে বাংলাদেশের স্বউদ্যোগে গঠিত ট্রাইব্যুনালের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারে না। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ ওয়ার্ল্ড পিস কাউন্সিলকে জাতিসংঘের যুদ্ধাপরাধ বিচারে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে অনুরোধ করতে আহ্বান জানান।১৪ পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে প্রথম সরকারি পদক্ষেপ হিসেবে অভিযুক্ত যুদ্ধবন্দীদের হস্তান্তরের জন্য ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশ সরকার ভারত সরকারকে অনুরোধ করে। ভারত সরকার প্রাথমিক অভিযোগ (প্রাইমাফেসি) প্রমাণিত এমন যুদ্ধবন্দীদের বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তরে রাজি হয়। ১৯৭২ সালের ২৯ মার্চ লে. জে. এ এ কে নিয়াজি, মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলিসহ ১ হাজার ১০০ পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীর বিচারের সরকারি পরিকল্পনা ঘোষণা করা হয়।১৫ বাংলাদেশ সরকার দুই স্তরবিশিষ্ট একটি বিচার পরিকল্পনা পেশ করেছিল। সে সময় ভারত শুধু সেসব পাকিস্তানি সৈন্যকে হস্তান্তর করতে রাজি হয়, যাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকার প্রমাণিত অভিযোগ হাজির করতে সক্ষম হয়েছিল।১৬ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ এপ্রিল ১৯৭২ বাংলাদেশের মাটিতে যেকোনো মূল্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে বলে পুনরায় সংকল্প ব্যক্ত করেন। আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির বৈঠকে তিনি বলেন, ‘যারা অভিযুক্ত নন তাদের প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা করা হবে।’১৭ পরবর্তী সময়ে তিনি এ বিষয়ে আরও স্পষ্ট ভাষায় বলেন, ‘পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালি ও যুদ্ধাপরাধীদের অভিন্নভাবে বিবেচনা করা যেতে পারে না।’১৮ কানাডার আলব্রাটা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক আইনের অধ্যাপক এল সি গ্রিন ১৯ এপ্রিল, ১৯৭২ নয়াদিল্লিতে ইন্ডিয়ান ল ইনস্টিটিউটে বক্তৃতাকালে বাংলাদেশে পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে বলেছিলেন যে এই বিচার-প্রচেষ্টা অনেক সমস্যা ও প্রশ্নের জন্ম দেবে (মেহরিস, পৃ. ১১১)। তাঁর মন্তব্যটি সময়ের পরিক্রমায় আজ অবধি সত্য প্রমাণিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশ সরকারের সংগৃহীত প্রমাণের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭২ সালের ১৪ জুন ভারত সরকার প্রাথমিকভাবে নিয়াজিসহ ১৫০ জন যুদ্ধবন্দীকে বিচারের জন্য বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তরে সম্মত হয়।১৯ পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার-প্রক্রিয়া রুখতে মরিয়া জুলফিকার আলী ভুট্টো গণচীনকে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ অর্জন ভেটো ক্ষমতা ব্যবহার করে স্থগিত করতে সম্মত করে। ১৯৭২ সালের ২৫ আগস্ট পাকিস্তানের স্বার্থে গণচীনের প্রদত্ত ভেটোর কারণে বাংলাদেশের জাতিসংঘে যোগদান সম্ভবপর হয়নি।২০ উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের লক্ষ্যে ১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংসদে পাস করে। তবে ১৫০ যুদ্ধবন্দীকে বিচারের জন্য বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করতে রাজি হয়নি ভারত।

চতুর্থ জেনেভা কনভেনশনের অনুচ্ছেদ ৩ (১) (ঘ) অনুসারে যুদ্ধবন্দীদের বিচারের প্রসঙ্গে শর্ত ছিল যে অভিযুক্ত যুদ্ধবন্দীদের বিচারের জন্য সভ্য জাতিসমূহের স্বীকৃত বিচারিক সুবিধা প্রদান নিশ্চিত করার মাধ্যমে নিয়মসম্মতভাবে গঠিত আদালতের রায় দ্বারা তাদের বিচার ও রায় কার্যকর করা যাবে। বাংলাদেশকে এই অনুচ্ছেদের প্রয়োগ থেকে বিরত রাখতে ১৯৭৩ সালের ২৭ মে, ভুট্টো পাকিস্তানে আটক ২০৩ জন জ্যেষ্ঠ বাঙালি কর্মকর্তাকে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে একই ধরনের আদালতে বিচার করা হবে বলে হুমকি দেন।২১ ভুট্টোর হুমকি সত্ত্বেও, বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩ প্রণয়ন করে। আইনটি জেনেভা কনভেনশনের সঙ্গে যাতে বিরোধপূর্ণ না হয় সে জন্য সংবিধানের অনুচ্ছেদ নম্বর ৪৭-এ একটি অতিরিক্ত ধারা সংযুক্তির দ্বারা গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধসহ অন্যান্য অপরাধের বিচারের পথ সুগম করা হয় এবং ৪৭(ক) নামে একটি নতুন অনুচ্ছেদ সংযোজন দ্বারা এসব বিচারের ক্ষেত্রে বিচারাধীন অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মৌলিক অধিকার সীমিত করা হয়। বাংলাদেশ আইনটি প্রণয়নের সঙ্গে সঙ্গে ভারত যাতে যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত যুদ্ধবন্দীদের বাংলাদেশের হাতে তুলে না দেয়, সে জন্য ভুট্টো ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে মামলা দায়ের করেন।২২ ১৯৭৩ সালের ২৮ আগস্ট ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ দিল্লি চুক্তি সম্পাদিত হয়। এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা যথাক্রমে ড. কামাল হোসেন, শরণ সিং এবং আজিজ আহমেদ। এই চুক্তি অনুসারে অভিযুক্ত ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী ব্যতীত সব পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দী এবং পাকিস্তানে আটক সব বাঙালির স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত হয়। চুক্তির অন্যতম সিদ্ধান্ত ছিল বাংলাদেশ সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদায় পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশে অবস্থানরত উর্দুভাষী পাকিস্তানি এবং অভিযুক্ত যুদ্ধবন্দীদের ভাগ্য প্রশ্নে প্রত্যক্ষভাবে আলোচনা করবে। ঘটনাপরম্পরায় সে সময় পাকিস্তানে আটকে পড়া কয়েক হাজার ভারতীয় সেনাসদস্য, সরকারি কর্মকর্তা ও বেসামরিক কয়েক লাখ মানুষকে মিথ্যা বিচারের মুখোমুখি করার ঘোষণা দেয় পাকিস্তান। ফলে ভারতের তত্কালীন সরকারের ওপর অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ও সামরিক চাপের সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে পাকিস্তানে আটকে পড়া বাংলাদেশিদের জীবন রক্ষার্থে ও নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের স্বার্থে এবং সর্বোপরি বিশ্বরাজনীতির তত্কালীন হর্তা-কর্তা-বিধাতাদের চাপে ভারতের নয়াদিল্লিতে ১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিল বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান ত্রিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষর করে। অভিযুক্ত যুদ্ধবন্দীরা বাংলাদেশের হেফাজতে ছিল না বিধায় বাংলাদেশ এসব যুদ্ধবন্দীর অন্যায্য প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে প্রত্যক্ষ কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। ভারত সরকারের দায়কে হয়তো লঘু বিবেচনা করা হবে, কারণ নিজ দেশের নাগরিকদের নিরাপত্তার প্রশ্নকে সে অগ্রাধিকার দিয়েছিল।

আন্তর্জাতিক আইনের আধুনিক স্থপতি ওপেনহেইম যুদ্ধাপরাধ সম্পর্কে বলেছেন, ব্যক্তিগত লালসা, জিঘাংসা ও লাভের জন্য কোনো সৈনিক বা ব্যক্তি নিজ বা শত্রু ভূখণ্ডে প্রযোজ্য সর্বজনীন আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করলে তা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচিত হবে এবং তিনি বিচারের জন্য দোষী বিবেচিত হবেন।২৩ ওপেনহেইমের মতে, ‘যুদ্ধাপরাধ হলো রাষ্ট্রসমূহ এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের অংশগুলোর আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে অপরাধের দায়’ (মেহরিস, পৃ. ১৭৫-২১০)। ওপেনহেইম চার ধারার যুদ্ধাপরাধের উল্লেখ করেছেন:

ষ          সামরিক বাহিনীর সদস্য কর্তৃক যুদ্ধের স্বীকৃত কোনো বিধির লঙ্ঘন।

ষ          শত্রু সামরিক বাহিনীর সদস্য নয়, এমন বেসামরিক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যেকোনো ধরনের সশস্ত্র আঘাত।

ষ          অঘোষিত গুপ্ত হামলা এবং উত্খাতের উদ্দেশ্যে ষড়যন্ত্রমূলক গোপন হামলা।

ষ          লুণ্ঠনের অভিলাষে যেকোনো ধরনের হামলা।

ওপেনহেইম তাঁর গ্রন্থে যুদ্ধের ২০টি বিধি উল্লেখ করেছেন, যেগুলো লঙ্ঘন করলে লঙ্ঘনকারী সামরিক বাহিনী বা বাহিনীর সদস্য যুদ্ধাপরাধের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হবে।২৪ বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের সমন্বয়ে গঠিত আধা সামরিক বাহিনীসমূহ ওপেনহেইমের নির্দেশিত ২০টি বিধির সবগুলো প্রত্যক্ষভাবে লঙ্ঘন করেছিল।

৭ অক্টোবর ১৯৪২ জাতিসংঘ যুদ্ধাপরাধ কমিশন গঠিত হয়। এই কমিশন অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের অভিযোগের ধরন ও মাত্রার বিচারে কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করে। কমিশনের শ্রেণি বিভাজন অনুসারে পাকিস্তানি অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের অনেকের বিরুদ্ধে ‘এ’ শ্রেণিতে অভিযোগ আনয়ন সম্ভব।২৫ ১১ ডিসেম্বর ১৯৪৬ সাধারণ পরিষদ ন্যুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালে অনুসৃত মূলনীতিগুলো অনুমোদন দিয়ে ৯৫(১) প্রস্তাব পাস করে। ১৯৭১ সালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের জন্য ন্যুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালে অনুসৃত মূলনীতিগুলো অনুসারে অভিযুক্ত পাকিস্তানি সামরিক সদস্যদের বিচার করার ন্যায্যতা বাংলাদেশের থাকলেও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নব্য রাষ্ট্রের বৈধতা অর্জনের জন্য সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ শর্ত অপরাপর সার্বভৌম রাষ্ট্রসমূহের স্বীকৃতির রাজনীতির কারণে এবং আন্তর্জাতিক সর্বজনীন বিচারব্যবস্থার অনুপস্থিতির কারণে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে খুব বেশি অগ্রসর হতে পারেনি।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে জেনোসাইড অপরাধ মানব ইতিহাসে নতুন কোনো বিষয় নয়। মধ্যযুগে রোমে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে জেনোসাইড সংঘটিত হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলার ইহুদিদের বিরুদ্ধে জেনোসাইড অপরাধ করেছিলেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা জেনোসাইড অপরাধ করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিতের পর ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ ২৬০ক (৩) প্রস্তাবের মাধ্যমে জেনোসাইড কনভেনশন সর্বসম্মতভাবে সাধারণ পরিষদে অনুমোদন করে। জেনোসাইড মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধসহ আন্তর্জাতিক অপরাধ বিচারের জন্য একটি সর্বজনীন বিচারিক আদালত প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু ১৯৭১ সালে এবং পরবর্তী কয়েক বছরেও এই বিচারিক আদালত পূর্ণাঙ্গভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আন্তর্জাতিক বিচারিক কর্তৃপক্ষের অনুপস্থিতি রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রিক কূটকৌশল-সংশ্লিষ্ট জেনোসাইড, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের মতো আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার-প্রক্রিয়াকে অনিশ্চয়তার মধ্যে রেখে দিয়েছিল। ১৯৪৮ সালের জাতিসংঘ আয়োজিত জেনোসাইড-বিষয়ক সম্মেলনে তত্কালীন বিদগ্ধ আইনজ্ঞরা জেনোসাইডের একটি সর্বজনীন সংজ্ঞা প্রদান করেন। এই সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, জেনোসাইড বলতে কোনো জাতিগত, নৃতাত্ত্বিক, বর্ণগত অথবা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করার প্রবৃত্তি হতে সম্পাদিত নিম্নে বর্ণিত যেকোনো কর্মকাণ্ডকে নির্দেশ করা হবে—

ক.        জাতি বা গোষ্ঠীর সদস্যদের হত্যা করা।

খ.        জাতি বা গোষ্ঠীর সদস্যদের মারাত্মক শারীরিক বা মানসিক ক্ষতিসাধন।

গ.         উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কোনো গোষ্ঠীকে সমূলে বা আংশিকভাবে নিধনের জন্য সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনাপ্রসূত আরোপিত ব্যবস্থাপনা।

ঘ.         জাতি বা গোষ্ঠীর বংশগতি রোধে আরোপিত ব্যবস্থাপনা।

ঙ.        জোরপূর্বক কোনো জাতি বা গোষ্ঠীর শিশুদের অন্য জাতি বা গোষ্ঠীতে স্থানান্তর।

এই সম্মেলনের গৃহীত ঘোষণার প্রথম অনুচ্ছেদ অনুসারে, যুদ্ধাবস্থায় বা শান্তিকালীন যেকোনো সময়ে সংঘটিত জেনোসাইড শাস্তিযোগ্য অপরাধ এবং চতুর্থ অনুচ্ছেদ দ্বারা শাসনতান্ত্রিক প্রধান, সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তাদের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা হয়েছে। জেনোসাইড সম্বন্ধীয় দুটি বিষয় আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। প্রথমত, জেনোসাইড সংঘটনে রাষ্ট্রীয় প্রধানের প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ জরুরি নয়, যদি তাঁর অধস্তনদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। অধস্তনদের দ্বারা যদি জেনোসাইড অপরাধ সংঘটিত হয়, তবে তাদের নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা ও অপরাধের জন্য সরকারপ্রধানও সমভাবে দায়ী।

মানবতার দায়মুক্তির বিচার অনিবার্য

সন্দেহাতীতভাবে পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থানরত বাঙালিদের এবং পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ জনসাধারণের প্রাপ্য বেসামরিক ব্যক্তিদের অব্যাহতি বিষয়ক বিধি লঙ্ঘন করেছে এবং ১৮৯৯ সালের দ্বিতীয় হেগ কনফারেন্স এবং ১৯০৭ সালের চতুর্থ হেগ কনফারেন্সের অনেকগুলো অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করেছে।২৬ জাতিসংঘের সনদের মূলনীতিগুলো অনুসারে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী বাংলাদেশে যা ঘটিয়েছে, তা কোনোভাবে ন্যায্যতা পায় না। উপরন্তু পাকিস্তানি বাহিনী বাংলাদেশে সংঘটিত জেনোসাইডের জন্য প্রত্যক্ষভাবে দায়ী। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত ও প্রকাশিত সংবাদ ও প্রতিবেদন অনুসারে সহজেই প্রতীয়মান হয় যে ইয়াহিয়ার উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশি জনগোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করা। মাদ্রিতে ১৯৩৩ সালে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক কংগ্রেসে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুসারে কোনো নৃতাত্ত্বিক, ধর্মীয় ও সামাজিক গোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করার অপচেষ্টাকে আন্তর্জাতিক আইনের বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়।২৭ রাফায়েল ল্যামকিন তাঁর ‘অ্যাক্সিস রুল ইন অকুপাইড ইউরোপ’ (১৯৪৪) গ্রন্থে জেনোসাইডের সংজ্ঞায়নে বলেন, ‘পদ্ধতিগতভাবে কোনো জনগোষ্ঠীকে বা জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার প্রয়াস।’২৮ ল্যামকিনের সংজ্ঞানুসারে বাংলাদেশ জেনোসাইডকে যথার্থ বা আদর্শ জেনোসাইড বলা যেতে পারে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ সর্বসম্মতভাবে জেনোসাইডকে মানবজাতির বিরুদ্ধে অপরাধ ঘোষণা করে ১১ ডিসেম্বর, ১৯৪৬ ৯৬(ঝ) প্রস্তাবটি পাস করে। জেনোসাইড কনভেনশনের অনুচ্ছেদ ৬ অনুসারে অপরাধের প্রশ্নে সমকালীন আন্তর্জাতিক বিচারব্যবস্থার ক্ষমতা রয়েছে বিচার করার যত দিন পর্যন্ত অন্য কোনো বিচারিক অবকাঠামো তৈরি না করা হয়। জাতিসংঘ যদি সংক্ষুব্ধ দেশগুলোর জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের অনুপস্থিতিতে বিকল্প আন্তর্জাতিক বিচারব্যবস্থার আয়োজনে অসমর্থ হয়, তবে যে দেশে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে সে দেশ নিজস্ব উদ্যোগে জেনোসাইড অপরাধ বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে পারবে (মেহরিস, পৃ. ১৭১)। মানবাধিকার-বিষয়ক কমিশনের ২১তম অধিবেশনে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের সংজ্ঞায়ন জটিলতা সমাধানের প্রয়াস নেওয়া হয়। কমিশনের সদস্যদের মতে, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার ও দণ্ডাদেশ আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার স্বার্থে জনমনে আস্থা বিনির্মাণে মানবাধিকার ও মানবতার স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করবে।২৯

বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে যা ঘটেছে তা জেনোসাইড ভিন্ন কিছু নয়। হিটলার জার্মানি ও পোল্যান্ডে তাঁর জাতিগত ঘৃণার যে বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন, তার সঙ্গে কেবল বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি নৃশংসতা ও হত্যাযজ্ঞ তুলনীয়। পাকিস্তানিদের নৃশংসতা ও পাশবিকতায় তাদের অপরাধ উদ্দেশ্য (মেনস রে) স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে (মেহরিস, পৃ. ১৭৩)। ন্যুরেমবার্গে অনুসৃত ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও যথার্থভাবে প্রযোজ্য। আইন, মানবতা ও ন্যায়ের স্বার্থে যুদ্ধাপরাধের বিচার করা অনিবার্য। যুদ্ধাপরাধের বিচার অবশ্যই ন্যায়পরায়ণতা ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে হওয়া উচিত, প্রতিশোধস্পৃহা থেকে নয়। বিচার যেমন হিংসাত্মক হতে পারে না, তেমনি অহিংস হতে পারে না। সাধারণ অপরাধের পরিস্থিতি এবং যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের পরিস্থিতি এক মানদণ্ডে বিচার্য নয়। দণ্ডের উদ্দেশ্য সম্পর্কে হুগো গ্রোসিয়াস বলেছেন, ‘হয়তো এটি অপরাধী, ক্ষতিগ্রস্ত এবং সম্প্রদায়ের ভালোর জন্য।’৩০

যুদ্ধবন্দীদের পরিবারগুলো তাদের পরিবারের সদস্যদের প্রত্যাবর্তনের জন্য মুখিয়ে থাকবে—সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ওই সব যুদ্ধবন্দীকে যুদ্ধাপরাধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর একটিই প্রার্থনা থাকে, দোষীদের বিচার ও শাস্তি বিধান। শুধু সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা পরিবারের জন্য নয়, মানবতার বৃহত্তর স্বার্থে জেনোসাইড, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে সংঘটিত যেকোনো অপরাধের বিচার অপরিহার্য। নচেত্ মানব ইতিহাসে এ ধরনের পাশবিক ও নৃশংস অপরাধের পুনরাবৃত্তি নিরোধ সম্ভব নয় (মেহরিস, পৃ. ১৭৪)।

পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি আজও অমীমাংসিত রয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন অনুসারে অপরাধের বিচার যখনই সুযোগ তৈরি হোক না কেন সম্পন্ন করা উচিত। ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত যে আন্তর্জাতিক অপরাধ অন্যান্য অপরাধের চেয়ে দ্রুতগতির প্রচার ও প্রসার পায়। আন্তর্জাতিক অপরাধসমূহকে বিচার-প্রক্রিয়ার মধ্যে নিয়ে না এলে এই অপরাধের পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা থাকে। এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে রাজনৈতিক কর্মীরা স্বভাবত জড়িত থাকে বলে প্রায়ই অপরাধের অস্বীকৃতির রাজনীতি লক্ষ করা যায়। অস্বীকৃতির রাজনীতিকে প্রকারান্তরে সর্বজনীন মানবতার বিরুদ্ধাচরণ বা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ আখ্যায়িত করা যায়। আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার প্রশ্নে স্বভাবজাতভাবে অপরাধীর স্বরাষ্ট্র আগ্রহী হয় না, কারণ সংঘটিত অপরাধের সঙ্গে প্রায়ই রাষ্ট্রযন্ত্রের সম্পৃক্ততার প্রমাণ মেলে। কিন্তু যেকোনো জাতিরাষ্ট্রের অপরাধের দায় থেকে অবমুক্ত হওয়া উচিত। কোনো সভ্য ও মানবিক জাতি নিশ্চয়ই চাইবে না তারা হন্তক পাশবিক জাতি হিসেবে বিশ্ব ইতিহাসে পরিচিত হোক। বিচারের সঙ্গে দণ্ডাদেশের ওতপ্রোত সম্পর্ক থাকলেও বিচার সম্পন্ন করা প্রাধিকারযোগ্য। যুদ্ধাপরাধ ও জেনোসাইডের জন্য শাস্তি প্রদানে সমর্থ না হলেও অন্তত অভিযোগ প্রমাণ সাপেক্ষে ভর্ত্সনা ও দণ্ডাদেশ ঘোষণা করা উচিত। মানবতার দায়মুক্তির জন্য বিষয়টি অপরিহার্য।

তথ্যসূত্র:

1.            Devid Loshak, Pakistan Crisis, London, 1971, P. 59.

2.            Guardian (Manchester), June 5, 1971.

3.            Government of India, Ministry of External Affairs, Bangla Desh Documents, P. 446.

4.            ibid.

5.            Institute for Defence Studies & Analyses, News Review on Pakistan, Pak 5/71, P. 21.

6.            Statement of Hendrik Van Der Heijden, Economist, Pakistan Division of the World Bank, included in Thousand My Lais published by Society for Human Rights, Bangla Desh.

7.            http://www.globalsecurity.org/military/world/war/argentina.htm

8.            Rummel, R J. “Death by Government”. New Brunswick and London: Transaction Publishers, 1994.

9.            Lickttenstein, Grace. “Armey Expels 35 Foreign Newsmen from Pakistan”, The New York Times, March 28, 1971.

10.          Bangla Desh Documents, P. 387-388.

11.          The Hindustan Times, New Delhi, January 16, 1972, P. 1.

12.          ibid.

13.          The Hindustan Times, New Delhi, January 22, 1972, P. 1.

14.          The Hindustan Times, New Delhi, January 18, 1972, P. 1.

15.          The Hindustan Times, New Delhi, January 22, 1972, P. 1.

16.          নিউইয়র্ক টাইমস, ৩০ মার্চ ১৯৭২, পৃ. ৩|

17.          “India opens way for Dacca trials”, The New York Times, March 18, 1972, P. 1.

18.          The Hindustan Times, New Delhi, April 8, 1972, P. 1.

19.          ibid.

20.          “India to deliver 150 P.O.W.'s to Bangladesh to face trial”, The New York Times, June 15, 1972, P. 11.

21.          “A veto by Peking”, The New York Times, August 27, 1972; P. E3.

22.          “Bhutto threatens to try Bengalis held in Pakistan”, The New York Times, May 29, 1973; P. 3

23.          Maj Gen Sukhwant Singh AVSM, “India's Wars Since Independence”, Lancer International, USA, Pp. 536-538.

24.          L. Oppenheim, International Law, Vol. 2 (Ed. By H. Lauterpacht, 7th ed., London, 1952). Pp. 566-567.

25.          ibid, P. 567.

26.          ibid, Pp. 567-568.

27.          History of the United Nations War Crimes Commission and the Development of the Laws of War, London, His Majesty’s Stationery Office, 1948.

28.          International Law Reports, Vol. 36 (1968), P. 32.

29.          ibid.

30.          ibid, P. 27.