কালান্তরের ঘূর্ণিপাকে

 ১.

ইংরেজের সংস্পর্শে এসে বাঙালির জীবনে ভেতরে-বাইরে পরিবর্তনের কথা বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর বিখ্যাত ‘কালান্তর’ প্রবন্ধে তিনি ইংরেজকে ‘নব্য য়ুরোপের চিত্তপ্রতীক’ এবং ‘চিত্তদূতরূপে’ আখ্যায়িত করেছেন। তিনি লিখেছেন ইংরেজের আগমনের ফলে ‘য়ুরোপীয় চিত্তের জঙ্গমশক্তি আমাদের স্থাবর মনের উপর আঘাত করল।’ একে তিনি তুলনা করেছেন আকাশ থেকে নামা বৃষ্টিধারার সাথে যা ‘ভূমিতলের নিশ্চেষ্ট অন্তরের মধ্যে প্রবেশ করে প্রাণের চেষ্টা সঞ্চার করে দেয়, সেই চেষ্টা বিভিন্নরূপে অঙ্কুরিত বিকশিত হতে থাকে।’

পশ্চিমের এই শক্তি এল কিসের জোরে? কবি মনে করেন তাদের ‘সত্যসন্ধানের সততায়’। তারা প্রতিদিন জয় করেছে ‘জ্ঞানের জগেক, কেননা তার বুদ্ধির সাধনা বিশুদ্ধ, ব্যক্তিগত মোহ থেকে নির্মুক্ত।’ আমাদের চিত্ত প্রাচীন বিশ্বাসের প্রাচীরে আবদ্ধ এবং নতুনের প্রতি সন্দিগ্ধ থাকলেও ‘জ্ঞানের বিশ্বরূপ’ এবং বুদ্ধির ‘সর্বব্যাপী ঔত্সুক্য’ সম্পূর্ণ ঠেকানো যায়নি। মানুষের জন্মগত আর ‘পূর্বজন্মার্জিত কর্মফলে’ যে অধিকার এবং তার সৃষ্ট অচলায়তনে বাঁধা যে সমাজ বহুকাল স্থবির হয়ে থেকে স্থাবর হয়ে পড়েছিল তাতে ঘা লাগল, ফাঁকফোকর তৈরি হলো। এই কালান্তরের আগে ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, বাঙালি অষ্টাদশ শতাব্দী নাগাদ ‘তাহার গ্রাম্য জীবনের ক্ষুদ্র পরিধির মধ্যে খুশি হইয়াই থাকিত।’

এবারে ইংরেজের প্রভাব পড়ল বাঙালি জীবনাচরণে এবং বুদ্ধির জগতে, অর্থাত্ বাইরে ও ভেতরে। ইংরেজি ভাষায় দক্ষ, ইংরেজের পোশাকে অভ্যস্ত, ইংরেজের চালচলনের অনুরক্ত একটি শ্রেণি তৈরি হয়। তাদের, এবং তাদের বাইরেও অনেকের, মন থেকে সনাতন বিশ্বাস ও সংস্কারের ঘোর কাটতে শুরু করে—ক্ষুদ্র একটি অংশের মধ্যে সন্দেহ-সংশয়, জিজ্ঞাসা-কৌতূহল, এমনকি জন্মায় সাহস, যা প্রশ্ন ও প্রত্যাখ্যান করে সনাতন প্রথাকে এবং নতুন ও বিকল্পকে গ্রহণ ও সৃজন করার জন্য তত্পর হয়। রাজা রামমোহন রায় এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ধর্ম ও শাস্ত্রের সাহায্য নিয়ে ধর্মের নামে সমাজের অমানবিক নিষ্ঠুর কিছু প্রথা রদ করতে চেয়েছিলেন। সতীদাহ প্রথা বন্ধের উদ্যোগ দ্রুত সাফল্য পেয়েছিল মূলত ইংরেজ শাসকদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায়; বিধবাবিবাহ চালু করা শাসক নয় হিন্দুসমাজের দায় হওয়ায় তা ঘটেছে ধীরে, বৃহত্তর সমাজের প্রায় অগোচরে, এবং বিপরীতে, বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে—সমাজ বা শাসক কখনো অনুমোদনের স্পষ্ট কোনো বিধান দেয়নি।

তবে সনাতন সমাজের সঙ্গে এ দুজনের বিতর্ক ও বিরোধ পুরোনোকে চ্যালেঞ্জ করার সাহসিকতার দৃষ্টান্তই কেবল নয়, এ সূত্রে তাঁদের কর্মজীবন বাঙালির মানসে প্রতিবাদ-প্রত্যাখ্যানের সাহস সঞ্চার করেছে। এ সূত্রে ডিরোজিও ও তাঁর ইয়ং বেঙ্গলদের মুক্তচিন্তা ও আচার বিরোধিতার ঐতিহাসিক গুরুত্বও মনে রাখা দরকার। এর বাইরে বাঙালির পরিণত মননসাধনায় বঙ্কিম-ভূদেব-অক্ষয় দত্তের মতো চিন্তাবিদদের ধর্ম থেকে বিজ্ঞানের যুক্তিনির্ভর রচনাসমূহ, দ্বারকানাথ ঠাকুর, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় বা দ্বারকানাথ গাঙ্গুলি প্রমুখের মতো প্রথা ভাঙা কর্মীদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ পাথেয় হয়ে থাকল।

মুসলমান সমাজ ইংরেজি শিক্ষা ও ইংরেজের প্রভাবে এসেছে আরও প্রায় এক শ বছর পরে। তবে মূলত চাষি, জোলা ও অন্যান্য বৃত্তিজীবী নিয়ে গঠিত খাস স্থানীয় মুসলিম সমাজে কখনো আরবি ভাষা এবং কোরআন ও সুন্নাহভিত্তিক শাস্ত্রচর্চা গভীরতা পায়নি। আর আশরাফ মুসলমানের উদ্ভব মূলত এ দেশে আগত ফারসি ও তুর্কিভাষী শাসক-প্রশাসক, প্রচারক-সাধক, সৈনিক-বণিক এবং তাদের বংশধর হিসেবে বা সান্নিধ্য লাভের সূত্রে। এটিও অনারব সংস্কৃতি যারা অভিবাসী জীবনে মূলত ফারসি ভাষা ও সংস্কৃতির উত্তরাধিকারই বহন করেছে। আর স্থানীয় মানসে এর স্বাঙ্গীকরণে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে পরবর্তীকালে আরবি-ফারসির দোসর উর্দুভাষার বিকাশ, বিশেষত এ ভাষায় উত্কৃষ্ট সাহিত্য রচিত হলে এবং শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলাবহির্ভূত মুসলমানদের জন্য উর্দু চালু হলে সর্বভারতে ক্রমে মুসলিম সমাজ এ ভাষাকে গ্রহণ করে নেয়। তবে এই কৃষিপ্রধান দেশের প্রকৃতির প্রাচুর্যে ও খামখেয়ালিতে অভ্যস্ত গ্রামীণ সমাজের পক্ষে তার চিরায়ত লোকবিশ্বাস ও লোকাচারের সংস্কৃতি ত্যাগ করা সম্ভব ছিল না—সে হিন্দু কি মুসলমান হোক।

২.

উচ্চতর বিদ্যাচর্চা, যার অংশ হিসেবে বিজ্ঞান, দর্শন ও ধর্মশাস্ত্র গভীরভাবে পঠন ও অনুশীলন চলে তা গ্রামসমাজের পক্ষে ধারণ লালন সম্ভব নয়, এটি সারা বিশ্বে নগরেই ঘটেছে এবং উচ্চতর বিদ্যাপীঠে। ইতালীয়, ইউরোপীয় এবং ইংলিশ রেনেসাঁসের ইতিহাসও এ সাক্ষ্যই দেয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় উত্পাদন ও বাণিজ্যিক কেন্দ্রগুলোর পরোক্ষ ভূমিকা বা পৃষ্ঠপোষকতার। মুসলিম ইতিহাসেও বাগদাদ বা কর্ডোভার মতো নগরীতেও ইতিহাস একই ধারাতেই চলেছে।

কলকাতা ইংরেজদের পত্তন করা নগরী এবং এখানেই গড়ে ওঠে যুগপত্ উচ্চতর বিদ্যাপীঠ এবং অর্থনৈতিক নবজোয়ারের কেন্দ্র। তা ছাড়া রাজধানী হিসেবে এ নগরই ক্ষমতার কেন্দ্র। এই ত্র্যহস্পর্শে তাই এখানেই ঊনবিংশ শতাব্দীতে একটি রেনেসাঁসের সূচনা হয়েছিল। কিন্তু তা সমগ্র বাংলায় ছড়াতে না পারার পেছনে দুটি প্রধান কারণ বলা যায়—কলকাতার মতো তখন জঙ্গম নগর আর ছিল না বাংলায়, যাওবা ছিল সেগুলো তো বিশাল গ্রামবাংলার তুলনায় নগণ্য, তদুপরি গ্রাম্যতার দ্বারা আবিষ্ট। দ্বিতীয়ত, বাংলার জনসংখ্যার প্রায় সমান অন্য অংশ মুসলমানের মধ্যে ঐতিহাসিক কারণেই ইংরেজের প্রভাব ঘটেছে পরে এবং একটু ভিন্নভাবে। আমরা দেখব প্রথম প্রজন্মের ইংরেজি শিক্ষিত ও ইংরেজি-প্রভাবিত এদেশি মুসলমান, যেমন নবাব আবদুল লতিফ বা সৈয়দ আমির আলী বাঙালি মুসলমানের ভাষা ও সংস্কৃতির প্রশ্নে বিভ্রান্ত ছিলেন। আর যখন খাঁটি বাঙালি মুসলিম পরিবারের উচ্চশিক্ষিত চিন্তাবিদেরা নিজ সমাজের মধ্যে যুক্তি ও জিজ্ঞাসার আলোড়ন তুলতে চাইলেন—তাও কলকাতার জাগরণের প্রায় শত বছর পরে—তারা টিকে থাকার ও লড়াই চালিয়ে যাওয়ার মতো সামাজিক সমর্থন পায়নি। মুসলিম সাহিত্যসমাজের উদ্যোগে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন হয় ১৯২৬ সালে, তখন থেকে ২০১৬ প্রায় ৯০ বছরের ব্যবধান। এ বিস্মৃত সময়ের মধ্যে দেশ, সমাজ ও সংস্কৃতিতে বিস্তর পরিবর্তন ঘটেছে, কিন্তু বলা যাবে না যে সমানতালে সমাজমানসেরও গুণগত পরিবর্তন হয়েছে।

যেকোনো পরিবর্তনের ভেতর-বাহির থাকে এবং ভেতরেরও ভেতর আরও ভেতর থাকতে পারে। বাইরের পরিবর্তনগুলো আমরা দেখতে পাই, প্রথমে এ পরিবর্তনেও বাধা আসে, কিছু সমাজ থেকে কিছু সংস্কারবংশ। কিন্তু প্রয়োজনে স্বাচ্ছন্দ্য ও অর্থনৈতিক বিবেচনায় মানুষ রুচি ও অভ্যাস পরিবর্তন করে। ধুতি-লুঙ্গি ছেড়ে প্যান্ট-শার্ট স্যুট পরা, নাপিতের ক্ষুরের পরিবর্তে ব্যক্তিগত রেজর ব্লেডের ব্যবহার, বাড়িতে টেবিলে বসে খাওয়ার প্রচলন, কঙ্কাল ঘেঁটে ডাক্তারিবিদ্যা পড়া, মেয়েদের বিদ্যালয়ে পঠনপাঠন এমনি অজস্র দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়।

এমন কিছু পরিবর্তনও এসেছে, যার সাথে মনকে অর্থাত্ ভেতরকে মানিয়ে নিতে হয়েছে। আগে মানুষ স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামের গলিতে বদ্ধ জীবনে অভ্যস্ত ছিল—সুনীতিকুমারের ভাষায় গ্রাম্যতায় আবদ্ধ জীবন। কিন্তু এবার একদল পড়তে গেল গ্রাম ছেড়ে কাছের সদরে, কেউ আরও দূরে বড় শহরে, অনেকেই মহানগরী কলকাতায়। একই ঘটনা চাকরির ক্ষেত্রেও ঘটল। দিনে দিনে এ সংখ্যা বেড়েছে এবং এদের ব্যাপ্তি উপমহাদেশব্যাপী ছড়াতে থাকল। পাটনা, রাঁচি, লক্ষেৗ, কাশী, ক্রমে কাছাড়, শিলচর, রেঙ্গুনে বাঙালি বসতি গড়ে উঠেছিল উল্লেখযোগ্য হারে। রামমোহন-দ্বারকানাথ ঠাকুর সমুদ্রযাত্রা করে ইউরোপে এবং পশ্চিমযাত্রীর পথও খুললেন। এভাবে বাঙালি জীবনের স্থবিরতা কেটে পরিসর ও গতি বাড়ল। তারও চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো স্বধর্মের ভিন্নভাষী, ভিন্ন আচার-রুচির মানুষের সঙ্গে যেমন তেমনি বিধর্মী, ভিন্নভাষী, ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের সঙ্গে পরিচয় হলো, মেলামেশার অভ্যাস হলো। বৈপরীত্য বৈচিত্র্যের মধ্যেও রুচিগত মিল, হার্দিক অন্তরঙ্গতার ঘটনাও বিরল থাকল না। তার মনোজগত্ পরিবর্তন গ্রহণে কিছুটা তৈরি হলো।

পশ্চিমে রেনেসাঁস-উত্তর দর্শনচর্চা বিশুদ্ধ ভাবনার স্বতঃস্ফূর্ততাকে বিজ্ঞান ও গাণিতিক সামঞ্জস্যের প্রতি দায়বদ্ধ করে তুলেছিল। নীতিদর্শন ও শ্রেয়োনীতিক ভাবনার নবায়ন ঘটল বিজ্ঞানের প্রত্যক্ষ অবদানের আলোকে। তাদের রেনেসাঁসের মূল অনুঘটক যে বিজ্ঞান তার জ্ঞান কার্যকারণের যুক্তি ও প্রমাণসাপেক্ষতার শর্তে এগিয়ে গেলেও তাকে প্রাণবন্ত রেখেছে বিজ্ঞানের দর্শন, এমনকি বিজ্ঞানের শিল্পরূপ ও নন্দনসহ মানবিক সংস্কৃতির প্রাসঙ্গিকতা।

ফলে বিজ্ঞানের প্রায়োগিক ও ব্যবহারিক যেসব উদ্ভাবনা ও প্রযুক্তি, কৃেকৗশল তা পশ্চিমের জন্য কোনো বিচ্ছিন্ন ভোগ্যপণ্যমাত্র নয়, জ্ঞানতাত্ত্বিক পরম্পরার উপজাত সম্পদ এবং তা একটি বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতাই বহন করছে। বড় কথা, যুক্তি ও বিশ্লেষণের দ্বারা তাদের মননক্রিয়া নির্দেশিত হবে, এটাই শিক্ষিত মানসের সংস্কৃতি হয়ে উঠল। ফলে সহজেই তাদের পক্ষে সমাজ ও রাষ্ট্রকে ন্যায়, সমতা, নাগরিক অধিকার সুরক্ষায় সময়োচিত পদক্ষেপ নিতে এবং আইনের শাসন ও মানবাধিকারের স্বীকৃতি দিয়ে সামাজিক রূপান্তর ও নবায়নে উদ্বুদ্ধ করল। তবে বহির্বিশ্বে, প্রধানত এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকায় তাদের বাণিজ্যিক আগ্রাসন ও ভূরাজনৈতিক স্বার্থ মিলিয়ে সাম্রাজ্যবাদী ভূমিকার কথাও আমরা ভুলব না। শেষোক্তরা রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘ছোট ইংরেজ’।

৩.

রবীন্দ্রবর্ণিত কালান্তরের বাহ্য পরিবর্তনগুলোর সঙ্গে মনোজগতের রূপান্তর সব সময় সমানতালে চলেনি, হয়তো সেটা স্বাভাবিক নয় বলেই চলেনি। রামমোহন বাঙালি হিন্দুর অসংখ্য দেবদেবীর বিগ্রহসংবলিত পূজা-অর্চনার পল্লবগ্রাহী ধর্মসংস্কৃতির নবায়ন করতে চাইলেন বৈদিক হিন্দুশাস্ত্রেরই আশ্রয় নিয়ে। কিন্তু আমবাঙালি হিন্দু তার ধর্মীয় সংস্কৃতি ছাড়তে পারেনি। বিদ্যাসাগর এক বিস্ময়কর ব্যতিক্রম, শাস্ত্রজ্ঞানে এবং পরিচ্ছদ, চলনে সনাতন হিন্দু পণ্ডিত, কিন্তু কর্মে, ভাবনায়, লেখায় নিজেকে সম্পূর্ণ নিয়োজিত করেছেন মানব—বিশেষত নারীর—এবং সমাজের কল্যাণ সাধনায়; পরকাল ও পূজা-অর্চনা সম্পর্কে ছিলেন বরাবর নীরব নিষ্ক্রিয়, যে কারণে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে একবার নাস্তিক আখ্যায়িত করেছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্রের সমাজভাবনায় পাশ্চাত্যের সেক্যুলার দর্শন ও শিক্ষার প্রভাব অস্পষ্ট নয়। কিন্তু বাংলা ভাষার অমর এই কথাশিল্পী জীবনদর্শনের দিক থেকে গোঁড়া হিন্দুই ছিলেন। আমরা জানি, রবীন্দ্রনাথ প্রাচীন ঔপনিবেশিক ভারত এবং দর্শনের অনুরক্ত ছিলেন, কিন্তু সেই সাথে তারুণ্যে একদিকে ছিল সর্বপ্রাণবাদের (pantheism) আর অন্যদিকে রোম্যান্টিক শিল্পবোধ ও উদার মানবতাবাদী চেতনার প্রভাব এবং সব মিলিয়ে তাঁর মতো অলোকসামান্য সৃজনপ্রতিভা তৈরি করেছিলেন নতুন মানবধর্মের বারতা। স্বামী বিবেকানন্দও ধর্মীয় সংকীর্ণতার গণ্ডি ভাঙতে চেয়েছিলেন উদার মানবতাবাদকে সামনে এনে। এ ছাড়া বাংলার লোকসমাজে হিন্দু-মুসলিম, বাউল-সহজিয়া, সুফিসাধনার সব ধারা থেকেই লালনের মতো সর্বকালে এমন সাধকেরা এসেছেন, যাঁরা ধর্মীয় গণ্ডি ও বিভেদের ঊর্ধ্বে মানবতার জয়গান গেয়েছেন—তাঁদের কোনো কোনো গোষ্ঠীর স্বতন্ত্র সম্প্রদায়, সমাজও আমাদের অজানা নয়। ইয়ং বেঙ্গলদের শাস্ত্রবিরোধী আচারপ্রথা ভাঙার বিদ্রোহ কিন্তু এ সমাজে ক্ষণিকের স্ফুলিঙ্গের মতোই জ্বলে উঠে নিভে গেছে, হয়তো কিছু বিচ্ছিন্ন গুণগ্রাহী সমঝদার রেখে গেছে। এক কালান্তর থেকে অন্য কালান্তরের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছাতে পৌঁছাতে তার জের ও রেশ ক্রমেই কমে এসেছে।

এর পেছনেও কারণ আছে। মুসলিম সমাজে যখন মনোজগতের জাগরণ ঘটছে তত দিনে এ দেশবাসীর মানসে দুটি বড় আকাঙ্ক্ষার জন্ম হয়েছে—প্রথমটি হলো আত্মপরিচয়ের সন্ধান ও প্রাচীন গৌরবের পুনরুজ্জীবন আর দ্বিতীয়টি হলো পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্ত হয়ে স্বরাজ ও স্বাধীনতা অর্জন। প্রথমটি ধর্মীয় পুনরুজ্জীবনবাদী চেতনা থেকে রক্ষণশীলতার বাতায়ন খুলে দিল আর দ্বিতীয়টি আধুনিক রাষ্ট্রগঠনের আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত করল। স্বরাজ ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় দুই সম্প্রদায়ের লক্ষ্য পৃথক হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু প্রথম প্রণোদনাই দুই সমাজের প্রধান প্রণোদনা হয়ে ওঠায় ক্রমেই তা হিন্দু ও মুসলমানদের স্বাতন্ত্র্যবাদী করে তুলেছিল। ফলে কালান্তরের যাত্রাপথ মসৃণ থাকল না এবং এ কারণেও কলকাতায় সূচিত রেনেসাঁস সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে পারল না।

তবে এই রেনেসাঁসের প্রভাবে একটি তৃতীয় ধারা যে তৈরি হয়নি তা নয়। এটি এল ইংরেজি শিক্ষিত রাজনীতিসচেতন নাগরিক গোষ্ঠী থেকে। এদের মধ্যে চিন্তাভাবনা-মানসিকতার দিক থেকে এক প্রান্তে বিপ্লবী চেতনা অন্য প্রান্তে রক্ষণশীল ধর্মীয় চেতনার প্রভাবসহ মধ্যবর্তী নানা প্রবণতা দেখা যায়। মোটাদাগে একে কি আমরা বলতে পারি ভিক্টোরীয় মানসিকতা? এ রকম মানুষ সাধারণত প্রথানুসারী নির্বিবাদী আর এই মানসিকতার জেরে এরা মতপার্থক্য, এমনকি জীবনাচরণে কিছু পার্থক্য সত্ত্বেও পাশাপাশি জীবনযাপন করতে পারে। এরা পরমতসহিষ্ণু গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনের উপযোগী ছিল এবং পরবর্তী বিভিন্ন গণতান্ত্রিক ও নাগরিক আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকাও রেখেছে।

ভেতর থেকে সামাজিক ঐক্য, মতামতের ঐক্য গড়ে উঠল কি না তা নিয়ে সংশয় থাকল, এবং অনেক প্রশ্ন, ইস্যু, সংকটের নিষ্পত্তি ছাড়াই ইতিহাস তার নিজস্ব গতিতে এগিয়ে চলেছে। দাঙ্গা, দুর্ভিক্ষ, দেশভাগ এসবের জবাব দিতে পারেনি। ভেতরের প্রস্তুতিতে, তথা কালান্তরের দর্শন উপলব্ধিতে যে দুর্বলতা ছিল তা স্পষ্ট হয় পরবর্তী ঘটনাবলিতে।

ভাষা আন্দোলন ও এরপরের গণতান্ত্রিক সংগ্রাম এবং সাংস্কৃতিক ও নাগরিক কার্যক্রমের ফলেই ঘটল অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ, বঙ্গবন্ধুর উত্থান, মুক্তিযুদ্ধ এবং এসবের ফসল হিসেবে এল স্বাধীন বাংলাদেশ। তার যাত্রাপথ মসৃণ হয়নি, প্রত্যাঘাত এসেছে দ্রুত, দেখা গেল সেই প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে আমাদের রাষ্ট্রের মূলনীতি, সমাজ ও রাজনীতির মূলধারা—অন্তত সে হিসেবে যা গণ্য হয়ে এসেছে—কার্যকর প্রতিরোধ দাঁড় করাতে পারেনি। এমনকি একপর্যায়ে ভাষা ও সাংস্কৃতিক অর্জন নিয়ে আমাদের গৌরববোধও আবেগ ও উচ্ছ্বাসের নানা বহিঃপ্রকাশেই সীমিত হয়ে পড়ছে। কার্যত জাতি যেন চলেছে ভিন্ন ধারায়।

৪.

গত শতাব্দীর ষাটের দশক থেকেই পশ্চিমা বিশ্ব উপলব্ধি করছিল সমাজজীবনে গুণগত পরিবর্তনের আলামত। ওই দশকেই মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী ড্যানিয়েল বেল লিখলেন বিখ্যাত গবেষণাগ্রন্থ দ্য এ-অব আইডিওলজি। পুঁজিবাদ, পণ্যবিপ্লব ও ভোগবাদের বিস্তার ঘটতে শুরু করেছে তখন এবং এর প্রভাব মানুষ অনুভব করতে শুরু করেছে। ব্রিটিশ গণিতজ্ঞ ও দার্শনিক আলফ্রেড নর্থ হোয়াইটহেড এরও আগে সাবধানবাণী উচ্চারণ করে বললেন, মানুষ বস্তুনিষ্ঠ ও নৈর্ব্যক্তিক হতে গিয়ে তার আত্মগত (subjective) হওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। একে এক অর্থে, বা নতুন ব্যঞ্জনায় বলতে পারি, মানুষের আত্মহারা হয়ে পড়া! টি এস এলিয়ট কবিতার শিরোনাম দেন ফাঁপা মানুষ Hollowman কিংবা পতিত জমি বা Waste Land. যেখানে তিনি বলেন—

What are the roots that clutch, what branches grow

Out of this stony rubbish? Son of man,

You cannot say or guess, for you know only

A heap of broken images, where the sun beats

And the dead tree gives no shelter, the cricket no relief,

And the dry stone no sound of water.

The Waste Land part-1

বাংলাদেশ বা তৃতীয় বিশ্বের দেশে দেশে তখনো এ ধরনের বস্তুতান্ত্রিকতার সংকট দেখা দেয়নি, বরং তখনো প্রধানত কৃষি ও প্রকৃতিনির্ভর এই সমাজগুলোয় আদর্শবাদ, ভাববাদের রমরমা চলছে। বরং তখন দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদও চর্চা হয়েছে রোমান্টিক আদর্শবাদের মতোই। সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন তখনো এসব দেশের ছাত্রতরুণ ও সাধারণজনের বড় একটি অংশকে আত্মত্যাগের ভাবাদর্শিক রাজনীতিতে দেশ গঠনে অনুপ্রাণিত করেছে।

কিন্তু আশির দশকের পর থেকে এ রকম অধিকাংশ দেশেও প্রচলিত মূলধারার রাজনীতি ক্ষমতার একচ্ছত্র প্রতাপের সঙ্গে আর এঁটে উঠতে পারছিল না। ক্ষমতা ও অর্থ গাঁটছাড়া বেঁধেছে তত দিনে, আর রাজনীতিতে আদর্শ ও দর্শনকে সাইনবোর্ড-মাত্র বানিয়ে অপরাধ ও দুর্নীতিকে ঠাঁই করে দেওয়া হলো। রাজনীতিতে আগেও আদর্শ হিসেবে ধর্মের বুলি কপচানোর প্রচলন ছিল, এখন আরও তুখোড়, ব্যাপক, বহুমাত্রিক হলো তার ব্যবহার।

সোভিয়েত এবং সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের পতনের সূত্র ধরে দ্রুতই উন্নয়নশীল বিশ্বের আদর্শিক রাজনীতি, বিশেষত সমাজতান্ত্রিক আদর্শের প্রতিরোধ, ভেঙে পড়ল। এই পরিবর্তন এবং আরও কয়েকটি কারণে আমরা এবার যে কালান্তরের মুখোমুখি হয়েছি তা মূলত বৈশ্বিক, যদিও একটি দেশজ রূপও তার রয়েছে।

৫.

ইতিমধ্যে পশ্চিমের প্রতিস্পর্ধী জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন ভেঙে গেল, ন্যাটো বহাল থাকলেও ওয়ারশ চুক্তি বাতিল হয়ে গেল, আরব লিগ, আফ্রিকান ঐক্য সংস্থা কার্যকারিতা হারাল, এমনকি জাতিসংঘও ভারসাম্য হারাল। পশ্চিম বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি এবং ডব্লিউটিও বা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা প্রভৃতির মাধ্যমে বিশ্ব অর্থনীতি ও বিশ্ববাজারের আধিপত্য ধরে রাখল। দেশে দেশে উন্নয়নের অসমতার মধ্যে বাজারের উন্মুক্ত প্রতিযোগিতায় শক্তিমান অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ ও কৌশল কার্যকর হবে সেটা জানা কথা। কিন্তু বাজার অর্থনীতিই বিশ্বায়নের মূল চাবিকাঠি হলো, জ্ঞানের ও আলোকনের সুবিধাগুলো প্রাপ্তির ক্ষেত্রে নয়। বরং সেসব ক্ষেত্রে স্বত্বাধিকারের শর্তগুলো কঠোর করার ফলে বৈষম্য বেড়ে গেল।

বিজ্ঞানের অবদান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে কৃষি উত্পাদনে এ সময় বৈপ্লবিক রূপান্তর ঘটেছে—যেমন পরিমাণে তেমনি বৈচিত্র্যে। তার প্রসাদ আমাদের মতো কৃষিপ্রধান দেশে ভালোভাবেই আমরা পাচ্ছি। জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও উন্নতির প্রভাব পড়েছে—স্বাস্থ্য, খাদ্য, শিক্ষা, পরিচ্ছদ, দারিদ্র্যবিমোচন ইত্যাদির বিভিন্ন সূচকে তাত্পর্যপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিও অপার সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে, এর অপপ্রয়োগ বা ব্যবহারের বিপদ মাথায় রেখেও ইতিবাচক দিকটিতেই জোর দেওয়া যায়। এ কেবল ব্যক্তির দক্ষতা ও সচ্ছলতার সম্ভাবনাই বাড়াল না, বিশ্বের এবং বিশ্বজ্ঞানের সঙ্গে তার সংযুক্তি ও অন্তর্ভুক্তির সুযোগ তৈরি করল।

বিশ্বায়নের এই পথ ধরেই আমরা দেখছি ইংরেজি ভাষার বিশ্বযাত্রা চলছে অবাধে, অপ্রতিহত গতিতে। ইংরেজি বলয়বহির্ভূত উন্নত বিশ্ব, বিশেষত ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, যারা এতকাল ধরে স্ব স্ব সাংস্কৃতিক জাতীয়তার গৌরববোধ থেকে ইংরেজি ভাষা প্রতিরোধ করে এসেছিল তারাও এখন ইংরেজি শিখছে। এশিয়ার শক্তিশালী অর্থনীতি এবং স্বকীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি নিয়ে স্বাতন্ত্র্যবাদী গর্বিত চীন-জাপানও ক্রমে ইংরেজির দরজা খুলে দিচ্ছে। বহুভাষার দেশ, সমৃদ্ধ সভ্যতা ও বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের এক বিরল সংস্কৃতিসমৃদ্ধ দেশ ভারতের উচ্চশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর প্রধান ভাষাই আজ ইংরেজি—রাষ্ট্রভাষা হিন্দি বা স্ব স্ব রাজ্যভাষা নয়। আমাদের দেশে প্রায় হুজুগের মতো এসেছে এই প্রভাব, ঢাকা-চট্টগ্রাম শহরে নতুন প্রজন্মের বড় অংশ মাতৃভাষায় দুর্বল, অনেকে তাতে ভাব প্রকাশে অক্ষম থেকেই বেড়ে উঠছে।

পৃথিবীতে এখনো হতদরিদ্র মানুষ প্রচুর, খাদ্যাভাব ও অপুষ্টিতে ভুগছে অনেক মানুষ, নানা স্থানে বিশুদ্ধ পানীয় জলের অভাবও প্রকট, নানা রোগ-বিপর্যয় চলছেই, বেকারত্ব বাড়ছে এবং সারা বিশ্বে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান বেড়েই চলেছে। পশ্চিমের অর্থনীতিতে অস্ত্র ব্যবসায়ের বড় ভূমিকা থাকায় বিশ্বশান্তি তো হুমকিতে থাকছেই, আঞ্চলিক যুদ্ধবিগ্রহও বন্ধ হবে না। বিশ্ব ও বিশ্ববাসীর জন্য আরও সমস্যার আলামতও আমরা দেখছি। সে আলোচনার মাধ্যমে এ নিবন্ধের উপসংহার টানার আগে তার মুখবন্ধটুকু বলে নিই।

৬.

এ বছর রবীন্দ্রনাথের তিরোধানের পঁচাত্তর বছর পূর্ণ হচ্ছে। জীবনের শেষ জন্মদিনে শেষ ভাষণের শিরোনাম দিয়েছিলেন কবি ‘সভ্যতার সংকট’। তাতে তিনি পশ্চিমের সভ্যতার ওপর আস্থা হারানোর কথা বলেছিলেন। কবি লিখেছেন, ‘মানবপীড়নের মহামারী পাশ্চাত্য সভ্যতার মজ্জার ভিতর থেকে জাগ্রত হয়ে উঠে আজ মানবাত্মার অপমানে দিগন্ত থেকে দিগন্ত পর্যন্ত বাতাস কলুষিত করে দিয়েছে।’

আজ কি আমরা তার চূড়ান্ত রূপ দেখছি? কবির প্রত্যাশা অনুযায়ী সত্যিই কি পুব থেকে এ সংকট থেকে উত্তরণের নতুন সূর্য উদিত হতে যাচ্ছে? তার কোনো আলামত কি দেখা যায়?

বাস্তবতা বলছে এখনো সারা বিশ্বে পশ্চিমের প্রভাব—কি মানুষের বাস্তব জীবনে কি চিন্তার জগতে—যথেষ্ট বেগবান এবং প্রায় অপ্রতিহত। রোমান্টিক সাহিত্য বা দর্শন যেভাবে আদর্শ ও আদর্শবাদকে প্রণোদিত করেছিল তা রোমান্টিক উত্তর আধুনিক ও উত্তরাধুনিক সাহিত্য ও দর্শন করতে পারে না। কারণ সব ধরনের আদর্শবাদেরই একটি সামূহিক আবরণসদৃশ ভূমিকা আছে, যার নিচে ঢাকা পড়ে যায় অনেক মানবিক জাগতিক দুর্বলতা, অন্যায় ব্যর্থতা দ্বন্দ্ব, অনেক প্রশ্ন থেকে যায় উপেক্ষিত, অমীমাংসিত। আধুনিক কবি-সাহিত্যিক-দার্শনিক এই দুর্বলতা উড়িয়ে দিতে চেয়েছেন জীবনের সব সত্যকে বাস্তবের আলোয় টেনে এনে, মুখোশ খুলে দিয়ে নগ্ন করে, সব বাস্তবতা ও সব রকম সম্ভাবনার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, খুঁটিয়ে যাচাই করে। তার হাতে বিশুদ্ধ বিজ্ঞান মনোবিজ্ঞান সমাজবিজ্ঞানের নানা আয়ুধের ব্যবহার হয়েছে। মানুষের ঘাটতি, সংকটগুলো তারা জানে এবং এ নিয়ে কোনো অনুযোগ করে না, কোনো কৈফিয়তও খাড়া করে না। আমাদের পরিচিত সনাতন আদর্শবাদের কোনো সযোগ এখানে নেই।

এই বাস্তবতায় পৌঁছানোর কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক পুঁজি আমাদের তেমনভাবে ছিল না। আমাদের শিক্ষা বিজ্ঞানের দর্শন এবং নন্দনকে আত্মস্থ করার কোনো পথ তৈরি করেনি, যুক্তি ও বিশ্লেষণের দক্ষতা সৃষ্টি করেনি, এমনকি বিশুদ্ধ জ্ঞান ও জ্ঞানচর্চার কোনো চাহিদাও তৈরি করতে পারেনি। সমাজ, শিক্ষিত সমাজও, জ্ঞানের মুক্ত অসীমতা সম্পর্কে অচেতন। রবীন্দ্রনাথ পশ্চিমের ক্ষেত্রে যাকে ব্যক্তিগত মোহ থেকে নির্মুক্ত বিশুদ্ধ জ্ঞানের সাধনায় অর্জিত জ্ঞানের জগত্ আখ্যা দিয়ে প্রশংসিত করেছিলেন আমরা তা সৃষ্টি করতে পারিনি, তার মূল্য উপলব্ধি করিনি। আর তাতে জ্ঞান ও ডিগ্রি, জ্ঞানী ও শিক্ষক, সাহিত্য ও দর্শন, শিল্পকলা ও সংস্কৃতির মধ্যে গুলিয়ে ফেলেছি।

আর তাই আমরা যেন রবীন্দ্রকথিত ‘সত্যসন্ধানের সততা’ প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি। পশ্চিম তার আগ্রাসী অর্থনীতি ও ভূরাজনীতি চালিয়ে যাচ্ছে, পাশাপাশি জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞানসৃষ্টির অসীম মুক্ত বাতাবরণ অন্তত একাডেমিয়াতে চালু রেখেছে জোরালোভাবে এবং সেই সূত্রে আলোকিত সমাজের নাগালের মধ্যে তার সুফলপ্রাপ্তি নিশ্চিত রেখেছে।

এই বাস্তবতায় সাধারণ মানুষের ভাবাদর্শের ঝোঁক প্রকটভাবে প্রকাশ পাচ্ছে ধর্মীয় রক্ষণশীলতার মধ্যে। এ প্রবণতা দেখা যাচ্ছে উন্নত-উন্নয়নশীল নির্বিশেষে সারা বিশ্বে, সব ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মধ্যে। বলা যায়, আজ ধর্মীয় রক্ষণশীল আদর্শবাদের বিশ্বায়ন হয়েছে। আর খুব চাপে পড়েছে যে মুসলিম সমাজ তারা তৈরি করছে ইসলামের এক জঙ্গি আত্মঘাতী রূপ। তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমাদের দুর্বল গণতন্ত্র পুনরায় কর্তৃত্ববাদী শাসনের দিকে ফিরে যাচ্ছে। আমাদের বহুকালের উদার মানবতাবাদী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য শক্ত প্রতিপক্ষের সর্বাত্মক প্রতিরোধের মুখে পড়েছে।

৭.

এখন বুঝতে হবে ইংরেজি ভাষার আধিপত্য, ভোগবিলাসের অবারিত সুযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি ও বৈদ্যুতিক গণমাধ্যমের ব্যাপক বিস্তার চললেও বিশ্বায়নের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ প্রভাব মিলে আমরা যে কালান্তরের নতুন বাস্তবতায় পৌঁছেছি তা অস্বীকার করা যাবে না। প্রশ্নটা হলো, এর সাথে আমাদের বাঙালিত্ব, সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের সমন্বয় হবে কীভাবে?

এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া জরুরি, কিন্তু উত্তর নিশ্চয় সহজ নয়, আর উত্তর পেলেও, গন্তব্যে তাড়াতাড়ি পৌঁছানোর সংক্ষিপ্ত কোনো পথ থাকবে না। খসড়াভাবে, উচ্চকিত চিন্তার আকারে, হয়তো কিছু কথা বলা যায়।

আগামী প্রজন্মকে হতে হবে দ্বিভাষী, মাতৃভাষাকে জলাঞ্জলি দিয়ে ইংরেজি নয়, বাংলা-ইংরেজি দুভাষাতেই দক্ষ হতে হবে। কারণ মাতৃভাষা হলো নিজ সংস্কৃতির অন্দরের বাসিন্দা হওয়ার প্রবেশপথ, আর সংস্কৃতিচর্চা ও সাংস্কৃতিক বিকাশের মূল হাতিয়ার। এর অভাব ঘটলে আমরা এক ভয়াবহ পরিণতির সম্মুখীন হব—আগামী প্রজন্ম হয়ে পড়বে সাংস্কৃতিক উদ্বাস্তু, cultural refugee। তাদের মোহমুক্ত বিশুদ্ধ জ্ঞানচর্চার মতো যুক্তি ও ব্যাখ্যার সামর্থ্য অর্জন করতে হবে, যাতে সহায়ক হবে গণিত ও বিজ্ঞানচর্চা। সেই সঙ্গে প্রযুক্তি ও কৃেকৗশলের সঙে এবং এসবের দর্শন ও নন্দনের সঙ্গেও সম্যক পরিচয় থাকতে হবে। নতুন প্রজন্মের সামনে খোলা থাকবে বিশ্বনাগরিক হওয়ার সুযোগ—বিদেশে পাড়ি না দিয়েও দেশে বসে তা হওয়া ও থাকা যাবে।

আর বিশ্বকে একযোগে কাজ করার উপলক্ষ তৈরি করে দেবে জলবায়ু পরিবর্তনের অনিবার্যতা, যার প্রবল কড়া নাড়ার প্রতি কারও পক্ষেই আর বধির থাকা সম্ভব নয়। ধর্মীয় রক্ষণশীলতা ও জঙ্গিবাদ যে সংঘাত সৃষ্টি করছে তা হয়তো সত্যিই সভ্যতার সংঘাত নয়—তা থেকে মুক্ত হওয়ার দিকে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতের বৈশ্বিকতা কি বিশ্ববাসীর জন্য কোনো অমোঘ সমাধানের পথ সৃষ্টি করে দেবে?

এ নিয়ে আগাম পূর্বাভাস দেওয়া আমার কাজ নয়। বিজ্ঞানী মার্টিন রিজ একবিংশ শতাব্দীকে আখ্যায়িত করেছেন আমাদের চূড়ান্ত শতক হিসেবে। তাঁর বইটির নামই Our Final Century। তাঁর মতে, পৃথিবীতে যেসব প্রজাতি নিজেদের মধ্যে হানাহানি করেছে তারা শেষ পর্যন্ত নির্বংশ হয়েছে। মানুষ সেই দিকেই ধাবিত হচ্ছে—রিজ এমনটাই মনে করেন। তাহলে চূড়ান্ত প্রশ্নটা হলো, মানুষ কি সংঘাতকে জবাব দিয়ে বিশ্বে সম্প্রীতির বাতাবরণ সৃষ্টি করতে পারবে যাতে বৈষম্য, আগ্রাসন বন্ধ হবে? সেই ক্ষেত্রে দুটি কথা মনে হয়। জবাব কে দেবে? মানুষই তো। কোন মানুষ? নিশ্চয় নতুন যুগের নতুন মানুষ। আর সেখানেই আমি দেখতে পাই পুবের, আমাদের, সম্ভাবনা বা সম্ভাবনার সম্ভাবনা। আমাদের দেশের জনসংখ্যার ৪০ ভাগ অর্থাত্ প্রায় ৬ কোটির বেশি নবীন প্রজন্মের ছেলেমেয়ে। উপমহাদেশে এ সংখ্যা ৫০ কোটির মতো হবে। আর এশিয়ায়? নিশ্চয় শতকোটির ওপরে হবে। বর্তমান সমাজে তরুণেরা সক্রিয় সরব হয়ে উঠেছে, তরুণ প্রাণ নিশ্চয় নিশ্চেষ্ট নয়, তারা বিশ্বের নানা সূত্র থেকে রসদ আহরণ করছে, এবং আমরা তাদের মধ্যে এই সঞ্চিত সম্পদের বিচিত্ররূপে অঙ্কুরিত বিকশিত হওয়ার অপেক্ষায় থাকতে পারি।

আমরা জানি, আহরণ ও সঞ্চয়ন যতটা সহজ তা কাজে লাগিয়ে অঙ্কুরিত বিকশিত করা ততটাই কঠিন। পথ রোধ করে দাঁড়ায় অন্তরে স্থাবর হয়ে ওঠা নানা সংস্কারের আবরণ আর অচলায়তন। সে নিশ্ছিদ্র নিশ্চেষ্ট দেয়ালে জানালা কাটতে পারে নতুন দর্শনের তাজা হাওয়া—অতীতে তা কখনো এসেছে ধর্মের রথে চেপে, কখনো বিজ্ঞানের, কখনো শিল্প-সাহিত্য-ধর্ম-বিজ্ঞানের সমন্বয়ে রেনেসাঁসের প্রবল জোয়ারে ভেসে। কালে কালে ধর্ম নানা গোঁড়ামি ও সংকীর্ণতার ফাঁদে অধর্ম হয়ে উঠছে, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির চমকপ্রদ সাফল্যের নিচে চাপা পড়ে মানুষের ভোগ ও বস্তুগত জয়ে ব্যবহূত হচ্ছে, শিল্পকলা বিচ্ছিন্নতার কবলে পড়ছে। নতুন দর্শন চাই, অন্তত নতুন দার্শনিক ব্যাখ্যা—যা হবে এই বর্তমান ও তাকে ঘিরে যে সংকটের কালো মেঘ ঘনায়মান তাকে উড়িয়ে দেওয়ার মতো জোরালো হাতিয়ার। আর তারই সহায়তায় কালান্তরের নতুন বাঙালি তৈরি হবে নতুন প্রজন্ম থেকে।

রবীন্দ্র-তিরোধানের পঁচাত্তর বছর পরে পূর্বদিগন্ত থেকে সেই দর্শনের গভীর মর্মস্পর্শী চিত্ত-আলোড়নকারী ধ্বনি কি শুনব আমরা যা সম্প্রদায়ের নয় মানুষের ধর্মকে উজ্জীবিত করবে? ক্ষুদ্র স্বার্থ ও সংকীর্ণ চিন্তার সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কল্যাণের বাণী ধ্বনিত করবে?

‘মনুষ্যত্বের অন্তহীন প্রতিকারহীন পরাভবকে’ রবীন্দ্রনাথ মানতে পারেননি। এমন পরিণতিতে বিশ্বাস স্থাপনকে অপরাধ জ্ঞান করেছেন। তাহলে রবীন্দ্রনাথের কথা ধরেই বলা যায় উন্নত বিশ্ব মানুষের শক্তিরূপ দেখিয়েছে, এবার আমাদের পালা, দেখাতে হবে মানুষের মুক্তিরূপ, যে মানুষ জানবে কর্মত্যাগী বৈরাগ্যে মুক্তি নয়, অসংখ্য বন্ধনের আনন্দের মধ্যেই মেলে মহানন্দময় মুক্তির স্বাদ, যে জানবে ‘সেই মুক্তি বৈরাগ্যের মুক্তি নয়, সেই মুক্তি প্রেমের মুক্তি। ত্যাগের মুক্তি নয়, যোগের মুক্তি। লয়ের মুক্তি নয়, প্রকাশের মুক্তি।’