ঢাকায় বাংলাদেশি নবীন এবং শিক্ষিতদের মধ্যে অভিবাসন আকাঙ্ক্ষা

সারসংক্ষেপ

বর্তমানে, পূর্বের যেকোনো সময়ের তুলনায় অধিক মানুষের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য তাদের জন্মস্থানের পরিবর্তে অন্য কোনো স্থান। এই প্রবণতা ‘বৈশ্বিক দক্ষিণে’ বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয়। ঢাকার শিক্ষিত (নিম্ন) মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটি উদাহরণ অনুসরণ করে এই প্রবন্ধে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে যে অনেক ‘সম্ভাব্য অভিবাসীর’ জন্য, নিজের জন্মভূমি ত্যাগের ব্যাকুলতা আন্তর্জাতিক অভিবাসনের মূল কারণ নয়; বরং তা হতাশা এবং অসম্পৃক্ততার একটি রূপকবিশেষ। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, দ্রুত নগরায়ণ এবং শিক্ষায় ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগ; উদীয়মান শহুরে (নিম্ন) মধ্যবিত্ত নবীনদের মধ্যে নতুন ‘আধুনিক’ জীবনাচরণের আকাঙ্ক্ষার জন্ম দিয়েছে। কিন্তু এই আকাঙ্ক্ষা তাদের নিজেদের দেশে পূরণ করা সম্ভব হয় না। এর ফলে বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের একধরনের অসম্পৃক্ততার অনুভূতির জন্ম হয়। সাংস্কৃতিক আবহে নির্মিত বৈদেশিক স্থানসমূহের কল্পনা কীভাবে স্থানীয় জীবনের ব্যক্তিগত (পুনঃ) মূল্যায়নের সঙ্গে সম্পর্কিত, তা এই প্রবন্ধের বিশেষ মনোযোগের বিষয়। প্রায় সব তথ্যদাতাই স্থানীয় আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক এবং অস্তিত্বের নিরাপত্তাহীনতা কীভাবে তাদের ‘নিরাপদ’ স্থানের জন্য প্রলুব্ধ করেছে তা ব্যাখ্যা করেছেন। তারা বিশ্বাস করেন সেখানে তাদের স্বপ্ন পূরণ হতে পারে।

মুখ্য শব্দগুচ্ছ

বাংলাদেশ, অভিবাসন আকাঙ্ক্ষা, মধ্যবিত্ত শ্রেণি, নবীন, নিরাপত্তাহীনতা, নাগরিক (অ) সম্পৃক্ততা।

ভূমিকা

২০১০ সালের মার্চের এক সন্ধ্যায় আমার বন্ধু সুবর্ণা এবং আমি ঢাকায় নবনির্মিত উপশহর খিলক্ষেতে যাওয়ার জন্য একটি সিএনজি অটোরিকশা ভাড়া করি। কয়েক বছর আগে পর্যন্ত এই জায়গাগুলো ধানখেত ছিল। এখন এই এলাকা জনবহুল, যেখানে বস্তি, ঘর, অফিস, রাস্তার পাশের দোকান এবং ছোট ছোট রেস্টুরেন্ট মিলে একটি নতুন পরিবেশ তৈরি করেছে। প্রধান সড়ক ছাড়িয়ে একটি জনবহুল বাজারের মধ্য দিয়ে আমরা আরও তিন কিলোমিটার পথ অতিক্রম করলাম। রাস্তাটিতে কাদার ছড়াছড়ি এবং সরু ছিল। এরপর আমরা ১৫তলাবিশিষ্ট প্রায় আটটি অ্যাপার্টমেন্টের একটি আবাসিক এলাকায় প্রবেশ করলাম। ওইখানে আমরা একজন অবসরপ্রাপ্ত এনজিও কর্মকর্তা সাঙমার সাক্ষাত্কার নিতে গিয়েছিলাম। যখন আমরা বসলাম, তখন আমাদের সঙ্গে এসে যোগ দিলেন সাঙমার ১৮ বছর বয়সী ছেলে জন। তিনি হঠাত্ যুক্তরাষ্ট্রে একটি আইভি লিগ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির স্বপ্নের কথা আমাদের জানালেন। যেহেতু জন ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন, তাই তিনি ইংরেজি বলছিলেন বেশ দক্ষভাবে। তার বাবার উপস্থিতিতে, জন অভিযোগ করলেন যে, কেউ তার স্বপ্নকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। এই স্বপ্নে অটুট থাকা কতটা কঠিন, তা তিনি আমাদের বলেছিলেন। জন তাকে উত্সাহিত না করায় তাঁর বিদ্যালয় এবং মা-বাবার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন। কিছুক্ষণ পর জন কেন বাংলাদেশ ছাড়তে দৃঢ়ভাবে ইচ্ছুক, তার কারণ আমাদের সামনে উপস্থাপন করলেন। ‘চারপাশে তাকিয়ে দেখুন, পরিবেশটা কী স্যাঁতসেঁতে’, তিনি নালিশ করলেন।

জন মনে করেন এই দেশে উন্নতি করা সম্ভব না। যখন আমি জনকে প্রশ্ন করলাম যে অনেক লোক বাংলাদেশ ত্যাগের স্বপ্ন দেখছে, এ কথাটি অতিকথন কি না; তখন জন উত্তর দিলেন, ‘আমাদের এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করার প্রয়োজন নেই, এটি সহজবোধ্য একটি বিষয়, এটি সবাই জানে।’ তখন আমাদের আলোচনা অন্যদিকে মোড় নিল। বাবা ও ছেলে দেশপ্রেম নিয়ে তর্কে জড়িয়ে পড়লেন। সাঙমা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, যার জন্য তিনি সম্প্রতি একটি ক্রেস্ট পেয়েছেন। সে সময়ে তাঁর বয়স ছিল প্রায় ২১ বছর এবং তিনি দেশের জন্য যুদ্ধ করতে প্রস্তুত ছিলেন। তিনি জোর দিয়ে বললেন যে দেশের জন্য ভালো কিছু করা, দেশপ্রেম, এখনো প্রাসঙ্গিক; কিন্তু বর্তমানে দেশের প্রধান শত্রু দারিদ্র। তাঁর ছেলের দেশপ্রেম তুলনামূলক কম। সে তাঁর মেধাকে ব্যবহার করতে তৈরি, তবে দেশের জন্য প্রাণ দেওয়ার কোনো ইচ্ছা তাঁর নেই।১

আমার সাদা চামড়া হয়তো জনকে তার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল, তবে এই আকাঙ্ক্ষার পেছনে অন্য কারণও কাজ করেছে। তার স্বপ্নগুলো দৃঢ় এবং কোনো অর্থেই অদ্ভুত কোনো বিষয় নয় (এমনকি এটাকে সাধারণ বিষয় হিসেবে গণ্য করা হয়)। এমনটা বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা এবং বিশ্বময় অনেক নবীনেরই (এবং ততটা নবীন না হলেও) স্বপ্ন। অর্থ উপার্জন, সুযোগ বৃদ্ধি বা একটি পেশায় স্থায়ী হওয়ার জন্য ‘বৈশ্বিক দক্ষিণ’, পূর্ব ইউরোপ এবং অন্য আরও অনেক স্থানে ভবিষ্যত্ গড়ে তোলার জন্য মানুষেরা তাদের নিজেদের দেশ ত্যাগের স্বপ্ন দেখছে। ১৯৯৬ সালে আপ্পাদুরাই উল্লেখ করেন, ‘অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন অনেক বেশি মানুষ নিয়মিতভাবে কল্পনা করে যে তারা বা তাদের সন্তানেরা যে দেশে জন্মগ্রহণ করেছে, সে দেশের পরিবর্তে অন্য দেশে বাস করবে এবং কাজ করবে’ (১৯৯৬, পৃ. ৬)। একটি সাম্প্রতিক গ্যালাপ জরিপে দেখা গিয়েছে, প্রায় ৭০০ মিলিয়ন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ অন্য দেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের ইচ্ছা পোষণ করে (আইসিপোভা এবং অন্যান্য, ২০১০-২০১১)।২ অন্য কথায়, অসংখ্য মানুষের কল্পিত এবং বাস্তব গন্তব্য তাদের জন্মভূমির পরিবর্তে অন্য স্থান। সাম্প্রতিক বিশ্বায়ন আমরা কোথায় এবং কার সঙ্গে সম্পৃক্ত, সে ধারণারই পরিবর্তন সাধন করেনি; একই সঙ্গে আমরা কোথায় যেতে চাই, সেটাও বদলে দিয়েছে।

দুই দশক বা এ রকম সময় ধরেই অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা অভিবাসন আকাঙ্ক্ষার অর্থনৈতিক প্রভাবের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক-সাংস্কৃতিক দিকটি ক্রমাগতভাবে তুলে ধরছেন (যেমন- ক্যানডেল এবং মেসি, ২০০২; ব্যাস, ২০০৯; রুডনিক, ২০০৯)। তারা (উচ্চাকাঙ্ক্ষী) অভিবাসীদের (এককভাবে) শুধু বিচক্ষণ অর্থনৈতিক কর্মক হিসেবে এখন আর বিবেচনা করছেন না, যারা পুস-ফ্যাক্টরগুলোর (যেমন- দারিদ্র্য ও বেকারত্ব) এবং পুল-ফ্যাক্টরগুলোর (উচ্চ বেতন এবং চাকরির প্রাপ্যতা) প্রতি সাড়া দেয়। এখন বিশেষজ্ঞরা অভিবাসন করতে মানুষের প্রণোদনা ও সক্ষমতার জটিলতা এবং বৈচিত্র্যের বিষয়গুলোও তুলে ধরছেন। সর্বোপরি, অর্থনৈতিক বৈষম্য, বেতনের অসমতা, কর্মসংস্থানের সুযোগ এবং ‘সামাজিক কল্যাণ’-এর পার্থক্য (দেখুন, ক্যাসলু, ২০০০: পৃ. ২৭২) (উচ্চাকাঙ্ক্ষী) অভিবাসনের সবচেয়ে সুস্পষ্ট কারণ হতে পারে; কিন্তু এই বিষয়গুলো সবার জন্য এবং সবখানে একই মাত্রায় কাজ করে না। অন্যদিকে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির উচ্চহার অভিবাসনের হারকে বৃদ্ধি করে, এ রকমটাও দাবি করা যায় না। প্রতিটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্রই অভিবাসন-ইচ্ছুকদের রাষ্ট্র নয় এবং উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোর সব নাগরিকও অভিবাসন করতে ইচ্ছুক নয় (দেখুন, উল্লাহ, ২০১০: পৃ. ৮)।

কয়েকজন অভিবাসন বিশেষজ্ঞ অভিবাসন আকাঙ্ক্ষার সাংস্কৃতিক নির্মাণের বিষয়টির ওপর বিশেষভাবে দৃষ্টি দিয়েছেন। তাঁদের গবেষণার মূল বিষয়গুলো হলো: ‘অভিবাসনের সংস্কৃতি’ (যেমন- ম্যাসেই এবং অন্যান্য, ১৯৯৩; আলী, ২০০৭; হরভ্যাত, ২০০৮; জনসন, ২০০৮), আন্তদেশীয় অভিবাসন এবং স্থানীয় কল্পনায় বিদেশকে উপস্থাপনের মধ্যে সম্পর্ক (যেমন- গার্ডেনার, ১৯৯৩, ২০০৮; জেইটলিন, ২০১২), বা অভিবাসন আকাঙ্ক্ষা এবং তার বাস্তবায়নের মধ্যে ব্যবধান (যেমন- কার্লিং, ২০০২)।

যা হোক, সবগুলো পন্থাই অভিবাসন আকাঙ্ক্ষাকে এখনো (আন্তদেশীয়) অভিবাসনের একটি কাঠামোতেই ধারণায়ন করে। জন এবং তার বাবার সঙ্গে আমাদের আলাপ অভিবাসন আকাঙ্ক্ষা পাঠের অন্য একটি ধারণাকে সামনে নিয়ে এসেছে, যা তুলনামূলকভাবে অধিক স্পষ্ট। অভিবাসন হিসেবে শারীরিক স্থানান্তরের সঙ্গে এই ধারণার খুব কম সম্পর্কই রয়েছে। বিদেশের প্রতি জনের আকর্ষণ, তার দেশত্যাগের পূর্ব লক্ষণের চেয়ে অসন্তোষ, হতাশা এবং অসম্পৃক্ততার একটি বহিঃপ্রকাশ বা রূপক হিসেবে দেখা যায়। জনের বাবা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, দেশপ্রেমের অঙ্গীকার এবং কাজের মাধ্যমে এখনো দেশে জীবনের উন্নয়ন সম্ভব। কিন্তু তাঁর সন্তান বেড়ে উঠেছে অত্যধিক জনবহুল মেগাসিটির একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে। এই শহরের প্রতি তিনি বিতৃষ্ণাভাব পোষণ করেন এবং এখানে তার নিজেকে দমবন্ধ মনে হয়। তার কথায় বাংলাদেশে ব্যক্তিগত উন্নয়ন-সম্ভাবনার অপ্রতুলতা, সর্বোপরি একধরনের হতাশা এবং ওইসব জায়গার কথা, যেখানে সব সম্ভাবনা অবারিত এবং যেখানে তিনি যেতে ইচ্ছুক, সেসব কথা উঠে আসে। তার ভবিষ্যত্ আকাঙ্ক্ষার একটি আন্তদেশীয় মাত্রা আছে, যা তার বাবার যুবক বয়সে ধারণাতীত ছিল, যদিও তা আপাতত অভিবাসনের ভবিষ্যদ্বাণী করে না।

অতঃপর, এই প্রবন্ধ এটা ধরে নিয়ে শুরু হচ্ছে যে বিদেশ যাওয়ার ব্যাকুলতা অভিবাসনের আগে ঘটে, যখন এটি স্পষ্টত আকাঙ্ক্ষা এবং অভিবাসন কৌশলে পরিণত হয়। এই গবেষণায় অংশগ্রহণকারী অনেক তরুণ-তরুণীর জন্য বিদেশ যাওয়ার এই আকাঙ্ক্ষা কখনো বাস্তবে পরিণত হবে না এবং সম্ভবত এই আকাঙ্ক্ষা উবে যাবে বা পুরোপুরি ভিন্ন মনোভাবে পরিণত হবে। ঢাকা/বাংলাদেশে প্রাত্যহিক জীবনযাপন এবং নিত্যদিনের অভিজ্ঞতার বিষয়ে অধিকাংশ তথ্যদাতারই স্পষ্ট অভিযোগ রয়েছে, কিন্তু তাদের স্বপ্নগুলো সাধারণত অস্পষ্ট। অন্যদিকে তাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে কীভাবে যেতে হবে, তার কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনাও তাদের কাছে নেই। অন্য সবকিছুর পরও, দেশত্যাগের এই আকাঙ্ক্ষা নিজেদের দেশে দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা (কল্পনাপ্রসূত) এবং বৈশ্বিক সম্ভাবনাসমূহের মধ্যকার পার্থক্য থেকে উদ্ভূত হতাশা এবং অসম্পৃক্ততার একটি রূপক হিসেবে প্রতীয়মান হয়। এই অনুভূতিগুলো অভিবাসন-পূর্ব কর্মকাণ্ড এবং অভিবাসনের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে সাধারণভাবে বোঝা যাবে না। এসব অনুভূতি বুঝতে একটি বিস্তৃত পর্যালোচনাগত কর্মকাঠামো প্রয়োজন। এই লক্ষ্য পূরণে এই প্রবন্ধটি একটি পদক্ষেপ। ঢাকার শিক্ষিত (নিম্ন) মধ্যবিত্ত শ্রেণির তরুণ-তরুণীদের মতামত ব্যবহার করে এটি দেখানো হবে যে বিশেষত হতাশা, অসন্তোষ, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থার দ্রুত রূপান্তর, সাম্প্রতিক বিশ্বায়ন, স্থানীয় সুযোগ এবং বৈশ্বিক প্রতিশ্রুতির মধ্যকার অনুভূত বৈসাদৃশ্য একীভূত হয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পৃক্ততার বিষয়টিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে এবং এমন স্থানের জন্য আকাঙ্ক্ষা তৈরি করছে, যেখানে যেতে পারলে আমাদের তথ্যদাতাদের চাহিদাগুলো পূরণ হবে। গবেষণা পদ্ধতি এবং বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক পরিবর্তনগুলোর নাতিদীর্ঘ বর্ণনার পর গোটা গবেষণায় উঠে আসা চারটি মূল প্রসঙ্গ এই প্রবন্ধে আলোচনা করা হবে: শিক্ষার প্রতিশ্রুতি এবং স্থানীয় সুযোগগুলোর মধ্যকার পার্থক্য, ঢাকায় দৈনন্দিন বাস্তবতার দুঃসহ প্রভাবগুলো, হতাশার অনুভূতি এবং এর থেকে উদ্ভূত ‘জন্মভূমির’ সঙ্গে অসম্পৃক্ততার এবং অভিবাসন স্বপ্নগুলোর অস্পষ্ট প্রকৃতি। এগুলো ঢাকায় অনেক তরুণ-তরুণীরই ইচ্ছা কিন্তু তা পূরণ হয়নি।

অভিবাসন আকাঙ্ক্ষার পাঠ

ঢাকায় ছয় মাসব্যাপী (ফেব্রুয়ারি, ২০১০ থেকে সেপ্টেম্বর, ২০১০) নিবিড় অ্যাথনোগ্রাফিক তথ্য সংগ্রহের ওপর ভিত্তি করে এই প্রবন্ধ রচিত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে অংশগ্রহণকারী পর্যবেক্ষণ, বিভিন্ন অনানুষ্ঠানিক কথোপকথন এবং স্থানীয় তরুণ-তরুণীদের সঙ্গে ত্রিশটিরও বেশি আনুষ্ঠানিক সাক্ষাত্কার।৩ বাংলাদেশে অর্ধেকেরও বেশি মানুষের বয়স ২৫ বছরের কম। নগর জীবনের গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণের জন্য বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীরা—যাদের শিক্ষা, চাকরি এবং বিয়ে সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হয়—কীভাবে তাদের (বিদেশে) ভবিষ্যতের জীবনের ধারণা নির্মাণ করে এবং কীভাবে কল্পিত ভবিষ্যত্ অনুসারে কাজ করে, সে সম্পর্কে সূক্ষ্ম দৃষ্টি থাকা বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। আমরা আটটি অভিবাসন এবং বৃত্তি পরামর্শ কেন্দ্রে যাই, যেগুলো সাধারণত মিডিয়া সেন্টার নামে পরিচিত। অনুমতি সাপেক্ষে আমরা সেখানকার কর্মকর্তাদের সাক্ষাত্কার গ্রহণ করি।

গবেষণাটি লেখক এবং দুজন স্থানীয় (স্নাতকোত্তর) গবেষকের দ্বারা করা হয়েছিল। স্থানীয় গবেষকেরা বিস্তারিত সাক্ষাত্কারগুলো গ্রহণ করেছেন।৪ আমরা আমাদের নিজস্ব ব্যক্তিগত পরিচয় এবং স্নোবল স্যাম্পলিংয়ের মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে তথ্যদাতা নির্বাচন করি (ওরেইলি, ২০১২: পৃ. ৪২-৪৪)। বাংলাদেশে আমার ব্যক্তিগত গবষেণার অভিজ্ঞতা এবং দুজন গবেষকের ভিন্ন নৃতাত্ত্বিক এবং ধর্মীয় পটভূমির (মুসলিম বাঙালি এবং হিন্দু হাজং) কারণে আমরা তুলনামূলকভাবে তরুণ-তরুণী (যাদের বয়স ১৮ থেকে ৩০ বছর) এবং একটি মিশ্র গোষ্ঠীর তথ্যদাতার সাক্ষাত্কার নিতে পেরেছি।৫ আমাদের অধিকাংশ তথ্যদাতা বাঙালি এবং মুসলমান (১১ জন ছেলে এবং ৮ জন মেয়ে), ১০ জন (সবাই পুরুষ) সাক্ষাত্কারদাতা হিন্দুধর্মাবলম্বী এবং ৪ জন (২ জন ছেলে এবং ২ জন মেয়ে) ছিল আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সদস্য (চাকমা, হাজং ও ত্রিপুরা)। ফলে মোট বাংলাদেশি জনসংখ্যার তুলনায় আমাদের গবেষণা দলটি নৃতাত্ত্বিক এবং ধর্মীয় দিক দিয়ে অধিক বৈচিত্র্যময় ছিল। ফলে তথ্যদাতাদের আমরা বিভিন্নভাবে চিহ্নিত করতে পেরেছি। প্রায় সব তথ্যদাতাই অভিবাসনের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। বিদেশে যেতে চাওয়ার কারণ হিসেবে তারা মোটামুটি একই ধরনের (অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও অস্তিত্বগত) নিরাপত্তাহীনতা প্রকাশ করেছেন। যারা সংখ্যালঘু (নৃতাত্ত্বিক/ধর্মীয়) সম্প্রদায়ের সদস্য ছিলেন, তারা রাষ্ট্রে তাদের সংখ্যালঘু অবস্থার কারণেও নিরাপত্তাহীনতার কথা জানান। আমাদের নারী তথ্যদাতারা ইভ টিজিংয়ের কারণে নিরাপত্তাহীনতার কথা সরাসরি প্রকাশ করেন। ইভ টিজিং বলতে বাংলাদেশ এবং অন্যান্য দক্ষিণ এশীয় রাষ্ট্রে পুরুষদের দ্বারা নারীদের জনসমক্ষে যৌন হয়রানিকে বোঝায়।

আমাদের প্রায় সব তথ্যদাতাই প্রথম প্রজন্মের কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বা স্নাতক। তারা গ্রামীণ এলাকায় (গ্রাম ও ছোট শহর) জন্মগ্রহণ করেছেন এবং উচ্চশিক্ষার্থে ঢাকায় এসেছেন। শিক্ষিত হিসেবে সামাজিক অবস্থান তাদের নিজেদের আকাঙ্ক্ষা এবং ব্যক্তিগত উন্নয়ন, জীবনাচরণ এবং পেশা নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। সব সাক্ষাত্কারেই শিক্ষার সঙ্গে অর্জিত সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রতিশ্রুতি এবং বর্তমানের বাংলাদেশে এসব আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়নের বাস্তবিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে ধারণার স্বল্পতা একটি আপাত বিপরীত অবস্থার সৃষ্টি করেছে (আরও দেখুন, আহসান, ২০০৯)।৬

আমাদের তথ্যদাতারা একটি বৈচিত্র্যময় তরুণ-তরুণীর সমন্বয়ে গঠিত ছিলেন। তারা সবাই নানা মাত্রায় আধুনিক গণমাধ্যমের মাধ্যমে বিশ্বের অন্যান্য অংশের সঙ্গে সংযুক্ত। তাদের প্রায় সবারই কিছু বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়স্বজন বিদেশে থাকেন। যারা বিদেশে যাওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে আছেন বা বিদেশ থেকে ফিরে এসেছেন, এ রকম লোকদের সঙ্গে তারা পরিচিত। ছবি, ধারণা এবং মানুষের প্রবাহের মাধ্যমে গড়ে ওঠা সমাজগুলোর আন্তসম্পর্ক জীবনের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রভাবিত করেছে এবং তা জাতিরাষ্ট্রের সীমানার বাইরেও বিস্তৃত (লেভিট এবং গ্লিক শিলার, ২০০৪: পৃ. ১০০৭-১০০৯)। যদিও তাদের আন্তদেশীয় দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাপকভাবে বৈচিত্র্যময় ছিল। কারও কারও বিদেশে বন্ধুবান্ধুব এবং আত্মীয়স্বজন আছেন, যারা তাদের বাংলাদেশ ত্যাগ করতে বা দেশে থেকে যেতে উত্সাহিত করেন। অন্যদের বিদেশে কোনো বন্ধু বা আত্মীয়স্বজন নেই এবং ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগও নেই। অনেকের কাছে ইন্টারনেট ক্যাফে ব্যবহার ব্যয়বহুল এবং সেখানে বেশিক্ষণ থাকাও যায় না। অভিবাসীদের সঙ্গে যোগাযোগ এবং সংযোগ গড়ে তুলতে পারায় আমাদের তথ্যদাতাদের অল্প কয়েকজন তাদের স্বপ্ন পূরণে কাজ শুরু করতে পেরেছিলেন। তবে অধিকাংশই তা করতে সক্ষম হননি। তাদের আকাঙ্ক্ষা হতাশা এবং বিষাদের বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছু ছিল না।

অর্থনৈতিক রূপান্তর এবং চলিষ্ণু (mobile) নাগরিক

১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের অর্থনীতি অভূতপূর্বভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক সাহায্যের গুরুত্বের জায়গা দখল করে নিয়েছে তৈরি পোশাক রপ্তানি শিল্প, চিংড়ি রপ্তানি এবং রেমিট্যান্সের বৃদ্ধি, বিশেষত গাল্ফ দেশগুলো থেকে। জিডিপিতে কৃষির গুরুত্ব অর্ধেকের জায়গায় এক-ষষ্ঠাংশে নেমে এসেছে এবং সেবা খাতের গুরুত্ব এক-তৃতীয়াংশ থেকে দুই-তৃতীয়াংশে পরিণত হয়েছে (লুইস, ২০১১: পৃ. ১৩৬-১৩৭)। এসব পরিবর্তনের ফলে গ্রাম থেকে শহরে বড় ধরনের অভিবাসন ঘটেছে। শহরের জনসংখ্যা বার্ষিক ৩.৫% হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে (লুইস, ২০১১: পৃ. ১৬৩)। ১৯৭১ সালে ঢাকার অধিবাসী ছিল ১০ লাখ। ২০০৭ সালের মধ্যে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৪০ লাখে এবং ২০২৫ সালের মধ্যে তা সম্ভবত আড়াই কোটিতে পরিণত হবে (ভ্যান স্যান্ডেল, ২০০৯: পৃ. ২৩২)।

বহুজাতিক অভিবাসনের গুরুত্বের ফলে একটি বড় ধরনের অভিবাসন শিল্প প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, বর্তমানের বাংলাদেশ অভিবাসনকে উত্সাহিত করছে। ২০১২ সালের গ্যালাপের এক প্রতিবেদন অনুসারে, ৮ মিলিয়ন বাংলাদেশি যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসনের ইচ্ছা প্রকাশ করেন (তুলনামূলকভাবে ভারতে এই সংখ্যা ১০ মিলিয়ন এবং মেক্সিকোতে এই সংখ্যা ৫ মিলিয়ন)৭। এর ফলে এটা প্রমাণিত হয় যে, যেকোনো সময়ের তুলনায় বর্তমানে সমাজের সব স্তর থেকে অধিক সংখ্যক বাংলাদেশি অভিবাসনে ইচ্ছুক (তুলনামূলক চিত্রের জন্য দেখুন, গার্ডেনার, ১৯৯৩; রুডনিক, ২০০৯: পৃ. ৪৮; উল্লাহ, ২০১০)। শুধু ঢাকাতেই নয়, ছোট-বড় প্রায় সব শহরেই বিভিন্ন দপ্তরের দেয়াল, বাসস্টেশন এবং এমনকি রিকশার পেছনেও বৃত্তি কর্মসূচি, ভিসা পরামর্শকেন্দ্র এবং ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণের বিজ্ঞাপনের বিলবোর্ড এবং প্রচারপত্রে সজ্জিত। বাংলা ও ইংরেজি দৈনিক পত্রিকাগুলোও বৃত্তি, স্টুডেন্ট ভিসা, ওয়ার্ক পারমিট এবং এমনকি নিউজিল্যান্ড, বেলজিয়াম, কানাডা, হাঙ্গেরি, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, সাইপ্রাস, স্পেন, মালয়েশিয়া, জার্মানি, মাল্টা, ইতালি, চীন, স্কটল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, পোল্যান্ড, সুইডেন, ইউক্রেন, আজারবাইজান, যুক্তরাষ্ট্র, ডেনমার্ক, যুক্তরাজ্য, জর্জিয়া, যুক্তরাজ্য এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় স্থায়ী বসবাসের বিজ্ঞাপনে ঠাসা। অন্যান্য বিজ্ঞাপনে আইইএলটিএস বা টোফেলের কোচিংয়ের বিজ্ঞাপন বা ব্যাংক জামানত সহায়তা প্রদানের তথ্য এবং ‘অস্ট্রেলিয়া চল, জীবন পাল্টে ফেল’ বা ‘যা ইচ্ছা হয়ে যাও’ জাতীয় স্লোগান প্রচার করে।

১০০টিরও বেশি দেশে বাংলাদেশিরা কাজ করছেন, যদিও অভিবাসীদের অধিকাংশই মধ্যপ্রাচ্য বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কাজ করেন। এসব অভিবাসী বাংলাদেশের প্রধান দাতায় পরিণত হয়েছেন। একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকেই আনুষ্ঠানিকভাবে হিসাবকৃত রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল সব ধরনের বিদেশি সাহায্যের মোট অর্থমূল্যের চার গুণ (ভ্যান স্যান্ডেল, ২০০৯: পৃ. ২২৫)। ২০০৮ সালে বিদেশে কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা ছিল প্রায় ৫.৮ মিলিয়ন এবং জিডিপিতে রেমিট্যান্সের অবদান ছিল প্রায় ১০%; ২০০৫ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে বার্ষিক রেমিট্যান্সের প্রবাহ ৪.২ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পরিণত হয় (রহমান এবং আলমগীর কবির, ২০১২: পৃ. ২)। বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ১০টি রেমিট্যান্স গ্রহীতা দেশগুলোর একটি। মোট রেমিট্যান্সের দুই-তৃতীয়াংশই মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসে এবং এরপরে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান (বিশ্বব্যাংক, ২০০৮)।

বাংলাদেশের জন্য অভিবাসনের প্রাসঙ্গিকতা থাকা সত্ত্বেও, এটা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে ২০১১ সাল পর্যন্ত হিসাবকৃত অভিবাসীদের মোট সংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার মাত্র ৩.৩%। অধিকাংশ বাংলাদেশি তাঁদের নিজেদের জায়গাতেই আছেন। অভিবাসী হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ, আন্তযোগাযোগ, ইচ্ছা বা উদ্যম তাঁদের নেই। এই প্রবন্ধের ক্ষেত্রে নিচের পর্যবেক্ষণগুলো বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, বাংলাদেশে আগ্রহী অভিবাসীদের বিন্যাস বেশ বৈচিত্র্যময় এবং এর মধ্যে যারা দেশত্যাগের জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, যাদের অনেক আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধু বিদেশে থাকেন এবং যারা কৌশলগত পরিকল্পনায় যুক্ত থাকেন, তাঁরাও অন্তর্ভুক্ত (আরও দেখুন, রুডনিক, ২০০৯; উল্লাহ, ২০১০)। অন্যরা, যদিও দেশত্যাগের জন্য মুখিয়ে থাকেন, তবে তাঁদের ইচ্ছা পূরণের জন্য কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেন না এবং আমাদের গবেষণার সময় অংশগ্রহণকারী তথ্যদাতারা এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত; তাদের আকাঙ্ক্ষা অভিবাসন-সম্পর্কিত কাজে রূপ নেয় না। দ্বিতীয়ত, মধ্যপ্রাচ্য অধিকাংশ বাংলাদেশি অভিবাসীর কর্মস্থল, আমাদের মাত্র একজন তথ্যদাতাই মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। অন্যরা তথাকথিত পশ্চিমা উন্নত বিশ্বের নানা স্থানের নাম উল্লেখ করেন, যদিও তাদের উত্তর গোছালো ছিল না এবং এর মধ্যে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যের একটি স্পষ্ট ক্রম পরিলক্ষিত হয়।

শিক্ষা, আধুনিকতা এবং দূরবর্তী গন্তব্যের জন্য আকাঙ্ক্ষা

বাংলাদেশে সন্তানদের শিক্ষায় (বিদেশে) উচ্চবিত্তের যে দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে (ভ্যান স্যান্ডেল, ২০০৯: পৃ.২২৭) তা দ্রুতগতিতে মধ্যবিত্তের (উচ্চাকাঙ্ক্ষী) মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে। অধিকাংশ বাংলাদেশি ভাল বেতনের এবং উচ্চমর্যাদার চাকরি লাভের পন্থা হিসেবে শিক্ষাকে গুরুত্ব দেন (লুইস, ২০১১: পৃ.১৮২)। আমাদের প্রায় সব তথ্যদাতাই শিক্ষা গ্রহণের জন্য বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকা থেকে ঢাকায় এসেছেন। তাদের কেউই অদূর ভবিষ্যতে তাদের পৈতৃক গ্রাম বা শহরে ফিরে যাওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করেন না। প্রকৌশলী, সমাজকর্মী, ব্যবস্থাপক বা গবেষক হিসেবে প্রশিক্ষিত হওয়ার পর, তারা তাদের ডিগ্রির সঙ্গে মানানসই পেশা এবং জীবনাচরণের আশা করেন। শিক্ষিত বাংলাদেশি হিসেবে পাওয়া তাদের নতুন সামাজিক মর্যাদা, চাকরি এবং জীবনাচরণের ফলে তাদের ঢাকায় থাকতে হবে বলে তারা মনে করেন। আপাত বিরোধী মনে হলেও, আমাদের কয়েকজন তথ্যদাতার মতে, ঢাকাই তাদের মনে আন্তর্জাতিক অভিবাসনের আকাঙ্ক্ষার জন্ম দিয়েছে এবং এই বিষয়টি অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক অভিবাসনের মধ্যে যে একটি দৃঢ় সম্পর্ক রয়েছে, সে ধারণাটিকেই দৃঢ় করে (বিস্তারিত দেখুন, রুডনিক, ২০০৯: পৃ. ৪৮; কিং এবং স্কেলডন, ২০১০: পৃ. ১৬২৩)। জেনিথ (পুরুষ, বয়স: ২৫ বছর) ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘শহরে আসার পর, মানুষের আশা এবং স্বপ্ন বৃদ্ধি পায়’। তিনি আরও দেখেছেন, কীভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং সিনিয়র ভাইয়েরা—যাদের বিদেশি ডিগ্রি আছে এবং যারা বিদেশে যেতে চান—অন্যদের বিদেশে চলে যেতে উত্সাহিত করেন। সঞ্চিত (বয়স: ২৩ বছর) কলেজে ভর্তি হওয়ার পরই বিদেশে অভিবাসনের স্বপ্ন দেখা শুরু করেন। তার মতে, ‘আমার সব বন্ধুই স্নাতক শেষ করার পর বিদেশ চলে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন’।

যারা শিক্ষালাভ থেকে বঞ্চিত হয়েছে, তাদের শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসা স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশ সরকারের একটি অগ্রাধিকার ছিল (আহসান, ২০০৯)। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যুবকদের মধ্যে শিক্ষার হার ১৯৮১ সালের ২৯.২% থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০০৯ সালে ৫৫.৯%-এ পরিণত হয় (ইনডেক্স মান্ডি ২০১১)৮। দুর্ভাগ্যজনকভাবে,একই সময়ে শিক্ষিত তরুণ বেকারদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। বৈশ্বিক দক্ষিণের অন্যান্য এলাকার মতোই, শিক্ষিত তরুণ বেকারদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা একটি প্রধান আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি আনুষ্ঠানিক শিক্ষা সফল পেশাদারি কর্মস্থল নিশ্চিত করবে বলে অধিকাংশ মানুষ যে আশাবাদ পোষণ করতেন, তা অনেকের জন্যই সত্য হিসেবে প্রতীয়মান হয়নি (দেখুন, জাফরি, ২০০৯)। প্রকৃতপক্ষে, ‘বাংলাদেশে চাকরি লাভে বহুল প্রচলিত ব্যাপক দুর্নীতি এবং স্বজনপ্রীতির কারণে অনেক শিক্ষিত নবীনই অর্থনৈতিক ও সামাজিক মূলধনের অভাবে তাদের সাংস্কৃতিক মূলধনকে নিরাপদ চাকরিতে রূপান্তরিত করতে পারে না’ (আহসান, ২০০৯: পৃ. ১৩)। চাকরির অনিশ্চয়তা দেশত্যাগের আকাঙ্ক্ষার অন্যতম প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। আমাদের কয়েকজন তথ্যদাতা বিশ্বাস করেন যে তারা তাদের স্বপ্নের দেশে কাঙ্ক্ষিত চাকরি খুঁজে পেতে সক্ষম হবেন, যদিও তাদের নিজেদের দেশে সে রকম কোনো সম্ভাবনার আশা খুব অল্পই আছে। আকিদ, একজন ২৯ বছর বয়স্ক মুসলিম। তার জন্ম কুমিল্লার একটি প্রতিষ্ঠিত পরিবারে। তার বয়স্ক আত্মীয়রা ভালো পদে কাজ করেন এবং তিনি স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে অধ্যয়ন শেষ করেছেন, ফলে বিদেশে যাওয়ার কথা তিনি কখনো বিবেচনা করেননি। কিন্তু, ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের তিন বছর পর, তার মনেও দেশত্যাগের ধারণা জন্ম নিয়েছে, ‘আমি লক্ষ করেছি আমার চেয়েও বেশি যোগ্য শিক্ষার্থীরা একটি ভালো চাকরি খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে; তারা এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কিন্তু কোনো ভালো চাকরি পাচ্ছে না। কোনো কোনো সময়, চাকরিদাতারা এমনকি মোটা অঙ্কের অর্থও দাবি করে। চাকরিপ্রার্থীদের অনেক টাকার প্রয়োজন। (...) আমি বিদেশে যেতে পারলে একটি ডিগ্রি এবং অর্থ উপার্জন উভয়ই করতে পারব।’ সাহিরা একজন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, তিনি নারী প্রকৌশলী হিসেবে কাজের সুযোগের কথা বলছিলেন। তিনি এক বন্ধুর কাছে শুনেছেন যে বিদেশে নারীরা শিল্প খাতকে নিজেদের পেশা হিসেবে নিতে পারেন। তবে বাংলাদেশে ‘একজন নারী ১০০ বা এর কাছাকাছি সংখ্যক পুরুষ কাজ করে এ ধরনের একটি কোম্পানিতে কাজ করতে পারেন না, এটা অসম্ভব।’ শ্রমবাজারে প্রবেশ করতে পৃষ্ঠপোষকদের ভূমিকার কথাও সাহিরা তুলে ধরেন:

আমার নিজের অভিজ্ঞতা হচ্ছে যোগ্যতা দিয়ে কোনো চাকরি পাওয়া যায় না, যতক্ষণ পর্যন্ত আপনার প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষক না থাকছে। যদি কেউ আপনাকে একটি চাকরি দেয়, তিনি প্রতিদানে আপনার কাছ থেকেও কিছু আশা করবেন এবং আপনি হয়তো বুঝতে পারছেন কোনো নারীর কাছ থেকে সে প্রতিদান কী হতে পারে...আমি মনে করি বিদেশই নিরাপদ।

ঢাকার অসহনীয় অবস্থা, ‘আমরা কি ভোগার জন্যই এখানে জন্মগ্রহণ করেছিলাম?’

দিন দিন মেগাসিটি ঢাকার জীবন বাস্তবতা, যেটি পেশাদারি কর্মস্থল এবং মধ্যবিত্তের আধুনিক জীবনাচরণেরও স্থান, বিদেশে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষাকেও পুষ্ট করে। কোনো ধরনের সর্বাঙ্গীণ পরিকল্পনার অভাবে, দ্রুত নগরায়ণ দেশের রাজধানীর জন্য মারাত্মক কায়িক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিণতি বয়ে আনছে। বর্তমানে দূষিত বায়ুমানের মেগাসিটিগুলোর মধ্যে ঢাকার অবস্থান ওপরের দিকে এবং বায়ুদূষণ কমানো জরুরি হয়ে পড়েছে (দেখুন, গুরজার এবং অন্যান্য, ২০০৮)। এর লাখ লাখ বাসিন্দাকে প্রয়োজনীয় পানি, বিদ্যুত্ ও পরিবহন-সুবিধা দিতেও শহরটিকে বেগ পেতে হচ্ছে। জনপরিবহনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা এই শহরে নেই এবং অবকাঠামোগুলো ক্রমবর্ধমান ব্যক্তিগত গাড়িগুলোর স্থান সংকুলন করতে পারছে না, ফলে ভয়াবহ যানজট তৈরি হচ্ছে।

প্রায় সব সাক্ষাত্কারেই ঢাকার বসবাস অযোগ্য অবস্থা আলোচনার প্রধান বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আমাদের তথ্যদাতারা বিদ্যুত্ ও পানির কাঠামোগত স্বল্পতা, বিশ্রামের জন্য খোলা জায়গার অভাব এবং নিত্যদিনের ট্রাফিক জ্যামের অভিযোগ উত্থাপন করেন। এই যানজটের ফলে ঢাকার রাস্তাগুলো বন্ধ হয়ে যায় এবং চলাচল মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়। একটা সাক্ষাত্কারের সময় মিজান বলেছিলেন, ‘আপনি দেখুন এইমাত্র বিদ্যুত্ চলে গেল, যদিও আজ শুক্রবার (বন্ধের দিন); আজ তুলনামূলভাবে বিদ্যুতের চাহিদা কম, তবুও বিদ্যুতের সরবরাহ নেই’। মিজানের বয়স ২৮ বছর এবং তিনি বিবাহিত। তার বাড়ি কুষ্টিয়া এলাকায়। তার বাবা একজন ব্যবসায়ী এবং মা গৃহিণী। তিনি কম্পিউটার বিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন এবং একটি আবাসন কোম্পানিতে কাজ করছিলেন। তার স্ত্রীরও একটা চাকরি ছিল এবং কাজের পর সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে পড়াশোনা করছিলেন। মিজান এবং তার স্ত্রী দেশত্যাগের জন্য উদ্গ্রীব হয়ে ছিলেন। তিনি অব্যবস্থাপনা, ব্যাপক দুর্নীতি, যানজট ও লোডশেডিংয়ের বিষয়গুলো তুলে ধরলেন। একপর্যায়ে তিনি উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘এই দেশটা দিয়ে কী হবে, বেঁচে থাকার কি আর কোনো জায়গা নেই? আমরা কি শুধু ভোগার জন্যই এ দেশে জন্মগ্রহণ করেছি?’

গত এক দশকে প্রায় ৫% হারে ক্রমাগত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং এর ফলে বৃদ্ধি পাওয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণির, যা বর্তমানে মোট জনসংখ্যার ৯-১০%, সঙ্গে সঙ্গে শহরের জীবন ধারণের অবস্থার ক্রমান্বয়ে অবনতি হয়েছে। আবাসন বাজার দিন দিন বড় হচ্ছে, পুরোনো ভবন এবং বাংলোগুলো ভেঙে ফেলা হচ্ছে। এর স্থানে আধুনিক অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স গড়ে উঠছে। প্রতিদিন নতুন শপিংমল, রেস্টুরেন্ট, বিউটি পারলার এবং কফিশপ গড়ে উঠছে। এসব নতুন এবং আধুনিক ভবন আপাতত ভেতরে শীতল এবং বিলাসী স্থান তৈরি করছে, কিন্তু এগুলো তৈরি হচ্ছে বিশ্রাম নেওয়ার স্থানে। চলমান ভবন নির্মাণকাজের ফলে তৈরি হচ্ছে গোলমেলে শব্দ এবং অসহনীয় ধুলাবালি। ক্রমবর্ধমান ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা মানুষের চলাচলের গতি বৃদ্ধি করছে না, তার পরিবর্তে তৈরি হচ্ছে ক্রমবর্ধমান যানজট। যার ফলে শহরের যানবাহন বস্তুতপক্ষে প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টা রাস্তায় আটকে থাকে।

শহুরে পরিবেশের এক আমূল পরিবর্তনের কারণে বা এই পরিবর্তন সত্ত্বেও অনেকে তাদের কাঙ্ক্ষিত আধুনিক জীবনাচরণ পালন করতে পারেন না। ২০১০ সালের ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস-এর এক প্রতিবেদন অনুসারে বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে নৈরাশ্য উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ‘অর্থনৈতিক শাসনপদ্ধতিতে দুর্বলতা ধীরে ধীরে প্রকাশিত হচ্ছে, যা মধ্যবিত্ত শ্রেণির আকাঙ্ক্ষা এবং জীবনাচরণের মধ্যে সম্ভবত একটি দূরত্ব তৈরি করতে পারে’ (শহিদুজ্জামান, ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস, ২১ মার্চ, ২০১০)। এ ধরনের পর্যবেক্ষণ এই গবেষণায় অংশগ্রহণকারী নবীনরাও প্রকাশ করেছেন। হূদয় একজন ৩০ বছর বয়স্ক বাঙালি তরুণ এবং সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। কুষ্টিয়া জেলায় স্নাতক পর্যায়ে অধ্যয়নের পর, পড়াশোনা করার জন্য ২০০০ সালে তিনি ঢাকায় আসেন। হূদয়ও ঢাকায় তার জীবন নিয়ে খুবই হতাশ এবং দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন বাংলাদেশে তার কোনো ভবিষ্যত্ নেই। সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে ডেভেলপার এবং নির্মাতারা কী ধরনের ঝুঁকি নেন, সে সম্পর্কে তিনি ওয়াকিবহাল আছেন। ভবন নির্মাতারা নিম্নমানের ভবন-নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করেন এবং প্রাতিষ্ঠানিক ভবন নির্মাণ নীতিমালা এবং নিরাপত্তা নির্দেশনাগুলো মেনে চলেন না।৯ রাজধানীকে আরও বসবাসযোগ্য করে গড়ে তুলতে কী করতে হবে, তা হূদয়ের জানা আছে, কিন্তু তিনি মনে করেন এ ক্ষেত্রে সরকারের দক্ষতা ও ইচ্ছাশক্তির যথেষ্ট ঘাটতি আছে। তিনি আরও উল্লেখ করেন, ঢাকা শহর মারাত্মক ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় অবস্থিত। এই শহর যদি ভূমিকম্পে আক্রান্ত হয়, তবে এর বাসিন্দাদের রক্ষা পাওয়ার সুযোগ নেই বললেই চলে। ‘৭.৮ মাত্রার ভূমিকম্পে ৯০% ভবন ধসে পড়বে, তত্ক্ষণাত্ ৪০ লাখ লোক মারা যাবে, ৪০ লাখ লোক আহত হবে বা মারা যাবে, এর থেকে ছাড়া পাওয়া সম্ভব না। শুধু ২০ লাখ মানুষ এই দুর্যোগে বেঁচে থাকবে। এটা একটা বৃহত্ বেদনাময় ঘটনা হবে।’ যদিও হূদয় বিবাহিত, তবে এই দম্পতির কোনো সন্তান নেই। ঢাকায় তারা কীভাবে একটি শিশুকে যথাযথভাবে লালন-পালন করতে পারবে? ‘আমার সব বন্ধুই বিদেশ যাওয়ার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করছে, আমাদের এখানে থাকা উচিত নয়। আমাদের এখন কী করা উচিত? ... মানুষ অর্থ উপার্জন করছে এবং খরচ করছে, কিন্তু তাদের মানসিকতা সমস্যায় ভর্তি।’

পরিচয় নির্মাণ এবং একাত্মতার ধারণাসমূহ

গ্যালাপ জরিপ (আইসিপোভা এবং অন্যান্য, ২০১০) এটা নিশ্চিত করেছে যে কোনো স্থানে জন্মগ্রহণ করলেই ওই স্থানের সঙ্গে ব্যক্তির ঘনিষ্ঠতা থাকবে, এমন দাবি করা যায় না। প্রকৃতপক্ষে দেশপ্রেমের বোধ, যেমনটা সাঙমার নাম দিয়েছেন, জাগ্রত করা এবং লালন করা প্রয়োজন। জাতিসমূহ ‘ক্রমাগত নির্মাণের মধ্যে থাকে’ (অ্যান্ডারসন, ১৯৯১)। রাষ্ট্রগুলো এবং তাদের রাজনৈতিক এলিটরা আদর্শায়িত ভাষা, জাতীয় (এবং জাতীয়তাবাদী) শিক্ষাক্রম, কর আরোপ, (জাতীয় ও আন্তর্জাতিক) সংঘর্ষ এবং জোরপূর্বক একীভূতকরণ বা নির্মূলের মাধ্যমে একটি স্থায়ী প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত, যার লক্ষ্য হচ্ছে ‘জনগণকে নাগরিকে পরিণত করা’ (ফক্স এবং মিলার-ইদরিস, ২০০৮: পৃ. ৫৩৬-৫৩৭)। অন্যান্য আরও অনেক রাষ্ট্রের মতো বাংলাদেশেও জাতি-গঠন(বিস্তারিত দেখুন, অ্যান্ডারসন, ১৯৯১) বা বাংলাদেশীকরণ  একটি জটিল এবং আলোচিত প্রক্রিয়া। স্বাধীনতা লাভের পর, বাংলাদেশের জনগণকে একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে নিজেদের কল্পনা করার আহ্বান জানানো হয়েছিল (ভ্যান স্যান্ডেল, ২০০৯: পৃ. ১৮৫)। কিন্তু আজ পর্যন্ত জাতীয়তাবাদের প্রভাবশালী দুটি মডেলের কোনোটিই অপরটির ওপরে সর্বতোভাবে জয়ী হতে পারেনি। বাঙালি মডেল ধরে নেয় যে বাংলাদেশি জাতিসত্তার শিকড় নিহিত আছে পারস্পরিক অনুভূত বাঙালি জাতিসত্তা, সংস্কৃতি এবং ভাষার মধ্যে, কিন্তু সব বাংলাদেশিই জাতিগতভাবে বাঙালি নয়। তথাকথিত বাংলাদেশি মডেলের ভিত্তি এ ধারণার ওপর গড়ে উঠেছে যে, লাখ লাখ হিন্দু, খ্রিষ্টান বা বৌদ্ধ অধিবাসী থাকা সত্ত্বেও, বাংলাদেশিরা মূলত মুসলমান (করিম, ১৯৯৮; ব্যাল, ২০০৭; ভ্যান স্যান্ডেল, ২০০৯)। অধিকন্তু, উভয় মডেলই নাগরিকদের শুধু একটি অংশকে নিজের আওতাভুক্ত করছে। এর ফলে যারা এই আওতাভুক্তি থেকে বাদ পড়ছেন, তারা নিরাপত্তাহীনতা অনুভব করেন। পার্থক্যের অন্য সূচকগুলো, যেমন: শ্রেণি, রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা এবং আঞ্চলিকতাবাদ ইত্যাদি জাতি-গঠনের প্রক্রিয়াটিকে আরও জটিল করে তুলেছে।

সাক্ষাত্কারগুলো থেকে এটা প্রতীয়মান হয় যে নিরাপত্তা, নিরাপত্তাহীনতা এবং একাত্মতার মধ্যে একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। রাষ্ট্র, সরকার এবং সহনাগরিকদের সম্পর্কে হতাশা অধিকাংশ কথোপকথন এবং সাক্ষাত্কারের বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। আমাদের তথ্যদাতারা তাদের নিজেদের রাষ্ট্র সম্পর্কে নানা ধরনের অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন। কেউ কেউ জোর দিয়ে বলেছেন, তারা বিদেশে গিয়ে নতুন দক্ষতা অর্জন এবং অর্থ উপার্জন করে বাংলাদেশের জন্য ভালো কিছু করতে চান। অন্যরা বাংলাদেশের একটি অধিকতর ভালো ভবিষ্যতের বিষয়ে গভীরভাবে হতাশ এবং এ রকমটি ঘটার কোনো আশা পোষণ করেন না। রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পৃক্ততার বিষয়ে আমাদের বাঙালি মুসলিম এবং সংখ্যালঘু তথ্যদাতাদের কেউই অপরের চেয়ে এগিয়ে ছিল না। আকিদ একজন ১৯ বছর বয়সী মুসলিম ছাত্র এবং ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। তিনি দেশত্যাগের জন্য উদ্গ্রীব ছিলেন (‘আমি কোনোভাবেই বাংলাদেশে বাস করতে চাই না’)। তিনি তার সহনাগরিকদের আচরণ এবং কার্যক্রমের প্রতি নিজের লজ্জাবোধের কথা বলছিলেন, ‘তাদের মানসিকতা খুবই খারাপ, এটা আমি বলে বোঝাতে পারব না। আপনি দেশের রাজনীতি বা অন্য বিষয়গুলো লক্ষ্য করুন। পরিস্থিতি নৈরাজ্যকর।’

রাষ্ট্র পরিচালনা এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিষয়ে সব তথ্যদাতাই একধরনের গভীর অতৃপ্তি প্রকাশ করেছেন। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে রাজনীতিবিদদের মনোযোগের বিষয়ে হূদয় উপহাস প্রকাশ করেন। সুষ্ঠুভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার পরিবর্তে তারা বাংলাদেশের ‘সত্যি’ জাতীয় ইতিহাসের মতো আদর্শিক বিষয় নিয়ে সংঘাতে সময় এবং অর্থের অপচয় করে। ‘ঢাকা শহরে বিশ লক্ষ গাড়ি আছে, কিন্তু রাজনীতিবিদেরা বায়ুদূষণ নিয়ে কথা বলেন না; তারা জিয়া বা মুজিবের নাম পরিবর্তন নিয়ে ব্যস্ত।’১০ রাজনীতিবিদেরা যে পরিমাণ টাকা নষ্ট করেন তা মানসম্মত বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণের কাজে বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজে ব্যয় করা যেত। হূদয় মনে করেন, সরকারের পাঁচটি মৌলিক চাহিদা পূরণ করা উচিত: খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা। কিন্তু তার মতে, সরকার এমনকি প্রথম চাহিদাটিই পূরণ করতে পারছে না: ‘আমরা এই অবস্থায় বাস করছি, দেশ কোথায় যাচ্ছে? এ জন্যই আমি বিদেশে চলে যেতে চাই!... পেছনে ফিরে তাকাবার মতো সময় আমার নেই। আমার বাবা মারা গিয়েছেন, কিন্তু আমি এই বিষয়ে ভাবি না। আমি পরবর্তী প্রজন্ম নিয়ে শঙ্কিত।’

বহুল প্রচলিত দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি, আমাদের তরুণ তথ্যদাতাদের মনে নিরাপত্তাহীনতার দৃঢ় বিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে। সঞ্জীব, ২৪ বছর বয়সী একজন হিন্দু তরুণ। তার বাড়ি মাগুরা জেলায় এবং তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন

ছাত্র। তিনি ২০০৪ সালে ঢাকা আসেন এবং অল্প কয়েক বছরেই ঢাকায় তার  জীবন অসহনীয় হয়ে ওঠে। তিনি বিশ্বাস করেন, তার পড়াশোনার বিষয়— বায়োকেমিস্ট্রি— তাকে বিদেশে যেতে সাহায্য করতে পারে। তবে তিনি বিদেশে চলে যান, এটা তার বাবা-মা চান না। তিনি তার দেশের প্রতি কৃতজ্ঞতাও অনুভব করেন; কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি বিদেশে চলে যেতে ইচ্ছুক। তার এই সিদ্ধান্তের পেছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে, যার মধ্যে আছে ব্যাপক এবং ক্রমবৃদ্ধিমান দুর্নীতি, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার অভাব এবং নৈতিকতার পুরোদস্তুর অনুপস্থিতি। রুবি, ২৪ বছর বয়সের একজন তরুণী। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। তিনিও হতাশা ও নিরাশার কারণ হিসেবে ব্যাপক দুর্নীতিকে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন, ‘যখন আমরা, বন্ধুরা একসঙ্গে আড্ডা দিই, তখন আমরা কীভাবে বা কী কাজ করে দেশের জন্য কাজ করতে পারি তা নিয়ে আলোচনা করি। কিন্তু, দুর্নীতির মতো ব্যাপক সমস্যাটির কোনো সমাধান আমরা খুঁজে পাই না।’

রুবির গল্প আমাদের অন্য মুসলিম তথ্যদাতাদের গল্প থেকে কয়েকটা দিক থেকে ভিন্ন। একজন নারী এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসী একটি আদিবাসী গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে তাকে এমন কিছু নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন হতে হয়, যা অন্যান্য মুসলিম পুরুষ তথ্যদাতা সম্মুখীন হয় না। রুবির আত্মীয়রা ধনী। তার দাদা একজন বিখ্যাত ভূস্বামী ছিলেন। তার বাবা একজন সরকারি চাকরিজীবী এবং মা একটি ব্যাংকে কাজ করেন। তবুও তিনি বিদেশে গিয়ে একজন ব্যারিস্টার হতে চান, বিশেষত যুক্তরাজ্য গিয়ে। তার গন্তব্যের তালিকায় অস্ট্রেলিয়া ও নরওয়েও আছে। তার স্বপ্ন নির্মাণে একজন নারী এবং আদিবাসী ত্রিপুরা গোষ্ঠীর একজন সদস্য হওয়ার অভিজ্ঞতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদিও তার বাবা-মা সচ্ছল, তবে একজন ত্রিপুরা, হিন্দু এবং নারী হিসেবে তিনি ‘সবচেয়ে নিম্ন শ্রেণিতে’ অবস্থান করেন। তিনি বিশেষত পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিকায়ন এবং ‘তার নিজের লোকদের’ প্রতি সামরিক বাহিনীর আচরণের বিষয়ে তিনি শঙ্কিত। এই সাক্ষাত্কারের মাত্র কয়েক দিন আগেই তাদের ঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং ভয়ে তার বাবা-মাকে জঙ্গলে লুকিয়ে থাকতে হয়েছিল। একজন নারী হিসেবে তাকে প্রায়ই সামরিক বাহিনীর ইভ টিজিংয়ের শিকার হতে হয় এবং তার মতে, এমনকি মাঝে মাঝে তারা মেয়েদের ধর্ষণ ও হত্যাও করে। সর্বদা বিরাজমান এই হুমকি তার মধ্যে ক্রমাগত উত্কণ্ঠার জন্ম দিয়েছে।

কিছু তরুণ-তরুণী, বিশেষত যাঁরা সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর সদস্য, একটি আপাতবিরোধী ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন: দেশ ত্যাগ করা এবং তাঁদের নিজেদের সম্প্রদায়ের জন্য ভালো কিছু করা। উদাহরণস্বরূপ, অভিজিত ও নলীন দুজন ২২ বছর বয়সী দরিদ্র, নিম্নবর্ণের হিন্দু ছাত্র এবং তাঁরা দুজনই তাঁদের কর্তব্যের ওপর জোরারোপ করেছিলেন, ‘২২ থেকে ২৩টি হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামের আমিই একমাত্র ব্যক্তি, যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি ...। আমার বিদেশ যাওয়ার একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে এই সম্প্রদায়ের জন্য কিছু একটা করা’ (অভিজিত্)। হিন্দু বা মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মেধাবী তরুণ-তরুণী, যাঁরা যথাযথভাবে শিক্ষা পান না, তাঁদের বিষয়ে নলীন চিন্তিত, ‘আমার একান্ত ইচ্ছা, যদি আমি তাদের শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ করে দিতে পারতাম, কিন্তু আমি তা পারি না। তাই আমি দ্রুত একটি চাকরি খুঁজে পাওয়ার আশা করছি এবং চাকরি পেলে আমি তাদের জন্য কিছু একটা করতে পারব।’ কয়েকজন তথ্যদাতা উল্লেখ করেছেন যে যাঁরা অভিবাসনের ইচ্ছা পোষণ করেন, তাঁরা দেশে ফিরে এসে দেশের জন্য কিছু করারও ইচ্ছা রাখেন। তবে বাস্তবে, যেমনটা তাঁরা বিশ্বাস করেন, অল্প কয়েকজনই ফিরে আসবেন। এই বিষয়ে অভিজিত্ তাঁর হতাশা প্রকাশ করেছেন এভাবে, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক বিদেশে যান, কিন্তু তাঁরা দেশে ফিরে আসেন না। অন্যদিকে কিছু কিছু শিক্ষক বিদেশ থেকে ভালো শিক্ষা গ্রহণ করে দেশে ফিরে আসার পর বিভিন্ন এনজিওর সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। অর্জিত জ্ঞান আমাদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়াই তাঁদের কর্তব্য ছিল, কিন্তু তাঁরা তা করেন না। ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মান হ্রাস পাচ্ছে।’

এই প্রবন্ধের শুরুতে এটা উল্লেখ করা হয়েছে যে মুক্তিযুদ্ধকালীন এবং মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর প্রজন্মের মধ্যে একটি প্রজন্মগত পার্থক্য রয়েছে, যাঁরা মনে করেন মুক্তিযুদ্ধের প্রতিশ্রুতিগুলো এখনো পূরণ করা হয়নি। যদিও আমাদের কয়েকজন তথ্যদাতা জনের মতোই জাতীয় স্বার্থের প্রতি দায়বদ্ধতা অনুভব করেন না, তবে শাহবাগের সাম্প্রতিক গণবিক্ষোভ দেখে ধরে নেওয়া যায়, তরুণ-তরুণীরা বাঙালি জাতীয়তাবাদেরই অনুসারী। তবে এটা পরিষ্কার নয় যে আমাদের তথ্যদাতারা এবং তাদের মতো অন্য তরুণ-তরুণীরা এই গণবিক্ষোভে উপস্থিত ছিলেন কি না এবং এই গণবিক্ষোভ তাঁদের কাছে কী ধরনের গুরুত্ববহ।

স্বপ্ন অস্পষ্ট হওয়া উচিত!

বাংলাদেশি স্থানীয় এক গবেষক অনেকের স্বপ্নের দেশের প্রকৃতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশিদের স্বপ্ন অস্পষ্ট হওয়া উচিত।’ তার মতে, ভবিষ্যতে কী হতে যাচ্ছে, সে সম্পর্কে অধিকাংশ বাংলাদেশিরই কোনো ধারণা থাকে না। ‘অনেকের পরিকল্পনা বিভিন্ন কারণেই কখনো বাস্তবে রূপান্তরিত নাও হতে পারে।’ ফলে, বিকল্প কোনো কিছু আছে কি না সে সম্পর্কে সব সময়ই মানুষকে সজাগ থাকতে হয়। স্বপ্নের দেশের বিষয়ে অস্পষ্ট ধারণা থাকলেও, অধিকাংশ তথ্যদাতাই তাঁদের ইচ্ছাগুলো সম্পর্কে স্পষ্টত ওয়াকিবহাল। তাঁদের স্বপ্নের দেশ তাঁদের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সততা, কর্মসংস্থান, ভালো বেতন, মনের শান্তি, ব্যক্তিগত উন্নয়ন এবং সম্মানের পরিসর দিতে পারবে। এ রকম অবস্থা নিশ্চিত করতে পারে, এমন অনেকগুলো দেশের নাম তাঁরা উল্লেখ করেন: সুইজারল্যান্ড, জাপান, স্পেন ও কানাডা; এসব রাষ্ট্রকেই ‘উন্নত’ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। যদিও ইংরেজিভাষী দেশগুলো তুলনামূলক জনপ্রিয়, তবে অনেক তথ্যদাতাই তাঁদের ইংরেজির দক্ষতা এবং তারা কোনো ইংরেজি ভাষার পরীক্ষা পাস করতে পারবেন কি না সে বিষয়ে সন্দিহান। ফিনল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, স্পেন, নেদারল্যান্ডস ইত্যাদি দেশের নামও কথোপকথনের সময় তথ্যদাতারা হরহামেশাই উল্লেখ করেছেন।

আমার বন্ধুর মেয়ে উইনা, তাঁর ভবিষ্যত্ পড়াশোনার জন্য তাঁর বাবা-মা যে রাষ্ট্র ঠিক করেছেন—ভারত—সে বিষয়ে স্পষ্টত ভিন্নমত পোষণ করেন। তিনি আমার কাছে অভিযোগ করেছেন যে যদি পড়াশোনার জন্য তিনি ইউরোপকে বেছে না নেন তবে তাঁর বন্ধুরা তাঁকে নিয়ে উপহাস করবেন এবং কানাডা বা যুক্তরাষ্ট্র হলে তা আরও ভালো হয়। একই সঙ্গে তিনি এটাও বুঝতে পারছেন যে ইউরোপ বা যুক্তরাষ্ট্রের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হলে তাঁর একটি বৃত্তির প্রয়োজন। তিনি বর্তমানে একটি বৃত্তির আবেদনের ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করছেন এবং জার্মান এবং ফ্রেঞ্চ ভাষায় দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য দৃঢ়ভাবে চেষ্টা করছেন। উইনা বিদেশ যেতে অনড় এবং এর ব্যবস্থা করতে বাস্তবিক অর্থেই প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। তাঁর গল্প স্বপ্নের গন্তব্যের একটি স্পষ্ট ক্রম আমাদের সামনে তুলে ধরে।

তারপরও বাস্তববাদী আকাঙ্ক্ষা এবং দুষ্প্রাপ্য কল্পনার মধ্যে একটি স্পষ্ট পার্থক্য থেকেই যায়। এই গবেষণায় অংশগ্রহণকারী অধিকাংশ তরুণ-তরুণীরই কোনো সুপরিকল্পিত কর্মপরিকল্পনা এবং প্রয়োজনীয় সংগতি নেই। কারও কারও একটি স্বপ্নের দেশ থাকে, কিন্তু কারণটা বেশ পরিষ্কার নয়। ২৪ বছর বয়সী লিসা আয়ারল্যান্ড যেতে ইচ্ছুক। কেন সে আয়ারল্যান্ড যেতে চায়, এমন প্রশ্ন করলে সে হাসিসমেত উত্তর দেয়, ‘আমি জানি না; একটি কারণ হতে পারে এটি একটি দ্বীপরাষ্ট্র। আমি এটা পছন্দ করি কিন্তু কেন তা জানি না; এটি একটি নির্জন জায়গা এবং খুবই নিরুপদ্রব।’ ১৯ বছর বয়সী আকিদ স্পেন যাওয়ার স্বপ্ন দেখে, কিন্তু কবিরের সঙ্গে সাক্ষাত্কারের সময় নেদারল্যান্ডসের কথা শুনে সে তাঁর মত পাল্টায়, ‘আগে আমি স্পেন যেতে চাইতাম; কিন্তু আপনার কাছ থেকে শোনার পর, এখন নেদারল্যান্ডস যাওয়ার ইচ্ছাও আমার হচ্ছে, আমার নেদারল্যান্ডস যেতে খুব ইচ্ছা করছে।’ মিজানের স্বপ্ন ফিনল্যান্ড যাওয়ার। তিনি পত্রিকায় ফিনল্যান্ড সম্পর্কে পড়েছেন এবং অন্য শিক্ষার্থীদের এ সম্পর্কে বলতে শুনেছেন। তাঁর কাছে ফিনল্যান্ড অর্থ একটি শান্ত এবং জনশূন্য রাষ্ট্র, যেখানে তিনি বাংলাদেশের চেয়ে বেশি টাকা উপার্জন করতে পারবেন। তিনি ঠান্ডা আবহাওয়াও পছন্দ করেন এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলেন, ‘সেখানে বড় মাঠ এবং খোলা জায়গাসহ নদী থাকবে, যেখানে আমি আমার অবসর কাটাতে পারব। ...এখানে আমার সময়ও নাই, আবার সুযোগও নাই; কিন্তু আমি মনে করি সেখানে আমার হাতে অবসর সময় থাকবে।’

হূদয়ের (৩০ বছর বয়স এবং বিবাহিত) বিষয়টি কিছুটা ভিন্ন। তাঁর একটি স্পষ্ট কর্মপরিকল্পনা ছিল, ‘আমি মধ্যপ্রাচ্য বা মালয়েশিয়ার মতো কাছাকাছি কোনো স্থানে যেতে চাই, যেখানে আমার মতো লোকের জন্য চাকরি আছে। আমি কাতার বা এ রকম কোনো একটি দেশে চাকরি পেতে পারি ... প্রথমে মালয়েশিয়া যাওয়াই ভালো, যেখানে কোনো ঝক্কিঝামেলা ছাড়া আমি প্রয়োজনীয় তথ্য পেতে পারি, সেখান থেকে আমি সুইজারল্যান্ড যেতে পারি।’

উপসংহার

গ্যালাপের (আইসিপোভা এবং অন্যান্য, ২০১০-২০১১) মতো বিস্তৃত জরিপ থেকে এটা নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে যে বর্তমানে আন্তদেশীয় অভিবাসনের, বিশেষত ‘বৈশ্বিক দক্ষিণে’, একটি ক্রমবর্ধমান এবং ব্যাপকভাবে বিস্তৃত আকাঙ্ক্ষা বিদ্যমান। এই প্রবন্ধে যুক্তি দেখানো হয়েছে যে এই ধারা বাস্তবিক অর্থে বড় ধরনের অভিবাসনকে নির্দেশ করে না। ঢাকার শিক্ষিত (নিম্ন) মধ্যবিত্ত তরুণ-তরুণীদের মতামতের ভিত্তিতে এই প্রবন্ধে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে যে এসব তরুণ-তরুণীর মধ্যে অনেকের জন্য আন্তদেশীয় অভিবাসনের আকাঙ্ক্ষার এই বহিঃপ্রকাশ হতাশা এবং অসম্পৃক্ততাবর্তমানের একটি রূপকমাত্র। অভিবাসন গতিবিধির কর্মকাঠামোর মধ্যে এসব হতাশাকে ব্যাখ্যা করার পরিবর্তে, এই প্রবন্ধে একটি বিস্তৃত ব্যাখ্যা প্রদানের চেষ্টা করা হয়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, দ্রুত নগরায়ণ এবং শিক্ষায় ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগের ফলে বিকাশমান (নিম্ন) মধ্যবিত্ত তরুণ-তরুণীদের মধ্যে ‘আধুনিক’ জীবনাচরণের আকাঙ্ক্ষা জন্ম নিচ্ছে, যা তাঁদের নিজেদের দেশে পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এর ফলে বাংলাদেশের সঙ্গে একধরনের অসম্পৃক্ততা তৈরি হচ্ছে।

কীভাবে স্থানীয় জীবনাচরণের (পুনঃ) মূল্যায়ন সাংস্কৃতিকভাবে অনুবিদ্ধ বিদেশের কল্পনার সঙ্গে সম্পর্কিত, তার ওপর এই প্রবন্ধে বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। প্রায় সব তথ্যদাতাই উল্লেখ করেছেন যে স্থানীয় আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও অস্তিত্বের নিরাপত্তাহীনতার কারণেই তারা বিদেশে ‘নিরাপদ’ স্থানে যেতে চান, যেখানে তাঁদের স্বপ্নগুলো পূরণ হতে পারে। তারা সবাই বাংলাদেশের প্রতি একধরনের অনীহা পোষণ করেন, যা তাঁরা মেগাসিটি ঢাকার অসহনীয় পরিবেশ, লাগামহীন নগরায়ণ নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রের ব্যর্থতা, ব্যাপক দুর্নীতি এবং সর্বোপরি নৈতিকতার অনুপস্থিতির কাহিনিগুলোর মাধ্যমে প্রকাশ করেন।

আমাদের তথ্যদাতা তরুণ-তরুণীরা বাংলাদেশে যা অর্জন করতে পারেন না, তা অর্জন করার জন্য (উন্নত) বিদেশে যেতে চান (দেখুন, গার্ডেনার, ১৯৯৩, ২০০৮)। ‘উন্নত উত্তরে’ তাঁদের স্বপ্নের দেশগুলোকে তাঁরা বৈষম্য, সংঘর্ষ ও দুর্নীতিহীন পরিষ্কার এবং উন্মুক্ত স্থান হিসেবে কল্পনা করেন; যেখানে মানুষ একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, যেখানে প্রচুর এবং উপযুক্ত চাকরি, যথাযথ ও উচ্চ পর্যায়ের শিক্ষা এবং ব্যক্তিগত উন্নয়নের প্রয়োজনীয় সুযোগ রয়েছে। আমাদের এই গবেষণায় অংশগ্রহণকারী কতজন শেষ পর্যন্ত বিদেশে যেতে পেরেছেন, তা আমাদের জানা নেই; তবে এটা বলে শেষ করা নিরাপদ যে তাঁদের অধিকাংশকেই, বৈশ্বিক দক্ষিণে অন্যান্য কয়েক লাখ লোকের মতোই প্রতিশ্রুতিপূর্ণ বিশ্ব, প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থ স্বদেশ এবং কখনো পূরণ না হওয়া ব্যক্তিগত স্বপ্ন নিয়েই বাঁচতে হবে (আরও দেখুন, অচিলা এবং অচিলা, ২০০৬)।

তথ্যসূত্র:

১.         এই গবেষণা প্রকল্পের প্রতি দায়বদ্ধতা এবং সহযোগিতার জন্য আমি এস হাজং এবং এইচ কবিরের কাছে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ। এই প্রবন্ধের অধিকাংশ সাক্ষাত্কার কবির গ্রহণ করেছেন। তবে এর বিষয়সূচি আমারই তৈরি করা। ইডেন বার্টেলস, ইরিলা গ্রাসিয়ানি, ডাইয়েনকি হন্ডিয়াস, হুমায়ুন কবির, পেগি লেভিট, লোরেন নেন্সেল, ক্যাথিনকা সিনহা ক্যার্কহফ, রুস উইলিয়ামস এবং অজ্ঞাতনামা পিয়ার রেফারারদের মূল্যবান মতামতের জন্য তাঁদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। এই প্রকল্পটির অর্থায়ন করেছে ভিইউ ইউনিভার্সিটি আমস্টার্ডামের সেন্টার ফর কম্পারেটিভ সোশ্যাল স্টাডিজ (সিসিএসএস)।

২.         সাব-সাহারান আফ্রিকার ৩৬ শতাংশ মানুষ বিদেশে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। এশীয় দেশগুলোতে অভিবাসনে আগ্রহী মানুষ মাত্র ১০ শতাংশ, কিন্তু তার অর্থ প্রায় ২৫০ মিলিয়ন প্রাপ্তবয়স্ক।

৩.        অধিকাংশ সাক্ষাত্কার বাংলায় গ্রহণ করা হয়েছে এবং তারপর ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়েছে। তথ্যদাতাদের প্রকৃত পরিচয় গোপন করার জন্য আমি ছদ্মনাম ব্যবহার করেছি।

৪.         ডাচ বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থায়, প্রাতিষ্ঠানিক নৈতিকতা কমিটি সেভাবে চোখে পড়ে না। এ কারণেই গবেষককে গবেষণার নৈতিক দিকটির দিকে ক্রমাগত দৃষ্টি রাখতে হয়। সব তথ্যদাতাই এই গবেষণার লক্ষ্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন এবং জানতেন যে তাঁদের প্রকৃত পরিচয় গোপন করা হবে।

৫.         ১৯৯০-এর দশকের প্রথম থেকে বাংলাদেশে আমার অধিকাংশ গবেষণা বাংলাদেশের অ-মুসলিম, অ-বাঙালি ক্ষুদ্র আদিবাসী গোষ্ঠী গারোদের কেন্দ্র করে ছিল (উদাহরণস্বরূপ দেখুন, ব্যাল, ২০০৭)।

৬.        বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের একটি শহরে পরিচালিত গবেষণার মাধ্যমে আবু আহসান দক্ষতার সঙ্গে দেখিয়েছেন, কীভাবে কলেজে শিক্ষা গ্রহণকে বৃহত্ অর্থে আধুনিকায়ন এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চলিষ্ণুতার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। শিক্ষিত হওয়ার ফলে ব্যক্তি সমাজে সভ্য অবস্থান লাভ করেন এবং একই সঙ্গে একটি শিক্ষিত ‘আধুনিক’ জীবনাচরণ এবং ভোগ ধারার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন (আহসান, ২০০৯)।

৭.         দেখুন, http://www.gallup.com/poll/153992/150-Million-Adults-Worldwide-Migrate

৮.        দেখুন, http://www.indexmundi.com/facts/indicators/ SE.ADT.LITR.ZS/ compare#country = bd

৯.         নিম্নমানের নির্মাণকাজের একটি বীভত্স উদাহরণ হচ্ছে রানা প্লাজা ধস। এটি ঢাকার সাভারে অবস্থিত ৮ তলা একটি ভবন, যা ২৪ এপ্রিল, ২০১৩ সালে ধসে পড়ে। এই ভবনে ব্যাংক, দোকান এবং একটি তৈরি পোশাক কারখানা ছিল। এই ভবন ধসে ১১০০ মানুষ মারা যায় এবং প্রায় ২৫০০ মানুষ আহত হয়। হতাহতের অধিকাংশই ছিলেন নারী তৈরি পোশাকশ্রমিক।

১০.       শেখ মুজিবুর রহমান (মুজিব) ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের (১৯৭১) প্রথম প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক নেতা। ১৯৭৫ সালে তাঁর হত্যার তিন মাস পর জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠন করেন। ১৯৮১ সালে জিয়াকে হত্যা করা হয়। মুজিবের মেয়ে শেখ হাসিনা (আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতা), জিয়ার বিধবা স্ত্রী খালেদা জিয়া (বিএনপির নেতা) এবং তাঁদের দলের সদস্যরা একে অপরের সঙ্গে ক্রমাগত সহিংসতায় লিপ্ত রয়েছেন। তাদের বিবাদের বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে জাতীয় বিমানবন্দরের নামকরণ, স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ ইত্যাদি।

অনুবাদক: গোলাম মুস্তাফা

তথ্যপঞ্জি

                Ahasan, A., 2009. “My family didn’t send me to school to run a ‘betel leaf shop’!”: the cultural production of education and educated work in Domar, Bangladesh. Unpublished master thesis (M.A.) Sussex theses M 2597. Anthropology of Development and Social Transformation. University of Sussex.

                Ali, S., 2007. “Go west young man”: the culture of migration among Muslims in Hyderabad, India. Journal of Ethnic and Migration Studies, 33 (1), 37–58.

                Anderson, B., 1991. Imagined communities. London: Verso.

                Appadurai, A., 1996. Modernity at large: cultural dimensions of globalization. Minneapolis: University of Minnesota Press.

                Baas, M., 2009. Imagined mobility: migration and transnationalism among Indian students in Australia. Dissertation (PhD). University of Amsterdam.

                Bal, E., 2007. They ask if we eat frogs: Garo ethnicity in Bangladesh. Singapore: ISEAS.

                Carling, J., 2002. Migration in the age of involuntary immobility: theoretical reflections and Cape Verdean experiences. Journal of Ethnic and Migration Studies, 28 (1), 5–42.

                Castles, S., 2000. International migration at the beginning of the twenty-first century: global trends and issues. International Social Science Journal, 52 (165), 269–281.

                Esipova, N., Ray, J., and Srinivasan, R., 2010/2011. The world’s potential migrants: who they are, where they want to go, and

why it matters. 2010–2011, Gallop. Available from: http://www.imi.ox.ac.uk/pdfs/the-worlds-potential-migrants [Accessed 19 July 2011].

                Fox, J. E. and Miller-Idriss, C., 2008. Everyday nationhood. Ethnicities, 8, 536–563. Gardner, K., 1993. Desh-bidesh: Sylheti images of home and away. Man: A Monthly Record of Anthropological Science, 28 (1), 1–16.

                Gardner, K., 2008. Keeping connected: security, place and social capital in a “Londoni” village in Sylhet. Journal of the Royal Anthropological Institute, 14, 477–495.

                Gurjar, B.R., et al., 2008. Evaluation of emissions and air quality in megacities. Atmospheric Environment, 42, 1593–1606.

                Horváth, I., 2008. The culture of migration of rural Romanian youth. Ethnic and Migration Studies, 34 (5), 771–786.

                Jeffrey, G., 2009. Fixing futures: educated unemployment through a North Indian lens. Comparative Studies in Society and History, 51, 182–211.

                Jónsson, G., 2008. Migration aspirations and immobility in a Malian Soninke village. Working Paper No. 10. International Migration Institute, University of Oxford.

                Kandel, W. and Massey, D. S., 2002. The culture of Mexican migration: a theoretical and empirical analysis. Social Forces, 80 (3), 981–1004.

                Karim, L., 1998. Pushed to the margins: adivasi peoples in Bangladesh and the case of Kalpana Chakma. Contemporary South Asia, 7 (3), 301–316.

                King, R. and Skeldon, R., 2010. Mind the gap’ integrating approaches to internal and international migration. Journal of Ethnic and Migration Studies, 36 (10), 1619–1646.

                Levitt, P. and Glick Schiller, N., 2004. Conceptualizing simultaneity: a transnational social field perspective on society. International Migration Review, 38 (3), 1002–1039.

                Lewis, D., 2011. Bangladesh: politics, economy and civil society. Cambridge: Cambridge University Press.

                Massey, M., et al., 1993. Theories of international migration: a review and appraisal. Population and Development Review, 19 (3), 431–466.

                O’Reilly, K., 2012. Ethnographic methods. 2nd ed. London: Routledge.

                Osella, C. and Osella, F., 2006. Once upon a time in the West? Stories of migration and modernity from Kerala, South India. Journal of the Royal Anthropological Institute, 12, 569–588.

                Rahman, M. M. and Alamgir Kabir, M., 2012. Moving to Europe: Bangladeshi migration to Italy. Series: ISAS Working Papers 142. Institute of South Asian Studies (ISAS), Singapore.

                Rudnick, A., 2009. Working gendered boundaries: temporary migration experiences of Bangladeshi women in the Malaysian export industry from a multi-sited perspective. Amsterdam University Press.

                Sabur, S., 2013. It is the state who needs the holy trinity of nation-nationality-nationalism and a common enemy. Alal O Dulal, 6 May. Available from: http://alalodulal.org/2013/05/06/seuty-sabur/ [Accessed 28 Aug 2013].

                Ullah, A. A., 2010. Rationalizing migration decisions: labour migrants in east and southeast Asia. Farnham: Ashgate.

                Van Schendel, W., 2009. A history of Bangladesh. Cambridge University Press.

                Zeitlyn, B., 2012. Maintaining transnational social fields: the role of visits to Bangladesh for British Bangladeshi children. Journal of Ethnic and Migration Studies, 38 (6), 953–968.