গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদী অববাহিকায় বাঁধ নির্মাণ প্রতিযোগিতা এবং পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার ভবিষ্যত্

সারসংক্ষেপ

গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদী অববাহিকা প্রায় ১.৭ মিলিয়ন কিলোমিটার জায়গাজুড়ে বিস্তৃত; যেখানে চীন, ভারত, নেপাল, ভুটান ও বাংলাদেশের মিলিয়ন জনসংখ্যার বাস। এই তিন নদী এই পাঁচ রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক, সামাজিক, শিল্পায়ন, কৃষি-বাণিজ্য ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। দক্ষিণ এশিয়ার এই অঞ্চলে বিশ্বের মোট দরিদ্রের ৪০ শতাংশের বসবাস। বর্তমানে রাষ্ট্রগুলো জনসংখ্যা বৃদ্ধি, দ্রুত শিল্পায়ন ও নগরায়ণের ফলে পানিসম্পদের ওপর অব্যাহত চাপ মোকাবিলা করছে। আর এই চাপ মোকাবিলায় এই নদী অববাহিকায় রাষ্ট্রসমূহ গড়ে তুলছে বিশালকার বাঁধ/ড্যাম। বাঁধ তৈরির উদ্দেশ্য হচ্ছে বিদ্যুতের চাহিদা মেটানো, সেচের জন্য পানি সরবরাহ, শুষ্ক মৌসুমে পানি সংরক্ষণ করা ইত্যাদি। যদিও গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদী অববাহিকার রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ে এখনো তেমন কার্যকর আন্তসীমানা নদীর পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত চুক্তি ও আঞ্চলিক অবকাঠামো গড়ে ওঠেনি। এ অবস্থায় অব্যাহত বাঁধ নির্মাণ পরস্পরের মধ্যে তৈরি করছে সন্দেহ ও অবিশ্বাস। এই পরিপ্রেক্ষিতে এই নদী অববাহিকায় বাঁধ নির্মাণ প্রতিযোগিতা কীভাবে আন্তসীমানা নদীর পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনাকে সংকটে ফেলছে তা এই প্রবন্ধের মূল আলোচ্য বিষয়। এখানে বাঁধ নির্মাণ কীভাবে আন্তসীমানা নদীর পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার তিনটি মূলনীতি যথা: পানির সমতাভিত্তিক ও যৌক্তিক ব্যবহার, পারস্পরিক সহযোগিতার জন্য প্রয়োজনীয় কাঠামো নির্মাণ ও দায়িত্ব পালনের মানসিকতা, সংকট ও দণ্ড নিরসন-কাঠামোর প্রতি হুমকি সৃষ্টি করছে তা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

মুখ্য শব্দগুচ্ছ

নদী, দক্ষিণ এশিয়া, পানিসম্পদ, গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা, বাংলাদেশ, বাঁধ, পানি ও রাজনীতি।

ভূমিকা

দক্ষিণ এশিয়ার বিশাল ও সুগভীর নদীসমূহ বিশ্বের কাছে অতিপরিচিত। হিমালয় থেকে উত্পন্ন এসব নদী বঙ্গোপসাগরের মাঝ থেকে দক্ষিণ এশিয়ার সৃষ্টিতে হাজার হাজার বছর ধরে পলিমাটি সরবরাহ করে আসছে। এই নদীগুলোর দুই পারে গড়ে উঠেছে বহু সভ্যতা, নগররাষ্ট্র আর জনবসতি। দক্ষিণ এশিয়ার নদীগুলোর মধ্যে অন্যতম তিন নদী গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা অববাহিকায় পৃথিবীর বৃহত্তর জনবসতি গড়ে উঠেছে, যা আজকের আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাষ্ট্রগুলো দ্বারা পরিচিত। আয়তনের দিক থেকে বিশ্বে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা অববাহিকার অবস্থান তৃতীয়, যা আমাজন ও কঙ্গো নদী অববাহিকার পরে অবস্থান করছে।১ এই অববাহিকার অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচটি রাষ্ট্র যথা: ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান ও চীনের মধ্যে, যা এই দেশগুলোর বিলিয়ন জনগোষ্ঠীর জীবন ধারণ ও জীবিকার ব্যবস্থা করেছে। সেচের জন্য প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহ করে হাজার হাজার জমিকে আবাদি করেছে।২ যদিও ক্রমাগত জনসংখ্যার চাপ ও চাহিদা মোকাবিলা, শিল্পকারখানার বিকাশ, বিদ্যুত্ উত্পাদনে এর ব্যাপক চাহিদা এই নদী অববাহিকার পানিসম্পদের ওপর ক্রমান্বয়ে চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছে। প্রকৃতির এই সম্পদ পানি এখন হয়ে গেছে প্রতিযোগিতামূলক পণ্য, যা রাষ্ট্রগুলো নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য তাদের নিজ নিজ ভূখণ্ডে গড়ে তুলছে বিশাল বাঁধ, ড্যাম ও জলাধার। প্রাকৃতিক সম্পদ এই পানির ওপর রাষ্ট্রগুলোর অধিক নিয়ন্ত্রণ প্রকারান্তরে তাদের ভেতর তৈরি করছে পারস্পরিক অবিশ্বাস আর আস্থাহীনতা। রাষ্ট্রগুলোর নদীর পানিতে অধিকার, এর ব্যবহার এবং অভিগম্যতা বিষয়ে দেশগুলোর মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে মতানৈক্য। চালেনির ভাষায়, বর্তমানে আন্তর্জাতিক নদীর ওপর বাঁধ নির্মাণ আন্তরাষ্ট্রীয় দ্বন্দ্বের অন্যতম উত্স।৩ তাঁর মতে, এশিয়ায় বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বাঁধ রয়েছে, যার সঙ্গে আরও বেশ কিছু নির্মাণাধীন বাঁধ আগামী কয়েক বছরে যোগ হবে। দক্ষিণ এশিয়ার গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা অববাহিকায় আরও কিছু বাঁধ যুক্ত হবে। সম্প্রতি চীন তিব্বতের জাংবো নদীতে ৫১০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ‘জাংবো মেগা ড্যাম’ চালু করেছে। জাংবো নদীটি প্রায় তিব্বতের ভেতর দিয়ে ১৬২৫ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে ভারতের অরুণাচল প্রদেশে সিয়াং নাম ধারণ করেছে। অরুণাচলে নদীটি দুটি ধারায় যথাক্রমে ডিবাং ও লোহিত নামে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে ব্রহ্মপুত্র নাম ধারণ করে প্রবাহিত হয়েছে।

রাষ্ট্রগুলো কেন বাঁধ নির্মাণে আগ্রহী? এর কারণ অনেক। যার মধ্যে কৃষির জন্য সেচকার্য, জলবিদ্যুত্ উত্পাদন, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, সুপেয় পানি সরবরাহ, কলকারখানায় পানি সরবরাহ এবং জলজ সম্পদ আহরণ করা। বাঁধ নির্মাণে এশিয়ার রাষ্ট্রগুলো পশ্চিমা দেশগুলোকে পেছনে ফেলে দিয়েছে। চীনের ইয়াংটজি নদীর ওপর নির্মিত থ্রি গর্জেস বাঁধ ১.৪ কিলোমিটার লম্বা ও ৬০৭ ফুট উঁচু, যা যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো নদীর ওপর নির্মিত হোভার ড্যাম থেকে ৫ গুণ বড়।

কিন্তু বাঁধ নির্মাণের ফলে রাষ্ট্রের জনগোষ্ঠীকে যেমন কষ্ট স্বীকার করতে হয়, তেমনি অভিন্ন নদীর ওপর নির্ভরশীল পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের জনগণকেও এর ফল ভোগ করতে হয়। ১৯৫০ থেকে ২০০০ পর্যন্ত সময়কালে চীনে বাঁধ নির্মাণের ফলে ১২ মিলিয়ন মানুষ স্থানচ্যুত হয়েছে।৪ ভারতে বাঁধ নির্মাণের ফলে স্থানচ্যুতির সংখ্যা প্রায় ৪০ মিলিয়ন।৫ বাঁধ নির্মাণের ফলে জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক, পারিবারিক, সামাজিক যোগাযোগ ও প্রকৃতির ক্ষতির হিসাব ব্যাপক হওয়া সত্ত্বেও বাঁধ নির্মাণের প্রতিযোগিতা অব্যাহত আছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে দক্ষিণ এশিয়ায় আন্তনদী পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার ভবিষ্যত্ নিয়ে একটি নির্মোহ আলোচনার উদ্দেশ্যে এই প্রবন্ধের পরবর্তী অধ্যায়গুলোকে সাজানো হয়েছে।

দক্ষিণ এশিয়ায় আন্তসীমানা নদীর পানি ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব অপরিসীম, যা পানিকে বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক পণ্য থেকে গণপণ্যে রূপান্তর করবে। রাজনৈতিক-অর্থনীতির দিক দিয়ে গণপণ্যের সংজ্ঞায় বলা হচ্ছে যে এই পণ্য সবার জন্য উন্মুক্ত, এর ব্যবহার সবাই করতে পারে এবং এই পণ্যের প্রতি অভিগম্যতার জন্য কাউকে বাধা দেওয়া যাবে না। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা অববাহিকার পানিসম্পদের সঠিক ব্যবহারের জন্য অববাহিকায় অবস্থিত রাষ্ট্রগুলোর সমন্বিত ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন, যাতে এর সুফল সবাই ভোগ করতে পারে। এবং এক রাষ্ট্রের পানি ব্যবহারে অন্য রাষ্ট্র যেন ক্ষতির শিকার না হয় এটাই আন্তসীমানা নদীর পানিসম্পদ পানি ব্যবস্থাপনার মূল উদ্দেশ্য। যদিও এই অববাহিকার পানি রাষ্ট্রের সার্বভৌম অধিকার, নাকি গণপণ্য তা নিয়ে মতবিরোধ আছে। কিন্তু একটা বিষয় উল্লেখ না করলেই নয় যে, দক্ষিণ এশিয়ার জনগণ ইতিমধ্যে পানির সংকট মোকাবিলা করছে। পানিসম্পদের অব্যবস্থাপনা, প্রাকৃতিকভাবে ক্ষতিকর অবকাঠামো নির্মাণ, মাত্রাতিরিক্ত দূষণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাব ও রাষ্ট্রগুলোর পারস্পরিক সহযোগিতা ও সমন্বয়ের ঘাটতি এই অঞ্চলের পানিসংকটকে আরও তীব্রতর করবে।৬ এই অববাহিকায় প্রায় ৬৩০ মিলিয়ন মানুষের বসবাস। সুতরাং বাঁধ নির্মাণ প্রতিযোগিতা তাদের জন্য আর্থসামাজিক ও পারিবারিক ঝুঁকি সৃষ্টি করবে। এই উদ্ভূত সংকটকে মাথায় রেখে এই প্রবন্ধকে তিনটি অংশে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম অংশে আন্তসীমানা নদীর পানি ব্যবস্থাপনা ও আন্তরাষ্ট্রীয় নদীর পানি বণ্টন ও ব্যবহারকেন্দ্রিক সংঘাতের মধ্যে তাত্ত্বিক যোগসূত্র খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে। এই অংশে কিছু বৈশ্বিক উদাহরণ আনা হয়েছে নদীর পানিকেন্দ্রিক সংঘাতের পক্ষে।

দ্বিতীয় অংশে এই অববাহিকায় বাঁধ নির্মাণ প্রতিযোগিতা কীভাবে আন্তনদী পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনাকে সংকটে ফেলছে তা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তৃতীয় অংশে সন্নিবেশ করা হয়েছে কিছু সুপারিশ।

আন্তসীমানা নদীর পানি ব্যবস্থাপনা এবং পানিকেন্দ্রিক সংকট ও সংঘাতের মধ্যে তাত্ত্বিক যোগসূত্র

অ্যানা স্যুলজ-এর মতে, পানি প্রকৃতির সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ, যা মানুষের জীবন ও জীবিকার জন্য অপরিহার্য। কিন্তু এই পানি নিয়ে সমস্যার সৃষ্টি হয় যখন এই সম্পদ বণ্টনব্যবস্থা কার্যকর, টেকসই ও সবার জন্য সুবিধাজনক না হয়।৭ গত কয়েক দশকে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রগুলো প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জন করেছে। এই প্রযুক্তিগত দক্ষতা প্রমত্তা নদীর ওপর বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণে সহায়তা করেছে। এর ফলে রাষ্ট্র বিপুল পরিমাণে অর্থ ও প্রযুক্তি ব্যবহার করছে আন্তনদীর পানিসম্পদ আহরণের জন্য।৮ পৃথিবীতে যেসব নদী একাধিক রাষ্ট্রের সীমানার অভ্যন্তরে প্রবহমান তাদের আন্তর্জাতিক নদী বলা হয়ে থাকে। ‘অ্যাটলাস অব দ্য ইন্টারন্যাশনাল ফ্রেসওয়াটার অ্যাগ্রিমেন্ট’-এর মতে, পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি বড় নদী এক বা একাধিক রাষ্ট্রের ভেতর দিয়ে প্রবহমান।৯ যার মধ্যে কঙ্গো, নাইজার, নাইল, রাইন ও জাম্বেজি নদীগুলো প্রবাহিত হয়েছে ৯ বা এর অধিক রাষ্ট্রের মধ্য দিয়ে। অন্যদিকে আমাজন, ওরাল সাগর, গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা, জর্ডান, মেকং, নেমান, টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিস-শাতিল আরব ও ভলগা নদীগুলো প্রবাহিত হয়েছে কমপক্ষে পাঁচটি দেশের মধ্য দিয়ে।১০ যদিও এসব নদীর পানির ব্যবহার নিয়ে রয়েছে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে বিবাদ ও দ্বন্দ্ব। পৃথিবীতে প্রায় ২৬৩টি আন্তসীমানা নদী অববাহিকা রয়েছে, যা একাধিক রাষ্ট্রের মধ্যে অবস্থিত। আর তাই রাষ্ট্রগুলো সর্বদা বিভিন্ন কূটনৈতিক তত্পরতায় লিপ্ত থাকে এই অপ্রতুল ও অপরিহার্য সম্পদ আহরণের জন্য।১১ আন্তসীমানা নদীর পানিকেন্দ্রিক সংকট এবং সংঘাত সাধারণত সৃষ্টি হয় যখন নদীর পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনাকেন্দ্রিক কোনো প্রকার চুক্তি, প্রতিষ্ঠান এবং কর্তৃপক্ষ কার্যকর থাকে না। যার ফলে নদীকেন্দ্রিক অববাহিকা রাষ্ট্রগুলোর উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের দ্বারা নদীর পানিপ্রবাহের ব্যাপক পরিবর্তনকে যথাযথভাবে আমলে আনা সম্ভব হয় না। ফলে অববাহিকা রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে পরস্পরের উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ দানা বাঁধতে থাকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আন্তনদীর ওপর নির্মিত বাঁধ, ব্যারাজ, আন্তনদী প্রকল্প নদীর পানিপ্রবাহের ওপর স্থায়ী পরিবর্তন সাধন করে। নদী অববাহিকা রাষ্ট্রগুলো এই পরিবর্তনের কুফল ভোগ করে। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক নদীশাসন চুক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো এই কুফলের মাত্রা কমাতে পারে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে। এই সহযোগিতামূলক নদী অবকাঠামোগত প্রতিষ্ঠান উজানে অবস্থিত রাষ্ট্রগুলোকে একতরফা নদীর পানি প্রত্যাহার করতে নিরুত্সাহিত করে। অন্যথায় একতরফা অবকাঠামো নির্মাণ ও পানি প্রত্যাহার চলতেই থাকে। এতে করে অববাহিকা অঞ্চলে পানিকেন্দ্রিক সংকট সৃষ্টি হতে পারে। পানি সরবরাহের ঘাটতি একটি দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্যও হুমকি। বর্তমানে শিল্প ও কৃষি খাতে ব্যাপক পানির চাহিদা বাড়ছে। কোনো কারণে সেই পানির ঘাটতি হলে দেশের শিল্প ও কৃষি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। যাতে করে বেকারত্ব, মহামারি, খাদ্যসংকট ও কোন্দলের সৃষ্টি হতে পারে। এই বিষয়টি উপলব্ধি করে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান বলেছিলেন, ‘পৃথিবীতে সুপেয় পানি নিয়ে চলমান ভয়াবহ প্রতিযোগিতা ভবিষ্যতে সংকট ও যুদ্ধের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়াবে’।১২ দ্বন্দ্ব-এর ইংরেজি rival শব্দটি এসেছে লাতিন (rivus) থেকে, যার অর্থ পানির ধারা, যা অনেকে ব্যবহার করে থাকে।১৩ আন্তর্জাতিক নদীর পানি নিয়ে দ্বন্দ্ব সাধারণত কূটনৈতিক পর্যায়ে শুরু হয় অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগের মাধ্যমে। এসব অভিযোগের সঠিক তদন্ত ও সমাধানের উদ্যোগ না নিলে পরবর্তী সময়ে তা স্থায়ী সংঘাতে রূপ নেয়। অনেক সময় এসব দ্বন্দ্বের কারণে রাষ্ট্রগুলো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে। উদাহরণস্বরূপ জর্ডান নদীর পানিবণ্টনকে কেন্দ্র করে ইসরায়েল, জর্ডান, লেবানন, সিরিয়া এবং পশ্চিম তীরের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলে আসছে। ১৯২০ সাল থেকে মিসর ও সুদান নীল নদের পানি ব্যবহার করে আসছে। বর্তমানে ইথিওপিয়া নীল নদের ওপর বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প হাতে নিয়েছে, যা মিসর ও সুদান বিরোধিতা করেছে। ১৯৫০-এর দশক থেকে দুই কোরিয়ার মধ্যে যুদ্ধাবস্থা চলে আসছে। ১৯৮০-এর প্রথমভাগে দক্ষিণ কোরিয়া কর্তৃক হান নদীর ওপর বাঁধ নির্মাণ দুই কোরিয়ার মাঝে প্রায় যুদ্ধাবস্থা তৈরি করে।

পানি নিরাপত্তাবিষয়ক আন্তর্জাতিক ‘মিনিস্টেরিয়াল ডিক্লারেশন অব দ্য হ্যাগ অন ওয়াটার সিকিউরিটি ইন দ্য টোয়েন্টিফার্স্ট সেঞ্চুরি’-এ ‘আন্তসীমানা নদী’ শাসন বলতে পানিকে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে যৌক্তিক উপায়ের মাধ্যমে ব্যবস্থাপনাকে বোঝানো হয়েছে, যাতে করে নদীর ওপর নির্ভরশীল সব জনগোষ্ঠী, রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠানসহ সকল পক্ষের স্বার্থ রক্ষা হয়।১৪ পরবর্তী সময়ে ‘গ্লোবাল ওয়াটার পার্টনারশিপ ডায়ালগ অন ইফেক্টিভ ওয়াটার গভর্নেন্স’ আন্তসীমানায় অবস্থিত নদীগুলো ব্যবস্থাপনার জন্য পানি সুশাসনের ওপর একটি ধারণাগত কাঠামো তৈরি করেছে।১৫ তাদের মতে, পানি ব্যবস্থাপনা শাসন হতে হবে স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক, দীর্ঘমেয়াদি টেকসই ও সাম্যতার ভিত্তিতে। ১৯৯৭ সালের জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক আয়োজিত ‘কনভেনশন অন দ্য ল অব দ্য নন-নেভিগেশনাল ইউজেস অব ইন্টারন্যাশনাল ওয়াটারকোর্সেস’১৬ আন্তসীমানা নদীর পানি ব্যবস্থাপনার জন্য পানি সুশাসনের তিনটি মূলনীতিকে সমর্থন করে। সেগুলো হলো:

ষ          পানির সমতাভিত্তিক ও যৌক্তিক ব্যবহার।১৭

ষ          পারস্পরিক সহযোগিতার জন্য প্রয়োজনীয় কাঠামো নির্মাণ ও দায়িত্ব পালনের মানসিকতা।

ষ          সংকট ও দ্বন্দ্ব মোকাবিলায় সকল পক্ষের সমঝোতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া।

নদী অববাহিকায় রাষ্ট্রগুলোর জন্য এই বিশেষ তিনটি দায়িত্ব পালনের আহ্বান করা হয়। এদের মধ্যে যৌক্তিক ও সাম্যতার ভিত্তিতে নদীর পানির ব্যবহারকে আন্তসীমানা নদীর পানি সুশাসনের অন্যতম বলে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তর মেকং নদী অববাহিকায় অবস্থিত রাষ্ট্রগুলো এই নদীর পানি ব্যবস্থাপনায় যে চুক্তিতে উপনীত হয় সেখানে বলা হয়েছে যে রাষ্ট্রগুলো তাদের ভূখণ্ডে এই নদীর পানি যৌক্তিক ও সাম্যতার ভিত্তিতে ব্যবহার করবে। হেলসিংকি রুলে বলা আছে, প্রত্যেক রাষ্ট্র এই মূলনীতি পালন করবে সবার জন্য কল্যাণকর পানি ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে।১৮ এদিক থেকে বলা যায়, আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবস্থাপনা অববাহিকা রাষ্ট্রগুলোর একই সঙ্গে দায়িত্ব ও অধিকার। নিজ প্রয়োজনে নদীর পানি ব্যবহার হচ্ছে রাষ্ট্রগুলোর অধিকার, আর তাদের দায়িত্ব হচ্ছে এই অধিকার নিশ্চিত করতে গিয়ে অন্য রাষ্ট্রগুলোর অধিকারে হস্তক্ষেপ না করা এবং পারস্পরিক সাহায্য ও আদান-প্রদানের মাধ্যমে নদী অববাহিকার পানি সম্পদের নিরাপত্তা ও টেকসই উন্নয়ন সাধন, যা পক্ষান্তরে আঞ্চলিক সহযোগিতার একটি অনন্য মাইলফলক।

পানি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সহযোগিতামূলক মূলনীতি অববাহিকায় অবস্থানরত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে তাদের অংশের পানিসম্পদের উন্নয়নের ওপর জোর দিয়েছে। পারস্পরিক সহযোগিতার পরিধি বিস্তৃত হয়েছে, পানিসম্পদ উন্নয়নসংক্রান্ত নিজ নিজ রাষ্ট্রের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের তথ্যের আদান-প্রদান, সম্ভাব্য ক্ষতি ও লাভ-লোকসানের জরিপের ব্যবস্থা, অববাহিকার জনগোষ্ঠীর ভবিষ্যত্ পানির চাহিদা নিরূপণ, বৃহত্ নির্মাণ যেমন: বাঁধ, ড্যাম, ব্যারেজ প্রভৃতি নির্মাণের সময় আগাম তথ্য সরবরাহের ব্যবস্থা করা। অববাহিকা রাষ্ট্রগুলোর অবাধ তথ্যপ্রবাহ নদীসংক্রান্ত যেকোনো ধরনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সম্পর্কে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও সন্দেহ দূর করতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। ‘ইন্টারন্যাশনাল ওয়াটারকোর্স কনভেনশন’-এর ৮.১ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, সহযোগিতামূলক এই মূলনীতিটি রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বাস্তবায়ন সম্ভব, যখন তা অনুসরণ করা হয় সার্বভৌমত্বের প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধা, আঞ্চলিক অখণ্ডতা, পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে। এভাবে যেকোনো আন্তর্জাতিক নদী অববাহিকার সামগ্রিক উন্নয়ন সাধন করা সম্ভব।১৯

তৃতীয় ও সর্বশেষ মূলনীতি হচ্ছে, অববাহিকা রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে উদ্ভূত দ্বন্দ্ব নিরসনে একটি ‘দ্বন্দ্ব নিরসন ব্যবস্থা’ তৈরি এবং সেই ব্যবস্থা থেকে গৃহীত যেকোনো সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতিক্রমে সবাই মেনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি ও মানসিকতা। ওয়াটারকোর্স কনভেনশন-এ বলা হয়েছে, ‘দ্বন্দ্ব নিরসন ব্যবস্থা’-এর সঙ্গে একটি স্বাধীন তথ্য অনুসন্ধানব্যবস্থা গড়ে তোলা যায় অববাহিকার রাষ্ট্রগুলোর সমন্বয়ে, যাতে করে যেকোনো অভিযোগের অনুসন্ধান করা যায় এবং তথ্যের আদান-প্রদান করা যায়।

গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা অববাহিকায় পানির ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত সুশাসন অত্যন্ত জরুরি। বিশ্বের দুটি বৃহত্ জনবহুল রাষ্ট্র ভারত ও চীনের অবস্থান এই অববাহিকায়। এ ছাড়া এসব নদী নেপাল, বাংলাদেশ ও ভুটানের মধ্য দিয়েও প্রবাহিত হচ্ছে। এই অঞ্চলে যেভাবে দ্রুত হারে বাড়ছে জনসংখ্যা, সেভাবে বাড়ছে নগরায়ণ ও শিল্পায়ন, যা পানির চাহিদা দিনে দিনে বৃদ্ধি করছে। ইতিমধ্যে এই অঞ্চলে মাথাপিছু পানি ব্যবহারের পরিমাণ কমছে। বিভিন্ন রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে যে ২০৫০ সাল নাগাদ ভারতের জনগোষ্ঠী ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন হবে, যাতে করে মাথাপিছু পানির ব্যবহার কমে দাঁড়াবে ১৭৩১ কিউবিক মিটার।২০ বাংলাদেশে ২০২৫ সাল নাগাদ মাথাপিছু পানির পরিমাণ ৮৪৪৪ থেকে ৭৬৭০ কিউবিক মিটারে দাঁড়াবে এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তা আরও কমতে থাকবে।২১ এই অববাহিকার রাষ্ট্রগুলোর এই বর্ধিত চাহিদা মোকাবিলায় একতরফাভাবে এসব নদীর ওপর বিভিন্ন বাঁধ ও স্থাপনা নির্মাণ করে চলেছে, যার ফলে অনেক ক্ষেত্রে নদীর স্বাভাবিক গতিপথ ব্যাহত হচ্ছে। ফলে নদীর ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠী নানাভাবে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। এই অববাহিকা পৃথিবীর মোট স্থলভাগের ১ ভাগ কিন্তু এই ক্ষুদ্র অংশে পৃথিবীর মোট জনগোষ্ঠীর ১০ ভাগ মানুষ বসবাস করে। ফলে এই অঞ্চল অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ এবং এ কারণে নদীর স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ কোনো অঞ্চলে ব্যাহত হলে তা বিপুল জনগোষ্ঠীর জন্য হুমকি হয়ে ওঠে। এই অঞ্চলে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দরিদ্র লোকের বাস। সুতরাং তাদের জন্য পরিবেশগত হুমকি মোকাবিলা, নতুন জীবিকার সন্ধান ও নতুন আবাসস্থল নির্মাণ কষ্টসাধ্য। ডেভিড মাইকেল এবং অমিত পান্ডে তাঁদের ট্রাবলড ওয়াটার-ক্লাইমেট চেঞ্জ, হাইড্রো পলিটিকস অ্যান্ড ট্রান্সবাউন্ডারি রিসোর্স  গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে দক্ষিণ এশিয়া ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল এবং এর অধিকাংশ জনগোষ্ঠী নদী অববাহিকায় বসবাস করে।২২ তারা আরও বলে, দক্ষিণ এশিয়ার পানি ‘খুব কম আবার খুব বেশি’ এই গোলকধাঁধায় আটকে আছে। অর্থাং যখন পানির প্রয়োজন তখন তা অপ্রতুল, আবার যখন প্রাকৃতিক উপায়ে (যেমন বৃষ্টি) পানির সরবরাহ প্রচুর তখন প্রয়োজনের তুলনায় নদীতেও প্রচুর পানি থাকে। এবং এটা সম্ভব হয়েছে, পানিসম্পদ রক্ষণাবেক্ষণে পারস্পরিক সমঝোতা, আদান-প্রদান ও ব্যবস্থাপনার অভাবে। তাই প্রতিবছর অববাহিকার নিম্নাঞ্চলে আকস্মিক বন্যা হয়ে থাকে। তারা এই পরিস্থিতি উত্তরণের জন্য আন্তনদী পানি ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দেয়। এই নদী অববাহিকায় দুটি জনবহুল ও দ্রুত উন্নয়নকামী রাষ্ট্রের অবস্থান, যাদের ভবিষ্যত্ পানির চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। তবে ভৌগোলিক অবস্থানগত দিক দিয়ে চীন যেকোনো রাষ্ট্র থেকে সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। Pomeranz-এর মতে, চীন অববাহিকার উজানে অবস্থান করার কারণে হিমালয়ের তিব্বত থেকে উত্পন্ন ইয়াংটজি, মেকং, ব্রহ্মপুত্র, ইন্দুজ নদীগুলোর জলরাশি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। চীনের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তার বিদ্যুতের চাহিদা। চীনের জন্য জলবিদ্যুত্ প্রকল্প বাস্তবায়নের রয়েছে ব্যাপক সম্ভাবনা। চীনে নীতিনির্ধারকেরা ইন্দুজ, সুটলেজ, ব্রহ্মপুত্র, সালওয়েন, ইরাবতীসহ মেকং নদীতে জলবিদ্যুত্ প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করেছেন। তাই Pomeranz আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ও সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপারে সমীক্ষা না করে যেকোনো ধরনের জলবিদ্যুত্ প্রকল্প ভাটির দেশে যেমন বাংলাদেশ ও ভারতের জন্য পানি সরবরাহে ঘাটতি সৃষ্টি করবে।২৩ তাই পানি সুশাসনের জন্য পর্যাপ্ত কাঠামো ও ব্যবস্থাপনার মূলনীতিগুলো এই অববাহিকায় তৈরি না হওয়া পর্যন্ত এই অঞ্চলে পানির ব্যবস্থাপনা নির্ভর করে রাষ্ট্রগুলোর মর্জির ওপর। এখন পর্যন্ত এই অববাহিকায় শতাধিক ব্যারাজ, ড্যাম, বাঁধ, জলাধার নির্মিত হয়েছে, যা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী অংশে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা অববাহিকার ওপর অব্যাহত বাঁধ নির্মাণ প্রতিযোগিতা আন্তনদী পানি ব্যবস্থাপনার ওপর কীরূপ বিরূপ প্রভাব ফেলছে, তা আলোচনা করা হলো।

একনজরে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদী অববাহিকা

গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদীসমূহ দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম নদী অববাহিকা গড়ে তুলেছে। দক্ষিণ এশিয়ার বিস্তীর্ণ উর্বর ভূমি গঠনে এই অববাহিকা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে হাজার বছর ধরে। বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনভূমি সুন্দরবন গড়ে ওঠার পেছনে রয়েছে এই অববাহিকার অবদান। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদী অববাহিকা এশিয়ার ১.৭ মিলিয়ন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত, যার শাখা-প্রশাখা বিশ্বের দুটি জনবহুল ও দ্রুত উন্নয়নকামী রাষ্ট্র যথা চীন ও ভারতে প্রবাহিত হয়েছে। এ ছাড়া এই অববাহিকা নেপাল, ভুটান ও বাংলাদেশে বিস্তৃত। নিচের টেবিলে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদী অববাহিকাগুলোর প্রধান নদী ও তাদের অববাহিকা এলাকাসমূহ নিচে উপস্থাপন করা হলো:

সারণি-১: গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা অববাহিকার নদীসমূহ:

নদী      আয়তন                        অববাহিকার দেশসমূহ              অববাহিকার দেশসমূহে

            (কিলোমিটার)                                      নদীর আয়তন (শতকরা)

গঙ্গা      ১০৮৭৩০০       ভারত                                      ৭৯   

                                    চীন                                          ৩

                                    নেপাল                                      ১৪

                                    বাংলাদেশ                                             ৪   

                                    ভুটান  

ব্রহ্মপুত্র ৫৪৩৪০০                      ভারত                                      ৩৬

                                    চীন                                          ৫২

                                    নেপাল                                      ---

                                    বাংলাদেশ                                             ৭   

                                    ভুটান                                       ৭ 

মেঘনা  ৮২০০০                        ভারত                                      ৫৭

                                    চীন                                          ---

                                    নেপাল                                      ---

                                    বাংলাদেশ                                             ৪৩

                                    ভুটান                                       ---

মোট     ১৭১২৭০০                     ভারত                                      ৬৪   

                                    চীন                                          ১৮

                                    নেপাল                                      ৮

                                    বাংলাদেশ                                             ৭

                                    ভুটান                                       ৩

সূত্র: http://www.fao.org/nr/water/aquastat/basins/gbm/index.stm

গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদ হিমালয় থেকে উত্পন্ন। গঙ্গা হিমালয় থেকে উত্পন্ন হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়ে ভারতে প্রবেশ করেছে। ভারত এই নদীর অসংখ্য শাখা-উপশাখা সৃষ্টি করেছে। ভারতের মধ্য দিয়ে গঙ্গা দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে পদ্মা নাম ধারণ করে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। উল্লেখ্য যে পদ্মা বাংলাদেশের অন্যতম নদী। ব্রহ্মপুত্র চীনের অংশে অবস্থিত হিমালয় থেকে উত্পন্ন, যার নাম Yurlung Tsangpo। চীনের তিব্বত অংশের Burang Countyতে অবস্থিত হিমালয়ের Angsi Glacier থেকে উত্পন্ন হয়ে Yarlung Tsangpo Grand Canyon-এর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে এই নদী অরুণাচল প্রদেশ দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছে। ভারতে এই নদীর নাম Dihang অথবা Siang। অরুণাচল প্রদেশ থেকে এই নদী দক্ষিণ-পশ্চিমে মোড় নিয়ে আসাম ভ্যালি দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ব্রহ্মপুত্র নামে বাংলাদেশের উত্তর সীমানা দিয়ে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশে এই নদী থেকে উত্পন্ন বৃহত্ নদীর নাম যমুনা। তিব্বত মালভূমি থেকে উত্পন্ন ব্রহ্মপুত্র পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচুতে অবস্থানকারী নদী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তিব্বত মালভূমিতে গড়ে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪,০০০ মিটার উঁচু দিয়ে ২০৫৭ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে এই নদী ভারত ও শেষে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। অন্যদিকে মেঘনা ভারতের পূর্বে বরাক পাহাড় থেকে উত্পন্ন। সেখান থেকে এই নদী দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। মেঘনা, যমুনা ও পদ্মার মিলিত প্রবাহ বাংলাদেশকে বিধৌত করে বঙ্গোপসাগরে বিলীন হয়েছে। বাংলা বদ্বীপ গঠনে এই তিন নদীর ভূমিকা অপরিসীম।

চিত্র-১: গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদী অববাহিকার ভৌগোলিক অবস্থান

Capture
Capture

উত্স: https://www.google.be/search?q=Map+of+GBM+Basin&biw

জনসংখ্যার ঘনত্বের দিক দিয়ে এই অববাহিকা অন্যতম। প্রায় ৬৩০ মিলিয়ন মানুষের বসবাস, যা গোটা আফ্রিকার দুই-তৃতীয়াংশের সমান। কিন্তু আয়তনের দিক দিয়ে আফ্রিকা থেকে ১৮ ভাগের মাত্র ১ ভাগ। গোটা বিশ্বের জনসংখ্যার চার ভাগের এক ভাগ এই অঞ্চলে বসবাস করে অথচ সারা বিশ্বের মাত্র ৪ ভাগ জলজ সম্পদ এই অববাহিকায় বিদ্যমান। যার ফলে বিপুল জনসংখ্যার চাপ মোকাবিলা করতে হয় এই তিন মিলিত জলসম্পদকে। তাই মাথাপিছু পানি ব্যবহারের হার অত্যন্ত কম, যা ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে আরও বাড়ছে। এ জন্য এই অঞ্চলের দেশগুলোকে তাদের স্যানিটেশন, খাবার পানি, কৃষির জন্য সেচ, শিল্পকারখানার জন্য পানি ও বিদ্যুত্ সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য এই অববাহিকাজুড়ে ব্যাপক উন্নয়ন পরিকল্পনা নিতে হয়েছে। ২০০০ বছর আগে থেকেই এই অববাহিকায় সেচের জন্য খালসংযোগ নির্মাণ ও বন্যা থেকে বাঁচার জন্য বাঁধ নির্মাণ শুরু হয়। ১২ শতকে মোগল শাসকেরা শতাধিক সংযোগ খাল নির্মাণ করে কৃষি খেতে সেচকার্যের ব্যবস্থা করার জন্য। বর্তমানে ৩৫ মিলিয়ন হেক্টর কৃষিজমি এই অববাহিকার পানি সেচকার্যে ব্যবহার করা হয়। ১৯৪০-এর দশক থেকে এই অববাহিকায় বিভিন্ন বাঁধ নির্মাণ শুরু হয় নদীর গতিপথ পরিবর্তন, সেচকার্য ও জলবিদ্যুত্ উত্পাদনের জন্য। নিম্নে কিছু উল্লেখযোগ্য বাঁধের পরিসংখ্যান উপস্থাপন করা হলো।

সারণি-২: গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদী অববাহিকায় উল্লেখযোগ্য বাঁধসমূহ

দেশ      বাঁধের নাম                              নদী                  বছর    মূল উদ্দেশ্য 

ভুটান   Chhukha                              Ti Chu                ১৯৮৮ জলবিদ্যুত্

            Tala-Wankha                      Wang (Raidak)  ২০০৬   জলবিদ্যুত্       

            Kurichhu                              Kuri                  ২০০২    জলবিদ্যুত্

            Basochu                               Baso Stream     ২০০১   জলবিদ্যুত্

ভারত  Rihand                                  Rihand                  ১৯৬২  জলবিদ্যুত্

            Farakka Barrage                Ganges             ১৯৭৪   সেচ ও নদীপ্রবাহ

            Bhimgoda                            Ganges             ১৯৮৩ জলবিদ্যুত্

নেপাল  KaliGandaki                        Gandaki               ২০০২    জলবিদ্যুত্

            Kosi                                        Kosi                        ১৯৫৬  বন্যানিয়ন্ত্রণ

বাংলাদেশ         Manu Barrage                   Manu                    ১৯৯০   সেচ ও বন্যানিয়ন্ত্রণ  

            Tangon Barrage                                Tangon             ১৯৮৯  সেচ ও বন্যানিয়ন্ত্রণ   

            Teesta Barrage                  Teesta              ১৯৯৮  সেচ ও বন্যানিয়ন্ত্রণ   

সূত্র: বিভিন্ন উত্স থেকে সংগৃহীত

কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, এসবই প্রায় এককভাবে নেওয়া উদ্যোগ, যেখানে পারস্পরিক সহযোগিতার কোনো ব্যবস্থা নেই। যেখানে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম নদী অববাহিকা লাতিন আমেরিকার ‘লা প্লাটার’ পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার জন্য ১৯৬৭ সালেই অববাহিকার রাষ্ট্রসমূহ আলোচনা শুরু করে এবং ১৯৭০ সাল নাগাদ তারা একটি চুক্তিকাঠামো তৈরি করতে সমর্থ হয়। লা প্লাটা দক্ষিণ আমেরিকার প্রায় ৩ মিলিয়ন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। এই নদী অববাহিকায় লাতিন আমেরিকার সামরিক ও অর্থনৈতিক দুই পরাশক্তি দেশ আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের অবস্থান। এ ছাড়া এই অববাহিকায় বলিভিয়া, উরুগুয়ে ও প্যারাগুয়ের অবস্থান। এত বিপুল অঞ্চল নিয়ে অবস্থিত এই অববাহিকার জনসংখ্যা গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদী অববাহিকা থেকে অনেক কম। ১৯৬০-এর দশকে যখন লাতিন আমেরিকার এই পাঁচটি দেশ তাদের নিজ স্বার্থকে পাশ কাটিয়ে সমগ্র অঞ্চলের আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য ‘লা প্লাটার’ পানিসম্পদকে কাজে লাগানোর জন্য একটি কাঠামোগত চুক্তির জন্য কাজ করছে তখন তার মোট জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৬১ মিলিয়ন, যা ২০০০ সালে দাঁড়িয়েছে ১৩২ মিলিয়ন।২৪ পাহাড়ি এলাকা দিয়ে প্রবাহিত লা প্লাটার জলজ বিদ্যুত্ উংপাদনের সক্ষমতা অপরিসীম। তাই এই নদীর অববাহিকার পাঁচটি রাষ্ট্র যৌথভাবে বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প হাতে নিয়েছে এই অঞ্চলের বিদ্যুত্ ও সেচ চাহিদা মেটানোর জন্য। এ পর্যন্ত এই নদীর থেকে সম্ভাব্য ৯২,০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের প্রায় ৬০ ভাগ ব্যবহার নিশ্চিত করেছে। ব্রাজিলের মোট ৯০ ভাগ বিদ্যুতের জোগান আসে লা প্লাটা নদী থেকে।

গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা অববাহিকায় সাম্প্রতিক কালের বাঁধ নির্মাণ প্রতিযোগিতা ও আন্তনদী পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার ভবিষ্যত্

আন্তসীমানা নদী বিভিন্ন রাষ্ট্রের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে থাকে, যা ওই সব রাষ্ট্রের জনগোষ্ঠী ও সরকার ব্যবহার করে থাকে। সুতরাং এই পানিসম্পদ ব্যবহার, প্রয়োজনীয়তা, বিভিন্ন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামোর মধ্যে অবস্থানরত জনগোষ্ঠীর মধ্যে পানি ব্যবহারের ধরনের মধ্যেও পার্থক্য রয়েছে। আন্তনদীর পানি ব্যবস্থাপনা একটি জটিল প্রক্রিয়া, কারণ আন্তসীমানা নদীর পানি শুধু রাষ্ট্রের সীমানাই অতিক্রম করে না, বরং এর সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রের উন্নয়নভাবনা ও নীতি, আইনি কাঠামো, জননিরাপত্তা, রাজনৈতিক স্বার্থ ও লক্ষ ইত্যাদি। আন্তসীমানা পানি ব্যবস্থাপনার বিষয়টি আলোচনা অতীতে হলেও, এর বেশি ব্যবহার দেখা যায় ১৯৭২ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক আয়োজিত পরিবেশ ও উন্নয়নবিষয়ক সম্মেলনের পর থেকে। পরবর্তী সময়ে ১৯৯২ সালে রিও সম্মেলন, ১৯৯৮-এ হারারেতে অনুষ্ঠিত ‘এক্সপার্ট গ্রুপ মিটিং অন ওয়াটার রিসোর্সেস অ্যান্ড সাস্টেইনেবল ডেভলপমেন্ট’ এবং ১৯৯৮-এ নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ কমিশন অন সাস্টেইনেভল ডেভলপমেন্ট-এর মিটিংয়ে আন্তসীমানা নদীর পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার জন্য কিছু আন্তর্জাতিক মূলনীতি গ্রহণ করা হয়।২৫ সেগুলো যথাক্রমে:

১.         মূলনীতি এক: আন্তসীমানা নদীর পানি অতিমূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ, যা বেঁচে থাকার জন্য, উন্নয়ন ও পরিবেশের জন্য অতি দরকারি।

২.         মূলনীতি দুই: আন্তসীমানা নদীর পানির উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা অবশ্যই হতে হবে অংশগ্রহণমূলক, যা পানি ব্যবহারকারী জনগোষ্ঠী, পানি ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত পরিকল্পনাকারী, নীতিনির্ধারক ও পানি বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে হতে হবে।

৩.        মূলনীতি তিন: আন্তসীমানা নদীর পানি ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে জেন্ডার সমতা বিষয়ের অন্তর্ভুক্তি।

৪.         মূলনীতি চার: আন্তসীমানা নদীর পানি অর্থনৈতিকভাবে মূল্যবান এবং এই সম্পদ সবার মাঝে সমান বণ্টনের ব্যবস্থা করা, যাতে সকলে উপকৃত হতে পারে।

ওপরে উল্লেখিত মূলনীতিগুলো বিশ্লেষণ করে বলা যায় যে আন্তসীমানা নদীর পানি ব্যবস্থাপনা এমন একটি প্রক্রিয়া, যা সমন্বিত দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পানিসম্পদের উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা করা। এর সঙ্গে যুক্ত কৃষিজমি, বনাঞ্চল, জলাভূমি ও জলজ সম্পদেরও ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন, যাতে করে নদী অববাহিকা অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর সামগ্রিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি হয়। তবে এই ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সঙ্গে প্রাকৃতিক ভারসাম্যও বজায় রাখতে হবে এবং দূষণের হাত থেকে নদীকে ও নদীর ওপর নির্ভরশীল মানুষের জীবন ও জীবিকা রক্ষা করতে হবে। যদিও বাস্তবে আন্তসীমানা নদীর পানি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে এই মূলনীতি সব সময় মেনে চলা হয় না। আর যেখানে কোনো প্রকার ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত চুক্তি ও প্রটোকল নেই সেখানে এই মূলনীতি বাস্তবায়ন করা আরও কষ্টসাধ্য। দক্ষিণ এশিয়ার ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গা ও মেঘনা অববাহিকা এই অঞ্চলের ১.৫ বিলিয়ন জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদিও এই অঞ্চলে সমন্বিত আন্তনদী পানি ব্যবস্থাপনার ধারণা অত্যন্ত সীমিত আকারে বাস্তবায়ন হয়েছে, যা মূলত দ্বিপক্ষীয়। কিন্তু অববাহিকার সব রাষ্ট্রের সমন্বয়ে এখনো কোনো প্রকার ব্যবস্থাপনা-কাঠামো গড়ে ওঠেনি। এ জন্য জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি (ইউএনইপি) এবং ‘এশিয়ান ইনস্টিটটিউট অব টেকনোলজি’ (এআইটি) কর্তৃক ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত ফ্রেশওয়াটার আন্ডার থ্রেট: সাউথ এশিয়া রিপোর্টে বলা হয়েছে যে মাত্রাতিরিক্ত পানিসম্পদের আহরণ ও এর যথেচ্ছ ব্যবহার, পরিবেশগত পরিবর্তন এবং পারস্পরিক সহযোগিতার অভাবে পৃথিবীর বড় বড় নদী অববাহিকার জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে, যার মধ্যে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা অববাহিকা অন্যতম। এই পরিপ্রেক্ষিতে অববাহিকায় ব্যাপক আকারে ও সংখ্যায় বাঁধ নির্মাণ প্রতিযোগিতা সেই আন্তনদী পানি ব্যবস্থাপনার ধারণা ও এর ভবিষ্যত্ প্রশ্নের সম্মুখীন করেছে।২৬

এশিয়া তথা দক্ষিণ এশিয়ায় যে হারে বাঁধ নির্মাণ চলছে তাতে অনেকে এই প্রতিযোগিতাকে স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে অস্ত্র প্রতিযোগিতার সঙ্গে তুলনা করেছে। এবং এই প্রতিযোগিতা ইতিমধ্যে বিশ্বের পরিবেশবাদী, গবেষক, পানি ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত নীতি গবেষক, পরিবেশ রক্ষার নীতিনির্ধারকসহ সাধারণ মানুষের এই অঞ্চলের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার ব্যাপারে উদ্বেগ তৈরি করেছে। দ্রুত উন্নয়নশীল রাষ্ট্র ভারত ও চীনের কাছে তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য পানিসম্পদ অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, যদিও সমন্বিত ব্যবস্থাপনার অভাবে সেই সম্পদ দ্রুত কমে যাচ্ছে বা ব্যবহারের জন্য অনুপযুক্ত হয়ে যাচ্ছে। পানি বিশেষজ্ঞরা ইতিমধ্যে এই অঞ্চলকে ওয়াটার স্ট্রেসড হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।২৭ কারণ বিভিন্ন রাষ্ট্রে শিল্পায়ন ও ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ পানির জোগানের ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করছে এবং রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে ভবিষ্যত্ পানিসংকট মোকাবিলার ভীতি তৈরি করছে। যদিও এই অববাহিকার রাষ্ট্রগুলো তাদের পানি সংরক্ষণের ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করছে তা জনসংখ্যার চাহিদা মোকাবিলায় সক্ষম নয়। ফলে পানি ব্যবস্থাপনার জন্য গ্রহণযোগ্য কোনো আঞ্চলিক কাঠামো না থাকায় পরস্পরের প্রতি রয়েছে চরম অবিশ্বাস ও সন্দেহ। তাই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের যেকোনো পানি উন্নয়নমূলক প্রকল্প তথা বাঁধ নির্মাণকে দেখা হচ্ছে চরম অবিশ্বাসের সঙ্গে। এ ছাড়া দ্রুত বর্ধমান জনগণ, কৃষি বিপ্লব, শিল্পায়ন ও ব্যাপক নগরায়ণ ইত্যাদি অববাহিকা রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে একধরনের চাপ সৃষ্টি করেছে এই সম্পদের ওপর যত বেশি বেশি করে মালিকানা প্রতিষ্ঠা করা যায় ভবিষ্যতের পানিসংকট মোকাবিলার জন্য। এ ধরনের বাস্তবতায় পরবর্তী অংশে এই নদী অববাহিকায় বর্তমানের বাঁধ নির্মাণ প্রতিযোগিতা ভবিষ্যতে আন্তনদীর পানি ব্যবস্থাপনায় কী ধরনের প্রভাব ফেলবে তা নিয়ে আলোচনা করা হলো।

বাঁধ নির্মাণ প্রতিযোগিতার মুখে সমতাভিত্তিক ও যৌক্তিক উপায়ে পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার ভবিষ্যত্

গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা অববাহিকার দেশগুলো সর্বদা তাদের অভ্যন্তরীণ পানির চাহিদা মেটাতে সক্ষম হয় না। সেদিকে ভারত ও চীনের জন্য তা আরও বেশি প্রকট তাদের ক্রমবর্ধমান জনগণের চাহিদা মোকাবিলার জন্য। আবার শহর ও গ্রামের মানুষের ভেতর পানি বণ্টনেও রয়েছে বৈষম্য। নিরাপদ পানীয় ও শৌচাগারে গ্রামের মানুষের অভিগম্যতা শহরের মানুষের থেকে অনেক কম। এক হিসাবে দেখা যায়, প্রায় ভারতের ১৪০ মিলিয়ন এবং চীনের ১৪৭ মিলিয়ন মানুষের বিশুদ্ধ খাবার পানি থেকে বঞ্চিত এবং ৮১৫ মিলিয়ন ভারতের ও ৬০০ মিলিয়ন চীনের জনগণ উন্নত শৌচাগার থেকে বঞ্চিত।২৮ ভারতে বর্তমানে পানির জোগান কমতির দিকে। ২০৩০ সালের মধ্যে ভারতের পানির ঘাটতি ৫০ ভাগে গিয়ে দাঁড়াবে। ভারতে ১২টি বৃহত্ নদ-নদীর নেটওয়ার্ক রয়েছে যার মধ্যে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা অববাহিকা বৃহত্তর। ১৯৪৭-এর দেশভাগের পর থেকে ভারত তার নদ-নদীগুলোতে পানি সংরক্ষণের নানা পদক্ষেপ নিয়েছে, যা বর্তমানে প্রতিবছর ২১২.৭৮ বিলিয়ন কিউবিক মিটার।২৯ কিন্তু বর্তমান চাহিদার সঙ্গে তাল মেলাতে হলে ভারতে অত্যন্ত প্রয়োজন আন্তসীমানা নদীর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা, যাতে তাদের ক্রমবর্ধমান পানির চাহিদা পূরণ করা যায়।

গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা অববাহিকা হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত এবং ভৌগোলিক দিক দিয়ে চীন এই অববাহিকার উজানে অবস্থিত। যার ফলে চীন সব সময় এই অববাহিকার পানি ব্যবহারে তুলনামূলক বেশি সুবিধা লাভ করছে। এবং ভারতের মতো চীনেরও পানির চাহিদা দিনে দিনে বাড়ছে। চীনের বিদ্যুত্শক্তির চাহিদা ২০৩৫ সালের মধ্যে ৬০ ভাগ বৃদ্ধি পাবে।৩০ চীন তাই আন্তনদীগুলোর ওপর ব্যাপক আকারে বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে। এই বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে যে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা অববাহিকার দুটি বৃহত্ ও শক্তিশালী রাষ্ট্র তাদের ব্যাপক চাহিদা মেটানোর জন্য একতরফাভাবে নদীর ওপর নানা স্থাপনা তৈরি করছে, যার মধ্যে বাঁধ অন্যতম। এদের বাদ দিলে ভুটান ও নেপালেও দেখা যায় বাঁধ নির্মাণের নানা আয়োজন। নির্মাণাধীন বাঁধ মূলত পানি ধরে রাখার আধার হিসেবে কাজ করবে, যা বন্যার হাত থেকে বাঁচার জন্য প্রথম পর্যায়ের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা। এ ছাড়া বাঁধ নির্মাণের উদ্দেশ্য হচ্ছে নদীর স্বাভাবিক গতিধারা রোধ করে শুষ্ক অঞ্চলে পানি সরবরাহ করা, সেচকার্যের জন্য পানি সংরক্ষণ করা এবং জলবিদ্যুত্ উত্পাদন করা। তবে রাষ্ট্র তাদের বাঁধ নির্মাণ অব্যাহত রাখছে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ও যৌথ চাহিদা সমীক্ষা ছাড়াই। ফলে আন্তনদীর পানি সরবরাহ থেকে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো বঞ্চিত হবে। এর ফলে সমতাভিত্তিক যৌক্তিক উপায়ে পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা-বিষয়ক মূলনীতি গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা অববাহিকার পানি ব্যবস্থাপনা ক্ষেত্রে মেনে চলা অত্যন্ত দুরূহ বলে প্রতীয়মান। অন্যদিকে ভবিষ্যতে চীনে আরও বেশি বাঁধ নির্মাণ ভারত-চীনের মধ্যে সম্পর্কে অবিশ্বাস ও সন্দেহ সৃষ্টি করবে, যা ব্রহ্মপুত্র নদে বাঁধ নির্মাণকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যে দেখা যাচ্ছে। বার্কেফের মতে, চীন ‘নর্থ-সাউথ ওয়াটার ট্রান্সফার প্রজেক্ট’ হাতে নিয়েছে যা দেশের অর্থনৈতিক, নিরাপত্তা, শক্তি ও খাদ্য উত্পাদনে ব্যাপক ভূমিকা পালন করার সঙ্গে সঙ্গে এই অববাহিকার অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েনও সৃষ্টি করবে।৩১

বাঁধ নির্মাণ প্রতিযোগিতা আন্তসীমানা নদীর পানি ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতামূলক মূলনীতির পরিপন্থী

আন্তসীমানা নদীর পানি ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতামূলক মূলনীতি বলতে পারস্পরিক তথ্য, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা ও উন্নয়ন কৌশলের আদান-প্রদানকে বোঝানো হয়ে থাকে। নিদেনপক্ষে রাষ্ট্রগুলো তাদের অংশে গৃহীত পানি উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের সঠিক তথ্য অববাহিকার অন্যান্য রাষ্ট্রের কাছে সরবরাহ করবে। যদিও ব্রহ্মপুত্র নদে চীনের Yurlung বাঁধ নির্মাণবিষয়ক তথ্যের আদান-প্রদান ভারতসহ অন্যান্য রাষ্ট্রের কাছে তেমন হয়নি। ১৯৭০ সালে গৃহীত এই প্রকল্প সম্পর্কে চীন খুব কমই সরব থেকেছে। আশির দশকে জাপান একে মেগা-ড্যাম প্রকল্প বলে আখ্যায়িত করে। যদিও এই বাঁধ নির্মাণের পর চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিল্লি ও ঢাকাকে আশ্বস্ত করেছে যে এই বাঁধ এই দুই দেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে না।৩২ চীন নিকট ভবিষ্যতে ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর আরও ২৮টি বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে, যা বিশ্বের বড় হোভার ড্যাম যা ২২১ মিটার উঁচু তার থেকেও বড় হবে উচ্চতা ও আয়তনে। ২০০৮ সালে চীন তার বিখ্যাত থ্রি গর্জেস বাঁধ ইয়াংটজি নদীর ওপর নির্মাণ শেষ করে, যা হোভার ড্যামের তুলনায় ১০ গুণ বেশি জলবিদ্যুত্ উত্পন্ন করতে পারে। ১৯৫০-এর দশক থেকে চীন প্রায় ২২ হাজার ড্যাম নির্মাণ করেছে, যাদের উচ্চতা ১৫ মিটারের বেশি। ২০২০ সাল নাগাদ চীন তার জলবিদ্যুত্ প্রকল্প থেকে ১২০,০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদনে সক্ষম হবে।৩৩ সম্প্রতি চীনের ‘নর্থ-সাউথ ওয়াটার ট্রান্সফার প্রজেক্ট’ চীনের চারটি নদী যথা Yangtze, Yellow, Huaithe and Haihe-এর মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে তিনটি সংযোগ ক্যানালের মাধ্যমে চীনের মধ্য, পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলে পানি সরবরাহ করবে। অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করছে যে এই প্রজেক্ট আন্তসীমানা নদীর পানি সরবরাহে বিঘ্ন ঘটাবে। চীনে এসব বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার Mekong, Nu যাকে মিয়ানমারে Salween বলে ও Yarlung Tsangpo, যাকে ভারতে ও বাংলাদেশে ব্রহ্মপুত্র নামে ডাকা হয়, এই নদীগুলোর পানি সরবরাহে বিঘ্ন ঘটাবে। তিব্বত মালভূমি থেকে উত্পন্ন ব্রহ্মপুত্র নদ পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা উঁচু নদী, যার গড় উচ্চতা ৪০০০ মিটার। এই নদীর জলবিদ্যুত্ উত্পন্ন ক্ষমতা ব্যাপক তিব্বত অঞ্চলে। একে মাথায় রেখে চীন ইতিমধ্যে জাংমু জলবিদ্যুত্ প্রকল্প চালু করেছে, যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩৩০০ মিটার উঁচু। আগামী কয়েক বছরে এর নির্মাণকাজ শেষ হলে এর উচ্চতা গিয়ে দাঁড়াবে ৩৮১ ফুট বা ১১৬ মিটারে।৩৪ এই ব্রহ্মপুত্র নদ তিব্বত থেকে প্রসারিত শতাধিক শাখা-উপশাখায় বিভক্ত হয়ে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। চীনের এই বাঁধ স্বাভাবিকভাবেই এসব অঞ্চলে পানি সরবরাহে বিঘ্ন ঘটাবে বলে অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। পানি সরবরাহে বিঘ্ন হলে তা নদীর জলজ সম্পদের ওপরও বিরূপ প্রভাব ফেলবে। সঙ্গে সঙ্গে নদীর তীরে বসবাসরত বিশাল জনগোষ্ঠীর ওপরও মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। বাঁধ নির্মাণ-প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও সহযোগিতার অভাব এই অববাহিকা অঞ্চলে একধরনের ডমিনো অ্যাফেক্ট সৃষ্টি করেছে। অর্থাং অন্যান্য রাষ্ট্রও তাদের দেশের সীমানায় ব্যাপক হারে বাঁধ নির্মাণ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ ব্রহ্মপুত্র নদের উপশাখা ডিবাং নদীর ওপর ভারতের ৩০০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন জলবিদ্যুত্ উত্পাদন প্রকল্পের কথা বলা যায়। এর ফলে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি সরবরাহে বিঘ্ন ঘটবে। ডিবাং ছাড়াও আসাম ও অরুণাচল অঞ্চলে আরও ১৬৮টি বাঁধ নির্মাণের ভবিষ্যত্ পরিকল্পনা রয়েছে, যা সম্পন্ন হলে ভারত ৫৭ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পন্ন করতে পারবে।৩৫ এ কারণে ‘উত্তর-পূর্ব ভারত’কে ভারতের ভবিষ্যত্ শক্তির উত্স বলা হয়ে থাকে।

বাঁধ নির্মাণ প্রতিযোগিতা এবং আন্তসীমানা নদীর পানি ব্যবস্থাপনায় দ্বন্দ্ব নিরসনব্যবস্থা

ওপরের আলোচনা থেকে এটা প্রতীয়মান যে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদী অববাহিকায় রাষ্ট্রগুলোর একতরফা বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প তাদের ভেতর তৈরি করছে সন্দেহ ও সংঘাতময় পরিস্থিতি। এই পরিপ্রেক্ষিতে আন্তসীমানা নদীর পানিসম্পদ নিয়ে সৃষ্ট দ্বন্দ্ব নিরসনে আন্তর্জাতিক পানি আইনে দ্বন্দ্ব নিরসনব্যবস্থার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এই দ্বন্দ্ব নিরসনব্যবস্থা আন্তনদী পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার একটি অন্যতম মূলনীতি। উল্লেখ্য যে সব কটি আন্তসীমানা নদীর পানি ব্যবস্থাপনায় দ্বন্দ্ব নিরসনব্যবস্থা গড়ে উঠেছে অববাহিকা রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে চুক্তির আলোকে। এবং এসব চুক্তি আইনের মাধ্যমে সৃষ্ট দ্বন্দ্ব নিরসনব্যবস্থা থেকে গৃহীত যেকোনো সিদ্ধান্ত চুক্তির সদস্যরাষ্ট্রসমূহ মেনে নেয়। অ্যানা স্যুলজ (২০০৭)-এর মতে, অববাহিকা অঞ্চলে পানিসম্পদের সঠিক ব্যবহার, মানুষের অভিগম্যতা নিশ্চিত করা, কৃষির জন্য সেচকার্যের ব্যবস্থা, বিদ্যুত্শক্তি উত্পাদনের জন্য নদীর পানি বণ্টন ও উন্নয়নমূলক চুক্তির প্রয়োজন। এসব চুক্তির মধ্যে নিহিত কিছু মূলনীতি পরবর্তী সময়ে যেকোনো দ্বন্দ্ব নিরসনে সহায়তা করে। উদাহরণস্বরূপ ‘দ্য ডকট্রিন অব অ্যাবসলিউট ইন্টিগ্রিটি’-এর কথা বলা যায়, যেখানে বলা হয়েছে যে সদস্যরাষ্ট্রগুলো কখনোই তার দেশের সীমানার মধ্যে বয়ে চলা নদীর পানির স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করবে না, হোক না তার অবস্থান নদীর উজান বা ভাটিতে।৩৬ অন্যদিকে ‘দ্য ডকট্রিন অব লিমিটেড টেরিটোরিয়াল সভ্রেনিটি’-এর মতে, রাষ্ট্রগুলো এর দ্বারা সাধারণ নীতিমালা মেনে চলবে যে তাদের সীমানার মধ্যে পানিসম্পদের এমন যথেচ্ছ ব্যবহার করবে না, যা অন্য রাষ্ট্রের পানিসম্পদের ওপর হুমকি সৃষ্টি করে। কিন্তু ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় এই দুটি মূলনীতি কোনোটিই মানা হচ্ছে না কোনো প্রকার আন্তসীমানা নদী পানি ব্যবস্থাপনা চুক্তি না থাকার কারণে। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা অববাহিকার রাষ্ট্রগুলো, বিশেষ করে হারম্যান নীতি দ্য ডকট্রিন অব অ্যাবসলিউট সভ্রেনিটি অনুসরণ করছে। যার অর্থ সর্বময় সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে রাষ্ট্রগুলো তাদের সীমানার আন্তসীমানা নদীর পানিসম্পদের স্বাধীনভাবে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এমনকি সর্বউজানে অবস্থানরত রাষ্ট্রগুলোও এই নীতি অনুসরণ করছে। উদাহরণ হিসেবে ভারত ও চীনের গৃহীত বিভিন্ন পানি উন্নয়ন প্রকল্পের কথা উল্লেখ করা যায়। শুধু গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা অববাহিকা নয়, চীন তার মেকং ও সালওয়েন নদীতেও জলবিদ্যুত্ প্রকল্পের কাজ করছে, যা মেকং নদী অববাহিকার অন্যান্য রাষ্ট্রের জন্য উদ্বেগের বিষয়। মালহোত্রা ও আরোরার মতে, চীন ও ভারত ১৯৯৭ সালে অনুষ্ঠিত ‘ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন অন দ্য ল অব নন-নেভিগেশনাল ইউজেস অব ইন্টারন্যাশনাল ওয়াটারকোর্স’-এ অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে।৩৭ এর ৫ নম্বর ধারায় বলা আছে, ‘a State sharing an international watercourse with other States utilize the watercourse, in its territory, in a manner that is equitable and reasonable vis-à-vis the other States sharing it।৩৮ কিন্তু এই কনভেনশন এখনো বাস্তবায়ন হয়নি এবং গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা অববাহিকার পানি নিয়েও হয়নি কোনো চুক্তি। এমন অবস্থায় অব্যাহত বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পগুলো তৈরি করবে পারস্পরিক সন্দেহ। একটা কার্যকর আন্তসীমানা নদীর পানি ব্যবস্থাপনাকাঠামো কেবল পারে নির্মোহ সত্য অনুসন্ধান, ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ এবং অববাহিকা রাষ্ট্রগুলোর কার্যকলাপের ওপর নজরদারির মাধ্যমে জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা তৈরি করতে। এর ফলে উদ্ভূত যেকোনো দ্বন্দ্ব নিরসন করা সম্ভব।

ভবিষ্যত্ করণীয়

গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম নদী অববাহিকা, যেখানে বিশ্বের প্রায় ৪০ ভাগ দরিদ্র মানুষের বসবাস। মানব উন্নয়ন এর শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক ও জীবনযাত্রার মানের সূচকের ক্ষেত্রে এই অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলোর অবস্থান নিচের দিকে। দ্রুত ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা এই পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলছে। আবার এই অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলো নিরন্তর চেষ্টা করে যাচ্ছে শিল্পায়নের। ফলে বিভিন্ন জায়গায় গড়ে উঠছে শিল্প ও নগর। ১৯৯৫ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালে নগরায়ণের হার ছিল যথাক্রমে ৫.২%, ৩.০% এবং ৬.৫%, যা ইউরোপ (০.৫%), দক্ষিণ আমেরিকা (২.৩%) এবং অস্ট্রেলিয়া (১.২%) থেকে বেশি।৩৯

ভারত, বাংলাদেশ ও নেপালের অর্ধেকের বেশি মানুষ ২০২৫ সাল নাগাদ শহরে জীবিকার অন্বেষণে স্থানান্তরিত হবে। অপরিকল্পিত শিল্পকেন্দ্রিক নগরায়ণের চাপ পড়বে পানি, ভূমি, বিদ্যুত্ ইত্যাদির ওপর। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা অববাহিকার অবারিত পানির সঠিক ব্যবস্থাপনা ছাড়া এই ধরনের চাপ মোকাবিলা করা কষ্টকর। এই অববাহিকার পানিসম্পদের যথাযথ ও সঠিক ব্যবস্থাপনা ও ব্যবহারের মাধ্যমে মিলিয়ন মিলিয়ন হতদরিদ্র মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন সম্ভব। এবং এর জন্য দরকার রাষ্ট্রসমূহের সদিচ্ছা ও পানিসম্পদকে যৌথ মালিকানার সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করার মানসিকতার। পানিসম্পদকে শুধু ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে নিয়ন্ত্রণ না করে এর যথাযথ উন্নয়ন করার মাধ্যমে পুরো অববাহিকা অঞ্চলের মানুষের সামগ্রিক জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি, মানবসম্পদ উন্নয়ন, প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখা ও টেকসই উন্নয়ন সাধন করা। প্রশ্ন আসতে পারে, কীভাবে তা সম্ভব? এক হিসাবে দেখা যায়, গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা এই তিন নদীর মিলিত পানিপ্রবাহ বছরে ১৩৫০ বিলিয়ন কিউবিক মিটার, যার অর্ধেক প্রবাহিত হয় ব্রহ্মপুত্র দিয়ে। এই তিন নদীর মিলিত পানিপ্রবাহ পৃথিবীর সম্মিলিত পানিপ্রবাহের তিন গুণ বেশি। সুতরাং এই বিপুল জলরাশির সঠিক ব্যবহার করলে এই অঞ্চলের পানির চাহিদা, সেচকার্য ও বিদ্যুত্ উত্পাদনে ব্যাপক উন্নতি সাধন সম্ভব। এই অববাহিকার প্রায় সব রাষ্ট্রই একটি সমস্যার সম্মুখীন হয় তা হলো বর্ষাকালে ব্যাপক পানিপ্রবাহ আর শুষ্ক মৌসুমে পানির স্বল্পতা। তাই এই খেয়ালি প্রাকৃতিক সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহারের জন্য আঞ্চলিক সহযোগিতা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।৪০

উজানের দেশ চীন ও ভারত ভাবতে পারে, আঞ্চলিক সহযোগিতামূলক পানিসম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা কাঠামোতে তাদের অংশগ্রহণ স্বার্থের পরিপন্থী। কিন্তু সমন্বিত পানি ব্যবস্থাপনা, তথ্যের আদান-প্রদান শুধু ভাটির দেশ যেমন বাংলাদেশ, ভুটান বা নেপালকেই লাভবান করবে না, বরং তা ভারতের উত্তর, পূর্ব এবং উত্তর-পূর্ব ভারত ও চীনের বিভিন্ন অংশে জলবিদ্যুত্, প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা, নিরাপদ পানি সরবরাহ, নৌপথে বাণিজ্য সম্প্রসারণ, সর্বোপরি বন্যা ব্যবস্থাপনা, নদীভাঙন রোধে সহায়ক হবে। দক্ষিণ এশিয়ায় প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ তাদের ঘরবাড়ি হারিয়ে উদ্বাস্তুতে পরিণত হয় বন্যা ও নদীভাঙনের কারণে।

কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলো এখনো তাদের নিজ স্বার্থ ও পরস্পরের প্রতি সন্দেহ আর অবিশ্বাস থেকে পানি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে একতরফাভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তা যেমন ব্যয় ও কষ্টসাধ্য, আবার স্বল্প আয়ের দেশের পক্ষে সেগুলো বাস্তবায়ন করা অসম্ভব। যেমন নেপাল মোট সম্ভাব্য জলশক্তির মাত্র ০.৬ ভাগ ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছে।৪১ এ জন্য নেপাল যদি যৌথভাবে অববাহিকা অঞ্চলের অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে জল-বিদ্যুত্শক্তি উত্পাদনে সক্ষম হয়, তাহলে উদ্বৃত্ত বিদ্যুত্শক্তি নেপাল ভারত, বাংলাদেশ ও ভুটানে সরবরাহ করতে পারে। উদাহরণ হিসেবে ভুটানের মধ্যে বয়ে চলা Kuri Chu নদীর ওপর ভারত ও ভুটান যৌথভাবে জলবিদ্যুত্ প্রকল্প গড়ে তুলেছে ১৯৯৩ সাল থেকে। এ ছাড়া ভুটানের Sunkosh নদীর ওপর বাঁধ নির্মাণ বিষয়ে ১৯৯৩ সালে চুক্তিতে উপনীত হয়। এই বাঁধ নির্মাণ করা শেষ হলে উভয় রাষ্ট্রই জলবিদ্যুত্ উত্পাদনের সুফল লাভ করবে। Kosi নদীর পানি ব্যবস্থাপনাকে কেন্দ্র করে ভারত ও নেপাল ১৯৫৪ সাল থেকে যৌথ নদী কমিশন গঠন করেছে। এ ছাড়া নেপাল ও ভারত Chandra Canal, Western Kosi Canalগুলোর মান উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের জন্য যৌথভাবে কাজ করছে। ১৯৯৬ সালে ভারত ও বাংলাদেশ গঙ্গা পানিচুক্তি সম্পাদন করে, যা এই উপমহাদেশে ভারত ও নেপালের মধ্যে ১৯৯৬ সালে সম্পাদিত ‘মহাকালি’ নদী চুক্তির মতো গুরুত্বপূর্ণ। এই দুটি চুক্তি বর্তমানে কার্যকর রয়েছে। লক্ষণীয় যে চুক্তিগুলো সবই দ্বিপক্ষীয় যা গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা অববাহিকার সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য অপ্রতুল। এই অববাহিকায় অবস্থিত ভারত, চীন, ভুটান, নেপাল ও বাংলাদেশ এই সব রাষ্ট্রেরই যৌথভাবে পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নে কাজ করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন আঞ্চলিক যোগাযোগ ও তথ্যের আদান-প্রদান, দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনা, পানিসম্পদ উন্নয়নে প্রয়োজনীয় অর্থ ও জ্ঞানের সমন্বয় ও অংশীদারির ভিত্তিতে পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা। এ ছাড়া রাজনৈতিক সদিচ্ছার বড় প্রয়োজন প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মানুষের জন্য ও সামগ্রিকভাবে আঞ্চলিক পরিবেশ রক্ষার জন্য ক্ষতিকর এমন পানি উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন থেকে বিরত থাকা।

শেষ কথা

বর্তমানে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা অববাহিকায় যে গতিতে বাঁধ নির্মাণ-প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে তা রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ভবিষ্যতে আরও দূরত্ব সৃষ্টি করে চলবে। পানিকেন্দ্রিক সংঘাতও সৃষ্টি হতে পারে এ অঞ্চলে। তাই বাঁধ নির্মাণ-প্রক্রিয়াকে অববাহিকার সব রাষ্ট্রের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা দরকার। এই জন্য দরকার আন্তনদী পানি ব্যবস্থাপনা-বিষয়ক চুক্তি ও আঞ্চলিক কাঠামো, যাতে বাঁধ নির্মাণ-প্রক্রিয়ার সঙ্গে সদস্যরাষ্ট্রকে সম্পৃক্ত করা যায়। আন্তনদীর ওপর বাঁধ নির্মাণ নদীর ওপর নির্ভরশীল সব রাষ্ট্রের জন্যই ভবিষ্যত্ পানির সহজলভ্যতাকে হুমকির মুখে ফেলবে। তৈরি করবে হাজার হাজার উদ্বাস্তু, জীবনযাত্রার মান করবে নিম্নগামী। পানিকেন্দ্রিক দ্বন্দ্ব এই অঞ্চলকে করতে পারে অস্থিতিশীল আর তাই পরিশেষে উপমহাদেশের বিখ্যাত মানবতাবাদী সংগীতবিদ (সংগীতজ্ঞ) ভুপেন হাজারিকার একটি গানের চরণ দিয়ে শেষ করতে চাই।

মোরা যাত্রী একই তরণীর, সহযাত্রী একই তরণীর

যদি সংঘাত হয় তবে ধ্বংস হবে গর্ব মোদের প্রগতির

(We’re in the same boat brother, we’re in the same boat brother.

And if you shake one end, / you gonna rock the other / it’s the same boat brother.)

তথ্যসূত্র:

1.            Chowdhury R. & Ward N, "Hydro-Meteorological variability in the greater Ganges-Brahmaputra-Meghna basins", International  Journal of Climatology, no: 24, 2004. (Published online in Wiley InterScience, 2004), p-1.

2.            Ahmad Q. K., Biswas A. K., Rangachari R, Sainju M. M, Ganges-Brahmaputra-Meghna Region: A Framework for Sustainable Development, (the University Press Limited, Dhaka 2001).

3.            Chellaney, B, From Arms Racing to “Dam Racing” in Asia: How to Contain the Geopolitical Risks of the Dam-Building Competition. (Translantic Academy Paper Series, 2012) Washington, USA.

4.            Fuggle, R., Smith, W. T., Hydrosult Canada Inc., & Androdev Canada Inc, Experience with Dams in Water and Energy Resource Development in The People's Republic of China. Country Review Paper, (published by the World Commission on Dams. Cape Town, South Africa, 2000), P-72.

5.            Taneja, B. & Thakkar, H. Large Dams and Displacement in India, (the World Commission on Dams, Cape Town, South Africa, 2000).

6.            Maryam Mastoor, "Environmental Degradation: Focus on Water Scarcity", South Asia, Regional Studies, Vol XXVII, 2009, No 1, p-1.

7.            Schulz, A., "Creating a Legal Framework for Good Transboundary Water Governance in the Zambezi river and Incomati River Basins", Georgetown International Environmental Law Review, Winter 2007, no. 19, issue. 2, p. 117.

8.            Gleick, P., "Water and Conflict: Fresh Water Resources and International Security", International Security, Vol. 18, No. 1, p. 1993, p-84.

9.            Meredith A. G. & Aaron T. W., The World's International Freshwater Agreements (Oregon State University 2000), USA. 

10.          Wolf, Aaron T., "Criteria for Equitable Allocations: The Heart of International Water Conflict", Natural Resources Forum, Volume 23, Issue 1, 1999, pp. 3-30. 

11.          Conca, K. Wu, F., Mei, C., "Global Regime Formaton or Complex Institution Building? The Principle Content of International River Agreements", International Studies Quarterly, 2006, Volume 50, Issue 2, pp. 263–285.

12.          A. Carius, GEOFFREY D. and Aaron, T. W. The United Nations and Environmental Security, Issue no. 19 (ECSP REPORT 2004), p-1.

13.          Swain, A. Managing Water Conflict: Asia, Africa and Middle East (NY: Routledge, 2004).

14.          Ministerial Declaration of The Hague on Water Security in the 21st Century, www.worldwatercouncil.org/fileadmin/world_ water_council/documents/world_water_forum_2/The_Hague_Declaration.pdf

15.          Peter Rogers and Alan W Hall, Effective Water Governance, TEC Background Paper No. 7 (Global Water Partnership Technical Committee (TEC) GWP Secretariat 2003), p.15.

16.          United Nations, Convention on the Law of the Non-navigational Uses of International Watercourses, UN General Assembly resolution  no. 51/229, available at: http://www.un.org/documents/ga/res/51/ares51-229.htm.

17.          Article-5 on “Factors Relevant to Equitable and Reasonable Utilization and Participation”, the United Nations, Convention on the Law of the Non-navigational Uses of International Watercourses, UN General Assembly resolution no. 51/229, available at: http://www.un.org/documents/ga/res/51/ares51-229.htm. 

                1. Watercourse States shall in their respective territories utilize an international watercourse in an equitable and reasonable manner. In particular, an international watercourse shall be used and developed by watercourse States with a view to attaining optimal and sustainable utilization thereof and benefits there from, taking into account the interests of the watercourse States concerned, consistent with adequate protection of the watercourse. 

                2. Watercourse States shall participate in the use, development and protection of an international watercourse in an equitable and reasonable manner. Such participation includes both the right to utilize the watercourse and the duty to cooperate in the protection and development thereof, as provided in the present Convention.

18.          Salman, M. A. "The Helsinki Rules, the UN Watercourses Convention and the Berlin Rules: Perspectives on International Water Law", Water Resources Development, 2007, Vol. 23, No. 4, p.629.

19.          Article 8 on “General Obligation to Cooperate”, the United Nations, Convention on the Law of the Non-navigational Uses of International Watercourses, UN General Assembly resolution no. 51/229, available at: http://www.un.org/documents/ga/res/51/ares51-229.htm.

                1. Watercourse States shall cooperate on the basis of sovereign equality, territorial integrity, mutual benefit and good faith in order to attain optimal utilization and adequate protection of an international watercourse. 

                2. In determining the manner of such cooperation, watercourse States may consider the establishment of joint mechanisms or commissions, as deemed necessary by them, to facilitate cooperation on relevant measures and procedures in the light of experience gained through cooperation in existing joint mechanisms and commissions in various regions. 

20.          Iram, K., Mukhtar, A., & Ahmed, Z., "Water Scarcity in South Asia: A Potential Conflict of Future Decades", Journal of Political Studies, Vol. 21, Issue - 1, 2014. P.260.    

21.          John, W. Water security in South Asia: Issues and Policy Recommendations, (Observer Research foundation, 2011), p.3.

22.          Michael, D., & Pandya, A. Troubled Waters: Climate Change, Hydropolitics, and Transboundary Resources (The Henry L. Stimson Center: Washington DC, 2009). 

23.          Pomeranz, K. Asia's Unstable Water Tower: The Politics, Economy and Ecology of Himalayan Water Projects. Asia Policy ((Washington, D.C.: Woodrow Wilson Center Press, 2013) pp. 1-50.

24.          Mugetti, A., et.al. Global International Waters Assessment Patagonian Shelf (University of  Kalmar, 2004), pp.1-180.

25.          McIntyre, O., Improving Transboundary Water Governance through the Application of Integrated Water Resources Management, The United Nations Enviornment Programme, available at: www.unep.org/environmentalgovernance/.../ENGLISH%20Improving%20Transboundary%20Water%20Governance.html.

26.          Freshwater under Threat: South Asia: Vulnerability Assessment of Freshwater Resources to Environmental Change, United Nations Environment Programme (UNEP) & Asian Institute of Technology (AIT), 1999.

27.          Gareth Price et. al. Attitudes to Water in South Asia, Chatham House Report (Royal Institute  of International Affairs, 2014), p.1.

28.          Rosenfield J., “Exploring the China-India Relationship: Roundtable Report”, CNA China Studies, 2010, p. 8.

29.          Prakash, A., Sharma, M., & Chourey, J. Water in India: Situation and Prospects. Delhi: UNICEF, 2013.

30.          Agency, I. E. World Energy Outlook 2012, International Energy Agency, 2012.

31.          Berkoff, J., China: The South–North Water Transfer Project— is it justified? Water Policy No-5, 2013.

32.          Ranjan R., “Damming The Brahmaputra: Setback To South Asian Stability”, Centre for East Asian Studies, JNU, Aug. 12, 2010.

33.          Lewis, C., China’s Great Dam Boom: A Major Assault on Its Rivers, 2013, available at: www.yale.edu/feature/chinas_great_ dam_boom_an_assault_on_its_river_systems/2706/.

34.          Sanyal, A., China Building Dams in Brahmaputra: Tarun Gogoi Asks PM Modi to Take Up Issue, 2014, www.ndtv.com/india-news/china-building-dams-in-brahmaputra-tarun-gogoi-asks-pm-modi-to-take-up-issue-706313

35.          Duarah, C.K., India Gives Green Light to Build Country’s Largest Dam, 2014, available at: https://www.chinadialogue.net/article/show/ single/en/7359-India-gives-green-light-to-build-country-s-largest-dam

36.          Hazarika, O.B.Riparian Relations between India and China: Exploring Interactions on Transboundary Rivers, International Journal of China Studies, Vol. 6, No. 1, 2015.

37.          Malhotra, P. & Arora, “Sino-Indian Water Wars?”, in D. Vajpeyi (ed.), Water Resource Conflicts and International Security: A Global Perspective, Plymouth: Lexington Books, 2011.

38.          Convention on the Law of the Non-Navigational Uses of International Watercourses, 1997

39.          Biswas, A.K. (2008), Management of Ganges-Brahmaputra-Meghna System: Way Forward, Water Resources Development and Management.

40.          Shah RB (2001) Ganges-Brahmaputra: The Outlook for 21st Century. In: Biswas AK, Uitto JI (eds) Sustainable Development of the Ganges-Brahmaputra-Meghna Basin. United Nations University Press, Tokyo.

41.          Biswas, A.K. (2008).