সম্পাদকীয়

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্যের ওপর সরকারি দপ্তর ব্যবহার ও ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়ার মাধ্যমে সৃষ্ট দুর্নীতির প্রভাব সম্পর্কে বেশ আলোচনা চলছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ সেবাগুলো প্রদান করে, যার ওপর দরিদ্র জনগোষ্ঠী নির্ভরশীল। দুর্নীতি এসব সেবাকে বাধাগ্রস্ত করে এবং এসব সেবার মান ও পরিধি কমিয়ে দেয়। প্রাত্যহিক জীবনে সাধারণ মানুষ বিভিন্ন সরকারি যে সেবাগুলো লাভ করে তার অধিকাংশই দুর্নীতিগ্রস্ত, যার প্রভাব পড়ে সরাসরি মানুষের জীবনে। সরকারি সেবা খাতগুলোতে এই দুর্নীতি, ঘুষের লেনদেন এবং এর প্রতিবাদে জনপরিসরে দুর্নীতিবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিস্তৃত উঠে এসেছে নুরুল ইসলামের ‘দুর্নীতি, দুর্নীতির নিয়ন্ত্রণ এবং পরিবর্তনের চালকেরা: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রবন্ধে।

বাংলাদেশ ২০১২ সালে মিয়ানমারের সঙ্গে এবং ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে তার সমুদ্রসীমা-সংক্রান্ত বিরোধের মীমাংসা ঘটায়। এরপর থেকে জাতীয় অর্থনীতিতে সমুদ্রের গুরুত্বের বিষয়টি পুনরায় আলোচনায় আসে। বাংলাদেশ নদীবিধৌত দেশ হলেও, এর প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে সমুদ্র নানা মাত্রায় সম্পৃক্ত। এই বিষয়গুলো বহুল আলোচিত। কিন্তু বিস্তীর্ণ হাওরাঞ্চলের মানুষদের সঙ্গে সমুদ্রের সম্পর্ক কী? এদের অনেকেই কখনো সমুদ্র দেখেইনি, তারপরও তাদের সাহিত্য, জীবনাচরণ, ধর্ম, কৃষি এবং লোককথার সঙ্গে সমুদ্র মিশে আছে। নিম্নবর্গের এসব মানুষের জীবনাচরণে সমুদ্র সম্পর্কিত কল্পনার প্রতিফলনকে তুলে ধরেছেন পাভেল পার্থ। তাঁর প্রবন্ধের শিরোনাম ‘নিম্নবর্গের সমুদ্র-জিজ্ঞাসা: বাংলাদেশের সমুদ্র প্রতিবেশ, বৈচিত্র্য ও সংস্কৃতি বিষয়ে এক নিম্নবর্গীয় বয়ান’।

১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তবে শুরু থেকেই বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে পানির ন্যায্য হিস্যা পাচ্ছে না বলে অভিযোগ করে আসছে। অন্যদিকে, গত মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে ফারাক্কার ফিডার ক্যানেলে পানির নাব্যতা কমে যাওয়ায় ভারতকে ফারাক্কার তাপবিদ্যুেকন্দ্রের ছয়টি ইউনিট বন্ধ রাখতে হয়। ফলে দেখা যাচ্ছে, গোটা বিশ্বের মতোই দক্ষিণ এশীয় রাষ্ট্রগুলোতে পানিকেন্দ্রিক সংকট ক্রমেই প্রকট হচ্ছে। উল্লেখযোগ্য যে, দক্ষিণ এশিয়ার এই অঞ্চলে বিশ্বের মোট দরিদ্রের ৪০ শতাংশের বসবাস। বর্তমানে রাষ্ট্রগুলো জনসংখ্যা বৃদ্ধি, দ্রুত শিল্পায়ন ও নগরায়ণের ফলে পানিসম্পদের ওপর অব্যাহত চাপ মোকাবিলা করছে। এই চাপ সামলাতে প্রতিনিয়ত হাতে নিচ্ছে নতুন নতুন বাঁধ তৈরির পরিকল্পনা। এই বাঁধগুলো একদিকে বিদ্যুত্সহ কৃষিতে আমূল পরিবর্তন নিয়ে এলেও, ভাটির রাষ্ট্রগুলোর জন্য তৈরি করছে পরিবেশ ও প্রতিবেশগত নানান ঝুঁকির। এসব সংকট, দ্বন্দ্ব ও সম্ভাবনার বিশ্লেষণ তুলে ধরেছেন মোহাম্মদ আতিক রহমান। প্রবন্ধটির শিরোনাম ‘গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদী অববাহিকায় বাঁধ নির্মাণ প্রতিযোগিতা ও  পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার ভবিষ্যত্’।

মেধাপাচার বা ব্রেইন ড্রেইন আলোচিত একটি বিষয়। সাধারণভাবে এটা বিশ্বাস করা হয় যে মেধাবীরা বাংলাদেশে থাকতে চায় না। তবে এর নেপথ্যের কারণগুলো সম্পর্কে সবার একটা সাধারণ ধারণা থাকলেও, সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তা পরিবর্তিত হয়েছে। এই পরিবর্তনের ফলে তাদের কাঙ্ক্ষিত জীবনাচরণ এবং বাংলাদেশে বিরাজমান পরিস্থিতির মধ্যে বিদ্যমান বিরোধগুলো স্পষ্ট হচ্ছে। চাহিদা ও প্রাপ্তির মধ্যে অসামঞ্জস্যের ফলে দেশের সঙ্গে সম্পৃক্ততা হ্রাস পাচ্ছে এবং একই গতিতে অন্য দেশে চলে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই বিষয়টির জটিলতা এবং গুরুত্ব অনুধাবন করে এই সংখ্যায় অ্যালেন ব্যালের ‘ঢাকায় বাংলাদেশি নবীন এবং শিক্ষিতদের মধ্যে অভিবাসন আকাঙ্ক্ষা’ শীর্ষক প্রবন্ধ ছাপা হলো।

মানুষের প্রয়োজনে এবং কালের প্রবাহে সমাজে পরিবর্তন ঘটে। সব পরিবর্তনের মতোই সমাজের পরিবর্তনেরও ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দিক থাকে। এই উপমহাদেশে তেমনই এক পরিবর্তন সূচিত হয়েছিল ইংরেজদের শাসন প্রবর্তনের পর। হিন্দু এবং মুসলমান সম্প্রদায় এই পরিবর্তনগুলোকে বিবেচনা করেছে তাদের নিজস্ব ঐতিহাসিক ও সামাজিক বাস্তবতায়। অন্যদিকে বর্তমানেও পৃথিবীব্যাপী এক বিপুল ও অভূতপূর্ব পরিবর্তন ঘটেছে। এই পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগছে অর্থনীতি, রাজনীতি, ভাষা, সংস্কৃতিসহ জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই। রবীন্দ্রনাথের সমাজ-ভাবনার আলোকে এসব পরিবর্তন এবং গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করেছেন আবুল মোমেন। তাঁর প্রবন্ধের শিরোনাম ‘কালান্তরের ঘূর্ণিপাকে’।

বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা হচ্ছে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক কায়দায় শাসন-শোষণ থেকে স্বাধীনতা লাভ। তাই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং এর সঙ্গে সম্পৃক্ত অন্যান্য ঐতিহাসিক ঘটনাক্রমের বিশ্লেষণ সব সময়ই জাতীয় গুরুত্বের বিষয়। এরই ধারাবাহিকতায় প্রতিচিন্তার এই সংখ্যায় ছাপা হলো দুটি গ্রন্থ-আলোচনা। প্রথম গ্রন্থ-আলোচনাটি মোকাররম হোসেনের ফ্রম প্রোটেস্ট টু ফ্রিডম: দ্য বার্থ অব বাংলাদেশ  নামক গ্রন্থটির। এই বই আলোচনায় একজন মুক্তিযোদ্ধা কীভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস এবং মুক্তিযুদ্ধকে দেখেছেন, তা উঠে এসেছে। ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার উত্সমূলে প্রতিবাদ’ শিরোনামের গ্রন্থ-আলোচনাটি লিখেছেন আসজাদুল কিবরিয়া। এর পরেরটি যুদ্ধাপরাধের বিচারসংশ্লিষ্ট। স্বাধীনতার ঠিক পরের কয়েক বছরে যুদ্ধাপরাধের বিচার বিষয়টি কীভাবে আলোচনায় উঠে এসেছিল তা এই প্রবন্ধের মূল আলোচ্য বিষয়। ‘পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের অসমাপ্ত বিচার আলেখ্য: প্রাকপর্ব’ শিরোনামের গ্রন্থ-আলোচনাটি লিখেছেন মো. ফজলে রাব্বি।