দ্য রাইজ অব ইসলামিক স্টেট: আইসিস অ্যান্ড দ্য নিউ সুন্নি রেভল্যুশন —প্যাট্রিক ককবার্ন, ভার্সো, লন্ডন/নিউইয়র্ক ২০১৪/২০১৫, পৃষ্ঠা ১৯২পটভূমি দ্য রাইজ অব ইসলামিক স্টেট: আইসিস অ্যান্ড দ্য নিউ সুন্নি রেভল্যুশন বইটি প্যাট্রিক ককবার্নের অন্যান্য বইয়ের মতোই আলোচিত একটি বই। মধ্যপ্রাচ্যে আইসিসের উত্থানের কারণগুলো লেখক বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন বইটিতে। তিনি ৯-১১-পরবর্তী মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ভুল নীতিকে দায়ী করেছেন আইসিসের উত্থানের মূল কারণ হিসেবে। এর সঙ্গে গালফ রাষ্ট্রগুলোর আইসিসকে অর্থনৈতিক মদদদান ও ইরাক-সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি ও রাজনীতি কীভাবে আইসিসের উত্থানের জন্য অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল, লেখক তার বিবরণ দিয়েছেন বইটিতে। ১৯২ পৃষ্ঠার বইটিতে ৯টি অধ্যায় আছে। ২০ পৃষ্ঠার মুখবন্ধের পর প্রথম অধ্যায়ে রয়েছে পুরো বইটির সারসংক্ষেপ। দ্বিতীয় অধ্যায়ে মসুল দখলের মধ্য দিয়ে আইসিসের শক্তিশালী হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া বর্ণনা করা হয়েছে। তৃতীয় অধ্যায়ে লেখক উল্লেখ করেছেন আঞ্চলিক শক্তিগুলো কীভাবে তাদের নিজেদের স্বার্থে আইসিসকে মদদ দিয়ে তাদের নৃশংসতা উসকে দেয়। জিহাদিদের উত্থান, নেতৃত্ব ও অন্যান্য জিহাদি দলের সঙ্গে আইসিসের সম্পর্কের কথা চতুর্থ অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন ককবার্ন। পঞ্চম অধ্যায়ে বলা হয়, কীভাবে জিহাদিরা ইরাকে একের পর এক শহর দখল করতে থাকে ও ষষ্ঠ অধ্যায়ে ককবার্ন লিখেছেন, কীভাবে জিহাদিরা সিরিয়ার আন্দোলন নিজেদের সুবিধার্থে ব্যবহার করে সরকারবিরোধী দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোকে নিজেদের করায়ত্ত করে। সৌদি আরব আইসিসকে অনড় সমর্থন ও মদদ দিয়ে এসেছে ইরাক ও সিরিয়াতে শিয়া পৃষ্ঠপোষক সরকার দমনের জন্য। আইসিস শুধু একটি ত্রাস সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী নয়, বরং একটি আদর্শ, যা বিশ্বজুড়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের প্রচুর নাগরিক দলে দলে আইসিসে যোগ দিচ্ছে। এই ‘নির্ভীক’ আইসিস জিহাদিরা যখন যুদ্ধ শেষে নিজ নিজ দেশে ফিরে আসবে, তখন তারা নিজ দেশের সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্রতী হবে। এমতাবস্থায় আইসিসের মদদদাতা সৌদি আরব তাদের বিভিন্ন নীতিগত পরিবর্তন এনে এই দানব প্রতিহত করার চেষ্টা করছে, যার বর্ণনা সপ্তম অধ্যায়ে ককবার্ন দিয়েছেন। অষ্টম অধ্যায়ে আইসিস যুদ্ধে পক্ষপাতী ও দায়িত্বহীন পশ্চিমা গণমাধ্যমের নেতিবাচক আলোচনা করেছেন ককবার্ন। শেষ অধ্যায়ে লেখক আবারও আইসিসের উত্থানের সারসংক্ষেপ উল্লেখ করে আরব বসন্ত-পরবর্তী রাষ্ট্রগুলোর অস্তিত্ব নিয়ে তাঁর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর সম্ভাব্য অবস্থান ও নীতিগত পরিবর্তনই নির্ধারণ করবে আইসিসের ভবিষ্যত্।
ফরেন পলিসি জার্নালের মতে, ককবার্নের বইটি আইসিস বিষয়ে জানার জন্য যথার্থ। বইটি এই দীর্ঘ যুদ্ধে জড়িত বিভিন্ন অংশীদারের ভূমিকা পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করে। মধ্যপ্রাচ্যে এই যুদ্ধ যতই অগ্রসর হচ্ছে, ততই যেন এর প্রকৃতি আরও ভয়াবহ হচ্ছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক সাংবাদিক ও রাজনীতিবিষয়ক লেখক সাইমম হার্শের মতে ককবার্ন বর্তমানে ইরাকবিষয়ক সবচেয়ে ভালো সাংবাদিক। নিউইয়র্ক টাইমস-এর মতে, বইটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বর্ণনার প্রাচুর্যে ভরা। দ্য অবজারভার-এর মতে, মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি ও সংকট সম্পর্কে লেখা বইগুলোর মধ্যে খুব কম বই বইটির মতো তথ্যসমৃদ্ধ।
ব্রিটিশ জার্নালিজম অ্যাওয়ার্ডের বিচারকদের মতে, প্যাট্রিক ককবার্ন আইসিসের আবির্ভাব সম্পর্কে শুরু থেকেই সোচ্চার। আইসিস বিষয়ে এত গভীরতা, বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন ও অন্তর্দৃষ্টিমূলক লেখা যখন তিনি লিখছিলেন, তখন আর কেউ এই আসন্ন হুমকির ভয়াবহতা সম্পর্কে সোচ্চার ছিলেন না। তাঁদের মতে, এমআই-৬ ব্রিটিশ ব্রিগেডকে বাদ দিয়ে প্যাট্রিক ককবার্নকে নিয়োগ দেওয়া উচিত। মার্কিন সাংবাদিক, সমাজকর্মী, লেখক ও প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সাবেক রাজনৈতিক সহযোগী, সিডনি স্টোন ব্লুমেন্থাল হিলারি ক্লিনটনকে লেখা এক ই-মেইলে প্যাট্রিক ককবার্নকে ইরাক বিষয়ে সবচেয়ে তথ্যসমৃদ্ধ সাংবাদিক বলে উল্লেখ করেছেন।১
ককবার্নের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা ও গভীর অন্তর্দৃষ্টির প্রতিফলন ঘটেছে বইটিতে। আইসিস বিষয়ে যাদের জানার আগ্রহ আছে, তাদের জন্য বইটি চিন্তার খোরাক জোগায়। বইটিতে ইরাকের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে যে বিশদ আলোচনা আছে, তা এই বিষয়ে আগ্রহী পাঠক ও লেখকের জন্য নির্দেশক বই হিসেবে ব্যবহূত হতে পারে। তবে পুরো বইয়ে আইসিস উত্থানের কারণগুলো বিভিন্ন অংশে বিচ্ছিন্নভাবে বর্ণনা করা আছে, যা কখনো পুনরাবৃত্তিমূলক ও কখনো প্রয়োজনাতিরিক্ত। লেখার ক্ষেত্রে বইটি কাঠামোহীন। সিরিয়ার উত্তরাঞ্চল ও ইরাকে আইসিসের উত্থান ও এই বিষয়ে তথ্য বিস্তারের আবশ্যকতা বিষয়ে পশ্চিমা রাজনীতিক ও গণমাধ্যম উদাসীন। সেই শূন্যস্থান পূরণের উদ্দেশ্যে ককবার্ন এই আলোচনামূলক বইটি লিখেছেন। বইটি মূলত তাঁর ইরাকে আইসিস বিষয়ে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আলোকে লেখা। বইটিতে অন্য কোনো রেফারেন্স বা তথ্যসূত্র ব্যবহার করা হয়নি। সে ক্ষেত্রে বইটির প্রকৃতি ভিন্ন হতে পারত, বইটি বর্ণনামূলক না হয়ে, তাঁর অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা বিষয়ে সাক্ষাত্কারমূলক বা আত্মজীবনীমূলক বই হলে পাঠকের পড়ার ক্ষেত্রে হয়তো আর একটু স্বস্তিদায়ক হতো। বইটির স্বীকৃতি অংশে লেখক বলেছেন, বইটির বিভিন্ন অধ্যায় বিভিন্ন সময়ে, কখনো ২০১৪ সালে নিউইয়র্কের আর্ট ফাউন্ডেশনে বক্তৃতা দেওয়ার সময় বা ইনডিপেনডেন্ট ও লন্ডন রিভিউ অব বুকস-এর জন্য প্রবন্ধ লেখার সময় লেখা হয়েছে। তাই হয়তো ধারণা করা যায়, বইটির বিভিন্ন অধ্যায়ে লেখার মধ্যে সামঞ্জস্যের অভাব আছে। সে ক্ষেত্রে সম্পাদনার অপ্রতুলতা ধরা পড়ে বইটিতে। বইটির আর একটি বড় দুর্বলতা এখানে আইসিসের আদর্শ, উদ্দেশ্য, লক্ষ্য বা চরিত্র নিয়ে কোনো আলোচনা করা হয়নি। বইটি ২০১৪ সালে আইসিসের মসুল দখলের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে এবং বিভিন্ন সময়ে ২০০৪ থেকে ২০১৪ সালের বিভিন্ন ঘটনা উল্লেখ করেছে। সে ক্ষেত্রে যুদ্ধের উদ্দেশ্য ও কারণ বা যুদ্ধের প্রকৃতি বর্ণনা ছাড়াই যুদ্ধরত দলের উত্থানের কারণ সম্পর্কে বর্ণনা কিছুটা অসম্পূর্ণ বোধ হয়।