যদি কোনো মতবাদে বিশ্বাস থেকে থাকে মার্ক্সবাদের ওপর বিশ্বাস অবশ্যই আছে

অজয় রায়
অজয় রায়

জন্ম ১৯২৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে। রাজনীতিবিদ ও লেখক। স্কুলজীবনেই কমিউনিস্ট নেতাদের সান্নিধ্য পান এবং তখন থেকেই সক্রিয় কর্মী হয়ে ওঠেন। ১৯৪৬ সালে মুন্সিগঞ্জের হরগঙ্গা কলেজে ডিগ্রি ক্লাসে ভর্তি হন। প্রথম কারাবাস ১৯৪৮ সালে। ষাটের দশকে কারা-অভ্যন্তরে থাকা অবস্থায় এমএ পাস করেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনসহ মুক্তিযুদ্ধে রয়েছে বিশেষ অবদান। রাজনৈতিক মামলায় কারাগারে কাটিয়েছেন প্রায় ১৫ বছর। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ বাঙলা ও বাঙালী, আমাদের জাতীয়তার বিকাশের ধারা, বাংলাদেশের বামপন্থী আন্দোলন ১৯৪৭-৭১, গণ-আন্দোলনের নয় বছর, তীরের অন্বেষায় প্রভৃতি। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। এখনো তিনি রাজনীতি ও লেখালেখিতে সক্রিয়।

পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি, ষাটের দশকের আন্দোলন-সংগ্রাম, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন—এই কালপর্বে কমিউনিস্ট পার্টির পরোক্ষ-প্রত্যক্ষ ভূমিকা নিয়ে পার্টির তত্কালীন সক্রিয় নেতা অজয় রায়-এর সঙ্গে মতিউর রহমান-এর আলাপচারিতা।

মতিউর রহমান: শুরুতেই জানতে চাইছি, মার্ক্সবাদে কি আপনার এখনো বিশ্বাস আছে?

অজয় রায়: যদি কোনো মতবাদে বিশ্বাস থেকে থাকে—বিশেষ করে ইতিহাসের বিবর্তন সম্পর্কে কার্ল মার্ক্সের যে বক্তব্য, সমাজবিকাশের বিষয়ে যে বক্তব্য, সেই জায়গায় মার্ক্সবাদের ওপর আমার ধারণা-বিশ্বাস অবশ্যই আছে। সেটা আক্ষরিক অর্থে নয়, তাঁর মূল যে বিষয়, সেখানে বিশ্বাস অবশ্যই আছে।

মতিউর রহমান: মূল বিষয়টি কী? যেভাবে বলা হয়, আদিম সাম্যবাদ, দাসপ্রথা, সামন্তবাদ, পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদের পরে সমাজতন্ত্র, ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। এই যে ব্যাখ্যা এটার কথা কি আপনি বলছেন?

অজয় রায়: শুরু থেকেই একটা প্রশ্ন আমার ভেতরে ছিল। যেমন দাস-সমাজব্যবস্থা নিয়ে যেটা ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের বইতে পড়েছি, তার কোনো ধরন চীন বা ভারতে কখনো দেখিনি। তবে, মিসরসহ প্রাচীন সভ্যতার বেশির ভাগ দেশেই ছিল। শুনেছি, মিসরে পিরামিড তৈরিতে যে বিপুলসংখ্যক মানুষের শ্রম ব্যবহূত হয়েছে, এটার সবই দাসদের। স্বাভাবিকও সেটা। তবে ভারত ও চীন সম্পর্কে এটা খাটে না।

মতিউর রহমান: তাহলে তাজমহলে ২২ হাজার শ্রমিক ২০ বছর কাজ করেছিল, তারা কি দাস হিসেবে, না শ্রমিক হিসেবে? নাকি বেতনভুক্ত কর্মচারী হিসেবে?

অজয় রায়: তারা বনডেড লেবার (বাঁধা শ্রমিক) ছিল। বনডেড লেবার তো এখনো আছে। আগেও ভারতবর্ষে বনডেড লেবার ছিল।

মতিউর রহমান: হ্যাঁ, বিশ্বের বহু জায়গায় সেটা এখনো আছে।

অজয় রায়: একটা বিষয় বলা দরকার, ভারতের কমিউনিস্ট নেতা ডাঙ্গে [শ্রীপদ অমৃত ডাঙ্গে (১৮৯৯-১৯৯১)] ছিলেন লেখাপড়া জানা লোক, সংস্কৃত জানা পণ্ডিত এবং ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির আদিযুগের পরের নেতা। তিনি যখন জেলে ছিলেন, লিখলেন ফ্রম প্রিমিটিভ কমিউনিজম টু স্ল্যাভারি। আমরা তখন ভাবলাম, এই হলো আসল কমিউনিস্ট। কিন্তু ইতিহাসবিদ ডি ডি কোসাম্বি লিখলেন যে ডাঙ্গে কমিউনিস্ট নেতা হলেই ইতিহাস জানবেন, এমন কোনো কথা নেই। খুব কঠিনভাবে কথাটা বলেছিলেন তিনি।

মতিউর রহমান: মার্ক্সবাদের পর্ব বা এর ধারাবাহিক ইতিহাসের মধ্য দিয়ে যদি আপনি আসতে থাকেন, বিশেষ করে অর্থনীতি ও দর্শনের ক্ষেত্রে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের প্রভাব...

অজয় রায়: আমার কাছে যেটা মনে হয় দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়া সব সমাজেই যে একই রকম হবে, তার কোনো মানে নেই। আরও নির্দিষ্টভাবে বললে, উত্পাদিকা শক্তি এবং উত্পাদন সম্পর্কের পরস্পরের যে সংঘাত, এর মধ্য দিয়ে সমাজের যে পরিবর্তন, সেটা আমি গ্রহণ করি।

মার্ক্সবাদ শেখা নিয়ে আমাদের একটা সমস্যা আছে। কারণ আমরা মার্ক্সবাদ শিখেছি কার কাছ থেকে? আপনারা শিখেছেন পাকিস্তান আমলে। আর আমরা শিখেছি আরেকটু আগে থেকে। আমাদের উত্স ছিল প্রধানত বিলেত। বিলেত কোত্থেকে শিখেছে? উনিশ শতকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় দশকের সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিএসইউ) নিয়ন্ত্রণাধীন তৃতীয় আন্তর্জাতিক অর্থাত্ মস্কো থেকে। তার পরবর্তী সময়ে আমরা আরও শিখলাম চীন থেকে। তা ছাড়াও কিন্তু মার্ক্সবাদের আরও কিছু কেন্দ্র ছিল। এর মধ্যে ছিল জার্মানি, ইতালি, স্পেন ও ফ্রান্স। পরে যেহেতু মস্কো তাদের মতভিন্নতা গ্রহণ করতে পারল না; তাই আমরাও বাতিল করলাম।

মতিউর রহমান: সবকিছুর পরে আপনি কী বলবেন, সমাজতন্ত্র বা মার্ক্সবাদ কি শেষ হয়ে গেল? এর কি পুনরুজ্জীবন আর সম্ভব? কিংবা নতুন কেন্দ্র কি তৈরি হওয়া সম্ভব?

অজয় রায়: আমি তো একটা দেখছি, যেমন ওয়ান পার্সেন্ট ভার্সেস নাইন্টি নাইন পাসের্েন্টর লড়াই। বিশ্বে তো দেখলাম—আজকের পুঁজিবাদ ঘুরে ঘুরে একটা জায়গায় আবর্তিত হচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় যে নানা ধরনের প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে, সেগুলো তো গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি আমাদের এখানে শাহবাগ স্কয়ারে তার কিছুটা স্ফুরণ দেখেছি। তবে এসবের মধ্য দিয়ে শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে সমাজ পরিবর্তিত না হোক, দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে ভবিষ্যতের দিকে যে অগ্রগতির পথ, সেটা তো দেখাই যায়।

মতিউর রহমান: বিশ্বব্যাপী সোভিয়েত সমাজতন্ত্র বা পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্র ভেঙে পড়ার মধ্য দিয়ে মার্ক্সবাদ কি ব্যর্থ হয়ে গেল? এর পুনরুজ্জীবনের

সম্ভাবনা কতটুকু?

অজয় রায়: পুনরুজ্জীবনের কোনো উপায় নেই। কারণ পুনরুজ্জীবনের সম্ভাবনা জীবনই ঠিক করে দেবে। ড. নজরুল ইসলাম (বর্তমানে জাতিসংঘে কাজ করছেন) ১৯১৭ সালের অক্টোবরের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে ‘ফল্স স্টার্ট’ বলেছেন। কিংবা যা-ই বলুক, একটা বিষয় হলো সোশ্যালিজম ওয়াজ প্র্যাকটিসড বাই মস্কো। এর কিছু সুফল তো আছে।

সুতরাং সারা বিশ্বে সামগ্রিক পরিবর্তন না আনতে পারলেও ইতিবাচক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী বড় ভূমিকা তো রেখেছেন কমিউনিস্টরা। তার মধ্যে উপনিবেশবাদ-বিরোধী জাতীয় মুক্তি আন্দোলন, আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধ ইত্যাদিতে অনেক বড় অবদান রেখেছে। মার্ক্সবাদের একটা বড় দর্শন হচ্ছে জীবনের চলিষ্ণুতা। বারবার সমাজের এই পরিবর্তন, এটা কিন্তু জীবনই দেখিয়ে দিচ্ছে। এই জীবনটা ডগম্যাটিক মার্ক্সিজম, তা না।

মতিউর রহমান: তাহলে এই যে ডগম্যাটিক ধারণার মার্ক্সবাদ, রাশিয়া বা চীনে ছিল, সেটা কি অচল হয়ে গেছে? নতুনভাবে নানা তর্কবিতর্ক, দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে—আপনি বলছেন, জীবনের চলিষ্ণুতার মধ্য দিয়ে যা টিকে আছে, সেটাকে ভবিষ্যতে কি আমরা মার্ক্সবাদ বলতে পারব?

অজয় রায়: মার্ক্সের আগেই অ্যাজিউম অব মার্ক্সবাদ কথাটা চালু হয়ে গিয়েছিল এবং বিশ্বে সেটা গৃহীত। মার্ক্স যে বিষয়টা দেখিয়েছেন, সমাজটা স্থির নয়, সমাজটা চলমান। সুতরাং এই পরিবর্তনশীলতা তো আমরা অনেক জায়গায় দেখি। আর পরিবর্তনের মধ্যে মানুষের একটা ভূমিকা রয়েছে। সেটাও তো দেখি।

আজ ফল্স স্টার্ট বলি আর যা-ই বলি, যে সংকটটা সৃষ্টি হয়েছে, সেটা হলো তৃতীয় আন্তর্জাতিকের (কমিন্টার্ন) আগে তো দ্বিতীয় কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক ছিল। সেখানে তো শ্রমিক আন্দোলন বা বিপ্লবের মাধ্যমে সারা বিশ্বে পরিবর্তন আনার মতো নানা ধরনের সক্রিয়তা লক্ষ করা গেছে। কিন্তু তারপরে? সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি আন্ডার দ্য কন্ডিশন অব রাশিয়ান হোয়াইট টেরর—তত্কালে কমিউনিস্ট পার্টির গঠনতন্ত্র একটা হয়েছিল। তারা করেছিল সেটা। তারা করেছিল বলশেভিক পার্টি। তার পরবর্তীকালে যখন তৃতীয় আন্তর্জাতিক গঠন করা হয়, সেই গঠনকাঠামোটি, আমাদের দেশে অথবা ইংল্যান্ডে অথবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অন্যের মতাদর্শের হুবহু কেন প্রয়োগ হবে? আমাদের দেশ—যেখানে শ্রমিকশ্রেণিই গড়ে ওঠেনি, শ্রমিকশ্রেণি বাস্তবে সেভাবে ছিলও না, সেখানে শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে কীভাবে বিপ্লব হবে? এসব অবাস্তব অনেক কিছু আমরা ভেবেছি। অনেক ভুল করেছি।

মতিউর রহমান: বিভিন্ন দেশে তো মার্ক্সবাদী বড় বড় পণ্ডিত, নেতা, সংগঠক ছিলেন, তাঁরাও বিকল্প কিছু করতে পারলেন না, শুধু সোভিয়েত নীতি বা পরামর্শ অনুসরণ করলেন। তাঁদেরও পতন হলো। এর দায় কি শুধু দ্বিতীয় বা তৃতীয় আন্তর্জাতিককে দেবেন, নাকি ত্রিশ-চল্লিশ-পঞ্চাশের দশক ধরে দেশে দেশে যাঁরা নেতৃত্ব দিলেন, তাঁদের? মার্ক্সবাদ যদি আপনার কথামতো চলমান-চলিষ্ণু একটা ব্যাপার হয়, তবুও বলা যায়, বড় বড় পণ্ডিত-বিপ্লবী-পরিবর্তনমুখী মানুষ তো ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বেও ছিলেন, তাঁরাও তো পারলেন না নতুন কোনো পথের সন্ধান দিতে।

অজয় রায়: ভারতবর্ষের কথা বলছেন, সেটাই বলি। ভারতের কমিউনিস্টরা কংগ্রেসের মধ্যে থেকে কাজ করতেন। কংগ্রেস-নেতৃত্বের কাছে ব্যাপারটা জানা ছিল—অন্তত পণ্ডিত নেহরু ও মাওলানা আজাদ জানতেন চিনতেন তাঁদের। মন্বন্তররটা শুরু হলো ১৯৪২ সালে আগস্ট আন্দোলনের সময়। অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটিতে সম্ভবত ১২-১৫ জন কমিউনিস্ট ছিলেন। যদি আমার ভুল না হয়, খুব সম্ভবত সরদার শাহ ছিলেন তাঁদের মুখপাত্র। তাঁরা বিরোধিতা করলেন ‘কুইট ইন্ডিয়া’ (ভারত ছাড়) মুভমেন্টের। কেন? ওয়ার ইজ পিপল’স ওয়ার অর্থাত্ যুদ্ধটা সাধারণ মানুষের হয়ে গেছে। যখন কমিউনিস্টরা বিরুদ্ধে ভোট দেবেন, তখন মাওলানা আজাদ সরদার শাহকে মঞ্চে ডেকে নিয়ে গেলেন। সেখানে তাঁকে বললেন, তোমাদের যুক্তি আমি বুঝি। কিন্তু এখন এটার বিরুদ্ধে তোমরা যেয়ো না—তোমরা বিরুদ্ধে ভোট দিয়ো না। ভোট দিলে তো তোমাদের ১৫-২০টা ভোটে কিছু আসবে-যাবে না। তারপর কী হলো?

আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, আমি তখন বেনারসে থাকি। ক্লাস নাইনে পড়ি। এক দিন বেনারস ইউনিভার্সিটির গেটে ছাত্ররা মিছিল করতে বেরোবে, বাইরে পুলিশসহ সরকারের বাহিনী আছে। তারা বেরোলেই আক্রমণ করা হবে। তার আরেক পাশে কয়েকজন কমিউনিস্ট মাইকে প্রচার করছেন, এই আন্দোলন ভুল। তাঁরা ওই আন্দোলনের পুরোপুরি বিরুদ্ধাচরণ করছেন। এই ঘটনা, এই বিচ্ছিন্নতা, এর দায়টা কার?

১৯৪২-এর পরে ’৪৫-’৪৬-এ গান্ধী সম্পর্কে যে নিন্দাসূচক কথাবার্তা কমিউনিস্টরা বলেছেন, তা ঠিক ছিল না। আমার মনে আছে, পাকিস্তান হওয়ার পরপরই তো আর সংকীর্ণ অতি বিপ্লবী বামধারা আসেনি। পাকিস্তান হওয়ার পর কয়েক মাস সময় ছিল। ১৯৪৮ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসের পর তা শুরু হলো। এসবের আগে কমিউনিস্ট পার্টির একটা বুকলেট বের হলো ‘স্বাধীন সুখী পাকিস্তান গড়ে তুলুন’। তখন তো একটাই পাকিস্তান ছিল। আমিও রংপুরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এটা বিক্রি করেছি ছাত্রদের কাছে। অনেক বিক্রি হয়েছে। কারণ, সেটা ছিল জাতীয় আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। যেই উল্টোটা হয়ে গেল, অর্থাত্ সমাজতন্ত্রের জন্য সশস্ত্র বিপ্লবের সিদ্ধান্ত হয়ে গেল—সবকিছুর বদল ঘটে গেল।

মতিউর রহমান: হ্যাঁ কলকাতায় পার্টির বৈঠকের সিদ্ধান্তের পর ১৯৪৮ থেকে শুরু হয় ‘ইয়া আজাদি ঝুটা হ্যায়’ সশস্ত্র আন্দোলন। ’৪৯-’৫০-’৫১-তে এ রকম আন্দোলনের অবস্থা কি ছিল?

অজয় রায়: শোনেন, মুন্সিগঞ্জ শহরে আমাকে চিনত না, এ রকম লোক কম ছিল। আমাকে সমর্থন করুক আর না করুক, মানুষ আমাকে চিনত। কারণ ছোট্ট শহর মুন্সিগঞ্জে তখন ১ হাজার লোকের বাস। আমাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসা হলো ’৪৯ সালের প্রথমে—বজ্রযোগিনী গ্রাম থেকে। গরুর দড়ি দিয়ে বেঁধে গ্রাম থেকে হাঁটিয়ে আমাকে নিয়ে আসা হয়েছিল পুলিশ কেন্দ্রে। একটা লোকও সহানুভূতি জানায়নি। আমি মোটেও কোনো অপরিচিত লোক ছিলাম না। সবেমাত্র পাকিস্তান হয়েছে। মানুষের মধ্যে তখনো আশাবাদ আছে। তখন সশস্ত্র বিপ্লবের ডাক অসম্ভব-অবাস্তব ভাবনা ছিল।

মতিউর রহমান: ওই ভুলের দীর্ঘস্থায়ী একটা প্রভাব পড়ল গ্রেপ্তার-অত্যাচার-নির্যাতন, রাজশাহী জেলের অভ্যন্তরে খাপড়া ওয়ার্ডে হত্যাকাণ্ড ইত্যাদির মধ্য দিয়ে। ইতিমধ্যে পার্টির মধ্যে চিন্তার পরিবর্তন এল কিছুটা। আবার তো বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন। আবার কলকাতা বৈঠকের পর পার্টির পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে ’৫১ থেকে ’৫২ ভাষা আন্দোলনে ভূমিকা-উদ্যোগ তো ছিল।

এরপর ’৫৪-এর নির্বাচন এল। এরপর ১৯৫৮ সাল। আবার আমরা যেভাবেই দেখি না কেন, ১৯৬২-তে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন, ছাত্র আন্দোলন বা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিশাল একটা গণ-আন্দোলন গড়ে উঠল। সেখানে কমিউনিস্ট পার্টির গুরুত্বপূর্ণ একটা ভূমিকা ছিল। আবার বলতে পারেন কমিউনিস্ট পার্টি আত্মগোপনে থাকলেও ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে আবার তারা সমাজে ও দেশে প্রভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম হলো।

কমিউনিস্ট পার্টি এই যে ভূমিকা রাখল ’৫২ থেকে ’৬২ কিংবা ’৬২ থেকে ’৬৮ পর্যন্ত, সেখানে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট পার্টির কি প্রভাব ছিল? নাকি এই আন্দোলনটা নিজেদের উদ্যোগেই গড়ে তোলা হয়েছিল? সেই সময়ে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিআই) পরামর্শ কি আমরা নিতাম? নাকি নিজেরা স্বাধীনভাবে চলতাম?

অজয় রায়: কিছু পরামর্শ হয়তো নেওয়া হতো। কিছুটা যোগাযোগ ছিল। কিন্তু সিদ্ধান্ত স্বাধীনভাবে নিজেরাই নিতাম। ফলে আমার বিবেচনা হচ্ছে, মাঝখানে একটু বিরতি বাদ দিলে কমবেশি একাত্তর পর্যন্ত—জাতীয় আন্দোলনকে প্রভাবিত করার মতো কিছু কাজ আমরা করেছি। আর সেটা শুধু কমিউনিস্ট বা মার্ক্সবাদের জন্য নয়, এ দেশের স্বাধীনতার পক্ষে, এ দেশের বিকাশের পক্ষে। এমনকি এখানকার মননশীলতা বিকাশের ক্ষেত্রেও কিন্তু কমিউনিস্টরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পেরেছেন। এখানে সেই রকম ঘটেছিল বলেই তো হয়েছিল। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর সেই বিখ্যাত গল্প ‘একটি তুলসী গাছের কাহিনী’ পড়লে এখনো চোখে জল আসে। এটা ঠিক গল্প-কবিতা-গান-গণসংগীত-সংস্কৃতিচর্চা, ভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন—এসবের ক্ষেত্রে আদর্শগত অবস্থানে থেকেও বেশ বড় ভূমিকা পালন করেছেন কমিউনিস্ট ও বামপন্থীরা। কমিউনিস্টদের-বামপন্থীদের বড় একটা গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান ছিল এই সময়টায়। তাঁদের এই প্রভাব বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে একেবারে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।

মতিউর রহমান: কমিউনিস্ট পার্টি সাংগঠনিকভাবে ছোট ছিল, দুর্বল ছিল। কিন্তু আদর্শগতভাবে চিন্তাচেতনার দিক থেকে ছিল বেশ অগ্রসরমাণ। যে কারণে প্রভাবকের একটা ভূমিকা ছিল। কমিউনিস্ট নেতৃত্ব যত ছোট, যা-ই হোক না কেন, তারা এটা ভেবে করেছে। আপনার মতেও তারা এটা স্বাধীনভাবেই করেছে।

অজয় রায়: তবে একটা বিষয়ে আমি বলতে পারি। সেটা জেলখানার অভিজ্ঞতা। তখন ওই সময়ের কমিউনিস্টরা একটা কৌশল নিলেন। সেটা হলো আওয়ামী মুসলিম লীগের মধ্যে থেকে কাজ করো, পরে আবার আওয়ামী লীগের মধ্যে থেকেও কাজ করো। এর বিরুদ্ধে একটা প্রবল অভিমত ছিল তখনকার পার্টিতে। যাঁরা এর বিরোধিতা করেছেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন খুলনার ডা. মারুফ হোসেন প্রমুখ। আমার মনে আছে, রাজশাহীর পার্টিও এর বিরুদ্ধে ছিল। আমরা যাঁরা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ছিলাম, তাঁরা ছিলাম এই নীতির পক্ষে। আমাদের বোঝানোর জন্য স্বদেশ বোস আর নলিনী দাশকে পাঠানো হলো রাজশাহী জেল থেকে। তাঁরা দুজন এসে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত আমাদের বোঝাতে থাকলেন। তাঁরা বললেন, কমিউনিস্টদের স্বতন্ত্র লাইন, স্বাধীন লাইন আছে। যুক্তফ্রন্টে যেহেতু কমিউনিস্টরা নেই, তাহলে কেন এদের সঙ্গে থাকবে। অ্যাট দ্যাট টাইম পার্টি লিডারশিপ সিদ্ধান্ত নেয়, এদের সঙ্গে অর্থাত্ আওয়ামী মুসলিম লীগের মধ্যেই থাকতে হবে। পরে আওয়ামী লীগ হলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে থেকে কাজ করার সিদ্ধান্ত হয়। আর ন্যাপ যখন বিভক্ত হয়, পার্টি আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগ থেকে তখনই পদত্যাগ করার পক্ষে ছিল না।

মতিউর রহমান: তাহলে কি ন্যাপ করার পেছনে মারুফ হোসেনদের মতো যাঁরা ভাবতেন, তাঁদেরই দায়? তাঁরাই প্রাধান্য সৃষ্টি করে আওয়ামী লীগ ভেঙে ন্যাপ করলেন?

অজয় রায়: আপনি ঠিক ধরেছেন। তেমনটিই ঘটেছিল।

মতিউর রহমান: তাহলে ঘটনাটা কী? পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে মাওলানা ভাসানীর বিরোধিতা করা? আর কে কে ছিলেন এ রকম চিন্তার?

অজয় রায়: গুলিস্তান সিনেমা হলে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলের (১৯৫৭ সাল) দ্বিতীয় দিনে পররাষ্ট্রনীতির বিষয়ে অনুষ্ঠিত ভোটাভুটিতে শহীদ সোহরাওয়ার্দী জিতে গেলেন আর মাওলানা ভাসানী হেরে গেলেন। মাওলানা ভাসানী বাইরে এসেই তত্ক্ষণাত্ পশ্চিম পাকিস্তানে কয়েকটি তার পাঠালেন। তার মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সম্পাদক মাহমুদুল হক ওসমানীর কাছে একটা তারবার্তা পাঠালেন। আরও কয়েকজনের কাছে পাঠালেন। তিনি তাঁদের ঢাকায় ডাকলেন। মোজাফ্ফর আহমদ মাওলানার সচিব হিসেবে কাজটা করতেন। এই যে ডেকে বসলেন, তার আগে ন্যাপ নেতৃত্বের সঙ্গে পার্টির নেতৃত্বের কোনো আলোচনা হয়নি।

মতিউর রহমান: তখন কি পার্টি-নেতৃত্ব আওয়ামী লীগের মধ্যে এই বিভেদ চায়নি?

অজয় রায়: অন্তত তখন চায়নি। আওয়ামী লীগের ভেতরে থেকে কিছু পরিবর্তন না এনে এটা তো পার্টি চাইতে পারে না। এটা যখন হয়ে গেল, তখন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বড় বড় নেতা এলেন। বেলুচিস্তান থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গার নেতারা এলেন আলোচনা করার জন্য। ইতিমধ্যে শহীদুল্লা কায়সারের সঙ্গে কথা হলো। তিনিও এই বিভক্তির পক্ষে ছিলেন না। তিনি তখন পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে ছিলেন। তিনি আমাকে এর সঙ্গে থাকতে বললেন। পরে দেখলাম এই প্রভাব পড়েছে মন্ত্রিসভায়।

এটা জানেন বোধ হয়, সেই সময়ে প্রাদেশিক পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানে ন্যাপের ২৯ জন এমএলএ ছিলেন। তখন বিভেদ ছিল কৃষক প্রজা পার্টি এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে। ন্যাপই ছিল ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য বিশেষ শক্তি। বিষয়টা এমন দাঁড়াল যে ন্যাপে এসে লোকজন বলতে লাগলেন, আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে এসেছি, আমরা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ভোট দেব। কিন্তু পার্টির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল, না, এটা ঠিক হবে না। আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে এসেছি, ঠিক আছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের সরকারকে টিকিয়ে রাখতে হবে। কারণ, যে সংবিধান হয়েছে, সেই সংবিধানের ভিত্তিতে একটা নির্বাচন হতে হবে পাকিস্তানব্যাপী। সেটাই হবে অ্যাডভান্সমেন্ট ফর ডেমোক্রেসি। কারণ পার্টি জানত, মাওলানা ভাসানীর সঙ্গে আইয়ুব খানের দেওয়া-নেওয়ার আলোচনা হচ্ছে। ঢাকার ইয়ার মোহাম্মদ খানের মাধ্যমে এটা হতো। তাই ন্যাপের সঙ্গে থাকা সত্ত্বেও আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে আমরা ভোট দিইনি। তবে একবার ভোট দিতে হয়েছিল। যখন কেন্দ্রীয় ন্যাপ সিদ্ধান্ত নিল, তখন পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপকে এটা করতে হয়েছে।

মতিউর রহমান: আপনি যা-ই বলুন, পঞ্চাশ বা ষাটের দশকে পার্টি তেমন শক্ত ভিতের ওপর কিন্তু ছিল না। ওই সময় কিছু ক্ষেত্রে কিছু ভূমিকা পালন করে কিছু স্বীকৃতি পেয়েছে। কিন্তু বড় পরিসরে কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করার মতো জনভিত্তি কিংবা সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি কমিউনিস্ট পার্টি করতে পারেনি। ন্যাপও পারেনি। এ বিষয়ে কী বলবেন?

অজয় রায়: ১৯৫৭ সালের দিকে অনিল মুখার্জি, শহীদুল্লা কায়সার—তাঁদের সঙ্গে আমার নামটা যুক্ত করে দিয়েছিলেন। আমরা একটা প্রস্তাব দিই। এখনকার সমাজে মধ্যবিত্তের যে বিকাশ ঘটছে, তাতে কমিউনিস্ট পার্টি কি ভিত্তি পাবে? পাবে না। সুতরাং কমিউনিস্ট পার্টির উচিত, একটা প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলে পার্টির কাজ করা।

তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম সম্মেলন ১৯৫৬ সালে হয়। ওটাও কলকাতাতেই হয়েছিল। এর আগে ১৯৫১ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির সম্মেলনে ডাঙ্গে (শ্রীপদ অমৃত ডাঙ্গে) এসেছিলেন গোপনে। সেখানে রণনীতি-রণকৌশল নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। ডাঙ্গে বললেন, শোনো, তোমরা এসব রণনীতি-রণকৌশল বাদ দাও। বরং সমাজতন্ত্র কী, তোমরা কমিউনিস্ট যারা আছ, সেটা বিভিন্ন সংগঠন থেকে প্রচার করো। সেটাই তোমাদের আসল করণীয়। সেখানে ওই সময় যাঁরা ছিলেন, সবাই তাঁর কথাটা গ্রহণ করলেন। এই বিষয়গুলো যদি ধরেন, তাহলে বলা যায়, কমিউনিস্ট পার্টির ভেতরে এই ধরনের চিন্তা তো ছিলই।

মতিউর রহমান: ১৯৫৬ সালের সম্মেলনে কি আপনি গিয়েছিলেন?

অজয় রায়: না, আমি তখন জেলে ছিলাম।

মতিউর রহমান: ওই সময় বা ওই সম্মেলনে কি এই ধরনের কোনো আলোচনা হয়েছিল? কোনো দলিলে তা পাওয়া যায় না?

অজয় রায়: না, পাওয়া যায় না।

মতিউর রহমান: ১৯৬০ সালের দিকে কি এ রকম আলোচনা হয়েছিল?

অজয় রায়: অনিলদারা তো এ রকম আলোচনা করেছেন।

মতিউর রহমান: পার্টির কোনো ফোরামে আলোচনা হয়েছে কি না?

অজয় রায়: পার্টির কোনো ফোরামে না হলেও পার্টির নেতৃত্ব মণিদা, খোকাদা—তাঁদের সঙ্গে তো আলোচনা হতোই। তাঁদের আলোচনায় আমি থাকতাম। তবে ’৬০ সালের পরে নতুন করে আর আলোচনাটা আসেনি। তত দিনে তো আইয়ুব খান ক্ষমতায় এসে গেছেন।

মতিউর রহমান: তখন তো আওয়ামী লীগ আওয়ামী লীগের মতো, ন্যাপ ন্যাপের মতো। আর সিপিবি আত্মগোপনে থেকে ন্যাপের ভেতরেও কাজ করে। এই আলোচনা তো সত্তরের দশকেও কিছুটা এসেছিল। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে ’৮৭-তে তো এল—কমিউনিস্ট পার্টি নামে কোনো সংগঠন না করে অন্য নামে প্রগতিশীল দল গঠনের কথা। তখন তো মোহাম্মদ ফরহাদরাও এই রকমই ভেবেছিলেন।

অজয় রায়: মোহাম্মদ ফরহাদ দলিল উত্থাপন করেননি। তবে তাঁর হয়ে উত্থাপন করেন বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ। নাহিদ তখন কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন।

মতিউর রহমান: পরে তাঁরা মস্কোতে গেলেন।

অজয় রায়: ফরহাদ গেলেন, অনিলদা ওখানেই ছিলেন। সালাম ভাই ভিন্নমত পোষণ করলেন। তিনিও গেলেন।

মতিউর রহমান: আর কে গেলেন?

অজয় রায়: সালাম ভাই গিয়েছিলেন, মণি সিংহ ছিলেন। নাহিদ গিয়েছিলেন।

মতিউর রহমান: নাহিদ গিয়েছিলেন?

অজয় রায়: নাহিদ গিয়েছিলেন। কারণ, দলিল নাহিদের নামে ছিল। নতুন প্রস্তাব ছিল ভিন্ন নামে প্রগতিশীল দল গঠন করার। ফরহাদ ভাই নিজের নামে দলিল দেননি।

মতিউর রহমান: তাঁরা তো দুইটা ডকুমেন্ট নিয়ে মস্কো গেলেন। কিন্তু মস্কোতে সোভিয়েত-বন্ধুরা ফরহাদ ভাই ও নাহিদের প্রস্তাবটা গ্রহণ করলেন না।

অজয় রায়: হ্যাঁ, তাঁরা সমর্থন করেননি।

মতিউর রহমান: বলল কী, কমিউনিস্ট নামেই কাজ করতে হবে? যুক্তিগুলো কি মনে আছে আপনার?

অজয় রায়: বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর দেশের গণতান্ত্রিক দিকটা অনেক দূরে সরে যায়। সুতরাং এই দিকটা কোনো দিন ফিরে আসবে না। সুতরাং পরের ধাপে যেতে হলে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে যেতে হবে—এ রকম সাধারণ যুক্তি ছিল।

মতিউর রহমান: তার মানে, ’৫০ থেকে শুরু করে ’৮০ পর্যন্ত কমবেশি আলোচনাটা ছিল যে, পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশের মতো দুর্বল অর্থনীতির ভিত্তি, মুসলিমপ্রধান দেশ, শ্রমিকশ্রেণির অনুপস্থিতি, সামন্তবাদের প্রভাব ইত্যাদি—এসব কারণে কমিউনিস্ট পার্টির নামে অগ্রসর হওয়া কঠিন। অন্য একটা মত ছিল, কমিউনিস্ট পার্টির নামেই কাজ করতে হবে। আরেকটা হলো ভিন্ন নামে প্রগতিশীল কোনো দল ন্যাপ বা অন্য কোনো দলের মধ্যে থেকে কাজ করা।

অজয় রায়: গণতান্ত্রিক পর্যায়ে বিষয়টা সেই রকমই—সমাজতন্ত্র বাদ দেন। গণতন্ত্রকে স্থিতিশীল করা ইত্যাদি নিয়ে প্রগতির পথে অগ্রসর হওয়া আরকি।

মতিউর রহমান: তাহলে দুর্বলতাগুলোর মধ্যে একটা দেশের অর্থনৈতিক দুর্বলতা, আদর্শগত দুর্বলতা, তাত্ত্বিকভাবে বিভক্তি বা অস্পষ্টতা...এসবই ছিল। কিন্তু এটা একটা বাস্তব কারণ, আদর্শগত চিন্তার বিভক্তি—এ রকম একটা দুর্বল অবস্থানেই পার্টি সব সময় থেকে গেল।

অজয় রায়: কিন্তু এর মধ্যে এসে গেল স্বাধীনতাসংগ্রাম।

মতিউর রহমান: আপনি তো কেন্দ্রীয় কমিটিতে এলেন ১৯৭৩ সালে?

অজয় রায়: হ্যাঁ।

মতিউর রহমান: ’৬৯-৭০ সালের দিকে কি সিপিআইয়ের সঙ্গে যোগাযোগের কোনো সুযোগ ছিল? যোগাযোগ হতো?

অজয় রায়: খুব বেশি ছিল না।

মতিউর রহমান: তখন সোভিয়েত পার্টির সঙ্গে কোনো যোগাযোগ হতো?

অজয় রায়: সিপিএসইউয়ের সঙ্গে কিছুটা ছিল।

মতিউর রহমান: সেটা কি প্রভাবিত করার মতো কোনো যোগাযোগ?

অজয় রায়: তারা প্রভাবিত করতে চাইলে সেই বার্তাটাও সেভাবেই আসত।

মতিউর রহমান: তাহলে ’৬০ থেকে শুরু করে ’৭০-৭১—এই সময়কাল পর্যন্ত পার্টি নেতৃত্ব মোটামুটি স্বাধীনভাবেই কাজ করেছে বলা যায়?

অজয় রায়: হ্যাঁ, কমবেশি নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

মতিউর রহমান: এই সময়টা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিল বলেই সামগ্রিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কাজগুলো পার্টি করতে পেরেছিল?

অজয় রায়: যদি বাঁধনটা থাকত, তাহলে এ রকমটা হতো না। আবার,

আমি স্পষ্টভাবেই বলি, এই সময়ে পার্টির বড় দলের ওপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় ছিল না।

মতিউর রহমান: আমি ’৮৭ কি ’৯০-এর দিকে কলকাতায় গিয়েছিলাম। সেখানে নেপাল নাগের স্ত্রী আমাকে একটা প্যাকেট দিয়েছিলেন। সেটাতে দুটো পুরোনো শিখা আর নেপালদা মস্কোতে ’৮১-এর সম্মেলনে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের সঙ্গে কী আলাপ করবেন, সেসব পয়েন্ট ছিল। সেখানকার আলোচ্যসূচির কিছু বিষয় আমার মনে আছে। সেসব নিয়ে হয়তো পরামর্শ করা হয়েছে। তারপরও আমরা ধরে নিতে পারি, একাত্তরে নিজেরা স্বাধীনভাবেই যুদ্ধে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে জাতীয় আন্দোলনে বড় ভূমিকা পালন করেছে কমিউনিস্ট পার্টি।

অজয় রায়: ঠিক তা-ই।

মতিউর রহমান: যোগাযোগটা...

অজয় রায়: যোগাযোগটা কিছু ছিল।

মতিউর রহমান: নেপাল নাগ তো মস্কোতে দুবার গেলেন—’৮১-তে পার্টির কংগ্রেসেও গেলেন। পরে আবার গেলেন।

অজয় রায়: আর অনিলদা তো চিকিত্সার জন্য গেলেন।

মতিউর রহমান: ষাটের দশকের শেষের দিকে চট্টগ্রাম থেকে একটা জাহাজে করে তিনি গিয়েছিলেন গোপনে, তাই না?

অজয় রায়: না না, কলকাতা থেকে। চট্টগ্রাম থেকে না। তাঁর একটা কঠিন অসুখ হয়েছিল। সে জন্য প্রথমে কলকাতায় গিয়েছিলেন চিকিত্সার জন্য। সেখান থেকেই সোভিয়েত জাহাজে তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।

মতিউর রহমান: আমাকে কিন্তু বলেছিলেন, তিনি চট্টগ্রাম থেকে সেখানে গিয়েছিলেন কঠিন এক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে। পাসপোর্ট ছাড়া।

অজয় রায়: হ্যাঁ, পাসপোর্ট ছাড়া গিয়েছিলেন।

মতিউর রহমান: তাহলে তিনি ফিরলেন কেমন করে?

অজয় রায়: ওভাবেই এসেছেন। প্রথমে কলকাতায় এসে নেমেছেন। তখন তো মুক্তিযুদ্ধ চলছে।

মতিউর রহমান: কিন্তু অনিলদা এ নিয়ে কোথাও লেখেননি?

অজয় রায়: না, এটা লেখেননি।

মতিউর রহমান: আমরা যদি এভাবে দেখি, ’৫০-৬০-এর দশকে একধরনের উত্থানপতন-দ্বন্দ্বসংঘাত এসবের মধ্য দিয়ে এগোল সিপিবি। পঞ্চাশের দশকে ছাত্র-যুবক আর ষাটের দশকের দিকে কিছুটা শ্রমিক আর কৃষকশ্রেণির সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ে। কিন্তু জাতীয় আন্দোলনে অংশগ্রহণ করা—গণতন্ত্র, স্বায়ত্তশাসন, ভাষা-সংস্কৃতির জন্য কাজ করার ব্যাপারে নেতৃত্বে না থাকলেও

পার্টি বিশেষ উদ্যোগী ভূমিকা পালন করতে পেরেছিল। এই পর্বটাকে আপনি কীভাবে দেখেন?

অজয় রায়: আমি মনে করি, সেটা ছিল সঠিক ভূমিকা এবং আমাদের দেশের মানুষের জন্য স্বাধীনতা যদি একটা ল্যান্ডমার্ক হয়, তাহলে স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্র প্রস্তুতের ব্যাপারে আমরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পেরেছি। স্বাধীনতা আনার ক্ষেত্রে চিন্তাচেতনা বিনির্মাণে দ্বিজাতিতত্ত্বের বাইরে আসার চেষ্টা করা হয়, সেখানেও আমরা ভূমিকা রাখতে পেরেছি।

মতিউর রহমান: ষাটের দশকে সিপিবির নেতৃত্বে চীন-সোভিয়েত দ্বন্দ্বটা নিয়ে কিছু বলবেন? এখন কীভাবে দেখেন ব্যাপারটাকে? একদিকে হক-তোয়াহার নেতৃত্বে চীনের নীতির প্রতি সমর্থন আর একদিকে মণি সিংহ, খোকা রায় প্রমুখের নেতৃত্বে সংখ্যাগরিষ্ঠরা...।

অজয় রায়: চীন-সোভিয়েত দ্বন্দ্বটাকে দেখি পার্টির ভেতরে যুক্তফ্রন্টে থাকা কি থাকা-না—এই রকম যে তীব্র বিভাজনটা সৃষ্টি হলো, এটারই ধারাবাহিকতা হিসেবে। দুর্ভাগ্যবশত, মোহাম্মদ তোয়াহা-আবদুল হকরা বলতে থাকলেন,

আশু সমাজতন্ত্র হয়ে যাবে। বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। ষাটের দশকের শেষে এসেও স্লোগান তোলে, ‘তোমার বাড়ি আমার বাড়ি; নকশালবাড়ি,

নকশালবাড়ি।’

মতিউর রহমান: ’৫০-এ মারুফ হোসেন-স্বদেশ বোস হয়ে হক-তোয়াহার চীনপন্থী বিপ্লবী লাইন সৃষ্টি হলো। যার ফল মূলত চীনপন্থার উত্থান—সিপিবিতে বিভক্তি, ছাত্র ইউনিয়নে বিভক্তি, ন্যাপের মধ্যে বিভক্তি, কৃষক সমিতিতে বিভক্তি এবং সব মিলিয়ে একটা গুরুতর ক্ষতের সৃষ্টি। যাঁরা এই উগ্র এবং অতি বাম ছিলেন, তাঁরা ভাসানীর সঙ্গে মিলেমিশে গেলেন। এই ধারাটি পাকিস্তানি সমর্থকদের চিন্তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ল। তাঁরা ভাসানীর কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত থাকলেন সচেতনভাবে, নাকি অসচেতনভাবে? এটা নিয়ে আপনার কোনো ধারণা আছে?

অজয় রায়: ১৯৫৮ সালে যখন আইয়ুবের মার্শাল ল হলো, এর পরের বছর সারফুদ্দিন চৌধুরী (মোয়াজ্জেম চৌধুরীর পরিবারের সদস্য) একজন প্রধান ব্যক্তি হিসেবে আবির্ভূত হলেন। পার্টির সঙ্গে তাঁর ভালো সম্পর্ক ছিল। সারফুদ্দিন চৌধুরীদের সরাসরি যোগাযোগ ছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে। তিনি দিল্লিতে গেলেন। নেহরুর সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন। তা কেন? কারণটা হচ্ছে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান নিয়ে আলোচনা করা। সেখানে নেহরুর সঙ্গে দেখা হলো না। একসময় সিলেটে নেহরু জনসভা করেছেন। এই সারফুদ্দিন চৌধুরীর মা খোদেজা খাতুন চৌধুরী ছিলেন কংগ্রেসের নেত্রী। তাঁদের বাড়িতে ছিলেন নেহরু। সেই সূত্রেই একটা যোগাযোগ ছিল। নেহরু বার্তা পাঠালেন, তোমাদের যদি কিছু করতে হয়, কলকাতায় যাও। সেখানে গিয়ে বিধানচন্দ্র রায়ের সঙ্গে দেখা করো। পরে নেহরুর সঙ্গেও দেখা হলো তাঁদের। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের নেতা কে? তাঁরা তো আর কাউকে নেতা বানিয়ে নিয়ে যাননি। তাত্ক্ষণিকভাবে তিনি বলেন, আমাদের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি তখন বলেন, যদি মাওলানা ভাসানীকে যুক্ত করতে পারো, তাহলে আমরা সাহায্য করতে পারি। এটা একটা বিশেষ ঘটনা। এখানে এলেন তাঁরা। মাওলানা ভাসানীকে তখন ধানমন্ডিতে কোনো এক বাড়িতে আটকে রেখেছে আইয়ুব সরকার। ওটা একধরনের কারাগার ছিল। তার মধ্যেও গিয়ে সেখানে দেখা করলেন। মাওলানা ভাসানী বললেন, দেখো বাবা, আমি পারব না। আমার সঙ্গে আইয়ুবের বোঝাপড়া হয়ে গেছে। আমি চীনে যাব। তোমাদের যদি এ ব্যাপারে কিছু করতে হয়, তাহলে মুজিবের সঙ্গে দেখা করো। শেখ মুজিব তখন কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন। সারফুদ্দিন চৌধুরী তাঁর সঙ্গে দেখা করে কথা বলেন। শেখ মুজিব অনেক কথাই বলেন। তবে শুধু মনে আছে এটুকুই, ‘আমি দেশ ত্যাগ করতে পারব না। আমি দালাই লামা হতে পারব না।’

মতিউর রহমান: এটা কি ’৬২ সালে?

অজয় রায়: না, আরেকটু আগে। মণি সিংহ ও খোকা রায়ের সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে। সেটা হতে পারে ১৯৬০ বা ১৯৬১ সালে। তবে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের এটুকু পরিপক্বতা ছিল, এ খবর জানার পরও মাওলানাকে একেবারে অচ্ছুত করে দেয়নি তারা। যদিও পরে ন্যাপ ভাঙল। আর তেমন কিছু থাকল না।

মতিউর রহমান: ১৯৫০ থেকে শুরু করে চীন-রাশিয়ার ভিত্তিতে ভাঙন পর্যন্ত কিংবা তোয়াহা-হকদের একাত্ম হওয়া, আরও পরে যদি দেখি পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি—ওদের তো ধারাবাহিক আদর্শগত পতন শুধু নয়, পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িকতার নীতি ওদের মধ্যে থেকে গেল বিপ্লবের নামে...। এটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার। স্বাধীন হওয়ার পরও বাংলাদেশকে তাঁরা মানতে পারলেন না। তোয়াহা-মতিনের দলের নাম থাকল পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি আর সত্তরের দশকের শেষ পর্যন্ত আবদুল হকের দল হয়ে গেল পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি। আপনি এটাকে কীভাবে দেখেন?

অজয় রায়: সম্পূর্ণ ঠিক ধরেছেন। তা না হলে আবদুল হক কী করে ভুট্টোর কাছে অস্ত্র চেয়ে, অর্থ চেয়ে চিঠি লেখেন?

মতিউর রহমান: অতি বাম কমিউনিস্টদের ধারাটাকে আপনি কীভাবে দেখেন? তাঁরা লড়াই করেছেন, জেল খেটেছেন, আত্মগোপনে ছিলেন, খাপড়া ওয়ার্ডে গোলাগুলির মধ্যে পড়েছেন। উগ্র রাজনীতি থেকে এই যে রাজনৈতিক সুবিধাবাদী চরিত্রে পরিণত হওয়া বা এই যে পতন—এটাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন? সুযোগ-সুবিধা বা অর্থ কি এখানে খুব বড় ভূমিকা পালন করেছে?

অজয় রায়: অর্থের চেয়েও জাতীয় পরিচয় আর জাতীয়তাবাদের প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল।

মতিউর রহমান: কিন্তু তাঁদের যদি বাম ধারার চিন্তাচেতনা থেকে থাকে, তবে জাতীয় পরিচয়ের সংকট থাকবে কেন?

অজয় রায়: সেই সময়ের অবস্থায় বাম ধারা মানেই হচ্ছে, আমরা যারা কমিউনিস্ট তারা প্রো-ইন্ডিয়া। আর ওরা হচ্ছে ইন্ডিয়ার বিরুদ্ধে।

মতিউর রহমান: পরে দেখা গেল, যাঁরা চীনপন্থী ছিলেন, তাঁদের অনেকে বিএনপিতে যোগ দেন। আবার কেউ কেউ জাতীয় পার্টিতে চলে যান। আর আমরা যারা মস্কোপন্থী, তারা ভারত ও সোভিয়েতের সঙ্গে সব সময় বন্ধুত্বের ওপর জোর দিয়েছি।

অজয় রায়: আমরা হয় আওয়ামী লীগ হয়েছি, না হয় অন্য কিছু হয়েছি, বিএনপি হইনি।

মতিউর রহমান: তাহলে তো এখানে একটা আদর্শগত দিকও বিবেচনায় নিতে হবে। এই যে মণি সিংহ, খোকা রায়, নেপাল নাগ বা অনিল মুখার্জি—তাঁরা তো সোভিয়েতপন্থী হওয়ার পাশাপাশি ভারতপন্থী হয়ে থাকলেন, নাকি? এর কারণ কী? অতীত সম্পর্ক, নাকি অন্য কোনো কারণে এই ভারতপ্রীতিটা ছিল? আর সে কারণেই কি আদর্শগতভাবে ভারতের জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার ভাবনার সঙ্গে মিলে যায় আমাদের অবস্থান?

অজয় রায়: আমি আমার নিজেরটা দিয়ে বুঝি, যে ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আমরা উঠে এসেছি—সর্বভারতীয় একটা অবস্থান থেকে, রাজনীতি-সংস্কৃতি-অর্থনীতির দিক থেকে। এরা সবাই কিন্তু তা-ই। এর কিন্তু প্রভাব থাকেই। আরেকটা বিষয় নিয়ে আমাকে মোয়াজ্জেম চৌধুরী বলেছিলেন। পার্টিশন হওয়ার আগে, কলকাতা থেকে চলে আসার আগে—দেশভাগের ঘোষণা হয়ে গেছে। সব ঠিকঠাক। সবার জিনিসপত্র পাঠানো হচ্ছে, সেই সময়ে পার্ক সার্কাসে একটা মিটিং হয়েছিল। দ্যাট ওয়াজ অর্গানাইজড বাই শেখ মুজিবুর রহমান। সেখানে ‘ল্যাংড়া আনোয়ার’ ছিলেন, গ্রিন অ্যান্ড হোয়াইটের নূরুদ্দিন ছিল, আমাদের শহীদুল্লা কায়সার ছিলেন, আহমদুল কবীর ছিলেন, আমাদের পটুয়া কামরুল হাসান ছিলেন। এ রকম কথা এসেছিল, ‘পাকিস্তান হয়ে গেছে। আমরা এখানে এসেছি, সবাই তো পূর্ব পাকিস্তানেই যাব। যে যে দলই করি, একটা বিষয় সম্পর্কে সবাইকে ঠিকঠাক থাকা দরকার—হিন্দুদের সঙ্গে থাকা যাবে না।’

এই কথাটা আহমদুল কবীর সাহেবের সঙ্গে আমি যাচাই করেছি। এটা আসলে ঠিকই ছিল। পাকিস্তান তো একটা নয়। যদিও লাহোর প্রস্তাবে পাকিস্তান শব্দটাও ছিল না, তবুও দুটো স্টেটের কথা বলা হয়েছিল জনসংখ্যার ভিত্তিতে।

মতিউর রহমান: পঞ্চাশ-ষাটে সিপিবির নেতৃত্বকে আপনি কীভাবে দেখলেন—মণি সিংহ, খোকা রায়, অনিল মুখার্জি, জ্ঞান চক্রবর্তী প্রমুখ। তাঁদের আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন? তখন বা এখন—অতীত মিলিয়ে যদি বলেন...।

অজয় রায়: আমি মনে করি, তাঁরা যদি এখানে না থাকতেন, তাঁরা ওপারে থাকলে পরবর্তী সময়ে এমএলএ বা এমপিও হয়ে যেতে পারতেন। আরও ওপরে উঠে যেতে পারতেন। কিন্তু তাঁরা এখানে থাকলেন—এমনকি পঞ্চাশের দাঙ্গার পরও—আত্মগোপনে গেলেন, অনেক কষ্টের মধ্যে থাকলেন, তবু তাঁরা গেলেন না। এটা নিঃসন্দেহে এখানকার কাজের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি দরদ থেকেই। দেশের প্রতি ভালোবাসা থেকে সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন প্রগতিবাদী আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে।

মতিউর রহমান: এটা আদর্শগত দিক থেকে বললেন। কিন্তু রাজনৈতিক ভূমিকার কথা যদি জিজ্ঞেস করি?

অজয় রায়: রাজনৈতিক ভূমিকা তো তাঁরাই নিয়েছেন। ভুল নিলেও তাঁরাই, সঠিক নিলেও তাঁরাই নিয়েছেন। আবু হোসেন সরকারের সময় একটা জনসভাও করেছিলেন তাঁরা পল্টনে। পুলিশই অনুমতি দিয়েছিল। এরপর খোকাদা একটা প্রেস কনফারেন্সও করেছিলেন, আমরা কী চাই পাকিস্তানে? ইত্তেফাক-এর ফাইল ঘাঁটলে পেতে পারেন—এটা ১৯৫৫ সালের ঘটনা। আমরা পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র তৈরি করতে সচেষ্ট ছিলাম।

মতিউর রহমান: মাসটা মনে আছে?

অজয় রায়: মাসটা বছরের শেষের দিকে হবে। তখন খোকাদা, আমরা পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক বিকাশ চাই ইত্যাদি কথা বলেছিলেন। পুলিশ জিজ্ঞেস করেছিল, তোমরা কারা? উই আর সেলফ স্টাইল কমিউনিস্ট। কমিউনিস্ট পার্টির নাম তো তখন প্রকাশ্যে বলতে পারেননি।

মতিউর রহমান: তাহলে পার্টির প্রকাশ্য দল যেটা হয়েছিল, সেটা ১৯৫৬ সালের আগে? আলী আকসাদ বা খাপড়া ওয়ার্ডে গুলিতে পা-হারানো নূরুন্নবী, বগুড়ার আবদুল মতিন, মির্জা আবদুস সামাদ প্রমুখ ছিলেন এই টিমটাতে?

অজয় রায়: এটা হয়েছিল চুয়ান্ন সালে। এর বাইরে নূরুন্নবী (খাপড়া ওয়ার্ডের নূরুন্নবী নন, সাংবাদিক) ও কে জি মুস্তাফাও ছিলেন।

মতিউর রহমান: ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকাকে এখন কীভাবে মূল্যায়ন করেন?

অজয় রায়: আমি মূল্যায়ন করি এভাবে, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি যে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, আগে থেকে যদি আরও প্রস্তুতি থাকত, তবে কমিউনিস্ট ও সমগোত্রীয় আন্দোলনগুলো আরও বেশি ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হতো। কারণ, স্বাধীনতা আন্দোলনটা স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম কি না, অনেক সময় পর্যন্ত তা নিয়ে আমাদের মধ্যে দোদুল্যমানতা ছিল। সমগ্র পাকিস্তান একটা ফেডারেল কাঠামোর মধ্যে থাকবে, যদি ফেডারেল কাঠামো অসম্ভব হয়ে ওঠে, তাহলে সেটা স্বাধীনতাসংগ্রামে পর্যবসিত হবে—এ রকম একটা অবস্থান ছিল।

মতিউর রহমান: পঁচিশে মার্চের পরেও এমন চিন্তা ছিল কি?

অজয় রায়: না। এই চিন্তা অনেক আগে থেকে ছিল।

মতিউর রহমান: পঁচিশে মার্চের পর কী হলো?

অজয় রায়: আপনার কি মনে আছে, ময়মনসিংহ জেলা কমিটির একটা বৈঠক হয়েছিল? কোনো একজন অবাঙালি সহানুভূতিশীল ব্যবসায়ীর বাসায়—জায়গাটা ছিল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের কাছাকাছি। তখন অনিল মুখার্জি, খোকা

রায়, বারীণ দত্ত—এঁরা দেশে ছিলেন না। বড় ভাই (মণি সিংহ) জেল থেকে বেরিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ডে ছিলেন। আন্ডারগ্রাউন্ড অবস্থা থেকেই বড় ভাই সেই মিটিংয়ে এসেছিলেন।

মতিউর রহমান: ১৯৬৯ সালের মে দিবসে মণি সিংহ কমিউনিস্ট ছাত্র-সংগঠকদের এক বৈঠকে বলেছিলেন, সোভিয়েত বিপ্লবের আগে, ১৯০৫ সালের বিপ্লব যেমন অক্টোবর বিপ্লবের ‘ড্রেস রিহার্সেল’ ছিল, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান তেমনই ছিল।

অজয় রায়: তারও ছয়-সাত মাস পর সেই ময়মনসিংহ জেলা কমিটিরই আরেকটি সভা হয়। খোকা রায় সেখানে যান। তিনি সেখানে গিয়ে এটাকে কনটেস্ট করেন। সুতরাং দোদুল্যমানতা ছিল বলেই যদি এটাকে ‘ড্রেস রিহার্সেল’ হিসেবে ধরা হতো, তাহলে সে রকম কর্তব্য সামনে চলে আসে। আর যদি এটা মনে হয় যে, ট্রাইং টু হ্যাভ আ ফেডারেশন, তাও যদি হতো, তবুও শেষ পর্যন্ত আমরা মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতা সম্পর্কে আগাম কিছুটা আঁচ করতে পারতাম।

মতিউর রহমান: কিন্তু একাত্তরের মার্চ মাসে অনিল মুখার্জি মস্কোতে ছিলেন। পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের পর তিনি সেখান থেকে একটা বিবৃতি দিয়েছিলেন, যেটা নিউ এজ-এ ছাপা হয়েছিল। সেটাও স্বাধীনতার পক্ষে স্পষ্ট অবস্থান ছিল না।

অজয় রায়: পরবর্তীকালে এই ঘটনা নিয়ে কথা হয়েছে। আমি তো আগরতলা গিয়েছি পরে, আগস্ট মাসে। তার আগে দেশেই ছিলাম। সেখানে গিয়ে যা জানতে পেরেছিলাম, তার একটা হলো অনিল মুখার্জি বাংলাদেশে গণগত্যার ভয়ংকর ঘটনাগুলো সম্পর্কে জানতেন না। অন্যটা হলো স্বাধীনতার প্রতি তত্কালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকাটাও শুরুর দিকে স্পষ্ট ও ইতিবাচক ছিল না। তবে দ্রুতই তারা পাকিস্তানের গণহত্যার নিন্দা করে।

মতিউর রহমান: সব দোদুল্যমানতা সত্ত্বেও সে সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করে। এই নয় মাসে পার্টির ভূমিকাকে আপনি কীভাবে দেখেন? কতটুকু করতে পারল, কতটুকু সুযোগ ছিল তাদের জন্য। তখনো পার্টি ছোট। সদস্যসংখ্যাও বেশি না। সাধারণ ছাত্র ও তরুণদের মধ্যে কিছু প্রভাব ছিল। তারা দলে দলে আগরতলা, কলকাতা এবং পশ্চিমবঙ্গ ও মেঘালয়ের সীমান্ত দিয়ে গেল। তারা চেষ্টা করল নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে। এমনকি সিপিবি-ন্যাপ-ছাত্র ইউনিয়ন যৌথভাবে চেষ্টা করল একটা কমান্ড দাঁড় করানোর।

অজয় রায়: হ্যাঁ, তারপর পূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষে একটা প্রস্তাব নেওয়া হয় আগরতলায় বসেই। তারপরই সিপিবি চেষ্টা করেছে, মুক্তিযুদ্ধটা যাতে এক দলের যুদ্ধ না হয়। সেটা করতে গিয়ে নানাভাবে নিজেদের ভূমিকাটাকে বাড়ানোর চেষ্টা করেছে। এই অবস্থানটা তখনই ফলপ্রসূ হয়েছে, যখন সিপিআইয়ের সহযোগিতায় ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আমাদের নেতাদের সরাসরি বৈঠক হয়।

মতিউর রহমান: আমরা জানি, মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে সিপিবির নেতৃত্বে মণি সিংহ, আবদুস সালাম ও মোহাম্মদ ফরহাদ দিল্লিতে গিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেন।

অজয় রায়: ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা হয় দিল্লিতেই। সেখানে তাঁরা ইন্দিরার কাছে প্রস্তাব করেন, আলাদা প্রশিক্ষণ নেওয়ার ব্যাপারে। সেই সময়ে সিপিআইয়ের চাপও ছিল। এমনকি শুধু সিপিআইয়ের প্রভাব নয়, ইন্দিরা গান্ধীর একাধিক উপদেষ্টা ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধা। তাঁরা ইন্দিরা গান্ধীর ওপর একটা প্রভাব সৃষ্টি করে বলে আমি শুনেছি। শেষ পর্যন্ত তিনি সেটা মেনে নেন। একদিকে ছিলেন ভূপেশ গুপ্তসহ সিপিআইয়ের নেতারা। আরেক দিকে ছিলেন এঁরা। তবে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকাটা সব সময় সপক্ষে ছিল, তা নয়। সেই সময় কেরালাতে সিপিআইয়ের একটা কংগ্রেস হয়; সেই কংগ্রেসে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট নেতৃত্বও সেখানে আমন্ত্রিত ছিল—মণি সিংহ, খোকা রায় ও বারীণ দত্ত। সেখানে সোভিয়েত থেকে পার্টির উচ্চপদস্থ এক নেতা এসেছিলেন। আর তিনি এসেছিলেন মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে ভারতের ভূমিকা এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আরও জানতে। এরপর থেকে সোভিয়েত অবস্থানও বদল হতে শুরু করে।

মতিউর রহমান: আমরা দেখি, সিপিবি-ন্যাপ-ছাত্র ইউনিয়ন একটা যৌথ কমান্ড হলো এবং তারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিল। এর বাইরেও কমিউনিস্ট পার্টি বা ন্যাপ নানাভাবে তাদের নানা কর্মপ্রচেষ্টার মাধ্যমে সক্রিয় ছিল।

অজয় রায়: হ্যাঁ, সক্রিয় ছিল। সিপিবি-সিপিআইয়ের ঘনিষ্ঠতার মধ্য দিয়ে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টিকে প্রভাবিত করা এবং বিশ্ব শান্তি আন্দোলন ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংগঠনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন জোগানোর ক্ষেত্রে সিপিআইয়ের বড় ভূমিকা ছিল। এটা ইন্দো-সোভিয়েত চুক্তিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। এখানে একটা তথ্য বলি, বিশ্ব সংস্থাগুলোতে ওয়ার্ল্ড ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসে ডাঙ্গে ছিলেন ভারতীয় বড় নেতা। পঁচিশে মার্চের আগে আগে ডব্লিউএফটিওর একটা কনফারেন্স বা কনভেনশন হয়। সেখানে ডাঙ্গে একটা প্রস্তাব উত্থাপন করেন। একই সঙ্গে রমেশ চন্দ্র বিশ্ব শান্তি পরিষদের ভেতরে-বাইরে এবং ইউরোপে অত্যন্ত সক্রিয় ছিলেন। তাই বলা যায় সিপিআই ও তার পুরো নেতৃত্বের—ভূপেশ গুপ্ত, এন কে কৃষ্ণাণ, রমেশ চন্দ্রসহ অন্যদের একটা বিরাট ভূমিকা ছিল।

মতিউর রহমান: তাঁরা ওই সময় ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো সফর করেছিলেন। তাঁদের চিন্তা ছিল সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর সমর্থন আদায় ও একসঙ্গে নেওয়ার...

অজয় রায়: হ্যাঁ, আর সিপিআইয়ের সহযোগিতার জন্যই তো প্রথম বাংলাদেশের যে প্রতিনিধিদল বুদাপেস্টে অনুষ্ঠিত বিশ্বশান্তি পরিষদের সম্মেলনে গেলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতা আবদুস সামাদ আজাদ, ন্যাপের নেতা দেওয়ান মাহমুদ আলী ও কমিউনিস্ট পার্টির ডা. সারওয়ার আলী।

মতিউর রহমান: স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে সিপিবির সম্পর্ক ও ভূমিকাকে এখনকার বিবেচনায় আপনি কীভাবে দেখেন? বিশেষ করে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সিপিবির ঐক্য ও সংগ্রামের নীতি, সমর্থনের বা সহযোগিতার নীতিকে এখন কীভাবে মূল্যায়ন করেন?

অজয় রায়: একটা কথা স্পষ্টভাবে বলি, মুক্তিযুদ্ধ তো হলো। অনেক ত্যাগের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীনও হলো। কিন্তু স্বাধীনতার পরও বিষয়টা আসলে কী হয়েছে, কী এর প্রভাব, সে সম্পর্কে আমাদের স্পষ্ট কোনো বোধ বা সামগ্রিক কোনো ধারণা ছিল না। মনে পড়ে, স্বাধীনতার পরপরই আবুল মনসুর আহমদ দুটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। তিনি সেখানে বলেছিলেন, স্বাধীনতাটা হলো লাহোর প্রস্তাবের বাস্তবায়ন। দ্যাট ওয়াজ অলসো অ্যান্ড অ্যাসেন্স অব দ্য টোটাল স্ট্রাগল। এর প্রমাণ পাওয়া যায় ষাটের শুরুতে অনুষ্ঠিত এক গোপন বৈঠকে। ওই বৈঠকে মানিক মিয়ার সঙ্গে মণি সিংহ, খোকাদারাও ছিলেন। সেখানে স্বাধীনতার প্রশ্নে আমাদের নেতারা সম্মত হননি। তখন বঙ্গবন্ধু বললেন, মানলাম কথা। তবে আই ডোন্ট অ্যাগ্রি উইথ ইউ।

মতিউর রহমান: স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের ভূমিকা, সরকারের অবস্থান, তার সঙ্গে সিপিবির ভূমিকাকে কীভাবে দেখেন?

অজয় রায়: আমার ধারণা, সিপিবি ওই সময় তার কর্তব্যটাই ঠিক করতে পারেনি। আমি যদি মনে করি, এটা ন্যাশনালিস্ট গভর্নমেন্ট—দ্যাট ওয়াজ মাই আন্ডারস্ট্যান্ডিং, তাহলে এক বিষয়। আর যদি মনে করি, আবুল মনসুর আহমদের বক্তব্যের মতো, তাহলে তো আরেক বিষয়। সুতরাং এভাবে নিজেদের ভূমিকাকে স্পষ্ট করা যায়নি।

মতিউর রহমান: তাহলে কি আপনি বলতে চাইছেন, ওই সময় সিপিবির নিজস্ব চিন্তাধারা বা ভূমিকা বা ভূমিকা কী হওয়া উচিত—মুক্তিযুদ্ধের পুরো একটা মূল্যায়ন বা পর্যালোচনা, মুক্তিযুদ্ধোত্তর সময়ে করণীয় এগুলোর প্রতি সামগ্রিক একটা দৃষ্টিভঙ্গি নির্ধারণ করতে পারেনি? ফলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্ক, ঐক্য বা সহযোগিতার যে নীতি গ্রহণ করেছে, বিশেষ করে তত্ত্ব প্রয়োগের ক্ষেত্রে, তাতে পার্টি সংকটে পড়েছিল?

অজয় রায়: সবচেয়ে বড় কথা হলো সিপিবির গঠন-কাঠামো। এর কি কোনো প্রয়োজন ছিল, সিপিবির এভাবে ঢাকঢোল পিটিয়ে একটা শ্রমিক শ্রেণির দল হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার? এর চেয়ে ভিন্ন পরিচয়ে, ভিন্ন নামে একটা থার্ড ফোর্স বা সেকেন্ড ফোর্স হিসেবে থাকলে হতো। কিন্তু ওই ভূমিকার কোনো প্রয়োজন ছিল না। অন্তত মোজাফ্ফর আহমদের ন্যাপের মতো থাকলেও ভালো হতো (যদিও তাঁর নেতৃত্ব নিয়ে নানা প্রশ্ন ছিল)।

মতিউর রহমান: সেই পুরোনো প্রশ্নটি তুললেন, যেটা পঞ্চাশের দশকে আপনার মধ্যে ছিল, প্রকাশ্যে কমিউনিস্ট পার্টি হিসেবে কাজ করবে, নাকি অন্য কোনো প্রগতিশীল দলের ভেতরে থেকে কাজ করবে?

অজয় রায়: ঠিক সেটাই। আমি সেটাই বলতে চেয়েছি। কিন্তু আপনি তো একবার কমিউনিস্ট পার্টির দরজা খুলে দিয়েছেন, আবার তো সেটা বন্ধ করা যায় না।

মতিউর রহমান: কিন্তু ’৭৩-এ আপনি তো সম্পাদকমণ্ডলীতে গেলেন, তখন কি বিতর্কটা ছিল?

অজয় রায়: না, তখন বিতর্কটা হয়নি।

মতিউর রহমান: তখন তো দল হিসেবে কমিউনিস্ট পার্টিকে বড় করা, সক্রিয় করা, উদ্যোগী করা এবং সিপিবি-ন্যাপ আওয়ামী লীগ যৌথভাবে দেশকে অগ্রসর করে নেওয়া প্রভৃতি ভাবনা ছিল।

অজয় রায়: একটা বিষয় আমাদের চিন্তার মধ্যেই ছিল না। শুধু আমরা কেন, সোভিয়েত পার্টির সঙ্গে আমাদের যতটুকু আলোচনা হয়েছে, তাদের চিন্তার মধ্যেও ছিল না। সেটা হলো এই যে স্বাধীনতাটা হলো এবং মুজিবের শাসন পর্যন্ত অগ্রসর হলো। এটা যে আবার পিছিয়ে যেতে পারে, এ রকম কোনো ধারণা আমাদের মধ্যেও ছিল না, আবার সোভিয়েত পার্টির মধ্যেও ছিল না।

মতিউর রহমান: তাহলে আপনি বলতে চাইছেন, বাহাত্তর-পঁচাত্তর সময়পর্বে সিপিবির ভূমিকাটা স্পষ্ট ছিল না বা বাস্তবের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ছিল না বা আমরা সম্যক ধারণা নিতে পারিনি যে, আমাদের করণীয়টা কী?

অজয় রায়: আমরা সে সময়ের নানা দেশের অভিজ্ঞতা ও সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির তত্কালীন নীতির ওপর নির্ভর করেছি। কিন্তু নিজের দেশের সামগ্রিক অবস্থাকে পর্যালোচনা করে বাস্তব ও যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। স্বাধীনতাকে মূল্যায়ন করা কিংবা দেশে এত বড় ঘটনাটা ঘটল, সেটার কতটুকু কী প্রভাব, তার পর্যালোচনা করা দরকার ছিল।

মতিউর রহমান: তাহলে পুরো সময়ের কার্যক্রমকে কি আপনি নাকচ করে দিচ্ছেন?

অজয় রায়: নাকচ করে দিচ্ছি না। তবে নানা সময়ে অনেক বিষয়ের মধ্যে কোনো-না-কোনো ইতিবাচক দিক তো আছেই। কিন্তু ‘যে ভূমিকা পালন করিতে পারিতাম...,’ সেটা আমরা করতে পারিনি।

মতিউর রহমান: নাকি যে ভূমিকাটা পালনের চেষ্টা করা হয়েছে, সেটা বেশি ছিল অথবা সম্ভব ছিল না?

অজয় রায়: আমার মতে, এ জন্য আমি এখানকার যাঁরা, শুধু তাঁদেরই দায়ী করি না; বরং যাঁরা পীঠস্থান—সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টি, তাদের চিন্তা, প্রভাব, পরামর্শ ইত্যাদি আমাদের এমন ধারায় কাজের ক্ষেত্রে উত্সাহিত করেছে, ভূমিকা রেখেছে।

মতিউর রহমান: তার মানে সত্যিকার অর্থে নিজের দেশের অবস্থা, মানুষের চিন্তাজগতের অবস্থা, এখানকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি—এগুলো বিবেচনা করে সঠিক ও স্বাধীন রাজনৈতিক পথে সিপিবি অগ্রসর হতে পারেনি।

অজয় রায়: আমি এ কথাটিই বলতে চাচ্ছি। আমাদের করণীয় যা ছিল, আমরা তা করতে পারিনি।

মতিউর রহমান: যদি তা-ই হয়, তাহলে একটা কথা বিবেচনায় নিতে হবে যে, স্বাধীনতার পরপর ডাকসু, চাকসু, রাকসু নির্বাচনে সবখানে ছাত্র ইউনিয়ন জিতে গেল। তখন তরুণদের মধ্যে একটা উন্নত চিন্তা, সমাজ পরিবর্তন—এই চেতনা তাদের মধ্যে জোরালোভাবে ছিল, যেটা ধরে আমরা অগ্রসর হতে পারলাম না। যেটাকে জাসদ আবার একটা ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের’ নামে চরম হঠকারী বিভ্রান্তিমূলক উত্তেজনার রাজনীতির দিকে নিয়ে গেল। এটা কি তাহলে একটা কারণ যে, মানুষের চিন্তাচেতনা অনুযায়ী সঠিক পদক্ষেপ নিয়ে এগোতে পারিনি আমরা?

অজয় রায়: মানুষ বলতে তো শুধু তরুণ-ছাত্রসমাজ নয়। মানুষ বলতে তো সব বয়সী মানুষকেই বোঝায়—কৃষক-শ্রমিক-মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত সবই। বাইবেলে একটা কথা আছে, সম্ভবত ‘অরিজিন অব সিন’। সেভাবে দেখলে কমিউনিস্ট মুভমেন্টের অবদান তো বিশ্বে কম নয়। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা থেকে শুরু করে দেখলে বিশ্বে বিভিন্ন দেশে-অঞ্চলে যথেষ্ট অবদান আছে। কিন্তু তারপরও বলব, সেই ‘অরিজিনাল সিন’টির দায়দায়িত্বটা কে নেবে?

মতিউর রহমান: আপনি কি আমাদের সব ব্যর্থতার জন্য সোভিয়েত-বন্ধুদের দায়ী করছেন?

অজয় রায়: প্রকারান্তরে কিন্তু তা-ই। আজকে বিশ্বে মৌলবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, সবচেয়ে বড় বিপদ তো এটাই। এসবের পেছনে তাদের ব্যর্থতাও কাজ করেছে। সেটা কী করে হলো?

মতিউর রহমান: তাহলে যে সেই সময় ভাবতাম, অধনবাদী পথে সমাজতান্ত্রিক অভিমুখীনতার পথে বাংলাদেশকে নিয়ে যাওয়া—সেই তাত্ত্বিক ভাবনাগুলোও সঠিক ছিল না?

অজয় রায়: তখনকার বাস্তবতায় নিশ্চয়ই না।

মতিউর রহমান: বাকশাল গঠিত হওয়ার পর আমরা তাতে সমর্থন দিলাম, তাতে যোগও দিলাম। তাতে কি কোনো ভিন্নমত ছিল?

অজয় রায়: যোগ দেওয়াতে ভিন্নমত ছিল না। তবে এটা সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল না। এর একটা কারণ হলো ‘ফেইট আকমপ্লি’ অর্থাত্ বাধ্য হলাম। আরেকটা হলো, না হলে ভালো হতো, কিন্তু হলো।

মতিউর রহমান: না হলে ভালো, কিন্তু হলো—হলে আমরা থাকব, সোভিয়েত পরামর্শটা এ রকমই ছিল?

অজয় রায়: এ রকমই ছিল। আমি সম্পাদকমণ্ডলীতে ছিলাম। অনেক আলোচনা হয়েছে। তবে পার্টির মধ্যে একমাত্র বড়ভাই এবং খোকাদা, বিশেষ করে বড়ভাই এর বিরুদ্ধে ছিলেন।

মতিউর রহমান: কিন্তু বঙ্গবন্ধু একক দল করে ফেললে আর তো উপায় নেই, ব্যাপারটি কি এ রকম?

অজয় রায়: হ্যাঁ, তিনি করে ফেললে তখন আর কী করব, আর উপায় নেই। আমরা যারা কমিউনিস্ট পার্টির, তারা যোগ দেব।

মতিউর রহমান: কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে কি আমরা বলতে পেরেছিলাম, আমরা চাই ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্ট, এক দল না হলে ভালো হয়?

অজয় রায়: বলেছি আমরা; খুব বেশি বলেছি, তা নয়। তবে এই কথাটা সম্পর্কে আরও বিস্তারিত বলতে পারবে পঙ্কজ ভট্টাচার্য। কারণ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে হওয়া ওই মিটিংগুলোতে ন্যাপের মোজাফ্ফর আহমদ আর পঙ্কজ ভট্টাচার্য থাকতেন। যখন ত্রিদলীয় জোট হলো, তখন এদিক থেকে মণি সিংহ-ফরহাদ থাকতেন আর ওদিক থেকে মোজাফ্ফর আহমদ-পঙ্কজ ভট্টাচার্য থাকতেন।

মতিউর রহমান: তাহলে বাকশালে যোগদান করা, পার্টিকে বিলুপ্ত করা (যদিও আমাদের সিদ্ধান্ত ছিল, ছোট করে হলেও একটা সাংগঠনিক কাঠামো টিকিয়ে রাখা, যেটা বস্তুত কিছু ছিল না), এটাকে কি আপনি সঠিক সিদ্ধান্ত বলে মনে করেন, নাকি আমাদের ভুল হয়েছিল?

অজয় রায়: আমি মনে করি, বাকশালে যোগ দেওয়া আমাদের উচিত হয়নি। কারণ, তার কোনো সম্ভাবনা ছিল না, বাস্তবতা ছিল না। এটা যে জনতার মতের বিরুদ্ধে, তা আমাদের বোঝা উচিত ছিল। এটা সিপিবি নেতৃত্বও বোঝেনি তখন।

দুটি ঘটনার কথা বলি। এক. লাস্ট মিটিং অব শেখ মুজিব; সেটি সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে হয়েছিল। একসঙ্গে কোরআন, বাইবেল, গীতা, ত্রিপিটক পড়া হয়েছিল। আমি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, সেখান থেকে লোকজন হাত নেড়ে নিষেধ করেছে। তারা চাইছে না এগুলো একসঙ্গে এখানে পড়া হোক। দুই. শেখ মুজিব তখন থাকতেন নিজের বাড়িতে—গণভবনে নয়। আমি এক দিন হেঁটে হেঁটে সংসদ ভবনের পাশ দিয়ে কেন যেন যাচ্ছিলাম। এমন সময় দেখি শেখ মুজিব গাড়িতে করে আসছেন। আমরা সরে দাঁড়ালাম। তিনি হাত নেড়ে নেড়ে যাচ্ছেন। আমি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, সেখানে আরও পাঁচ-সাতজন ছিলেন। তাদের মধ্যে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না।

মতিউর রহমান: আমরা উত্সাহের সঙ্গে অনেক কিছু করলাম, অনেক উদ্যোগ নিলাম। ওই সময়ে বেগম সুফিয়া কামাল, কবীর চৌধুরী, শামসুর রাহমান—তাঁরা কেউ কিন্তু বাকশালকে গ্রহণ করেননি, বাকশালের সদস্য হননি।

অজয় রায়: অথচ রণেশদা ইতস্তত করতে করতে পার্টির সিদ্ধান্তের জন্য সদস্য হয়েছেন।

মতিউর রহমান: তাহলে আপনার মূল্যায়ন এখন, বাকশালের ব্যাপারে আমাদের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল না?

অজয় রায়: না, এটা কোনো সঠিক কাজ ছিল না।

মতিউর রহমান: ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে আমাদের একটা অভিজ্ঞতা হয়েছিল। আমি ওই সময় রোমানিয়া হয়ে বুলগেরিয়ায় গিয়েছিলাম। বুলগেরিয়ান পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির দুজন নেতার সঙ্গে লম্বা আলোচনা হয়েছিল। যখন অনিলদা তাঁদের বললেন, আমরা বাকশালে যোগ দিচ্ছি, তখন তাঁরা একটু বিস্মিত হয়েছিলেন। বললেন, তোমরা কি সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিএসইউ) সঙ্গে কথা বলেছ? অনিলদা উত্তর দিলেন, হ্যাঁ। তাদের মত কী? তারা হ্যাঁ বলেছে। তখন তারা একদলীয় শাসনব্যবস্থার অভিজ্ঞতা ব্যাখ্যা করতে আলজেরিয়া, ইরাক, সিরিয়ার অভিজ্ঞতার কথা বললেন। তাঁরা বললেন, এসব দেশে অধনবাদী পথ বা একদলীয় ব্যবস্থার অভিজ্ঞতা তো ভালো নয়। তাতে বোঝা গেল, তাঁদের চিন্তা বা ধ্যানধারণা সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির চেয়েও অনেক এগিয়ে ছিল।

অজয় রায়: ঠিক বলেছেন। তবে সমস্যা তো শুধু আমাদের মাথায় নয়। সমস্যা মস্কোর নেতৃত্বের মধ্যে ছিল।

মতিউর রহমান: আচ্ছা, আসলে সিপিআইয়ের সুস্পষ্ট মত কী ছিল?

অজয় রায়: সিপিআইয়ের মত ছিল বাকশালের মধ্যে না যাওয়া।

মতিউর রহমান: কিন্তু অনিলদা বুলগেরীয় নেতৃত্বকে বলেন, সিপিআইয়ের মত আছে। তবে সোভিয়েত পার্টির অবস্থান ছিল শর্তযুক্ত, যদি না পারো, তাহলে যোগ দিয়ো।

অজয় রায়: আর সিপিআইয়ের অবস্থান ছিল, যোগদান করে ফেললাম তো করে ফেললাম। আমার ভুল হতে পারে, কিন্তু আমি যত দূর জানি, যোগদানের

আগে তাদের অবস্থান ছিল বাকশালে না যাওয়া। এগুলোর কোনো দলিল বা কাগজ নেই।

মতিউর রহমান: এখন যদি আমরা বলি, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশে সর্বত্র ভয়ভীতিকর অবস্থা বিরাজমান ছিল। সেনাবাহিনীর মধ্যে অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থান চলে। কিন্তু সেখানে দেখা গেল, সিপিবি-ন্যাপ-ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে আমরা বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার দাবি ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করার ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া, জনমত গঠন করা, লিফলেট বিলি করা, দেশে-বিদেশে প্রচার করা, বিদেশের তথ্য দেশে এনে প্রচার করা, জমায়েত ও মিছিল করলাম। এটাকে আপনি কীভাবে দেখেন?

অজয় রায়: এটাকে আমি সার্বিকভাবে ইতিবাচকভাবে দেখি। এখান থেকে এসে আবার মৌলিক জায়গায় ফিরে যাওয়া...। প্রথম কথা বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলা হলো—এমন ষড়যন্ত্র তৃতীয় বিশ্বের দেশে দেশে হওয়া অস্বাভাবিক ছিল না। এই ধরনের ঘটনা ঘটছিল নানা দেশে। কিন্তু তাঁকে হত্যা করার পরে মানুষের মধ্যে যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হওয়ার কথা, তা তো হলো না। বরং অনেক ক্ষেত্রে অভ্যুত্থানের পক্ষে সমর্থনের ইঙ্গিতই দেখা গেল। এই ধরনের ঘটনাও ঘটতে পারে, এর কোনো মূল্যায়ন আমরা করতে পারিনি। সেটা যদি করতে পারতাম, তাহলে কোথা থেকে আবার শুরু করতে হবে, সেটাও বুঝতে পারতাম।

মতিউর রহমান: আচ্ছা, বাকশাল হলো, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হলো, আমরা প্রতিবাদ জানালাম, বিচার চাইলাম, আবার গণতান্ত্রিক সংগ্রাম করলাম, মানুষকে জাগ্রত করারও চেষ্টা করলাম। কিন্তু জিয়া ক্ষমতায় এলে তাঁর প্রসঙ্গে একটা বিতর্ক আমাদের মধ্যে দেখা দিল। যদিও সংখ্যাগরিষ্ঠ পাস করল, জিয়াউর রহমানের খালকাটা কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া এবং তাঁকে ‘হ্যাঁ’ ভোট দেওয়া। এ সম্পর্কে আপনার এখনকার মতামত কী?

অজয় রায়: এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সম্পাদকমণ্ডলীর মিটিংয়ে সবচেয়ে বেশি বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন আপনি। আর আপনার সঙ্গে মণি সিংহ ছিলেন।

মতিউর রহমান: তখনো কি সোভিয়েত পার্টি বা জিডিআর পার্টির অভিমত এমন ছিল—পার্টিকে রক্ষা করতে হবে, টিকে থাকতে হবে। সুতরাং সরকারকে সহযোগিতা করো?

অজয় রায়: এটা কিছুটা ছিল। এর চেয়ে বড় বিপদ ছিল বিমানবাহিনীর প্রধান তোয়াবের অবস্থান। পরে বিদেশে চলে গেলেন। এদিকটাও বিবেচনা করা হলো।

মতিউর রহমান: তার মানে জিয়ার প্রতি সিপিবি বা সোভিয়েত পার্টি কিছুটা ইতিবাচক ছিল—চরম দক্ষিণপন্থীদের বিরুদ্ধে অবস্থানের কারণে। কিন্তু আমরা যখন হ্যাঁ ভোট দিলাম, তত দিনে তো তোয়াব বিতাড়িত।

অজয় রায়: কিন্তু জিয়া যা করল, সমাজ ও রাষ্ট্রকেও পেছনের দিকে নিয়ে গেল, সেটাও মূল্যায়ন না করে আমরা জিয়ার হ্যাঁ ভোটে সমর্থন দিলাম। ‘খাল’ কাটতে গেলাম।

মতিউর রহমান: এমনকি আমরা সংসদে ন্যাপ ও অন্যদের প্রভাবিত করলাম

যে, তোমরা ‘হ্যাঁ’র পক্ষে ভোটটা দাও। তাতে কৌশলটা কি এ রকম ছিল যে, পার্টিটা সংকটে আছে, পার্টিকে রক্ষা করতে হবে, কর্মীদের জেলজুলুম থেকে নিজেদের রক্ষা করতে হবে? কারণ ফরহাদকে গ্রেপ্তার করল, মণি সিংহকে গ্রেপ্তার করল ইত্যাদি।

অজয় রায়: যতটুকু রক্ষা করা যায়, সেই কৌশলই ছিল। কারণটা ছিল এ রকম: বিপদের সময় ‘সবকিছুই ত্যাগ করো, বিপদ থেকে রক্ষা করো’।

মতিউর রহমান: আপনার মতে, জিয়াকে পুরোপুরি আমরা বুঝতে পারিনি। তাঁকে সহযোগিতা করা, হ্যাঁ ভোট দেওয়া—এগুলো বামপন্থী হিসেবে ঠিক ছিল না। আবার ধরুন, জিয়া হত্যা হয়ে গেল, এরশাদ ক্ষমতায় এল—এই সময়টায় সিপিবির ভূমিকাটা কেমন দেখেন?

অজয় রায়: বরং এই সময়টায় একটু ভালো ছিল। চেষ্টা করেছে সবাইকে নিয়ে সবার সঙ্গে মিলে কাজ করার। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করা। সেখানে সিপিবি-আওয়ামী লীগ-ন্যাপসহ অন্যান্য বাম দলকে নিয়ে এক থাকাটাও ইতিবাচক ছিল। এ ছাড়া কৃষক আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন ও ছাত্রদের জাগ্রত করার মতো কিছু এ সময় হয়েছে।

মতিউর রহমান: একটা প্রশ্ন, ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে আমরা পাঁচ-ছয়টা আসনে জিতলাম—আমরা জিতলাম, ন্যাপেরও কয়েকজন জয়ী হলো। এটা নিয়ে কোনো সরকারের সঙ্গে সমঝোতা ছিল কি? ইউসুফের মতো প্রার্থী, শহিদুল্লাহর মতো প্রার্থী বিজয়ী হলেন।

অজয় রায়: আমি এটা জানি না। তবে আমার একটা সন্দেহ আছে যে, এটা নিয়ে হয়তো প্রশাসনের সঙ্গে কোনো সমঝোতা ছিল।

মতিউর রহমান: এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সিপিবির একটা ইতিবাচক ভূমিকা ছিল। কিন্তু ১৯৮৭ সালের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের পরিবর্তন, পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর পরিবর্তন হলো, তার প্রভাব সিপিবিতে এসে পড়ল এবং পার্টি ভাঙতে শুরু করল, আমাদের ভেতর বিভ্রান্তি বাড়তে থাকল। ফলে আমাদের পার্টি দ্বিখণ্ডিত হলো প্রথমে, পরে আরও খণ্ডিত হতে থাকলে। একপর্যায়ে পার্টির অনেকে আওয়ামী লীগ, গণফোরামে যোগ দিতে থাকল। এ সময়কাল সম্পর্কে আপনি কী বলবেন?

অজয় রায়: এ সময়ের কথা আমি নিজেকে দিয়েই শুরু করি। আমি খুব স্পষ্ট ছিলাম না। থাকলে হয়তো আরেকটু জোরেশোরে ভূমিকা রাখতে পারতাম। সিপিবির যে অংশ অতি বাম পন্থার চিন্তার দিকে চলে গেল, তারা এখনো সেই নীতি দ্বারা অনেকখানি প্রভাবিত। আজকের প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করলে আপনাকে খেয়াল করতে হবে, বিশ্বটা যদি নাইনটি নাইন পার্সেন্ট ভার্সেস ওয়ান পার্সেন্ট হয়, তবে তো নাইনটি নাইন পার্সেন্টকে অ্যাকোমডেট করতে হবে, নাকি?

মতিউর রহমান: কিন্তু তখনো সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙেনি, নাইনটি ওয়ানে ভাঙল। এর আগে বার্লিন দেয়ালের পতন হয়ে গেল। আমরা সরে এসেছি। তখন সিপিবির এই অস্থিরতা, এই বিভ্রান্তি, এই বিভক্তি, এটা নিয়ে কিছু বলুন।

অজয় রায়: সিপিবির একেকজন একেক রকম করে বুঝেছেন। আসলে কেউই ঠিকমতো ব্যাপারটি বোঝেননি। সবাই পুরো বিভ্রান্তির মধ্যে ছিলেন। গভীরভাবে না বুঝে আমরা তর্ক-বিতর্ক করেছি।

মতিউর রহমান: আপনি বলতে চাইছেন, এই সংকটের গভীরতাটা, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের গভীরতা, সোভিয়েত সমাজব্যবস্থায় মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়াটা—এ থেকে সৃষ্ট ক্ষোভ-বিক্ষোভ যে হলো; এক দিকে কমিউনিস্ট, আরেক দিকে ন্যাশনালিস্ট, আবার সমাজে ধর্মের ব্যাপক প্রভাব—এসব থেকে আমরা আমাদের নিজেদের করণীয়টা বুঝতে পারিনি। সেই কারণে স্বাভাবিকভাবেই আমরা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেলাম।

অজয় রায়: হ্যাঁ। সারা দুনিয়াতেই প্রায় তা-ই হয়ে গেল।

মতিউর রহমান: কিন্তু কিছু দেশে পরিবর্তিত এই পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে নেওয়ার একটা চেষ্টা এবং কমিউনিস্ট আন্দোলনকে নতুন করে দাঁড় করানোর চেষ্টা কিছুটা লক্ষ করা যায়। এই সম্ভাবনা কি আমাদের এখানে ছিল? নাকি অতীতে ভুলভ্রান্তির কারণে আর কিছু করার ছিল না?

অজয় রায়: পরিবর্তন যে হলো, তা তো বাস্তব। আমি চাই বা না চাই পরিবর্তন হয়েছে। এটা আমার চাওয়া-না-চাওয়ার প্রশ্ন না। এই সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এই রাজনৈতিক প্রভাব সামাজিক বা অর্থনৈতিকভাবে হয়েছে। আসলে এই সংকটের ব্যাপকতা আমরা বুঝতে পারিনি। এসব নিয়ে আমাদের এখানে কোনো আলোচনাই হয়নি। আর আলোচনা না করে তো এগুলো করা

যায় না।

মতিউর রহমান: এটা আলোচনা করার দক্ষতা-যোগ্যতা-সামর্থ্য আমাদের কতটুকু ছিল?

অজয় রায়: এখনো সেটা নাই। কিন্তু আমি যে বুঝি না, সেটা যদি বুঝি, তাহলে অন্যজন যে বোঝেন, তাঁর কাছে তো আমি যেতে পারি। পশ্চিমবঙ্গে একটা বিষয় ভালো হচ্ছে, কংগ্রেসের সঙ্গে বামদের একটা সমঝোতা হচ্ছে। কিন্তু বাচ্চাদের যেমন হাম হয়, ওদের এখনো সেই অবস্থা। অথচ ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি তো বাচ্চা নেই। তারা এখনো কংগ্রেসকে কোনো দিন বুঝতেই পারল না। এই কংগ্রেস নামক দলটির মধ্যে তো অনেক কিছুই আছে।

মতিউর রহমান: আমরাই কি আওয়ামী লীগকে বুঝতে পারলাম?

অজয় রায়: পারিনি।

মতিউর রহমান: এখন আপনি আওয়ামী লীগের মধ্যে কী দেখেন? স্বৈরতন্ত্রের পতনের পর তো বাংলাদেশের ২৬ বছরের অভিজ্ঞতা হয়ে গেল। স্বৈরতন্ত্রের পতনের পর আমরা খুব উত্সাহী ছিলাম, গণতন্ত্র ফিরে এল—ভাবনাটা ছিল,

এই দুই দলের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রটা যদি ঠিকমতো চলে মন্দ কী? কিন্তু আজকে কী দেখি?

অজয় রায়: আমরা দেখি, অ্যাগেইন গো ব্যাক টু আবুল মনসুর আহমদ। অর্থাত্ সমাজ দুই ভাগে বিভক্ত।

মতিউর রহমান: তার মানে আপনি দেখেন, ধর্মের প্রভাব বেড়েছে? যা থেকে জঙ্গিবাদসহ আরও কিছু সামাজিক সমস্যার উদ্ভব ঘটেছে। একই সঙ্গে এ রকম কিছু কি দেখেন, স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবও বেড়েছে? অগণতান্ত্রিক ধ্যানধারণা-চিন্তাধারা বেড়েছে। তাহলে গত আড়াই দশকে কি এটাই পাওয়া?

অজয় রায়: না, কিছুই পাওয়া হলো না। এই না পাওয়া, এর পেছনে আমরাও দায়ী। কারণ আমরা যদি একটা গণতান্ত্রিক ধারায় অপজিশন বা যেখানে থাকি, রাজনীতিটা গণতান্ত্রিক রাখতে পারতাম, তাহলে আওয়ামী লীগের ওপর কিঞ্চিত্ হলেও একটা প্রভাব পড়তে পারত। আওয়ামী লীগের মধ্যে তো এখন নানান চিন্তার লোক আছে। এর মধ্যে বর্তমান সময়ে শঙ্কা বা সংকটটা বোঝে, এমন লোকও আছে। সুতরাং আমরা আজ যদি আওয়ামী লীগকে দোষ দিই—হ্যাঁ, যেহেতু তারা ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি করে, তারা এখন ক্ষমতায়, তাই দায়িত্ব তাদের সবচেয়ে বেশি। কিন্তু আমাদেরও একটা ভূমিকা আছে বলে দাবি করি; সেটি যদি বুঝে থাকি, তাহলে সেই অনুসারে সুযোগ বা সম্ভাবনা কতটুকু ছিল, সেটা বাস্তবায়নের জন্য আমরা কি কোনো চেষ্টা করেছি?

মতিউর রহমান: আপনি তো আবার পঞ্চাশের দশকে ফিরে গেলেন। বাংলাদেশে পশ্চাত্পদ কৃষিনির্ভর অর্থনীতি, সামন্তবাদ তখনো বিরাজমান, পুঁজিবাদ তখনো দাঁড়ায়নি—এমন অবস্থায় সিপিবির নামে দল না করে আমাদের কি উচিত ছিল ন্যাপের মতো গণতান্ত্রিক দল করা?

অজয় রায়: ও রকমই কিছু একটা করার দরকার ছিল।

মতিউর রহমান: সেটাই আবার সামনে নিয়ে আসা হলো ১৯৭৭-এ। মোহাম্মদ ফরহাদ ওই প্রস্তাব করেন নূরুল ইসলাম নাহিদের নামে। আর মঞ্জু বোধ হয় পাল্টা একটা প্রস্তাব করলেন মণি সিংহ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে। কিন্তু মস্কো বলল, না, ঠিক আছে সিপিবি নামেই থাকতে হবে। আপনার অবস্থান কী ছিল? বাংলাদেশের সামনে অগ্রসর হওয়ার পথ ছিল কি?

অজয় রায়: আমি এটা বুঝি, গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িকতা—মানুষে মানুষে সম্প্রীতি, উপকার করার মানসিকতা ইত্যাদি বিষয় তো থাকবেই। বিশ্বব্যাপী যদি বলেন, মানুষের উপকার স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো সোভিয়েত ইউনিয়নের চেয়ে ভালো করেছে। সেটার ভিত্তিতে সেটা সম্ভব হতে পারে কিন্তু তাতে নেতৃত্ব কে দেবে?

মতিউর রহমান: আপনি যে আশার পটভূমি তৈরি করলেন, এখানকার সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অবস্থা—সামাজিক শক্তিগুলোর অবস্থা, নেতাদের অবস্থা দেখে সেই আশাবাদের কোনো ভিত্তি দেখা যাচ্ছে না।

অজয় রায়: আমিও এর কোনো ভিত্তি দেখি না।

মতিউর রহমান: তারা পারেনি বা পারল না, সেটা ঠিক। এ জন্য একটা অপূর্ণতা আছে। কিন্তু বামপন্থীরাও দেশে দেশে নিজেদের সমাজটাকে দেশটাকে বোঝেননি, জানেননি, চেনেননি। সেই কারণে নিজেদের জন্য নতুন পথের সন্ধান করতে পারেননি।

অজয় রায়: ঠিক সেটাই।

মতিউর রহমান: অথচ আমাদের মতো সব দেশের পার্টিই সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সব নীতি মেনে চলতে চেয়েছে। কিন্তু তা করে একে একে ভেঙে পড়েছে।

অজয় রায়: হয়তো সোভিয়েতরাই এটা চায়নি। ক্রুডলি বললে এটাই আসে।

মতিউর রহমান: এখন তো দিনে দিনে শুধু অধোগতিই দেখি। অর্থনৈতিক, চিকিত্সা, আয়ুর অগ্রগতি ও উন্নয়ন এগুলো ঠিক আছে। বইয়ের অবস্থা দেখেছেন? পঞ্চাশ-ষাটের দশকে যা হয়েছিল, সেগুলোই আমাদের সামনে দৃষ্টান্ত।

অজয় রায়: যতটুকু মৌলিক চিন্তা ছিল, সব সেই সময়ের। এখন তো কিছুই নেই।

মতিউর রহমান: আপনাকে ধন্যবাদ।

অজয় রায়: আপনাকেও ধন্যবাদ।

সাক্ষাত্কার গ্রহণ: ৮ জানুয়ারি ২০১৫ ও ৬ মার্চ ২০১৬