বাংলাদেশে গণতন্ত্র: এলিট বনাম জনগণ

সারসংক্ষেপ

গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ব্যক্তিমানুষ ও নেতৃত্বের ভূমিকা আর্থসামাজিক পূর্বশর্তের চেয়ে কম নয়। একই সঙ্গে জনগণ এবং ব্যক্তিকে সংগঠিত করে যে রাজনৈতিক দল, তার ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। গণতন্ত্রকে অনেক সময় এলিট শ্রেণি এবং জনগণের মধ্যে একধরনের ঠান্ডা লড়াই বা যাকে বলে টাগ অব ওয়ার বোঝায়। এলিট শ্রেণি স্বেচ্ছায় গণতন্ত্রের পক্ষশক্তি হয় না। গণতান্ত্রিক অধিকার আদায় করে নিতে হয় এবং সেখানে জনগণের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। জনগণের ভূমিকা এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় তার অংশগ্রহণকে কেন্দ্র করে তাত্ত্বিক বিতর্ক আছে। একদিকে জোসেফ সুম্পিটার বা রবার্ট ডালের মতো তাত্ত্বিকেরা জনগণের ভূমিকাকে সীমিত রাখার পক্ষে মত দেন। অন্যদিকে ধ্রুপদি তত্ত্ব থেকে শিক্ষা নিয়ে অনেকে জনগণের ভূমিকাকে গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ হিসেবে ভাবেন। বাংলাদেশে ব্যক্তি বা দলীয় নেতৃত্বের ভূমিকায় মিশ্র সাফল্য লক্ষণীয়। রাজনৈতিক দলের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হলেও সেখানে বড় মাপের সংস্কারের প্রয়োজন আছে। কিন্তু তার প্রতি তেমন কোনো উত্সাহ লক্ষ করা যায় না। সিভিল সমাজের ভূমিকাও প্রশ্নবোধক। তারা মূলত আন্তর্জাতিক পুঁজির প্রবক্তা এবং দলীয়করণের দোষে দুষ্ট। সব মিলিয়ে গণতন্ত্রের ভাগ্য বাংলাদেশে এখনো তেমন সুপ্রসন্ন নয়।

মুখ্য শব্দগুচ্ছ

সিভিল সমাজ, গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত, এলিট শ্রেণি, জনগণ, জোসেফ সুম্পিটার, রুশো, লাতিন আমেরিকা।

ভূমিকা

যে বিশেষ ধরনের গণতন্ত্র বাংলাদেশে আজ বহাল আছে তার হালচিত্র নিয়ে এই প্রবন্ধটি লেখা। স্বাধীনতা লাভের পর ৪৫ বছর পার হলেও গণতন্ত্র আমাদের দেশে অসুস্থতায় ভুগছে। এমন কিছু বস্তুগত পূর্বশর্ত আছে যেগুলো গণতন্ত্রের জন্য জরুরি হলেও বাংলাদেশ সেগুলো পূরণ করে না। ওই পূর্বশর্তগুলো কেন বস্তুগত তার কারণ হচ্ছে সেগুলো সমাজের আর্থসামাজিক অগ্রগতির পর্যায়ের সঙ্গে যুক্ত। প্রত্যক্ষভাবে না হলেও অন্তত পরোক্ষভাবে। বস্তুগত পূর্বশর্তের মধ্যে আর্থসামাজিক উন্নয়নকে মুখ্য ধরা হয়ে থাকে। সামন্তবাদী এবং অনুন্নত আর্থসামাজিক কাঠামোকে গণতন্ত্রের জন্য কেউ উপযোগী ভাবে না। অথচ ওই ধরনের সামন্তবাদী কাঠামো বাংলাদেশে বিরাজ করছে। আরও কিছু পূর্বশর্ত আছে, যেগুলো আর্থসামাজিক উন্নয়নের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নয়। কিন্তু গুরুত্বের বিচারে তাদের ভূমিকাকে লঘু ভাবা যায় না। তার মধ্যে একটি হচ্ছে উদারনীতির বিকাশ। একে অপরের প্রতি উদার না হলে নাগরিক সমাজে নানা মতের প্রসার ঘটে না। ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং ভিন্নমত মেনে নেওয়ার সংস্কৃতি গড়ে না উঠলে গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়। উদারবাদী মানসিকতা সমাজে এমনিতেই জন্ম নেয় না। তার বিকাশে সর্বজনীন শিক্ষার বিকাশ, মুক্ত মনের প্রসার, জ্ঞান-বিজ্ঞানকে সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন হয়। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাকেও উপেক্ষা করা যায় না। রাষ্ট্রের পক্ষে নানা আইন প্রবর্তন করে উদারনীতির প্রসার ঘটানো সম্ভব হলেও সেসব উদ্যোগ আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থায় বর্তমানে হয় অনুপস্থিত নতুবা পুরোমাত্রায় নেই।

উদারনীতি বিকাশের ক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত শ্রেণির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা প্রায় বলা হয়। মধ্যবিত্ত বলতে বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, পেশাজীবী গোষ্ঠী, সাংস্কৃতিক কর্মীদের বোঝানো হলেও বাংলাদেশে তাঁদের অবদান প্রশ্নসাপেক্ষ। সিভিল সমাজ নামে যাঁরা রাষ্ট্র বা রাজনীতির ঊর্ধ্বে দাঁড়িয়ে জনগণের পক্ষে কথা বলেন এবং গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ হিসেবে যাঁরা পরিচিত তাঁদের ভূমিকাও আজ প্রশ্নসাপেক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংকীর্ণ রাজনৈতিক অবস্থান পরিহার করে তাঁরা নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে পরিস্থিতি বিচার করতে অভ্যস্ত নন। সিভিল সমাজের মধ্যে অনেকে নব্য উদারনৈতিক পুঁজিবাদী কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত। স্থানীয় পর্যায়ে ওই কেন্দ্রের স্বার্থ রক্ষার দায়িত্ব নিয়ে তাঁরা গণতন্ত্রের কথা বলেন। কিন্তু তাঁদের বক্তব্য বা নীতিগত অবস্থানের প্রতি মানুষের তেমন কোনো আস্থা নেই। সে কারণে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তাঁদের যথাযথ ভূমিকা পালন করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এই দুই পূর্বশর্ত আমাদের দেশে অনুপস্থিত কেন তার কারণ ঐতিহাসিক। উত্তরাধিকারসূত্রে সেগুলো আমরা আমাদের হাতে পেয়েছি। অনুন্নত আর্থসামাজিক কাঠামো কেন আজও টিকে আছে বা কীভাবে আমাদের হাতে এল তার কারণ খুঁজতে ঔপনিবেশিক শাসনের ইতিহাস ঘাঁটতে হয়। ব্রিটিশ শাসন এবং পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানি শোষণ ও অত্যাচারের ইতিহাস উল্লেখ না করে সেটি বোঝা কঠিন। কেন পর্যাপ্ত পরিমাণে গণতান্ত্রিক অভিজ্ঞতা আমাদের নেই, তার কারণও ঐতিহাসিক। পাকিস্তান আমলে গণতন্ত্রের চর্চার কোনো সুযোগ আমাদের ছিল না। কেন উদারনীতির বিকাশ ঘটেনি সেটিও ওই ঐতিহাসিক কারণের সঙ্গে যুক্ত। অনুন্নত আর্থসামাজিক কাঠামো এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির সঠিক ভূমিকার অভাবে এই ঘাটতিগুলো সৃষ্টি হয়েছে এবং যে কারণেই হোক সেগুলো আমাদের আজকের জীবনের বাস্তবতা হয়ে আছে। এসব পূর্বশর্ত দ্রুত পূরণ করা কঠিন। সেগুলো পূরণের জন্য দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন। প্রশ্ন হচ্ছে, দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে ওই পূর্বশর্ত পূরণ করে গণতন্ত্রের চিন্তাভাবনা কতটুকু যৌক্তিক। যদি যৌক্তিক না হয় তাহলে তার বাইরে ভিন্ন কোনো বিকল্প পথ আছে কি না সেটি বিচার করে দেখা প্রয়োজন।

আর্থসামাজিক পূর্বশর্ত ছাড়াই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব

পূর্বশর্ত-সংক্রান্ত একটি শক্তিশালী অবস্থান হচ্ছে, পূর্বশর্তের অভাবে গণতন্ত্র আটকে থাকে না এবং তাকে গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য ভাবাও ঠিক নয়। নানা উদাহরণ দিয়ে সেটি আমরা বোঝাতে পারি। দক্ষিণ আফ্রিকার মুক্তি আন্দোলনের নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার দেশ দীর্ঘকাল ধরে কোনো গণতান্ত্রিক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যায়নি। সেখানে বর্ণবাদী শাসন বলবত্ ছিল, যা কিনা কঠোর শোষণনীতির ওপর গড়ে উঠেছিল। সেখানে মানুষের বাকস্বাধীনতা হরণ করে গোটা জাতিকে শৃঙ্খলিত করে রাখা হয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও নেলসন ম্যান্ডেলার মতো সংগ্রামী নেতার পক্ষে ওই বর্ণবাদী সমাজে গণতন্ত্রের প্রাথমিক ভিত গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে। সমাজ উদার না হলে গণতন্ত্র আসবে না, সেটিও ঠিক না। গোটা ভারতবর্ষে উদারনীতির বিকাশ সমানভাবে ঘটেনি। ভারত একধরনের বর্ণবাদভিত্তিক সমাজ হওয়া সত্ত্বেও প্রায় সত্তর বছর ধরে গণতন্ত্র সেখানে সফলভাবে টিকে আছে। বাংলাদেশের কিছু উদাহরণও এ ক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য। ২০০৬ সালে ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে সামরিক বাহিনী সমর্থিত যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে, সে সরকার গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার যথার্থভাবে সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়। তারা নিরপেক্ষ ভোটার তালিকা তৈরি করে। জাতীয় পরিচয়পত্রের প্রথা চালু করে এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এর জন্য দেশকে পর্যাপ্ত পরিমাণ উদার হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হয়নি। গণতান্ত্রিক অভিজ্ঞতাহীনতা বা উদারনীতির ঘাটতিকে কারণ হিসেবে ব্যবহার করা সে কারণে ঠিক নয়।

আর্থসামাজিক বা আরও অন্যান্য পূর্বশর্তের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও আমাদের মতো দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। কিন্তু সেখানে চাই গান্ধী, নেহরু বা নেলসন ম্যান্ডেলার মতো মানুষ। যেখানে বস্তুগত পূর্বশর্তের অভাব আছে সেখানে এ ধরনের নেতৃত্ব গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে পারে। সে কারণে তাকে আমরা পূর্বশর্ত হিসেবেও দেখতে পারি। এই পূর্বশর্তটি বস্তুগত নয়। এটি ব্যক্তিকেন্দ্রিক, কারণ পূর্বশর্তটি ব্যক্তিমানুষের গুণাবলির সঙ্গে, রাজনৈতিক দলে অন্তর্ভুক্ত নেতা বা কর্মীর কার্যকলাপের গুণগত মানের সঙ্গে সম্পর্কিত। ফলে গুণগত দিক দিয়ে উচ্চ মানসম্পন্ন নেতৃত্ব বা সাচ্চা কর্মী নিয়ে গঠিত রাজনৈতিক দল গণতন্ত্রের ভবিষ্যত্ কী হবে তার ওপর বিশেষ প্রভাব রাখতে পারে। এটি নানা দেশের অভিজ্ঞতায় লক্ষ করা যায়। স্যামুয়েল হান্টিংটনও তার দ্য থার্ড ওয়েভ প্রবন্ধে নেতৃত্বের ভূমিকাকে মূল্যায়ন করে লিখেছেন, ‘economic development makes democracy possible; political leadership makes it real’ (1991:33)। এর কারণ রয়েছে। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে একক ব্যক্তির বিকাশ সম্ভব হলেও গোষ্ঠী বা সংগঠনের বিকাশ সেভাবে ঘটেনি। সে কারণে সংগঠনগতভাবে রাজনৈতিক দল দুর্বল হলেও ব্যক্তির ভূমিকা ওই দুর্বলতাকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুষিয়ে নিতে পেরেছে।

গণতন্ত্রের বিকাশে ব্যক্তি বা রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ—এই চিন্তাধারা বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছিল ১৯৯১ সালে সোভিয়েত এবং মার্কিনদের মধ্যে ঠান্ডা যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর। ঠান্ডা লড়াই শেষ হওয়ার পর নানা দেশ পূর্বশর্তের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই দেশগুলোর মধ্যে রাশিয়া, অন্যান্য সোভিয়েত রিপাবলিক, পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশ, এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার দেশ অন্তর্ভুক্ত। স্বৈরশাসন বা একনায়কতান্ত্রিক শাসনের বদলে ওই সব দেশে নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করা সম্ভব হয়েছিল। নির্বাচিত প্রতিনিধি দিয়ে রাষ্ট্রপরিচালনার প্রথা শুরু হয়। এই গণতান্ত্রিক প্রথা মোটামুটি নির্বিঘ্নে প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় ধরে নেওয়া হয়েছিল আর্থসামাজিক বা রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক পূর্বশর্ত ছাড়াই এলিট শ্রেণির সম্মতির ভিত্তিতে একটি দেশ গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে যেতে পারে। বস্তুগত পূর্বশর্তের অভাব সত্ত্বেও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অনেক উদাহরণ রয়েছে। তার মধ্যে চিলি ও পেরু অন্তর্ভুক্ত। এই দুই দেশ শিল্পায়িত না হয়েই অর্থাত্ আর্থসামাজিক পূর্বশর্ত পূরণ না করেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছে। শিল্পায়নের অভাব সেখানে গণতন্ত্রের সংগ্রামকে ব্যাহত করেনি। খনিজ সম্পদ রপ্তানি করে ওই দুই দেশ আধুনিকায়নের পথে অগ্রসর হয়। কলকারখানা তৈরির প্রয়োজন হয়নি। প্রয়োজন হয়নি শিল্পায়নের (Pinkney ২০০৩: ৬৬)। তবে চিলির ক্ষেত্রে ব্যাপারটি কিছুটা ভিন্ন হতে পারে। চিলির গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য অনেক আগে থেকেই ছিল। সেটি তার গণতন্ত্রায়ণে কিছুটা হলেও সাহায্য করেছে।

আরও অনেক দেশের উদাহরণ আছে যেখানে শিল্পায়ন নয়, বরং কৃষির আধুনিকায়ন ঘটিয়ে গণতন্ত্র এসেছে। তার উদাহরণ হচ্ছে ব্রাজিল। ব্রাজিলের এই উদাহরণ গণতন্ত্রের সনাতনী একটি তত্ত্বকে ভুল প্রমাণ করে। ওই তত্ত্বের দাবি ছিল কৃষিভিত্তিক কোনো দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব না। অথবা সম্ভব হলেও কঠিন। এসব উদাহরণের ভিত্তিতে বলা যায় যে শিল্পায়নের সঙ্গে যে সামাজিক পরিবর্তন জড়িত, সেগুলো গণতন্ত্রের জন্য পুরোমাত্রায় আবশ্যক ভাবা ঠিক নয়।

গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ব্যক্তির ভূমিকা নানা বিচিত্র পথে আসতে পারে। তার নানা উদাহরণ আমরা ইতিহাসের পাতায় দেখি। দেখা গেছে, কোনো বিশেষ ঐতিহাসিক কারণে কোনো দেশের ওপর গণতন্ত্রকে চাপিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। সেটি সম্ভব হয়েছে ব্যক্তি বা রাষ্ট্রনায়ক অথবা রাজনৈতিক দলের দূরদর্শিতার কারণে। তার একটি উদাহরণ হচ্ছে জাপান। শক্তি বা ভয়-ভীতি দেখিয়েই হোক আর দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে পরাজয়ের কারণেই হোক, বস্তুগত পূর্বশর্তের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও জাপানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছিল। একদিকে যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতি, অন্যদিকে সম্রাটের শাসন এবং উগ্র জাতীয়তাবাদের আবছায়ায় জাপানে গণতন্ত্রের কথা ভাবা কঠিন ছিল। কিন্তু তারপরও সেখানে গণতন্ত্র এসেছে ব্যক্তিবিশেষের দূরদর্শিতার কারণে। সে দেশের এলিট গোষ্ঠী এক পা এগিয়ে গিয়ে গণতন্ত্রকে স্বাগত জানিয়েছিল। সানফ্রানসিসকো শহরে ১৯৫১ সালে জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকার মধ্যে যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল তাতে জাপান অনেকটা বাধ্য হয়ে জাতীয় ঐতিহ্য, আধ্যাত্মিক ও ব্যক্তিগত জীবনে সম্রাটের প্রবল আধিপত্য এবং প্রভাবকে উপেক্ষা করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয়। জাপানের গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র মার্কিনরাই লিখে দিয়েছিল। সেটি আমরা অনেকেই হয়তো জানি না। সেই শাসনতন্ত্র অনুসরণ করে জাপান বিগত সত্তর বছর ধরে গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে পরিচিত। এই চাপিয়ে দেওয়ার কারণ বহুবিধ হতে পারে। জাপানের ক্ষেত্রে ঠান্ডা লড়াই বিশেষ ভূমিকা পালন করলেও করতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানকে সোভিয়েতের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে একধরনের ভূকৌশলগত প্রাধান্য লাভ করতে চেয়েছিল। তবে সেটি বড় কথা নয়। বড় কথা হচ্ছে পূর্বশর্তের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব। জাপানের উদাহরণ থেকে সেটি আমরা দেখতে পাই।

এই চাপিয়ে দেওয়ার আরও উদাহরণ রয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর (জুলাই ২৭, ১৯৫৩ সালে) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে উন্নত প্রযুক্তি, অর্থ এবং রাজনৈতিক সহযোগিতা দিয়ে সেখানকার অর্থনৈতিক অবস্থাকে উন্নত করেছিল এবং নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে সে দেশও গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে গেছে। ওই একই দাবি করা সম্ভব তাইওয়ানের ক্ষেত্রে। সেখানেও গণতন্ত্র এসেছে পূর্বশর্তের অনুপস্থিতিতে। ভূকৌশলগত কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানকে নানা ধরনের উন্নতমানের প্রযুক্তি সাহায্য দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রচুর অনুদানও তাইওয়ানের জন্য বরাদ্দ করা হয়। নানা বাধা-বিপত্তি কাটিয়ে তাইওয়ান আজ গণতান্ত্রিক দেশ এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে অতিশয় উন্নত। তুরস্কের ক্ষেত্রেও ওই চাপিয়ে দেওয়ার উদাহরণ আছে। দেশ হিসেবে তুরস্ক এশিয়া এবং ইউরোপের মাঝামাঝি জায়গায় অবস্থিত। কিন্তু অর্থনৈতিক সুবিধার কারণেই হোক আর ইউরোপের সদস্য হওয়ার গৌরববোধ থেকেই হোক, সে দেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হতে চায়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের শর্ত হচ্ছে সদস্যপদ পেতে হলে তুরস্ককে গণতান্ত্রিক দেশ হতে হবে, মানবাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে আরও উদ্যোগী হতে হবে। এই ধরনের বহিঃ চাপ কেবল ইউরোপ থেকে আসে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও ইদানীং তাদের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নীতিমালায় গণতন্ত্রকে পূর্বশর্ত হিসেবে ধরে নেয়। সেটিও একধরনের চাপিয়ে দেওয়া বৈকি। ওই চাপ বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও রয়েছে, যদিও পরোক্ষভাবে।

যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে আমাদের মতো যেসব দেশে বস্তুগত পূর্বশর্তের অভাব রয়েছে, সেখানে গণতন্ত্রের ভবিষ্যত্ অনেকখানি নির্ভর করছে ব্যক্তির ভূমিকার ওপর। ব্যক্তির ভূমিকা বলতে বোঝা উচিত নেতা এবং নেতৃত্বের ভূমিকাকে, রাজনৈতিক দলের সাংগঠনিক অবস্থা বা তার আদর্শকে। তার অর্থ হচ্ছে যে ঘাটতি বস্তুগত পূর্বশর্তের অভাবের কারণে সৃষ্টি হয় সেটি ব্যক্তিকেন্দ্রিক ফ্যাক্টরের বর্ধিত ভূমিকা দিয়ে পূরণ করা সম্ভব। প্রায় সব সমাজে বস্তুগত পূর্বশর্তের কিছু না কিছু ঘাটতি থাকে। এমন কোনো রাষ্ট্র বা সমাজ নেই যেখানে বস্তুগত পূর্বশর্তগুলো পুরোমাত্রায় পূরণ করা সম্ভব। সেই ঘাটতি আমাদের সমাজে দুর্ভাগ্যজনকভাবে অনেক বেশি। কিন্তু তারপরও কেন বাংলাদেশ রাজনৈতিকভাবে আজও ঐক্যবদ্ধ সমাজে পরিণত হতে পারেনি সে প্রশ্নের উত্তর রাজনৈতিক নেতৃত্বের দুর্বলতা বা অনীহা থেকে সৃষ্ট বলে ধরে নিতে সংকোচ করা উচিত নয়। নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে নিরপেক্ষ করার ক্ষেত্রে আমাদের ব্যর্থতা রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা রাজনৈতিক দলের ঘাড়ে চাপে। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা কেন গণকল্যাণমুখী নয় সেটি কোনো ঐতিহাসিক কারণ দিয়ে বোঝানো যাবে না। আংশিকভাবে হলেও তার উত্তর খুঁজতে হবে জনপ্রতিনিধিদের আচরণে, জনগণের প্রতি তাদের নির্লিপ্ত ভূমিকায়, তাদের মধ্যযুগীয় এবং ঔপনিবেশিক স্বৈরতান্ত্রিক মানসিকতায়। এই ত্রুটিগুলো গণতন্ত্রের বস্তুগত পূর্বশর্তের সঙ্গে যুক্ত নয়। এগুলোর কারণ ঐতিহাসিকও নয়। এগুলো ব্যক্তিমানুষের দুর্বলতা বা ভুলত্রুটির সঙ্গে যুক্ত। সেখানে অপ্রতুল মেধা এবং সদিচ্ছার অভাবও কারণ হতে পারে। রাজনৈতিক এলিট শ্রেণির গুণগত মানের সঙ্গে গণতন্ত্রের ভাগ্য যে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত সেই প্রতিপাদ্যটি মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই।

তবে বহিঃচাপের যেসব উদাহরণ এখানে উল্লেখ করা হলো তাকে নিঃশর্তভাবে গ্রহণ করে নেওয়া উচিত নয়, তা যতই কার্যকরী বলে মনে হোক না কেন। কেবল তার ওপর ভরসা করে আমাদের দেশে গণতন্ত্রের কথা ভাবা যায় না। যে পরিস্থিতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিল অথবা তাইওয়ান বা কোরিয়ায় নাক গলিয়েছিল তার কারণ বহুবিধ হতে পারে। সেই কারণগুলো আজকের বিশ্বে প্রযোজ্য নাও হতে পারে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর চীন বা ভিয়েতনামে কমিউনিস্ট শাসন প্রবর্তন এবং এশিয়ায় দ্রুতগতিতে সমাজতান্ত্রিক ধারণার বিস্তার লক্ষ করা গিয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হয়তো গণতন্ত্রের বেশ কিছু এশীয় মডেল তৈরি করে ওই প্রসারের আশঙ্কা থেকে এশিয়াকে মুক্ত করতে চেয়েছিল। কিন্তু সেই পরিস্থিতি আজ আর নেই। আজ ঠান্ডা যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটেছে। বাইরের সাহায্যের চেয়ে অভ্যন্তরীণ শক্তির ওপর গুরুত্ব দেওয়া আজ সে কারণে অনেক বেশি ফলপ্রসূ। তা ছাড়া পৃথিবীও আজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একচেটিয়া প্রভাবের মধ্যে নেই। একদিকে চীন এবং ভারতের অর্থনৈতিক শক্তি ও প্রভাব বৃদ্ধি, লাতিন আমেরিকায় ব্রাজিল বা আফ্রিকা মহাদেশে দক্ষিণ আফ্রিকা অথবা ইউরোপে রাশিয়া এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের শক্তি বৃদ্ধির কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একচেটিয়া আধিপত্য বিনষ্ট হচ্ছে। ফলে গণতন্ত্রের ভবিষ্যত্ বাস্তবায়নের প্রশ্নকে কেবল বাইরের প্রভাবের সঙ্গে যুক্ত করে দেখা সমীচীন হবে না। বলছি না ওই ভূকৌশলগত কারণ আজ সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত। চীনের পরাশক্তি হওয়াকে রোধ করার জন্য অথবা তার আঞ্চলিক প্রভাবকে সীমিত রাখার জন্য মিয়ানমার বা অন্য কোনো দেশের ওপর চাপ খাটিয়ে তাদের গণতন্ত্রের পথে আনার কৌশলকে পুরোপুরি বাতিল করা যায় না। যদিও সেটি কতটুকু কার্যকর হবে তা নিয়ে মতভেদ থাকতে পারে।

দ্বিতীয় যে কারণে আর্থসামাজিক পূর্বশর্ত ছাড়াই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা ভাবা যায়, সেটি হচ্ছে বর্তমানের পরিবর্তিত আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি। ইদানীংকালে বিশ্বপরিস্থিতি গণতন্ত্রের জন্য অনুকূল বলে ধরে নিতে হবে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ঠান্ডা যুদ্ধের সমাপ্তির পর গণতন্ত্রসংক্রান্ত গবেষণায় কোনো পূর্বশর্তের অনুপস্থিতিতে কীভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় সেটি বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছিল। মার্কিন স্বরাষ্ট্র বিভাগের এককালের প্রধান ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা The End of History and the Last Man—এই প্রশ্নটিকে তাত্ত্বিক ফ্রেমে সাজিয়ে বিচার করে দেখেছেন। তাঁর লেখায় তিনি দাবি করেছেন, রাষ্ট্রপরিচালনার অন্যতম ব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্রের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। সে কারণে মানবসমাজকে শাসন করার যেসব তত্ত্ব বা কৌশল নিয়ে নানা পরীক্ষণ করা হয়েছে (সমাজতান্ত্রিক, স্বৈরতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক, সামরিক) সেই পরীক্ষণের আজ সমাপ্তি ঘোষণার সময় উপস্থিত। সেখানে গণতন্ত্র ছাড়া অন্য কোনো শাসনব্যবস্থা দিয়ে রাষ্ট্রপরিচালনার সম্ভাবনা নেই, যেহেতু একদলীয় শাসনের তাত্ত্বিক যৌক্তিকতা সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতনের সঙ্গে শেষ হয়েছে।১ ঠিক এই অর্থে ফুকুয়ামা বুঝিয়েছেন কেন মানবসমাজ ইতিহাসের একেবারে শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেছে।

কেবল ফুকুয়ামা নন, সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের শক্ত এবং খাঁটি অনুসারী হয়ে যাঁরা এত দিন অন্য বৃন্তের মানুষ ছিলেন, তাঁরাও ওই সত্যটি ধীরে হলেও উপলব্ধি করছেন। তাঁদের মনে একনায়কতান্ত্রিক বা একদলীয় ক্ষমতাকাঠামো নিয়ে সন্দেহ জন্মেছে। তাঁরা এটুকু অন্তত বুঝতে পেরেছেন যে সারা বিশ্বে গণতান্ত্রিক জোয়ারের সামনে সর্বহারার একনায়কতন্ত্রের স্লোগানটা অসম্ভব রকম বেমানান দেখায়। ফলে তাঁদের উপলব্ধি হচ্ছে, সমাজতান্ত্রিক আদর্শের সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে হলে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের রশি ধরে অথবা তাকে সংশোধন করে অগ্রসর হতে হবে। D L Rabyi তাঁর Democracy and Revolution: Latin America and Socialism Today গ্রন্থে সেই অবস্থানের প্রতিফলন আমরা লক্ষ করি। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘বিপ্লবী বামের ক্ষেত্রে শিক্ষাটা আজ একেবারে পরিষ্কার। সমাজতন্ত্র একনায়কতন্ত্রের পথ ধরে অর্জন করা সম্ভব নয়। সে কারণে আজ আমরা সবাই গণতন্ত্রী। কঠোরপন্থী স্তালিনীয় তত্ত্বের দিন ফুরিয়ে গেছে। নির্বাচনকে বাতিল করে সর্বহারার একনায়কতন্ত্রের পক্ষে ওকালতি করা আর স্বৈরতন্ত্রকে সমর্থন করা’ (পৃষ্ঠা ২০) একই জিনিস। স্বাভাবিকভাবে এই ধরনের মূল্যায়ন গণতন্ত্রের প্রতি মানুষের সমর্থনকে বৃদ্ধি করবে, সেটি আশা করা যায়।

তত্ত্বগতভাবে বস্তুগত পূর্বশর্ত ছাড়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নকে জোরদার করার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন রবার্ট ডাল (১৯৮৯), রনালদ ইঙ্গেলহাট (১৯৯০), সিমোর লিপসেট (১৯৯৪), গ্যাব্রিয়েল আলমনড এবং সিডনি ভেরবা (১৯৬৩), রস্টো (১৯৭৩), জোসেফ সুম্পিটার (১৯৭৬), ল্যারি ডায়ামনড (১৯৯০), গুলিয়েরমো ও ডোনেলের লেখা। এসব গবেষকের যুক্তি হচ্ছে, একটি দেশের এলিট গোষ্ঠী বা প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ যদি নিজের স্বার্থের কথা ভেবে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছান এবং গণতন্ত্রের মূল নীতিমালা মেনে চলার অঙ্গীকার করেন, তাহলে আর্থসামাজিক পূর্বশর্ত ছাড়াই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব হতে পারে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই বিশেষ পথটি কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ সেটি যাচাই করে দেখা প্রয়োজন। রাজনৈতিক এলিট শ্রেণির মধ্যে বাংলাদেশে সমঝোতার রাজনীতি আজও অনুপস্থিত এবং ওই শ্রেণি দ্বিধাবিভক্ত। সে কারণে এলিট শ্রেণির ওপর এই গুরুদায়িত্ব দিয়ে কতটুকু নিশ্চিন্ত হওয়া যাবে সে প্রশ্ন অবান্তর নয়। আরও একটি দিক লক্ষ করার মতো। গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান শক্তি হচ্ছে জনগণ। এলিট শ্রেণির ওপর গণতন্ত্রের দায়িত্বভার চাপিয়ে দেওয়া এবং এলিট শ্রেণি ওই দায়িত্ব কতটুকু পালন করছে সেটি নির্ভর করে জনগণের ভূমিকার ওপর। সে কারণে এলিট শ্রেণির ওপর দায়িত্ব দেওয়ার অর্থ এই নয় যে জনগণের ভূমিকাকে আমরা উপেক্ষা করছি। গণতন্ত্রায়ণে জনগণের ভূমিকা এবং অংশগ্রহণের দিকটি অনেক তাত্ত্বিক আলোচনায় ঊহ্য রাখা হয়। কিন্তু এলিট গোষ্ঠী এবং জনগণের ভূমিকার আন্তসম্পর্ক-সংক্রান্ত প্রশ্নকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।

জনগণের ভূমিকার দিকটি এলিট শ্রেণির ভূমিকার মতোই গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাসে এমন অনেক উদাহরণ আছে যেখানে সামাজিক উত্থান-পতনে জনগণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ১৮৪৮ সালে নেপোলিয়নের নাতি লুই বোনাপার্ট যে সামরিক অভ্যুথান ঘটিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল তাতে জনগণের ভূমিকা ছিল প্রধান। কার্ল মার্ক্স তাঁর ১৮ ব্রুমেই লুই বোনাপাটে ব্যক্তি বা সামাজিক গোষ্ঠীর ভূমিকার গুরুত্ব তুলে ধরে দেখিয়েছেন নেপোলিয়নের ওই ক্যু সফল হয়েছিল সমাজের সবচেয়ে নিম্ন শ্রেণির সমর্থন নিয়ে। অন্যদিকে জার্মানিতে ফ্যাসিবাদের উত্থানের ক্ষেত্রেও জনগণের ভূমিকাকে ভেবে দেখা যায়। ১৯৩৩ সালের নির্বাচনে হিটলারকে জয়ী করেছিল সে দেশের জনগণ। ১৯৩৩ সাল থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত হিটলার ক্ষমতায় টিকে ছিলেন জনসমর্থনের কারণে। ফলে জনগণ এবং রাজনৈতিক এলিট শ্রেণির ভূমিকার মধ্যে বিশেষ সমন্বয় গণতন্ত্রের সফলতার জন্য আবশ্যকীয় বলে ধরে নিতে হবে। এলিট শ্রেণির ভূমিকা, জনমানুষের প্রতি তাদের কর্তব্যবোধ, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তাদের আন্তরিকতার ওপর অনেকখানি নির্ভর করে গণতন্ত্রের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে নাকি তার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে। ব্যক্তিকেন্দ্রিক এই ফ্যাক্টরগুলো বাংলাদেশে গণতন্ত্রের প্রধান পূর্বশর্ত হিসেবে ধরে নেওয়া বাঞ্ছনীয়।

এলিট শ্রেণি বনাম জনগণ

বস্তুগত পূর্বশর্তের অভাবের প্রেক্ষাপটে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কথা ভাবনায় নিয়ে আমরা প্রধান দুই পক্ষের ভূমিকার ওপর বিশেষ জোর দিতে চাই। ওই দুইয়ের একটি হচ্ছে দেশের এলিট শ্রেণি, বিশেষ করে রাজনৈতিক এলিট। অন্য পক্ষ হচ্ছে জনসাধারণ। আদর্শগতভাবে গণতন্ত্রকে এই দুই শ্রেণির ‘টাগ অব ওয়ার’ হিসেবে দেখা হয়ে থাকে। এলিট শ্রেণি জনগণের হাতে ক্ষমতা স্বেচ্ছায় হস্তান্তর করতে চায় না। তারা ক্ষমতা বরং নিজের হাতে কুক্ষিগত রাখতে চায়। অন্যদিকে জনগণ গণতন্ত্র চায়। কারণ গণতন্ত্রের অধীনে তার স্বার্থ সংরক্ষিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। গণতন্ত্রের অধীনে মানুষ স্বাধীনতা ভোগ করে। এই দুই শক্তির ভারসাম্য কোন দিকে গড়ায় তার ওপর নির্ভর করে গণতন্ত্রায়ণ-প্রক্রিয়া কতটুকু প্রসারিত হবে। এলিট শ্রেণি তার শ্রেণিগত ওই অবস্থান থেকে সরে আসতে পারে, নমনীয় মনোভাব দেখাতে পারে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও গণতন্ত্রের প্রতি আকর্ষিত হতে পারে কিন্তু সেটি নির্ভর করে বিশেষ পরিস্থিতির ওপর। তার নিজের স্বার্থের কথা চিন্তা করে এলিট শ্রেণি জনগণের সঙ্গে সমঝোতায় আগ্রহী হতে পারে। এলিট শ্রেণি সমাজে বিপ্লব বা অস্থিরতা চায় না। বিপ্লব তাদের ক্ষমতাকে আরও সংকুচিত করতে পারে এবং জনগণের ক্ষমতাকে বাড়িয়ে দিতে পারে—এই আশঙ্কার কারণে ইচ্ছা অথবা অনিচ্ছা সত্ত্বেও তারা গণতন্ত্রের পক্ষে এসে দাঁড়াতে পারে। তা ছাড়া এলিট শ্রেণি এবং জনগণের মধ্যে যে শক্তির ভারসাম্যের কথা বলা হয় সেটি যদি কোনো কারণে সমান সমান থাকে তাহলে এলিট শ্রেণি অনেক বেশি সচেতন হয় এবং জনগণের স্বার্থের দিকটি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় নেয়।

এলিট শ্রেণি এবং জনগণের ভূমিকা ও তাদের আন্তসম্পর্ক-সংক্রান্ত এই আলোচনাটি বোঝা প্রয়োজন, যদিও প্রসঙ্গটিকে সহজ ভাবা যায় না। তাত্ত্বিক দিক থেকে আন্তসম্পর্কটি এত দিন ধরে পশ্চিমা উদারনৈতিক দর্শনের ওপর ভর করে গড়ে উঠেছে, যদিও ওই উদারনৈতিক দর্শনের দৃষ্টিতে আমাদের দেশে জনগণ এবং এলিট শ্রেণিকে বিচার করা কঠিন। আমরা নিজেরাও তাদের আন্তসম্পর্ক-সংক্রান্ত কোনো দেশীয় তত্ত্ব দাঁড় করাতে পারিনি। অথচ এই আন্তসম্পর্ককে না বুঝে গণতন্ত্র নিয়ে কথা বলা কঠিন। আলোচনাটি সে কারণে অন্তত এই পর্যায়ে পশ্চিমা ভাবনার যে ফ্রেম রয়েছে তার মধ্যে রেখে করা ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই।

জনগণের ভূমিকা কী হবে?

গণতন্ত্র যদি এলিট শ্রেণি এবং জনগণের ক্ষমতাকেন্দ্রিক আন্তসম্পর্কের ওপর নির্ভর করে তাহলে জনগণের ক্ষমতার প্রকৃতি ও পরিমাণ কী সেটি মেপে দেখা প্রয়োজন। প্রথমত, এলিট গোষ্ঠী রাষ্ট্রশাসনের দায়িত্বভার পায়, কারণ জনগণ ওই ক্ষমতা তাদের প্রদান করে। সেদিক থেকে জনগণের ক্ষমতা কম ভাবা যায় না। জনগণের হাতে দুই ধরনের ক্ষমতা থাকে। একধরনের ক্ষমতা আছে যাকে De facto ক্ষমতা বলা হয়ে থাকে। অন্য আরও একধরনের ক্ষমতা আছে যাকে বলা হয় De jure ক্ষমতা। প্রথম ধরনের ক্ষমতা বলতে মানুষের প্রকৃতিগত ক্ষমতাকে বোঝায়। ফলে আমরা সবাই ওই ক্ষমতার অধিকারী। দ্বিতীয় ধরনের ক্ষমতা হচ্ছে সেই ক্ষমতা যেটি কাউকে হস্তান্তর করা যায়। প্রতিনিধিত্বশীল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সেটি সাধারণত হস্তান্তরিত হয় জনসাধারণের হাত থেকে এলিট শ্রেণির হাতে। সেভাবে এলিট শ্রেণির ওপর দেশ শাসনের দায়িত্বভার বর্তায়। প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রে সাধারণ মানুষ প্রতিনিধি নির্বাচন করে। তারা তাদের ক্ষমতা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে হস্তান্তর করে এই ভেবে যে ওই ক্ষমতা তাদের কল্যাণেই ব্যবহার করা হবে। জনগণের হাত থেকে হস্তান্তরিত এই ক্ষমতাই হচ্ছে De jure ক্ষমতা। অর্থাত্ জনগণের De facto ক্ষমতা নির্বাচিত প্রতিনিধির হাতে গিয়ে De jure ক্ষমতায় পরিণত হয়। অগণতান্ত্রিক পরিবেশে জনগণের হাতে De facto ক্ষমতা পরিমাণে বেশি থাকে। কারণ ওই ক্ষমতা এলিট শ্রেণির হাতে হস্তান্তরিত হওয়ার সুযোগ থাকে না। সুতরাং যেকোনো গণতন্ত্রে প্রধান প্রশ্ন হচ্ছে, জনগণ কোন ধরনের প্রতিনিধির হাতে ওই De jure ক্ষমতা হস্তান্তর করছে। কেবল হস্তান্তর করেই দায়িত্ব শেষ হচ্ছে না। সেই ক্ষমতা সম্পর্কে জনগণ কতটুকু সচেতন এবং De jure ক্ষমতা এলিট শ্রেণিকে প্রদান করে জনগণ তার অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে কতটুকু সক্রিয় বা পারদর্শী সেটিও বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

যে শর্তে জনগণ এলিট শ্রেণির হাতে তার ক্ষমতা হস্তান্তর করে সেই শর্ত এলিট শ্রেণি কতটুকু পালন করল বা আদৌ করল কি না তার তদারকির ক্ষমতা জনগণের আছে কি না বা কতটুকু আছে সেটি দিয়েই যাচাই করা সম্ভব একটি দেশে জনগণের ক্ষমতা কতটুকু। এই আন্তসম্পর্কের ওপর নির্ভর করে গণতন্ত্রের ভাগ্য। জনগণের ক্ষমতা যদি এলিট শ্রেণির ওপর যথেষ্ট প্রভাব রাখতে সক্ষম হয় তাহলে গণতন্ত্র সফল হবে। এলিট শ্রেণি ক্ষমতায় গিয়ে জনগণের দাবি-দাওয়াকে এড়িয়ে গিয়ে যদি আত্মসেবায় মগ্ন হয় এবং জনগণ সেই পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন বা তার বিরুদ্ধে ফলপ্রসূ প্রতিবাদ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয় তাহলে সে গণতন্ত্র আংশিক, খণ্ডিত বা বিকৃত হবে। গণতন্ত্র সেসব ক্ষেত্রে সার্বিক ব্যবস্থা হিসেবে দাঁড়াতে ব্যর্থ হবে। ফলে মূল যে দিক সম্পর্কে খেয়াল রাখা জরুরি তা হচ্ছে জনগণের সচেতনতার দিক, তাকে কীভাবে সচেতন করে তোলা যায়, যেন এলিট শ্রেণির সমকক্ষ শক্তি হয়ে সে তার দাবি পূরণের কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারে।

জনগণের সক্রিয়তা বা তার ভূমিকার প্রশ্নকে তিনটি পৃথক অবস্থান থেকে বিচার করে দেখা সম্ভব। এই তিনটির দুটি প্রাচীন গ্রিক গণতন্ত্রের অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া। বাকিটা গড়ে উঠেছে আধুনিক কালে। প্রথম ধরনের অংশগ্রহণ বলতে জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকে বোঝায়। সেটি প্রাচীন গ্রিসের গণতন্ত্রে আমরা লক্ষ করেছি। ওই প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের বিশেষ প্রেক্ষাপট ছিল। এথেন্সের আক্রোপলিসকে আমরা ছবিতে অনেকবার দেখেছি। তারই পাশে একটি মাঠ—হতে পারে টাওয়ার অব দ্য উইন্ড বা প্রাচীন আগোরার ধার ঘেঁষে কোনো বিস্তীর্ণ মাঠ। খ্রিষ্টপূর্ব ৫০৮ সালে গ্রিসের জনগণ বিদ্রোহ করে অত্যাচারী শাসককে পরাভূত করে। তার স্থলাভিষিক্ত হয়ে নতুন যে শাসক দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি জনগণের অধিকার এবং রাষ্ট্রশাসনে তাঁর ভূমিকার দিকটি অগ্রাধিকার দিয়ে বিচার করার সাহস দেখিয়েছিলেন। যে পদ্ধতি অনুসরণ করে ওই নতুন শাসক জনগণের অংশগ্রহণকে নিশ্চিত করেছিলেন সেটিই আজ গণতন্ত্র নামে পরিচিতি পেয়েছে। তিনি আক্রোপলিসের পাশে একটি জায়গা নির্ধারণ করে এথেন্সবাসীকে সেখানে সমবেত করেন। নতুন সম্রাট সমবেত জনতাকে রাষ্ট্রপরিচালনায় অংশগ্রহণের অনুরোধ জানান। উপস্থিত জনসমষ্টি ওই দিন গ্রিসের প্রথম পার্লামেন্টে পরিণত হয়। ঠিক আজকের দিনের বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ বা ব্রিটেনের হাউস অব কমন্সের মতো। সেখানে বিতর্ক এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের সহজ একটি ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। সাদা পাথর দিয়ে ‘হ্যাঁ’ ভোট এবং কালো পাথর দিয়ে ‘না’ ভোটের ব্যবস্থা চালু হয়। জনগণ কী সিদ্ধান্ত নেবে, কীভাবে তাদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রিত হবে, তার সমাধান এই গণতান্ত্রিক পদ্ধতির মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয়েছিল। এভাবে গ্রিক শব্দ ডেমোস যার অর্থ জনগণ এবং ক্রাটিস যার অর্থ শাসন বা জনগণের শাসনের ধারণা এথেন্সসহ বাকি বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।

এখানে যেটি গুরুত্বপূর্ণ সেটি হচ্ছে জনগণের শাসন। গ্রিক গণতন্ত্রকে জনগণের শাসন হিসেবে দেখা হয়েছে, কারণ সেখানে জনগণ সরাসরি সশরীরে উপস্থিত থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ পেয়েছে। ওই শাসনব্যবস্থায় জনগণের অংশগ্রহণ ছিল পূর্ণমাত্রায়। পরবর্তী সময়ে এই প্রত্যক্ষ উপস্থিতির পাশাপাশি আরও একটি স্তর যোগ করা হয়। তার সঙ্গে আজকের প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের সাদৃশ্য আছে। এথেন্সে সাধারণ মানুষের অ্যাসেম্বলির পাশাপাশি ৫০০ সদস্যের এক বিশেষ কাউন্সিল গঠন করা হয়। এই কাউন্সিলের দায়িত্ব ছিল প্রতিদিনের কাজগুলো পরিচালনা করা। নগররাষ্ট্রের সব জনগণের পক্ষে প্রতিদিন এক জায়গায় সমবেত হয়ে রাষ্ট্রের শাসন দেখাশোনা করা ব্যবহারিক দিক থেকে অসম্ভব ছিল। যদি তা-ই হতো তাহলে প্রতিদিনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে বাদ দিয়ে জনগণকে তার পুরো সময় ব্যয় করতে হতো রাষ্ট্রপরিচালনার কাজে। ওই দিকটি ভেবে রাষ্ট্রপরিচালনার জন্য লটারির মাধ্যমে কর্মকর্তা নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়। এভাবে প্রাচীন গ্রিসে জনগণের দুই ধরনের ভূমিকা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একটি হচ্ছে, জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণ। অন্যটি জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচন করার অধিকার। বলা বাহুল্য, প্রথমটি আজকের আধুনিক সমাজে প্রযোজ্য ভাবা কঠিন। কয়েক কোটি মানুষকে একটি স্থানে জড়ো করা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব দেওয়া আজ কোনোভাবে সম্ভব নয়। সে কারণে গণতন্ত্রের প্রধান রূপ হিসেবে প্রতিনিধিত্বের ধারণাটি স্থান করে নিয়েছে। ফলে জনগণের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছে। প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের পরিবর্তে প্রতিনিধি দিয়ে শাসন করার প্রথা গণতন্ত্রে প্রাধান্য পাওয়ার কারণে আজকাল জনগণের শাসন না বলে গণতন্ত্র বলতে জনপ্রতিনিধির শাসনকে বোঝানো হয়।

জনগণের অংশগ্রহণকেন্দ্রিক দ্বিতীয় তত্ত্বটি গ্রিক ধ্রুপদি উদাহরণের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। ওই ক্ল্যাসিক্যাল তত্ত্বে জনগণের অংশগ্রহণ বলতে তার বিদ্রোহী চরিত্রকে বোঝানো হয়েছে। ওই বিদ্রোহী চরিত্র অকার্যকর সরকারের বিরুদ্ধে একধরনের রক্ষাকবচ হিসেবে ভাবা হয়। এই রক্ষাকবচের ধারণাটি গড়ে ওঠে জনগণের প্রতিবাদী দিকের প্রতি লক্ষ রেখে। গ্রিসে কুশাসনের বিরুদ্ধে সাধারণ নাগরিকের বিদ্রোহ করার কারণে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছিল। বিদ্রোহের মুখে অভিজাত শ্রেণি গণতন্ত্র দিতে বাধ্য হয়েছিল। সেদিক থেকে ভাবলে ওই গণতন্ত্র প্রবলভাবে শ্রেণি বিভক্ত গ্রিক সমাজের অভ্যন্তরীণ সংগ্রামের ফসল ছিল। বঞ্চিত, নিগৃহীত ও অধিকারহীন বিশাল জনগোষ্ঠীর সেই বিদ্রোহটি ঘটেছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৫০৮ সালে। ওই বিদ্রোহে সাধারণ মানুষ অত্যাচারী শাসক রাজা হিপিয়াসকে উত্খাত করে। মানুষ রাস্তায় নামে, অভিজাত পরিবারের ঘরে ঘরে আগুন দেয়, হিপিয়াসকে এথেন্স থেকে বহিষ্কার করে। ফলে ওই প্রতিবাদী দিককে গণতন্ত্রের প্রধান রক্ষাকবচ হিসেবে দেখা হয়।

আধুনিক সমাজে ওই প্রতিবাদী দিকটি নতুনভাবে মূল্যায়িত হয়েছে। জনগণের অংশগ্রহণ বলতে তার বিদ্রোহী তত্পরতাকে আর বোঝানো হয় না। প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের ক্ষেত্রেও ওই একই কথা প্রযোজ্য। তার জায়গায় আজকাল জোর দেওয়া হচ্ছে মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণের ওপর। ওই সক্রিয়তা বলতে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করা, জ্বালাও, পোড়াও বা আক্রমণাত্মক কিছুকে বোঝায় না। বোঝায় বুদ্ধিবৃত্তিক, আবেগগত এবং নৈতিক শক্তি দিয়ে শাসকগোষ্ঠীর ওপর চাপ সৃষ্টি করা এবং সেভাবে তাকে দায়বদ্ধ রাখা। ফলে জনগণের অংশগ্রহণের প্রশ্নে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক, আবেগগত এবং নৈতিক শক্তি কীভাবে বৃদ্ধি করা যায় (Pateman 1970, p. 12) সেদিকটি তাত্ত্বিক আলোচনায় বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। জনগণের অংশগ্রহণের এই নতুন ধারণা গড়ে ওঠে ফরাসি দার্শনিক জ্য জাঁক রুশোর সময় থেকে। রুশো জনগণের বিদ্রোহী মনকে গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ হিসেবে ভাবেননি। তার চেয়ে তিনি অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন জনগণের সচেতন এবং সক্রিয় অংশগ্রহণকে। ওই সক্রিয় অংশগ্রহণ বলতে কী বোঝায়, সেটি বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।

সক্রিয় অংশগ্রহণ বলতে রুশো সমাজে বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোতে মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং যুক্ত থাকাকে বুঝিয়েছেন। প্রতিষ্ঠানে অংশ নিয়ে মানুষ নানা সিদ্ধান্ত গ্রহণে অবদান রাখতে পারে, তার ভেতরে যেসব গুণ আছে সেগুলোকে কাজে লাগাতে পারে। প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে মানুষ একে অন্যের সঙ্গে আন্তসম্পর্ক গড়ে তোলার সুযোগ পায়। ওই আন্তসম্পর্ক মানুষের মনস্তাত্ত্বিক এবং মনোভাবের জগতে পরিবর্তন এনে দেয়। একই সঙ্গে ব্যক্তিপর্যায়ে মানুষ সংগঠনের গুণগত মান বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে পারে। জনগণের অংশগ্রহণ বলতে তাহলে যা বোঝায় তা হচ্ছে মানুষের অভ্যন্তরীণ গুণগত পরিবর্তন। ওই পরিবর্তন জ্বালাও-পোড়াও বা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদের চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর বলে ধারণা করা হয়। ওই অভ্যন্তরীণ গুণাবলির বিকাশ জনগণকে প্রকৃত অর্থে আরও শক্তিশালী করে এবং গণতন্ত্রকে তৃণমূল পর্যায়ে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে সাহায্য করে। রুশো অবশ্য গুণগত পরিবর্তনের সঙ্গে একটি শর্ত আরোপ করেছিলেন। তিনি দাবি করেছিলেন জনগণের মনোজগতে গুণগত পরিবর্তন আনতে হলে সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য কমিয়ে আনতে হবে। ওই বৈষম্য কমানো না গেলে ওই আন্তসম্পর্ক সত্যিকার অর্থে ফলপ্রসূ হয় না। সামাজিক ও রাজনৈতিক বৈষম্যকে এমন পর্যায়ে রাখা প্রয়োজন যেন মানুষ কোনোভাবে রাজনৈতিক বৈষম্যের শিকার না হয়। এই দিকটি নিশ্চিত করা গেলে মনস্তাত্ত্বিক উন্নতি এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার পথটি সবার ক্ষেত্রে সহজ হবে বলে তিনি আশা করেছিলেন। রুশো সে কারণে সমাজে কোনো গোষ্ঠীকে অতিমাত্রায় ধনী হিসেবে ভাবেননি বা অতিমাত্রায় দরিদ্র হওয়ারও বিরোধিতা করেছেন। অতিমাত্রায় ধনিক গোষ্ঠী অন্যের ওপর কর্তৃত্ব করার সুযোগ পায়, অর্থের বিনিময়ে সাধারণ মানুষের ওপর প্রভাব খাটাতে পারে। সে কারণে সম্পত্তির মালিকানাকে রুশো গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ হিসেবে ভেবেছেন সে মালিকানা যত সীমিত হোক না কেন। সম্পত্তির ওপর মালিকানা মানুষের স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করে (Pateman, 1970 p. 22-23) এই ধরনের একটি বিশ্বাস রুশোর মনে ছিল।

দ্য পলিটিকস নামক গ্রন্থে গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলও দাবি করেছেন, জনগোষ্ঠীর মধ্যে সমতা সৃষ্টি না হলে জনগণ সার্বভৌম হতে পারে না। সমতাকে তিনি দুটি অর্থে বুঝতে চেয়েছিলেন। সমতা বলতে একদিকে প্রতিটি নাগরিকের শাসন করার অধিকারকে বোঝায়। বোঝায় সবার ভোট দেওয়ার অধিকার এবং রাষ্ট্রীয় অফিসের কর্মকর্তা হওয়ার অধিকারকে। সেই সঙ্গে শাসিত হওয়ার সম্ভাবনাকে বাদ দেওয়া যায় না। অর্থাত্ সমতার অর্থ কেবল স্বাধীনতা নয়। ওই স্বাধীনতা অন্যের স্বাধীনতাকে যেন হরণ না করে সে দিকটির প্রতিও লক্ষ রাখা জরুরি। সেদিক দিয়ে ভাবলে সমতা ও স্বাধীনতার মধ্যে বিরোধ থেকে যায়। সমাজে সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সবাই সমান অধিকার ভোগ করে না। সমাজে ধনীর তুলনায় দরিদ্রের সংখ্যা বেশি। সমতা ও স্বাধীনতার এই বিরোধকে গণতন্ত্রের অন্যতম প্যারাডক্স হিসেবে ধরা হয়। ফলে আমরা লক্ষ করেছি কোনো এক পর্যায়ে ধনিক শ্রেণির হাতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া কুক্ষিগত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ধনী-গরিব বিভেদ আমাদের দেশে তীব্র থাকায় জনগণ স্বাধীনভাবে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করে না। প্রবণতাটি কেবল অনুন্নত দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ভাবা যায় না। উন্নত সমাজেও জনগণ রাজনীতির প্রতি ওই বিশেষ অবস্থাগত কারণে অনেক বেশি নির্লিপ্ত হয়ে পড়ছে। জনগণের অংশগ্রহণের ব্যাপারে ধ্রুপদি তাত্ত্বিকেরা যেভাবে উত্সাহী হয়েছিলেন, সে উত্সাহের এখন পুনর্মূল্যায়ন ঘটতে দেখা যাচ্ছে গণতন্ত্রসংক্রান্ত নানা তত্ত্বে। বিশেষ করে সেটি লক্ষ করা যায় সুম্পিটারের তত্ত্বে। সেটি আমরা পরবর্তী সময়ে আলোচনা করব।

যাই হোক, রুশোর তত্ত্বে তাহলে জনগণকে পারস্পরিক নির্ভরশীল একটি সমষ্টি হিসেবে দেখা হয়েছে যে নির্ভরশীলতা গড়ে তোলা গেলে মানুষের মধ্যে সমতা ও স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে। এই নির্ভরশীলতা রুশোর কাছে বিশেষ গুরুত্ব পাওয়ার আরও একটি কারণ ছিল। সেখানে রুশো আইনের শাসনের একটি দিক লক্ষ করেছিলেন। সেটি হচ্ছে, ব্যক্তি যদি স্বাধীন হয় এবং স্বাধীন হিসেবে একে অপরের ওপর নির্ভরশীল হয় তাহলে এমন কোনো আইন পাস করতে কেউ উত্সাহী হবে না যে আইন অন্যকে ক্ষতি করে। রুশো এমন একটি সমাজ চেয়েছিলেন যেখানে খুদে কৃষকদের প্রাধান্য থাকবে বা খুদে কৃষক নিয়ে পুরো সমাজ গড়ে উঠবে। সেখানে অর্থনৈতিক সমতা বলবত্ থাকবে এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে।২ স্বাধীন মানুষ বলতে রুশো বুঝেছেন সেই মানুষকে যে কিনা সামাজিকভাবে দায়িত্বশীল হয়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেয়। রুশোর গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের তত্ত্ব সে অর্থে নিবিড়ভাবে প্রতিষ্ঠানের কাঠামোর সঙ্গে যুক্ত। ওই প্রতিষ্ঠান মানুষের মনস্তাত্ত্বিক গুণাবলি বা মনোভাবকে গণতান্ত্রিক করে এবং সেই ধরনের মানুষ প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারে।

রুশোর এই তত্ত্বকে পরবর্তী সময়ে আরও উন্নত করেছেন প্রখ্যাত দার্শনিক এবং উপযোগবাদী J S Mills (১৮০৬-১৮৭৩) এবং D S Cole। জনগণের অংশগ্রহণকে রুশোর মতো করে তাঁরাও শিক্ষামূলক এবং ব্যক্তির গুণগত মান উন্নয়নের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন। মানুষের মধ্যে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক পারস্পরিক সম্পর্ক জনগণের গুণগত মান উন্নয়নে সাহায্য করে। তার মনস্তাত্ত্বিক বিকাশ অনেকখানি নির্ভর করে ওই আন্তক্রিয়ামূলক অংশগ্রহণে, যেখানে মানুষ সমষ্টি স্বার্থ কী সে সম্পর্কে ধারণা পায়। আর সেটিই পরবর্তী সময়ে গণতন্ত্রের ভিত গড়ে তুলতে সাহায্য করে।৩ আজকাল সব দেশে জনসংখ্যা যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাকে মিলস কেবল ভোট দেওয়ার অধিকার এবং ওই ভোট দিয়ে জাতীয় সরকারে অংশগ্রহণকে তেমন গুরুত্ব দিয়ে দেখেননি। তাঁর মতে, আন্তক্রিয়ামূলক সম্পর্ক গড়ে তোলার সবচেয়ে উত্কৃষ্ট জায়গা হচ্ছে স্থানীয় পর্যায়ে।৪ যেমন গ্রাম, উপজেলা, মহকুমা, জেলা ইত্যাদি পর্যায়ে। মিলস প্রতিটি স্থানকে গণতন্ত্রের মূল কেন্দ্র হিসেবে পেতে চেয়েছেন। তিনি সেগুলোকে এমনভাবে গড়ে তুলতে চেয়েছেন যেন সেগুলো সমাজের স্বাভাবিক ঐক্য এবং বিকাশের কথা মাথায় রাখে। তিনি আরও জোর দিয়েছেন শিল্পপ্রতিষ্ঠান এবং আমলাতন্ত্রের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক কাঠামো গড়ে তোলার ওপর। সেখানে মানুষ সমষ্টিবদ্ধ কাজের অভিজ্ঞতা অর্জন করার সুযোগ পায় এবং গণতন্ত্র সম্পর্কে ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জন করে। Cole জনগণের অংশগ্রহণের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন সামাজিক সংগঠনের ভূমিকাকে কেবল বস্তুগত দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা ঠিক নয়। তাকে সংগঠনের প্রতিটি সদস্যের মানসিক বিকাশের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা প্রয়োজন। ওই বিকাশ বলতে কোল স্বশাসনকে বুঝিয়েছেন। অনেকটা আমাদের দেশে উপজেলা বা স্থানীয় সরকার এমনকি গ্রামীণ সরকারের মতো কিছু। তার অর্থ হচ্ছে, জনগণের পূর্ণ অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটানো উচিত।৫ ব্যালট বাক্সের গণতন্ত্র সত্যিকার অর্থে রাজনৈতিক সমতা নিশ্চিত করে না।৬ একইভাবে রাজপথে আন্দোলন, জ্বালাও-পোড়াও ইত্যাদি জাতীয় অংশগ্রহণ প্রকৃত গণতন্ত্রের জন্য উপযোগী ভাবা যায় না।

তবে সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে, রুশো বা তাঁর অনুসারীদের এই ধারণা বাস্তবায়িত হয়নি। কেবল তা-ই নয়, জনগণের অংশগ্রহণের ধারণাটি পরবর্তী সময়ে নানা ধরনের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে এবং ওই বিবর্তনে তাঁর ভূমিকাকে আজ অনেক বেশি সংকুচিত করে দেখা হচ্ছে। ফলে গণতন্ত্র পরিণত হয়েছে জনগণকে রক্ষা করার একটি ব্যবস্থায়। গণতন্ত্রের দায়িত্ব বলতে আজকাল মানুষের অধিকার রক্ষা করা, তার বাকস্বাধীনতা রক্ষা করা, সংগঠন করার অধিকার রক্ষা করা বোঝায়। একে অনেকে protective model of liberal democracy (Macpherson, 1977, pp. 22-43) হিসেবে উল্লেখ করেছেন, যা কিনা পশ্চিমা বিশ্বে ইতিমধ্যে স্থান করে নিয়েছে। অনেকটা ইচ্ছাকৃতভাবে সেখানে জনগণের ক্ষমতায়নের দিকটিকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। রাষ্ট্র কীভাবে মানুষকে রক্ষা করবে, সেটিই সেখানে প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্রিস্টোফর হাডসনের মন্তব্যটি এ ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ।৭ তিনি দেখিয়েছেন পশ্চিমা গণতন্ত্র মানুষের ক্ষমতায়ন নিয়ে ভাবে না। বরং মানুষের স্বাধীনতাকে রক্ষার প্রতিশ্রুতি দেয় মাত্র। আধুনিক গণতন্ত্রে ভোট দেওয়ার দিকটি প্রাধান্য পাওয়ায় গণতন্ত্রকে জনগণের শাসন না বলে প্রতিনিধিত্বকারী এলিট শ্রেণির শাসন বলাই শ্রেয়। তার অর্থ হচ্ছে, মুক্ত ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। জনগণের ভূমিকা সেখানে ওই ধরনের নির্বাচনে অংশ নেওয়া এবং তাদের মতামত স্বাধীনভাবে ব্যক্ত করা। এই দৃষ্টিভঙ্গিটি সুম্পিটার নামে একজন গবেষকের ধারণার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ (Hudson, C, 2012, p. 444)।

তবে জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠতাভিত্তিক গণতন্ত্রে জনগণের ভূমিকা নিশ্চিত হলেও সেখানে বেশ কয়েকটি ব্যবহারিক সমস্যা রয়ে গেছে। প্রথম সমস্যা হচ্ছে, সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন জনগণের স্বার্থ কতটুকু রক্ষা করবে বা আদৌ করবে কি না তার কোনো গ্যারান্টি নেই। হিটলারের নাজি পার্টি বা ইরানের আয়াতুল্লাহ সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল। জনগণ প্রদত্ত ক্ষমতা ব্যবহার করে হিটলার পৃথিবীকে কোথায় নিয়েছিল সেটি আমরা জানি। সংখ্যাগরিষ্ঠ বলতে জনসংখ্যার ৫১%কে বোঝায়। ওই সংখ্যক ভোটে নির্বাচিত হয়ে জনপ্রতিনিধিরা বাকি ৪৯%কে বঞ্চিত করার অধিকার পেল কি না সেটি একটি উদ্বেগের ব্যাপার। বাংলাদেশে প্রায় সব নির্বাচনে বিজয়ী দল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে এবং সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে ধ্বংস করার লক্ষ্য নিয়ে অত্যাচার, নিপীড়ন, রাজনৈতিক কর্মীর বিরুদ্ধে নির্যাতন এবং ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদের কৌশল বেছে নেয়। তার উদাহরণ একাধিক। এ ধরনের বৈষম্য ও নির্যাতন জাতিগতভাবে বিভক্ত সমাজে অহরহ ঘটছে। ইরাক জাতিগত দিক দিয়ে ভিন্ন। সেখানে শিয়া বা সুন্নি সম্প্রদায় সংখ্যাগত দিক দিয়ে প্রায় সমানে সমান। আরও রয়েছে সংখ্যালঘু অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী। সংখ্যাগরিষ্ঠের গণতন্ত্র শিয়া ধর্মীয় গোষ্ঠীর বিজয় এনে দিলেও জনসংখ্যার ৪৫% হয়েও সুন্নিরা ক্ষমতাকাঠামো এবং রাষ্ট্রপরিচালনার কর্তৃত্ব থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। ওই একই প্রশ্ন কানাডার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সেখানে ইংরেজি ও ফরাসি ভাষাভাষী মানুষের প্রায় সমান উপস্থিতি রয়েছে। ফরাসি ভাষাভাষীরা বিশেষ একটি অঞ্চলে কেন্দ্রীভূত এবং ইংরেজি ভাষাভাষীরা ভিন্ন অঞ্চলে সংখ্যাগরিষ্ঠ। ফলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এসব দেশে বিচ্ছিন্নতাবাদ প্রবল আকার ধারণ করতে পারে, যে কারণে জাতিগতভাবে বিভক্ত সমাজে সংখ্যাগরিষ্ঠের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা উপযোগী কি না সে বিষয়ে সন্দেহ আছে।

প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নটি ঘিরে দ্বিতীয় সংশয় হচ্ছে অল্প ভোটের ব্যবধানে যাঁরা জনগণের প্রতিনিধি হন, আর যাঁরা অল্প ভোটের ব্যবধানে হেরে যান, তাঁদের মধ্যে অবস্থানগত পার্থক্য নগণ্য হতে পারে। জনগণ কেন একজনকে নির্বাচিত করে বা অন্যকে করে না, তার কারণ এই নয় যে যিনি নির্বাচিত হলেন, তিনি সবচেয়ে বুদ্ধিমান, দূরদর্শী বা দক্ষ। নির্বাচনে যোগ্যতার মাপকাঠি জ্ঞান নয়, দক্ষতা নয়, এমনকি প্রার্থীর দূরদর্শিতাও নয়। নির্বাচিত হওয়ার পেছনে আরও বহুবিধ কারণ থাকে। মিথ্যা প্রলোভন, অর্থ, সস্তা প্রতিশ্রুতি, জনবন্ধুর মুখোশ পরে মানুষকে পক্ষে টানা সম্ভব হলেও রাষ্ট্রপরিচালনায় তার প্রভাব পড়ে (ম্যাকিয়াভেলি ওইভাবে শাসন করার উপদেশ দিয়ে গেছেন)। সংখ্যাগরিষ্ঠতা সে কারণে ভয়ংকর হতে পারে যদি নিম্নমানের বুদ্ধিবৃত্তিকতাকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়। বুদ্ধি নয়, সংখ্যা প্রাধান্য পেলে গণতন্ত্র নিম্নমানের হয়। অভিযোগটি একেবারে মিথ্যা ভাবা কঠিন। গ্রিক নগররাষ্ট্রে সক্রেটিসকে হেনস্থা হতে হয়েছিল সংখ্যাগরিষ্ঠেরই হাতে। যদিও তিনি ছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক। এই সমস্যাগুলো পশ্চিমা বিশ্বে সমাজ পরিচালনার মূল তত্ত্ব উদারনীতির (Liberalism) সঙ্গে যুক্ত। গণতন্ত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের সার্বভৌমত্ব রক্ষার (সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন) পাশাপাশি রাষ্ট্রশাসনে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে যেন ওই শাসন সংখ্যালঘিষ্ঠের অধিকারকে খর্ব না করে (Plattner 2010, p. 84)। এটি পশ্চিমা দেশগুলোতে বাস্তবায়ন সম্ভব হলেও বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে বিষয়টি নিঃসন্দেহে গুরুত্ব দিয়ে দেখা প্রয়োজন।

তৃতীয় সমস্যা লক্ষ করা যায় লোকপ্রিয় রাজনীতিতে। গণতন্ত্রে লোকপ্রিয় স্লোগান ব্যবহার করে জনগণের সমর্থন আদায় করা সম্ভব হয়। জনগণ লোকপ্রিয় রাজনীতির প্রতি সহজে আকৃষ্ট হয়। ওই রাজনীতি তাদের ভাগ্যে পরিবর্তন আনার প্রতিশ্রুতি দেয়। জনগণের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার পর ওই লোকপ্রিয় নীতির বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না। এতে করে মানুষের সমর্থন ওই ধরনের নেতৃত্বের প্রতি কমে আসে। এ থেকে সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে। ইতিহাসে এর অনেক উদাহরণ রয়েছে। শেখ মুজিবের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকালে দেওয়া নানা প্রতিশ্রুতি স্বাধীনতার পর পূরণ করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীকালে বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয় তার সঙ্গে ওই অপূর্ণ থাকা প্রতিশ্রুতির যোগ সম্পর্ককে বাতিল করা কঠিন। লোকপ্রিয় রাজনীতি তার উদ্দেশ্য সফল করার জন্য যেকোনো আদর্শ ব্যবহার করে থাকে। ইউরোপে ওই রাজনীতির কুফল আমরা ইতিমধ্যে লক্ষ করেছি। ফ্রান্সে লে পেন সংখ্যালঘিষ্ঠ মুসলিমবিরোধী স্লোগান ব্যবহার করে প্রচুর ভোট পেয়ে থাকে। অস্ট্রিয়ায় জরগ হেয়ডার অথবা ভেনেজুয়েলায় হুগো চাভেজের লোকপ্রিয় রাজনীতিও এখানে উল্লেখযোগ্য। ভারতের বিজেপি পার্টি ধর্মীয় বিভেদ এবং হিন্দু রাষ্ট্রের দাবি তুলে ধর্মকে ব্যবহার করে। লোকপ্রিয় রাজনীতি চর্চা বাংলাদেশেও লক্ষ করা যায়। ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার করে হেফাজতে ইসলাম বা আরও অনেক ধর্মীয় রাজনৈতিক দল জনগণকে আকৃষ্ট করতে চেষ্টা করে। জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে তারাই আবার অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা ভাবে।৮ ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন যে ধরনের গণতন্ত্র এনে দেয় সেই শাসন দিয়ে জনগণের মঙ্গল কতটুকু হবে তার কোনো নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না।

চতুর্থত জনগণের সচেতনতা এবং অংশগ্রহণের আরও একটি দিক আছে যেটির গুরুত্ব উপেক্ষা করা কঠিন। ঝযধফর ঐধসরফ নামে একজন গবেষক মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশে জরিপ চালিয়ে জনগণের সচেতনতার মাত্রাগত দিকের একটি চিত্র তুলে ধরেছেন, যেটি আমাদের জন্য প্রণিধানযোগ্য। সেই জরিপে দেখা যায়, মধ্যপ্রাচ্যে জনগণের অধিকাংশ সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার একমাত্র পথ হিসেবে ইসলামি আইন প্রবর্তনকে বিবেচনা করে। সে কারণে তারা ইসলামি আইন চায় এবং ঐশী শাস্তির প্রবর্তন চায়। ওই শাস্তির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে চুরির অপরাধে হাত কাটা, adultery’র জন্য পাথর ছুড়ে হত্যা এবং ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করার অপরাধে মৃত্যুদণ্ডের বিধান (Masoud, 2014, p.171)। সংখ্যাগরিষ্ঠের এই মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে শাসন করার অর্থ দাঁড়াতে পারে মধ্যযুগীয় নিয়মমাফিক নানা দেশে অগণতান্ত্রিক নিষ্ঠুর সমাজ গড়ে তোলা।

তাহলে এ ক্ষেত্রে একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন মনে করা উচিত। প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র যদি অবাস্তব হয়, সংখ্যাগরিষ্ঠের গণতন্ত্র যদি বুদ্ধিবৃত্তিকতাকে অবদমন করে তাহলে গণতন্ত্রে জনগণের ভূমিকা কী হবে সেটি ভাববার বিষয় বৈকি। একটি ধারা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে গণমানুষের অংশগ্রহণকে সীমিত রাখার পক্ষে মত দেয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে রাজনীতি থেকে দূরে রেখে বড় ধরনের মতবিরোধ থেকে পুরো শাসনব্যবস্থাকে মুক্ত রাখা সম্ভব বলে তাঁরা মত প্রকাশ করেন। সেটি পুরোপুরি অসত্য নয়। রাজনীতির ওপর বিশেষজ্ঞ যাঁরা তাঁরা লক্ষ করেছেন গণ-আন্দোলন দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ কখনো সহজ হয়নি। অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, স্বৈরশাসন থেকে মুক্ত হলেও কিছুকাল পর ওই স্বৈরাচারী শাসন ভিন্ন আঙ্গিকে ফিরে এসেছে। জার্মানিতে ভাইমার রিপাবলিক (১৯১৯-১৯৩৩) তার উদাহরণ। সেখানে গণতন্ত্র ব্যর্থ হয়েছিল নির্বাচনী পদ্ধতির কারণে। বেশি গণতন্ত্রী হতে গিয়ে নির্বাচনী পদ্ধতিতে আনুপাতিক হারে সদস্য নির্বাচনের ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল। ভোটের সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে সেখানে পার্টির আসন বরাদ্দের প্রথা চালু হয়। এর ফলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পার্টি পার্লামেন্টে বেশ বড় সংখ্যায় আসন লাভের সুযোগ পায়। তারা জাতীয় ইস্যুর বদলে আঞ্চলিক সমস্যার ওপর গুরুত্ব দেওয়ায় পার্লামেন্টে তাদের আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকে স্থানীয় সমস্যাগুলোর মধ্যে। কোনো রাজনৈতিক দল ওই নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ না করায় সংখ্যালঘিষ্ঠের সরকার গঠন করা হয়। একপর্যায়ে ওই পার্লামেন্ট অকার্যকর হয়ে পড়ে। সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে সরকার গঠিত হলেও পার্লামেন্টে আইন প্রণয়নে বা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মতৈক্যে পৌঁছানো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এর ফলে রাষ্ট্র দুর্বল হয়ে পড়ে। একপর্যায়ে ওই গণতন্ত্রের ব্যর্থতা দেখিয়ে জার্মানিতে কীভাবে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সে ইতিহাস আমাদের জানা আছে।

জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের অর্থ গণতন্ত্র নয়। যুক্তিটি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ভাবা সম্ভব। বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে মানুষের অভূতপূর্ব অংশগ্রহণ আমরা লক্ষ করেছি। কিন্তু স্বাধীনতা এলেও ওই আন্দোলন গণতন্ত্রকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেনি। নব্বই দশকের দিকে এরশাদবিরোধী আন্দোলন গণতন্ত্রের পথকে কিছুটা উন্মুক্ত করেছিল। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও গণতন্ত্র শেকড় গাড়তে ব্যর্থ হয়েছে। ইদানীংকালে শাহবাগ চত্বরে বিপুল মানুষের সমাগম লক্ষ করা গেলেও গণতন্ত্র তারপরও শক্তিশালী হয়নি। ১৯৩৩ সালে জার্মানিতে যেভাবে ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটেছিল ধর্মীয় স্লোগানের ভিত্তিতে গণতন্ত্রের যা কিছু অর্জন, তাকে ওই গণ-আন্দোলনের স্রোতোধারায় বানচাল করার ষড়যন্ত্র লক্ষ করা গিয়েছিল। হেফাজতে ইসলাম নামে একটি ধর্মভিত্তিক আন্দোলনের নেতৃত্বে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের বাস্তব সম্ভাবনা সে সময় সৃষ্টি হয়েছিল। কেবল সরকারের শক্ত অবস্থানের কারণে এবং ঢাকাবাসীর সমর্থনের অভাবে ওই ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়। মধ্যপ্রাচ্যের নানা দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠের অংশগ্রহণ বা সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ওপর ভিত্তি করে সরকার গঠনের ফলাফল কী হয়েছে সেটি আমরা ইতিমধ্যে আলোচনা করেছি মিসর, তিউনিসিয়ার উদাহরণ দেখিয়ে।

গণ-আন্দোলন কেন ব্যর্থ হয় তার কিছু কারণ এখানে উল্লেখ করতে আপত্তি নেই। অন্যতম একটি হচ্ছে, সব গণ-আন্দোলনে যতটুকু বিজয় অর্জিত হয় তার সবটুকুই রাজনৈতিক এলিট শ্রেণি ভোগ করে। সাধারণ মানুষের ভাগ্যে তেমন কিছু জোটে না। একপর্যায়ে গণ-আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যায়। জোয়ার শেষ হওয়ার পর ভাটার টানে সমুদ্র যেমন ফিরে যায়, জনগণও তেমনি ঘরে ফেরে। আন্দোলনের ফলাফল থেকে যায় এলিট শ্রেণির হাতে। ওই বিজয়কে তারা কীভাবে ব্যবহার করবে, গণতন্ত্রের কতটুকু বাস্তবায়িত হবে সেটি নির্ভর করে তাদের মর্জির ওপর। রবার্ট ডালের একটি পর্যবেক্ষণ এখানে প্রণিধানযোগ্য মনে হয়। নানা গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি দেখিয়েছেন নিম্ন শ্রেণি থেকে আসা গ্রুপ বা উপগ্রুপ রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে কম সক্রিয় হয় এবং কর্তৃত্ববাদী মনোভাব তাদের মধ্যে প্রবলভাবে থাকে (Pateman, C, 1970, p. 10)। জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণকে সে কারণে তেমন গুরুত্ব দিয়ে ভাবা সঠিক নয় বলে তাঁর দাবি।

গণতন্ত্রের ডানপন্থী সমালোচকেরা এর বিকল্প হিসেবে নাগরিক সমাজের গুণগত মানের ওপর জোর দিয়ে থাকেন। তার কারণ হচ্ছে, জনগণ তাদের ধারণায় সাধারণভাবে সমাজ ও রাজনীতি সম্পর্কে অজ্ঞ এবং বুদ্ধিহীন। ২০০৩ সালে প্রকাশিত Richard Posner-এর Law, Pragmatism and Democracy (Cambridge: Harvard University Press, 2003, p. 16) গ্রন্থে এই ধরনের উক্তি লক্ষ করা যায়। সেখানে আরও মন্তব্য করা হয়েছে যে সাধারণ মানুষ সহজে ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারে, কারণ তারা তথ্যকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে অক্ষম। Bryan Caplan (২০০৭) নামে আরও একজন গবেষক The Myth of Rational Voter: Why Democracies Choose Bad Policies গ্রন্থে জনগণের প্রজ্ঞাহীনতার অভিযোগ নিয়ে এসেছেন। জনগণের দুর্বল বিচার-বুদ্ধি গণতন্ত্র বাস্তবায়নের পথে প্রধান বাধা হিসেবে ওই সব তাত্ত্বিকের রচনায় লক্ষ করা যায়। সে কারণে জনগণের শাসন কতটুকু সম্ভব বা কার্যকরী সে নিয়ে সব সময় সংশয় রয়েছে। রাষ্ট্রক্ষমতার ওপর এলিট শ্রেণির একচেটিয়া দখল থেকে মুক্তি পাওয়া তাদের ধারণায় কঠিন এবং ওই বাস্তবতা মেনে নেওয়াই সমীচীন।

তবে নাগরিক সচেতনতা নিয়ে এই ধরনের মন্তব্যের পরও জনগণের বর্ধিত ভূমিকাকে এত সহজে নাকচ করে দেওয়া উচিত নয়। কারণ এ কথা তো সত্য যে রাজনৈতিক তথ্য সম্পর্কে নাগরিক সমাজ কতটুকু ওয়াকিবহাল হলে তাকে সচেতন ধরা হবে তার কোনো সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়া কঠিন। অতিমাত্রায় সচেতন ব্যক্তিদের মধ্যেও প্রতিটি ইস্যু নিয়ে মতবিরোধ থাকে। তারাও অভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। কারণ প্রত্যেকের মতামত ভিন্ন হওয়া স্বাভাবিক। সে কারণে যত সচেতন বা জ্ঞানীই হোক না কেন, একই তথ্য বিশ্লেষণ করতে গিয়ে মানুষ ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান নিতে পারে। যেকোনো সমস্যা বিচারে সে কারণে মতের অমিলকে নাকচ করা যায় না। সেটি বুদ্ধি বা বুদ্ধিহীনতার ওপর নির্ভর করে না। আর সে কারণে জনগণের প্রজ্ঞাহীনতার দোহাই দিয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তাদের ভূমিকাকে অবমূল্যায়ন করা যথাযথ ভাবা যায় না।

তবে এ কথাও মানতে হচ্ছে যে বাংলাদেশের মতো অনুন্নত সমাজে জনগণকে দুঃখজনকভাবে এক অদ্ভুত সমষ্টি হিসেবে ভাবতে হয়। এখানকার ক্ষুদ্র সংখ্যক জনগণ বুদ্ধিহীন বা রাজনীতি সম্পর্কে অজ্ঞ সে দাবি করা কঠিন হলেও যে ৮০ শতাংশ মানুষ গ্রামে বাস করেন তাঁরা অধিকাংশই কৃষক, না হয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, উকিল, মোক্তার, স্কুল-কলেজের শিক্ষক। এঁদের অধিকাংশ ভালোভাবে শিক্ষিত নন। রাষ্ট্রপরিচালনার নীতির মতো জটিল বিষয় নিয়ে তাঁরা ভাবেন না। ভাবার সময় তাঁদের নেই বা সামর্থ্য নেই। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত তাঁরা মাঠে সময় কাটায় না। সন্ধ্যায় পাড়ায় চায়ের দোকানে জটলা করেন। টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রেখে দেশকে ভাবেন। পর্দায় নানা খবর, মুখ বা ঘটনা ভেসে ওঠে। সেগুলোর ওপর চোখ বুলিয়ে কিছু বিক্ষিপ্ত বিচ্ছিন্ন আলাপে জড়িত হয়ে তাঁরা ঘরে ফেরেন। এই নিয়ে গড়ে ওঠে অধিকাংশ মানুষের সচেতনতার পরিধি। মেয়াদান্তে নির্বাচন আসে। তার সঙ্গে কিছু ক্ষণিক উত্তেজনা থাকে। নির্বাচন কেন্দ্রে কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে ভোট দেওয়ার সুযোগ আসে। কপাল মন্দ হলে সেটুকুও ভাগ্যে জোটে না। কেউ সে কাজটি ইতিমধ্যে হয়তোবা সম্পন্ন করে দিয়ে গেছে। সেই সঙ্গে রয়েছে অর্থের বিনিময়ে ভোট কেনার সংস্কৃতি। এঁদের কোনো সংগঠন নেই। থাকলেও সেসব সংগঠন ব্যক্তি আধিপত্য দিয়ে পরিচালিত হয়। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের ভূমিকা সেখানে নিতান্ত নগণ্য বলে ধরে নিতে হয়।

এই হচ্ছে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের প্রধান একটি অংশের সচেতনতার গভীরতা ও পরিধি। এই জনগোষ্ঠীকে সার্বভৌম ক্ষমতার উত্স হিসেবে ধরে নেওয়া হয় এবং তাকে ঘিরে গড়ে ওঠে গণতন্ত্রের বাকি অংশ, নেতা এবং রাজনৈতিক দল। তাঁরা এই জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি হয়ে দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতিনিধি হন এবং দেশ শাসন করেন। মেয়াদান্তে নির্বাচন আসে, নতুন সরকার গঠিত হয়। আর তাকেই গণতন্ত্র হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। সে কারণে যতই দিন যাচ্ছে ততই ওই জাতীয় নির্বাচন-প্রক্রিয়ার প্রতি মানুষের উত্সাহ কমছে। মানুষ তুমুলভাবে আন্দোলিত হচ্ছে না। রাজনীতিবিদদের নিয়ে মানুষের উত্সাহে ভাটা পড়ছে, তাদের কর্মকাণ্ডে মানুষ বীতশ্রদ্ধ হচ্ছে। তাদের দেখা হচ্ছে গণশত্রু হিসেবে। ফলে জনগণের ভূমিকার দিক থেকে ভাবলে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ঘাটতি রয়েছে। বলা যেতে পারে জনগণের সার্বভৌমত্ব এখানে দুর্বল কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে।

রাজনৈতিক এলিট শ্রেণির ভূমিকা

জনগণের অংশগ্রহণ বা সংখ্যাগরিষ্ঠের রায়সংক্রান্ত এই বিতর্ক দীর্ঘকালের। সংখ্যাগরিষ্ঠের গণতন্ত্রকে বাদ দিয়ে অতীতে নানা ধরনের বিকল্প ভাবনার জন্ম হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। তার একটি ধারা ইতালিয়ান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী গায়েটানো মস্কা (তাঁর রচনা The Rulling Class) এবং জার্মান সমাজতাত্ত্বিক রবার্ট মিচেলসের (তাঁর রচনা Political Parties) মতো তাত্ত্বিকদের রচনায় লক্ষ করা যায়। তাঁরা উভয়ে মিলে একধরনের এলিট তত্ত্বের পক্ষে ওকালতি করে গেছেন। সেখানে জনগণের ভূমিকাকে দেখা হয়েছে খুবই নগণ্য হিসেবে। তাঁরা কেন এলিট তত্ত্বের পক্ষে ওকালতি করেছিলেন তার পেছনে বিশেষ দুটি ঘটনা প্রভাব রেখেছিল। ওই দুই ঘটনার মধ্যে তাঁরা একটি ঐতিহাসিক প্রবণতাও লক্ষ করেছিলেন। জনগণের সক্রিয় ভূমিকার কারণে যেসব সামাজিক পরিবর্তন এতকাল ধরে ঘটেছে সে পরিবর্তনগুলো স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা সৃষ্টি করে, এই ছিল তাদের সিদ্ধান্ত। এ ক্ষেত্রে দুটি ঐতিহাসিক ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। প্রথম ঘটনা ঘটে রাশিয়াতে। ১৯১৭ সালের নভেম্বর মাসে জনগণের প্রত্যক্ষ এবং সশস্ত্র অংশগ্রহণে লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক পার্টি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে জারের রাজতন্ত্রকে উত্খাত করে এবং সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। ওই রাষ্ট্রের চরিত্র ছিল Totalitarian এবং তার উদ্ভবের পেছনে জনগণের সমর্থন প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল। দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটে ১৯৩৩ সালের দিকে। ওই বছর জার্মানিতে হিটলারের নেতৃত্বে জার্মান সোশ্যালিস্ট পার্টিও জনগণের প্রত্যক্ষ সমর্থন নিয়ে ওই একই ধরনের একনায়কতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠিত করে। জার্মান জাতীয়তাবাদী অনুভূতিকে ব্যবহার করে হিটলার জনগণের বিপুল সমর্থন আদায় করতে সক্ষম হয়। যে শাসনপদ্ধতি হিটলার প্রবর্তন করেছিল তাকে স্বৈরশাসন বা একনায়কতান্ত্রিক শাসন হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়। তার অর্থ হচ্ছে জনগণের সক্রিয় ভূমিকার মধ্যে লোকপ্রিয় গণতান্ত্রিক মনস্তত্ত্ব থাকলেও সেই ভূমিকা স্বৈরশাসনের জন্ম দিতে পারে। এসব দৃষ্টান্তের কারণে জনগণের ভূমিকাকে অশুভ ধরে নেওয়া হয়। সে কারণে তাকে উপেক্ষা করে এলিট শাসনের পক্ষে এক বিশেষ ধারার জন্ম হয়েছিল, যেখানে এলিট শ্রেণির ওপর আস্থা রেখে রাষ্ট্রশাসনে তার শক্তিশালী এবং বর্ধিত ভূমিকার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। তারই ফলে গড়ে উঠেছে নানা জাতীয় এলিট তত্ত্ব, যার মধ্যে ইতিমধ্যে উল্লেখিত মস্কা এবং মিচেলের Iron law of oligarchy অন্যতম। ধ্রুপদি গণতান্ত্রিক তত্ত্ব এরপর থেকে প্রায় প্রতি ক্ষেত্রে জনগণের ভূমিকাকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিরোধিতা করে এসেছে। গণতন্ত্রসংক্রান্ত সুম্পিটারের তত্ত্ব তার একটি বড় উদাহরণ।

প্রখ্যাত রাজনীতি বিজ্ঞানের তাত্ত্বিক জোসেফ সুম্পিটার জনগণের ভূমিকাকে তেমন গুরুত্ব দিয়ে দেখেননি। তিনি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ওই ভূমিকার পরিবর্তে এলিট শ্রেণির ভূমিকাকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভেবেছেন। তাঁর তত্ত্বকে সাধারণত এলিট সমঝোতার তত্ত্ব হিসেবে পরিচিতি দেওয়া হয়। ওই তত্ত্বে জনগণের সীমিত অংশগ্রহণের কথা বলা হয়েছে, জোর দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন এলিট গোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষমতার ভাগ-বাঁটোয়ারার ওপর, সমঝোতার ওপর, কীভাবে অভ্যন্তরীণ সংঘাত এড়িয়ে এলিট শ্রেণির নানা গ্রুপ বা অংশ সম্মতিতে পৌঁছাতে পারে। সুম্পিটারের ধারণায় গণতন্ত্র রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের একটি মাধ্যম মাত্র এবং নিতান্তই ক্ষমতাকেন্দ্রিক। তিনি গণতন্ত্রকে প্রতিযোগিতা হিসেবে দেখেছেন। কিন্তু সেই প্রতিযোগিতাকে কেবল এলিট শ্রেণির অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতার মধ্যে সীমিত রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। যাঁরা নির্বাচনে এলিট শ্রেণির পক্ষ থেকে পদপ্রার্থী হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন তাঁরা প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনে অংশ নিয়ে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করবেন (Diamond, L, 1999, p 8) এবং জনগণের ভূমিকা সে ক্ষেত্রে হবে ভোটে অংশ নেওয়া এবং যোগ্য ব্যক্তিকে নির্বাচিত করা।৯

সুম্পিটার গণতন্ত্রকে আদর্শ হিসেবে দেখার প্রবল বিরোধিতা করেছেন। তার বদলে তাকে মানসম্পন্ন প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা হিসেবে দেখার কথা বলেছেন। সেই ব্যবস্থার একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি প্রশাসনিক কাঠামো দাঁড় করানো এবং তার অধীনে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক, আইনগত ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্তগুলো গ্রহণ করা। এই অবস্থানকে যাঁরা ইতিবাচক মনে করেছেন এবং তার প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রবার্ট ডাল। গণতন্ত্রকে সুম্পিটারের মতো করে তিনিও একটি রাজনৈতিক পদ্ধতি, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সাজানো একটি ব্যবস্থা হিসেবে দেখার পরামর্শ দিয়েছেন, যার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে নির্বাচনী প্রক্রিয়া। ওই প্রক্রিয়ায় খুব স্বল্পসংখ্যক নেতার প্রাধান্য বা অংশগ্রহণ থাকা প্রয়োজন। তারাই রাষ্ট্রপরিচালনায় মূল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে এবং গণতন্ত্রকে নেতা নির্বাচনের একটি প্রক্রিয়া হিসেবে দেখবে। গণতন্ত্রের দায়িত্ব সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা নয়। জনগণের দায়িত্ব ভোট দেওয়া এবং সবচেয়ে ভালো পণ্যটি কেনা, ঠিক যেটি আমরা বাজারে হতে দেখি। পণ্য বলতে এ ক্ষেত্রে বোঝানো হচ্ছে রাজনৈতিক নেতা বা ব্যক্তি। গণতন্ত্রে প্রার্থী বেচাকেনা হয়। জনগণ ক্রেতার ভূমিকা পালন করে। ভোটের মাধ্যমে তারা তাদের প্রতিনিধি কিনে দেশের শাসনভার তাঁদের হাতে তুলে দেয়। এই তাত্ত্বিক কাঠামোকে ক্ল্যাসিক্যাল ডকট্রিন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। অনেকে এর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন (Pateman, C, 1970, p.2)। ডাল১০ একে পলিয়ারখি হিসেবে দেখার উপদেশ দিয়েছেন।

গণতন্ত্রের এই বিশ্লেষণ নিতান্তই গণতন্ত্রের প্রক্রিয়াগত দিকের ওপর জোর দেয়। ডাল তাঁর Elective Polyarchy রচনায় সমাজে বিদ্যমান আর্থসামাজিক বৈষম্যকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করার উপদেশ দিয়েছেন। সমাজকে অবিভাজিত জনসমষ্টি হিসেবে ধরে নিয়ে গ্রুপ, গোত্র বা সামাজিক বিভেদকে তাঁর মতে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা শ্রেয়। কারণ জনগণ অভিন্ন কোনো স্বার্থ দিয়ে বাঁধা সমষ্টি নয়। বর্ণবিভক্তি, নারীর অবহেলিত সামাজিক অবস্থান গণতন্ত্রে বিবেচ্য নয়। ধর্মীয় বিভক্তির রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিফলের কথাও ভাবার প্রয়োজন নেই। সামাজিক বিভেদ, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে সমাজের অভ্যন্তরে যেসব পরিবর্তন ঘটে সেগুলোর প্রতি মনোযোগ দেওয়া তিনি প্রয়োজন মনে করেননি। প্রথাভিত্তিক সামাজিক উপাদানগুলো যেমন: ধর্ম, জাতি, বর্ণপ্রথা, ধর্মীয় বিভেদ, এমনকি ধর্মের অভ্যন্তরীণ বিভেদ বা জটিলতাকে গণতন্ত্রের আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজনীয়তাকেও তিনি বাতিল করে দিয়েছেন। সেগুলো বাস্তব জীবনে উপস্থিত থাকলেও তাকে বাদ দিয়ে গণতন্ত্রকে ভাবতে হবে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সফল হওয়ার পর যা কিছু প্রথাগত, সামন্ততান্ত্রিক, অনাধুনিক সেগুলো দূর করা সম্ভব হবে বলে তাঁর বিশ্বাস। সে কারণে প্রথাভিত্তিক সামাজিক ফ্যাক্টরগুলো গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাপর্বে মূল্যহীন ভাবাই শ্রেয়।

এই তত্ত্ব আরও জোর দিয়েছে সমাজের এলিট প্রতিষ্ঠানের ওপর। আর সে কারণে ওই দুই গবেষকের তত্ত্বে এলিট শ্রেণির ওপর গণতন্ত্রের সব দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। এলিট প্রতিষ্ঠান বলতে তিনি আমলাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে বুঝিয়েছেন যার মধ্যে ব্যাংক, বিমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, ট্রেড ইউনিয়ন রাষ্ট্রধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত। এগুলো সমাজের স্থায়ী এবং কাঠামোর দিক থেকে দীর্ঘদিন ধরে গড়ে ওঠা মূল প্রতিষ্ঠান। সে কারণে ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন এবং গণতন্ত্রের পক্ষশক্তি হিসেবে দেখা প্রয়োজন। তারাই গণতন্ত্রের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। সে কারণে গণতন্ত্রের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে ওই সব প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে সংস্কার কীভাবে হচ্ছে তার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া। এরই বিপরীতে যেসব প্রতিষ্ঠান সমাজে স্বীকৃতির অপেক্ষায় আছে, যেগুলো সমাজের অভ্যন্তরে নতুন নতুন পরিবর্তনের কারণে কেবল গড়ে উঠতে শুরু করেছে, সেগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবার প্রয়োজন নেই বলে তিনি মনে করেন। একইভাবে রাজনৈতিক নেতৃত্ব, নেতার গুণ, বুদ্ধিমত্তা, সামাজিক অবস্থান, অতীত জীবন ইত্যাদি ওই তত্ত্বে জনগণের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান মনে করেছিলেন। দলীয় নীতি বা দর্শনকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবা হয় না। রবার্ট ডালের মতো মস্কা এবং মিচেলও ওই একই অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন এবং জনগণের ভূমিকাকে প্রাধান্য দেওয়ার রীতিকে আক্রমণ করেছিলেন। তাঁদের মতে, যেকোনো জটিল সমাজে হয় এলিট শ্রেণি নতুবা সাধারণ মানুষ শাসন (গণতন্ত্র) করবে। এরা উভয়ে একসঙ্গে কাজ করতে পারে না (Pateman, C 1970, p.2)। জনমানুষের অংশগ্রহণ সামাজিক ব্যবস্থাকে অস্থিতিশীল করে। সে কারণে কেবল এলিট শ্রেণিকে শাসনের ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেওয়া শ্রেয়। বোধগম্য যে জনগণের ভূমিকাসংক্রান্ত যেসব ধ্রুপদি ধারণার সঙ্গে আমরা ইতিমধ্যে পরিচিত হয়েছি, তাদের প্রতি এই তাত্ত্বিকদের ছিল গভীর সন্দেহ।

তবে জনগণের ভূমিকাকে যতই অস্বীকার করা হোক না কেন, এই তত্ত্বের মূল দুর্বলতার একটি দিক খুবই স্পষ্ট। সেটি হচ্ছে, গণতন্ত্রকে নিছক প্রক্রিয়া হিসেবে দেখা এবং গণতন্ত্রকে সীমিত অর্থে বোঝা। প্রক্রিয়াগত দিক বলতে সঠিক সময়ে নির্বাচন হচ্ছে কি না, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত আছে কি না, মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের স্বীকৃতি আছে কি না, রাজনীতিতে আপামর জনসাধারণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হচ্ছে কি না ইত্যাদিকে বোঝায়। ফলে গণতন্ত্রকে কীভাবে মজবুত করা যাবে তার কোনো স্ট্র্যাটেজি ওই তত্ত্বে তুলে ধরা হয়নি। সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও আদর্শিক ক্ষেত্রে জটিলতাগুলোর প্রতি মনোযোগ না দেওয়ায় আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে সত্যিকার পরিবর্তন যা কি না গণতন্ত্রের ভিতকে শক্ত করতে সাহায্য করে, সে সম্পর্কে এ তত্ত্ব সম্পূর্ণ উদাসীন। গণতন্ত্রকে অবশ্যই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পর্যায়কে গুরুত্ব দিতে হবে। রাজনৈতিক ইতিহাস, প্রাতিষ্ঠানিক আকার, জাতিগত রূপ, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের দিকগুলোকে গণতন্ত্রের সংগ্রাম থেকে বাদ দিলে শাসনব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্র কীভাবে ব্যর্থ হয় সেটি আমরা ইতিমধ্যে ‘আরব বসন্ত’ বিপ্লবের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি।

এই অবস্থানটি অবশ্য কোনো আকস্মিক প্রবণতা নয়। পশ্চিমা বিশ্বে গণতন্ত্রকে এলিট গোষ্ঠীর দায়দায়িত্ব হিসেবে দেখার দীর্ঘ ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। লারি ডায়মন্ড এলিটকেন্দ্রিক এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রবক্তা হিসেবে উত্তরণকালীন গণতন্ত্রেও এলিট শ্রেণির ওপর ওই বিশেষ দায়িত্ব দিতে আগ্রহী। এলিট শ্রেণি যদি নিজেদের মধ্যে রাজনৈতিক বিবাদের সীমানা এবং পরিধিকে সংকুচিত করার ফ্রেমওয়ার্ক দাঁড় করাতে পারে তাহলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তারা যথেষ্ট ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে বলে তার ধারণা। এলিট শ্রেণিভিত্তিক গণতন্ত্রকে চালু রাখতে গেলে সমাজে ক্ষমতার নানা কেন্দ্রের মধ্যে সমঝোতা সৃষ্টির সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হয়। সমাজে ক্ষমতার নতুন নতুন কেন্দ্র গড়ে ওঠে নানা সময়ে নানা কারণে। যাঁরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকেন, তাঁরা প্রতিনিয়ত উদীয়মান রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তির মুখোমুখি হন এবং দ্বন্দ্বে লিপ্ত হন। সেই দ্বন্দ্বের মীমাংসা যদি শান্তিপূর্ণভাবে সম্ভব হয়, তাহলে বিবাদরত ক্ষমতার কেন্দ্রগুলো নিজেদের মধ্যে সমঝোতায় পৌঁছাতে পারে এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় দেশ শাসনে সম্মত হয়। এভাবে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করে গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতা টিকিয়ে রাখা সম্ভব বলে তার ধারণা।

আমাদের দেশীয় এলিট শ্রেণির প্রধান দুর্বল দিকটি গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় প্যারাডক্সের সঙ্গে যুক্ত। প্যারাডক্সটি হচ্ছে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার সঙ্গে সমঝোতার। গণতন্ত্রে প্রতিযোগিতা এবং সমঝোতা একই সূত্রে গাঁথা। কেবল প্রতিযোগিতা বা কেবল সমঝোতা দিয়ে গণতন্ত্র হয় না। প্রয়োজন হয় এই দুইয়ের বুদ্ধিবৃত্তিক মিশ্রণ। কখনো সমঝোতা কখনো প্রতিযোগিতা—এই মিশ্রণ আমাদের এলিট শ্রেণির রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিণত করতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা রাজনীতিকে এখনো পুরোনো ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যে রেখে বুঝতে চায়। সে কারণে প্যারাডক্সটি আমাদের দেশে গণতন্ত্রের জন্য হয়ে দাঁড়িয়েছে মরণফাঁদ।

গণতন্ত্রকে এমন একটি ব্যবস্থা হিসেবে আমরা জানি যেখানে ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে নানান রাজনৈতিক দল প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়। সেখানে দলীয় কর্মীরা প্রচারণা চালায়। দলের সুনির্দিষ্ট ম্যানিফেস্টো থাকে। প্রতিযোগিতা সাধারণত প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেয়। তার অর্থ হচ্ছে, প্রতিযোগিতা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ঘটে। সেই প্রতিযোগিতার নীতিমালা থাকে। সভ্য গণতান্ত্রিক দেশে ওই প্রতিযোগিতার কাঠামো থাকে। নির্বাচনী প্রতিযোগিতার ফল হিসেবে জনগণ প্রতিনিধি নির্বাচন করে। সেখান থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা স্থানান্তরিত হয় সংসদে, যেখানে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা দেশের উন্নয়নের কথা মাথায় রেখে নীতি বা আইনের ওপর বিতর্কে অবতীর্ণ হন। কিন্তু এই প্রতিযোগিতা অনেক সময় অতিমাত্রায় তীব্র রূপ ধারণ করে। সেই তীব্রতা নানা ইস্যুকে কেন্দ্র করে ঘটতে পারে। সংসদ অধিবেশনে গণপ্রতিনিধিরা উত্তেজিত হয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক অবস্থান গ্রহণ করতে পারেন। প্রতিযোগিতার তীব্রতা সীমারেখা অতিক্রম করলে পুরো গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ভেঙে পড়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। ফলে গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে হলে একদিকে যেমন প্রতিযোগিতার আবশ্যকতা থাকে, তেমনি থাকে সমঝোতার। প্রতিযোগিতা ও সমঝোতার মধ্যে সূক্ষ্ম ভারসাম্য গড়ে তোলা না গেলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় না। এই দুইয়ের সম্পর্ককে আগেই প্যারাডক্স হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ প্রতিযোগিতা এক দিক থেকে সমঝোতার বিপরীত। সমঝোতাও প্রতিযোগিতার বিপরীত। অথচ এই দুইয়ের সমন্বয় বা উপস্থিতি ব্যতীত গণতন্ত্রকে ভাবা কঠিন।

বাংলাদেশের বুর্জোয়া শ্রেণির প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক নেতৃত্ব অত্যন্ত অপরিপক্ব। এখানে রাজনৈতিক এলিট শ্রেণি গণতন্ত্রের কৌশলী দিক সম্পর্কে সচেতন নয়। মতৈক্য ও সমঝোতা দিয়ে বিরোধ এবং দ্বন্দ্বের নিষ্পত্তি গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত হলেও এ দেশের এলিট শ্রেণি এখনো সেই কৌশল আয়ত্ত করতে সক্ষম হয়নি। নানা ধরনের সমঝোতা, এক পা পিছিয়ে আসা, বিরোধী শক্তির সঙ্গে বিশেষ ক্ষেত্রে কৌশলগত আপসের রাজনৈতিক মূল্য থাকলেও সামন্তবাদী একগুঁয়েমির কারণে ওই কৌশল রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়নি। দেশের এলিট শ্রেণি সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলেনি। কোন ধরনের ব্যবহার সঠিক, কোনটি সঠিক না, তারা তাদের ব্যক্তি জীবনের উদাহরণ দিয়ে দেখাতে পারে। তাদের নেতিবাচক ব্যবহার এখানে বরং অন্যদের নেতিবাচক ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করেছে। এ থেকে রাজনৈতিক এলিটদের সঙ্গে বাকি এলিটদের পার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে, যেটি দেশীয় গণতন্ত্রের জন্য শুভ নয়। বিরোধী রাজনৈতিক বিশ্বাস এবং অবস্থানকে যে এলিট গোষ্ঠী গ্রহণ করতে পারে না তার পক্ষে প্রয়োগবাদী এবং নমনীয় হওয়াও কঠিন। তাদের চিন্তা থাকে স্থির, আদর্শ পরিচালিত। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিশ্বাস বা সমঝোতা গড়ে ওঠে না। সে কারণে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনায় ভদ্রতা ও অন্যের মতামত এবং দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি সম্মান প্রদর্শনের ঐতিহ্য এখানে গড়ে ওঠেনি।

এলিট শ্রেণির সেই অপরিপক্বতা দূর করা যেত যদি শাসকশ্রেণি দুই ইতালীয় চিন্তাবিদ ম্যাকিয়াভেলি বা প্যারেটোর এলিট তত্ত্বের সঙ্গে কিছুটা অন্তত পরিচিত হতেন। তারা উভয়ে এলিট শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন দুটি অর্থে। একটি ব্যাপক অর্থে, যেখানে সমাজের সব এলিটকে বোঝায়। ব্যাপক অর্থে এলিট বলতে প্যারেটো দেখেছেন ক্ষুদ্র এক গ্রুপকে, যারা কাজের ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করেছে এবং পেশার স্তরবিন্যাসে সবচেয়ে উঁচু স্থানে অবস্থান করছে। ব্যবসায়ী, আর্টিস্ট, সফল রাজনীতিবিদ, প্রফেসরের মতো পেশাজীবী মানুষ ব্যাপক অর্থে এলিট। তবে এই এলিটদের গুরুত্ব কম। সংকীর্ণ অর্থে এলিট বলতে সরকারি বা রাজনৈতিক এলিটকে বোঝায়। সংকীর্ণ অর্থে ব্যবহূত এলিট সংখ্যায় নগণ্য হতে পারে কিন্তু রাষ্ট্রপরিচালনায় এবং সামাজিক নিয়ন্ত্রণে তারাই মুখ্য ভূমিকা পালন করে। ফলে সমাজের ধরন নির্ভর করে এই ক্ষুদ্র এলিট গোষ্ঠীর চরিত্র এবং রাজনৈতিক পারদর্শিতার ওপর। এলিট শ্রেণির এই অংশ বৃহত্ অংশকে তত্ত্বীয়ভাবে শাসন করে দুটি উপায়ে। শক্তি অথবা ছলনা দিয়ে। সেদিক থেকে রাজনৈতিক এলিটকে দুই গোত্রে ভাগ করা যায়। যারা শক্তি প্রয়োগে শাসন করতে উদ্যোগী হয় তারা সিংহ পরিবার নামে পরিচিত। যারা চাতুর্য এবং ছলনা দিয়ে শাসনের ক্ষমতা রাখে তারা শৃগাল পরিবারের। প্যারেটো বিশেষভাবে জোর দিয়েছেন the instinct for combination এর ওপর, অর্থাত্ শৃগাল এবং সিংহের যে প্রবৃত্তি, সেই উভয় প্রবৃত্তির সমন্বয়ের ওপর। এই গুণ আয়ত্ত করে চিন্তা ও বাস্তবতার মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনে পারদর্শী হওয়া এলিট শ্রেণির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এরই মধ্য দিয়ে এলিট শ্রেণির মধ্যে সংযতাচার, আপসরফার মনোভাব এবং চুক্তিতে পৌঁছাতে আলাপ-আলোচনার সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। বিশ্বের প্রতিটি গণতান্ত্রিক দেশে রাজনৈতিক এলিট এই দক্ষতা কোনো না কোনোভাবে অর্জন করে। দলগত সংঘাত এবং দলীয় তিক্ততা উপশমে আমাদের দেশে এলিট শ্রেণি ওই দক্ষতা থেকে অনেক দূরে। অথচ এই দক্ষতাই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার একমাত্র পথ।

জোসেফ সুম্পিটার বা রবার্ট ডালের তত্ত্ব পশ্চিমা দেশের ক্ষেত্রে কার্যকর হলেও উন্নয়নশীল দেশে তার উপযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। বিশেষ করে লাতিন আমেরিকার গণতান্ত্রিক অভিজ্ঞতা সুম্পিটারের তত্ত্বকে অনেকাংশে নাকচ করে দেয়। Agustin Cueva (১৯৭৬) তাঁর El desarroll del capitalism en America Latina, Mexico City: Siglo XX1 লেখা রচনায় উল্লেখ করেছেন যে লাতিন আমেরিকায় যেসব বুর্জোয়া বিপ্লব (এলিট শ্রেণির নেতৃত্বে পরিচালিত বিপ্লব) অনুষ্ঠিত হয়েছে তার কোনোটিই গণতন্ত্রের কথা বলেনি। লাতিন আমেরিকার বুর্জোয়া শ্রেণির এজেন্ডাতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কোনো উল্লেখ নেই। মেক্সিকোতে ১৯১০ এবং ১৯১৭ সালে বুর্জোয়া বিপ্লব অনুষ্ঠিত হয়েছিল। গুয়াতেমালায় ১৯৪৪ সালে, বলিভিয়ায় ১৯৫২ সালে এবং ব্রাজিলে ১৯৬৪ সালে বিপ্লব অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু সব ক্ষেত্রে ওই বিপ্লবের একটি মাত্র উদ্দেশ্য ছিল, যেভাবেই হোক পুঁজিবাদী অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করা। সেখানে রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্রের কোনো উল্লেখ বা তার বাস্তবায়নের অঙ্গীকার নেই। বুর্জোয়া শ্রেণি গণতন্ত্রের বদলে বরং একধরনের স্বৈরতান্ত্রিক শাসন দিয়ে দেশ চালিয়েছে। লাতিন আমেরিকায় অধিকাংশ সময় সামরিক অভ্যুত্থান ঘটেছে এবং সামরিক বাহিনী দিয়ে বুর্জোয়া শ্রেণি দেশ শাসনকে পছন্দ করেছে। তারা মনোযোগী থেকেছে অর্থের প্রতি, পুঁজির বিকাশের প্রতি। ফলে ওই স্বৈরাচারী শাসনের শেকড় সেখানে অতীতকাল থেকে প্রোথিত হয়ে আছে এবং সেখানে কোনো পরিবর্তন আনার কথা বুর্জোয়া গোষ্ঠী বা এলিট শ্রেণি ভাবেনি। গণতন্ত্রের প্রতি লাতিন আমেরিকার বুর্জোয়া শ্রেণি কিছু দুর্বলতা দেখিয়েছে কেবল সোভিয়েত ব্যবস্থার পতনের পর। কিন্তু সেখানেও গণতন্ত্রকে সুম্পিটারের মতো কেবল নির্বাচনী প্রক্রিয়া হিসেবেই ভাবা হয়েছে। গণতন্ত্র বলতে আইনগত এবং শাসনব্যবস্থাগত একটি কাঠামো গড়ে তোলা এবং নৈতিকতাশূন্য এক ব্যবস্থা হিসেবে ভাবার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে এলিট শ্রেণি নিজেদের পরিচালিত কোনো বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেনি। এলিট শ্রেণি এখানে ক্ষমতায় এসেছে সামরিক শাসনের মাধ্যমে। ১৯৭৫ সালে সামরিক অভ্যুত্থান নতুন এলিট শ্রেণি গঠনে সাহায্য করে এবং পুরোনো এলিট শ্রেণিকে বদলিয়ে দেয়। এই এলিট শ্রেণি গণতন্ত্রের মধ্য দিয়ে নয়, সামরিক একনায়কতন্ত্রের সাহায্যে রাষ্ট্রক্ষমতা নিজের হাতে কুক্ষিগত রাখে। সেদিক থেকে লাতিন আমেরিকার এলিট শ্রেণির সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক এলিটের কেবল সাদৃশ্য নয়, বরং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তার ব্যর্থতার ধারাবাহিকতাও লক্ষণীয়।

কিন্তু ৯০-এর দশক থেকে লাতিন আমেরিকায় যে গণতন্ত্রায়ণ আমরা লক্ষ করেছি, সেই গণতন্ত্রে সিভিল সমাজের ভূমিকার সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল এলিট গোষ্ঠী। ওই এলিট শ্রেণি গণতন্ত্রকে যদিও কেবল প্রক্রিয়া হিসেবে দেখেছে। তার ঐতিহাসিক কারণও আছে। লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্রায়ণ ঘটেছে বিভিন্ন সময়ে। ইকুয়েডর, বলিভিয়া ও পেরুতে ১৯৭০ সালের শেষের দিকে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ক্ষমতায় আসেন। মধ্য আমেরিকা, আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে, ব্রাজিল, প্যারাগুয়ে ও চিলিতে গণতন্ত্র আসে ১৯৮০ বা ৯০-এর দশকে। মেক্সিকোতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৯৭ সালের নির্বাচনের পর। এসব দেশ গণতন্ত্রের ন্যূনতম সংজ্ঞা অর্থাত্ নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র হাতে পেয়েছে। তারা দীর্ঘকাল সামরিক একনায়কতন্ত্রের অধীনে শাসিত হলেও পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের কারণে সামরিকতন্ত্রের অভ্যন্তরে বেশ বড় ধরনের বিবর্তন ঘটে। বিবর্তনটি সামরিক বাহিনীকে অনেক বেশি আমলাতান্ত্রিক সংগঠনে পরিণত করে। এই আমলাতন্ত্রই কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের মূল মেরুদণ্ডে পরিণত হয়। ফেরনান্দ কারডোসো এই আমলাতান্ত্রিকীকরণের কারণ হিসেবে দুটি প্রবণতাকে তুলে ধরেছেন। তার মধ্যে একটি হচ্ছে, সামরিক বাহিনীর পেশাগত ক্ষেত্রে পরিপক্বতা এবং বামপন্থী গেরিলা যুদ্ধে সামরিক বাহিনীর অভিজ্ঞতা (Cardoso, Fernando 1986, p. 24)। ১৯৬৪ সালের দিকে ব্রাজিলে সামরিক বাহিনীর মধ্যে উদারনৈতিক গণতন্ত্রী সামরিক অফিসারদের বিশেষ একটি অংশের প্রভাব বৃদ্ধি পায়। কিন্তু ওই গণতন্ত্রী চরিত্রকে ধরে রাখা সম্ভব হয়নি বামপন্থী গেরিলা যুদ্ধের কারণে। অ্যালফ্রেড স্টেপান তাঁর দ্য মিলিটারি ইন পলিটিকস (নেওয়া হয়েছে Cardoso, Fernando 1986, p. 24) নামক গ্রন্থে লিখেছেন যে পেশাজীবী সামরিক বাহিনীর পক্ষে একটি রাষ্ট্রের চরিত্রকে গণতান্ত্রিক এবং লিবারেল হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষমতা থাকে। সামরিক বাহিনী বিপ্লব ঝঞ্ঝা লাতিন আমেরিকায় কিছুটা স্থিতিশীলতা আনতে সক্ষম হলেও গেরিলা যুদ্ধ সেখানে এতই জটিল এবং দীর্ঘ ছিল যে ওই স্থিতিশীলতা বেশিদিন টেকেনি। তা ছাড়া দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারণে সামরিক বাহিনী আমলাতান্ত্রিক ও কর্তৃত্ববাদী শক্তিতে পরিণত হয়। গুলিয়েমো ওডোনেল দেখিয়েছেন লাতিন আমেরিকায় সামরিক বাহিনী রাজনৈতিক দলগুলোকে অনেকটা অলংকারের মতো ব্যবহার করে এসেছে। ঠিক বাংলাদেশে জিয়াউর রহমানের সময় যেটি ঘটেছিল। জিয়াউর রহমান ১৯৭৫ সালের ৮ নভেম্বর পার্লামেন্ট বাতিল করেন, যদিও তিনি ১৯৭৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচন এবং গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ১৯৭৬ সালের শেষের দিকে রাজনৈতিক দলের নিয়ন্ত্রণসংক্রান্ত সংলাপের ফলে প্রকাশ্য রাজনীতির দরজা খুলে গেলে প্রায় ৬০টি রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করে। এরই মধ্যে রাজনৈতিক দলের মধ্যে ভাঙন সৃষ্টিতে তিনি বিশেষ পারদর্শিতা দেখান। মুসলিম লীগের শাহ আজিজুর রহমানকে প্রলোভন দেখিয়ে তাঁর পক্ষে আনতে তিনি সক্ষম হন। আওয়ামী লীগকে কয়েক ভাগে বিভক্ত করে মিজানুর রহমান ও মাওলানা তর্কবাগীশকে দিয়ে নতুন দল গঠন করান। ওসমানীর জাতীয় জনতা পার্টি, খোন্দকার মোশতাকের গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট তৈরির পাশাপাশি তাঁর পক্ষে ভাসানী ন্যাপের অভ্যন্তরে ভাঙন ধরানো সম্ভব হয়। মসিউর রহমান ও এস এ বারীর নেতৃত্বাধীন ন্যাপ জিয়াকে সমর্থন জানায়। পরে তাঁরা জিয়ার দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলে যোগ দেন। আতাউর রহমান খানের ইউনাইটেড পিউপিলস পার্টি বিভক্ত হয়ে এক অংশ কাজি জাফর আহমদের, অন্য অংশ ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম চৌধুরীর নেতৃত্বে জিয়ার দলে যোগ দেন। সামরিক বাহিনী ও আমলাতন্ত্রকে জিয়া তার সমর্থনের ঘাঁটি হিসেবে তৈরি করেন। মুসলিম লীগ ও ইসলামী পার্টির সমর্থন আদায় করা তার পক্ষে সম্ভব হয়। বেশ কিছু প্রগতিবাদী দল, যারা শেখ মুজিবের বিরোধিতা করে এসেছিল, তারাও জিয়ার সঙ্গে যোগ দেয়। ফলে রাজনীতিতে বিভেদ ও হিংসার মনোভাব সৃষ্টিতে জিয়ার মতো পারদর্শী আর কেউ ছিলেন বলে মনে হয় না। তিনি দলীয় রাজনীতির চেয়ে ব্যক্তি রাজনীতিকে উত্সাহিত করেছিলেন। ১৯৭৭ সালের নির্বাচন বাতিল করে ধাপে ধাপে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ গ্রহণ করে প্রথমে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন, পরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এবং সবশেষে সংসদ নির্বাচনের পরিকল্পনা করেন। ইতিমধ্যে বিচারপতি সায়েমকে স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে অপসারণ করে নিজে প্রধান মার্শাল ল প্রশাসক হন। এভাবে গড়ে ওঠে একটি আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র, যেখানে সামরিক বাহিনী ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রের আঁতাত মুখ্য ভূমিকা পালন করে। তারপরও লাতিন আমেরিকার মতো বাংলাদেশেও আসল ক্ষমতার অধিকারী থাকে সামরিক বাহিনী এবং অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো।

সেটি লাতিন আমেরিকায় ৯০-এর দশক থেকে লক্ষ করা গিয়েছিল, যখন ধীরে হলেও লাতিন আমেরিকার অভ্যন্তরীণ বাজার আন্তর্জাতিক প্রভাবের আওতায় আসে। অনিয়ন্ত্রণ, ব্যক্তি উদ্যোগ এবং বাণিজ্যে উদারনৈতিকীকরণের মাধ্যমে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো লাতিন আমেরিকায় প্রচুর বিনিয়োগ করে। অর্থনীতিতে বাজারের গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। বামপন্থী সমবিতরণের যে নীতির ঢেউ লাতিন আমেরিকায় প্রবহমান ছিল এবং যার কিছু প্রভাবে উন্নয়নকে বিভিন্ন রাষ্ট্র তার মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করে এগিয়েছিল, সেই নীতির ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। এই সময়ে তিনটি প্রধান শক্তির মধ্যে অংশীদারি গড়ে ওঠে। সেগুলো হচ্ছে রাষ্ট্রীয় খাত, ব্যক্তিগত খাত এবং বহুজাতিক করপোরেশন। এই তিন শক্তির প্রভাবে আগের কৃষি রপ্তানিভিত্তিক এবং স্বনির্ভর অর্থনৈতিক মডেল যা কিনা একটি স্বনির্ভর বাজারের চাহিদা মেটাত, তার স্থান দখল করে নেয় বৃহত্ ব্যক্তিমালিকানা এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানা। সেই সঙ্গে অভ্যন্তরীণ বাজার সম্পূর্ণভাবে আন্তর্জাতিকীকরণের শিকার হয়। ফলে শহরকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠে মাস সোসাইটি। যে গ্রাম এত দিন এই প্রভাবের বাইরে ছিল এবং সব ধরনের প্রভাব থেকে নিজের গা বাঁচিয়ে রাখছিল সেখানেও পুরোনো কাঠামোর অভ্যন্তরে পুঁজির সঞ্চয়ন ঘটতে থাকে এবং আধুনিকীকরণের প্রভাব দৃশ্যমান হয়।

এই প্রক্রিয়ার শেষ ফলাফল হচ্ছে, সামরিকতন্ত্রের বদলে গণতন্ত্রায়ণের বাণী চারদিকে ছড়িয়ে পড়া। এরই মধ্য দিয়ে যে নতুন শ্রেণি গড়ে ওঠে সেই শ্রেণির আশা-আকাঙ্ক্ষা পুরোনো সব শ্রেণি থেকে ভিন্ন হয়ে দাঁড়ায়। ব্যবসায়ী, কারিগর, পরামর্শদাতা, বিশ্ববিদ্যালয়ের পেশাজীবী শ্রেণি এবং ছাত্রসমাজ এদের চিন্তার জগতে বিশাল পরিবর্তন আসে। তারা এখন কথা বলে উত্পাদন নিয়ে, প্রবৃদ্ধি, বৈদেশিক বিনিয়োগ, বাণিজ্য, লাভ-লোকসান ইত্যাদি নিয়ে। তারা সামরিকতন্ত্রের সংকীর্ণ সাংস্কৃতিক জগতের দিকে তাকিয়ে নিজেদের সীমানাকে চিহ্নিত করতে আর প্রস্তুত নয়। সামরিকতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী আন্দোলনও বিশেষ ভূমিকা রাখে। চেতনাগত ওই পরিবর্তনের সঙ্গে আরও যুক্ত হয় ধর্মযাজক, বিশপ শ্রেণি, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক বন্দীদের আত্মীয়স্বজন। তাঁরাও নিপীড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। তার ফলে সামরিকতন্ত্রের অভ্যন্তরে দ্বন্দ্ব বা বিবর্তন দেখা দেয়, যার প্রভাবে উদারনীতির প্রতি বিশেষ আগ্রহ জন্মে এবং তা থেকে গণতন্ত্রে। এই অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে গণতন্ত্রায়ণের গভীর সম্পর্ক আছে। চিলি ছাড়া অন্যান্য দেশে অর্থনৈতিক পরিবর্তন এসেছে গণতন্ত্রের পরে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন গণতান্ত্রিক সরকারের ভিতকে আরও শক্ত করতে সাহায্য করেছে। ব্যক্তি খাতের প্রসারের কারণে রাষ্ট্রের ক্ষমতা কমে এসেছে। সিভিল সমাজের বিস্তার নিশ্চিত হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রের ক্ষমতা কমিয়ে ব্যক্তি খাতকে শক্ত করার কারণে সমাজে দারিদ্র্য ও অসমতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

Atilio Boron (১৯৯৮)-এর মতো অনেক গবেষক লাতিন আমেরিকার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে সেখানে গণতন্ত্র ব্যর্থ হয়ে স্বৈরশাসনের দিকে ঢলে পড়বে বা সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করবে, এ ধরনের ঝুঁকি সেখানে নেই। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও ওই একই কথা প্রযোজ্য। কিন্তু গণতন্ত্রের বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, গণতন্ত্র সেখানে মানুষের মনে কোনো আশা জাগাতে পারেনি।১১ সেই আশা জাগানোর জন্য দুটি প্রয়োজনীয় উপাদান হচ্ছে, গণতন্ত্র মানুষের মধ্যে ন্যূনতম সমতার লক্ষ্যে কাজ করল কি না বা ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশে সহায়তা করল কতটুকু। দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতায় নাগরিক সমাজের প্রতিটি সদস্য কথায় বা বাস্তবে স্বাধীনতা অনুভব না করলে, অর্থনীতি ও অর্থনৈতিক সমতার কথা না ভাবলে গণতন্ত্র ব্যর্থ হয়।১২ এগুলো অন্তর্ভুক্ত না হলে গণতন্ত্র সম্পর্কে মানুষের মনে কোনো গভীর অনুভূতি গড়ে ওঠে না এবং মানুষের অনুমোদন লাভ সে কারণে সম্ভব হয় না। এটি লাতিন আমেরিকার মতো আমাদের দেশের এলিট শ্রেণির ব্যর্থতা। এই ব্যর্থতা কাটিয়ে না উঠলে গণতন্ত্র যে উভয় ক্ষেত্রে ব্যর্থ হবে, সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না।

Sheri Berman দেখিয়েছেন যে ইউরোপে গণতন্ত্র সফল হয়েছে কেবল উদারনীতির কারণে নয় বা সুস্থ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাওয়ার কারণেও নয়। সেখানে অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের মুখ্য ভূমিকা গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করেছে এবং জনগণের সমর্থন পেয়েছে। ইউরোপে স্ক্যান্ডেনেভিয়ান দেশগুলো যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক তাদের অর্থনীতিতে জনকল্যাণমূলক নানা নীতি প্রবর্তন করে ভিন্ন ধাঁচের এক সমাজ এবং রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। গণতন্ত্র বিকশিত হওয়ার জন্য সমাজকে কেবল কাঠামো হিসেবে ভাবা যথেষ্ট নয়।১৩ ফলে সুম্পিটার বা ডাল গণতন্ত্র সম্পর্কে যে ধারণা দিয়েছেন এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় এলিট শ্রেণির ভূমিকাসংক্রান্ত যে তত্ত্বের প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছেন সেটি পুরোপুরি আমাদের দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ভাবা যায় না। জনগণের অংশগ্রহণ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এলিট শ্রেণি যদি আন্তর্জাতিক পুঁজির পক্ষে কথা বলে, দেশীয় বুর্জোয়া গোষ্ঠীর অর্থনৈতিক ইচ্ছা এবং আকাঙ্ক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে গণমানুষের ভাগ্যের সঙ্গে যুক্ত ক্ষেত্রগুলোকে যদি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে তাহলে সেই গণতন্ত্র আমাদের মতো দেশে সফল হবে না এবং এলিট শ্রেণির পক্ষে গণতান্ত্রিক উপায়ে দেশ শাসনও বাধাগ্রস্ত হবে।

টিকা:

১.         ফুকুয়ামা লিখেছে What we may be witnessing is not just the end of the Cold War, or the passing of a particular period of post-war history, but the end of history as such: that is, the end point of mankind's ideological evolution and the universalization of Western liberal democracy as the final form of human government.’ Francis Fukuyama, The End of History and the Last Man (1992).

২.         Plamenatz রুশো সম্পর্কে বলেছেন He turns his minds…to consider how the social order affects the structure of human personality (vol.1, p. 440), and it is the psychological impact of social and political institutions that is Rousseau’s main concern, which aspect of men’s characters do particular institutions develop? (দেখুন Pateman, 1974, p. 24).

৩.        মিলস তাঁর Political Ecomony তে লিখেছেন a democratic constitution not supported by democratic institutions in detail, but confined to the central government, not only is not political freedom, but often creates a spirit precisely the rverse (দেখুন Pateman 1974, p. 30).

৪.         মিলসের দাবিটি এ রকম: It is no use having universal suffrage and participation in national government if the individual has not been prepared for this participation at local level. It is at this level that he learns how to govern himself (Pateman 1974, p. 30).

৫.         কোল লিখেছেন, The object of social organization is not merely material efficiency, but also essentially the fullest self expression of all the members. Self expression involves self government and this means that we must call forth the people’s full participation in the common direction in the affairs of the community. (Pateman 1974, p. 36).

৬.        He also says, the abstract democracy of the ballot box did not involve real political equality, the equality of citizenship implied by universal suffrage was only formal and it obscured the fact that political power was shared very unequally. (Pateman 1974: 39). His conclusion is- individuals and their institutions cannot be considered in isolation from one another.

৭.         Liberal democracy is not meant to be so much about empowering people as it is about protecting their liberties and allowing them to pursue their own interests unimpeded….. This approach to democracy corresponds with Schumpeter’s seminal definition of democracy. (Hudson, C 2012, p. 444).

৮.        A political movement that emphasizes the interests, cultural traits, and spontaneous feelings of common people, as opposed to those of a privileged elite. For legitimation, populist movements often appeal to the majority directly-through mass gatherings, referendums, or other forms of popular democracy-without much concern for checks and balances or the rights of minorities. (Taken from Plattner Mark 2010, p.88)

৯.         As a political method, that is to say, a certain type of institutional arrangement for arriving at political – legislative and administrative – decisions. (Schumpeter, Capitalism, Socialism and Democracy, 1943, p 242)?

১০.       ডালের রচনার মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হচ্ছে, A Preface to Democractic Theory (1956) and Hierarchy, Democracy and Bargaining in Politics and Economics? এখানে গণতন্ত্রকে এভাবে দেখা হচ্ছে, Democracies are political systems characterized by popular participation, genuine competiton for executive office, and institutional checks on power. (নেওয়া হয়েছে Joseph Siegle and etal 2004, p.1 থেকে)

            Necessity for individual attitudes and psychological qualities to be developed. Major function is therefore educational in a very widest sense (democratic skills, procedures etc)? All political systems to be democratized Industry and local governments. (Pateman 1974, p. 42-43)

                Dahl has defined political system as “any persistent pattern of human relationship that involves to a significant extend power, rule or authority” in (Pateman 1974: 44). (এই সংজ্ঞা ডালের ১৯৬৩ সালে লেখা পৃষ্ঠা ৬-এ পাওয়া যাবে)

১১.       The fact that the major threat besieging democracy in Latin America (and it should be added, in industrialized democracies as well) is not so much a “blatant authoritarian regression” but the loss of purpose and meaning of democracy due to its lack of depth, poor quality, unfairness, and incompleteness (Aguero 1994, 5-7) in Boron Atilo A (1998) Faulty Democracies? A Reflection on the Capitalist “Fault Lines” in Latin America.

১২.       আলেন টোরেন লিখেছেন, democracy is more than a political project; it is also a moral ethical project. According to Touraine “democracy is the subordination of the organization of society – and of political power in particular- to one objective that is not social but moral; the liberation of everyone” (Varas, 1998, p.148 থেকে নেওয়া).

১৩.      The success of democracy in Western Europe since World War Two has been misattributed to liberalism. The consolidation of democracy in Europe was due to the protection of economic and social rights through the welfate state. (Berman 2006, 2010, p. 50).

গ্রন্থপঞ্জি

                Agustin Cueva (1976) El desarroll del capitalism en America Latina, Siglo XX1, Mexico City.

                Berman, S (2006) The Primacy of Politics, Cambridge University Press, Cambridge.

                Berman Sheri (2007) How Democracies Emerge: Lessons from Europe, Journal of Democracy, Volume 18, Number 1. pp. 28-41

                Berman, S (2011) The past and future of social democracy and the consequences of democratic promotion. In: Hobson C and Kurki M (eds) The Conceptual Politics of Democracy Promotion. Routledge, London.

                Boron Atilo A (1998) Faulty Democracies? A Reflection on the Capitalist “Fault Lines” in Latin America, In Aguero, Felipe and Jeffrey Stark (ed) Fault Line of Democracy in Post-Transition Latin America, North-South Centre Press, University of Miami

                Bryan Caplan (2007) The Myth of Rational Voter: Why Democracies Choose Bad Policies, Princeton University Press, Princeton

                Cardoso, Fernando Henrique, (1986), Democracy in Latin America, in: Politics Society, 15: 23.

                Cohen Carl (ed) (1962) Communism, Fascism and Democracy: The Theoretical Foundation, Random House, New York, 1962, P. 424.

                Diamond, Larry (1999), Developing Democracy: Towards Consolidation, The John Hopkins University Press, Baltimore.

                Fukuyama, Cardoso, Fernando Henrique (1986) Democracy in Latin America, Politics & Society, 1986, 15:23

                Fukuyama, Francis (1992) The End of History and the Last Man, Free Press, NY.

                Gilley, Bruce, (2009) Is Democracy Possible? Jornal of Democracy, Vol 20, N 1, pp. 113-127

                Held, David (1987), Models of Democracy, Polity Press, Oxford.

                Held, D (2006) Models of Democracy, 3rd edn, Polity Press, Cambridge.

                Huntington, (1991) Democracy’s Third Wave, Journal of Democracy Vol. 2. No. 2, pp.12-34

                Macpherson, CB (1977) The Life and Times of Liberal Democracy, Oxford University Press, Oxford.

                Masoud Tarek (2014) The Ups and Downs of Islamism. A book review on Shadi Hamid’s book “Temptations of Power: Islamists and Illiberal Democracy in a New Middle East” in Journal of Democracy, Volume 25, Number 3, pp. 170-174

                Pateman Carole, (1970) Particiption and Democratic Theory, Cambridge University Press, Cambridge

                Pinkney, Robert, (2003) Democracy in the Third World, Lynne Rienner Publishers, London.

                Plattner Marc (2010), Populism, Pluralism, and Liberal Democracy, Journal of Democracy, Volume 21, Number 1 pp. 81-92

                Posner Richard (2003) Law, Pragmatism and Democracy, Harvard University Press, Cambridge

                Plattner, Mark, (2015) Is Democracy in Decline, Journal of Democracy, January, Volume 26, Number 1.pp. 5-10

                Raby, D. L. (2006) Democracy and Revolution: Latin America and Socialism Today, Pluto Press, London.

                Reece Jones, (2011) Dreaming of a Golden Bengal: Discontinuities of Place and Identity in South Asia, Asian Studies Review, September 11, Vol.35, pp. 373-395

                Robert Goodin, (2010) Global Democracy: in the Begining, International Theory 2.2, pp. 175-209

                Roy Olivier (2012) The Transformation of The Arab World, Journal of Democracy, Volume 23, Number 3, PP 5-18

                Roy Olivier and Wittes, Tamara Cofman (2008) Three Kinds of Movements, Journal of Democracy, Volume 19, Number 3, pp. 7-27

                Schedier, Andreas (2000), The Democratic Revelation, Journal of Democracy, Volume 11, Number 4, October, pp. pp. 5-19

                Schumpeter, J. A (1943), Capitalism, Socialism and Democracy, Geo, Allen and unwin, London

                Sorensen, George (1998) Democratisation in the Third World, The Role of Western Politics and Research, Purdue University: West Lafayette.

                Spina, Nicholas & others (2011). Confusianism and Democracy: A Review of the Opposing Conceptualisation, Japanese Journal of Political Science 12(1), 143-160.

                Stockton, David (2002) The Classical Athenian Democracy, Oxford, Oxford University Press.

                Vali, Nasr, (2005) The Rise of “Muslim Democracy”, Journal of Democracy, Volume 16, Number 2, pp. 13-27.