একবিংশ শতাব্দীতে বিশ্বায়ন এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার

সারসংক্ষেপ

এশীয় অর্থনৈতিক সংকট এবং সাম্প্রতিক কালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার পর, করপোরেট-চালিত প্রক্রিয়া হিসেবে বিশ্বায়ন ন্যায়সংগতভাবেই বিস্তর সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। এই প্রবন্ধে সমালোচনাসমূহের মতাদর্শগত নির্মাণকে পাশ কাটিয়ে, স্বতন্ত্রভাবে সমালোচনাসমূহকে বিশ্লেষণাত্মকভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছে। এরপর অমর্ত্য সেনের সক্ষমতা পরিপ্রেক্ষিত এবং খান, নুসবম এবং অন্যদের সম্প্রসারিত ব্যাখ্যার আলোকে বিশ্বায়নের একটি নৈতিক-নিয়মাত্মক (নরম্যাটিভ) ব্যাখ্যার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। স্বাধীনতাকেন্দ্রিক এই নৈতিক পরিপ্রেক্ষিত ন্যায়-নীতি এবং প্রতিষ্ঠানের ওপর জোরারোপ করে, যা বৈশ্বিকভাবে এবং স্থানীয়ভাবে স্বাধীনতাকে বর্ধিত করে। এটা দেখানো হয়েছে যে বর্তমান পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক দক্ষতা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের স্বচ্ছ মূলনীতিভিত্তিক একটি বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থার কাঠামোই কাম্য। তবে বিশ্বায়নের বর্তমান চিড় ধরা প্রক্রিয়া শেষ পর্যন্ত একটি চিড় ধরা আঞ্চলিকতাবাদ বা এমনকি জাতীয় সংরক্ষণবাদ এবং দ্বন্দ্বে পর্যবসিত হতে পারে। তাই এখানে প্রদত্ত কার্যকাঠামোর ভিত্তিতে বহুপক্ষীয় সহযোগিতা একটি আশু প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। এমতাবস্থায় বাণিজ্য, আর্থিক ব্যবস্থা থেকে শুরু করে পরিবেশগত, নারী এবং সংখ্যালঘুদের অধিকার ইত্যাদি ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার শাসনব্যবস্থা তৈরির বিষয়টি বৈশ্বিক, জাতীয়, সামাজিক এবং রাজনৈতিক আলোচ্যসূচিতে অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। নিচ থেকে গড়ে তোলা আন্তর্জাতিক গণতান্ত্রিক আন্দোলন এই সমাজব্যবস্থার দিকে আমাদের অগ্রসর করবে।

মুখ্য শব্দগুচ্ছ

বিশ্বায়ন, বৈশ্বিক ন্যায়বিচার, সক্ষমতা, আর্থিক সংকট, বৈশ্বিক আর্থিক কাঠামো, বৈশ্বিক সমাজ।

ভূমিকা

বর্তমানে এশীয় অর্থনৈতিক সংকট এবং সাম্প্রতিক কালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার পর, করপোরেট-চালিত প্রক্রিয়া হিসেবে বিশ্বায়ন ন্যায়সংগতভাবেই বিস্তর সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। এই প্রবন্ধে সমালোচনাসমূহের মতাদর্শগত নির্মাণকে পাশ কাটিয়ে, স্বতন্ত্রভাবে সমালোচনাসমূহকে বিশ্লেষণাত্মকভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছে। এখানে গৃহীত স্বাধীনতাকেন্দ্রিক পরিপ্রেক্ষিত ন্যায়-নীতি এবং প্রতিষ্ঠানের ওপর জোরারোপ করে, যা বৈশ্বিকভাবে এবং স্থানীয়ভাবে স্বাধীনতাকে বর্ধিত করে। এটা দেখানো হয়েছে যে বর্তমান পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক দক্ষতা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের স্বচ্ছ মূলনীতিভিত্তিক একটি বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থার কাঠামোই কাম্য। তবে বিশ্বায়নের বর্তমান চিড় ধরা প্রক্রিয়া শেষ পর্যন্ত একটি চিড় ধরা আঞ্চলিকতাবাদ বা এমনকি জাতীয় সংরক্ষণবাদ এবং দ্বন্দ্বে পর্যবসিত হতে পারে।

তাই এই প্রবন্ধের মূল লক্ষ্য হচ্ছে একটি ধাঁধা ব্যাখ্যা করা এবং সমাধানের এমন কৌশল বাতলে দেওয়া, যা স্বাধীনতা-বর্ধক। ধাঁধাটি হচ্ছে বিশ্বায়নের বাগাড়ম্বর, আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর (আইএফআই) কাঠামোগত সংস্কার নীতিমালা এবং নিয়মভিত্তিক বৈশ্বিক ব্যবস্থার অনুসরণ সত্ত্বেও কেন আঞ্চলিকতাবাদ এবং এমনকি জাতীয়তাবাদী সংরক্ষণবাদের দিকে একটি ঝোঁক লক্ষ করা যাচ্ছে? এর পেছনে এই প্রবন্ধে প্রধান যে যুক্তিটি দেওয়া হয়েছে তা হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নেতৃত্বে চলমান বিশ্বায়ন প্রকল্পের ভিত্তিমূলে একটি অসংগতি রয়েছে, যা বাস্তব পৃথিবীতে অসমতার প্রভাবগুলো অনুধাবনে প্রতীয়মান প্রত্যাখ্যান থেকে উদ্ভূত হচ্ছে। অধিকন্তু, এটা তাদের বৈশ্বিক ন্যায়বিচারের কিছু মূল্যবান মূলনীতিকে অগ্রাহ্য করার পথ করে দিয়েছে। ন্যায্যতার বিষয়গুলোকে উপেক্ষা করার মাধ্যমে বিশ্বায়নের বর্তমান নেতারা অর্থনৈতিক দক্ষতাকে ক্ষতির সম্মুখীন করার ঝুঁকি নিচ্ছেন। তাই আমার লক্ষ্য হচ্ছে ‘বিশ্বায়ন এবং এর অসন্তুষ্টিগুলো’কে বোঝার চেষ্টা করা (স্টিগলিত্স ২০০২, ২০০৬; খান ১৯৯৪, ১৯৯৫ক, ১৯৯৫খ, ১৯৯৬, ১৯৯৭ক, ১৯৯৭খ, ১৯৯৭গ, ১৯৯৮, ১৯৯৯ক, ১৯৯৯খ, ২০০৪ক, ২০০৪খ, ২০০৫, ২০০৭; খান এবং লিউ ২০০৮, খান ২০১৩ক, ২০১৩খ, ২০১৪) এবং সামনে এগিয়ে যাওয়ার কিছু দিকনির্দেশক মূলনীতি প্রস্তাব করা।

বারবার ব্যবহারের ফলে বিশ্বায়ন শব্দটি ইতিমধ্যে একাডেমিক ক্লিশেয় পরিণত হয়েছে। অনেকের মতে, উত্পাদনের বিশ্বায়ন এবং নতুন আন্তর্জাতিক শ্রম বিভাজনের উত্পত্তি, এই দুটি প্রবণতা বৈশ্বিক অর্থনীতির কাঠামোগত গভীর রূপান্তরকে চিহ্নিত করে। কিছু ক্ষেত্রে এই দাবিটি নির্ঘাত সত্য। কিন্তু সম্প্রতি কয়েকজন পর্যবেক্ষক (হ্যারিস ১৯৯৮, খান ১৯৯৮) উল্লেখ করেছেন যে সাধারণ ব্যবহারে বিশ্বায়ন শব্দটি ব্যাপক অর্থে বর্ণনাত্মক শ্রেণির, বিশ্লেষণাত্মক শ্রেণির নয়। অধিকন্তু, বর্ণনাত্মক শব্দ হিসেবে এটার যথাযথ ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট প্রয়োজন। কিন্তু বিশ্বায়নসংক্রান্ত সুবিশাল এবং ক্রমবর্ধমান রচনাবলিতে প্রায়ই এটি অনুপস্থিত থাকে। ঐতিহাসিকভাবে দেখলে এটা প্রতীয়মান হয় যে বিশ্বায়ন আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক একীভূতকরণের একটি পরস্পরবিরোধী প্রক্রিয়া; যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, মহামন্দা এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দ্বারা ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয়েছিল। ব্রেটন উডস কাঠামোর উত্পত্তিকে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিশ্বকে একীভূতকরণ এবং একই সঙ্গে ব্যক্তিগত মূলধনের প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণের একটি পন্থা হিসেবে দেখা যেতে পারে। ব্রেটন উডস কাঠামোর পতন ক্যাপিটাল অ্যাকাউন্ট উদারীকরণের পথে গতি সঞ্চার করে, যা সাধারণত বিশ্বায়নের সবচেয়ে দৃশ্যমান দিক। তবে, এমনকি এই প্রক্রিয়াও অস্থিতিশীলতায় পরিপূর্ণ। এটি মেক্সিকোর এবং আরও সাম্প্রতিক এবং এমনকি আরও নাটকীয় এশীয় অর্থনৈতিক সংকট এবং অতি সাম্প্রতিক একুশ শতকের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের দ্বারা প্রমাণিত হচ্ছে। এমনকি আদর্শ নব্যধ্রুপদি হেকসার-ওলিন-স্যামুয়েলসন মডেলের মধ্যেও একই সময়ে বাণিজ্যের একীভূতকরণের ফলে উত্তরের অদক্ষ শ্রমিকদের বেতন হ্রাস পেতে পারে; ফলে সেখানে বৈষম্য বৃদ্ধি পাবে (ক্রুগম্যান ১৯৯৬, উড ১৯৯৪)। বাণিজ্যের মাধ্যমে দক্ষিণে আরও অধিক সমতা বিধান হবে বলে ধরে নেওয়া হয়েছিল কিন্তু বাস্তবে এমনটা ঘটার খুব কম প্রমাণই দেখা যাচ্ছে। সুতরাং, বিশ্বায়নের বাগাড়ম্বরকে সতর্কতার সঙ্গেই মোকাবিলা করা প্রয়োজন। বড় জোর, আমরা একটি ‘চিড় ধরা’ বিশ্বায়নের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি (হ্যারিস, ১৯৯৮)।

যদিও কয়েক দশক ধরে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে যে কাঠামোগত পরিবর্তনগুলো ঘটেছে, তা আন্তসীমান্ত অর্থনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করেছে এবং বলতে গেলে একটি বৈশ্বিক অর্থনীতি তৈরি করেছে। বিশ্বব্যাপী আর্থিক বাজারগুলোর বিধিব্যবস্থার হ্রাসকরণের সহায়তায় ঘটা বাণিজ্য এবং বৈদেশিক বিনিয়োগের আন্তর্জাতিকীকরণ অর্থনৈতিক একীভূতকরণ এবং আঞ্চলিক জোট গঠনকে ত্বরান্বিত করেছে (কুক এবং ক্যার্কপ্যাট্রিক, ১৯৯৭)। এক নতুন ধরনের শ্রম বিভাজন এবং গুণগতভাবে একটি ভিন্ন ধরনের সম্পদ ব্যবহার, উত্পাদন এবং মূলধন সঞ্চয়ের উত্পত্তি ঘটেছে। সাম্প্রতিক বৈশ্বিক অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব হচ্ছে বৈশ্বিক আন্তনির্ভরশীলতা এবং একটি অসম বৈশ্বিক অর্থনৈতিক গ্রামের সৃষ্টি।

বৈশ্বিক অর্থনীতির এই অসম একীভূতকরণ নতুন কোনো বিষয় নয়। এই কাঠামোগত পরিবর্তনসমূহ বৈশ্বিক বাজার সংগঠনের মধ্যে একটি গুণগত রদবদল নিয়ে এসেছে। যেমন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পরিবর্তে আন্তর্জাতিক উত্পাদনের ওপর জোর দেওয়া এবং আন্তর্জাতিক পুঁজি এবং মানসিক শ্রমভিত্তিক ব্রেইন-পাওয়ার শিল্পের আধিপত্য (থরো, ১৯৯৬)। যেমনটা কুক এবং ক্যার্কপ্যাট্রিক (১৯৯৭) উল্লেখ করেছেন:

অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের আন্তর্জাতিকায়ন নতুন কোনো ধারণা নয়...তবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আগেকার বিস্তারের চেয়ে আন্তর্জাতিক একীভূতকরণের সাম্প্রতিক মাত্রা গুণগতভাবে ভিন্ন। কারণ এর বৈশিষ্ট্য হলো অর্থনৈতিক যোগসূত্রসমূহকে বর্ধিত করা, যা মাঠপর্যায়ে প্রায়ই জাতীয় সীমান্ত অতিক্রম করে (পৃষ্ঠা, ৫৫)।

অর্থনৈতিক একীভূতকরণের বিগত বছরগুলোতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতাসমূহ কমিয়ে আনা বৈশ্বিক অর্থনীতিকে একীভূতকরণে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। অন্যদিকে বর্তমানের বৈশ্বিক বাণিজ্যে বহুজাতিক করপোরেশনগুলো, ক্রমবর্ধমান অর্থ ও পুঁজিবাজার এবং তথ্য ও কম্পিউটার প্রযুক্তি প্রধান ভূমিকা পালন করছে।

১৯৮০-এর দশকের প্রথম থেকে বহুজাতিক করপোরেশনগুলো শুধু সংখ্যাগত দিক থেকেই বৃদ্ধি পায়নি, বরং বৈদেশিক বিনিয়োগে তাদের অংশও বিস্ময়করভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি ১৯৯০-এর দশকের প্রথম দিকে বহুজাতিক করপোরেশনের সংখ্যা ছিল ৩৭,০০০ এবং এই করপোরেশনগুলো ১৭০,০০০ অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করত। করপোরেশনগুলোর সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল প্রায় ২ ট্রিলিয়ন ডলার (কুক এবং ক্যার্কপ্যাট্রিক, ১৯৯৭)। বর্তমানে কোনো কোনো বহুজাতিক করপোরেশনের মোট লেনদেনের পরিমাণ কিছু কিছু উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের মোট জাতীয় উত্পাদনের (জিএনপি) চেয়েও বেশি।

বৈশ্বিক অর্থনীতি সম্পর্কে প্রভাব বিস্তারকারী পুঁজিবাজার এবং পুঁজি লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্রমবর্ধমান গুরুত্বের কারণে বিশ্বায়ন ক্রমশ প্রবলতর হচ্ছে। পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রণ হ্রাস এবং বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় নীতির উদারীকরণের ফলে রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে পুঁজিপ্রবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বৈশ্বিক অর্থনীতি একীভূত হয়েছে।

পৃথিবীর প্রতিটি অংশে বিশ্বায়ন এবং আঞ্চলিকায়নের প্রভাব অনুভূত হওয়ার পর থেকেই সমাজবিজ্ঞানীরা এই দুটি ধারণা, সেগুলোর আন্তসম্পর্ক এবং প্রক্রিয়াগুলো উন্নয়নশীল রাষ্ট্রসমূহের প্রবৃদ্ধি ও কল্যাণসাধনে কী ধরনের প্রভাব বিস্তার করতে পারে সে বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা শুরু করেছেন। এটি নানা বিতর্কেরও জন্ম দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মধ্যে বিরোধের সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্র রয়েছে। কিছু বিশেষজ্ঞ, যেমন হার্স্ট (১৯৯৫) বিশ্বায়িত অর্থনীতির মতো কোনো বিষয় আছে কি না সে বিষয়েই প্রশ্ন তুলেছেন। অন্যদিকে থরো (১৯৯৬), ওহমা (১৯৯৬) বিশ্বাস করেন যে অর্থনৈতিক একীভূতকরণের গুণগতভাবে নতুন একটি রূপ বিশ্বায়ন ও আঞ্চলিকায়নের আবির্ভাবের পরিবেশ তৈরি করেছে। অধিকন্তু, বিশ্বায়ন ও আঞ্চলিকায়ন উন্নয়নশীল রাষ্ট্রসমূহের কল্যাণকামিতা বৃদ্ধি করছে, না খর্ব করে আঞ্চলিক ও আর্থসামাজিক বৈষম্য চিরস্থায়ী করছে, সমাজবিজ্ঞানীরা এই বিতর্কে লিপ্ত আছেন।

এই প্রবন্ধে আমি বিশ্বায়ন এবং আঞ্চলিকায়নের অন্তঃসার, তাদের সম্পর্ক এবং বিশেষত উন্নয়নশীল রাষ্ট্রসমূহের ওপর তাদের যে প্রভাব পড়তে পারে তা বিশ্লেষণ করব। মূলধনের বৈশ্বিক প্রবাহ এবং স্থানীয় প্রয়োজন ও সংবেদনশীলতার মধ্যকার অসংগতিসমূহও এখানে আলোচনা করা হবে। সবশেষে আমরা দেখব যে এই অসংগতি বিশ্বায়নকে কাঠামোগত এবং নিয়মাত্মক উভয় দিক থেকে বোঝার দিকেই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে; বিশেষত যখন তা উন্নয়নের সঙ্গে সম্পর্কিত হবে।

চিড় ধরা বিশ্বায়ন: একটি নিয়মাত্মক বিশ্লেষণ কাঠামো

যেমনটা শুরুতে উল্লেখ করা হয়েছে, বিশ্বায়ন ছিল ১৯৯০-এর দশকের একটি বহুল ব্যবহূত শব্দ। পরিবর্তনের প্রক্রিয়া হিসেবে বিশ্বায়ন রাজনীতি এবং অর্থনীতিকে ছাড়িয়ে গিয়ে বিজ্ঞান, সংস্কৃতি এবং জীবনাচরণেও নিজের ক্ষেত্র বিস্তৃত করেছে (গ্রিফিন এবং খান, ১৯৯২)। প্রকৃত অর্থে, বিশ্বায়ন একটি ‘বহুমাত্রিক ধারণা যা সামাজিক কর্মের নানা রূপে, যেমন অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, আইনগত, সংস্কৃতি, সামরিক ও প্রযুক্তিগতভাবে এবং সামাজিক কর্মকাণ্ডের বিভিন্ন ক্ষেত্রে, যেমন পরিবেশের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায়’ (প্যারেটন এবং অন্যান্য, ১৯৯৭: ২৫৮)।

বিশ্বায়নের সংজ্ঞার বিষয়ে বা আমাদের জীবন ও আচরণে এর প্রভাব সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা একমত নন। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ বিশ্বায়নকে একটি রাজনৈতিক ধারণা হিসেবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন (গিলস, ১৯৯৭)। অন্যদিকে অন্যরা এই বিষয়টিকে সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং পরিবেশগত পরিবর্তনের কাঠামোর আলোকে বিশ্লেষণ করেছেন (ম্যাকগ্রু, ১৯৯২)। কেউ কেউ বিশ্বায়নের ইতিবাচক প্রভাবগুলোর ওপর জোরারোপ করেছেন। অন্যদিকে অন্যরা আয়, সামাজিক বৈষম্য, নারী এবং দরিদ্রদের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাবগুলোর ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন (সেন, ১৯৯৭; গিলস, ১৯৯৭)। অন্য একদল বিশেষজ্ঞ, জাতিরাষ্ট্রসমূহের ওপর বিশ্বায়নের প্রভাব তুলে ধরেছেন এবং যুক্তি দেখিয়েছেন যে ‘আজকের সীমান্তহীন বিশ্বের বৈশ্বিক অর্থনীতিতে অংশগ্রহণ করার মতো গুরুত্ববহ কর্মক (ধপঃড়ত্) হিসেবে জাতিরাষ্ট্রসমূহ ইতিমধ্যে তাদের ভূমিকা হারিয়েছে’ (ওহমা, ১৯৯৬: ১১)। একই সঙ্গে অন্যরা একটি উত্তরাধুনিক পৃথিবীতে একীভূতকরণ এবং খণ্ডায়নের পরস্পরবিরোধী শক্তিগুলোর ওপর তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন (খান, ১৯৯৮, অধ্যায় ৬ ও ৭, ২০০২ক, ২০০২খ, ২০০৩, ২০০৪ক, ২০০৪খ, ২০০৭)।

যেহেতু অসংখ্য জাতি, ব্যক্তি ও সম্প্রদায়ের ওপর বিশ্বায়নের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে, ফলে বিশ্বায়নকে স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা এবং এর প্রভাবগুলোকে খতিয়ে দেখা অপরিহার্য। এর অন্যতম প্রধান শর্ত হচ্ছে প্রপঞ্চটিকে সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা। এই প্রবন্ধে বিশ্বায়নকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে একটি আন্তসংযুক্ত অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত, সাংস্কৃতিক এবং যোগাযোগমূলক প্রক্রিয়া হিসেবে, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্যাপকভাবে বিকশিত হয়েছে। সহজভাবে বলতে গেলে বিশ্বায়ন দ্বারা বৈশ্বিক অর্থনীতির এমন একীভূতকরণকে বোঝায়, যার ফলে পৃথিবীর এক স্থানে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা, অন্য স্থানের ব্যক্তি এবং সম্প্রদায়ের আর্থসামাজিক পরিবেশ ও জীবনাচরণের ওপর সুস্পষ্ট, টেকসই এবং লক্ষণীয় প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। যেমনটা ম্যাকগ্রু উল্লেখ করেছেন, বিশ্বায়ন হচ্ছে ‘রাষ্ট্র এবং সমাজসমূহের মধ্যকার যোগসূত্র এবং আন্তসম্পর্কগুলোর একটি প্রাচুর্য নির্মাণ, যা আধুনিক বিশ্বব্যবস্থা তৈরি করেছে। একই সঙ্গে এটি একটি প্রক্রিয়া যার দ্বারা পৃথিবীর এক অংশে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা, সিদ্ধান্ত এবং কর্মকাণ্ড; যা তার থেকে অনেক দূরের অন্য কোনো স্থানের ব্যক্তিবর্গ এবং সম্প্রদায়ের ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করতে পারে’ (১৯৯২, পৃষ্ঠা ২৬২)। যা হোক, প্রপঞ্চটির সত্যিকার বিশ্লেষণাত্মক গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে হলে, এটিকে অবশ্যই বিশ্বায়নের একটি তত্ত্বের অংশ হতে হবে। অধিকন্তু, গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত প্রভাব বুঝতে হলে, তত্ত্বটিরও অবশ্যই একটি নিয়মাত্মক দৃষ্টিকোণ থাকতে হবে। উত্তরাধুনিক বিশ্বের বাস্তবতার ভিত্তিতে খান (১৯৯৮) এমনই একটি তত্ত্ব প্রস্তাব করেছেন। সংক্ষেপে বলতে গেলে বলতে হয়, বৈশ্বিক অর্থনীতির কাঠামোগত শক্তিগুলো বাজার ও অঞ্চলগুলোকে একীভূতকরণের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তবে অনেক বাজার জাতীয় অর্থনীতির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এবং মানুষের জীবনের বাজারবহির্ভূত এমন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিকও রয়েছে, যা হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। ফলে, আমরা ম্যাকওয়ার্ল্ড এবং জিহাদের মতো পরস্পরবিরোধী ধারণাসমূহের মোকাবিলা করছি (বারবার, ১৯৯৫)। তাহলে বিশ্বায়নের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখা যেতে পারে, এমন একটি নিখাদ বৈশ্বিক সমাজ গড়ে তুলতে হলে বৈশ্বিক ন্যায়বিচারের প্রয়োজনীয় শর্তগুলো পূরণ করা প্রয়োজন। খান (১৯৯৮) কমপক্ষে ৫টি ক্ষেত্র (অন্যগুলোর মধ্যে) উল্লেখ করছেন, যেখানে বৈশ্বিক ন্যায়বিচারের আদর্শগুলো অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে:

১.         আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং মুদ্রা শাসনব্যবস্থা: বর্তমান পরিশোধব্যবস্থা অপ্রতিসম। এই ব্যবস্থায় শুধু ঘাটতি রাষ্ট্রগুলোকেই মুদ্রামান সমন্বয়ের দায় নিতে বাধ্য করার মাধ্যমে শাস্তি দেওয়া হয়। এটিকে একটি বৈশ্বিক দায় ভাগাভাগীকরণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হবে। একইভাবে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থার ঐতিহাসিক অসমতাগুলোকে স্বীকার করে নেওয়া প্রয়োজন। যেমন স্থির প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা অনুসারে বিশেষায়িতকরণের ফলে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলো বিকাশমান বৈশ্বিক শ্রম বিভাজনে তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে যেতে পারে।

২.         আন্তর্জাতিক মূলধনপ্রবাহ: উন্নত অর্থনীতির অনেক মানুষের মতে, এলডিসিগুলোতে মূলধনের প্রবাহ (মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির আওতায় বা বাইরে) তাদের মঙ্গলের পথে ন্যূনত পক্ষে স্বল্প মেয়াদে হলেও একটি বাধা তৈরি করতে পারে। একই সঙ্গে এলডিসিগুলোতে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের ফলে শুধু নিম্ন-বেতন, প্রান্তিক কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারে (উড, ১৯৯৪)। একটি ন্যায়ভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গিতে উত্তর এবং দক্ষিণ উভয় অঞ্চলেই সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের প্রভাবসমূহ বিবেচনা করতে হবে এবং তা অবশ্যই আত্মনির্ধারণের ভিত্তিতে হতে হবে। পারিশ্রমিক এবং কর্মপরিবেশের উন্নয়নের মাধ্যমে দক্ষিণে মূলধনের একটি নিয়ন্ত্রিত প্রবাহই সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত সমাধান হতে পারে।

৩.        আন্তর্জাতিক পরিবেশগত বিবেচনাসমূহ: এই ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আন্তনির্ভরশীলতা ক্রমবর্ধমান হারে স্বীকৃতি পাচ্ছে। তবে উত্তর ও দক্ষিণের মধ্যে সম্পর্ক বিবেচনায় ন্যায়বিচারের দাবিগুলো সুনির্দিষ্ট নয়। অন্য সব বিষয় সমান ধরলে পরিবেশগত আদর্শ মাপকাঠিগুলোর কঠোর বাস্তবায়নই ন্যায়সংগত বলে বিবেচিত হতে পারে। কিন্তু কেউ কেউ যুক্তি দেখান যে এরূপ আদর্শগুলো দক্ষিণের কিছু মানুষের জীবন-জীবিকা ধ্বংস করে দিতে পারে। বৈশ্বিক পরিবেশগত আদর্শ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে একটি বৈশ্বিক কর এবং স্থানান্তর পরিকল্পনা পূর্বশর্ত হিসেবে ধরা যেতে পারে। এই ক্ষেত্রে ন্যায়বিচারের পূর্বশর্ত হচ্ছে ধনী রাষ্ট্রগুলো থেকে দরিদ্র রাষ্ট্রগুলোতে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তিব্যবস্থার হস্তান্তর।

৪.         সম্পদের পুনর্বণ্টন এবং মানব উন্নয়ন: চলমান আলোচনা অধিকাংশ মানুষকে প্রয়োজনীয় সম্পদ প্রদানের কথা বলে, যাতে করে তারা তাদের সামাজিক সক্ষমতাগুলোর উন্নয়ন করতে পারে। অধিকাংশ গবেষণায় (যেমন অ্যাডেলম্যান এবং রবিনসন, ১৯৭৮; খান, ১৯৮৫; জেমস এবং খান, ১৯৯৩) দেখা গিয়েছে যে, দরিদ্রদের সম্পদের পুনর্বণ্টন না করায়, দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে দরিদ্র জনগোষ্ঠী যাতে বাজার সক্ষমতা অর্জন করে সে জন্য সম্পদের পুনর্বণ্টন এবং মানব মূলধনের উন্নয়ন আমাদের নিয়মাত্মক কাঠামোতে একটি জরুরি প্রয়োজন হিসেবে দেখা দিয়েছে। এ জন্য পৃথিবীর অধিকাংশ স্থানে প্রান্তিক নীতিগত হস্তক্ষেপের পরিবর্তে সত্যিকার অর্থে মানব উন্নয়নমুখী কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন হবে।

৫.         জেন্ডার-সম্পর্কিত ন্যায়বিচার: নারীদের ওপর বিশ্বায়নের প্রভাব সতর্কতার সঙ্গে মূল্যায়ন করতে হবে। জেন্ডারবৈষম্য-সম্পর্কিত চমত্কার নথিভুক্ত তথ্যগুলো থেকে দেখা যায় যে নারীদের সক্ষমতাসমূহ নেতিবাচকভাবেই প্রভাবিত হচ্ছে। ফলে দ্ব্যর্থহীনভাবে এই দাবি উঠেছে যে নারীদের সক্ষমতাসমূহ বৃদ্ধি (বা কমপক্ষে হ্রাস না করতে) করতে নীতিনির্ধারকদের সতর্ক দৃষ্টি দিতে হবে। নারীদের অপুষ্টি থেকে শুরু করে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনে অংশগ্রহণের মতো সামাজিক সীমাবদ্ধতাগুলো দূর করতে বিশ্বায়ন কি সাহায্য করবে? দুর্ভাগ্যবশত উত্তরটি পরিষ্কার নয়। এখন পর্যন্ত উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের অনেক নারীই বৈশ্বিক বাজারব্যবস্থার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা ধারণ করেন না, ফলে বিশ্বায়ন ইতিমধ্যেই তাদের ক্ষতি করছে (বিশেষভাবে দ্রষ্টব্য, খান ২০১৪)।

এই পাঁচটি উদাহরণ শুধু দৃষ্টান্তস্বরূপ উপস্থাপন করা হলো। একটি ন্যায়ভিত্তিক বৈশ্বিক অর্থনীতি গড়ে তোলার পথে এগুলো কোনোভাবেই সব বিষয়কে ধারণ করে না। (উদাহরণস্বরূপ বিশ্বায়নের সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে চলা গ্রাম/নগরের বৈষম্য এবং ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে এর প্রভাবের বিষয়টি আমরা যুক্ত বা দৃষ্টিগোচর করতে পারি।) কিন্তু বিষয়গুলো অবশ্যই বিশ্বায়নের যুগে ন্যায়বিচারের সমস্যা এবং সম্ভাবনাগুলোকে তুলে ধরে। যে অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক সমস্যাটি আমরা এখন পর্যন্ত আলোচনা করিনি, তা হলো জাতীয় সার্বভৌমত্বের ক্ষয়। এটি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার দাবির একটি অনিবার্য ফল। ন্যায়বিচারের নীতিসমূহ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একটি বৈশ্বিক উত্পাদন ও বণ্টনব্যবস্থার সঙ্গে সহমত হওয়ার অর্থ হচ্ছে আন্তর্জাতিক চুক্তি, নিয়মাবলি এবং চূড়ান্তভাবে সম্ভবত নতুন আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর কাছে উল্লেখযোগ্য কর্তৃত্ব ছেড়ে দেওয়া। এটা মনে রাখা উচিত যে এমনকি ন্যায়বিচারের নিয়ন্ত্রণধর্মী নিয়মাবলি ছাড়াও, বিশ্বায়ন-প্রক্রিয়া জাতীয় সার্বভৌমত্বকে, এমনকি উন্নত শিল্পায়িত রাষ্ট্রসমূহেরও (যেমন নাফটা) দুর্বল করে দিচ্ছে। সুতরাং, ন্যায়ভিত্তিক অর্থনীতির দাবিকে অবশ্যই যুক্তিসংগত নীতিমালার ভিত্তিতে এর (একই সঙ্গে অন্যান্য বিষয়, যেমন জীবনধারণের ঐতিহ্যগত সংস্কৃতির ক্ষয়) মুখোমুখি হতে হবে। মূল বার্তাটি হচ্ছে এই যে ব্যক্তির যুক্তিসংগত স্বশাসন হিসেবে স্বাধীনতার নীতিটি এসব নীতির মধ্যে প্রধান হতে হবে। এটি একটি (সম্ভবত একমাত্র) যুক্তিসংগত দৃষ্টিকোণ, যদি আমরা জিহাদের স্কিলা এবং ম্যাকওয়ার্ল্ডের ক্রিবডিসকে আমাদের হিসেবে না ধরি।

ম্যাকওয়ার্ল্ড বিশ্বায়নকে অর্থনৈতিক, পুঁজিসংক্রান্ত এবং প্রযুক্তিগত চিড় ধরা কিন্তু বাস্তব একীভূতকরণ হিসেবে দেখেন। ১৯৭০-এর দশকের শুরুর দিকে ব্রেটন উডস চুক্তির পতনের পর পুঁজিবাজারের (সুদের হার এবং মুদ্রা বিনিময় হারসমেত) নিয়ন্ত্রণ হ্রাস করা হয়, ফলে রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে মূলধনের প্রবাহ বৃদ্ধি পায়। তখন পর্যন্ত বিশ্বের আর্থিক ব্যবস্থা ১৯৪৫ সালের ব্রেটন উডস চুক্তির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হতো, যা মুদ্রাগুলো একটি নির্দিষ্ট বিনিময় হার প্রদান করত এবং মুদ্রাগুলোর মূল্য ডলার ও স্বর্ণের ভিত্তিতে নির্ধারিত হতো। নিক্সন প্রশাসন ১৯৭১ সালে এই ব্যবস্থা বাতিল করে এবং এর পরিবর্তে নিয়ত পরিবর্তনশীল মুদ্রা বিনিময় হার চালু হয়। এর মাধ্যমে বিশ্ববাজারের ভিত্তিমূল স্থাপিত হয়।

এটি উদারীকরণ, বেসরকারীকরণ এবং নিয়ন্ত্রণ হ্রাসের নব্য উদার মুক্তবাজার মতবাদের পুনরুত্থানের মাধ্যমে জোরদার হয় এবং রাজনৈতিক রক্ষণশীলদের উত্থানের পর—যুক্তরাষ্ট্রে রিগান এবং যুক্তরাজ্যে থেচার—একমাত্র নীতিতে পরিণত হয়। ভূতপূর্ব সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর পতন এবং একটি প্রভাবশালী ও অবিসংবাদিত চিন্তাপদ্ধতি হিসেবে নব্য-উদারতাবাদের আবির্ভাবের পর এটি আরও জোরদার হয় (ফক, ১৯৯৭)। এসব বিষয় মূলধনি যন্ত্রপাতিসহ পণ্য, সেবা এবং পুঁজির মুক্ত প্রবাহের একটি সহায়ক পরিবেশ তৈরি করার মাধ্যমে একটি একীভূত বৈশ্বিক অর্থনীতি তৈরি করছে। খান (২০০৩) এই ধরনের চিড় ধরা ও পরস্পরবিরোধী, কিন্তু তা সত্ত্বেও একীভূত বৈশ্বিক অর্থনীতিকে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন। বিশেষত উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোতে যদি আমরা বিশ্বায়নের প্রভাবগুলো আমলে নিয়ে প্রশ্ন করি, যেমনটা এর প্রবক্তারা দাবি করেছিলেন, প্রক্রিয়াটি তেমনটা কাজ করছে না কেন। উন্নত বিশ্বে এর প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার জন্য স্টিগলিত্স (২০০৬) একটি ভালো উত্স।

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের জন্য একটি সামাজিক সক্ষমতা নীতিতত্ত্ব

বিশ্বে নব্য-উদারতাবাদের সমস্যাগুলো বুঝতে স্টিগলিত্স এবং অন্যরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। যেমনটা এই প্রবন্ধে আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, আমরা এখানে এসব ইতিবাচক বিশ্লেষণকে বিশ্বায়ন এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের নিয়মাত্মক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে একীভূত করার চেষ্টা করেছি। সেন এবং অন্যদের মতে, কার্ডিনাল বা অর্ডিনাল উপযোগবাদের কিছু ঐতিহ্যগত অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি খুবই সংকীর্ণ। রউলীয় প্রাথমিক পণ্য দৃষ্টিভঙ্গি বেশ বিস্তৃত হলেও, বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ধারার এই পৃথিবীতে ইতিবাচক ও নিয়মাত্মক ধারণাগুলোর সর্বাঙ্গীন একীভূতকরণে এটার কিছু সীমাবদ্ধতা আছে (সেন ১৯৯২, খান ১৯৯৮)। বিকল্প হিসেবে সক্ষমতা দৃষ্টিভঙ্গি প্রস্তাব করা যেতে পারে। নুসবম (১৯৯৫) সক্ষমতার তালিকাসমেত একটি ‘অ্যারিস্টটলীয়’ দৃষ্টিভঙ্গি প্রস্তাব করেছেন। তবে সেন কোনো একটি সুনির্দিষ্ট তালিকা অনুমোদন করতে ততটা উত্সুক নন। খান (১৯৯৮, ২০০৩) সমর্থিত ‘হেগেলীয়’ সামাজিক সক্ষমতা দৃষ্টিভঙ্গিতে একটি নির্দিষ্ট সমাপ্তহীন তালিকা গ্রহণ করা হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে একটি গতিশীল ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে সরলীকরণের অযোগ্য সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের ভিত্তিতে সক্ষমতার ওপর জোরারোপ করা হয়েছে।১ এসব বৈশিষ্ট্য আমলে নিয়ে করা একটি ব্যাখ্যামূলক তালিকা সক্ষমতা নীতিশাস্ত্র-সম্পর্কিত সুনির্দিষ্ট আলোচনার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে।

বিশেষত অর্থসংস্থানের বিশ্বায়নের ক্ষেত্রে সঠিকভাবে পরিকল্পিত একটি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে যুক্তিসিদ্ধ অর্থসংস্থান এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি একসঙ্গে চলতে পারে। তবে প্রবৃদ্ধির ফলাফল অবশ্যই মানব মঙ্গলের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করতে হবে। আদর্শ উপযোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে এটা করার জন্য একটি যথার্থ সামাজিক কল্যাণ ক্রিয়া (এসডব্লিউএফ বা Social Welfare Function) বাছাই করা যেতে পারে, যেখানে উপার্জনের মাত্রা এবং উপার্জনের বণ্টন উভয়ই আলোচিত হবে। একটি নির্দিষ্ট মাত্রার উপার্জনের ক্ষেত্রে সমতাকে প্রাধান্য দেওয়ার জন্য কৌশলগতভাবে নির্দিষ্ট এসডব্লিউএফগুলোই গ্রহণীয়।২

অ্যাডাম স্মিথের পরিজ্ঞানগুলোর ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন তাত্ত্বিক কল্যাণের একটি অধিক বিস্তারিত মূল্যায়ন প্রস্তাব করেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে ‘সক্ষমতা দৃষ্টিভঙ্গি’র প্রবর্তক হচ্ছেন অমর্ত্য সেন। উপযোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গির তাত্ত্বিক সমালোচনা করতে গিয়ে সেন, নুসবম এবং অন্যরা বলেছেন যে এই দৃষ্টিভঙ্গিতে সব গুণকেই উপযোগের বাক্সে বন্দী করা হয়েছে। এটিই এই দৃষ্টিভঙ্গির সবচেয়ে কঠোর সমালোচনা। নুসবম-এর একটি দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ এবং বিষাদ-জর্জরিত বাবা মি. গ্রেডগ্রাইন্ড এবং তার ছাত্র বিটজারের মধ্যে একটি ঘটনাকে উদ্ধৃত করে। উপযোগবাদী যৌক্তিকতার কঠোর নিয়ম অনুসরণের ক্ষেত্রে বিটজার তার গুরুকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন, এ ক্ষেত্রে একজন বাবার বিষাদ হূদয়ঙ্গম করার কোনো স্থান ছিল না। আমিও আমার সাম্প্রতিক কিছু প্রবন্ধ এবং আমার বই টেকনোলজি, ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ডিমোক্রেসিতে৩ একই ধারার সমালোচনার উল্লেখ করেছি। এই দৃষ্টিভঙ্গি সক্ষমতাকে স্পষ্টভাবে সামাজিক বিষয়ে পরিণত করে এবং প্রশ্ন করে: অর্থনৈতিক (বাস্তব এবং অর্থনৈতিক) এবং অন্যান্য (যেমন রাজনৈতিক, সামাজিক ইত্যাদি) প্রতিষ্ঠানের কোন শ্রেণিপরম্পরা সক্ষমতাকে একই সঙ্গে গড়ে সুস্থিতভাবে বৃদ্ধি পেতে এবং বিভিন্ন বৈচিত্র্যপূর্ণ ব্যক্তির মধ্যে সেগুলোকে সমকক্ষ হতে দেবে? কার্যত আমরা জিজ্ঞেস করি: আমরা কীভাবে ব্যক্তির জন্য বাস্তব ও ইতিবাচক স্বাধীনতা বৃদ্ধি এবং সমতা আনয়ন করতে পারি এবং নিচের আলোচনা তা আরও স্পষ্ট করবে।

তাই বিশেষত সুস্থির বৈশ্বিক আর্থিক সংস্থানের এবং সাধারণভাবে বিশ্বায়নের মঙ্গলজনক প্রভাবগুলো আলোচনা করতে আমি সামাজিক সক্ষমতা দৃষ্টিভঙ্গির একটি প্রকরণ বেছে নিয়েছি। এখানে কল্যাণের বিস্তারিত অভিজ্ঞতালব্ধ সূচকগুলো এবং এগুলো কীভাবে একটি সংকট এবং তার পরবর্তী অবস্থা দ্বারা প্রভাবিত হয় তা উপস্থাপন করা আমার লক্ষ্য নয়। এটা ভবিষ্যতে কোনো এক প্রবন্ধে আলোচনা করা হবে। এখানে আমি শুধু স্পষ্টভাবে সংস্কারের ফলাফলগুলো মূল্যায়নের ধারণাগত সমস্যাগুলো আলোচনা করতে চাই। এখানে যেসব প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এবং পরিবর্তনগুলো প্রস্তাব করা হলো বা বিশেষজ্ঞরা অন্য যেসব বিকল্প কাঠামো প্রস্তাব করেছেন, সেগুলো অবশ্যই সক্ষমতা বৃদ্ধিকারী হতে হবে বা কমপক্ষে সক্ষমতা হ্রাসকারী হবে না। কিন্তু এখনো প্রথমে আমাদের প্রশ্ন করতে হবে: মূর্ত এবং বিমূর্তভাবে সক্ষমতা বলতে কী বোঝায়?

সক্ষমতাকে মানবদেহ এবং মনের সাধারণ শক্তি হিসেবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে, যা অর্জন, রক্ষণাবেক্ষণ, লালন এবং উন্নত করা যায়। এগুলো খর্ব করা বা একেবারে হরণ করাও যেতে পারে (বিশেষ পরিস্থিতিতে যেমন অপুষ্টি বা দুঃসহ কারাবাস)। আমি অন্যখানে এসব মানব সক্ষমতার সামাজিক (শুধু শারীরবৃত্তীয় নয়) অমোচনীয়তার বিষয়ে জোরারোপ করেছি। সেন নিজেই ‘কর্মক্ষম হওয়ার জন্য একটি নির্দিষ্ট ধরনের সম্ভাবনা বা সুযোগের’ ওপর জোরারোপ করেছেন।

সক্ষমতা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অর্থনৈতিক সংস্কার এবং কাঠামো মূল্যায়ন করতে আমাদের আরও গভীরে প্রবেশ করতে হবে এবং কিছু মৌলিক সক্ষমতা কী হতে পারে তা সুনির্দিষ্টভাবে বর্ণনা করতে হবে। ডেভিড ক্রোকার সাম্প্রতিক এক প্রবন্ধে নুসবম এবং সেন উভয়েরই সক্ষমতার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির একটি প্রশংসনীয় সংক্ষিপ্তসার প্রদান করেছেন। প্রধানত নুসবম হলেও অন্য আরও কিছু উেসর ওপর নির্ভর করে তিনি একটি তালিকা তৈরি করেছেন, যা এখানে পুনরায় উল্লেখযোগ্য:

মৌলিক প্রায়োগিক মানব সক্ষমতাসমূহ (ন দ্বারা নুসবম এবং স দ্বারা সেন বোঝানো হয়েছে। উদ্ধৃতি চিহ্নযুক্ত অংশ নুসবম থেকে নেওয়া এবং অন্যগুলোর উত্স উল্লেখ করা হয়েছে)।

১.         নৈতিকতা বিষয়ে সক্ষমতা

১.১.      ন এবং স: যতদূর সম্ভব মানব জীবনের সম্পূর্ণ শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারা

১.২.      ন: সাহসী হতে পারা

২.         শারীরিক সক্ষমতা

২.১.      ন এবং স: ভালো স্বাস্থ্য রক্ষা করতে সক্ষম হওয়া

২.২.      ন এবং স: যথেষ্টভাবে পুষ্টি অর্জনে সক্ষম হওয়া

২.৩.     ন এবং স: প্রয়োজনীয় আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে পারা

২.৪.      ন: ‘যৌন পরিতৃপ্তি অর্জনের সুযোগ পাওয়ায় সক্ষম হওয়া’

২.৫.      ন এবং স: এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াতে সক্ষম হওয়া

৩.        পরিতোষ

৩.১.     ন এবং স: অপ্রয়োজনীয় এবং অনুপকারী যন্ত্রণা এড়িয়ে যাওয়ায় এবং আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা অর্জনে সক্ষম হওয়া

৪.         জ্ঞানীয় গুণাবলি

৪.১.      ন: ‘পঞ্চ ইন্দ্রিয় ব্যবহারে সক্ষম হওয়া’

৪.২.      ন: ‘কল্পনা করতে সক্ষম হওয়া’

৪.৩.     ন: ‘চিন্তা করতে এবং যুক্তি প্রদর্শনে সক্ষম হওয়া’

৪.৪.      ন এবং স: গ্রহণযোগ্যভাবে ওয়াকিবহাল হওয়া

৫.         অন্তর্ভুক্তি-১ (সহানুভূতি)

৫.১.      ন: ‘নিজেদের বাইরে অন্য বিষয় এবং ব্যক্তির সঙ্গে সংযুক্ত থাকাতে সক্ষম হওয়া’

৫.২.      ন: ‘ভালোবাসতে, শোকার্ত হতে, স্পৃহা এবং কৃতজ্ঞতা অনুভব করতে সক্ষম হওয়া’

৬.        বাস্তব যুক্তিবৃত্তির গুণ (ক্রিয়া)

৬.১.     ন: ভালো সম্পর্কে ধারণা তৈরিতে সক্ষম হওয়া

            স: ‘বেছে নেওয়ার সক্ষমতা’; লক্ষ্য, প্রতিশ্রুতি এবং মূল্যবোধ নির্ধারণে সক্ষম হওয়া

৬.২.     ন এবং স: একজনের নিজের জীবনের পরিকল্পনা সম্পর্কে সমালোচনামূলক ভাবনা প্রদানে সক্ষম হওয়া

৭.         অন্তর্ভুক্তি-২ (বন্ধুত্ব এবং ন্যায়বিচার)

৭.১.      ন: ‘অন্যের সঙ্গে এবং অন্যের জন্য বাঁচাতে, অন্য মানুষকে স্বীকৃতি প্রদানে এবং তার জন্য বিচলিত হতে, বিভিন্ন ধরনের পারিবারিক এবং সামাজিক মিথষ্ক্রিয়ায় অংশগ্রহণে সক্ষম হওয়া’

৭.১.১.  ন: বন্ধুত্ব স্থাপনে সক্ষম হওয়া

            স: বন্ধুদের দেখতে যেতে এবং তাদের বিনোদিত করতে সক্ষম হওয়া

৭.১.২.   স: গোষ্ঠীতে অংশগ্রহণের সক্ষমতা

৭.১.৩.  ন: রাজনৈতিকভাবে অংশগ্রহণের এবং ন্যায়বিচারের সক্ষমতা

৮.        পরিবেশগত গুণ

৮.১.     ন: ‘জীবজন্তু, গাছপালা এবং পরিবেশের সঙ্গে বসবাস করতে এবং এগুলোর প্রতি সংস্রব রাখতে সক্ষম হওয়া’

৯.         অবসর

৯.১.     ন: ‘হাসতে, খেলতে এবং বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ড উপভোগ করতে সক্ষম হওয়া’

১০.       বিচ্ছিন্নতাবোধ

১০.১.   ন: নিজের জীবন নিজের মতো করে বাঁচতে সক্ষম হওয়া

১০.২.    ন: ‘নিজস্ব পরিবেশ এবং পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকাতে সক্ষম হওয়া’

১১.       আত্মসম্মান

১১.১.   স: ‘আত্মসম্মান থাকার সক্ষমতা’

১১.২.    স: ‘লজ্জা ব্যতিরেকে প্রকাশ্যে উপস্থিত হওয়ার সক্ষমতা’

১২.       মানব সমৃদ্ধি

১২.১.    ন: ‘স্বাভাবিক সম্ভাবনাগুলোর সর্বশেষ সীমা পর্যন্ত একটি বৈচিত্র্যময় এবং পরিপূর্ণ মানবিক জীবনযাপনের সক্ষমতা’

১২.২.    স: ‘মূল্যবান কর্মক্ষমতা অর্জনের সক্ষমতা’

এই ক্রমধারা বজায় রাখতে অন্য গুণাবলিতে বাস্তবিক যৌক্তিকতা এবং সংসর্গ সঞ্চারিত করা প্রয়োজন। তবে বিন্যস্ত না করাই তুলনামূলকভাবে ভালো হতে পারে। ক্রোকার, সেনের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে নুসবমের দৃষ্টিভঙ্গির তুলনা করেছেন। কয়েকটি ক্ষেত্রে সেন ও নুসবমের তালিকার মধ্যে পার্থক্য দেখা যায়। সেনের কাছে শারীরিক সক্ষমতা এবং কর্মক্ষমতা (২) অন্তর্নিহিতভাবেই ভালো এবং অন্য ভালো (উচ্চতর) কিছুর জন্য শুধু সহায়কমাত্র নয়; যেমনটা ভালো জীবনের কিছু দ্বৈতবাদী তত্ত্বে ধরে নেওয়া হয়। অ্যারিস্টটলকে ব্যাখ্যা করে নুসবম শারীরিক কর্মক্ষমতা যেগুলো মনোনীত ও ইচ্ছাকৃত, যেমন ‘নিজের পুষ্টিবিধান এবং প্রজনন কাজ, যা যুক্তিচালিত জীবনের একটি অংশ তৈরি করে’—এবং অন্যান্য কাজ যেগুলো ইচ্ছাকৃত নয়, যেমন হজম এবং অন্যান্য ‘ঘুমের মধ্যকার শারীরিক ব্যবস্থার কাজ’ (আসন্ন)—তার মধ্যে পার্থক্য করেছেন। তিনি সম্ভবত বলতে চেয়েছেন যে ইচ্ছাকৃত শারীরিক কর্মকাণ্ডগুলো যা পুষ্টিকর এবং স্বাস্থ্যকর অবস্থার দিকে পরিচালিত করে, তা অন্তর্নিহিতভাবেই ভালো। কিন্তু স্বাস্থ্যবান হওয়া বা ভালো পরিপাকব্যবস্থা থাকা কর্মদক্ষতা নয় (কারণ তা ইচ্ছাকৃত নয়) এবং তা শুধু মূল্যবান এ কারণে যে তা আমাদের অন্য কতগুলো কাজ করতে সক্ষম করে। তার জন্য আরেকটি পথ খোলা থাকতে পারে, তা হলো সেনের অভিমত গ্রহণ করা। সেনের মতে, শারীরিক অবস্থা এবং প্রক্রিয়াগুলো—ইচ্ছাকৃত হোক বা না হোক—অন্তর্নিহিতভাবে এবং সহায় হিসেবে ভালো; কিন্তু অন্যান্য সহজাত ভালো সক্ষমতা/কর্মক্ষমতাগুলোর চেয়ে কম মূল্যবান।

অধিকন্তু, নুসবম ৫ এবং ৮-১০ নম্বর বিষয় যোগ করেছেন, সেনের কাছে যার কোনো পরিপূরক নেই। এই বিষয়গুলো সমাদৃত বৈশিষ্ট্য। বিষয়-৮, যেটিকে আমি ‘পরিবেশগত গুণ’ বলেছি, নুসবমের দৃষ্টিভঙ্গিতে সাম্প্রতিক সময়ে যুক্ত হওয়া একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এটা এমন একটা সময় যখন অনেকে পরিবেশগত নৈতিকতা এবং উন্নয়ন নৈতিকতার মধ্যকার একাভিমুখিতাকে প্রভাবিত করার পথ খুঁজছেন। তাই অন্যান্য প্রজাতি এবং বাস্তুতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধার জন্য মানবকেন্দ্রিক নৈতিকতার একটি ক্ষেত্র তৈরি করা প্রয়োজন। নুসবমের ‘পরিবেশগত গুণ’ যথেষ্ট শক্তিশালী কি না তা বিবেচনাযোগ্য। হয়তোবা এটাকে এমনভাবে পাঠ করা যেতে পারে: ‘অন্তর্নিহিতভাবে মূল্যবান হিসেবে জীবজন্তু, গাছপালা এবং পরিবেশের সঙ্গে বসবাস করতে এবং এগুলোর প্রতি সংস্রব রাখতে সক্ষম হওয়া’। বেশ আন্তরিকভাবে তৈরি করা এই তালিকায় ৯ নম্বর বিষয়টি কিছুটা কৌতুকপ্রবণতার অবতারণা করেছে। নুসবমের তালিকায় এই বিষয়গুলোর উপস্থিতি এবং সেনের তালিকায় সেগুলোর অনুপস্থিতি এবং আরও সাধারণভাবে, নুসবমের ব্যাখ্যায় প্রায়ই দেখতে পাওয়া অধিক মূর্ত বয়ন কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায়? একটি প্রস্তাব হচ্ছে, এই পার্থক্যগুলোর কারণ হচ্ছে তার লেভেল-১-এ সীমাবদ্ধতা, ভঙ্গুরতা এবং মানব অস্তিত্বের প্রয়োজনীয়তার ওপরে নুসবমের অধিক গুরুত্ব দেওয়া। অন্যদিকে এমনটা হতে পারে যে মানবজাতি সম্পর্কে নুসবমের সমৃদ্ধতর ধারণা, বৈজ্ঞানিক ধীশক্তি থেকেও অনেক বেশি গল্প-বলিয়ের কল্পনা কাজে লাগানো থেকে তৈরি। অন্যদিকে, সেন আত্মসম্মানের ভালো দিকটি যোগ করেছেন, একটি গুণ যা তাকে রউলসের অভিন্ন অবস্থানে এনেছে। এটি তাকে কান্টিয় নৈতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে সক্ষম করেছে, যেখানে নৈতিক কর্তাদের নিজেদেরসহ অন্য সবাইকে শ্রদ্ধা করার বাধ্যবাধকতা ছিল।

তবে সেন ও নুসবম উভয়ই একমত হন যে এই সক্ষমতাগুলো স্বতন্ত্র এবং খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কোনো ব্যক্তির পক্ষে এর কোনো একটির বিনিময়ে অন্যটি অর্জন করা সহজ নয়। খুব বেশি হলে, একজন ব্যক্তি খুবই সংকীর্ণ পথে এমনটা করতে পারে। এ বিষয়গুলোকে কখনো উপযোগের মতো সংকীর্ণ করা যায় না। অর্থাত্ প্রতিটি সক্ষমতাই গুণগতভাবে স্বতন্ত্র। টাকা কিংবা অন্য কোনো সাধারণ মাপকের ভিত্তিতে এগুলোকে সামগ্রিকভাবে একীভূত মাপজোকে প্রকাশ করা অসম্ভব।

যেমনটা ক্রোকার উল্লেখ করেছেন, সাধারণ আয় বণ্টন বিবেচনার বাইরে গিয়ে স্বাধীনতা, অধিকার এবং ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে ‘সক্ষমতা নৈতিকতা’র প্রভাব রয়েছে। যদি কেউ সক্ষমতা দৃষ্টিভঙ্গিকে মানব উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হিসেবে মেনে নেয়, তাহলে অর্থনৈতিক নীতিমালার প্রভাব পুরোপুরি মূল্যায়নের জন্য বণ্টনভিত্তিক ন্যায়বিচারকে ছাড়িয়ে যাওয়া প্রয়োজন।

এই দৃষ্টিকোণ থেকে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক শাসনব্যবস্থা এবং জাতীয় অর্থনৈতিক নীতিমালাগুলোকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে আমরা শুধু দক্ষতার প্রশ্নটিই তুলতে চাই না, বরং মানব মুক্তি-সম্পর্কিত সব প্রশ্ন উত্থাপনের ইচ্ছা রাখি। বিশেষত কিছু কাজ করার জন্য ইতিবাচক মানবমুক্তির বিষয়টি। সুতরাং, একটি ভারসাম্যহীন লাভ বণ্টনব্যবস্থার দিকে নিয়ে গেলেও, বাজার তৈরি এবং দক্ষ উত্পাদন নিজে থেকে খুব কম অর্থই বহন করে। রীতিমতো ভয়াবহ হচ্ছে, যদি বাজার এবং অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো আয়ুষ্কালের হ্রাস, বেকারত্ব বৃদ্ধি, অনেকের জন্য ভোগের মাত্রা হ্রাস, কিছু গোষ্ঠী যেমন নারী ও সংখ্যালঘুদের বঞ্চিত করার মতো ধারণাগুলোর দিকে চালিত করে, তবে এগুলো এমনকি দুর্বলভাবেও ন্যায়সংগত বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কাঠামো হিসেবে গণ্য হবে না। বিপরীত দিকে, এমন পরিস্থিতিতে সক্ষমতা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বৈশ্বিক বাজার এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান  দৃঢ়ভাবে অন্যায্য হয়ে উঠবে।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক বাজার এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর সমস্যাসমূহের পূর্বেকৃত ইতিবাচক বিশ্লেষণকে একটি সম্পূর্ণ স্বচ্ছ ‘সামাজিক সক্ষমতা’ কাঠামোতে ফেলতে হবে। এ রকম কাঠামোটি সম্পূর্ণ নিয়মাত্মক। এটি পশ্চাদপদদের তাদের সক্ষমতাগুলোকে বৃদ্ধিতে সাহায্য করার মাধ্যমে তাদের সক্ষমতার সমতা অর্জনের দিকে চালিত করতে একটি দৃঢ় নৈতিক অবস্থান গ্রহণ করে। তাই যেকোনো প্রস্তাবিত বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কাঠামোতে বৈশ্বিক অর্থনীতির দরিদ্র জাতিগুলো এবং দরিদ্র মানুষেরা একটি বিশেষ নৈতিক মনোযোগের যোগ্য। যেমনটা নব-প্রবর্তিত কাঠামোর বর্ধিত উত্পাদনের আলোকে খান (১৯৯৮) দেখিয়েছেন, শেষতক যেকোনো উত্পাদন বৃদ্ধির লক্ষ্য হতে হবে মানুষের স্বাধীনতা বৃদ্ধি করা। সেনের (১৯৯৯) মতে, এ রকম স্বাধীনতার একটি সহায়ক এবং একটি চূড়ান্ত মূল্য আছে। সামাজিক সক্ষমতা হিসেবে স্বাধীনতা আরও উত্পাদন বৃদ্ধির দিকে ধাবিত করতে পারে। সুতরাং এমনকি দৃঢ়সংকল্প, দক্ষতানির্ভর বিশ্লেষণেও একটি প্রায়োগিক বিষয় হিসেবে এগুলোকে অবশ্যই আলোচনায় আনতে হবে।

এখন পর্যন্ত এই প্রবন্ধের লক্ষ্য হচ্ছে, কীভাবে মন্দ তত্ত্ব খারাপ নীতিমালার দিকে পরিচালিত করে তা দেখানো। তত্ত্বগুলো বাম, ডান বা মধ্যবর্তী যে মতাদর্শীই হোক না কেন। একইভাবে, সবার জন্য ন্যায্যতা এবং কল্যাণের মতো গুরুতর নৈতিক বিষয়গুলো নিশ্চিত করা না গেলে, তা একটি বিক্ষুব্ধ সমাজের দিকে চালিত করতে পারে। যখন আমরা এমন একটি বৈশ্বিক সমাজ নির্মাণের দিকে ধাবিত হব, যেখানে সাংস্কৃতিক ও সামাজিক আচরণের পার্থক্যগুলো ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ এবং সমৃদ্ধ বৈচিত্র্যের মধ্যে প্রকাশিত হওয়ার মাধ্যমে আমরা কল্যাণের দিকে চালিত হব এবং এসব বিষয়কে সমানভাবে সম্মান জানানো হবে; তখন আমরা পুরোনো অর্থনৈতিক কাঠামো সংস্কারের মাধ্যমে বৈশ্বিক নাগরিকত্বের একটি স্পষ্ট নৈতিক দৃষ্টিকোণ নিয়ে নতুন অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান তৈরির বাস্তবিক চেষ্টা করতে পারব। দক্ষতা ও ন্যায্যতা দুটিই গুরুত্বপূর্ণ এবং মাঝে মাঝে দুটো একসঙ্গেই অর্জন করা যেতে পারে। অন্য সময়ে স্বল্পমেয়াদে হলেও এগুলোর মধ্যে ছাড় দেওয়ার বিষয়টি অবশ্যই সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। এই ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক তত্ত্বের অগ্রগতি, ইতিবাচক এবং নিয়মাত্মক উভয়ই একটি পরিমিত কিন্তু উপকারী ভূমিকা পালন করতে পারে। সুতরাং, সংকট নিবারণ ও ব্যবস্থাপনার জগতে যেকোনো অর্থনৈতিক ব্যবস্থাতেই ব্যয় কমানো ও লাভ বাড়ানোর ক্ষেত্রে তা অবশ্যই ইতিবাচক অর্থনৈতিক তত্ত্ব এবং অর্থনৈতিক নৈতিকতার অগ্রগতি উভয়ের দ্বারাই চালিত হতে হবে। নিচের দুটি অংশে সাধারণভাবে উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্য এবং এশীয় অর্থনৈতিক সংকটের ক্ষেত্রে বিশ্বায়নের প্রভাব আলোচিত হবে। সাধারণ এবং বিশেষ উভয় দৃষ্টিকোণ থেকেই প্রধান প্রস্তাব অর্থাত্ অকপট নব্য-উদারবাদী দৃষ্টিভঙ্গির বিপদসমূহ এখানে প্রতিপাদিত হয়েছে। অধিকন্তু, (সামাজিক) সক্ষমতা বৃদ্ধিকারক নীতিমালার প্রয়োজনীয়তাও এখানে প্রতিপাদিত হয়েছে।

বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল রাষ্ট্রসমূহের জন্য প্রভাবসমূহ

উন্নয়নশীল রাষ্ট্রসমূহের কল্যাণ এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপর বিশ্বায়নের প্রভাববিষয়ক সনির্বন্ধ আলোচনাগুলো পাঠের সময় একটি দৃষ্টিভঙ্গি প্রভাবশালী হিসেবে প্রতীয়মান হয়। দৃষ্টিভঙ্গিটি হচ্ছে, প্রগাঢ় অর্থনৈতিক একীভূতকরণের ফলে উত্পাদনের নিয়ামক হিসেবে পণ্য এবং সেবাসমূহের প্রবাহ বৃদ্ধি পাবে; ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং জনগণের কল্যাণ অগ্রসর হবে। এটা বিশ্বাস করা হয় যে বিশ্বায়নের ফলে একটি উন্নততর শ্রম বিভাজন তৈরি হবে। ফলে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলো (যেখানে প্রচুর শ্রমিক রয়েছে) শ্রমঘন পণ্যগুলোতে বিশেষায়িত হবে এবং উন্নত রাষ্ট্রগুলো তাদের শ্রমিকদের অধিক উত্পাদনশীল খাতে নিয়োজিত করতে পারবে (দ্য ইকোনমিস্ট, ১৯৯৭ক)। আরও যুক্তি দেখানো হয় যে বিশ্বায়নের ফলে উত্পাদনশীল বিনিয়োগ সুযোগ অনুসারে মূলধনের প্রবাহ নিশ্চিত হবে, ফলে মূলধনের বিপরীতে লাভের পরিমাণও বৃদ্ধি পাবে।

অন্যরা (ফক, ১৯৯৭; খান, ১৯৯৬; সেন, ১৯৯৭, ১৯৯৯; স্টিগলিত্স, ২০০২, ২০০৬) এই যুক্তি নাকোচ করে দেন এবং বলেন যে বিশ্বায়ন এবং আঞ্চলিকায়ন অধিকাংশ ক্ষেত্রে শক্তিশালী অর্থনৈতিক সত্তাদের লাভবান করছে, ফলে দুর্বল রাষ্ট্র এবং অঞ্চলগুলোর প্রান্তিকায়ন ঘটছে। এটা বলা হয় যে বিশ্বায়ন সেবা খাতসমূহের এবং দক্ষ শ্রমিকের গুরুত্ব বৃদ্ধি করলেও একই সঙ্গে প্রাথমিক পণ্য এবং অদক্ষ শ্রমিকদের গুরুত্ব হ্রাস করছে। জীবপ্রযুক্তি, মাইক্রোইলেকট্রনিকস এবং এ রকম খাতে ঘটে যাওয়া বিপ্লবগুলো কাঁচামালের গুরুত্ব কমিয়ে দিয়েছে। ফলে, প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর যে রাষ্ট্রসমূহকে একসময় সমৃদ্ধিশালী হিসেবে গণ্য করা হতো, এখন তারা আর ধনী রাষ্ট্রের তালিকাতে স্থান পাচ্ছে না। এটা বিস্ময়ের বিষয় নয় যে আজকের বিশ্বের সবচেয়ে ধনী মানুষ হচ্ছে মাইক্রোসফটের মালিক বিল গেটস। প্রযুক্তির উন্নয়ন শুধু জোগান কাঠামোতেই পরিবর্তন আনেনি, এটা তাদের গুরুত্বেরও পরিবর্তন ঘটিয়েছে। আধুনিক কলকারখানাগুলো কম প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করে, ফলে প্রতিযোগিতামূলক সূচকে প্রাকৃতিক সম্পদের মর্যাদা হ্রাস পেয়েছে। আধুনিক অর্থনীতিতে প্রযুক্তি, জ্ঞান ও দক্ষতা তুলনামূলক প্রাধান্যের একমাত্র উেস পরিণত হয়েছে (থরো, ১৯৯৬)। এ রকম পরিস্থিতি প্রধানত প্রাথমিক পণ্য এবং অদক্ষ শ্রমিক রপ্তানিকারক উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোকে অসুবিধাজনক অবস্থানে ঠেলে দিয়েছে।

অন্যদিকে, বিশ্বায়ন ইতিমধ্যে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোকে বৈশ্বিক বাজারের নিয়মনীতি অনুসারে চলতে বাধ্য করছে। ফলে তাদের জাতীয় উন্নয়ন নীতিমালার গুরুত্ব সীমাবদ্ধ হচ্ছে (খান, ১৯৯৮, ২০০৪ক, ২০০৪খ; চেঙ, ২০০৭; বনভিন, ১৯৯৭)। অর্থনীতিবিদেরা দীর্ঘ সময় ধরে এটা জানেন যে যখন মূলধন অবাধে আন্তসীমান্তে প্রবাহিত হয়, তখন জাতীয় অর্থনৈতিক নীতিমালার স্বতন্ত্রতা এবং গুরুত্ব বিলীন হয়ে যায়।

অধিকন্তু, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক বাজার এবং উচ্চমাত্রার সঞ্চরণশীল ব্যক্তি খাতে পুঁজির প্রবৃদ্ধি, মুদ্রা বিনিময় হার এবং কার্যকর ও সুস্থির সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতিমালা প্রণয়নে রাষ্ট্রসমূহের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সক্ষমতাকে দুর্বল করে দেয় (খান, ২০০৪খ; আঙ্কটাড, ২০০৬, ২০০৭)।

সুতরাং, প্রবৃদ্ধি ও বণ্টনের দৃষ্টিকোণ থেকে সার্বিকভাবে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রসমূহ হেরে যাচ্ছে। চীন এবং এর পূর্বে পূর্ব এশীয় অর্থনীতিগুলোর সাফল্য ছিল কৌশলগত একীভূতকরণনির্ভর, যেখানে জাতীয় বাণিজ্য, শিল্প ও আর্থিক নীতিমালাগুলো তুলনামূলকভাবে স্বতন্ত্র ছিল। উচ্চপ্রবৃদ্ধির সময় অসমতা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং অভ্যন্তরীণ চাহিদা মজুত ব্যবহারের মাধ্যমে বাড়ানো যেত। মজার বিষয় হচ্ছে, চীন এখন প্রচুর পরিমাণে মার্কিন সরকারের স্বল্প-প্রদায়ী বন্ড কেনার মাধ্যমে, বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশের খুব ধনীদের অপব্যয়ী ব্যয়ের ধরনকে অর্থসংস্থানের ক্ষেত্রে সহায়তা করছে। এর পেছনে পদ্ধতিগত কারণ রয়েছে। কিন্তু এটা অস্বীকার করা যাবে না যে এই ব্যবস্থা বৈশ্বিক অর্থনীতিকে সার্বিকভাবে একটি সংকোচননির্ভরতা দিয়েছে এবং চীনের অভ্যন্তরে জীবনমান নিম্ন রেখেছে। ফলে তুলনামূলক অধিক দরিদ্ররা প্রায় এই তিন দশকের প্রবৃদ্ধি থেকে সমানভাবে উপকার ভোগ করতে পারেনি। যখন ১৯৯০-এর দশকে পূর্ব এশীয় অর্থনীতিগুলো সাফল্যের সঙ্গে তাদের আর্থিক বাজারকে উদারীকরণ করেছিল, পশ্চিমা করপোরেট স্বার্থচালিত বিশ্বায়নের আসল বিপদ তখন ঘরে প্রবেশ করে। এরপরই তারা সবচেয়ে তীব্র অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন হয় (খান, ২০০৪; স্টিগলিত্স, ২০০২, ২০০৬)। প্রধানত নিজেদের ক্যাপিটাল অ্যাকাউন্ট উদারীকরণ করতে অস্বীকার করার মাধ্যমে চীন ও ভারত এই সংকট থেকে নিজেদের রক্ষা করেছিল।

বিশ্বায়নের অসংগতিসমূহের একটি উদাহরণ: এশীয় আর্থিক সংকটের সময় এশীয় মিরাকল থেকে এশীয় বিপর্যয়

বিশ্বে বিকাশমান অর্থনৈতিক একীভূতকরণের অন্তর্নিহিত অস্থিরতাগুলোর একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সংকট, যা প্রথমে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে শুরু হয় এবং পরে কোরিয়াকেও আক্রান্ত করে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং কোরিয়াতে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর ফলে জাপানের মন্দা এবং ঋণ ঘনায়মান হওয়াও কিছুটা খারাপ মোড় নেয়। এই সংকট এবং এর প্রভাব আলোচনা করতে হলে এশীয় মিরাকল এবং বিশ্বায়ন সম্পর্কে একটি অনুত্তেজিত দৃষ্টিভঙ্গি রাখা প্রয়োজন।

সংকটটির সংক্ষিপ্ত পুনঃস্মরণ করলে দেখা যাবে যে ২ জুলাই ১৯৯৭ সালে শুরু হওয়া থাই সংকট এবং পরবর্তী সংক্রমণ প্রভাবগুলোর জন্য আক্রান্ত অর্থনীতিতে বিভিন্ন মাত্রায় বিদ্যমান কয়েকটি ফ্যাক্টর জড়িত। এ ফ্যাক্টরগুলোর মধ্যে রয়েছে মার্কিন ডলারের ভিত্তিতে একটি কার্যত স্থির মুদ্রা বিনিময় হার, গৃহায়ণের মতো অস্থিতিশীল খাতে স্বল্প সময়ে ঋণ দেওয়া ও নেওয়া ইত্যাদি। ১৯৯৬ সালের রপ্তানি হ্রাস ইতিমধ্যেই ব্যালেন্স অব ট্রেডে ঘাটতি সৃষ্টি করেছিল। যখন বাথ, রিঙ্গিত এবং রুপিয়ার মতো মুদ্রাগুলোর বিরুদ্ধে ফাটকামূলক আঘাত শুরু হয়, তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো দীর্ঘ মেয়াদে তা আর সামাল দিতে পারেনি। কিন্তু এই সংকটটি শুধু মুদ্রার সংকট ছিল না। শিগগিরই ব্যাংকিং খাত আক্রান্ত হয়েছিল। প্রথমে অসংখ্য ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তারল্যসংকট এবং সবশেষে দেউলিয়াপনা দেখা দিয়েছিল। পরিশেষে, বাস্তবিক অর্থে অর্থনীতিগুলো আক্রান্ত হয়েছিল, সবচেয়ে তীব্র আঘাতের সম্মুখীন হয়েছিল ইন্দোনেশিয়া। ইন্দোনেশিয়ায় এই অর্থনৈতিক সংকটটি একটি পূর্ণমাত্রার রাজনৈতিক সংকটে পরিণত হয়েছিল এবং সুহার্তোর ৩০ বছরের শাসনের সমাপ্তি ঘটিয়েছিল।

এই সংকটকে কীভাবে চিহ্নিত করা হবে সে সম্পর্কে এখন একটি স্পষ্ট মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যেমনটা জমো (১৯৯৮) এবং খান (২০০৪খ) উল্লেখ করেছেন, এই রাষ্ট্রগুলোতে সমন্বয় প্রকল্পগুলো নিয়ে আইএমএফ এবং এর সমালোচকদের মধ্যে বিতর্ক থেকে অনেক মতবিরোধ প্রকাশিত হয়েছে। তবে নীতিগত বিতর্কে সংকটটিকে ত্বরান্বিত করতে বিশ্বায়নের ভূমিকার মতো কিছু মৌলিক বিষয় যথেষ্টভাবে স্থান পায়নি।

১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে সার্বিকভাবে এই অঞ্চল দ্রুত উন্নতি করতে শুরু করে। বৈদেশিক বিনিয়োগের জন্য অবমূল্যায়ন এবং নিয়ম হ্রাসের কারণে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডের মতো রাষ্ট্রগুলো সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) আকৃষ্ট করতে সমর্থ হয়। সৌভাগ্যবশত প্লাজা চুক্তির পর জাপানি ইয়ানের উচ্চমূল্য অনেক জাপানি কোম্পানিকে বিদেশে বিনিয়োগে প্ররোচিত করে। কিছু জাপানি এফডিআইয়ের গন্তব্য হয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া।

এমনকি সংকটের সময়েই এটা দেখা গিয়েছিল যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভিত্তিগত বিষয়গুলো সুস্থিরই ছিল (খান, ২০০২ক, ২০০২খ, ২০০২গ, ২০০২ঘ, ২০০২ঙ)। অন্য কথায় আর্থিক স্থিতি বজায় ছিল, মুদ্রানীতি মন্দ ছিল না এবং মূল্যস্ফীতি উচ্চ ছিল না। তবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রপ্তানিনির্ভর প্রবৃদ্ধিতে গৃহায়ণ এবং আর্থিক বাজারের বুদবুদও ছিল। সম্পত্তি, নির্মাণ এবং স্টক মার্কেটের দ্রুত বৃদ্ধি নিজেরাই নিজেদের ধ্বংস ডেকে আনে। ভবিষ্যতে উচ্চ ফল লাভের আশায় বর্তমান সময়েই উচ্চমূল্য ও বিনিয়োগে প্ররোচিত করে। যখন এই অর্থহীনতা বৃদ্ধির অস্থির গতিবেগ মুখ থুবড়ে পড়ে, এর গতিপথ হঠাত্ ঠিক বিপরীতমুখী হয়ে যায়। দ্রুত বৃদ্ধির এই বাগাড়ম্বর, যা একই সঙ্গে গতানুগতিক এবং প্রসন্ন ছিল, একটি সমান সর্বনাশের বাগাড়ম্বরের দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছিল।

এ রকম একপেশে, রৈখিক বয়ানে ইতিহাস একমুখী হিসেবে অগ্রসর হয়। তবে বিশ্বায়নের যুক্তি, যা উল্লেখ করতে আমরা কুণ্ঠিত হই, আরও অনেক জটিল। এশীয় উদাহরণ দেখিয়েছে যে এক সঙ্গে অসংখ্য বাজার শক্তির লাগাম ছেড়ে দিলে, বিশেষত বিবেচনাহীনভাবে এবং অন্যান্য নিয়মনীতি আরোপ ও তা কার্যকর করার সক্ষমতা অর্জন না করে ক্যাপিটাল অ্যাকাউন্টের উদারীকরণ কীভাবে ধ্বংস এবং বিশৃঙ্খলা ডেকে আনতে পারে।

মেক্সিকান সংকট এবং এশীয় সংকটের মধ্যে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য উভয়ই আছে। উভয় ক্ষেত্রেই দ্রুত মুদ্রার পতন হয়। ল্যাটিন আমেরিকা এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া উভয় অঞ্চলেই অধিক মাত্রায় সংক্রমণ প্রভাব কাজ করেছে। তবে দুটি সংকটের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হচ্ছে, মেক্সিকান পেসোর পতন এবং এর ফলে তৈরি হওয়া ‘টেকিলা ইফেক্ট’-এর কারণে সম্পত্তি বিক্রির প্রবণতা তৈরি হয়নি, যেমনটা হয়েছিল এশীয় সংকটে। ল্যাটিন আমেরিকান সংকট পূর্ণমাত্রার ঋণ সংকোচনে পরিণত হয়নি।

সুতরাং, এশীয় সংকট শুধু একটি পরিশোধের হিসাবের সংকট ছিল না। এটা ছিল একটা মুদ্রাসংকট, যেটা অর্থনীতির বাস্তব ক্ষেত্রে একটি পূর্ণমাত্রার এবং বৃহদায়তন ঋণ সংকোচন এবং মন্দায় পরিণত হয়। এই নতুন ধরনের মুদ্রাসংকট এবং ঋণ সংকোচনকে চিহ্নিত করার একটি উপায় হচ্ছে এগুলোকে আন্তর্জাতিক মূলধন বাজারের ব্যর্থতা হিসেবে দেখা, যা বর্তমান করপোরেট-চালিত বিশ্বায়নের একটি যুক্তিযুক্ত ফলাফল। প্রথম ক্ষেত্রে বিশ্বায়িত আন্তর্জাতিক মূলধন বাজার সন্তোষজনকভাবে মূলধনের বণ্টনে ব্যর্থ হয়েছে, যা নব্যধ্রুপদি অ্যারো-ডেবরু সাধারণ ভারসাম্য মডেলের বিপরীত। সংকটের সময় অ্যালেন গ্রিনসপ্যান বিনয়ের সঙ্গে যেমনটা উল্লেখ করেছিলেন: ‘অতীতের ঘটনাবলির পর্যালোচনা করলে এটা পরিষ্কার হয় যে লাভজনকভাবে গ্রহণযোগ্য ঝুঁকিতে যে পরিমাণ মূলধন এসব অর্থনীতিতে বিনিয়োগ করা যেত, তার চেয়ে বেশি মূলধন এসব অর্থনীতিতে প্রবাহিত হয়েছিল’ (গ্রিনসপ্যান, ১৯৯৭: ১-২)। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত উদ্যোগ খাতে ব্যাংক ব্যবস্থা বৈদেশিক মূলধনের অন্তঃপ্রবাহ ধারণ করতে এবং অন্য খাতে তা প্রবাহিত করতে ব্যর্থ হয়েছিল। স্টিগলিজের রূপকে বলতে হয় ব্যাংক ব্যবস্থা, আরও সাধারণভাবে আর্থিক ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মস্তিষ্ক হিসেবে কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছিল। অন্যভাবে বললে, এটা কার্যকরভাবে ঝুঁকির ওপর নজর রাখতে এবং মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে। স্পষ্টভাবে, বিগত সংকটগুলোর ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা হয়নি, যেমনটা অতিসাম্প্রতিক কালে উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে ঘটে যাওয়া সাবপ্রাইম ঋণসংকট থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি, এটিও আর্থিক খাতে নিয়ন্ত্রণ হ্রাসের সঙ্গে সম্পর্কিত।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, এশীয় সংকট-সম্পর্কিত ওপরের আলোচনায় পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আলোকে বিশ্বায়নের আপাত স্ববিরোধগুলোই প্রকাশিত হয়েছে, যার ওপর আমি এই প্রবন্ধে জোরারোপ করেছি। যেমনটা সোবহান (১৯৮৯) এবং অন্যরা উল্লেখ করেছেন উন্নয়নশীল বিশ্বে পুঁজিবাদ বৃহদার্থে রাষ্ট্র কর্তৃক পরিচালিত হয়েছে। তবে, যেসব রাষ্ট্র যিকঞ্চিত হলেও সফল পুঁজিবাদী অর্থনীতি তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে, সে একই রাষ্ট্রই বিশ্বায়নের মুখে শক্তিহীন হয়ে পড়েছে। এই আপাত বিরোধাত্মক অবস্থার আরও বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রয়োজন।

যেমন এশিয়ার উন্নয়নশীল অর্থনীতিগুলোতে পুঁজিতান্ত্রিক উন্নয়নের জন্য অবকাঠামো তৈরি রাষ্ট্রের কর্তব্য বলে বিবেচনা করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে, রাষ্ট্রীয় কাঠামোর সক্রিয় সহযোগিতায় পুঁজিবাদীরা একটি শ্রেণি হিসেবে গড়ে ওঠে এবং তারাই বৃহদর্থে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করে। এশীয় উন্নয়নের আপাতবিরোধ হচ্ছে এই, একটি নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত রাষ্ট্রসমূহ এসব করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু এসব রাষ্ট্রচালিত পুঁজিতান্ত্রিক উন্নয়ন যে তাদের সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে গিয়েছে তাও এখন স্পষ্ট প্রতীয়মান।

১৯৯০-এর দশকে এশিয়ার উন্নয়নশীল রাষ্ট্রসমূহ বৈশ্বিক বিস্তারের মোটামুটি অর্ধেক নিয়ন্ত্রণ করত। তবে, রপ্তানির মাধ্যমে প্রবৃদ্ধির ফলে পুঁজিবাদের উদারীকরণের জন্যও এসব অর্থনীতির ওপর চাপ ছিল। উত্তর কোরিয়া, যেটি ওইসিডি গোষ্ঠীকে যোগ দিতে যাচ্ছিল, তাদের জন্য এই উদারীকরণ অপরিহার্য শর্ত হিসেবে দেখা হয়েছিল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্য রাষ্ট্রগুলোর জন্য উদীয়মান বাজারে এফডিআই এবং আর্থিক মূলধনের প্রবাহের সমাহারকে আরও অধিক উদারীকরণকে ন্যায্যতা প্রদানকারী হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছিল। স্থির মুদ্রা বিনিময় হার এবং গোঁড়া আর্থিক ও মুদ্রা নীতিমালার শাসনব্যবস্থা এসব বাজারকে ইতিমধ্যে বিশ্বাসযোগ্যতা প্রদান করেছিল। তবুও রাষ্ট্র—যেমনটা দেখা গিয়েছিল আগের মতো বিশ্বায়িত বাজারে—দেশীয় পুঁজিপতিদের রক্ষা করতে পারেনি। অনুন্নত রাষ্ট্রযন্ত্রের জন্য তথাকথিত ‘শাসনপদ্ধতির সংকট’ (জমো, ১৯৯৮) একটি বাস্তবিক সংকট, যেটি বিশ্বায়নের শক্তিগুলোর সঙ্গে লড়তে কার্যত শক্তিহীন। সুতরাং, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তিতে বৈসাদৃশ্য আবারও তীব্রভাবে প্রকাশিত হলো। বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের সতর্ক তদন্তে বাস্তব এবং আর্থিক খাতের যে অসম উন্নয়ন তাও বের হয়ে এসেছে। যখন পুঁজিবাজারে আস্থার পতন হয় এবং বিনিয়োগকারীরা বাজার ত্যাগ করতে থাকেন, তখন দুর্বল রাষ্ট্রগুলো তাদের অভ্যন্তরীণ পুঁজিবাজারকে বাঁচাতে খুব কম পদক্ষেপই নিতে পারে। যেমনটা সিয়ামওয়ালা (১৯৯৭) দুঃখপূর্ণভাবে বলেছেন, থাই রাষ্ট্র এবং থাই বুর্জুয়াদের এ রকম ব্যর্থতার কারণে আইএমএফের পীড়াদায়ক শর্তগুলো মেনে নেওয়া ছাড়া থাইল্যান্ডের মতো রাষ্ট্রগুলোর কাছে আর কোনো বিকল্প নেই। থাইল্যান্ডে আমলা, রাজনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ীদের মধ্যকার জটিল সম্পর্কের কারণে (ক্রোঙকাও, ১৯৯৭) এই সংকট মোকাবিলায় খুব দ্রুত কোনো সুসংগত পদক্ষেপ নেওয়া হবে, এটাও আশা করা যাচ্ছিল না। অন্য কোনো বিন্যাসে, বিশ্বায়নের অধীনে শাসনপদ্ধতির এই সংকট অন্য অনেক রাষ্ট্রে চলমান রয়েছে।

এসব কিছুতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামকটি হচ্ছে বৈশ্বিক পুঁজিবাদে রাষ্ট্রযন্ত্রের অসম উন্নয়ন। উদাহরণস্বরূপ, অনেক এশীয় রাষ্ট্রে আমলারা বিভিন্ন বিশেষায়িত কাজে নির্দেশক এবং তদারককারী বিশেষজ্ঞের কাজ করে এবং তাঁদের কাজে তুলনামূলকভাবে দক্ষ হয়ে ওঠেন এবং অংশত এই কারণে শক্তিশালী হয়ে ওঠেন। একই সময়ে, এই একই রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অনেকগুলোতেই ব্যাংকিং এবং আর্থিক খাতের জন্য প্রয়োজনীয় অত্যন্ত দক্ষ বিশেষজ্ঞ এবং শক্তিশালী আমলা নেই। এমনকি থাইল্যান্ডের মতো রাষ্ট্রে, যেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ট্যাকনোক্রেটিক সক্ষমতার জন্য সুনাম আছে, সেখানেও নতুন প্রতিষ্ঠান যেমন ব্যাংকক ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংকিং ফ্যাসিলিটিসহ উদারীকৃত বাজারের সম্মুখে আমলারা নিজেদের অসহায় মনে করেছিলেন (লরিডসেন, ১৯৯৮)। আরও সাম্প্রতিক সংকটগুলো যেমন আর্জেন্টিনার সংকট এবং দ্রুত বর্ধনশীল বৈশ্বিক সাবপ্রাইম ঋণসংকট, যথেষ্ট পরিমাণ সামাজিক রক্ষণাবেক্ষণ এবং অর্থনৈতিক নিয়মনীতি অবলম্বন না করে দ্রুত উদারীকরণের একই ধরনের সমস্যাগুলোকে নির্দেশ করছে।

সংক্ষিপ্তসার এবং উপসংহার

বিশ্বায়নের অবশ্যই কিছু ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে, যেমন প্রযুক্তির হস্তান্তর, নির্দিষ্ট খাতে উত্পাদন বৃদ্ধি এবং উন্নত ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রসমূহে কিছু মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন। তবে বর্তমানের বিশ্বায়ন সাধারণত নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চল বা গোষ্ঠীকে লাভবান করলেও, ভঙ্গুর এবং পশ্চাত্পদ অঞ্চল এবং মানুষদের প্রান্তিকায়িত করছে এবং পীড়াদায়ক অবস্থান সৃষ্টি করছে। মানব এবং আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের ওপর বন্তুগত সম্পদ অর্জনকে গুরুত্বদানের মাধ্যমে করপোরেট-চালিত এ ধরনের বিশ্বায়ন বিভিন্ন মানবিক চাহিদার মধ্যে অসমতা সৃষ্টি করছে, ফলে সহিংসতা, উন্মত্ততা এবং হতাশা তৈরি করছে। বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদগুলো এসব আপাতবিরোধকে তুলে ধরে।

বর্তমানের বৈশ্বিক অর্থনীতিতে কাঁচামালের এবং কম দক্ষ শ্রমিকের গুরুত্ব কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে দক্ষ শ্রমিক এবং জ্ঞান, বিশেষত টেলিযোগাযোগ এবং কম্পিউটার প্রযুক্তি খাতের জ্ঞানের কদর ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা দরিদ্র জাতিসমূহকে, যারা প্রাথমিক পণ্য এবং কম দক্ষ শ্রমিকের প্রধান রপ্তানিকারক, একটি অসুবিধাজনক অবস্থানে দাঁড় করাচ্ছে।

বিশ্বায়ন সরকার এবং জাতিরাষ্ট্রসমূহের ওপর বিশ্ববাজারের নিয়ম এবং অনুশাসনগুলো আরোপ করছে, ফলে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোর আর্থিক এবং মুদ্রানীতিসহ জাতীয় নীতিমালার গুরুত্ব হ্রাস পাচ্ছে। গিলপিনের মতে, যদি একটি রাষ্ট্র মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে লড়তে মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে, তবে এর ফলে অভ্যন্তরীণ সুদের হার বৃদ্ধি পায় এবং এর কারণে পুঁজির অন্তঃপ্রবাহ শুরু হয়, যা তখন আসল নীতিগত উদ্দেশ্যকে প্রতিহত করে এবং মুদ্রা বিনিময় হার বৃদ্ধি করে। ...স্থিতিশীল আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক এবং মুদ্রাবিষয়ক মূল্যবোধ থেকে অভ্যন্তরীণ লক্ষ্য অর্জনের প্রচেষ্টাকে পৃথক রাখা অসম্ভব।৪

বিশ্বায়নের অন্য নেতিবাচক প্রভাবটি হচ্ছে আয়বৈষম্যের ওপর এর প্রভাব। যেমনটা আগে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, বিশ্বায়নের একটি প্রবণতা হচ্ছে জাতি, ব্যক্তি ও অঞ্চলসমূহের মধ্যে আয়বৈষম্য বৃদ্ধি করা। ফক অন্য আরও অনেকের মতামতকে ধারণ করেন, যখন তিনি বলেন,

...ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া হিসেবে একটি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার অধীনে বিশ্বায়ন সংঘটিত হচ্ছে, যাতে সব ধরনের স্থূল অসমতা দেখা যাচ্ছে। ফলে এটি সমাজের মধ্যে এবং সমাজসমূহের মধ্যে যারা ইতিমধ্যেই সুবিধাজনক অবস্থানে আছে তাদের ওপর প্রবৃদ্ধির উপকারিতার ওপর মনোনিবেশ করছে। একই সঙ্গে যারা ইতিমধ্যে সবচেয়ে বেশি অসুবিধাজনক অবস্থানে আছে তাদের অবস্থাকে তুলনামূলক এবং নিশ্চিতভাবে আরও খারাপ করে তুলছে।৫

আরও কিছু ন্যায্য উদ্বেগজনক বিষয় রয়েছে, যেমন ট্রাইপোলার অঞ্চলে (উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ, পূর্ব এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল) অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং সম্পদের কেন্দ্রীভূতকরণ, অন্যান্য উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে সম্পদের প্রবাহ হ্রাস পেতে পারে, ফলে বৃহত্ অঞ্চল যেমন সাব-সাহারান আফ্রিকার আর্থিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোর প্রকোপ বৃদ্ধি পেতে পারে। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিশ্বায়ন ও আঞ্চলিকায়নকে অপ্রতিরোধ্য মনে হতে পারে, তাই বৈশ্বিক বাজার অর্থনীতির ফলে জন্মলাভ করা আর্থসামাজিক সমস্যাসমূহকে অতিসত্বর আলোচনায় স্থান দেওয়া অতীব জরুরি।

এই প্রবন্ধে আমি জোর দিয়ে বলেছি যে একটি ন্যায্য বৈশ্বিক অর্থনীতির ধারণাগত কাঠামোতে বিশ্বায়নের বিরূপ প্রভাবগুলোকে আলোচনায় আনতে হবে। এটা করার জন্য আমি সামাজিক সক্ষমতা দৃষ্টিভঙ্গিকে ব্যবহার করার প্রস্তাব করেছি। এই দৃষ্টিকোণ থেকে একটি ন্যায্য বৈশ্বিক অর্থনীতির দিকে যেকোনো পদক্ষেপের জন্যই বৈশ্বিক সম্পদ এবং ক্ষমতার উল্লেখযোগ্য পুনর্বণ্টন প্রয়োজন হবে। বিশেষত, এর জন্য বর্তমান শক্তিশালী রাষ্ট্রসমূহকে তাদের সার্বভৌমত্বের কিছুটা নতুন আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর কাছে ছেড়ে দিতে হবে। এই সংগঠনগুলো একটি সময়োচিত এবং ন্যায়সংগত উপায়ে উন্নত এবং উন্নয়নশীল রাষ্ট্রসমূহের মধ্যকার বৈসাদৃশ্যগুলোকে চিহ্নিত করার মাধ্যমে বৈশ্বিক মঙ্গলকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। বৈশ্বিক অর্থসংস্থানের সমস্যাসমূহ বহুপক্ষীয়ভাবে কীভাবে সমাধান করা যায় তার একটি উদাহরণ হচ্ছে প্রস্তাবিত টবিন কর। এই কর থেকে হওয়া আয় এমন উন্নয়নের অর্থসংস্থানে খরচ করা যায়, যা এলডিসির মানুষদের সক্ষমতা বাড়াবে তাহলেই সবচেয়ে ভালো হয়।৬

যা হোক, বর্তমান অবস্থায় টবিন কর গ্রহণ বা অদূর ভবিষ্যতে উন্নয়নের জন্য এটার পরার্থে ব্যবহারের কোনো আশা দেখা যাচ্ছে না। একই সময়ে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রসমূহের স্বার্থেই একটি একক রাষ্ট্র হিসেবে এবং আঞ্চলিক পর্যায়ে দলবদ্ধ হয়ে স্বাধীনভাবে কাজের জন্য তাদের যে পর্যায়ের আপেক্ষিক স্বশাসন থাকুক না কেন, তা কাজে লাগাতে হবে এবং এর মাধ্যমে চিড় ধরা বিশ্বায়নের বিরূপ প্রভাবসমূহকে উপশম করতে হবে। এসব সীমাবদ্ধ প্রচেষ্টা সার্বিকভাবে কার্যকর হবে না, কিন্তু নীতিমালা-সম্পর্কিত অসাড়তা—এ ক্ষেত্রে বিশ্বায়নের প্রভাবশালী ডিসকোর্সকে সমালোচনাহীনভাবে গ্রহণ করা হয়—অপেক্ষা তা গ্রহণযোগ্য। চূড়ান্তভাবে একটি স্বচ্ছ নিয়মভিত্তিক বাণিজ্য ব্যবস্থা এবং বৈশ্বিক আর্থিক কাঠামোনির্ভর একটি ন্যায্য বৈশ্বিক ব্যবস্থা একই সঙ্গে দক্ষতা এবং সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারে; কিন্তু এই অভিমুখে যাত্রার জন্য সব পক্ষেরই—কমপক্ষে প্রধান উন্নত এবং উন্নয়নশীল রাষ্ট্রসমূহের—এখানে উপস্থাপিত কাঠামোর আলোকে সহযোগিতা করার ইচ্ছাশক্তি থাকা প্রয়োজন।

যদি এই প্রবন্ধে প্রস্তাবিত মূল যুক্তি সঠিক হয়, তবে বৈশ্বিক আর্থিক বাজারগুলোর তদারকি প্রয়োজন এবং একটি সঠিক বৈশ্বিক আর্থিক কাঠামোকে একই সঙ্গে দক্ষতা ও ন্যায্যতার যুক্তির আলোকে নির্মাণ করতে হবে। দক্ষতার দৃষ্টিকোণ থেকে যুক্তিটি হচ্ছে, একটি অভিন্ন পদ্ধতিগত ঝুঁকি পৃথিবীতে জুতসই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজনের মধ্য দিয়ে দূরদর্শিতাকে কাজে লাগানো, যাতে করে আগের চেয়ে ভালোভাবে নীতিমালা তৈরি এবং বাস্তবায়ন করা যায়। ন্যায্যতার দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, সক্ষমতা দৃষ্টিভঙ্গির ওপর ভিত্তি করে অগ্রসরমান যুক্তি প্রতিষ্ঠান এবং নীতিমালা প্রণয়নের দিকে চালিত করতে পারে, যা শুধু ঋণদাতাদেরই নয়, সাধারণ নাগরিকদেরও রক্ষা করবে। বিশেষত, অনগ্রসর এবং ভঙ্গুর জনগোষ্ঠীর দিকে অবশ্যই সতর্ক নজর দিতে হবে। সংকটের আগে যথেষ্ট পরিমাণ সামাজিক নিরাপত্তাবলয় গড়ে তুলতে হবে এবং সংকটের পর তাদের জরুরি প্রয়োজন মেটাতে অবশ্যই দ্রুত সাড়া দিতে হবে। সংকটের আগে একটি অধিক গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া, এ ধরনের প্রশাসনিক কাঠামো বুঝতে আরও বেশি সহায়ক হতে পারে। আবারও, সব পর্যায়ে ভালো গণমুখী শাসনপদ্ধতি প্রয়োজন। যদি একুশ শতককে একটি অধিক সভ্য বৈশ্বিক সমাজ গঠনের পক্ষে অধিক নিরাপদ হতে হয়, তবে এসব গণতান্ত্রিক পূর্বশর্তের দিকে অবশ্যই মনোযোগ দিতে হবে এবং সাথে সাথে উপযুক্ত প্রায়োগিক উপদেশ গ্রহণ করতে হবে, যা কোনো একজন অর্থনীতিবিদ আংশিকভাবে কোনো একসময় দিতে পারেন। তবে অন্য সমাজবিজ্ঞানীদের এবং প্রকৃত ন্যায়পরায়ণ সমাজসেবীদের এতে সামগ্রিকভাবে অংশগ্রহণ অপরিহার্য।

অনুবাদ: গোলাম মুস্তাফা

তথ্যসূত্র:

১.         বিস্তারিত তথ্যনির্দেশ এবং ব্যাখ্যার জন্য নিচে দেখুন।

২.         উদাহরণস্বরূপ স্যুর-কনকেইভ এসডব্লিউএফগুলো ‘সমতাকাঙ্ক্ষী’ এসডব্লিউএফ।

৩.        খান (১৯৯৮, ১৯৯৭গ)।

৪.         গিলপিন (১৯৮৭: পৃষ্ঠা. ১৪৫)।

৫.         ফক (১৯৯৭, পৃষ্ঠা. ১৯); আরও দেখুন, খান (২০০৪খ)।

৬.        হক এবং অন্যান্য (১৯৯৬)।

গ্রন্থপঞ্জি:

                Adelman, I. and Robinson, S. (1978). Income Distribution Policy in Developing Countries: A Case Study for Korea, Palo Alto: Stanford University Press.

                Baker, Dean, Epstein, G. and Pollin, R. (1998) Globalization and Progressive Economic Policy, Cambridge, Cambridge University Press.

                Barber, B. (1995). Jihad vs. McWorld, New York: Random House.

                Bonvin, J. (1997). "Globalization and Linkages: Challenges for Development Policy," Development 40 (2): 39-42.

                Bosier S. (1997). The Elusive Goal of Regional Development: Between the Black Box and the Political Agenda. Edificio CEPAL: Stantiago-Chile.

                Chang, Ha-Joon(2007), Institutional Change and Economic Development, London: Anthem Press.

                Cook, P. and Kirkpatrick, C. (1997). "Globalization, Regionalization and Third World Development," Regional Studies 31 (1): 55-66.

                Falk. R. (1997). "Resisting 'Globalization-from-above' through 'Globalization-from-below'," New Political Economy 2 (1): 17-24.

                Greenspan, A. (1997). `Statement Before the U.S. House of Representatives Committee on Banking and Financial Services’, Washington, D.C. 13 November.

                Gills, K. B. (1997). "Editorial: 'Globalization' and the 'Politics of Resistance'," New Political Economy 2 (1): 11-15.

                Gilpin, R. (1987). The Political Economy of International Relations, Princeton: Princeton, New Jersey.

                Griffin K. and Khan A. R. (1992). Globalization and the Developing World: An Essay on the Structural Dimensions of Development in the Post Cold War Era. UNRISD, Geneva.

                Harris, Laurence. (1998). “The Dynamics of Globalization: Eight Skeptical Theses”, Paper presented at the UNU/AERC Conference, Tokyo, August 3-4, 1998.

                Hirst, P. (1995). Globalization in Question, Political Economy Research Centre Occasional Paper Number 11. Sheffield, England: The Political Economy Research Center.

                James, J. and Khan, Haider A. (1993). “The Employment Effects of Income Redistribution,” World Development (March): 817-28.

                (1997). “Technolgy Choice and Income Distribution” World Development, (February): 153-165.

                (1998). Technological Systems and Development, London: Macmillan.

                Jomo, K.S. (1998). “Introduction: Financial Governance, Liberalization and Crises in East Asia,” in Tigers in Trouble: Financial Governance, Liberalization and Crises in East Asia. Hong Kong: Hong Kong University Press, pp. 1-23.

                Khan, Haider Ali and Yi-bei Liu, (2008), "Globalization and the WTO Dispute Settlement Mechanism: Making a Rule-based Trading Regime Work", http://mpra.ub.uni-muenchen.de/7613/

                Khan, Haider A. (2014). Development and Women's Rights as Human Rights: A Political and Social Economy Approach within a Deep Democratic Framework, Denver Journal of International Law and Policy, Vol. 42, No. 3(Aug. 2014).

                Khan, Haider A. (2013a). Development Strategies: Lessons from the Experiences of South Korea, Malaysia, Thailand and Vietnam, in Augustin K. Fosu ed. Achieving Development Success, Oxford University Press, 2013:119-132.

                Khan, Haider A. (2013b).Basel III, BIS and Global Financial Governance, Journal of Advanced Studies in Finance, Volume IV, Issue 2(8), Winter 2013

                Khan, Haider A. (2007), " A Theory of Deep Democracy and Economic Justice in the Age of Postmodernism",                 http://econpapers.repec.org/paper/tkyfseres/2007cf468.htm

                Khan, Haider A. (1998). Technology, Development and Democracy: Limits to National Innovation Systems in the Age of Postmodernism, Aldershot, U.K.: Edward Elgar.

                ..... 2004a, Innovation and Growth in East Asia: The Future of Miracles, Macmillan

                ..... 2004b, Global Markets and Financial Crisis: Asia’s Mangled Miracle, Macmillan/Palgrave.

                ..... 2003, "Creating Social Capabilities in a POLIS", in Tom Misa et als. Eds. Technology and Modernity, The MIT Press.

                ..... 1996, “Beyond Distributive Justice in the McWorld”, Global Justice, Spring/Summer, pp. 30-40.

                Khan, Haider A. (1999a) “Corporate Governance of Family Businesses in Asia: What’s Right and What’s Wrong?” ADBI paper no. 3, Tokyo, 1999.

                Khan, Haider A. (1999b) “ Corporate Governance in Asia: Which Road to Take?” paper presented at 2nd high level symposium in ADBI, Tokyo

                Khan, Haider Ali, 1994, "Does Bilateral Foreign Aid Affect Fiscal Behavior of a Recipient?" Journal of Asian Economies, March

                ..... 1995a, "Does the Policy-Maker Make a Difference?" paper presented at AEA/ASSA meetings, Washington D.C., January 1995.

                ..... 1995b, "Does Japan's Aid Work?" unpublished paper, University of Denver.

                Khan, Haider A. (1997a), "Does Japanese Bilateral Aid Work? Foreign Aid and Fiscal Behavior in a Bounded Rationality Model," Regional Development Studies, Vol. 3 (Winter, 1996/97), pp. 283-97.

                Khan, Haider A.(1997b), Technology, Energy and Development: The South Korean Transition, Cheltenham: Edward Elgar.

                Khan, Haider A.(1997c), African Debt and Sustainable Development, New York: phelps-Stokes Foundation.

                Khan, Haider A. (2002a), “ Can Banks Learn to Be Rational?”, Discussion Paper no. 2002-CF-151, Graduate School of Economics, University of Tokyo.

                Khan, Haider A. (2002b), “ Corporate Governance: the Limits of the Principal –Agent Model”, Discussion Paper, CIRJE, University of Tokyo.

                Khan, Haider A. (2002c) “The Extended Panda’s Thumb and a New Global Financial Architecture: An Evolutionary Theory of the Role of the IMF and Regional Financial Architectures, Working paper, GSIS, University of Denver.

                ..... 2002d, “Does Aid Work? Japanese Foreign Aid, Development Expenditures and Taxation in Malaysia: some results from a bounded rationanlity model of fiscal behavior”, Journal of the Centre for International Studies, Aichi Gakuin University, Vol. 4, pp. 1-19.

                ..... 2002e, “ What can the African countries learn from the macroeconomics of foreign aid in Southeast Asia ?”, Aryeetey, E., Court, J., Nissanke, M. and Weder, B., Asia and Africa in the Global Economy, Tokyo, UNU Press.

                Krongkaew, M. (1997). “An Alternative Interpretation of Economic Policy Determination in Thailand”. Paper presented at the conference on `Asia’s Development Experience’, Tokyo, December 1-2.

                Krugman, P. (1996). Pop Internationalism, MIT Press, Cambridge, MA.

                Lauridsen, L. S. (1998). “Thailand: Causes, Conduct, Consequences,” in Jomo, K.S. ed. Tigers in Trouble: Financial Governance, Liberalization and Crises in East Asia. Hong Kong: Hong Kong University Press, pp. 137-157.

                McGrew A. (1992). The Third World in the new global order, in Allen T. and Thomas A. (eds.) Poverty and Development in the 1990s. Oxford University Press in association with the Open University, Oxford.

                Ohmae, K. (1996). The End of the Nation State. Harper Collins Publishers: London.

                Peraton, J. et al (1997). "The Globalization of Economic Activity," New Political Economy 2 (2):257-277.

                Sen, G. (1997). "Globalization, Justice and Equity: A gender perspective," Development 40(2):21-26.

                Siamwalla, A. (1997) “Can a Developing Democracy Manage Its Macroeconomy?” The Case of Thailand, Lecture delivered at Queen’s University, Kingston, Ontario, Canada on October 15.

                Sobhan, R (1989) “The State and Development of Capitalism: The Third World Perspective”, in Bharadwaj, K. and S. Kaviraj, eds. Perspectives on Capitalism, New Delhi: Sage Publications, pp. 247-258.

                Stiglitz, J. 2002. Globalization and Its Discontents, New York: Norton

                ..... 2006. Making Globalization Work, New York: Norton

                Straubhaar, T. and Wolter, A. (1997). "Globalization, Internal Labor Markets and the Migration of the Highly Skilled," Intereconomics 32 (4): 174-180.

                The Economist, “Mahathir, Soros and the Currency Markets: Amoral may be, but Currency Speculators are both necessary and productive” (September 7-October 3, 1997).

                The Economist, “One World?” (October 18, 1997a).

                Thurow, L. (1996). The Future of Capitalism: How Today’s Economic Forces Shape Tomorrow’s World. Penguin Books: New York.

                Ul, Haq, M., K. Inge and I. Greenberg (eds.) (1996). The Tobin Tax: Coping with Financial Volatility. Oxford: Oxford University Press.

                Wood, A. (1994). North-South Trade, Employment and Inequality: Changing Fortunes in a Skill-driven World. Oxford. Clarendon Press.

                Yeung, Y. and Lo, F. (1996). "Global Restructuring and Emerging Urban Corridors in Pacific Asia," in Yeung, Y. and Lo, F. (eds.) Emerging World Cities in Pacific Asia. United Nations University: Tokyo.