এক তরুণ শিক্ষকের অ্যাকটিভিস্ট হয়ে ওঠার গল্প

রেহমান সোবহান, ছবি: আমাজন
রেহমান সোবহান, ছবি: আমাজন

আনট্রাঙ্কুইল রিকালেকশনস: দ্য ইয়ারস অব ফুলফিলমেন্ট—রেহমান সোবহান, সেইজ, দিল্লি: ২০১৬

আমাদের সমাজ রাজনীতিময়। একটি ঔপনিবেশিক বা উপনিবেশ-উত্তর সমাজের হয়তো এটাই বৈশিষ্ট্য। রাজনীতিবিদেরা এ দেশে পালাবদলের প্রক্রিয়ায় চালকের আসনে থাকেন। অনেকে তারকাখ্যাতি পেয়ে যান। কেউ কেউ হয়ে যান মহাতারকা বা মেগাস্টার। রাজনীতির বাইরে অন্যান্য স্রোতোধারা থেকে যায় অলক্ষ্যে।

গত শতাব্দীর ষাটের দশকে এটা মোটামুটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় পূর্ব পাকিস্তানের সিদ্ধান্ত গ্রহণে কার্যকর অংশগ্রহণের সুযোগ নেই। পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে বৈষম্য যেমন বাড়ছিল, তেমনি বিস্তৃত হচ্ছিল মানসিক বিচ্ছিন্নতা। শেখ মুজিবের ছয় দফা কর্মসূচি একটা স্ফুলিঙ্গ তৈরি করল এবং তা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল। এর পটভূমি তৈরি হয়েছিল একদল অর্থনীতিবিদের মিলিত চেষ্টায়। এর ফলে পাকিস্তানের দুই প্রদেশের মধ্যকার সম্পর্কে কাঠামোগত পরিবর্তনের দাবি উচ্চারিত হয়েছিল।

অর্থনীতিবিদদের উপলব্ধি ছিল, পাকিস্তানের অর্থনীতি দুই প্রদেশে দুই রকম। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পেছনে যেমন দ্বিজাতিতত্ত্বের একটা ভূমিকা ছিল, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পেছনে তেমনই ছিল দ্বি-অর্থনীতির তত্ত্ব। এই তত্ত্বের বীজ বোনা হয়েছিল পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি, যা পরবর্তী ১০ বছরে ডালপালা ছড়িয়ে পরিণত হয়েছিল আকাঙ্ক্ষার বিশাল মহিরুহে। ইতিহাসের এই প্রচ্ছন্ন অধ্যয়নই উঠে এসেছে অধ্যাপক রেহমান সোবহানের সাম্প্রতিক গ্রন্থে। দিল্লি থেকে প্রকাশিত বইটির নাম আনট্রাঙ্কুইল রিকালেকশনস: দ্য ইয়ারস অব ফুলফিলমেন্ট। বইটি একই সঙ্গে স্মৃতিকথা, আত্মজীবনী এবং ইতিহাস।
২.
রেহমান সোবহান জন্মেছিলেন সোনার চামচ মুখে নিয়ে। ব্যক্তিগত ক্যারিয়ার ও ক্যারিশমার পেছনে ছুটলে তিনি হতে পারতেন একজন বড় শিল্পপতি। পারিবারিক সূত্রেই তিনি ঢাকা ট্যানারিজের মালিক হয়েছিলেন। রায় বাহাদুর রণদাপ্রসাদ সাহাকে সঙ্গে নিয়ে এটা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাঁর বাবা খন্দকার ফজলে সোবহান। ওই সময় এটাই ছিল পূর্ব পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় ট্যানারি। কারখানা ছিল হাজারীবাগে। ১৯৫৭ সালে কেমব্রিজ থেকে ঢাকায় ফিরে তিনি এই প্রতিষ্ঠানে তাঁর বাবার ৫১ শতাংশ শেয়ারের দায়িত্ব নেন। যেদিন তিনি প্রথম কারখানাটি দেখতে যান, তাঁর মনে হয়েছিল, ‘একজন পাপী জাহান্নামে প্রবেশ করছে’। পরে তিনি এটা বিক্রি করে দিয়েছিলেন। তিনি যদি এখনো এটা চালাতেন, তাহলে তাঁকে হয়তো ঢাকা আর সাভারে শাটল কর্কের মতো আসা-যাওয়া করে জেরবার হতে হতো।  বেচে দিয়ে তিনি বেঁচে গেছেন। ধাতে সয়নি বলেই তিনি শিল্পপতি হতে পারেননি।

দার্জিলিংয়ের সেন্ট পলস স্কুল, লাহোরের এচিসন কলেজ ও কেমব্রিজের মতো বনেদি প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনার সুবাদে তিনি বিদেশেই থিতু হতে পারতেন কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে বা করপোরেশনে। তাঁর বাবা করাচির বাসিন্দা হয়েছিলেন, করাচি ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্টের চেয়ারম্যান হিসেবে। রেহমান সোবহান কিন্তু ঠিকানা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন ঢাকা, যেখানে তিনি আগে কখনো থাকেননি। মাতৃভাষা বাংলা না হওয়া সত্ত্বেও বাংলা ও বাঙালির জন্য উত্সর্গ করেছেন তাঁর জীবন এবং সব কর্মযজ্ঞ। তিনি অনেক বাঙালির চেয়েও অনেক বেশি বাঙালি।

৩.

১৯৪০ সালের মার্চে লাহোরে মুসলিম লীগের সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবের আলোকে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের একটি রূপরেখা তৈরির চেষ্টা ছিল পঞ্চাশের দশকের গোড়া থেকেই। ১৯৫০ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের এক সম্মিলনী সভায় ‘ইউনাইটেড স্টেটস অব পাকিস্তান’-এর কাঠামোয় কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র দপ্তর ছাড়া বাকি সব বিষয় প্রাদেশিক সরকারের হাতে ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিল।১ এরই ধারাবাহিকতায় ১৬ বছর পরে রচিত হয়েছিল ছয় দফা। ছয় দফা হঠাত্ করে আসমান থেকে পড়েনি। দীর্ঘদিন ধরে স্বায়ত্তশাসনের দাবি ও ধারাবাহিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এর তাত্ত্বিক ভিত্তি তৈরি হয়েছিল। ১৯৫৩ সালের শেষের দিকে গঠিত যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা দাবির ১৯ নম্বর দফায় আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের সংক্ষিপ্ত রূপ দেওয়া হয়েছিল। একই সঙ্গে তৈরি হয়েছিল রাজনীতিবিদদের সঙ্গে অর্থনীতিবিদদের যুগলবন্দি, স্বাধিকারের দাবিতে যাঁরা এক মোহনায় মিশেছিলেন।

১৯৬৪ সালের ৫ জুন ১১ দফা দাবির ভিত্তিতে আওয়ামী লীগের যে মেনিফেস্টো লেখা হয়, তাতে ছয় দফার কথাগুলো বলা হয়েছিল। সঙ্গে অন্যান্য দাবিও ছিল। ছয় দফা এসেছে ধীরে ধীরে, ধাপে ধাপে। সময়ের সঙ্গে দাবিগুলো আরও পরিমার্জিত হয়েছে, স্পষ্টতর হয়েছে। এর সঙ্গে সমান্তরালভাবে উঠে এসেছিল ‘দুই অর্থনীতি’র তত্ত্ব। তত দিনে এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যে কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত সনাতন ধারার অর্থনৈতিক পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে পূর্ব-পশ্চিমের দূরত্ব কমানো যাবে না। এ জন্য দুই প্রদেশের অর্থনীতির স্বতন্ত্র গতি-প্রকৃতিকে বিবেচনায় নিতে হবে।

৪.

পাকিস্তানের দুই অংশে যে দুটো অর্থনীতি বিরাজমান, এই ধারণা প্রথম তোলা হয় ১৯৫৬ সালে। পাকিস্তানের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার (১৯৫৬-৬০) জন্য উন্নয়ন কৌশল তৈরির লক্ষ্যে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতিবিদেরা ১৯৫৬ সালের ২৪-২৮ আগস্ট একটি সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন। সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ ও পূর্ব পাকিস্তান পরিকল্পনা বোর্ডের যৌথ উদ্যোগে। এতে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের অর্থনীতির শিক্ষক এবং পরিকল্পনা বোর্ডের অর্থনীতিবিদেরা অংশ নেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মাজহারুল হকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনের শেষে বিভিন্ন অধিবেশনের আলোচনার সারসংক্ষেপ ও সুপারিশ নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। এতে স্পষ্টভাবে বলা হয়, পাকিস্তানকে একটি ‘দুই অর্থনীতির’ দেশ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে, যেমন অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক সম্পদ জোগাড়ের বিষয়টি একক অর্থনীতির আওতায় থাকলেও দুই প্রদেশের আলাদা বৈশিষ্ট্যগুলো ধরেই পরিকল্পনা তৈরির কাজটি করতে হবে।

এই প্রতিবেদনে স্বাক্ষর দিয়েছিলেন এম এন হুদা, মাজহারুল হক, আবদুর রাজ্জাক, নূরুল ইসলাম, আবদুস সাদেক, আবদুল্লাহ ফারুক, এ এন এম মাহমুদ, সাইফুল্লাহ, মো. হোসেন ও শফিকুর রহমান। সম্মেলন শেষ হওয়ার আগেই ঢাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার কারণে এ এফ এ হোসেন, এম টি হক ও সাখাওয়াত হোসেন স্বাক্ষর দিতে পারেননি, যদিও তাঁরা এই প্রতিবেদনের সঙ্গে একমত ছিলেন। পাকিস্তান অর্থনীতি সমিতির সম্পাদক এম এন হুদা স্বাক্ষরিত এই প্রতিবেদনটিই দুই অর্থনীতির ওপর এ দেশের বুদ্ধিজীবীদের প্রথম আনুষ্ঠানিক বিবৃতি। পাকিস্তান অর্থনীতি সমিতি এবং পাকিস্তান সরকারের পরিকল্পনা বোর্ডের প্রধান অর্থনীতিবিদের নামে বিবৃতিটি প্রচার করা হয়।২

বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনের রাজনৈতিক ধারার সূচনা হয়েছিল আরও পরে, যা বেগবান হয় ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ছয় দফা প্রকাশের পর। এর ১০ বছর আগেই এ দেশের অর্থনীতিবিদেরা তার প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিলেন। অর্থনীতিবিদদের এই যাত্রায় পরে আরও অনেকের মতো শামিল হয়েছিলেন রেহমান সোবহান। দুই অর্থনীতির তত্ত্বসংবলিত প্রতিবেদনটি প্রকাশের বছর খানেকের মধ্যেই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। স্বাতন্ত্র্যবোধ আর স্বাধিকারের যে মশালটি হুদা, হক, রাজ্জাক, ইসলামরা জ্বালিয়েছিলেন, রেহমান দ্রুতই সেই মিছিলে শরিক হন।

৫.

রাজনীতি আগে না অর্থনীতি আগে, এ অতি পুরোনো তর্ক। ১৮৫৯ সালে জার্মান ভাষায় প্রকাশিত ‘জুর ক্রিটিকাদের পলিটিশেন ওকোনোমি’ (আ কন্ট্রিবিউশন টু দ্য ক্রিটিক অব পলিটিক্যাল ইকোনমি) প্রবন্ধের ভূমিকায় কার্ল মার্ক্স বলেছেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিভিন্ন পর্যায়ে সমাজে নানা ধরনের উত্পাদন সম্পর্ক তৈরি হয়, যা মানুষের ইচ্ছা-নিরপেক্ষ। উত্পাদন সম্পর্কের সমষ্টিগত অবস্থানই অর্থনীতির কাঠামো নির্ণয় করে। এর ওপর গড়ে ওঠে আইনগত ও রাজনৈতিক উপরিকাঠামো। মোদ্দা কথা, অর্থনীতিই রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে।৩ মার্ক্সের ইকোনমিক ডিটারমিনিজম তত্ত্বের সূত্রপাত এখান থেকেই।

ইউরোপের অনেক অর্থনীতিবিদ মার্ক্সের এই তত্ত্বকে অসার বলে উড়িয়ে দেন। মার্ক্সের নিজের লেখায়ও এ নিয়ে স্ববিরোধিতা লক্ষ করা যায়। তবে এই তত্ত্ব একেবারে উপেক্ষাও করা যায় না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমি ব্যাখ্যা করতে গেলে নিশ্চিতভাবেই এই অঞ্চলের মানুষের ওপর পাকিস্তানি রাষ্ট্রব্যবস্থার চাপিয়ে দেওয়া নীতির প্রসঙ্গটি চলে আসে। অর্থনৈতিক বঞ্চনা ও বৈষম্য কীভাবে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মনে ধীরে ধীরে পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল, তা আজ আর কেউ অস্বীকার করেন না। অর্থনৈতিক বঞ্চনা থেকে উত্সারিত হয়েছিল নীতিনির্ধারণে কার্যকর অংশগ্রহণের দাবি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধ এবং জাগরণ, যা একটা জাতিরাষ্ট্র গঠনের অনিবার্য উপাদান হিসেবে কাজ করেছিল। নানা তথ্য-উপাত্ত দিয়ে অর্থনৈতিক বৈষম্যের খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ করেই দাঁড় করানো হয়েছিল দুই অর্থনীতির তত্ত্ব।

৬.

রেহমান সোবহান এই বইয়ে তাঁর জীবনের নানা পর্যায় একটু একটু করে মেলে ধরেছেন। তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ও চিন্তাচর্চার ক্ষেত্রে কেমব্রিজের আবহ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিল, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাঁর কাছাকাছি বয়সের ফুফাতো ভাই কামাল হোসেন সম্পর্কে কিছু তথ্য পাওয়া যায় তাঁর বইয়ে। কামাল হোসেন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা রাজ্যের নটরডেম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাত্র ১৮ বছর বয়সে অর্থনীতির স্নাতক হন। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে এমএ পড়ার জন্য তিনি বৃত্তিও পেয়েছিলেন। কিন্তু তত দিনে তাঁর মন বদলে গেছে। তিনি অক্সফোর্ডের কুইন্স কলেজে আইনশাস্ত্র পড়তে চলে আসেন।

রেহমান সোবহান কেমব্রিজে পড়ার সময় আরও কয়েকজনের সান্নিধ্যে আসেন, যাঁরা পরে নানা বিষয়ে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন আবদুস সালাম (পদার্থবিদ্যায় নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী), মাহবুব উল হক (ইউএনডিপির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনের অন্যতম পথিকৃত্), অমর্ত্য সেন (নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ) প্রমুখ। দক্ষিণ এশীয় ছাত্রছাত্রীদের একটা সমিতি ছিল। নাম কেমব্রিজ মজলিস। রেহমান এর সভাপতি হয়েছিলেন। তাঁর কমিটির সম্পাদক ছিলেন দিলীপ আধারকার এবং কোষাধ্যক্ষ ছিলেন অমর্ত্য সেন। এই মজলিস থেকে তাঁরা সংবর্ধনা দিয়েছিলেন খ্যাতনামা ভারতীয় পরিসংখ্যানবিদ পি সি মহলানবিস, নিউ স্টেটসম্যান-এর সম্পাদক কিংসলে মার্টিন ও ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির নেতা রজনী পাম দত্তকে। ওই সময় অক্সফোর্ড মজলিসের সভাপতি ছিলেন কামাল হোসেন এবং বরুণ দে ছিলেন সম্পাদক।

রেহমান করাচি ফিরে আসেন ১৯৫৬ সালের অক্টোবরে। কেমব্রিজে থাকা অবস্থায় পেশোয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮০০ টাকা বেতনে অর্থনীতি বিভাগে রিডার (সহযোগী অধ্যাপক) হিসেবে যোগ দেওয়ার জন্য প্রস্তাব পেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ঢাকায় থাকবেন। ঢাকায় আসেন ১৯৫৭ সালের জানুয়ারি মাসে। বয়স তখন ২১। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। পূর্ব পাকিস্তানে প্রাদেশিক সরকার চালাচ্ছে আওয়ামী লীগ।

রেহমান পাকিস্তান পরিকল্পনা কমিশনে চাকরির জন্য আবেদন করেছিলেন। চাকরি পেলে তাঁকে করাচি থাকতে হতো। চাকরির সাক্ষাত্কারে তিনি বলেন, তিনি ঢাকায় থাকতে চান। তাঁকে পূর্ব পাকিস্তান পরিকল্পনা বোর্ডে যোগ দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হলো। মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান প্রশাসন ও পরিকল্পনা তৈরিতে আমলাদের প্রভাব কমানোর জন্য পরিকল্পনা বোর্ডে কয়েকজন শিক্ষাবিদকে নিয়ে এসেছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এম এন হুদা, একই বিশ্ববিদ্যালয়ের কমার্সের অধ্যাপক এ এফ এ হোসেন এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক আবদুর রাজ্জাক। বোর্ডের সহকারী প্রধান অর্থনীতিবিদ ছিলেন মোশাররফ হোসেন। মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে রেহমান সোবহানের সখ্য হলো এবং তখন থেকেই ঢাকায় মোশাররফ হলেন রেহমানের ‘গডফাদার’। মোশাররফ তখন তাঁর ফিনল্যান্ডের স্ত্রী ইনিরাকে নিয়ে নবাবপুর রোডের লাগোয়া লালচান মুকিম লেনে একটা ভাড়াবাড়িতে থাকতেন। আড়ম্বরহীন জীবন। আবদুর রাজ্জাক ছিলেন মোশাররফের শিক্ষক। সব সময় ‘স্যার’ বলতেন। সেই থেকে আবদুর রাজ্জাক রেহমানেরও স্যার হয়ে গেলেন। এই গুরু-শিষ্য সম্পর্ক শেষ পর্যন্ত বজায় ছিল।

প্ল্যানিং বোর্ডের অফিস ছিল সচিবালয়ে। রেহমান সোবহান ছয় মাস ঘোরাঘুরি করলেন। কখনো হাজারীবাগের ‘জাহান্নামে’ যান ট্যানারি দেখতে, নাকে-মুখে রুমাল চেপে। কখনো যান সচিবালয়ে চাকরির খোঁজখবর নিতে। তাঁর জুতোর সুকতলা ক্ষয় হয়ে যাওয়ার জোগাড়। দুই হাজার টাকা দিয়ে একটা সেকেন্ডহ্যান্ড গাড়ি কিনলেন। কিন্তু ঘোরাঘুরিই সার হলো। চাকরি জুটল না। অধ্যাপক এম এন হুদার পরামর্শে শেষমেশ যোগ দিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে, সিনিয়র লেকচারার (অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর) পদে। কেমব্রিজের ডিগ্রি থাকায় এই পদে সরাসরি নিয়োগ পেতে সুবিধা হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর যোগ দেওয়ার তারিখটা ছিল ১৯৫৭ সালের ২৬ অক্টোবর। শুরু হলো তাঁর জীবনের নতুন এক অধ্যায়। সহকর্মী হিসেবে পেলেন রিডার নুরুল ইসলামকে। অক্টোবরে আরও কয়েকজন তরুণ একই বিভাগে যোগ দিলেন লেকচারার পদে। তাঁদের মধ্যে ছিলেন আনিসুর রহমান, মকসুদ আলী, মুজাফফর আহমদ, মহিউদ্দিন আহমদ, মাহফুজুল হক প্রমুখ। দীর্ঘ পথপরিক্রমায় তাঁরা অনেকেই একসঙ্গে ছিলেন, একই লক্ষ্যে কাজ করেছেন। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের হাল ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান যখন পরিকল্পনা কমিশন পুনর্গঠন করেন, তখন তাঁর যাত্রা শুরু হয়েছিল নুরুল ইসলাম, রেহমান সোবহান, আনিসুর রহমান, মুজাফফর আহমদ ও মোশাররফ হোসেনের হাত ধরে। তাঁদের হাতেই তৈরি হয়েছিল বাংলাদেশের প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনা (১৯৭৩-৭৮)।

৭.

আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব খাজা নাজিমুদ্দিন সম্পর্কে কিছু তথ্য দিয়েছেন রেহমান সোবহান। নাজিমুদ্দিন সম্পর্কে রেহমানের নানা। নাজিমুদ্দিন ১৯৪৩-৪৬ সালে অখণ্ড বাংলার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৫৭ সালে দেশভাগের সময় তিনি বঙ্গীয় আইন পরিষদে সোহরাওয়ার্দীকে হারিয়ে মুসলিম লীগ সংসদীয় দলের নেতা এবং সেই সুবাদে পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মারা গেলে তিনি পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল হন। ১৯৫১ সালের অক্টোবরে পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান আততায়ীর গুলিতে নিহত হলে নাজিমুদ্দিনকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী করা হয়।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্মলগ্ন থেকেই দেশটি প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের খপ্পরে পড়ে। এর অন্যতম শিকার নাজিমুদ্দিন নিজেই। ১৯৫৩ সালের এপ্রিল মাসে গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে তাঁকে বরখাস্ত করেন। ঢাকায় ফিরে আসেন তিনি। ঢাকায় নাজিমুদ্দিনের নিজের কোনো বাড়ি ছিল না। তিনি ময়মনসিংহ রোডে ছোট ভাই খাজা শাহাবুদ্দিনের বাড়িতে উঠেছিলেন। ওই পর্যায়ের একজন রাজনীতিবিদের নিজস্ব বাড়ি নেই, এটা ভাবতেও অবাক লাগে। রাজনীতির মাঠে যাঁরা সক্রিয়, তাঁদের কেউ কেউ রাজনীতির কারণে বাড়িঘর কিংবা সহায়-সম্পত্তি হারিয়েছেন। আবার রাজনীতি করে অনেকেই বাড়ি এবং সম্পদের মালিক হয়েছেন। কী নিদারুণ বৈপরীত্য!

নানা খাজা নাজিমুদ্দিনের সৌজন্যেই রেহমান সোবহানের সঙ্গে রাজনীতির উদীয়মান তারকা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম সাক্ষাত্পর্বটি সম্পন্ন হয়েছিল। এটা ১৯৫৭ সালের জুন মাসের কথা। নাজিমুদ্দিন তাঁর ভাইয়ের বাড়িতে মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানকে নৈশভোজের আমন্ত্রণ জানান। রাজনৈতিক মতপার্থক্য এবং বিরোধ থাকা সত্ত্বেও তাঁদের মধ্যে সৌজন্য ও বিনয়ের কোনো ঘাটতি ছিল না। তাঁরা দুজনই দাওয়াত কবুল করেছিলেন। ভোজসভাটিও ছিল জাঁকজমকে ভরা। অতিথিদের মধ্যে রেহমান সোবহানও ছিলেন। শেখ মুজিব ও রেহমান সোবহানের অলক্ষ্যেই নিয়তি তাঁদের দুজনকে এক সুতোয় গেঁথেছিল।

ঢাকা ট্যানারিজের অফিস ছিল আরমানিটোলায়। কাছেই রূপমহল সিনেমা হল। সেখানে মাওলানা ভাসানী সম্মেলন ডেকেছেন। তিনি ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ ছেড়ে দিয়েছেন। কৌতূহলবশেই রেহমান গেলেন সম্মেলন দেখতে ও বক্তৃতা শুনতে। দেখলেন সম্মেলনস্থলের বাইরে জনৈক মাহবুবুর রহমান মুসলিম লীগের কিছু গুন্ডাপান্ডা নিয়ে চিত্কার-চেঁচামেচি করছে। ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মীকেও দেখলেন হইচই করছে। ওরা স্লোগান দিচ্ছে—ভাসানী গুন্ডা ভারতের দালাল। পুরো ব্যাপারটির নেপথ্যের আয়োজক ছিলেন এনএসএফের প্রতিষ্ঠাতা এ আর ইউসুফ। এ সময় আজাদ পাকিস্তান পার্টির নেতা মিয়া ইফতেখারউদ্দিন এলেন একটা গাড়িতে করে। তাঁর গাড়ির ওপর লাঠির বাড়ি পড়তে লাগল। তিনি গাড়ি থেকে যেই নামতে যাবেন, একটা লাঠির বাড়ি এসে পড়ল তাঁর হাঁটুর ওপর। গাড়ির চালক বুদ্ধি করে তাঁকে জোর করে গাড়িতে ঢুকিয়ে সোজা চলে এলেন হোটেল শাহবাগে। মিয়া সাহেব এই হোটেলেই উঠেছেন। রাতে তাঁকে দেখতে গেলেন রেহমান। এচিসন কলেজ ও কেমব্রিজে পড়ার সুবাদে তিনি মিয়া সাহেবকে আগে থেকেই চিনতেন। তাঁর হাঁটু বেশ ফুলে উঠেছে। কিন্তু মিয়া সাহেব নির্বিকার। তাঁর মন্তব্য ছিল, রাজনীতিতে এমনটা হয়। একটু পর সেখানে এলেন শেখ মুজিব। মিয়া সাহেবের খোঁজ নিতে এসেছেন। মিয়া সাহেব বাম রাজনীতির লোক। এখন ভাসানীর দিকে ঝুঁকেছেন। রাজনৈতিক শত্রুতা শেখ মুজিবের কাছে সৌজন্য প্রকাশে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। এমনটাই ছিল ওই সময়ের রাজনীতি। রেহমান সোবহানকে সেখানে দেখে শেখ মুজিব অবাক হলেন। রেহমান তাঁকে মনে করিয়ে দিলেন, খাজা নাজিমুদ্দিনের দেওয়া নৈশভোজে তাঁদের দেখা হয়েছিল। মুজিব অবাক হলেন এই ভেবে যে এই লোকটার ডান-বাম দুই দিকেই যোগাযোগ আছে!

৮.

১৯৫৮ সালের অক্টোবরে পাকিস্তানে সামরিক আইন জারি হলো। পূর্ব পাকিস্তান পরিকল্পনা বোর্ড আবারও আমলাদের দখলে গেল। বোর্ডে কর্মরত শিক্ষকেরা ফিরে এলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তত দিনে দুই অর্থনীতির তত্ত্ব আরও তীক্ষ্ন আর ধারালো হয়েছে। ১৯৬১ সালের মে মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সঙ্গে সরাসরি কথা বলার দাওয়াত পান। এই দলে ছিলেন এম এন হুদা, এ এফ এ হোসেন, আবদুল্লাহ ফারুক (মাজহারুল হকের অনুপস্থিতিতে) ও নুরুল ইসলাম। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনার পর তাঁদের বিশ্লেষণ, সুপারিশসহ একটি প্রতিবেদন তৈরি করেন নুরুল ইসলাম। দলের সবাই একমত হয়ে অনুমোদন করার পর প্রতিবেদনটি প্রেসিডেন্টের সচিবের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এই প্রতিবেদনে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের সুপারিশ ছিল। সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছিল, কেন্দ্রের হাতে স্রেফ তিনটি বিষয় থাকবে: প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্রনীতি এবং দেশের দুই অংশের মধ্যে যোগাযোগের কয়েকটি দিক।৪

১৯৬১ সালের জুন মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক নুরুল ইসলাম এবং রেহমান সোবহান কার্জন হলে দুই অর্থনীতির ওপর একটা সেমিনারের আয়োজন করেন। রেহমান সোবহান তাঁর বইয়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছেন। সেমিনারে পাকিস্তানের প্ল্যানিং কমিশনের উপপ্রধান হাবিবুর রহমান অংশ নিয়েছিলেন। সম্মেলনে নুরুল ও রেহমান দুই অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা করেন। পরদিন দ্য পাকিস্তান অবজারভার-এর পঞ্চম পাতায় সংবাদ শিরোনাম ছিল, ‘রেহমান সোবহান সেইজ পাকিস্তান হ্যাজ টু ইকোনমিজ’। ওই দিনই আইয়ুব খান ঢাকা ছেড়ে চলে যান। যাওয়ার সময় সাংবাদিকেরা দুই অর্থনীতির ওপর প্রেসিডেন্টের মন্তব্য জানতে চান। পরদিন অবজারভার-এর প্রথম পাতায় আইয়ুবের মন্তব্য ছাপা হয়েছিল এভাবে, ‘আইয়ুব খান সেইজ পরিকল্পনা হ্যাজ অনলি ওয়ান ইকোনমি’। পাকিস্তান প্ল্যানিং কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান সৈয়দ হাসান রেডিওতে প্রচারিত এক ভাষণে আঞ্চলিক বৈষম্যকে বলেছিলেন ‘ডেড হর্স’ (মৃত ঘোড়া, অর্থাত্ এর অস্তিত্ব নেই) এবং বাঙালি অর্থনীতিবিদদের তাচ্ছিল্য করে বলেছিলেন, এরা ‘বিদেশি শক্তির নিচুমানের গোলাম’। এর জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক আবু মাহমুদ, আনিসুর রহমান এবং রেহমান সোবহান ঢাকা টাইমস-এ লিখেছিলেন, ‘ডিসপ্যারিটি: ডেড হর্স অর আ লাইভ প্রবলেম’ (বৈষম্য: মৃত ঘোড়া না জীবন্ত সমস্যা)। তাঁরা সৈয়দ হাসানের যুক্তি খণ্ডন করেছিলেন।

৯.

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার সময় রেহমান সোবহান বিচিত্র ধরনের অভিজ্ঞতা লাভ করেন। ওই সময়ের রাজনীতির দলাদলি এবং নেতিবাচক দিকগুলোর অনেক চিত্র ফুটে উঠেছে রেহমান সোবহানের লেখায়। এ রকম একটা ঘটনার চাক্ষুষ সাক্ষী তিনি নিজে। বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডরে দাঁড়িয়ে তিনি যা দেখেছিলেন, তার একটা রসাল বর্ণনা পাওয়া যায় এই বইয়ে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় মওদুদ আহমদ পাকিস্তান ছাত্র শক্তি এবং এ আর ইউসুফ ও আবুল হাসনাত ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফেডারেশনের (এনএসএফ) সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৬০ সালের দিকে একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে মওদুদ হাসনাতের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছিলেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ছিলেন পল নিউম্যান। ওই বিভাগের ছাত্র তালুকদার মনিরুজ্জামান পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস না পাওয়ায় মওদুদ কয়েকজন ছাত্রকে নিয়ে নিউম্যানের কাছে প্রতিবাদ জানান। এ সময় এ আর ইউসুফের ইঙ্গিতে হাসনাত মওদুদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং তাঁর মুখে কয়েকটা ঘুষি মারেন। ঘটনাটি অনেক দূর গড়ায়। চ্যান্সেলর ছিলেন গভর্নর আজম খান। তিনি বিষয়টি হাইকোর্টের বিচারপতি আসিরকে দিয়ে তদন্ত করিয়েছিলেন। তদন্তে নিউম্যানকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বরখাস্তের সুপারিশ করা হয়েছিল। নিউম্যান তাঁর দেশ জার্মানিতে চলে যান। অদৃষ্টের কী পরিহাস! সিকি শতাব্দী পরে ইউসুফ, হাসনাত ও মওদুদ, তিনজনই জেনারেল এরশাদের মন্ত্রিসভায় একযোগে কাজ করেছেন। বন্ধুত্ব কিংবা শত্রুতা, কোনোটাই চিরস্থায়ী না।

১০.

শিক্ষকদের দলবাজি এবং সরকার-তোষণ তখনো ছিল। রেহমান সোবহান এ রকম একটা ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন। ১৯৬৩ সালে গভর্নর মোনেম খান স্বাধীনচেতা অধ্যাপক মাহমুদ হোসেনকে সরিয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহের উপাচার্য অধ্যাপক ওসমান গণিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ করেন। ওসমান গণি মোনেম খানের অনুগত ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন সিনিয়র শিক্ষককে নিয়ে সরকারপন্থী একটা চক্র গড়ে তোলেন। এই চক্রের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন গণিত বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আজিজ, রসায়ন বিভাগের প্রধান ও সলিমুল্লাহ হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক মফিজুল্লাহ, গণিতের শিক্ষক ও ঢাকা হলের (পরে নাম হয় শহীদুল্লাহ্ হল) প্রভোস্ট মুশফিকুর রহমান এবং পদার্থবিদ্যা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আবদুল মতিন চৌধুরী। গতিক সুবিধের হবে না বুঝতে পেরে মতিন চৌধুরী আণবিক শক্তি কমিশনে একটা কাজ জুটিয়ে করাচি চলে যান এবং আইয়ুব সরকারের পতন হলে ভোল পাল্টে ফেলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মতিন চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যও হয়েছিলেন। খুব দ্রুতই তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন।

১১.

রেহমান সোবহানের স্মৃতিচারণা কেবল অর্থনীতি আর রাজনীতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। একান্ত ব্যক্তিগত অন্তরঙ্গ বিষয়গুলো অনেকেই তাঁদের লেখায় এড়িয়ে যান। হয়তো কাউকে বিব্রত করতে চান না কিংবা স্ক্যান্ডাল হবে এই ভেবে চেপে যান। রেহমান সোবহান এ ধরনের ব্যক্তিগত দু-একটা বিষয় তাঁর স্মৃতিকথায় অকপটে বয়ান করেছেন। এখানে তাঁকে রক্ত-মাংসের একজন স্বাভাবিক মানুষ হিসেবেই দেখা যায়।

লন্ডনে পাকিস্তানের হাইকমিশনার ইকরামুল্লাহর বাসায় রেহমান সোবহানের যাতায়াত ছিল। হাইকমিশনারের মেয়ে সালমা রশীদ আখতার বানু সেখানে আইন পড়তেন। তাঁদের জানাশোনা হলো।

মিয়া ইফতেখার উদ্দিনের মালিকানাধীন পাকিস্তান টাইমস-এর সংবাদদাতা ছিলেন এস এম আলী। ঢাকায় আলীর সঙ্গে রেহমানের বন্ধুত্ব হয়। আলীর মাধ্যমে পরিচয় হয় ভাস্কর নভেরার। নভেরা ছিলেন আলীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আলী তখন ব্যাংকক পোস্ট-এর কাজ নিয়ে ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি রেহমানকে একদিন নভেরার কাছে নিয়ে গেলেন। নভেরা নিউ বেইলি রোডের একটা অ্যাপার্টমেন্টে একাই থাকতেন। তাঁর হাতে গোনা কয়েকজন বন্ধু ছিল। তিনি ছিলেন বস্তুত এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা। এরপর রেহমান বেশ কয়েকবার নভেরার বাসায় গেছেন। তিনি নভেরাকে সব সময় কালো পোশাক পরা অবস্থায় দেখতেন। কথা বলতেন কম। নভেরা সম্পর্কে রেহমানের মন্তব্য হলো, তিনি ছিলেন খুবই আবেগপ্রবণ। রেহমান মাঝেমধ্যে তাঁকে নিয়ে বেড়াতে বের হতেন। বাইরে থেকে থিয়েটারের কোনো গ্রুপ এলে ব্রিটিশ কাউন্সিলে তাঁরা যেতেন অনুষ্ঠান দেখতে। ওই সময় একজন অবিবাহিত তরুণ অ্যাপার্টমেন্টে একাকী বসবাসকারী একজন তরুণীর কাছে যাওয়া-আসা করেন, এটা হয়তো অনেকেই লক্ষ করেছেন। বছর খানেক চলল এ রকম। ইতিমধ্যে রেহমান সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি সালমাকে বিয়ে করবেন। রেহমান স্বীকার করেছেন, নভেরার প্রতি তাঁর দুর্বলতা ছিল। কিন্তু তিনি তখন আস্তে আস্তে রাজনীতির বৃত্তে ঢুকছেন এবং নভেরা ছিলেন বিপরীত মেরুর। এটাকে রেহমান বলেছেন প্ল্যাটোনিক সম্পর্ক। তিনি নভেরাকে সালমাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত জানালেন। নভেরা বুঝে নিলেন, তাঁদের সম্পর্কের এখানেই ইতি। এরপর নভেরা প্যারিস চলে যান (পৃ. ২১৬-২১৭)।

সালমা ১৯৫৮ সালের গ্রীষ্মে কেমব্রিজের গার্টন কলেজ থেকে আইনশাস্ত্রে বিএ অনার্স করেন এবং লিঙ্কনস ইন-এ নাম লেখান। ২১ বছর বয়সে তিনি ব্যারিস্টার হন। তিনি পাকিস্তানের দ্বিতীয় কনিষ্ঠতম ব্যারিস্টার। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলেন সালমার মামা। সোহরাওয়ার্দী চেয়েছিলেন সালমা তাঁর জুনিয়র হিসেবে আইন ব্যবসায়ে থাকুক। সালমা তাঁর রাজনীতিবিদ মামার পেছনে দৌড়াদৌড়ি করতে চাননি। সালমার বাবা পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব হিসেবে ১৯৬৯ সালে অবসরে যান এবং লন্ডনে কমনওয়েলথ ইকোনমিক কমিটির চেয়ারম্যান পদে যোগ দেন। লন্ডনেই সালমার সঙ্গে রেহমানের বিয়ে হয়। একজন সাবেক আইসিএস অফিসারের মেয়ে এবং সোহরাওয়ার্দী পরিবারের সদস্য হিসেবে যে আয়েশি জীবনে অভ্যস্ত ছিলেন সালমা, তিনি ঢাকায় একজন শিক্ষকের সীমিত আয়ের সংসারে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবেন কি না, এ নিয়ে রেহমানের মনে সংশয় ছিল। ১৯৬২ সালের ১৭ মে তাঁদের বিয়ে হয়। সালমা পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি মানবাধিকার নিয়ে অনেক কাজ করেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি গড়ে তুলেছিলেন ‘আইন ও সালিশ কেন্দ্র’। তারপরও একটা অতৃপ্তি থেকে যেতে পারে। স্বাধীনভাবে নিজের পেশায় নিয়োজিত থাকলে সমাজ হয়তো একজন দক্ষ আইনজীবী কিংবা বিচারপতি পেত।

১২.

রেহমান সোবহান আপাদমস্তক একজন শিক্ষক। আর একজন শিক্ষকের কাছে সবচেয়ে বড় সম্পদ হচ্ছে তাঁর ছাত্র। তেমনি একজন ছাত্রের কাছে সবচেয়ে বড় অবলম্বন হচ্ছেন একজন শিক্ষক। এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কে টানাপোড়েন লক্ষ করা যায় ষাটের দশকে থেকেই। সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতির কারণে অনেক ছাত্র ও শিক্ষকের পদস্খলন দেখা গেছে।

রেহমান সোবহান ১৯৫৭ থেকে ১৯৭১—একটানা ১৪ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র পড়িয়েছেন। একদিকে তিনি দেশের সেরা শিক্ষকদের পেয়েছেন সহকর্মী হিসেবে, অন্যদিকে তাঁর হাত ধরে সেরা ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি ছেড়ে সমাজের বিভিন্ন স্তরে ছড়িয়ে পড়েছেন নানা কর্মযজ্ঞে অংশ নিতে। তিনি তাঁর ছাত্রদের ভোলেননি। তবুও তাঁর একটু আক্ষেপ থেকে গেছে। শিক্ষা একটা পরিবারের কাছে বিনিয়োগের ক্ষেত্র বটে। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্রদের অনেকেই শিক্ষাবিদ না হয়ে সিভিল সার্ভিসের দিকে ঝুঁকেছিলেন। হয়তো সেখানেই বিনিয়োগ ছিল বেশি ঝুঁকিমুক্ত এবং লাভজনক। এ প্রসঙ্গে তিনি যাঁদের নাম উল্লেখ করেছেন, তাঁরা সবাই পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া, যাঁদের পেলে বিশ্ববিদ্যালয় বর্তে যেত। তাঁদের মধ্যে আছেন ফখরুদ্দীন, মির্জ্জা আজিজ, এ এম এ রহিম, আবুল আহসান, মনোয়ারুল ইসলাম, মোস্তফা ফারুক মোহাম্মদ, শামসুল আলম, ফরাসউদ্দিন ও শাহ মোহাম্মদ ফরিদ। শিক্ষার জগতে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আজিজুর রহমান খান। লেকচারার হিসেবে যোগও দিয়েছিলেন। ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকার কারণে সরকারি গোয়েন্দা সংস্থার ছাড়পত্র না পাওয়ায় তাঁর চাকরি নিয়মিত করা হয়নি। তিনি দেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান এবং ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হন। তাঁর আরেকজন ছাত্র আমিনুল ইসলামের একই কারণে একই পরিণতি হয়েছিল। স্বদেশ বোস তাঁর রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঠাঁই পাননি। আমিনুল ইসলাম এবং স্বদেশ বোস পরে করাচিতে পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিকসে (পিআইডিই) যোগ দিয়েছিলেন। ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া আরেকজন ভালো ছাত্রের কথা রেহমান বলেছেন, যিনি রাজনীতিকেই কর্মক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। তিনি হলেন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। তাঁর আরেকজন ছাত্র রাশেদ খান মেনন ছাত্র ইউনিয়নের বড় নেতা ছিলেন। এমএ পরীক্ষার সময় তিনি জেলে ছিলেন। এটা ১৯৬৫ সালের কথা। মেননের মৌখিক পরীক্ষা নেওয়ার জন্য অধ্যাপক আবু মাহমুদ, আনিসুর রহমান ও রেহমান সোবহান ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়েছিলেন। পরীক্ষায় মেনন তাঁর ক্লাসে পঞ্চম স্থান পেয়েছিলেন। তিনিও কর্মক্ষেত্র হিসেবে রাজনীতিকেই বেছে নেন।

১৩.

সংকীর্ণ গোষ্ঠীস্বার্থে সরকারের উঁচু পর্যায়ের মদদে যদি ছাত্রসংগঠনকে ব্যবহার করা হয়, তবে ওই সংগঠন নিতান্তই লাঠিয়াল বাহিনী হয়ে পড়ে। গভর্নর মোনেম খান ১৯৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত হওয়ার পর থেকেই এনএসএফকে সরকারের লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করতে থাকেন। তাদের সমর্থনে কয়েকজন শিক্ষকও জুটে যান। ঢাকা হলের প্রভোস্ট মুশফিকুর রহমান সরাসরি এনএসএফকে সমর্থন করতেন। ঢাকা হলে ছাত্রসংসদ নির্বাচনে এনএসএফ সব সময় জিতে যেত।

ষাটের দশকজুড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল উত্তপ্ত। একদিকে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও আন্দোলন, অন্যদিকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এনএসএফের পেশিশক্তির ব্যবহার। ১৯৬৪ সালে কার্জন হলে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে এর একটা বিস্ফোরণ ঘটে। অনুষ্ঠানটি পণ্ড হয়ে যায়। শেখ ফজলুল হক মণি ছিলেন ছাত্রলীগের নেতা। তাঁর শাস্তি হয়। তাঁর এমএ ডিগ্রি বাতিল করে দেওয়া হয়। শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের একজন ছিলেন রেহমান সোবহানের ছাত্র জাকির আহমদ। জাকির ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। জাকির হাইকোর্টে মামলা ঠুকে দেন। মামলায় তাঁকে সহযোগিতা দেন কামাল হোসেন। কামালের মাধ্যমে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এস আর পাল জাকিরের পক্ষে দাঁড়ান। হাইকোর্টের বিচারপতি সাত্তার জাকিরের পক্ষে রায় দেন। হাইকোর্ট শাস্তি বাতিল করলেও মামলাটি সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। ‘জাকির আহমদ বনাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ মামলাটি ওই সময় বেশ আলোচিত হয়েছিল এবং ‘ল রিপোর্ট’-এ তা জায়গা করে নিয়েছিল। জাকির আহমদ পরে আইন পেশায় যুক্ত হন এবং আশির দশকে হাইকোর্টের বিচারপতি হয়েছিলেন।

১৪.

কোনো ধরনের সমালোচনা সরকারের ধাতে সয় না। সম্ভবত এটাই প্রকৃতির অলিখিত নিয়ম, বিশেষ করে পশ্চাদপদ সমাজে। অন্যায় দেখলে মানুষ প্রতিবাদী হবে, এটাই স্বাভাবিক। বিশেষ করে তরুণেরা, ছাত্ররা কখনোই বিনা প্রতিবাদে চাপিয়ে দেওয়া কোনো অন্যায় বা অন্যায্য সিদ্ধান্ত মেনে নেয় না। সে জন্য তরুণদের বিভক্ত করতে বা দমিয়ে রাখতে সরকার নানা ফন্দি আঁটে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লাঠিয়াল বাহিনী পোষে, দালাল বুদ্ধিজীবী তৈরি করে এবং নানাভাবে তাঁদের পারিতোষিক দেওয়ার বন্দোবস্ত করে। মোনেম খানের আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও পেশিশক্তি ব্যবহার করে ছাত্র-শিক্ষকদের মুখ বন্ধ রাখার চেষ্টা হয়েছিল। ষাটের দশকের ওই সময়ের অন্ধকার দিনগুলোর বর্ণনা পাওয়া যায় রেহমান সোবহানের বইয়ে।

সরকারের ঠ্যাঙারে বাহিনীর পোশাকি নাম ছিল এনএসএফ। এদের একজন নেতা জাহাঙ্গীর ফয়েজ ঢাকা হলের প্রভোস্টের মদদে হলে মাফিয়া রাজত্ব কায়েম করেছিল। তার সহযোগীদের মধ্যে ছিল সাইদুর রহমান, যে পাঁচপাত্তু নামে পরিচিত ছিল। সে অবশ্য আয়েশ করে বলত পাসপার্ট টু, যদিও এ নামে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ডিগ্রি ছিল না। জাহাঙ্গীরের আরেক সঙ্গী ছিল খোকা। সে গলায় একটা জ্যান্ত সাপ পেঁচিয়ে হেঁটে বেড়াত। তাদের সবার নেতা ছিল রেহমান সোবহানেরই একজন ছাত্র, জমির আলী। জমির আলীর সঙ্গে মোনেম খানের দুই ছেলের ভালো যোগাযোগ ছিল। সরকারপ্রধানের ছেলে যদি গুন্ডামি করে বেড়ায়, তখন শৃঙ্খলা বলতে আর কিছু থাকে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা তখন অনেকটা ওই রকমই ছিল। সরকারি মদদে দুর্বৃত্তায়ন ষোলোকলায় পূর্ণ হয়েছিল। উপাচার্য অধ্যাপক ওসমান গণি সরাসরি এদের পৃষ্ঠপোষকতা দিতেন।

অধ্যাপক আবু মাহমুদ সদ্য হার্ভার্ড থেকে পিএইচডি করে ফিরেছেন। তিনি মার্ক্সবাদী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ১৯৬৪ সালে বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক নুরুল ইসলাম পিআরডিইর পরিচালক পদে নিয়োগ পেয়ে করাচি চলে যান। সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে অধ্যাপক মাহমুদ অর্থনীতি বিভাগের প্রধান হলেন। কে টি হোসেন, আনিসুর রহমান ও রেহমান সোবহান তখন অর্থনীতি বিভাগের রিডার (সহযোগী অধ্যাপক)। আনিসুর রহমান তখন বিদেশে। উপাচার্য করলেন কী; তিনি সবাইকে ডিঙিয়ে অপেক্ষাকৃত জুনিয়র কে টি হোসেনকে বিভাগীয় প্রধান পদে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেন। অধ্যাপক মাহমুদ এই নিয়োগকে চ্যালেঞ্জ করে আদালতে মামলা ঠুকে দেন। হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ মামলার শুনানি করেন। মামলার কাজ গোছানোর দায়িত্ব নেন কামাল হোসেন। আইনজীবী এস আর পাল আদালতে মাহমুদের পক্ষে দাঁড়ান। মামলায় মাহমুদের জয় হয়। উপাচার্যের হাইকোর্টের রায় উপেক্ষা করে কে টি হোসেনকে বিভাগীয় প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন। মাহমুদ তখন আদালত অবমাননার মামলা করেন। বিচারপতি মোর্শেদ উপাচার্যকে আদালত অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে রায় দেন।

উপাচার্য এবং তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা হাইকোর্টের রায় হজম করতে পারেননি। ১৯৬৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চরম অঘটন ঘটল। মাহমুদ গাড়িতে করে তাঁর বাসায় যাচ্ছিলেন। এনএসএফের জাহাঙ্গীর ফয়েজ, আলতাফ হোসেন, পাঁচপাত্তু, খোকা এবং আরও দুজন হকিস্টিক নিয়ে তাঁকে আক্রমণ করে। গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। মাহমুদকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করা হয়। তাঁকে কয়েক সপ্তাহ হাসপাতালে থাকতে হয়।

এর কিছুদিন আগে এনএসএফের কয়েকজন অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র মাহবুবউল্লাহকে কলাভবন চত্বরে পিটিয়েছিল। মাহবুবউল্লাহ পিকিংপন্থী ছাত্র ইউনিয়নের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। আহত অবস্থায় মাহবুবউল্লাহ অধ্যাপক আবু মাহমুদের কামরায় আশ্রয় নেন এবং তাঁর লাঞ্ছনার বর্ণনা দেন। তাঁর কাছ থেকে জানা যায়, এনএসএফের গুন্ডারা অর্থনীতি বিভাগের সরকারবিরোধী শিক্ষকদের দেখে নেবে বলে হুমকি দিয়েছে। মাহবুবউল্লাহ পরে কমিউনিস্ট পার্টির মতিন-আলাউদ্দিন গ্রুপে যুক্ত হন। তিনি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে তিনি রেহমান সোবহানের কাছে চিঠি লিখেছিলেন।

কয়েক দিন পর গভর্নর মোনেম খান গভর্নর হাউসে কয়েকজন সিনিয়র শিক্ষককে ডেকে পাঠান। শিক্ষকেরা ন্যায়বিচার দাবি করলে তিনি তাঁদের তিরস্কার করেন। তিনি বলেন, মাহমুদ তাঁর প্রাপ্য পেয়েছেন। মোনেম খান তাঁর নিচুমানের শিক্ষাগত যোগ্যতার কারণে হীনম্মন্যতায় ভুগতেন। নিজের পক্ষে সাফাই গাইতে তিনি যুক্তি দিতেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তো বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ডিগ্রি ছিল না!

কয়েক সপ্তাহ পর প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ঢাকা সফরে আসেন। নাগরিকদের একটা প্রতিনিধিদল বেগম সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে আইয়ুবের সঙ্গে দেখা করে। ওই দলে কামাল হোসেনও ছিলেন। মোনেম খান এর আগেই আইয়ুব খানকে কানপড়া দিয়ে থাকবেন। তিনি আগত অতিথিদের বিরুদ্ধে বেশ আক্রমণাত্মক ভাষায় কথা বলেন। তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা রাজনীতি করেন, তাঁরা সরকারবিরোধী এবং পাকিস্তানবিরোধী। বেগম সুফিয়া কামাল কথা বলছিলেন উর্দুতে। তিনি ইনসানিয়াতের (মানবিকতা) দোহাই দিয়ে প্রেসিডেন্টকে পরিস্থিতি সামাল দিতে অনুরোধ করেন। আইয়ুব উর্দুতে জবাব দেন, সরকারবিরোধীরা ইনসান (মানুষ) নয়, তারা হায়ওয়ান (জানোয়ার)।

পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছিল। অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাককে হেনস্তা করার ফন্দি আঁটে কর্তৃপক্ষ। তিনি দীর্ঘ ছুটি নিয়ে ১৯৬৭ সালে ইংল্যান্ডে চলে যান। আবু মাহমুদ পদত্যাগ করে জাতিসংঘের চাকরি নিয়ে ব্যাংককে যান। মুজাফফর আহমদও পদত্যাগ করেন এবং ইউনাইটেড ব্যাংকের উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দিতে করাচি চলে যান। আনিসুর রহমান যোগ দেন যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে। রেহমান সোবহান ফোর্ড ফাউন্ডেশনের একটা বৃত্তি নিয়ে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসে যান পিএইচডি করতে। সরকারের পেটোয়া বাহিনীর দৌরাত্ম্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তখন রীতিমতো নরক। রেহমানের পিএইচডি করার জন্য যথেষ্ট প্রস্তুতি ছিল না। দুই বছর পর তিনি ফিরে আসেন। তত দিনে দেশ অনেকটা বদলে গেছে। ১৯৬৮-৬৯ সালে দেশে ঘটে গেছে একটা গণবিপ্লব। আইয়ুব-মোনেমের সূর্য অস্তাচলে গেছে। ক্ষমতায় আসীন হয়েছে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বে সামরিক জান্তা।

১৫.

রেহমানের লড়াইয়ের প্রধান অস্ত্র ছিল কলম। কলমের লড়াইয়ে দরকার হলো একটা বাহনের। এখানে দেখা গেল কামাল হোসেনের সঙ্গে তাঁর মিলিত প্রয়াস। ‘ফোরাম’ নামে একটা ইংরেজি সাপ্তাহিকের ডিক্লারেশন নিলেন কামাল, নিজেই হলেন প্রকাশক। সম্পাদক হলেন তাঁর স্ত্রী হামিদা হোসেন। রেহমান সোবহান পত্রিকা বের করার যাবতীয় দায়িত্ব নিলেন, হলেন নির্বাহী সম্পাদক। দৈনিক সংবাদ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল। কর্মী জোগান দিয়ে তো সাহায্য করলই, বিনা পয়সায় সংবাদ-এর ছাপাখানায় ছাপা হতো ফোরাম। প্রতি সংখ্যার দাম আট আনা।

একদিকে চলছে মাঠে-ময়দানে স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে রাজনীতির লড়াই। নেতৃত্বে শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে ফোরাম-এ ছাপা হচ্ছে অর্থনৈতিক বৈষম্য আর বঞ্চনা নিয়ে শাণিত সব প্রতিবেদন আর প্রবন্ধ। ‘বিটুইন দ্য লাইন’ নামে নিয়মিত কলাম পাঠাতেন লাহোর থেকে মজহার আলী খান। আরও লিখতেন করাচির এম ভি নাকভি এবং ঢাকার এবিএম মূসা, এ এল খতিব, রাজিয়া খান আমিন, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, মঈদুল হাসান, মওদুদ আহমদ, সিরাজুল হোসেন খান প্রমুখ। এ ছাড়া ফোরাম-এ মাঝেমধ্যে লিখতেন নুরুল ইসলাম, আনিসুর রহমান, আখলাকুর রহমান, এ আর খান, কবিরউদ্দিন আহমদ, মোজাফফর আহমদ চৌধুরী, কে জি মুস্তাফা। এমনকি অমর্ত্য সেন, হামজা আলাভি ও নেভিল ম্যাক্সওয়েলের মতো মানুষেরাও ফোরাম-এ লিখেছেন।

চলতি পুঁজি জোগাড়ের জন্য ফোরাম-এর আজীবন গ্রাহক সংগ্রহের চেষ্টা চালানো হয়। এক হাজার টাকা অগ্রিম দিলেই একজনকে আজীবন গ্রাহক করা হতো। প্রথম আজীবন গ্রাহক হলেন স্বয়ং শেখ মুজিব। ১৯৬৯ সালের ২২ নভেম্বর রমনার সবুজ চত্বরে ফোরাম-এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। ওই অনুষ্ঠানেই শেখ মুজিব এক হাজার টাকা দিয়ে গ্রাহক হয়ে যান। ম্যাগাজিন সাইজের এই সাপ্তাহিকীটি বের হতো রোববারে। নিউজপ্রিন্টে ছাপা হলেও প্রচ্ছদে থাকত কার্টুনচিত্র।

১৬.

১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে বিপুল বিজয়ের পর আওয়ামী লীগের সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল ছয় দফার ভিত্তিতে একটা সংবিধান তৈরি করা। এত দিন যা ছিল দাবি, এখন তা হয়ে দাঁড়াল দায়িত্ব। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, এ এইচ এম কামারুজ্জামান ও খন্দকার মোশতাক আহমদকে নিয়ে শেখ মুজিবের একটা অনানুষ্ঠানিক হাইকমান্ড ছিল। শেখ মুজিব তাঁদের নিয়ে বারবার বৈঠক করেন। কিন্তু সংবিধান তৈরির জন্য দরকার বিশেষজ্ঞের। শেখ মুজিব এ কাজে তাঁর পরীক্ষিত সহযোগীদের জড়ালেন, যাঁরা এত দিন বুদ্ধিবৃত্তিক ফ্রন্টে স্বাধিকারের জন্য লড়াই করে আসছিলেন। রেহমান সোবহানের বিবরণ থেকে জানা যায়, বিশেষজ্ঞদের মধ্যে ছিলেন নুরুল ইসলাম, মোজাফফর আহমদ চৌধুরী, খান সরোয়ার মুরশিদ, আনিসুর রহমান, কামাল হোসেন এবং তিনি নিজে। একাত্তরের উথালপাতাল দিনগুলোতে লোকচক্ষুর আড়ালে চলত তাঁদের আলোচনা। তাঁরা খসড়া তৈরি করে শেখ মুজিবকে দিতেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে সংলাপ ও দর-কষাকষির জন্য একা খসড়া সংবিধান তৈরির কাজটা মুজিব আগেভাগেই করে রাখলেন।

১৭.

১ মার্চ ইয়াহিয়ার নামে প্রচারিত বেতার ভাষণে ৩ মার্চ অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত হওয়ার ঘোষণা প্রচারিত হলে মানুষ পাকিস্তানি পতাকা পুড়িয়ে বিক্ষোভ জানায়। শেখ মুজিব সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। ওই আন্দোলনে আরও অনেকের মতো দেশের সামনের কাতারের অর্থনীতিবিদেরাও শরিক হন। রেহমান সোবহানের বর্ণনায় জানা যায়, নুরুল ইসলামের ধানমন্ডির বাসা তখন তাঁদের আলাপ-আলোচনার একটা কেন্দ্র হয়ে ওঠে। শিগগিরই তা গোয়েন্দাদের নজরদারিতে চলে আসে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কর্নেল ইয়াসিন এবং টিঅ্যান্ডটি বিভাগের কর্মকর্তা এম হুদা ছিলেন নুরুল ইসলামের আত্মীয়। তাঁর ওই বাসায় নিয়মিত যেতেন। ঢাকা সেনাবাহিনীতে বিভিন্ন সামগ্রী সরবরাহের দায়িত্বে ছিলেন কর্নেল ইয়াসিন। সেনাবাহিনীতে খাবার সরবরাহকারীদের একটা তালিকা তৈরি করে তিনি আওয়ামী লীগের নেতাদের হাতে তুলে দেন। আওয়ামী লীগের কর্মীরা ওই সরবরাহকারীদের সবাইকে খুঁজে বের করে এবং খাবার সরবরাহ থেকে নিবৃত্ত করে। এই কৌশলটি পাকিস্তানি সেনাদের কাবু করতে কাজে লেগেছিল। ইয়াসিন এবং হুদা দুজনকেই ২৫ মার্চের পর গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁরা অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হন। ইয়াসিনকে লাহোরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং বাঙালি জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের সঙ্গে একই মামলায় বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছিল।

১৮.

সংলাপ ব্যর্থ হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরোধ আন্দোলন সশস্ত্র রূপ নিল এবং একটা সর্বাত্মক মুক্তিযুদ্ধের পর্বে প্রবেশ করল একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে। পূর্ব পাকিস্তান এখন বাংলাদেশ। বাংলাদেশের নতুন নাম হলো পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ (গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ)। অনেকেই জানেন না এই নামকরণের ইতিহাস। এ প্রসঙ্গে মঈদুল হাসান বলেছেন:

রেহমান সোবহান বোধ হয় কখনো এটা দাবি করেননি, কিন্তু আমি বিষয়টা জানি। তিনিই বাংলাদেশের এই নামকরণ করেন। এই নামটা এখনো চলছে।৫

১৯.

রেহমান সোবহান স্মৃতিকথা লিখলেও নিজের নামে অনাবশ্যক ঢোল পেটাননি। ব্যক্তিগত প্রসঙ্গগুলো বারবার উল্লেখ করলেও নেপথ্যে উঠে এসেছে ওই সময়ের ঘটনাপ্রবাহ, ইতিহাসের নানা চরিত্র, যা হয়ে উঠেছে সময়ের এক নির্মোহ দলিল। রেহমানের এই বই হলো একজন তরুণ শিক্ষকের অ্যাকটিভিস্ট হয়ে ওঠার গল্প, যিনি নিরন্তর লড়াই করে গেছেন বুদ্ধিবৃত্তিক ফ্রন্টে। ইউরোপে ‘পাবলিক ইনটেলেকচুয়াল’ কথাটি চালু আছে। এ হলো এমন একটি প্রতিভূ, যেখানে একজন বুদ্ধিজীবী একই সঙ্গে হয়ে যান সমাজবদলের সৈনিক। সেই যুদ্ধটি রেহমান সোবহান লাঠিসোঁটা কিংবা বন্দুক দিয়ে করেননি। মেধা ও মনন দিয়ে কলম হাতে নিয়ে করেছেন। এ লড়াইয়ে আরও অনেকেই ছিলেন। তিনি তো অবশ্যই ছিলেন।

তথ্যসূত্র

১.         Humayun, Syed (1995), Sheikh Mujibs 6-Point Formula: An Analytical Study of the Breakup of Pakistan. Royal Book Company, Karachi, p. 411-415

২.         Islam, Nurul (2013). Making of a Nation Bangladesh: An Economist's Tale, UPL, Dhaka, p. 38-44

৩.        Marx, Karl (1977). A Contribution to the Critique of Political Economy, Progress Publishers, Moscow.

৪.         নুরুল ইসলাম, ছয় দফা ও দুই অর্থনীতি, প্রতিচিন্তা, পঞ্চম বর্ষ, চতুর্থ সংখ্যা, অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০১৫, ঢাকা, পৃ. ১১

৫.         এ কে খন্দকার; মঈদুল হাসান; এস আর মীর্জা (২০১৪), মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর: কথোপকথন, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, পৃ. ২৫