সারসংক্ষেপ
আমাদের সমাজের ইতিহাস লেখার দৃষ্টিভঙ্গি মূলত পুরুষতান্ত্রিক। পুরুষদেরকেই আমরা ইতিহাসের নায়ক বা খলনায়ক হিসেবে দেখে অভ্যস্ত। কিন্তু ইতিহাসের নানান বাঁকে নারীরাও রেখেছিলেন গৌরবোজ্জ্বল অবদান। এমনই এক মহীয়সী নারীর নাম লীলাবতী নাগ। আসামের গোয়ালপাড়া শহরে ১৯০০ সালের ২ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করা লীলাবতী নাগ ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের এক অগ্রবর্তী সৈনিক। তবে তিনি শুধু রাজনীতিতেই তাঁর কর্মকাণ্ডকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। নারীশিক্ষা এবং নারীদের রাজনীতিসচেতন করে তুলতে তাঁর অবদান প্রাতঃস্মরণীয়। বিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই ছিলেন দক্ষ সংগঠক। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘দীপালী সংঘ’ নামে নারী সমিতি। ১৯২৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘নারীশিক্ষা মন্দির’ নামে বিদ্যালয়। ১৯৩১ সালে প্রকাশ করেন জয়শ্রী নামক নারীদের পত্রিকা। এই পত্রিকার বিস্তার ঘটল সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক দূরদৃষ্টির প্রসার ঘটানোর প্রয়াসে। তাঁর সাধনা ছিল নতুন সমাজ, নতুন জীবন, নতুন মানুষ গড়ে তোলার। রাজনৈতিক শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য, মানুষের কল্যাণের জন্য, ব্রিটিশদের শাসনমুক্ত হওয়ার স্বাধীনতার স্বপ্ন যখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার রক্তে ভেসে যাচ্ছিল, তখন ১৯৪৭ সালে তিনি ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শান্তি কমিটি। দেশভাগের পর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আর নিরাপত্তা-সংকটের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দু সম্প্রদায়ের জনস্রোত সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে বাস্তুত্যাগী হতে শুরু করলে, তিনি পশ্চিমবঙ্গে তাদের জন্য আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক পুনর্বাসনের কাজে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। এই প্রবন্ধে লীলা নাগের কর্মময় জীবনের মূল বিষয়গুলো আলোচিত হয়েছে। একই সাথে উঠে এসেছে ওই সময়কার সমাজবাস্তবতায় একজন নারীর পক্ষে সক্রিয় রাজনীতিতে অংশ করা কতটা সাহসের বিষয় ছিল, সেই দিকটিও।
মুখ্য শব্দগুচ্ছ
নারীশিক্ষা, লীলাবতী নাগ, নারী আন্দোলন, দীপালী সংঘ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন।
তুমি কি কেবলই ছবি, শুধু পটে লিখা।
ওই-যে সুদূর নীহারিকা
যারা করে আছে ভিড় আকাশের নীড়
ওই যারা দিনরাত্রি
আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী গ্রহ তারা রবি,
তুমি কি তাদের মতো সত্য নও।
হায় ছবি, তুমি শুধু ছবি
নয়নসমুখে তুমি নাই,
নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই—আজি তাই
শ্যামলে শ্যামল তুমি, নীলিমায় নীল।
আমার নিখিল তোমাতে পেয়েছে তার অন্তরের মিল।
নাহি জানি, কেহ নাহি জানে—
তব সুর বাজে মোর গানে,
কবির অন্তরে তুমি কবি—
নও ছবি, নও ছবি, নও শুধু ছবি ১
এক শ্রদ্ধেয় লীলাবতী নাগ, আপনার সঙ্গে আমার প্রথম পরোক্ষ সাক্ষাত্ ঘটেছিল ১৯৫৪ সালে। সেই বছর চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিলাম আপনার প্রতিষ্ঠিত ‘নারীশিক্ষা মন্দির’ (২ ফেব্রুয়ারি ১৯২৮) বিদ্যালয়ে।২ বিদ্যালয়টির বড়দিদির (প্রধান শিক্ষয়িত্রী) অফিস ঘরের দেয়ালে একটি বড় বাঁধানো আলোকচিত্র টানানো ছিল আপনার। স্কুলের শিক্ষয়িত্রীরা শিক্ষাবর্ষের শুরুতে ছাত্রীদের কাছে আপনার পরিচিতি, কর্মকাণ্ড, শিক্ষাচর্চা বিষয়ে বিশদভাবে বলতেন। সে সময়ে পরম শ্রদ্ধায় আপনার কথা বলতেন বিদেশিনী দিদি, জ্যোতি দিদি, ইনু দিদি। ভাসা-ভাসা বুঝতাম আপনি মেয়েদের শিক্ষার জন্য জীবন উত্সর্গ করেছেন। বড় হতে হতে জানলাম আপনি কলকাতায় শিক্ষা, রাজনীতি, পূর্ববঙ্গের বাস্তুত্যাগীদের জন্য নানা কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দিয়ে সাংগঠনিকভাবে সক্রিয় থেকে কাজ করে যাচ্ছেন।৩ আপনার প্রতিষ্ঠিত ‘নারীশিক্ষা মন্দির’ বিদ্যালয়ে আমি ১৯৬০ সাল পর্যন্ত পড়েছি; ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি হয়েছিলাম ইডেন কলেজে। আইএ পাস করে ভর্তি হই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তত দিনে জেনেছি আপনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দুজন ছাত্রীর একজন, যিনি সহশিক্ষার বন্ধ দরজা উন্মুক্ত করতে একরোখা প্রতিবাদে জয়ী হয়েছিলেন। খুব দেখার ইচ্ছা হতো আপনাকে। আপনি কেন চলে গেলেন নিজের দেশ আর জন্মভূমি ছেড়ে? কর্মযজ্ঞের বিপুল সাফল্যময় সুকীর্তিগুলো অসমাপ্ত রেখে চলে গেলেন কেন? ধীরে ধীরে জেনেছি চলে যেতে আপনাকে বাধ্য করেছিল (১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর)—পাকিস্তান সরকার ১৯৪৮ সালে। পাকিস্তান সরকার আপনার প্রতিষ্ঠিত ‘নারীশিক্ষা মন্দির’ স্কুলের নাম বদলে ‘শের-এ-বাংলা বালিকা বিদ্যালয়’ করেছিল। জানি না আপনি জেনেছিলেন কি না। আপনার প্রতিক্রিয়ার বিষয়েও জানি না। তবে আমরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলাম বাংলাদেশের নারী-মানবাধিকার সামাজিক আন্দোলনের পথিকৃত্ কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে।
আপনি কেন একবারও পূর্ব পাকিস্তানে আসেননি? জেনেছি, সেটাও রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞার জন্য। দেশভাগের পর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আর নিরাপত্তা-সংকটের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দু সম্প্রদায়ের জনস্রোত সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে বাস্তুত্যাগী হতে শুরু করলে পশ্চিমবঙ্গে তাদের জন্য আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক পুনর্বাসনের কাজে আপনি সম্পৃক্ত হলেন। আজীবন তাদের পাশে ছিলেন।
আপনার জীবনের তিন দশক (’২০, ’৩০, ’৪০—দশকের) বা ত্রিশটি বসন্তের যত ফুল, যত গান, যত কবিতা, যত কর্মোদ্যোগ ‘ঢাকা’-কে ঘিরে উত্সারিত হয়েছিল, সেসব ধ্বংস হতে শুরু করল। সেসবের প্রাণভোমরা ছিলেন আপনি। আপনাকে ঘিরে কর্ম-উদ্দীপক হাজার হাজার নারী-পুরুষের জীবন অস্থিতিশীল হয়ে পড়ল। তাদের পাশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় বিধ্বস্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষ সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে যেতে বাধ্য হলেন। তাদের পাশে আপনি ছিলেন পশ্চিমবঙ্গে। বড় হতে হতে সেই সব কর্মকাণ্ডের ইতিহাস পাঠে আপনার স্থির-অবিচল, যন্ত্রণাবিদ্ধ-সফল জীবনযাত্রার অনুষঙ্গী হওয়ার প্রেরণা পেয়েছিলাম।
ভেবেছিলাম যদি সুযোগ পাই একবার কলকাতায় গিয়ে আপনার সাক্ষাত্ পেতে চেষ্টা করব। তা আর হলো না। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতায় ভারতের নারী সংগঠনগুলোর সহযোগিতায় যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে কাজ করার সুবাদে আমরা অধীর আগ্রহে আপনার সাক্ষাত্ পাওয়ার আশা করেছিলাম। দুঃখে-কষ্টে-অশ্রু ভারাক্রান্ত হয়ে শুনলাম, ১৯৬৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সেরিব্রাল আক্রমণে অসুস্থ হয়ে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় আড়াই বছর পর ১৯৭০ সালের ১১ জুন রাত ১২টা ২০ মিনিটে ইহজীবন ত্যাগ করেছেন।৪ এই দুঃখ আমি আজও বহন করে চলেছি। দেখা হলো না, সাক্ষাতে জানা হলো না আপনাকে।