ইতিহাসের আলোকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

প্রাক্-কথন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শ বছর পূর্তি হতে আর মাত্র চার বছর বাকি। একটি জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে প্রাচীন, ঐতিহ্যবাহী ও প্রধান উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক পালাবদলের প্রধানতম কেন্দ্র হিসেবে গত ছিয়ানব্বই বছরে তার অর্জন ও বিসর্জনের তালিকা অনেক দীর্ঘ। কিন্তু তার অতীতের বিপুলতর সাফল্য এবং বর্তমানের পাহাড়ভারী জরাগ্রস্ততার উত্স ও কারণ সম্বন্ধে চিন্তাশীল ও গবেষণামূলক আলোচনার পরিমাণ লজ্জাজনকভাবে কম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা সম্পর্কে এখনো পর্যন্ত প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য বইয়ের সংখ্যা বড়জোর এক কুড়ি। ষাটের দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো ও শিক্ষাপরিবেশগত সমস্যা চিহ্নিত করে কয়েকটি বই লেখা হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস লেখার প্রথম প্রয়াস ছিল ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রকাশিত ড. এম এ রহিমের The History of The University of Dacca (১৯৮১) বইটি১। এই বইতে বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ষাট বছরের একাডেমিক ও অবকাঠামোগত বিকাশের বিবরণ দেওয়া হয়েছে, বিশ্লেষণ ছিল সামান্য, তথ্যগত অনেক দুর্বলতাও আছে। এরপরে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সম্পাদনায় দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয় ১৯৭০ পর্যন্ত প্রদত্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন বক্তৃতার সংকলন২। এই সংকলন অনেক কারণে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হতে পারে। তবে এই বইয়ের সবচেয়ে বড় তাত্পর্য হলো, এটি আমাদের উচ্চশিক্ষাদর্শনের ব্লুপ্রিন্ট, উচ্চশিক্ষা সম্পর্কে আমাদের ধারণাগত পরিবর্তন বোঝার জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ উত্স। ব্যক্তি উদ্যোগে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সবচেয়ে বড় ভলিউমে কাজ করেছেন রতন লাল চক্রবর্ত্তী। প্রাথমিক উত্স ও দুষ্প্রাপ্য দলিলাদি ব্যবহার করে তিনি রচনা করেছেন ৪৪৭ পৃষ্ঠায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রন্থিত ইতিহাস৩, ১১৮৮ পৃষ্ঠায় দুই খণ্ডে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৪৭-১৯৭১)৪, ৩৭৬ পৃষ্ঠায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ (১৯২১-২০০০)৫ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী ১৯২১-১৯৫২৬। বস্তুত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেকর্ডরুমে আকর-উেসর যে স্বর্ণখনি অযত্নে-অবহেলায় পোকার খাবার হচ্ছে, তার সদ্ব্যবহার রতন লাল চক্রবর্ত্তীর মতো আর কোনো গবেষক করতে পারেননি। ড. মুহাম্মদ আবদুল্লাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে স্বতন্ত্র কোনো গ্রন্থ রচনা করেননি। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রধান দুই কান্ডারি নওয়াব সলিমুল্লাহ ও নওয়াব আলী চৌধুরীর একমাত্র প্রামাণ্য জীবনী৭ লেখার কৃতিত্ব তাঁর। এসব জীবনীতে পুরোনো পত্রিকা ও দলিল-দস্তাবেজ ঘেঁটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পটভূমি নিয়ে যে আলোচনা করেছেন, তা এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে তথ্যনিষ্ঠ ও প্রামাণ্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্য নিদর্শনের বর্ণনা ও ছবি নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন আয়শা বেগম৮। রঙ্গলাল সেন ও রফিকুল ইসলাম লিখিত বই দুটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন কিন্তু পুরোপুরি গবেষণানির্ভর নয়৯। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি বিভাগের ইতিহাস রচনার প্রয়াসও লক্ষ করা গেছে।১০ এর বাইরে প্রকাশিত হয়েছে কালপঞ্জি ধরনের কয়েকটি বই।১১ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জীবনী, আত্মজীবনী ও সাক্ষাত্কার, স্মৃতিচারণামূলক রচনা, বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন, বিভিন্ন হল অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন কর্তৃক প্রকাশিত গুরুত্বপূর্ণ স্মারকগ্রন্থ— এসবের পরিমাণ বিশাল। তবে এসব তো ইতিহাস নয়, ইতিহাসের উপাদান মাত্র। উচ্চশিক্ষা-সম্পর্কিত কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে১২, যেগুলোতে আবশ্যিকভাবে এসেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। কিন্তু জাতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান; রাজনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক কর্ষণক্ষেত্র এই প্রতিষ্ঠানের অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যত্ নিয়ে সামগ্রিক কোনো গবেষণা হয়নি। ২০১৬ সালে এসে এই খরা কিছুটা হলেও কেটেছে। পতনের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখন গবেষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। প্রথমা প্রকাশনের কল্যাণে এক বছরেই আমরা পেলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে তিনটি গবেষণাগ্রন্থ। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে বেরিয়েছে ইমতিয়াজ আহমেদ ও ইফতেখার ইকবাল সম্পাদিত University of Dhaka : Making Unmaking Remaking শীর্ষক ইংরেজি সংকলনগ্রন্থ, ফেব্রুয়ারিতে বেরিয়েছে সৈয়দ আবুল মকসুদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা নামের বই। বছর শেষে বেরিয়েছে একই লেখক লিখিত এই বইয়ের সম্পূরক স্যার ফিলিপ হার্টগ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য শীর্ষক বই। প্রথম বইটির শিরোনামই বেশ ইঙ্গিতবহ। এখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অনবদ্য ইতিহাস, এর পতিত হওয়ার দুঃখজনক কারণ ও পুনরুজ্জীবনের রূপরেখা আলোচিত হয়েছে ঐতিহাসিক ও সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে। দ্বিতীয় বইটি প্রাথমিক উত্স ব্যবহার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি, এর প্রতিষ্ঠা ও বিকাশের প্রথম দুই দশকের ‘অনুসন্ধানমূলক’ আলোচনার প্রয়াস। এই বইয়ের জন্য কৃত গবেষণার একটি বর্ধিত ফলাফল হলো তৃতীয় বইটি। এই তিনটি বই একসঙ্গে পাঠ করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় এক শ বছরের বিবর্তনের একটা স্বচ্ছ রেখা ফুটে ওঠে। বইগুলোতে আলোচিত বিষয়বস্তু বিবেচনা করে আমরা প্রথমে বাংলা বই দুটি এবং তারপর ইংরেজি সংকলনগ্রন্থটি সম্পর্কে আলোচনা করব।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা

সৈয়দ আবুল মকসুদ, প্রথমা, ফেব্রুয়ারি ২০১৬

১.

তত্কালীন পূর্ববঙ্গে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের দাবি সর্বপ্রথম তোলেন ‘মোহামেডান এডুকেশনাল কনফারেন্স’-এর অনারারি জয়েন্ট সেক্রেটারি ব্যারিস্টার সাহেবজাদা আফতাব আহমেদ খাঁ। ১৯০৬ সালের ২৭-২৯ ডিসেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত কনফারেন্সের বিশতম অধিবেশনে তিনি এই দাবি করেন। চার বছর পর ১৯১০ সালে তত্কালীন পূর্ব বাংলা ও আসাম প্রাদেশিক ব্যবস্থাপক পরিষদে পরিষদ সদস্য বাবু অনঙ্গ মোহন সাহা ঢাকায় একটি স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় ও একটি হাইকোর্ট স্থাপনের দাবি তোলেন। ১৯১১ সালের ১৯ আগস্ট ‘পূর্ববঙ্গ-আসাম প্রাদেশিক মুসলমান সমিতি’ ও ‘প্রাদেশিক মুসলিম লীগ’ লেফটেন্যান্ট গভর্নর হেয়ারকে বিদায় ও নতুন লেফটেন্যান্ট গভর্নর সি বেইলিকে স্বাগত জানাতে গিয়ে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের দাবি জানায়। একই বছর ৮ অক্টোবর বেইলি লর্ড হার্ডিঞ্জের কাছে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় ও হাইকোর্ট স্থাপনের প্রস্তাব করেন। সেই প্রস্তাবে সাড়া না দিলেও বঙ্গভঙ্গ রদ-পরবর্তী আহত মুসলমান সম্প্রদায়কে খুশি করার জন্য ১৯১২ সালের ৩১ জানুয়ারি তিনি নিজেই ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কথা ঘোষণা করেন। ২ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিক সরকারি ঘোষণা আসে। ২৭ মে রবার্ট নাথানের নেতৃত্বে গঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন।১৩

ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ধারণাটি কার মস্তিষ্কপ্রসূত, কার দাবি সরকারকে বেশি প্রভাবিত করেছিল, এ নিয়ে গবেষকদের মধ্যে ভিন্নমত আছে। অনেক গবেষকই তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই মুসলিম নেতাদের এই কৃতিত্ব দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। ড. সুফিয়া আহমেদ দাবি করেছেন, নওয়াব সলিমুল্লাহ ১৯০৫ সাল থেকেই ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে আসছিলেন।১৪ ড. আবদুর রহিম বলেছেন, মুসলিম প্রতিনিধিদল হার্ডিঞ্জের কাছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জোর দাবি জানিয়েছিলেন।১৫ বর্তমান গ্রন্থের লেখকও একই মত পোষণ করেছেন। তথ্যসূত্রের উল্লেখ ছাড়াই তিনি বলেন, বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে পূর্ব বাংলার মুসলমান নেতারা ‘আঘাত পান ও হতাশ হন। তাঁরা তখন দাবি জানান ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার। মুসলমান নেতাদেরও সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করা সম্ভব ছিল না। ব্রিটিশ সরকার নীতিগতভাবে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করে।’ (পৃ. ২৯)

কিন্তু ইতিহাসের ভিন্ন এক বয়ানও আমাদের সামনে হাজির করেছেন গবেষক ড. মুহাম্মদ আবদুল্লাহ। তথ্যপ্রমাণসহ তিনি আমাদের জানাচ্ছেন, ১৯১২ সালে হার্ডিঞ্জের ঘোষণার পূর্ব পর্যন্ত নওয়াব সলিমুল্লাহ ও নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী প্রমুখ ঢাকার মুসলমান নেতা ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য নিবেদিতপ্রাণ হয়ে কাজ করছিলেন। পূর্বোল্লিখিত আফতাব আহমেদ ও অনঙ্গ মোহনের দাবির পক্ষে তাঁরা কোনো বক্তৃতা-বিবৃতিও দেননি। বরং, ১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর মুসলিম লীগ যে সভায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সে সভায় নওয়াব সলিমুল্লাহ আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা কামনা করেন। এমনকি ১৯১১ সালেও (১৫ ও ১৭ মার্চ) তিনি তাঁর বাসভবনে সভা করে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন এবং অন্য প্রদেশের মুসলমানদের সঙ্গে সহযোগিতা করার আহ্বান জানান। এই সভাতেই সলিমুল্লাহকে সভাপতি করে গঠিত হয় আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ‘পূর্ববঙ্গ-আসাম প্রাদেশিক চাঁদা কমিটি’। তাঁর প্রধান রাজনৈতিক সহযোগী নওয়াব আলী চৌধুরী ১৯০৮ সালে ময়মনসিংহে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক শিক্ষা সমিতির বার্ষিক সভায় প্রস্তাবিত আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়কে মুসলিম ভারতের একমাত্র জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, পূর্ববঙ্গ এখনো বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উপযুক্ত নয়। চাঁদা তোলার ব্যাপারে তিনি ছিলেন প্রধান কর্মযোগী। ১৯১১ সালের মার্চের পরে তিনি মাওলানা শওকত আলিসহ পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জেলা ঘুরে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকার চাঁদা (নগদ আদায় ও প্রতিশ্রুত) সংগ্রহ করেন। মুসলমান নেতারা যে আলীগড়-চিন্তায় অভিভূত ছিলেন তার প্রমাণ হলো, ১৯১২ সালের ২০ ডিসেম্বর আটটি দাবি-সংবলিত মুসলিম নেতাদের যে পত্র লর্ড হার্ডিঞ্জের কাছে পাঠানো হয় তাতে পূর্ববঙ্গের শিক্ষা উন্নতিসংক্রান্ত কয়েকটি দাবি থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো উল্লেখ ছিল না। ফলে, মুসলিম নেতাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এই মত গবেষণাসিদ্ধ নয়।১৬

২.

১৯১২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সরকারি ঘোষণা আসার পর প্রধানত উচ্চবর্ণের হিন্দু বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ ও উকিল শ্রেণি এর বিরোধিতা শুরু করেন। ১৬ ফেব্রুয়ারি স্যার রাসবিহারী ঘোষের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল ভাইসরয়ের সঙ্গে দেখা করে এই উদ্যোগকে ‘অভ্যন্তরীণ বঙ্গ-বিভাগ’ হিসেবে আখ্যায়িত করে এর বিরোধিতা করেন। বিরোধিতাকারী অন্যান্য জাতীয় নেতাদের মধ্যে ছিলেন বিপিন চন্দ্র পাল, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, সুরেন্দ্রনাথ সমাজপতি, ব্যারিস্টার ব্যোমকেশ চক্রবর্তী, পেয়ারী মোহন মুখোপাধ্যায়, অম্বিকা চরণ মজুমদার। ঢাকার হিন্দু নেতাদের মধ্যে ছিলেন ঢাকার সবচেয়ে প্রভাবশালী আইনজীবী ও সাবেক পৌরসভা চেয়ারম্যান আনন্দচন্দ্র রায়, বাবু ত্রৈলোক্যনাথ বসু প্রমুখ। বিরোধিতাকারী কংগ্রেসপন্থী মুসলমান নেতাদের মধ্যে ছিলেন ব্যারিস্টার আবদুর রসুল, মাওলানা আকরম খাঁ, মৌলবি আবুল কাসেম, বিহারের মৌলবি লিয়াকত হোসেন।১৭

কোনো তথ্যপ্রমাণ ও যুক্তিগ্রাহ্য কারণ দেখানো ছাড়াই বর্তমান গ্রন্থের লেখক বইয়ের বিভিন্ন জায়গায় প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে, রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতা করেছেন। কারণ হিসেবে তিনি যা বলতে চেয়েছেন তার সারমর্ম হলো ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতাকারীদের কেউ কেউ নিজেদের উদ্যোগে পশ্চিমবঙ্গে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর রবীন্দ্রনাথও বোলপুরে একটি ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জাল বুনছেন’। পূর্ববঙ্গ তাঁর আয়ের উত্স হলেও পূর্ববঙ্গের প্রতি তাঁর কোনো দরদ ছিল না। এসেছেন মাত্র দুবার, ১৯৩৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিলিট নিতেও আসেননি। কিন্তু ১৯৩৮ সালে ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিলিট নিজে গিয়ে গ্রহণ করেছেন। এ রকম কয়েকটি বিক্ষিপ্ত তথ্য উপস্থাপনের পর লেখক তাঁর চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে ‘ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় রবীন্দ্রনাথের বিরোধিতার কারণ সহজেই বোঝা যায়।’ (পৃ. ৫৮) এসব মন্তব্যের পক্ষে লেখক কোনো সূত্র উল্লেখ করেননি।

রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করেছেন তা ঐতিহাসিক সত্য। বঙ্গভঙ্গ পর্যন্ত তিনি হিন্দু জাতীয়তাবাদে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু ১৯০৭-০৮ সাল নাগাদ তিনি ‘আনুষ্ঠানিক ধর্ম ও সংকীর্ণ জাতীয়তার ঊর্ধ্বে’ উঠতে পেরেছেন বলে মনে করা হয়।১৮ তাঁর সেই সময়ের বক্তৃতা-বিবৃতি ও লেখালেখিতেও সেই ছাপ পাওয়া যায়। যেমন ১৯০৮ সালে কংগ্রেসের পাবনা সম্মেলনে প্রদত্ত ভাষণে তিনি বলেন,

মুসলমানেরা যদি যথেষ্ট পরিমাণে পদমান লাভ করিতে থাকেন তবে অবস্থার অসাম্য-বশত জ্ঞাতিদের মধ্যে যে মনোমালিন্য ঘটে তাহা ঘুচিয়া গিয়া আমাদের মধ্যে সমকক্ষতা স্থাপিত হইবে। যে রাজপ্রসাদ এতদিন আমরা ভোগ করিয়া আসিয়াছি আজ প্রচুর পরিমাণে তাহা মুসলমানদের ভাগে পড়ুক, ইহা আমরা যেন সম্পূর্ণ প্রসন্নমনে প্রার্থনা করি।১৯

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক ঘোষণার এক বছর আগে লিখিত ‘হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়’ শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি বলেন,

...যাহারা স্বতন্ত্র তাহারা পরস্পর পাশাপাশি আসিয়া দাঁড়াইলে তবেই তাহাদের বাড়াবাড়ি কাটিয়া যায় ও তাহাদের সত্যটি যথার্থভাবে প্রকাশ পায়।...হিন্দু বা মুসলমান বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি বিশ্বকে স্থান দেওয়া হয় তবে সেই সঙ্গে নিজের স্বাতন্ত্র্যকে স্থান দিলে কোনো বিপদের সম্ভাবনা থাকিবে না।২০

রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছেন, এখনো পর্যন্ত কোনো গবেষণায় তা প্রমাণিত হয়নি। ১৯১২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৬ মার্চের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করে কলকাতা, ঢাকা ও পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জেলায় অনুষ্ঠিত কমপক্ষে ১১টি সভার কথা উল্লেখ করেছেন ড. আবদুল্লাহ।২১ এসব সভার কোনোটিতে রবীন্দ্রনাথ সশরীরে উপস্থিত ছিলেন কিংবা বক্তৃতা-বিবৃতি পাঠিয়েছেন তার কোনো প্রমাণ নেই।

এখানেই শেষ নয়, রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শনের প্রকৃতি ও উদ্দেশ্য সম্পর্কিত কোনো গবেষণার২২ উল্লেখ না করেই তিনি মন্তব্য করেছেন, ‘বিশ্বভারতী ধাঁচের শিক্ষা আধুনিক রাষ্ট্রগঠনকারী মানুষ তৈরিতে সক্ষম নয়। শিক্ষা বিষয়টির সঙ্গে মান জড়িত। আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার সেই মানের প্রশ্নে আপসহীন। রবীন্দ্রনাথ-প্রস্তাবিত শিক্ষাপদ্ধতি সংগীত, শিল্পকলা প্রভৃতি সৃষ্টিশীল মানুষ তৈরি করতে পারে—সুযোগ্য প্রশাসক ও বিজ্ঞানী নয়।’ রবীন্দ্রনাথের বহুবিধ পরিচয়ের মধ্যে একটি প্রধান পরিচয় হলো তিনি একজন শিক্ষাবিদ এবং শিক্ষা বিষয়ে তাঁর মৌলিক চিন্তা এখনো প্রাসঙ্গিক। তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতীকে বর্তমান লেখক যেখানে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিচ্ছেন, সেখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি ভারতের বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ভারতের ১০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাঙ্কিংয়ে বিশ্বভারতীর স্থান একাদশ।

রবীন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠার কালে বঙ্গদেশে সাম্প্রদায়িকতা ছিল উত্তুঙ্গে। মুসলমান সমাজে তখন তিনি গৃহীত হননি। পাকিস্তান আমলে রবীন্দ্রনাথের সাম্প্রদায়িকীকরণের চূড়ান্ত ঘটে। তাঁকে নিষিদ্ধ করা হয় তথাকথিত জাতীয় সংহতি টিকিয়ে রাখার প্রশ্নে। কিন্তু বাঙালির ভাষাভিত্তিক ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদের সংগ্রামে তিনি হয়ে ওঠেন ‘সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক শক্তি’।২৩ ১৯৭১ সালে ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও যেমন মুসলিম জাতীয়তাবাদের বিনাশ ঘটেনি, তেমনি রবীন্দ্রনাথকে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করার প্রবণতাও কমজোর হয়নি। সেই প্রবণতার একটি ‘বাজারে’ প্রোপাগান্ডা হলো, রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতা করেছেন। বর্তমান ‘অনুসন্ধানমূলক অভিসন্ধর্ভে’র লেখকও সেই প্রোপাগান্ডাতে অংশ নিয়েছেন।

৩.

আবুল মকসুদের এই বইটিতে তথ্যগত ভুলও পাওয়া যায়। যেসব হিন্দু বুদ্ধিজীবী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন, লর্ড হার্ডিঞ্জ তাঁদের আশ্বাস দিয়েছিলেন যে ঢাকার বিশ্ববিদ্যালয়টি হবে সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ, যেখানে সব সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীদের সমান প্রবেশাধিকার থাকবে। তাঁরা এতে সন্তুষ্ট না হয়ে অভিযোগ তুলতে থাকেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি ‘ভালো কলেজ’ ঢাকা কলেজকে ধ্বংস করা হচ্ছে। সাম্প্রদায়িক আক্রমণ করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত ইংরেজ প্রশাসকেরাও তা থেকে মুক্তি পাননি। ‘তিন ইহুদি একত্র হয়েছে, এটার সংস্পর্শ দোষ ঘটেছে, এটা টিকবে না।’২৪ তিন ইহুদি ছিলেন উপাচার্য পি জে হার্টগ, গভর্নর জেনারেল লর্ড রিডিং ও ভারত সচিব মন্টেগু। বর্তমান গ্রন্থের লেখক সেই অভিযোগ খণ্ডন করতে গিয়ে আমাদের জানাচ্ছেন, ‘বলা বাহুল্য, এঁদের তিনজনের সবাই যে ইহুদি ছিলেন, তার প্রমাণ নেই।’ (পৃ. ৫২) অথচ এই তিনজন শুধু ইহুদি ছিলেন না, ছিলেন ইংল্যান্ডের সবচেয়ে প্রভাবশালী ইহুদিদের অন্যতম।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য পি জে হার্টগ যে ইহুদি ছিলেন, তার প্রমাণ বর্তমান লেখক লিখিত হার্টগের জীবনীগ্রন্থেই পাওয়া যাবে। ভারত সচিব মন্টেগু (১৮৭৯-১৯২৪) ছিলেন ব্রিটেনের দ্বিতীয় ইহুদি মন্ত্রী। ১৯১৯ সালে ইংল্যান্ড ও তুরস্কের মধ্যে স্বাক্ষরিত ‘ট্রিয়েটি অব সার্ভ’-এর প্রতিক্রিয়ায় ভারতে যে খেলাফত আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল, তিনি ছিলেন তার বিরোধী। ‘জায়োনিজম’ এবং ইহুদিদের আলাদা ‘হোমল্যান্ড’ ধারণার কট্টর বিরোধী এই লিবারেল রাজনীতিবিদকে মন্টেগু-চেমসফোর্ড শাসন সংস্কার প্রস্তাবের (১৯১৯) জন্য ভারতের সবচেয়ে প্রতিভাবান ব্রিটিশ শাসক বলে মনে করা হয়। ১৯২৪ সালের ১৫ নভেম্বর তাঁর মৃত্যুর পর কলকাতার জামনগরে তাঁর মূর্তি উন্মোচনকালে মহারাজা জাম সাহেব তাঁকে ‘intellectually, the most brilliant statesman and best friend India ever had since, perhaps, Edmund Burke’ হিসেবে অভিহিত করেন।২৫ ভারতের তত্কালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড রিডিং (১৮৬০-১৯৩৫) ছিলেন ইংল্যান্ডের প্রথম কয়েকজন ইহুদি মন্ত্রীর একজন, প্রথম ইহুদি লর্ড চিফ জাস্টিস অব ইংল্যান্ড, প্রথম ও এখনো পর্যন্ত একমাত্র ব্রিটিশ ইহুদি যিনি ‘marquessate’ হিসেবে ভূষিত হয়েছেন।২৬

৪.

রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পশ্চাদপদতার কারণে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে এত উত্সাহ-আয়োজন দেখালেও লর্ড হার্ডিঞ্জের প্রস্তাবের পর পূর্ববঙ্গের মুসলমান নেতারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য অক্লান্ত আন্দোলন-সংগ্রাম করে গেছেন। নওয়াব সলিমুল্লাহর মৃত্যুর (১৯১৪) পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্প বাস্তবায়নকে নিজের প্রধান রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা বানিয়ে এই লক্ষ্যে মাঠে-ময়দানে-লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে দাবিদাওয়া পেশ ও চাপ প্রয়োগ করে অসাধারণ দৃঢ়তার পরিচয় দেন নওয়াব আলী চৌধুরী। এ ছাড়া আরও যেসব নেতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন নবাব সিরাজুল ইসলাম, স্যার সৈয়দ শামসুল হুদা, আবদুল করিম, এ কে ফজলুল হক, আহছানউল্লাহ প্রমুখ (পৃ. ৫৫-৬৯)।

সৈয়দ শামসুল হুদার ভূমিকা উঠে এসেছে বইটিতে। বিস্মৃতপ্রায় এই নেতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট কমানোর প্রতিবাদ করেন। ঢাকায় প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয় যেন ‘উন্নত মানের আদর্শ বিশ্ববিদ্যালয়’ হয়, এই বিশ্ববিদ্যালয় যাতে পূর্ববঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তিক উদ্দীপনা সৃষ্টি করতে পারে সেই ব্যাপারে তিনি সরব ছিলেন। আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ভালো বরাদ্দ দেওয়া, ভালো শিক্ষক নিয়োগ, আধুনিক লাইব্রেরিসহ অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিত করার দাবিতেও তিনি সোচ্চার ছিলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্প ঘোষণার পর থেকে বিশ্বযুদ্ধ, সরকারের আর্থিক অসংগতিসহ অসংখ্য কারণে এই প্রকল্প পিছিয়ে যায়। এই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্পকে সরকারের অগ্রাধিকারে রাখার জন্য রাজনীতির মঞ্চে, লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী। শুধু হিন্দু বুদ্ধিজীবী শ্রেণি নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশ্নে তাঁকে আলীগড়পন্থীদেরও মোকাবিলা করতে হয়েছিল। তাঁদের আশ্বস্ত করতে হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলে তা প্রস্তাবিত আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী হবে না।২৭ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নাথান কমিটির ২৫টি সাব-কমিটির ৬টিতেই তিনি সদস্য ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘আঞ্চলিক আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ চালু করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য ১৬ হাজার টাকার তহবিল দান করা ইত্যাদি ছিল তাঁর অনন্য অবদান। হিন্দুধর্ম ও হিন্দু পুরাণ প্রাধান্যের পাঠ্যপুস্তকের বদলে যেন মুসলমানদের পছন্দসই পাঠ্যপুস্তক চালু করা হয়, এই ছিল তাঁর একটি সব সময়ের দাবি। মাতৃভাষা প্রশ্নে সমসাময়িক মুসলিম নেতাদের মতো আচ্ছন্নতায় না ভুগে তিনি ঘোষণা করেছিলেন: ‘আমাদের মাতৃভাষা উর্দু নয়, বাংলা।’ এই জনদরদি নেতা দীর্ঘদিন বিস্মৃত থাকার পর সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর নামে একটি অডিটোরিয়াম তৈরি করেছে (পৃ.৬৪-৬৬)।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশ্নে নিবেদিত আরেকজন মুসলিম নেতা ছিলেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক। মুসলমানদের শিক্ষা প্রসঙ্গ ছিল তাঁর রাজনীতির একটা গুরুত্বপূর্ণ অ্যাজেন্ডা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে শুধু মুসলমানরা উপকৃত হবে, এই তত্ত্বের তিনি ছিলেন ঘোর বিরোধী। বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভায় তিনি এর বিরোধিতা করেন, পূর্ববঙ্গের মানুষের প্রতি যে বৈষম্য হচ্ছে তার ব্যাপারে তিনি সোচ্চার ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রগতি, ছাত্রদের সমস্যার খোঁজখবর করতে নিয়মিত আসতেন। আরেকজন মুসলমান নেতা, যিনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি হলেন খান বাহাদুর আহছানউল্লাহ। শিক্ষা বিভাগের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা হওয়ায় তিনি সরকারের শিক্ষাসংক্রান্ত বিভিন্ন কমিটিতে থাকতেন এবং মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য কাজ করে গেছেন (পৃ. ৬৯-৭২)।

৫.

৩৯২ পৃষ্ঠার বইটি এগারোটি ভাগে বিভক্ত। ‘প্রস্তুতিপর্ব’ শীর্ষক প্রথম ভাগে লেখক আরও দেখিয়েছেন কীভাবে মুসলিম নেতাদের পশ্চাত্পদতার কারণে মুসলমানরা ইংরেজি শিক্ষায় পিছিয়ে যায়। পশ্চিম বাংলার তুলনায় মুসলমানপ্রধান পূর্ববঙ্গ কীভাবে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও বৈষম্যের শিকার হতো। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও মুসলমানরা বিশেষ উপকৃত হতে পারছিল না। এই বৈষম্যের ফলে মুসলমান নেতারা ‘আরবি বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠার দাবি তোলেন এবং হিন্দু ‘অধিপতি শ্রেণি’ তা সহানুভূতির সঙ্গে দেখেননি। তাই বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার পর মুসলমান নেতারা হতাশ হয়ে পড়েন। এই হতাশা ও বঞ্চনাবোধ ক্রমে ঘনীভূত হয় এবং একসময় রাজনৈতিক চেতনায় পরিণত হয়। ফলে বিচ্ছিন্নতাবাদের জন্ম এবং কালক্রমে দেশ ভাগ হয়। লেখক এরপর বলেন, ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান সমাজ প্রথম থেকে ন্যায্য সুযোগ-সুবিধা পেলে এবং তাঁদের দাবি সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করা হলে তাদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদের জন্ম হতো না।’ (পৃ. ৩৩-৩৪) এ মন্তব্য অতি সরলীকরণের দোষে দুষ্ট এবং বাংলায় হিন্দু-মুসলমান সমস্যা ও বিচ্ছিন্নতাবাদের নানামুখী মাত্রাকে অস্বীকার করে।২৮

৬.

বইয়ের দ্বিতীয় ভাগের শিরোনাম ‘ভূগোল’। ১৬১০ সালের মোগল রাজধানী ঢাকা ১৭০৪ সালের পর তাঁর জৌলুশ হারিয়ে অবহেলিত শহরে পরিণত হয়। ১৭০৪ সালে রাজধানী মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরিত হয়। ঢাকা আবারও প্রাণ ফিরে পায় ১৯০৫ সালে পূর্ব বাংলা ও আসাম নিয়ে গঠিত নতুন প্রদেশের রাজধানী হওয়ার পর। রমনা, নীলক্ষেত, মিন্টু রোড, হেয়ার রোড এলাকাকে কেন্দ্র করে গঠিত হয় নতুন শহর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ফলেও ঢাকা নতুন করে বিকশিত হয় এবং প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে পায়। নতুন প্রদেশের সরকারের জন্য নির্মিত লাল ইটের ভবনসমূহ, রমনার ছায়াঘেরা সবুজ পরিবেশে যাত্রা শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রয়োজনীয় বিস্তৃত জায়গা ও অবকাঠামো, চিত্ত ও বুদ্ধিবৃত্তি বিকাশের উপযোগী নির্মল পরিবেশ নিয়েই যাত্রা শুরু করে উপমহাদেশের প্রথম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনন্য ও ভারতের জন্য অভিনব প্রাকৃতিক ও শিক্ষাপরিবেশ উঠে এসেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিকের শিক্ষার্থীদের স্মৃতিচারণা থেকে। যথার্থভাবেই একে বলা হতো ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’। উঠে এসেছে ঢাকার ইতিহাস-ঐতিহ্য, ঢাকা তথা পূর্ববঙ্গের তত্কালীন সাংস্কৃতিক জীবন, সামাজিক জীবন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, চল্লিশের দশকের ঢাকা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (পৃ. ৭৩-৯৯)।

কিন্তু কিছু তথ্য বিভ্রান্তিকর। পুরোনো হাইকোর্ট ভবন সম্পর্কে তিনি এক জায়গায় লিখেছেন, ভবনটি শতাব্দীর শুরুতে নতুন প্রদেশের আইন পরিষদ ভবন ছিল, কিন্তু কোনো অধিবেশন বসেনি। তারপর সেটিকে প্রাদেশিক লেফটেন্যান্ট গভর্নরের বাসভবন করা হয়, কিন্তু প্রথম গভর্নর স্যার ব্যামফিল্ড ফুলার সেখানে বাস করেননি (পৃ. ৭৭)। অন্য জায়গায় লিখেছেন, এই ভবনটি নির্মিত হয়েছে ১৯০১-০২ সালে। এরপর তিনি হাকিম হাবিবুর রহমান (আসুদেগানে ঢাকা) উদ্ধৃত করেন, যা তাঁর আগের বক্তব্যের বিপরীত—বাংলা ও আসাম মিলে স্বতন্ত্র প্রদেশ হওয়ার পর লেফটেন্যান্ট গভর্নর ফুলারের বাসভবন হিসেবে নির্মিত হয়, তিনি পছন্দ না করায় তা প্রাদেশিক পরিষদের জন্য নির্ধারিত হয়। কিন্তু কোনো অধিবেশন বসেনি (পৃ. ৯১)।

৭.

তবে এই অধ্যায়ে উপস্থাপিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে নবাবদের প্রদত্ত জমি। লেখক জানাচ্ছেন, সুনির্দিষ্ট তথ্যসূত্র উল্লেখ না করেই, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব ঘোষিত হতেই নবাব সলিমুল্লাহ নবাব এস্টেটের জমি দেওয়ার অঙ্গীকার করেন এবং সে অনুযায়ী ৬০০ একর জমি দেওয়ার ঘোষণা করেন। প্রধানত নবাবদের জমিতেই এবং সরকারি ভবনে বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়। এসব ভবনের মধ্যে রয়েছে কার্জন হল, পুরোনো ঢাকা কলেজ (ঢাকা হাইকোর্ট প্রাঙ্গণের সাদা বাড়ি), ঢাকা মেডিকেল কলেজের মূল ভবন প্রভৃতি (পৃ. ৮১)। কিন্তু এগুলোর মধ্যে কোনটি নবাবদের প্রদত্ত কিংবা তাঁদের জায়গায় তৈরি তার কোনো উল্লেখ লেখক করেননি।

সরকার বিশ্ববিদ্যালয়কে নীলক্ষেত থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত ১৮৩৯ বিঘা জমি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আনুষ্ঠানিকভাবে জমি বরাদ্দ দেওয়ার কাজ এগিয়ে নেওয়ার জন্য ১৯২৩ সালে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি করা হয় এবং কমিটি-সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কথা বলে, জরিপ করে দেখে সেখানে অত জায়গা নেই। শেষ পর্যন্ত ৭২৮ বিঘা জমি বিশ্ববিদ্যালয়কে ইজারা দেওয়া হয় এবং ১৯২৮ সালের মার্চে সরকারের সঙ্গে এই মর্মে চুক্তিপত্র সম্পন্ন হয়। যদিও ১৯২১ সালের এক আদেশে বিশ্ববিদ্যালয়কে এসব ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। ১৯৩৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সরকারের জমিসংক্রান্ত আরেকটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়কে ২৫৭.৭৭০ একর জমি রেজিস্ট্রি করে দেওয়া হয়। এর বাইরেও বিশ্ববিদ্যালয়কে নবাবদের দেওয়া ৩০০ একর জমি ছিল, যার বেশির ভাগ পরে বেদখল হয়ে যায়। ১৯২৮ সালের চুক্তিপত্র পরিশিষ্টে দেওয়া হয়েছে, ১৯৩৬-এর চুক্তির কোনো তথ্যসূত্র পর্যন্ত দেওয়া নেই (পৃ. ৮১-৮২)।

সলিমুল্লাহর জীবনীকার আমাদের এই সম্পর্কে কোনো তথ্য দেননি।২৯ বাংলাদেশ সরকারের ভূমি সংস্কার অফিসের ওয়েবসাইট থেকে আমরা জানতে পারি,

১৯০২ সালে আহছানউল্লাহর জ্যেষ্ঠ পুত্র নওয়াব খাজা সলিমুল্লাহ জমিদারির ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু অচিরেই পারিবারিক কোন্দল শুরু হয় এবং সলিমুল্লাহ পরিবারটির উপর সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। জমিদারি ব্যবস্থাপনায় এত বেশি ফাটল ধরে যে, সরকারকে প্রদত্ত খাজনার বকেয়া এবং এস্টেটের দেনা ক্রমাগতভাবে বাড়তেই থাকে। এ পর্যায়ে সরকার রাজনৈতিক বিবেচনার পরিপ্রেক্ষিতে নওয়াব সলিমুল্লাহকে অর্থ ও অন্যান্য সকল প্রকার সহযোগিতা ও সাহায্য প্রদান করেন। ব্রিটিশ সরকারের এ সাহায্যের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল সলিমুল্লাহকে ১৯০৮ সালে একটি বড় অঙ্কের ঋণ প্রদান করা, যে ঋণ দিয়ে তিনি হিন্দু মহাজনদের নিকট তাঁর ব্যক্তিগত সকল দেনা পরিশোধ করতে সক্ষম হন।

ঔপনিবেশিক সময়ে একটি সরকারি নীতি ছিল দেশীয় অনুগত ভূস্বামীদের জিইয়ে রাখা। এর নেপথ্যে ছিল শাসকশ্রেণির ওপর জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ক্রমাগত চাপ। এমনি এক পরিস্থিতিতে ভগ্নপ্রায় ও টলটলায়মান ঢাকা নওয়াব এস্টেটকে ১৯০৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কোর্ট অব ওয়ার্ডসের অধীনে নিয়ে আসা হয়। কোর্ট অব ওয়ার্ডসের তত্ত্বাবধানে এস্টেটটির প্রথম ব্যবস্থাপক ছিলেন এইচ সি এফ মেয়ার। তারপরে আসেন এল জি পিলেন, পি জে গ্রিফিথ এবং পি ডি মার্টিন। তাঁরা সবাই ছিলেন ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের সদস্য। ১৯৫০ সালের ইস্ট বেঙ্গল এস্টেট একুইজিশন অ্যাক্টের অধীনে ১৯৫০ সালে ঢাকা নওয়াব এস্টেটের বিলুপ্তি ঘোষণা করা হয়। কেবল আহসান মঞ্জিল প্রাসাদ ও তত্সংলগ্ন জমিজমা এবং অন্যান্য স্থানে যেসব জমি রায়তিস্বত্বে খাসজমি ছিল সেগুলো এই অধিগ্রহণ আইনের আওতার বাইরে থাকে।৩০

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ঋণদায়গ্রস্ত নবাবের এস্টেট সরকার অধিগ্রহণ করে এবং তা কোর্ট অব ওয়ার্ডসের অধীনে চলে যায়। ফলে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নবাবদের জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক তাঁর এক সাক্ষাত্কারে বলেছিলেন,

...নওয়াব পরিবারের টাকায় নয়; নওয়াব পরিবারের জায়গাতেও নয়। রমনার যে জায়গায় ঢাকা ইউনিভার্সিটি এর পুরাই খাসমহল, সরকারের জমি। সেটলমেন্ট রিপোর্ট-এ তাই আছে। ...এটার ভেরিফিকেশন তো সোজা। যে কেউ ইন্টারেস্টেড, সে ঢাকা কালেক্টরেটে যেয়ে দেখে আসতে পারেন।৩১

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিকের ইতিহাস-সম্পর্কিত সেই চ্যালেঞ্জ লেখক গ্রহণ করেননি।

৮.

‘উদ্বোধন’ শীর্ষক বইয়ের তৃতীয় ভাগে এসেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের একেবারে শুরুর দিনগুলোর কথা। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর বিশ্ববিদ্যালয় ‘বাস্তবে রূপায়িত’ হয় ১৯২১ সালে। এর আগের কর্মযজ্ঞ ছিল রাজসিক। লেখকের ভাষায়, নতুন প্রদেশ গঠনকালের চেয়েও ‘বেশি চাঞ্চল্য আসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময়।’ ব্রিটেন থেকে নিয়ে আসা হয় শিক্ষাবিদ ও কারিগরি বিশেষজ্ঞদের—উপাচার্য পি জে হার্টগ, প্রকল্প পরিচালক এইচ ই স্টেপলটন, খ্যাতনামা স্থপতি মি গ্যারেথ। স্টেপলটন একসময় ঢাকার ইন্সপেক্টর অব স্কুল হিসেবে কাজ করেছেন। ১৯২০ সালের ১১-১২ মার্চ নর্থব্রুক হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ইতিবৃত্ত-বিষয়ক এক অনুষ্ঠানের একজন আলোচক হিসেবে তিনি ‘আ ইউনিভার্সিটি ইন দ্য মেকিং’ শিরোনামে একটি পেপার উপস্থাপন করেন। সেখানে তিনি প্রতিষ্ঠিতব্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপরেখা তুলে ধরে আশা প্রকাশ করেন, এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ঢাকা ‘পূর্ব বাংলার বুদ্ধিবৃত্তিক রাজধানী’ হয়ে উঠবে। তিনি চেয়েছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত হোক শক্তিশালী ‘স্কুল অব হিস্টরি’, ‘প্র্যাকটিক্যাল স্কুল অব সোশ্যাল ইকোনমিকস’। ‘বস্তুত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ইতিহাস বিষয়ে সেটিই প্রথম লেখা এবং সবচেয়ে প্রামাণিক ও যথার্থ দলিল।’ স্টেপলটনের এই বক্তৃতা পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়েছে। লেখক পুস্তিকাটি দেখেছেন (পৃ. ১০০-১০৪)। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো তথ্যসূত্র হিসেবে তার কোনো উল্লেখ করেননি, এমনকি প্রকাশকালও না, গ্রন্থপঞ্জিতে তার কোনো উল্লেখ নেই। তাই লেখকের চোখের দেখায় আমাদের সন্তুষ্ট থাকতে হলো।

‘বলধা গার্ডেনে উপাচার্যের ভাষণ’ শীর্ষক পরিচ্ছেদটি আমাদের ‘তদবির-সংস্কৃতি’র সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। প্রথম উপাচার্য হার্টগ কলকাতায় এসেই তাঁর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধী পক্ষের সঙ্গে সমঝোতার আয়োজন করে ঢাকায় আসেন ১৯২০ সালের ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে। নতুন বিশ্ববিদ্যালয় চালু করার ক্ষেত্রে তাঁর সবচেয়ে গুরুদায়িত্ব ছিল দক্ষ শিক্ষকমণ্ডলী নিয়োগ দেওয়া। অন্যদিকে শিক্ষক নিয়োগের ব্যাপারে তদবিরের আয়োজন-পরিকল্পনা করতে থাকেন ‘ঢাকার হিন্দু সমাজপতিরা’। ১৯২১ সালের ৭ জানুয়ারি বলধা গার্ডেনের নতুন উপাচার্যকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। নবাববাড়ির সদস্য, আইনজীবী, সরকারি কর্মকর্তাসহ ঢাকার প্রভাবশালী ব্যক্তিরা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। এই সংবর্ধনা সভায় উপাচার্য হার্টগ যে বক্তৃতা প্রদান করেন, তাতে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যত্ চরিত্র প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে। তিনি আশা পোষণ করেন, ‘একটি মহান ও সমৃদ্ধ “বাংলাদেশ” গঠনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিশাল ভূমিকা রাখবে।’ হার্টগ তাঁর বক্তব্যে সুস্পষ্ট জানিয়ে দেন, মুসলমানদের শিক্ষায় সুযোগ করে দেওয়া এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য হলেও এটি কোনো মুসলিম কিংবা হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় হবে না, এটি হবে সবার জন্য উন্মুক্ত। এটি হবে প্রাচ্য ও প্রাশ্চাত্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অনন্য সম্মিলন। বক্তব্যে তিনি আয়োজকদের জানিয়ে দেন, যোগ্য শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে তাঁরা সর্বোচ্চ মান বজায় রাখবেন। বিলেতের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের গঠন ও বিকাশের সাক্ষী হার্টগ উপস্থিত নাগরিকদের কাছে কীভাবে নাগরিকদের আনুকূল্যে সেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেই দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন। তবু আয়োজকেরা ক্ষান্ত হননি। তাঁরা শিক্ষক নিয়োগসংক্রান্ত ‘উপদেষ্টা কমিটি’র ব্যাপারে আপত্তি তোলেন। তাঁদের প্রধান আশঙ্কা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুসলমান-প্রাধান্য সৃষ্টি হবে। ফলে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে অবিশ্বাসের সৃষ্টি হয় (পৃ. ১০৪-১১২)।

উপাচার্য হার্টগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গঠনে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন। উপমহাদেশের পরিবেশে নতুন ধরনের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার চ্যালেঞ্জিং দায়িত্ব তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয়। দীর্ঘ শিক্ষাপ্রশাসনিক অভিজ্ঞতা বিশেষত ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় ও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের পুনর্গঠনে ভূমিকা, স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ (SOAS) প্রতিষ্ঠার অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ হওয়ায় এই গুরুদায়িত্ব পালনের জন্য যোগ্যতম ব্যক্তি হিসেবেই তাঁকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনেও একজন ‘প্রভাবশালী ও সবচেয়ে সক্রিয়’ সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন। এই কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরে স্যার হার্টগের অবদান ছিল অসামান্য। তাঁর স্ত্রী ম্যাবল হার্টগের কাছেও এই জনগোষ্ঠীর দায় আছে। তখনকার রক্ষণশীল সামাজিক পরিবেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিকের ছাত্রীদের এসকর্ট দিয়ে আনা-নেওয়ার দায়িত্ব তিনি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। এই অঞ্চলে নারীদের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে তাঁর এই কীর্তি অবিস্মরণীয়। এখানে কয়েকটি ছাপার ভুল আছে, হার্টগ ম্যাবলের চেয়ে ৫১ বছরের বড় ছিলেন (পৃ. ১১৪); ম্যাবলের বইয়ের শিরোনাম India: New Patter-এর স্থলে ‘Ptters’ এসেছে (১১৪); হার্টগের বই Words in Action-এর নাম হয়ে গেছে World in Action (পৃ. ১১৫)।

প্রকল্প ঘোষণার প্রায় এক দশক পর ১৯২১ সালের ২১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। কিন্তু তার শুরুটাও ছিল বন্ধুর। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বর্জনের অসহযোগ আন্দোলনের ফলে সারা ভারতের শিক্ষা পরিবেশ বিপর্যস্ত। অনেকটা ‘অনাড়ম্বর কিন্তু ভাবগম্ভীর’ পরিবেশে সম্পন্ন হয় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বর্জন করলে অনগ্রসর মুসলমানরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ফলে ফজলুল হকসহ পূর্ববঙ্গের হিন্দু-মুসলমান অনেক নেতা অসহযোগ আন্দোলন থেকে নিজেদের সরিয়ে নেন, কেউ কেউ এর বিরোধিতা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম শুরু হয়। উপাচার্য হার্টগের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও উচ্চ আদর্শের ফলে উচ্চ বেতনে সারা ভারতের সেরা শিক্ষকদের নিয়োগ দেওয়া হয়। তবে ইংরেজ শিক্ষকদের তুলনায় ভারতীয়দের বেতন ছিল অনেক কম। এ নিয়ে ভারতীয় শিক্ষকেরা মনস্তাত্ত্বিক সংকটে ভুগতেন, তা জানা যায় রমেশচন্দ্র মজুমদারের স্মৃতিচারণা থেকে। ফলে কোনো কোনো শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে সরকারি কলেজে যোগ দেন বা দেওয়ার উদ্যোগ নেন। শিক্ষকদের মধ্যে ছিল বিভাজন। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা-কলকাতা, উঁচু ডিগ্রিধারী-ডিগ্রির জৌলুশহীন ছিল এ রকম উপদল। তবে যা ছিল না, তা হলো সাম্প্রদায়িকতার কালেও হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক বিভাজন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের গৃহীত নীতিমালা, শিক্ষকদের ব্যক্তিগত উদারতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে সাম্প্রদায়িকতার কলুষমুক্ত রাখার ব্যাপারে তাদের অনমনীয় অবস্থান এবং সর্বোপরি সাম্প্রদায়িক শহরের অভ্যন্তরেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উদার পরিবেশে সাম্প্রদায়িকতা বাসা বাঁধতে পারেনি, অন্তত প্রথম এক দশক। অন্যদিকে মুসলমানরাও শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে তদবির করেছেন, তবে ভব্যতার পরিচয় দিয়েছিলেন। এ রকম পরিবেশেই আবাসিক হল, টিউটোরিয়াল শিক্ষাপদ্ধতি, উচ্চমানসম্পন্ন পরীক্ষাপদ্ধতি ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য নিয়ে এই অঞ্চলে অভিনব এক বিশ্ববিদ্যালয় তার যাত্রা শুরু করেছিল (পৃ. ১০০-১২৭)।

শিক্ষকদের বিভাজন নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে রমেশচন্দ্র মজুমদারের কথা এসেছে বারবার, ব্যবহূত হয়েছে তাঁর বহু উদ্ধৃতি। লেখকের মতে, ‘শিক্ষকদের মধ্যে যে ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত রেষারেষি ছিল, সেখানে কলকাতা গ্রুপের নেতৃত্ব দেন রমেশ মজুমদার’ এবং তিনি ‘নানা কারণে অধ্যাপক ও উপাচার্য হিসেবে জনপ্রিয় ছিলেন না।’ জনপ্রিয় ছিলেন না তার প্রমাণ হিসেবে লেখক দুটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন। প্রথমটি রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত শোকসভায় সভাপতির ভাষণে ইংরেজিতে বক্তৃতা করতে গিয়ে তিনি ছাত্রদের প্রতিবাদের মুখে পড়েছিলেন। দ্বিতীয় ঘটনাটি হলো হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর সঙ্গে রমেশচন্দ্রের দ্বন্দ্ব। এ ঘটনার উল্লেখ করতে গিয়ে লেখক রমেশচন্দ্র মজুমদারের সঙ্গে টেনে নিয়ে আসেন যদুনাথ সরকারকে। ‘প্রাচীনকাল নিয়ে যে শুধু গবেষণা করেছেন সে জন্য নয়, বয়সের কারণে এবং প্রাচীনপন্থী হওয়ায় তাঁর সঙ্গে দূরত্ব ছিল যদুনাথ সরকার ও রমেশচন্দ্র মজুমদারের সঙ্গে।’ লেখকের ভাষ্য হলো, এত বড় পণ্ডিত ও বাংলা বিভাগ তাঁর হাতে গড়ে উঠলেও ঢাকায় বয়ঃকনিষ্ঠদের কাছে তিনি উপযুক্ত সম্মান ও আনুগত্য লাভ করেননি। এ প্রসঙ্গে ‘প্রফেসর সরকারের’ নামে যে উদ্ধৃতিটি দেওয়া হয়েছে, তা আসলে রমেশচন্দ্র মজুমদারের। উদ্ধৃতি থেকে এটা প্রমাণিত হয় যে রমেশ মজুমদার কলকাতার সঙ্গে বিশেষত আশুতোষ মুখার্জির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। কিন্তু তাতে কোনোভাবেই শাস্ত্রীকে তাঁর অসম্মান প্রমাণিত হয় না। এক ইংরেজি বক্তৃতার কারণে তিনি ছাত্রদের কাছে অজনপ্রিয় ছিলেন তা বলার সুযোগও খুব কম। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর ছাত্ররা স্মৃতিচারণায় রমেশচন্দ্রের প্রশস্তি করেছেন। কারণ, তিনি বিপ্লবী ছাত্রদের নিজ বাসায় আশ্রয় দিতেন, পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতে সহায়তা করতেন, এমনকি কারান্তরীণ ছাত্রদের বইপত্র দিয়েও সহায়তা করতেন।৩২ তাঁর ছাত্র অমূল্যভূষণ সেন বলছেন, ‘বস্তুত পুরুষপ্রবর ড. মজুমদার হলের ছাত্রদের শুধু প্রভোস্ট ছিলেন না, পিতার উদ্বিগ্ন চিত্ততায় তিনি ছিলেন তাদের ‘friend, philosopher and guide’।৩৩ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যদুনাথ সরকারেরও একধরনের সম্পর্ক ছিল। ১৯৩৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডিলিট ডিগ্রি প্রদান করে এবং তিনি ১৯৪৮ সালে প্রকাশিত ‘History of Bengal, Vol. 2’ সম্পাদনা করেছেন। তবে তিনি কোনোকালেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন না। কিন্তু এই আলোচনায় তিনি (তাঁর নামে ভুল উদ্ধৃতিসহ) এমনভাবে এসেছেন, তাতে যে কারও মনে হতে পারে তিনি এখানকার শিক্ষক ছিলেন এবং শিক্ষকদের দলাদলির অংশ ছিলেন (পৃ. ১২১-১২৩)।

৯.

‘প্রশাসন’ শিরোনামে বইয়ের চতুর্থ ভাগে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্ট, একাডেমিক কাউন্সিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল, চ্যান্সেলর, শিক্ষক নিয়োগ, ভাইস চ্যান্সেলর, রেজিস্ট্রার ও ট্রেজারার, বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রাম, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, অনুষদ, সমাবর্তন ইত্যাদিসহ প্রথমদিকের প্রশাসনিক কার্যক্রম, প্রশাসকদের যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে তার বিবরণ উঠে এসেছে। প্রথম কোর্ট সভায় প্রতিষ্ঠার বিলম্বের কারণ ব্যাখ্যা করে আচার্য আর্ল অব রোনাল্ডশে আশা প্রকাশ করেন আবাসিক ও টিউটোরিয়াল পদ্ধতির মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভারতে একটি ‘মডেল’ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হবে। উপাচার্য হার্টগ তাঁর ভাষণে আশা প্রকাশ করেন, এই বিশ্ববিদ্যালয় মুসলমানদের শিক্ষার সুযোগ বিস্তৃত করবে। শিক্ষক ও কর্মকর্তা পদে মুসলমানদের যথার্থ প্রতিনিধিত্ব হয়নি, এ রকম দাবি প্রসঙ্গে তিনি জানিয়ে দেন, সম্প্রদায়ের দাবি মেটাতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান বিসর্জন দেওয়া হবে না। এ ক্ষেত্রে তিনি কোনো সুপারিশ না শুনে একাডেমিক যোগ্যতার ওপর জোর দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় যাতে তার প্রতিশ্রুত শিক্ষার মান রক্ষা করতে পারে, সে জন্য প্রথমদিকের একাডেমিক কাউন্সিল ছিল নিবেদিতপ্রাণ, সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও তাঁরা কাজ করেছেন। প্রথমদিকের উপাচার্যরা ছিলেন জ্ঞানে-গুণে, প্রশাসনিক যোগ্যতায় উপমহাদেশের সবচেয়ে মর্যাদাবান ব্যক্তিদের অন্যতম। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দুই দশক রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব পালন করেছেন খান বাহাদুর নাজির উদ্দিন আহমেদ। অবৈতনিক কোষাধ্যক্ষ পদে নিযুক্ত ছিলেন নবাব পরিবারের খাজা শাহাবুদ্দিন, খ্যাতিমান আইনজীবী শশাঙ্ক কুমার ঘোষ প্রমুখ। রাষ্ট্রীয় আদর্শের পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রাম পরিবর্তন হয়েছে চারবার, প্রতীক পরিবর্তন হয়েছে তিনবার। ভারতের শ্রেষ্ঠ শিক্ষকমণ্ডলী নিয়ে প্রথম অনুষদসমূহ গঠিত হলেও প্রথম নারী শিক্ষক পেতে সময় লেগেছিল দেড় দশক। ১৯৩৫-৩৬ সালে প্রথম নারী শিক্ষক হিসেবে ইতিহাস বিভাগের সহকারী প্রভাষক পদে যোগ দেন করুণাকনা গুপ্ত।

অর্থনৈতিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়কে নানা প্রতিবন্ধকতার শিকার হতে হয়েছে। তত্কালীন শিক্ষামন্ত্রী ‘কংগ্রেস নেতা’ প্রভাসচন্দ্র মিত্রের নেতিবাচক ভূমিকার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে ফজলুল হক ও স্যার আবদুর রহিমের চেষ্টায় তা বাড়ানো হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ট্রাস্ট ফান্ডের দাতা ছিলেন রাজা রাজেন্দ্রনারায়ণ রায়। প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয় ১৯২৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। আচার্য তাঁর ভাষণে বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রগতি সম্পর্কে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন এবং ‘স্মরণ করিয়ে দেন যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোনো সাম্প্রদায়িক বিদ্যাপীঠ হবে না।’ উপাচার্য হার্টগ বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক সংকটের কথা উল্লেখ করেন। প্রথম ও দ্বিতীয় সমাবর্তনে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ছিল লক্ষণীয়ভাবে কম। তার কারণ হিসেবে লেখক উল্লেখ করেন, ‘বাড়ি প্রত্যন্ত অঞ্চলে হওয়ায়’, কিংবা ‘উপযুক্ত কাপড়চোপড়ের অভাবে’ শিক্ষার্থীরা এই জমকালো অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে পারেননি (পৃ. ১২৮-১৪৯)। এই ভাগেও লেখক অতিশয়োক্তির দোষ থেকে মুক্ত থাকেননি। যেমন এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, ‘নবাব সৈয়দ শামসুল হুদা ছিলেন তখন বাংলার সবচেয়ে প্রভাবশালী আইনজীবী ও বুদ্ধিজীবী এবং লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সভাপতি।’ (পৃ. ১৩৮)

১০.

পঞ্চম ভাগের শিরোনাম ‘বিজ্ঞান অনুষদ’। প্রথমে গণিত, পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়ন—এই তিনটি বিভাগ নিয়ে বিজ্ঞান অনুষদ গঠিত হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার প্রথম যুগে যে গবেষণা-সংস্কৃতির জন্য প্রসিদ্ধ হয়েছিল তাতে এই অনুষদের কৃতিত্ব ছিল অনেক। জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ (১৮৪৯-১৯৫৯), এ বি সেন গুপ্ত, ওয়াল্টার এ জেঙ্কিন্স, জগদ্বিখ্যাত পদার্থবিদ সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্রমুখ পণ্ডিতকে নিয়ে এই অনুষদ ছিল ‘নক্ষত্রের সমাবেশ’। সত্যেন বসুর নিয়োগ নিয়ে আলোচনা থাকলেও এই অনুষদ নিয়ে সামগ্রিক আলোচনা ছিল সংক্ষিপ্ত, অনুষদের পুরো একাডেমিক কার্যক্রম তাতে ফুটে ওঠেনি। এই ভাগে বরং বেশি এসেছে ঢাকা হলের সাংস্কৃতিক ও একাডেমিক কর্মকাণ্ডের বিবরণ। ঢাকা কলেজের হিন্দু হোস্টেলকে অসাম্প্রদায়িক নাম দিয়ে ‘ঢাকা হল’ করা হয়। এই হল থেকেই ছাত্রদের প্রথম ম্যাগাজিন শতদল (১৯২৪) প্রকাশিত হয়। এই হলের ছাত্রসংসদ বা ‘মন্ত্রিসভা’, ‘সোশ্যাল সার্ভিস লীগ’, ‘লাইব্রেরি’, ‘নাট্যসংঘ’ বিষয়ক আলোচনায় হলের প্রাণচাঞ্চল্য, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ এমনকি সমান্তরাল জাতীয় রাজনীতি-সংস্কৃতির কথাও উঠে এসেছে ভালোভাবে। ঢাকা হলে রবীন্দ্রনাথ ও আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের আগমন-সম্পর্কিত বিবরণটিও ছিল প্রাসঙ্গিক (পৃ. ১৫০-১৭০)।

১১.

ষষ্ঠ ভাগে এসেছে ‘জগন্নাথ হল’। ১৪ পৃষ্ঠার এই অংশে জুবিলী স্কুল, জগন্নাথ কলেজ থেকে জগন্নাথ হলের ইতিবৃত্ত, হলের প্রভোস্টদের ভূমিকা, বর্ণপ্রথার প্রাধান্য, ছাত্রনেতাদের সততা ও কৃচ্ছ্রতা, বার্ষিক পুনর্মিলনী, নজরুলের হলে আগমন, হল ম্যাগাজিন বাসন্তিকা-সহ হলের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোচনা এসেছে। উঠে এসেছে এই হলের প্রথম দিকের ছাত্র ও পরবর্তী সময়ে সাহিত্য-সংস্কৃতিতে বিখ্যাত বুদ্ধদেব বসু, মন্মথ রায়, অমলেন্দু বসু প্রমুখের কথা। হল সাময়িকী বাসন্তিকা থেকে নেওয়া কিছু উদ্ধৃতির ফলে এই অংশের বিবরণ অনেক তথ্যনিষ্ঠ ও প্রাণবন্ত হয়েছে। তবে ‘প্রভোস্টগণ: নরেশচন্দ্র ও রমেশচন্দ্র’ শীর্ষক পরিচ্ছেদে এই দুই প্রভোস্ট সম্পর্কে লেখক যে মন্তব্য করেছেন তা পুনর্বিবেচনার বিষয়। লেখকের মতে, নরেশচন্দ্র সব ক্ষেত্রে নিজের মতের প্রাধান্য চাইতেন বলে সবার সঙ্গে তাঁর সংঘাত বাধত। ফলে তিনি অজনপ্রিয় ব্যক্তিতে পরিণত হন, হতাশ হয়ে কলকাতায় চলে যান এবং সেখানেও ‘শেষ পর্যন্ত সুবিধা করতে পারেননি’ (পৃ. ১৭১-১৮৪)। এই ভাগের পরে আছে ১৫ পৃষ্ঠার একটি অ্যালবাম, তাতে কিছু অমূল্য ছবি আছে।

১২.

লেখকের আদি প্রকল্প ছিল ‘মুসলিম হলের ইতিবৃত্ত’ রচনা করা, পরবর্তী সময়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস লিখবেন বলে স্থির করেন। ফলে তাঁর পুরো বইয়ের বিন্যাসে তার ছাপ পড়ে। বইয়ের সবচেয়ে বড় অধ্যায়টির নাম ‘মুসলিম হল’ (পৃ. ২০১-৮৫)। প্রস্তাবিত আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলসমূহের চরিত্র কেমন হবে তা নিয়ে কলকাতা স্যাডলার কমিশন বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মতামত নিয়েছিল। ‘কমন হল’, ‘মিক্সড হল’, ‘সেপারেট হল’ নিয়ে মতৈক্য হয়নি। ফলে শেষ পর্যন্ত তিনটি হল প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়। ১৯২০ সালের আইনের মাধ্যমে ‘মুসলিম হল’ প্রতিষ্ঠিত হয়, ১৯২৮ সালে এই হলের নামকরণ করা হয় সলিমুল্লাহ মুসলিম হল। স্বাধীনতার পর ‘ধর্মনিরপেক্ষতার প্রকাশ ঘটাতে’ গিয়ে মুসলিম শব্দটি বাদ দেওয়া হয়, পরবর্তী সময়ে মামলার মাধ্যমে সাবেক নাম ফিরে আসে। মুসলিম হলের নির্দিষ্ট কোনো অবকাঠামো ছিল না, কলা ভবন অর্থাত্ বর্তমান ঢাকা মেডিকেল কলেজের দোতলার ‘গুদামঘরে’ ছাত্রদের থাকতে হতো। মুসলিম ছাত্রদের আবাসিক সমস্যা দূর করার জন্য উপাচার্য হার্টগের উদ্যোগে গঠন করা হয় মুসলিম হল কমিটি। তারই ফলে ১৯৩১ সালে বর্তমান স্থানে স্বতন্ত্র ভবনটি তৈরি করা হয়। তবে এই ভবন নির্মাণের ব্যাপারে ঢাকা পিপলস অ্যাসোসিয়েশন ও হিন্দু মহাসভাভুক্ত ‘রক্ষণশীল হিন্দু’রা বিরোধিতা করে। কিন্তু এসব বিরোধিতা উপেক্ষা করে এই ভবন তৈরি হয়। হল লাইব্রেরি, পাঠকক্ষ, কমনরুম, ইনডোর খেলাধুলা, হল ইউনিয়ন, হল সাময়িকী, বিতর্ক, হল ম্যাগাজিন প্রকাশ, হলের বার্ষিক ভোজ, ছাত্র-শিক্ষকের মানবিক সম্পর্ক, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে এই হল মুসলমান ছাত্ররা যাতে জীবনের বৃহত্তর ক্ষেত্রে, রাজনীতিতে, প্রশাসনে নেতৃত্বের যোগ্যতা অর্জন করতে পারে, সেভাবে তাদের প্রস্তুত করে। ‘মুসলিম হল ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা বাংলার বুদ্ধিবৃত্তিক দিগন্তে (in the intellectual horizon of Bengal) এক নতুন আলোকবর্তিকা রূপে দেখা দেয়’।

হল ইউনিয়ন কার্যক্রমের মাধ্যমে মুসলমান ছাত্রদের মানসিক, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ঘটে। গভর্নর লিটনের ব্যক্তিগত বদান্যতা ও ভারতপ্রীতির কথা আসে। মুসলিম হলের ছাত্রদের জন্য বিত্তবানেরা বিভিন্ন বৃত্তি চালু করেন। উল্লেখ করার মতো একটি বৃত্তি ছিল, বলিয়াদির জমিদার কাজেমউদ্দিন সিদ্দিকী প্রদত্ত বৃত্তি। ‘সবচেয়ে নিয়মিত নামাজি’র জন্য তিনি পাঁচ টাকার একটি বৃত্তি চালু করেন। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় মুসলিম হলে এসে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির কথা বলেন, স্বদেশি পণ্য ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করেন। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেও মুসলিম হলের ছেলেরা এগিয়ে আসে সংস্কারের জগদ্দল পাথর পেরিয়ে। পতাকা, মুসলিম হল ম্যাগাজিন ইত্যাদি সাময়িকী তাঁদের মধ্যে যে নব ‘শক্তি ও ঐশ্বর্যের’ উত্থান ঘটেছিল তার প্রমাণ বহন করে। মুসলিম হলে রবীন্দ্রনাথের আগমন হলের ছাত্রদের শিল্প-সাহিত্যকর্মে অনুপ্রাণিত করে, নজরুলের আগমন প্রাণচাঞ্চল্য ও তারুণ্যের উদ্যম সৃষ্টি করে। মুসলিম হলে এসেছেন (১৯২৭) সুভাষচন্দ্র বসু। এই হলেই আবুল হুসেনের মতো যুগান্তরকামী কর্মযোগী ও সংস্কারকের নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ বা ‘শিখা গোষ্ঠী’। ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনে’র মাধ্যমে এই সংগঠনের নেতারা মুসলমান সমাজের সংস্কার এবং আচ্ছন্নতার বদলে জ্ঞান ও যুক্তির আলোক প্রসারিত করতে চেয়েছিলেন।

ডিরোজিওর (১৮০৯-৩১) নেতৃত্বে হিন্দু কলেজের ছাত্ররা প্রগতিশীল ও যুক্তিবাদী আন্দোলনের মাধ্যমে হিন্দু সমাজের আধুনিকায়নে যে ভূমিকা রেখেছিলেন, তার সঙ্গে ঠিক এক শ বছর পরে মুসলমানদের অচলাবস্থা কাটানোর ক্ষেত্রে শিখা গোষ্ঠীর অবদান তুলনীয়। আর এই হলের সামগ্রিক বিকাশে এবং চিত্তবৃত্তির বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় উদার পরিবেশ নিশ্চিত করতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন হলের প্রথম প্রভোস্ট ও পরবর্তী সময়ে উপাচার্য স্যার এ এফ রহমান। বইয়ে ‘আবুল হুসেন: শিক্ষক ও সংস্কারক’ ও ‘মহাপ্রাণ রহমান’ শীর্ষক দুটি আলাদা পরিচ্ছেদ রাখা যথার্থ হয়েছে। আবুল হুসেন বিষয়ে লেখক পুরোনো গবেষণার দ্বারস্থ হননি। আবুল হুসেনের পরিবারের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত যোগাযোগ, সাক্ষাত্কার ও চিঠি আদান-প্রদানের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বেশি ব্যবহার করেছেন। আবুল হুসেনের কনিষ্ঠ সহোদর সৈয়দ মোহাম্মদ হোসেনের যে মূল্যবান চিঠিটি ব্যবহূত হয়েছে তার তারিখ উল্লেখ থাকলে কিংবা এর কোনো অনুলিপি ছাপলে গ্রহণযোগ্যতা বাড়ত (পৃ. ২৬৭-২৭০)।

এফ রহমানের ব্যাপারে লেখক বলেছেন, ইতিহাস বিভাগের রিডার হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার (১৯২১) আগে ‘তিনি ছিলেন আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক’ (পৃ. ২৭৬)। কিন্তু এফ রহমান যে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার ছিলেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পাওয়ার জন্য ঢাকার নবাবের সুপারিশ কামনা করেছিলেন, তা উল্লেখ করলে এই ‘মহাপ্রাণে’র কৃতীর কোনো অসম্মান হতো না। ১৯২০ সালের ৬ মার্চ ঢাকার নবাবের কাছে লিখিত এক পত্রে এফ রহমান লেখেন:

I am writing this letter to beg a favour from you and to remind you of your very kind promise to me. The Dacca University Bill will become an Act by the end of this month and it is almost certain that some initial appointments will be made immediately. I feel sure that if you spoke to the Governor about me, I may get a good position there in the Dacca University. They are going to start a Muslim Hall in the University; if you care to recommend me for the headship of that with a professorship in the University.৩৪

ঢাকার নবাব তাঁর দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী গভর্নরের কাছে অনুরোধ জানান। উপাচার্য হার্টগ অনেকটা বিপাকে পড়েন। কারণ এফ রহমানের কোনো গবেষণাকর্ম ছিল না। কিন্তু ব্যক্তির যোগ্যতা বিচার করেই সে সময় সুপারিশ করা হতো। এফ রহমান আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করেছেন। তাই শেষ পর্যন্ত এফ রহমানকে মুসলিম হলের প্রভোস্ট করা হয় ঠিকই, কিন্তু ইতিহাস বিভাগের প্রফেসরশিপ যোগ্য ব্যক্তি হিসেবে রমেশচন্দ্র মজুমদার লাভ করেন। রহমান নিয়োগ পান রিডার পদে। পরবর্তী সময়ে তিনি একজন সুযোগ্য শিক্ষক, দক্ষ প্রশাসক ও মানবতাবাদী উদারপন্থী হিসেবে তাঁর অনন্য প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন।

মুসলিম হলের ব্যাপারে লেখক বইয়ের বিভিন্ন জায়গায় অনেক আবেগপ্রসূত মন্তব্য করেছেন। তার একটি হলো, এই হলের ছাত্ররা ‘বিশ্ব মুসলিম সম্প্রদায়ের সাথে নিজেদের যুক্ত মনে করলেও মুসলিম জাতীয়তাবাদে’র কথা তাঁদের মাথায় আসেনি। তাঁরা একই সঙ্গে ছিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদী এবং বৃহত্তর পরিধিতে ভারতীয় জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। উচ্চবিত্তের হিন্দুদের সাম্প্রদায়িকতার জবাবে অভিজাত মুসলমানরা সাম্প্রদায়িক হয়েছেন বটে, তবে মুসলিম হলের ছাত্ররা ‘অখণ্ড ভারতীয় জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করতেন’ (পৃ. ২০৭)। মুসলিম হলেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘শিখা গোষ্ঠী’, কিন্তু মুসলিম হলের ছাত্ররা অন্তত ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের আগে রাজনীতিতে সাধারণভাবে আগ্রহী হয়েছিলেন তার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। ঢাকায় বিপ্লবী দলগুলোতে মুসলমান ছাত্রদের অংশগ্রহণ ছিল না, সম্ভবপরও ছিল না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রায় ১৫ বছর পর ১৯৩৭ সালে ঢাকা জেলা ছাত্র ফেডারেশন গঠিত হয়। এই সংগঠন ঢাকার প্রায় ৬০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শাখা-প্রশাখা গড়ে তোলে। কিন্তু কমিউনিস্ট সংযোগের ফলে মুসলমান ছাত্ররা এর সঙ্গে জড়িত হওয়ার বিরোধী ছিল। তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বিস্তৃত ছিল হল ইউনিয়ন নির্বাচন পর্যন্ত। সেই রাজনীতিরও ভিত্তি ছিল আঞ্চলিকতা। যে জেলার ছাত্রসংখ্যা বেশি, সে জেলার প্রার্থীরাই জিতত। সাধারণত মেধাবী ছাত্ররাই হল ইউনিয়ন নির্বাচনে প্রার্থী হতেন। এই ধারার বাইরে এসে রাজনীতিকে সাংগঠনিক রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেন ফজলুর রহমান,৩৫ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথমদিকের মুসলিম ছাত্রদের মধ্যে যিনি রাজনীতিতে আগ্রহী হয়েছিলেন এবং পরবর্তী সময়ে জাতীয় রাজনীতিতে নাম করেছিলেন।৩৬ তিনি তাঁর রাজনৈতিক আদর্শে এতটাই ‘মুসলিম জাতীয়তাবাদী’ ছিলেন যে বাংলাকে আরবি হরফে লেখার প্রস্তাব পর্যন্ত করেছেন।৩৭ তবু মুসলমান ছাত্রদের মধ্যে প্রগতিশীল রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল। কিন্তু সলিমুল্লাহ হলে প্রতিবাদীরাই প্রধান ছিলেন এই প্রমাণ পাওয়া যায় না, অন্তত ১৯৫২ সালের পূর্ব পর্যন্ত। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্বে আন্দোলনের দুটি কেন্দ্রের একটি ছিল সলিমুল্লাহ হল। এই হলে ইউনিয়নের নেতৃত্বে ছিলেন মোটামুটি ‘ইসলামপন্থী’রা। অসাম্প্রদায়িক ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছাত্রদের কেন্দ্র ছিল মেডিকেল কলেজ হোস্টেল।৩৮

১৩.

বাংলাদেশ যে নারীশিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়নে দক্ষিণ এশিয়ায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, সমাজ ও রাষ্ট্রে এই সম্ভাবনার আদি বীজ বপন করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সে যুগের অচলাবদ্ধ সমাজে কলকাতায় গিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করা ছিল প্রায়-অসম্ভব ব্যাপার। তাই ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পূর্ববঙ্গের নারীদের উচ্চশিক্ষার দ্বার খুলে যায়। এতে বেশি উপকৃত হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ ও পশ্চাত্পদ মুসলমান সম্প্রদায়ের নারীরা। যুগান্তরের বার্তা নিয়ে এগিয়ে আসেন লীলা নাগ, ফজিলতুন নেসা, খোদেজা খাতুন, জামশেদ-উন-নিসা প্রমুখ নারী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথমদিকের যে শিক্ষা পরিবেশ, অবকাঠামো ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে এই নারীমুক্তি সম্ভব হয়ে উঠেছিল, তা উঠে এসেছে ‘নারীশিক্ষা’ শীর্ষক অষ্টম অধ্যায়ে। সহশিক্ষা ছিল অনেকটাই আনুষ্ঠানিক, ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ ছিল না বললেই চলে। তবু এই অঞ্চলের নারীরা বৃহত্তর সমাজের তুলনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উদার পরিবেশে নাটক, সংগীতানুষ্ঠান ইত্যাদি করেছেন, অন্যান্য সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়েছেন, খেলাধুলায় এসেছেন, সুপর্ণা নামে সাময়িকী প্রকাশ করেছেন, সমাজের যুগ-যুগান্তের অচলাবস্থাকে ভেঙে প্রগতির পথ নির্দেশ করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কীভাবে পূর্ববঙ্গে নারীদের সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও মানসিক বিকাশের সুযোগ তৈরি হয়েছে, তার ইঙ্গিত পাওয়া যায় এই অধ্যায়ে। তবে লেখকের তথ্যনিষ্ঠতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। যেমন তিনি বলেছেন, লীলা নাগ প্রতিষ্ঠিত ‘দীপালী সংঘ’ শুধু পূর্ববঙ্গের নয়, ‘উপমহাদেশের প্রথম ছাত্রী সংগঠন’। কিন্তু এর কোনো তথ্যসূত্র উল্লেখ করেননি (পৃ. ২৯৬)। লীলা নাগের জীবনী ও জন্মশতবার্ষিকী স্মারকগ্রন্থে এ রকম কোনো তথ্য পাইনি।৩৯ আল মামুন ক্লাবে প্রদত্ত ফজিলতুন নেসার ঐতিহাসিক বক্তব্য থেকে যে উদ্ধৃতি ব্যবহার করা হয়েছে, তার এক জায়গায় তথ্যসূত্র দেওয়া হয়েছে ‘সওগাত, অগ্রহায়ণ, ১৩৩৪’, অন্য জায়গায় দেওয়া হয়েছে (পৃ. ৭৬-৭৮)।

১৪.

বইয়ের নবম ভাগে এসেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘কয়েকটি বিভাগের কথা’। বাংলা ও সংস্কৃত, আরবি, সংস্কৃত ও পালি, উর্দু ও ফারসি বিভাগ, ইংরেজি বিভাগ, দর্শন বিভাগ ও দর্শন সমিতি, ইতিহাস সমিতির ইতিহাস চর্চা, অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রথম দিকের শিক্ষক, শিক্ষা কারিকুলাম, শিক্ষা পরিবেশ, গবেষণা, বিভিন্ন বিভাগীয় সমিতির কার্যক্রম উঠে এসেছে। বাংলা বিভাগ শুরু থেকেই গবেষণার ক্ষেত্রে সরব। ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি বিভাগে পাশ্চাত্য শিক্ষিত মুসলমান পণ্ডিত পাওয়া না যাওয়ায় ঢাকা মাদ্রাসার শামসুল উলামা আবু নসর ওয়াহিদকে নিয়োগ দেওয়া হয় অস্থায়ীভাবে। বুদ্ধদেব বসু, মন্মথনাথ বসু, অমলেন্দু বসুর মতো ছাত্র এবং সুশীল কুমার দে ও মাহমুদ হাসানের মতো প্রখ্যাত শিক্ষকদের নিয়ে ইংরেজি বিভাগ ছিল গবেষণা ও সৃষ্টিকর্মে সমৃদ্ধ। জি এইচ ল্যাংলি, হরিদাস ভট্টাচার্য, মমতাজউদ্দিন আহমদের মতো শিক্ষক থাকলেও ‘ইউরোপে বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিকে কেন্দ্র করে যেভাবে আধুনিক দর্শনের অনুশীলন হয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তা হয়নি। সমাজে ধর্মীয় সংস্কারের কারণে যুক্তির চর্চা কমই হয়েছে। সেটা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ব্যর্থতা।’ তবে পরবর্তী সময়ে গোবিন্দ চন্দ্র দেব ও আখতার ইমাম গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। ইতিহাস বিভাগে ছিল রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতো প্রতিভাবান ‘প্রথাগত ইতিহাসবিদ’, আবার প্রখ্যাত মার্ক্সবাদী ইতিহাসবিদ সুশোভন সরকার। মৌলিক গবেষণায় ইতিহাস বিভাগ ও ইতিহাস সমিতির অবদান ছিল খুবই তাত্পর্যপূর্ণ। শুরু থেকেই এই বিভাগ ছিল ‘উঁচু মানসম্পন্ন’। এই বিভাগ কর্তৃক ১৯২০-এর দশকে তিন খণ্ডে পরিকল্পিত এবং ১৯৪৩ ও ১৯৪৮ সালে প্রকাশিত দুই খণ্ডের ‘History of Bengal’ বাংলার ইতিহাসচর্চায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান। তবে রমেশচন্দ্র মজুমদার ও যদুনাথ সরকার সম্পাদিত এই দুটি গ্রন্থের যুগ বিভাগ ও অন্যান্য বিষয়ে মতামত দিয়েছেন ও প্রশ্ন তুলেছেন পরবর্তী ইতিহাসবিদগণ। অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রথম শিক্ষকদের অন্যতম ছিলেন এস বিদ্যনাথ আয়ার, ডি এন ব্যানার্জি প্রমুখ। ১৯২২-২৩ সালে পৃথক কমার্স বা বাণিজ্য বিভাগ চালু হলে অর্থনীতির অনেক শিক্ষক সেই বিভাগে যোগ দেন। অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষা কারিকুলাম ও টেক্সট বুক সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। সে সময়ের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে খুব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো, বিভাগের শিক্ষার্থীরা সংবিধান-বিষয়ক পাঠ গ্রহণ করছেন ডি এন ব্যানার্জি, অমিত সেনদের মতো অধ্যাপক ও আমন্ত্রিত সংবিধান বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে (পৃ. ৩০০-৩২২)।

১৫.

‘বিবিধ প্রসঙ্গ’ শীর্ষক সর্বশেষ অধ্যায়টি হতে পারত বইয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কারণ এখানে ‘গ্রন্থাগার’, ‘গবেষণাকর্ম’, ‘পাবলিক লেকচার’, ‘উচ্চতর গবেষণা: পিএইচডি, ডিলিট ও ডিএসসি’, ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা’, ‘সম্মানজনক ডিগ্রি প্রদান’, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসংসদ’, ‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি’ ইত্যাদি উপশিরোনামে আলোচিত হয়েছে আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গসমূহ। অনন্য গ্রন্থাগার-সংস্কৃতি, গবেষণার মাধ্যমে মৌলিক উদ্ভাবন, নিয়মিত পাবলিক লেকচারের মাধ্যমে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছে জানান দেওয়া এবং ইউনিভার্সিটি বুলেটিন কিংবা জার্নালে প্রকাশ করা, আমন্ত্রিত দেশি-বিদেশি পণ্ডিতদের পাবলিক লেকচার সিরিজের মাধ্যমে সমসাময়িক বিশ্ব-জ্ঞানপ্রবাহের সঙ্গে যুক্ত থাকা, নিত্যনতুন জ্ঞান সৃষ্টি ও উদ্ভাবনের আলোকে উদ্ভাসিত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিয়ে সঘন বুদ্ধিবৃত্তিক পরিমণ্ডল—এসবের মধ্য দিয়েই স্বপ্নদ্রষ্টাদের স্বপ্ন সত্যি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার যাত্রার প্রথম দুই দশক উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন লাভ করেছিল। এসব বিষয় সংক্ষিপ্ত পরিসরে এলেও তা একটা পূর্ণ অবয়ব তৈরি করতে পেরেছে। তবে অধ্যায়ের বিন্যাস একে কম গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। শিরোনামের দাবি মেনে এ অধ্যায়ে যেমন এসেছে ‘রমেশচন্দ্র মজুমদারের বাংলা-বিরূপতা ও তার প্রতিবাদ’, ‘মোহিতলাল আখ্যান’, ‘ঢাকার সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি’, ‘স্বাস্থ্য ও চিকিত্সা’, ‘শরীরচর্চা ও খেলাধুলা’, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যানটিন’ ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু থেকেই বিখ্যাত গুণীজনদের সম্মানজনক ডিগ্রি প্রদানের রীতি গড়ে ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম আচার্য আর্ল অব রোনাল্ডশে, প্রথম উপাচার্য হার্টগ, বিজ্ঞানী সি ভি রমন, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, স্যার আবদুর রহিম, বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু, স্যার প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, যদুনাথ সরকার প্রমুখকে বিভিন্ন সময় ডিগ্রি প্রদান করা হয়। শরত্চন্দ্রকে ডিগ্রি দেওয়ার বিরোধিতা করেছিল ঢাকার প্রভাবশালী পত্রিকা ঢাকা প্রকাশ। রবীন্দ্রনাথ ডিলিট নিতে না আসা প্রসঙ্গে এবার লেখক নতুন যুক্তি হাজির করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি মন্তব্য করেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক ও তখনকার ছাত্রদের কাছ থেকে জানা যায়, তাঁর সঙ্গে শরত্চন্দ্র ও যদুনাথকে ডক্টরেট দেওয়ায় তিনি সমাবর্তনে আসেননি। তখন তিনি মনে করতেন, বাংলায় তিনি কারোরই সমপর্যায়ের নন। তাঁর শরীর ভালো নয় এই অজুহাতে তিনি আসেননি।’ (পৃ. ৩৩১) ‘রবীন্দ্রনাথ তাঁর নাইট খেতাব ফিরিয়ে দিলেও, তাঁকে সেকালে “স্যার” সম্বোধন করলে তিনি অখুশি হতেন না।’ (পৃ. ৩৩২) কিংবা ‘শরত্চন্দ্রের ডিলিট-প্রাপ্তি প্রশ্নে রবীন্দ্রনাথও খুশি হননি। অর্থনীতিবিদ ভবতোষ দত্তের অনুমান শুধু একা রবীন্দ্রনাথকে ডিলিট দিলে তিনি যেতেন।’ (পৃ. ৩৩৩) ভবতোষ দত্তের মতো লেখকও শুধু অনুমাননির্ভর কথা বলেছেন, কিন্তু কোনো তথ্যপ্রমাণ হাজির করেননি।

১৬.

প্রতিষ্ঠার পঁচিশ বছরের মধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এই ‘জনগোষ্ঠীর বুদ্ধিবৃত্তির পরাকাষ্ঠ বা প্রতীক’। কিন্তু এই গৌরবময় ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা সে রক্ষা করতে পারেনি। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দেশভাগ ও পরিবর্তিত আর্থসামাজিক পরিস্থিতিতে তার মানের অবনমন ঘটেছিল। তবু প্রথম চল্লিশ বছর সে এশিয়ার একটি প্রধান উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে অধিষ্ঠিত ছিল। এই জনপদের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিবর্তন এবং জাতীয়তাবাদী যে আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্ম হয়, তাতে অনন্য ভূমিকা পালন করে। ‘মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত...মোটের ওপর একটা আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখে।’ কিন্তু স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আইনের মাধ্যমে দলীয় রাজনীতির পথ খুলে যায় এবং শিক্ষক নিয়োগে অপরিণামদর্শী দুর্নীতির সংস্কৃতি চালু হয়। একদিকে ক্রমবর্ধমান শিক্ষার্থীর সংখ্যা, অন্যদিকে বহু জায়গা বেদখল হয়ে যাওয়ায় অবকাঠামোগতভাবে সে দুর্বল হয়ে পড়ে। আবাসন সমস্যা প্রকট হয়, একসময়ের প্রগতিশীল ছাত্ররাজনীতি লেজুড়বৃত্তিতে পরিণত হয়। ফলে, গবেষণা ও সামগ্রিক শিক্ষা পরিবেশ দূষিত হয়ে পড়ে। উপসংহারে লেখক তাই আফসোস করে বলেন, ‘বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরোনো ও প্রধান বিদ্যাপীঠ হিসেবে গবেষণার ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ভূমিকা পালনের কথা ছিল, তা এই প্রতিষ্ঠানটি পুরোপুরি করতে পারছে না।’ অতীত গৌরবের এই অনুসন্ধান হয়তো আমাদের নতুন করে পথ দেখাতে পারে।

১৭.

মুখের কথা আর গবেষকের সিদ্ধান্ত, এই দুই ক্ষেত্রে দায়িত্বের মাত্রায় তফাত অনেক। গবেষণায় কল্পনার স্থান ইদানীংকালে দেওয়া হচ্ছে, Historical Imagination বা ঐতিহাসিক কল্পনা নামে, তাও একটা পদ্ধতি। এত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে লিখিত এই গ্রন্থে লেখক কোনো সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিই অনুসরণ করেননি। কিছু ক্ষেত্রে তথ্যসূত্র দিয়েছেন পুরোপুরি নিয়ম মেনেই। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ অনেক তথ্য, অনেক মন্তব্যের প্রমাণস্বরূপ কোনো সূত্র উল্লেখ করা হয়নি। যে দুষ্প্রাপ্য দলিলগুলোর ব্যবহার এই বইয়ের আপাতমূল্য অনেক বাড়িয়ে দিতে পেরেছে, তা অনেক ক্ষেত্রে তৈরি করেছে সংশয়। কারণ, এ রকম অনেক দলিলের কোনো তথ্যসূত্র উল্লেখ করা হয়নি। কখনো শুধু নামোল্লেখ, কখনো লেখক দেখেছেন এই বলেই দায়িত্ব শেষ করা হয়েছে। প্রায় ২০০ জন ব্যক্তির সাক্ষাত্কার নেওয়া হয়েছে, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাক্ষাত্কারের কোনো সাল-তারিখ উল্লেখ করা হয়নি। এসব ক্ষেত্রে তথ্যসূত্র না দেওয়া থাকায় কোনটা দলিলপত্র কিংবা সাক্ষাত্কার থেকে পাওয়া তথ্য, কোনটা লেখকের নিজের মন্তব্য তা বোঝা দায়সাধ্য হয়ে পড়ে। তথ্যগত ভুলের পাশাপাশি বইয়ের বিন্যাসে গলদ আছে। একই প্রসঙ্গ বিভিন্ন জায়গায় এত বিক্ষিপ্তভাবে এসেছে যে তা থেকে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো পাঠকের জন্য দুরূহ হয়ে পড়ে। এ রকম একটা বইয়ের কোনো নির্ঘণ্ট নেই, তথ্যসূত্র দেওয়া হয়নি, গ্রন্থপঞ্জি দেওয়া হয়েছে নির্বাচিত। একই দলিলপত্র নিয়ে কিংবা একই কালপরিধি নিয়ে আগে গবেষণা করেছেন এমন গবেষকদের নামোল্লেখ পর্যন্ত করা হয়নি। বইয়ের জন্য প্রয়োজনীয় গবেষণা ও তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের কাল (সত্তর-আশি দশক) এবং প্রকাশকালের (২০১৬) ব্যবধান এর একটি কারণ হতে পারে। দেশের একজন খ্যাতিমান ইতিহাসবিদ এবং আরেকজন বড় গবেষক এই পাণ্ডুলিপি দেখে পরামর্শ দিয়েছেন বলে লেখক আমাদের জানিয়েছেন (পৃ. ১৭-১৮)। তবু অনেকগুলো গুরুতর ভুল থেকে যাওয়াটা হতাশাজনক। বইয়ের কলেবর বেড়ে যাবে, এই অজুহাত না দিয়ে পরবর্তী সংস্করণে অন্তত তথ্যসূত্র আর বিস্তারিত গ্রন্থপঞ্জি দিলে কিছুটা দায়মুক্তি ঘটবে।

স্যার ফিলিপ হার্টগ

সৈয়দ আবুল মকসুদ, প্রথমা, ডিসেম্বর ২০১৬

স্যার ফিলিপ জোসেফ হার্টগ শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্যই ছিলেন না, তিনি ছিলেন উপমহাদেশের প্রথম এই ‘আবাসিক ও শিক্ষাদানকারী’ বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপরেখা প্রণয়নকারী। ঢাকায় প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাদর্শন, প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রশাসনিক অবকাঠামোর নকশাকার। ‘গত ১০০ বছরের আধুনিক বাংলাদেশের যাঁরা নির্মাতা, স্যার ফিলিপ হার্টগ তাঁদের প্রথম সারির একজন।’ স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দ্বারা। সুতরাং স্যার ফিলিপ হার্টগকে স্মরণ করা আমাদের জাতীয় ও নৈতিক দায়িত্ব।’ কিন্তু গত পঞ্চাশ বছরে এই দায়িত্ব পালন তো করা হয়নি, বরং এক অবিমৃষ্যকারী অবহেলার শিকার হয়েছেন এই মহান শিক্ষাবিদ। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথমদিকের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের স্মৃতিচারণায় তাঁর সম্পর্কে বিচ্ছিন্ন কিছু বর্ণনা ও মন্তব্য আছে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত তাঁকে নিয়ে আমাদের অনুসন্ধান বাংলাপিডিয়া৪০ ও অন্য একটি জীবনীকোষে৪১ সংক্ষিপ্ত দুয়েকটি ভুক্তি, বিশ্ববিদ্যালয়-সম্পর্কিত বইয়ে না-করলেই-নয় জাতীয় আলোচনা। বাংলা একাডেমি চরিতাভিধানে উপমহাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক বেশ কয়েকজন বিদেশিকে নিয়ে ভুক্তি আছে, কিন্তু হার্টগ-সম্পর্কিত কোনো ভুক্তি নেই।৪২ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি হল নির্মাণ করে তার দায় শেষ করেছে। বাংলা একাডেমি এখনো পর্যন্ত প্রায় দেড় শ জীবনী গ্রন্থ ছাপিয়েছে, হার্টগ তাদের বিবেচনায় আসেনি। লেখক ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ এই জাতীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক দায় নিজের কাঁধে নিয়ে রচনা করেছেন এই গ্রন্থ। এ ক্ষেত্রে তিনি পথিকৃতের কৃতিত্বের দাবিদার।

১.

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-সম্পর্কিত লেখকের আগে আলোচিত বইটির কাজ করতে গিয়ে বর্তমান গ্রন্থের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন। এক দিক থেকে সেই বইয়ের বর্ধিত ফলাফল এই কাজ। ফলে ‘তথ্য-উপাত্ত জোগাড় করতে যথেষ্ট বেগ’ স্বীকার করলেও বইয়ের বিন্যাসের ক্ষেত্রে কোনো বাড়তি দায়িত্ব নেওয়ার ছাপ পাওয়া যায় না। এমনকি আগের বইয়ে ব্যবহূত ভুল তথ্যের কোনো সংশোধন কিংবা পুনর্মূল্যায়নও করা হয়নি। বইয়ের কোনো বিষয়সূচি নেই। ‘প্রবেশক’, ‘উপক্রমণিকা’সহ ২৬টি ছোট পরিচ্ছেদে সাজানো হয়েছে ১১২ পৃষ্ঠার বইটি। আগের বই থেকে এই বইয়ের উন্নতির দিক হলো এখানে একটি তথ্যসূত্র যোগ করা হয়েছে। প্রচুর প্রাথমিক উত্স, দুষ্প্রাপ্য দলিলাদি ব্যবহার করা হলেও প্রদত্ত তথ্যসূত্রের সংখ্যা মাত্র ১২। ‘নির্বাচিত গ্রন্থপঞ্জি’ হুবহু আগের বইয়ে যা ছিল, তাই আছে। এমনকি সেই গ্রন্থপঞ্জিতে যে মুদ্রণপ্রমাদ ছিল, তারও পুনরাবৃত্তি ঘটেছে।৪৩ এর মধ্যে ‘স্টেপলটনের স্বপ্ন ও কর্ম’ ও ‘বলধা গার্ডেনে হার্টগের সংবর্ধনা ও তদবির’ শীর্ষক দুটি পরিচ্ছেদ হুবহু পূর্বোল্লিখিত বই থেকে নেওয়া। ‘১ জুলাই ১৯২১: স্বর্ণাক্ষরে লেখা দিন’ শীর্ষক পরিচ্ছেদটি সেই বইয়ের একই নামের পরিচ্ছেদের পরিবর্ধিত রূপ।

২.

হার্টগ তাঁর ৬০ বছরের কর্মজীবনের ৫ বছর ঢাকায় এবং ১৬ বছর উপমহাদেশে কাটিয়েছেন। ভারতে অবস্থানকালীন পুরো সময়ই তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন, যা ছিল প্রধানত শিক্ষা উন্নয়নবিষয়ক। ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব পালনের সময় তাঁর লক্ষ্য ছিল অবহেলিত অথচ সম্পদপূর্ণ পূর্ব বাংলায় যাতে একটি অসাম্প্রদায়িক ও জ্ঞানবিভাসিত সমাজ গড়ে ওঠে।’ সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য তিনি কাজ করেছেন একেবারেই নিঃস্বার্থভাবে।

১৮৬৪ সালের ২ মার্চ এক ব্রিটিশ ইহুদি পরিবারে ফিলিপ হার্টগের জন্ম। মধ্যযুগব্যাপী নিপীড়নের শিকার ইহুদিদের বারবার দেশ পরিবর্তন করতে হতো। হার্টগের আদি পুরুষদের কয়েক প্রজন্ম ছিল নেদারল্যান্ডসে, সেখান থেকে তাঁরা আসেন ফ্রান্সে। ফিলিপ হার্টগের বাবা আলফন্স হার্টগ ফ্রেঞ্চ শিক্ষকের চাকরি নিয়ে ইংল্যান্ডে চলে আসেন এবং স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। তাঁরা ছিলেন সংস্কারবাদী ও উদারবাদী ইউরোপীয় ইহুদিদের শীর্ষ নেতা আব্রাহাম গেইগারের (১৮১০-১৮৭৮) অনুসারী। লেখক আমাদের জানাচ্ছেন, ফিলিপের বাবা আলফন্স হার্টগ ‘বিত্তবান ও সংস্কৃতিমনা’ ছিলেন (পৃ. ১৫)। কিন্তু ফ্রেঞ্চ শিক্ষক আলফন্স সংস্কৃতিমনা ছিলেন বটে, কখনো ‘বিত্তবান’ ছিলেন না। বরং তাঁর এবং ম্যারিয়ন হার্টগের সংসার চলত কোনোমতে। কারণ, তাঁদের ‘had no capital and very little of their race’s reputed business ability.’ স্বামী-স্ত্রী দুজনই ছিলেন স্কুলশিক্ষক। আলফন্স স্কুলে এবং বাড়িতে ফ্রেঞ্চ পড়াতেন। ম্যারিয়ন নিজে ইহুদি শিশুদের জন্য একটি ‘বোর্ডিং ও ডে’ স্কুল চালু করেন, যেখানে সাধারণ শিক্ষার সঙ্গে ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া হতো।৪৪ তাঁদের তিন ছেলে, দুই মেয়ে—নুমা, হেলেনা (নেলি), মারকুস, সিসিলে ও ফিলিপ। আরও দুই সন্তান শিশুকালে মারা যায়। নুমা ও ফিলিপের স্কুলের খরচ দিতেন কয়েকজন বিত্তবান ও প্রভাবশালী ইহুদি। হার্টগ পড়াশোনা শুরু করেছেন মায়ের স্কুলে। এরপর তিনি ভর্তি হন ইউনিভার্সিটি কলেজ স্কুলে। বিখ্যাত ধনাঢ্য ইহুদি রথচাইল্ড পরিবারের ব্যারন ম্যায়ার দে রথচাইল্ড তাঁর স্কুল ফি বহন করতেন। আলফন্স হার্টগের এককালের ছাত্রী ম্যায়ার ফিলিপের বড় ভাই নুমা হার্টগের পড়াশোনার খরচও দিতেন সাবেক শিক্ষকের প্রতি বদান্যতাস্বরূপ। ম্যায়ারের মৃত্যুর পর হান্নাহ এই দায়িত্ব নেন। কিন্তু তাঁর বিয়ের পর এই ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গেলে ফিলিপের পড়ানো বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। কারণ, মায়ের স্কুল চালাতে গিয়ে তখন তাঁদের পরিবার ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। এই পরিস্থিতিতেই হার্টগকে তাঁর বড় ভাই ম্যানচেস্টারের ওয়েন্স কলেজের অধ্যাপক মারকুসের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। ম্যানচেস্টারের ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে বিএসসি ডিগ্রি নেওয়ার পর ফ্রান্সে বসবাসরত তাঁর বোন নেলি ও দুলাভাই সোরবর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক আরসেন ডারমেস্টেটারের কাছে নিয়ে আসা হয়। এই নিঃসন্তান দম্পতি তাঁকে সন্তানের মতো লালনপালন করেন। সেখানে গিয়ে তিনি ভর্তি হন কলেজ দে ফ্রান্সে এবং সেখানকার পড়াশোনা শেষে পরবর্তী সময়ে জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে।৪৫ এভাবেই ফিলিপ হার্টগ একটি ‘কসমোপলিটন শিক্ষা’ লাভ করেন।

৩.

বিজ্ঞানে হার্টগের মৌলিক কোনো গবেষণা নেই। পরিবারের সবাই বিশেষত বোনজামাই প্রখ্যাত ফরাসি ভাষাবিদ ও সোরবর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আরসেন ডারমেস্টেটার (১৮৪৬-১৮৮৮) খুব চেয়েছিলেন তিনি একজন প্রথম শ্রেণির রসায়নবিদ হবেন। হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত জার্মান রসায়নবিদ রবার্ট বানসেনের (১৮১১-১৮৯৯) অধীনে গবেষণার ব্যবস্থাও করে দিয়েছিলেন। ১৮৮৫ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি ডিগ্রি লাভ করার পর হার্টগ উপার্জনের দিকে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর বোন নেলির ইচ্ছায় তিনি ফরাসি রসায়নবিদ Marcellin Berthelot (১৮২৭-১৯০৭)-এর ল্যাবরেটরিতে কাজ করার জন্য ফ্রান্সে ফিরে যান। ১৮৮৭ সালে ‘প্রিপারেশন অব সালফাইট’-এর ওপরে তাঁর প্রথম প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এখানকার পাঠ শেষ করার পর তিনি কেমিক্যাল ফিজিকসে গবেষণার জন্য বছরে ১০০ পাউন্ডের বার্কলে স্কলারশিপ নিয়ে ইংল্যান্ডে ফিরে যান। রয়্যাল সোসাইটি থেকেও ৫০ পাউন্ডের একটি বৃত্তি লাভ করেন। কিন্তু গবেষক হার্টগের জন্য প্রথম হতাশা আসে ১৮৯০ সালে তিনি যখন তাঁর সালফাইট-বিষয়ক গবেষণার জন্য লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিএসসি ডিগ্রি লাভে ব্যর্থ হন। এর কারণ হিসেবে গবেষণা-পরীক্ষকেরা জানান, তাঁর গবেষণার পরিধি খুবই সংকীর্ণ। বৃত্তি শেষ হলে তিনি ওয়েন্স কলেজের সহকারী লেকচারার ও রসায়নের ডেমনেস্ট্রেটরের একটি অতিরিক্ত পদে যোগ দেন। এ সময় তিনি আর্থিক সচ্ছলতার আশায় ম্যানচেস্টার গার্ডিয়ান-এ বিজ্ঞানবিষয়ক বইয়ের সমালোচনা, নিবন্ধ লিখতে শুরু করেন এবং বিজ্ঞান লেখক হিসেবে সমাদর লাভ করেন। Dictionary of National Biography-এর জন্য ‘গ’ আদ্যক্ষরের সব রসায়নবিদের জীবনী লেখেন। এ সময় তিনি দুয়েকটি গবেষণা প্রবন্ধ লিখলেও মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়, রসায়নবিদ হওয়া তাঁর নিয়তি নয়। ওয়েন্স কলেজের তত্কালীন চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডিক্সনের সঙ্গে আলোচনা করে তিনি বোন সিসিলিকে চিঠিতে লেখেন, ‘I had a long talk with Dixon, he told me that he thought my 'genius' lay rather in criticizing and organizing than in experimental observation.’ ডিক্সনের এই মন্তব্য মেনে নেওয়া হার্টগের পক্ষে দুঃসাধ্য ছিল, কারণ হার্টগ নিজে চেয়েছেন বড় রসায়নবিদ হতে। কিন্তু তাঁর প্রতিভা আপন পথ খুঁজে নেয় দ্রুত। ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটির সম্প্রসারণ প্রকল্পের সচিব হিসেবে যোগদান করার মাধ্যমে শিক্ষা প্রশাসনের পথে তাঁর দীর্ঘ কর্মময় ও সফল যাত্রা শুরু হয়। বর্তমান গ্রন্থের লেখক তাঁর ‘ভূমিকা’য় চারবার ও বইয়ের ভেতরে বেশ কয়েকবার হার্টগের নামের আগে ‘ড.’ বসিয়েছেন। কোথাও বলছেন, ‘হার্টগ নিজে ছিলেন একজন খ্যাতিমান রসায়নবিজ্ঞানী’ (পৃ. ১৭)। এই অতি মহীয়ান করে তোলার প্রবণতা জীবনীকারের জন্য দোষণীয়।

৪.

হার্টগ তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন ওয়েন্স (Owens) কলেজের ‘বিশপ বার্কলে স্কলার’ হিসেবে। সেখান থেকে তাঁর জীবনের মোড় পরিবর্তন হয়। রসায়নের অধ্যাপনা থেকে তিনি শিক্ষা প্রশাসনের দিকে ঝুঁকে পড়েন। ১৮৯৯-১৯০৩ সময়কালে তিনি ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন পুনর্গঠনের দায়িত্ব পালন করেন। আলফ্রেড মোজলে কমিশন অব এডুকেশনাল এনকোয়ারির সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ১৯০২-০৩ সালে। এরপর একাডেমিক রেজিস্ট্রার হিসেবে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের পুনর্গঠনের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় তখন ছিল ১৯০২ সালের আগের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা বর্তমান বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো অধিভুক্তকারী বিশ্ববিদ্যালয় (affiliated university)। বিশ্ববিদ্যালয়টির কাজ ছিল পরীক্ষা নেওয়া এবং ডিগ্রি প্রদান করা। হার্টগের দায়িত্ব ছিল এই প্রতিষ্ঠানকে শিক্ষাদানকারী (teaching) বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা।৪৭ এই দায়িত্ব অসাধারণ সাফল্যের সঙ্গে পালন করে তিনি একজন শিক্ষাসংগঠক হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আরেকটি যে অসাধারণ কীর্তি গড়েন তা হলো লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্য স্কুল অব ওরিয়েন্টাল স্টাডিজ, পরবর্তী সময়ে স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ (SOAS) প্রতিষ্ঠায় তিনি প্রধান উদ্যোক্তা ও প্রশাসকের ভূমিকা পালন করেন।৪৮

৫.

লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার হিসেবে অসাধারণ কীর্তি এবং শিক্ষা প্রশাসক হিসেবে খ্যাতির কারণে হার্টগকে ১৯১৭ সালে গঠিত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন বা স্যাডলার কমিশনের সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৯১৯ সালে প্রদত্ত এই কমিটির রিপোর্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তাত্পর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে (পৃ. ১৪-২০)। লেখক আমাদের জানাচ্ছেন, হার্টগ ছিলেন এই কমিটির ‘সবচেয়ে সক্রিয় সদস্য’ এবং বিশালাকার ‘রিপোর্ট প্রণয়নে পনেরো আনা কৃতিত্ব হার্টগের। অন্য সদস্যরা পরামর্শ দিয়েছেন, কিন্তু লেখার কাজটি সদস্যসচিব হিসেবে তাঁকেই করতে হয়েছে।’ (পৃ. ১৯-২০) এসব তথ্যের জন্য লেখক কোনো সূত্র ব্যবহার করেননি। কিন্তু অন্য উত্স থেকে আমরা যা জানতে পারি, তা ভিন্ন রকম।

আট সদস্যের কমিশনের চেয়ারম্যান ও সেক্রেটারি যথাক্রমে লিডস ইউনিভার্সিটির উপাচার্য ড. মাইকেল স্যাডলার এবং ভারত সরকারের এডুকেশনাল ডিপার্টমেন্টের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জর্জ অ্যান্ডারসন।৪৯ সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ‘সদস্যসচিব’ নন, হার্টগ ছিলেন কমিশনের একজন সাধারণ সদস্য। কমিশনে ‘সদস্যসচিব’ বলে কোনো পদ ছিল না। কমিশন তাদের মূল রিপোর্ট পেশ করে ৫ খণ্ডে। সঙ্গে ছিল পরিশিষ্ট, মেমোরেন্ডা, প্রশ্নমালা ইতাদি নিয়ে আরও ৮ খণ্ড। মূল রিপোর্টের ৫২টি অধ্যায় ভাগাভাগি করে লেখেন কমিশনের সব সদস্য। সর্বোচ্চ ১১টি করে অধ্যায় লিখেছেন চেয়ারম্যান স্যাডলার, হার্টগ ও অপর সদস্য রামসে মুইর। হার্টগ লিখিত ১১টি অধ্যায়ের মধ্যে ছিল পরীক্ষাপদ্ধতি, শিক্ষার মাধ্যম, ইংরেজি শিক্ষা, মেডিকেল শিক্ষা, ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে লিখিত অধ্যায়। তবে হার্টগ লিখিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় এবং বাংলাদেশের সঙ্গে হার্টগের সম্পর্ক ও প্রাসঙ্গিকতা নিরূপণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে তাত্পর্যপূর্ণ হলো ‘The University of Dhaka’ শীর্ষক ৩৩ নম্বর অধ্যায়।৫০ রিপোর্টের চতুর্থ খণ্ডে অন্তর্ভুক্ত ১২০ পৃষ্ঠার এই অধ্যায়ে প্রস্তাবিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপরেখা নির্মাণ করা হয়েছে, তা অনুযায়ীই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরি হয়েছে। এখানে তিনি প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের দার্শনিক, প্রশাসনিক, একাডেমিক কর্মকাণ্ডের এক নিখুঁত এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নকশা তৈরি করেন। তিনি আশা প্রকাশ করেন,

Dacca will be a small university compared to Calcutta, but it is to be remembered that many of the greatest of university teachers have lived and worked in universities besides which Dacca will be large and in many ways the opportunities of Dacca will be Unique. We hope that, in this quiet intellectual centre in the great plains and waters of Eastern Bengal, and in touch with a historic city, there may spring up a fresh synthesis of eastern and western studies. These are the possibilities of Dacca, It will lie with the men who control the University to turn those possibilities into realities.৫১

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য হিসেবে সেই দায়িত্ব প্রধানত তাঁর কাঁধে এসে পড়ে। তিনি তাঁর অসাধারণ প্রশাসনিক নৈপুণ্যে নিজের প্রণীত নকশা বাস্তবায়ন করেন। আবাসিক হল, টিউটোরিয়াল শিক্ষাপদ্ধতি, উন্নত পরীক্ষাপদ্ধতি এবং যে অনন্য প্রশাসনিক কাঠামো নিয়ে উপমহাদেশের প্রথম ‘আবাসিক ও শিক্ষাদানকারী’ বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু হয়েছিল, তা ছিল তাঁর দীর্ঘ তিন দশকের শিক্ষা প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা ও এ বিষয়ক বহু গবেষণার ফল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল একরকম তাঁর নিজের স্বপ্নে ও দর্শনে লালিত সন্তান। সুতরাং, পি জে হার্টগ শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্যই ছিলেন না, ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থপতি। তিনি শুধু একজন অসাধারণ শিক্ষা প্রশাসকই ছিলেন না, ছিলেন একজন মহান শিক্ষা দার্শনিক এবং তাঁর এই প্রায়-বিপরীত দুই গুণাবলির দুষ্প্রাপ্য সম্মিলনীর ফলেই প্রতিষ্ঠার কয়েক বছরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠেছিল উপমহাদেশের একটি ‘মডেল বিশ্ববিদ্যালয়’।

৬.

হার্টগকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের প্রস্তাব দেওয়া হয় ১৯২০ সালের ২১ জুন, ২৪ জুন তিনি এই প্রস্তাবে সম্মতি জ্ঞাপন করেন। ১ ডিসেম্বর কলকাতায় অবস্থিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্প অফিসে এসে তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এ প্রসঙ্গে লেখক আমাদের জানান, ‘উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের উদ্দেশ্যে হার্টগ ও ম্যাবল হার্টগ তাঁদের শিশুসন্তানদের নিয়ে লন্ডন ত্যাগ করেন ১১ নভেম্বর।’ (পৃ. ২২) কিন্তু ম্যাবল হার্টগ স্বয়ং আমাদের জানাচ্ছেন, তাঁরা হার্টগের কাছে এসে পৌঁছান হার্টগের এক মাস পরে। অর্থাত্ ১৯২১ সালের জানুয়ারির শুরুতে, হার্টগ তত দিনে ঢাকায় এসে উপাচার্য অফিসে কার্যক্রম শুরু করেছেন।৫২ উপাচার্য হিসেবে তাঁকে প্রথম যে প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়েছে, তা হলো আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। নিজের বেতন তোলা, কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কাজ—সব ক্ষেত্রেই এই সমস্যা ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়কে বাস্তবে রূপায়িত করার ক্ষেত্রে হার্টগকে সহায়তা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্পেশাল অফিসার ও ইতিহাসবিদ এইচ ই স্টেপলটন। হার্টগের দায়িত্ব গ্রহণের আগে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স’ প্রণয়নের গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করেন তিনি। ‘হার্টগের ডান হাত’ ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম রেজিস্ট্রার খান বাহাদুর নাজির উদ্দিন আহমেদ।

অপরিচিত ঢাকা শহরে ব্যক্তিগত অসুবিধার পাশাপাশি হার্টগকে প্রশাসনিক ক্ষেত্রে প্রধানত যেসব সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছিল সেগুলোর মধ্যে ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক সংকট, শিক্ষক নিয়োগ প্রশ্নে দুই সম্প্রদায়ের তদবির, মুসলমানদের মধ্যে যোগ্য শিক্ষকের অপ্রতুলতা, কংগ্রেসের নেতৃত্বে চলমান অসহযোগ আন্দোলন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বর্জন আন্দোলন, ঢাকায় সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের তত্পরতা, সাম্প্রদায়িক বিভেদ, ঢাকার স্থানীয় প্রভাবশালী হিন্দুদের বিরোধিতা ইত্যাদি। এতসব প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও দীর্ঘ অভিজ্ঞতা, প্রশাসনিক যোগ্যতা এবং চারিত্রিক দৃঢ়তার মাধ্যমে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শক্ত ভিত্তি স্থাপন করে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন।

শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে তাঁকে বিভিন্ন ধরনের—সাম্প্রদায়িক ও আঞ্চলিক—তদবিরের মুখোমুখি হতে হয়। কিন্তু গবেষণা-যোগ্যতাকে প্রধান মাপকাঠি নির্ধারণ করে এ ক্ষেত্রে তাঁর অনমনীয় অবস্থানের ফলে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জড়ো করতে পেরেছিলেন উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের। আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে উপমহাদেশের সমৃদ্ধ লাইব্রেরিসমূহের একটি, তারও ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে হার্টগের প্রশাসনিক উদ্যোগ ও ব্যক্তিগত আগ্রহের ফলে। সহকর্মীদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল বন্ধু ও পৃষ্ঠপোষকের। তাঁরা যাতে তাঁদের শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম নির্বিঘ্নে চালিয়ে যেতে পারেন সেদিকে ছিল তাঁর তীক্ষ দৃষ্টি। তরুণ শিক্ষকদের জন্য তিনি ছিলেন দরদি অভিভাবক ও উদ্যোগী পৃষ্ঠপোষক। তরুণ শিক্ষক ও পরবর্তী সময়ে বিখ্যাত বিজ্ঞানী সত্যেন বসু এবং ভাষাবিজ্ঞানী মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর ইউরোপে উচ্চশিক্ষার আয়োজনে হার্টগ মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। বসুর আইনস্টাইনের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ তৈরিতেও হার্টগের ভূমিকা ছিল (পৃ. ৫৩-৫৬, ৭১-৭২)।

লেডি ম্যাবল হার্টগের ভূমিকা সম্পর্কে আলাদাভাবে বলা হয়েছে। ‘শিক্ষাবিদদের দৃষ্টিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ শীর্ষক পরিচ্ছেদটি শুধু রমেশচন্দ্র মজুমদারের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-সম্পর্কিত স্মৃতিচারণা থেকে দীর্ঘ কয়েকটি উদ্ধৃতি দিয়েই শেষ করা হয়েছে, যেখানে প্রধানত উঠে এসেছে শিক্ষকদের মধ্যে বিভাজনের কথা। ফলে এই পরিচ্ছেদ পাঠককে বিভ্রান্ত করে (পৃ. ৭০)। এই উদ্ধৃতিগুলো পূর্বোল্লিখিত বইয়েও একই ছিল, ফলে এই বইয়ে উদ্ধৃতিগুলোর অন্তর্নিহিত বক্তব্য আলাদা করে চিহ্নিত করে আরও সতর্ক ব্যবহার প্রয়োজন ছিল।

৭.

বইয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং লেখকের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো ‘কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রবক্তা’, ‘কৃষি গবেষণার পথিকৃত্’ এবং ‘চামড়াশিল্প নিয়ে গবেষণা’ আয়োজনের উদ্যোক্তা হার্টগকে আবিষ্কার। ‘বাংলার অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে’ গঠিত ‘ঢাকা টেকনিক্যাল অ্যান্ড ভোকেশনাল এডুকেশন কমিটি’র সভাপতি হিসেবে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্পের রূপকার হিসেবে তিনি পূর্ববঙ্গে অর্থকরী বিদ্যাশিক্ষার আয়োজনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পরিচ্ছেদ শিরোনামের দাবি অনুযায়ী ভেতরের আলোচনায় তথ্যগত প্রমাণ ও যুক্তির ধারাবাহিকতার বদলে মন্তব্যপ্রবণতা লক্ষ করা যায়। উপরিউক্ত বিষয়ে হার্টগের চিন্তা ও পরিকল্পনা কলকাতা ইউনিভার্সিটি কমিশন রিপোর্টের পূর্বোল্লিখিত ‘The University of Dhaka’ শীর্ষক অধ্যায়ে বলা আছে।৫৩ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হওয়ার পর সে জন্যই হার্টগকে ক্রমান্বয়ে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পদক্ষেপ হিসেবেই তিনি কৃষি, কারিগরি ও মেডিকেল শিক্ষা, চামড়াশিল্প নিয়ে গবেষণা চালু করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। বেনামে একটি উদ্ধৃতি ছাড়া কমিশন রিপোর্টের সেই অধ্যায়ের নামও উল্লেখ করেননি লেখক। পূর্ববঙ্গের পশ্চাত্পদ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের প্রতি হার্টগের সহানুভূতি ছিল। তিনি চাইতেন এই বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামিক জ্ঞানচর্চার একটি প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠুক। মুসলমান ছাত্রদের জন্য আলাদা হল প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাঁর বিশেষ উদ্যোগ ছিল, ‘মুসলিম হল সাইট কমিটি’তেও ছিলেন তিনি। সোশ্যাল সার্ভিস লীগ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সামাজিক দায়বদ্ধতার বোধ তৈরি করতে চেয়েছিলেন তিনি। চেয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ‘শিক্ষা ও গবেষণায়, পরীক্ষাগারে ও পাঠাগারে, টেনিস কোর্ট ও খেলার মাঠে’ সরব হয়ে সার্বিক শিক্ষালাভের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে উঠুক (পৃ. ৮৩-৮৭)।

এই অংশে আরও কিছু মারাত্মক ভুল পাঠকের চোখে পড়বে। একজনের উদ্ধৃতি অন্যের মুখে বসিয়ে দেওয়া, ভুল অর্থ করা কোনো কিছু বাদ যায়নি। যেমন ভুল উদ্ধৃতির একটি প্রমাণ, সরকার চায় ছাত্ররা রাজনীতি থেকে দূরে থাকুক। হার্টগ প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে গভর্নর ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য আলেকজেন্ডার বুলওয়ার লিটনের সামনেই ‘রাজনীতি আধুনিক জীবনের অংশ’ বলে স্বীকার করে বলেছেন, ‘তার অর্থ এই নয় যে আপনারা কখনো সক্রিয় রাজনীতিবিদ হবেন।’ (পৃ. ৮৭) এই কথাগুলো হার্টগের নয়, প্রথম সমাবর্তনে উপাচার্য হার্টগের বক্তব্য ছিল অতি সংক্ষিপ্ত। এক পৃষ্ঠার সেই বক্তব্যে তিনি সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক সংকটের উল্লেখ করে বক্তব্য শেষ করেন।৫৪ বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য লিটন সেদিন দীর্ঘ বক্তৃতা দিয়েছিলেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য ও আদর্শ, উচ্চশিক্ষাদর্শন সম্পর্কে অনেক অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ মন্তব্য করেন। সেই বক্তৃতাতেই তিনি বলেছিলেন, ‘...Most of you, I hope, have political ambitions and whether or not you ever become active politicians, you are probably anxious to see the development of the political consciousness of your country.’৫৫

এই উদ্ধৃতিটিরই ভুল ও মনগড়া অর্থ করে লেখক আবার লিখেছেন, ‘সক্রিয় রাজনীতি করুন আর না-ই করুন, দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে আপনাদের সচেতনতা থাকতেই হবে, আপনাদের হতে হবে রাজনৈতিকভাবে সচেতন, ‘to see the development of the political consciousness of your country.’ (পৃ. ৮৭)

একই পৃষ্ঠায় লেখক লিখেছেন, ‘হার্টগ অব্যাহতভাবে বলেছেন’, কারিগরি বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো বিষয়ে অধ্যয়ন করার উদ্দেশ্য সেই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ—ইতিহাসবিদ, বিজ্ঞানী—হিসেবে নিজেকে তৈরি করা (পৃ. ৮৭-৮৮)। এই কথাগুলোও একই ব্যক্তির। লিটনের বক্তব্যের সেই অংশটুকু ছিল এ রকম,

Now the essential difference between a University and a technical school is this, that at a University every course of study is provided and should be undertaken with the sole purpose of producing the highest standard of achievement in that branch of study. ...if you study them at a University, you should study them as if your object were to become a scholar, a historian, a mathematician, a scientist, and you should be content not with the mere standard of an examination, but with nothing less than the standard of your professors.৫৬

পরের পৃষ্ঠায় (পৃ. ৮৮) হার্টগের নামে উদ্ধৃত মন্তব্যটিও লর্ড লিটনের, যেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘situated as it in Eastern Bengal, Dacca will naturally become the chief centre of Mohamedan learning and devote special attention to higher Islamic studies.’57

৮.

১৯২৫ সালের ৩০ নভেম্বর উপাচার্য হিসেবে হার্টগের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু তাঁকে আরও এক মাস অস্থায়ী ভিত্তিতে উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে দেওয়া হয়। তাঁর সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে সম্মানজনক ডিগ্রি প্রদান করা হয়। এমনকি তাঁর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘোর বিরোধী পিপলস অ্যাসোসিয়েশনও তাঁকে আরেক মেয়াদে নিয়োগ দেওয়ার আবেদন করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেওয়ার পর হার্টগ নবগঠিত ভারতীয় পাবলিক সার্ভিস কমিশনের একজন সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তিনি কমিশনের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা পদ্ধতির মানোন্নয়ন, একাডেমিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ প্রশাসনিক কর্মকর্তা নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কমিশনের প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামোর উন্নয়নে ভূমিকা রাখেন। এ ছাড়া তিনি কমিশনের শিক্ষাসংস্কার বিষয়ক কমিটি Auxiliary Committee of the Simon Commission-এর সভাপতি হিসেবেও উপমহাদেশের শিক্ষাসংস্কারে অনন্যসাধারণ ভূমিকা পালন করেছেন। এই কমিটির উপমহাদেশের এক শ বছরের শিক্ষাব্যবস্থার অগ্রগতি পর্যালোচনা করে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার প্রস্তাব করে। ১৯৩১ সালে লন্ডন ফিরে যাওয়ার পর তিনি তাঁর পুরোনো গবেষণাকর্মে মনোনিবেশ করেন। তাঁর গবেষণার ক্ষেত্র ছিল শিক্ষা, পরীক্ষাপদ্ধতি, মাতৃভাষা শিক্ষা, ইংরেজি শিক্ষা ইত্যাদি। পরীক্ষাপদ্ধতির বিষয়ে তিনি ছিলেন জগদ্বিখ্যাত বিশেষজ্ঞ। তাঁর লিখিত ৯টি বইয়ের মধ্যে ৪টিই ছিল এই বিষয়ক। এ ছাড়া তাঁর অসংখ্য গবেষণা প্রবন্ধ, আর্টিকেল প্রকাশিত হয়েছে ইউরোপের নামীদামি পত্রিকা-সাময়িকীতে। উপমহাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে তাঁর অতীব গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো Some Aspects of Indian Education-Past and Present (Oxford University Press, 1939)। তাঁর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো Words in Action- The Teaching of the Mother Tongue for the Training of Citizens in a Democracy (University of London Press, 1947) (পৃ. ৯৯-১০৯)। তাঁর বর্তমান জীবনীকার এই গ্রন্থের নাম লিখেছেন World in Action। শুধু মুদ্রণপ্রমাদ বলে এই দায় এড়ানো যায় না। কারণ, আগের গ্রন্থেও এই বইয়ের নামে একই ভুল করা হয়েছিল।

৯.

মহান শিক্ষাবিদ হার্টগ ১৯৪৭ সালের ২৭ জুন লন্ডনে মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু তাঁর দূরদর্শী চিন্তা ও প্রশাসনিক দক্ষতার ফসল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি জনগোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্ক্ষা ও গৌরবের প্রতীক হিসেবে টিকে থাকে দীর্ঘদিন। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে অধঃপতন হয়েছে, এর একটি প্রমাণ এই বিশ্ববিদ্যালয় তার এই মহান স্থপতিকেও যোগ্য সম্মান প্রদর্শন করেনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-সম্পর্কিত এই দুটি বইয়ের লেখকের প্রধান কৃতিত্ব অপরিহার্য অথচ আকর্ষিত বিষয়ে নতুন করে আলো ফেলা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মলগ্নের একাডেমিক, প্রাতিষ্ঠানিক, অবকাঠামোগত বিকাশ, সমসাময়িক সমাজ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এর উন্মেষ ও বিকাশ এবং সুদূরপ্রসারী ভূমিকার ইঙ্গিতবাহী এই বইটি। গবেষণার অধারাবাহিকতা ও দুর্বল গ্রন্থবিন্যাস এর মানহানি করেছে বটে, তবে এদের প্রাসঙ্গিকতা প্রশ্নাতীত। এই বইয়ে এমন অনেক মন্তব্য আছে যা লেখকের বর্তমান গবেষণায় প্রমাণিত হয়নি, কিন্তু সেসব বিষয়ে গবেষণা জরুরি। সুতরাং, গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্তের জন্য না হলেও গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা-প্রকল্পের (hypothesis) জন্য সৈয়দ আবুল মকসুদ লিখিত এই দুটি বই ভবিষ্যত্ গবেষকদের জন্য হতে পারে পাথেয়।

University of Dhaka : Making, Unmaking, Remaking

Edited by Imtiaz Ahmed & Iftekhar Iqbal

Prothoma, January 2016

ওপরে আলোচিত বই দুটির প্রকল্প ছিল গৌরবময় অতীত অনুসন্ধানের মাধ্যমে বর্তমানের হতাশাজনক পরিস্থিতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া। তবে প্রধানত অতীত অনুসন্ধানেই সীমাবদ্ধ ছিল আলোচনার পরিধি। বর্তমানের অধঃপতনের কারণ কিংবা ভবিষ্যতের সমাধান ও সম্ভাবনার কথা আলোচিত হয়নি। সেই তুলনায় বর্তমান গ্রন্থটির আওতা অনেক বিস্তৃত, পদ্ধতিগতভাবে উন্নত এবং সংকলনগ্রন্থ হওয়ার সুবাদে নানামুখী দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে সমৃদ্ধ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের যৌথ উদ্যোগে ২০১৪-১৫ সালের মধ্যে অনুষ্ঠিত তিনটি এক দিনের সেমিনারে শিক্ষক-শিক্ষার্থী-একাডেমিকস পঠিত ১৪টি ইংরেজিতে লিখিত একাডেমিক প্রবন্ধের সংকলন। সম্পাদনা করেছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ এবং ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ইফতেখার ইকবাল। সম্পাদকদ্বয় বিশ্বাস করেন, ‘যদি একটি প্রজন্মের মানুষ একটি বিশ্ববিদ্যালয় “নির্মাণ” প্রক্রিয়ায় নিয়োজিত হতে পারে, আরেকটি প্রজন্ম যদি দুঃখজনকভাবে তা “অনির্মাণ” করতে পারে, তাহলে নিশ্চয় আশা থেকে যায় যে, আরেকটি প্রজন্ম তা “পুনর্নির্মাণে” নিজেদের নিয়োজিত করবে।’ (পৃ. ৯) সে জন্যই বইয়ের নামকরণ করা হয় ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: নির্মাণ, অনির্মাণ, পুনর্নির্মাণ’ (Dhaka University : Making, Unmaking, Remaking)। ভূমিকা, ইনডেক্স ও লেখক পরিচিতি নিয়ে সর্বমোট ৩৩৪ পৃষ্ঠার বইয়ের মূল অংশকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে।

১.

বইয়ের ভূমিকাটি একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রবন্ধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। বেশ বিস্তারিত এই ভূমিকায় বইয়ে উত্থাপিত প্রধান প্রধান যুক্তি ও সুপারিশের সম্যক ধারণা পাওয়া যায়। স্পেনের সর্ববৃহত্ সরকারি গবেষণা সংস্থা Consejo Superior de Investigaciones Cientificas (CSIC)-এর ২০১৫ সালে পরিচালিত একটি জরিপে দেখা যায়, পৃথিবীর ২০,০০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ২,৪৬২তম। excellence, openness, impact ও presence—এই চারটি মাপকাঠিতে র্যাঙ্কিং করা হয়েছে। excellence-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ১,৯৩১, openness-এ ৩,৪৪১, impact-এ তার অবস্থান আরও ভয়াবহ ৬,৭৬৫, শুধু presence-এ তার অবস্থান তুলনামূলকভাবে ভালো। এই দুর্গতির জন্য ‘চিন্তার দৈন্য’ বা ‘হতাশাজনক একাডেমিক দক্ষতা’কে দায়ী করা যেতে পারে। কিন্তু সম্পাদকদ্বয় মনে করেন, যে পরিস্থিতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম হয়েছে, তার সঙ্গে এর সংযোগ রয়েছে (পৃ. ১২)।

‘সম্পূর্ণ রাজনৈতিক তাড়না’ (sheer political compulsions) থেকে খুব কম বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম হয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার একটি। এর প্রথম সমাবর্তনেই গভর্নর ও প্রথম আচার্য লর্ড লিটন সুস্পষ্ট করে বলেছিলেন, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা করা হয়েছে বঙ্গভঙ্গ রদের কারণে হতাশ মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্য ‘রাজকীয় ক্ষতিপূরণ’ (Imperial compensation) হিসেবে। ফলে, অবাক হওয়ার কিছু নেই যে সময়ের বিবর্তনে বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ‘রাজনৈতিক উত্তরাধিকার’ তার একাডেমিক কার্যক্রমসহ অন্যান্য কার্যক্রমকে গুরুত্বহীন করে ফেলেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পাকিস্তান এবং পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় সম্মুখ-নেতৃত্ব দিয়েছে, ভাষা আন্দোলনের কেন্দ্র ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়, স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনও করেছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। এ রকম গৌরব পৃথিবীর আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই। এই অনন্য অর্জন যত প্রশংসনীয়ই হোক না কেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার ‘রাজনৈতিক ভিত্তি’ থেকে বের হতে পারেনি। নিজেকে একটি আন্তর্জাতিক ‘সেন্টার অব এক্সিলেন্স’ হিসেবে রূপান্তর করতে ব্যর্থ হওয়ার এটাই সবচেয়ে ‘কাঠামোগত কারণ’ (foundational or structural raison d’etre) (পৃ. ১২-১৪)।

এই হতাশাজনক পরিস্থিতির কারণ কী? লেখকদের অনুসন্ধান বিশ্লেষণ করে সম্পাদকদ্বয় আমাদের প্রধানত তিনটা কারণ জানাচ্ছেন। ‘বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের রাজনৈতিকীকরণ’, শিক্ষাকেন্দ্রিক (teaching-centric) বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করে এর শিক্ষকদের জ্ঞানের জন্য বাইরের উেসর ওপর নির্ভরশীল ও বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘মাঝারিদের স্বর্গ’ (A heaven for mediocre) বানিয়ে ফেলা এবং ওপরের দুই অবস্থার ফলাফলস্বরূপ ‘উদ্ভাবকের পরিবর্তে গণহারে দোভাষী (interpreters) উত্পাদন’। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শ বছর পূর্তিকালে পরবর্তী প্রজন্মই এই পরিস্থিতির বৈপ্লবিক পরিবর্তনে এগিয়ে আসবে বলে সম্পাদকদ্বয়ের প্রত্যাশা (পৃ. ১৪-১৬)।

২.

প্রথম অধ্যায় শুরু হয়েছে ইতিহাস বিভাগের বর্ষীয়ান অধ্যাপক আবদুল মোমিন চৌধুরীর ‘ব্যক্তিগত ভাবনা’ (personal reflections) দিয়ে। অধ্যাপক চৌধুরী ছাত্র ও শিক্ষক হিসেবে প্রায় ছয় দশক ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত। তিনি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে দেখান, আবাসিক ব্যবস্থা, টিউটোরিয়াল পদ্ধতি, শিক্ষক নিয়োগ ও শিক্ষার্থী ভর্তি, সুশাসন, গবেষণার অবনমনের মাধ্যমে কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধঃপতন হয়েছে। অধঃপতনের কারণ হিসেবে তিনি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষকদের পারস্পরিক সম্পর্কের অবনতি, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজিকে অবহেলা, নিয়ন্ত্রণের অসাধ্য শিক্ষার্থী সংখ্যা, বিপথগামী ছাত্ররাজনীতি এবং একাডেমিক কমিউনিটি হিসেবে নৈতিক অবস্থান ও যথার্থ অনুভূতির অভাবকে দায়ী করেছেন (পৃ. ৩৩-৪৮)।

‘Student Politics and youth mobilization’ শীর্ষক দ্বিতীয় অধ্যায়ে ছাত্ররাজনীতি ও তরুণদের সংগঠিতকরণ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তিনটি প্রবন্ধেই ছাত্ররাজনীতির বিবর্তন তুলে ধরা হয়েছে, তবে আলোচনা এগিয়েছে ভিন্ন ভিন্ন সম্পূরক প্রেক্ষিত (complementary perspective) বিবেচনার মাধ্যমে। সৈয়দ মনির খসরু ও মো. তাহমিদ জামি লিখিত পরিচ্ছেদে উনিশ শতকের শুরু থেকে ছাত্ররাজনীতির ইতিহাস বিশ্লেষণের পর সমসাময়িক বাস্তবতা বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়েছে কীভাবে ছাত্ররাজনীতি নিজেদের মধ্যে অন্তঃকলহে লিপ্ত হচ্ছে। দেখানো হয় যে জাতীয় রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার হাতিয়ার বানিয়ে শিক্ষার্থীদের কীভাবে অক্ষমতায়ন (disempowerment) করা হচ্ছে। কীভাবে ছাত্ররাজনীতিতে দুর্নীতি, সহিংসতা ও অসহিষ্ণুতা রাজত্ব কায়েম করেছে। বিশেষত ১৯৯০-পরবর্তী সময়ে উদ্দেশ্যহীনতা কীভাবে ছাত্ররাজনীতিকে বিপথগামী করেছে, তার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। বর্তমান বিপথগামিতা থেকে উত্তরণের উপায় হিসেবে তাঁদের প্রস্তাব হলো ছাত্ররাজনীতিকে একই সঙ্গে বিবর্তনবাদী (diachronic) ও কালানুবর্তী (synchronic) দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হবে। ছাত্ররাজনীতিকে একদিকে আমাদের সামাজিকভাবে দায়বদ্ধ ও মূল্যবোধনিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক ঐতিহ্যের প্রতি সচেতন থাকতে হবে, আবার একই সঙ্গে একুশ শতকের দাবি অনুযায়ী তার কর্মসূচি ও পরিকল্পনা ঢেলে সাজাতে হবে। ছাত্ররাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন না আনলে বাংলাদেশ তার গণতান্ত্রিক সম্ভাবনার পথ থেকে বিচ্যুত হবে (পৃ. ৪৯-৬৯)।

আনু মুহাম্মদ আরও গভীরে গিয়ে ছাত্ররাজনীতির উদ্দেশ্যহীনতার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বৃহত্তর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, ক্ষমতাসীন দলগুলো তাদের নব্য-উদারনীতিবাদী কৌশলসমূহ জারি রাখার জন্য শিক্ষার্থীদের ‘রাজনৈতিক অস্ত্র’ (political tools) হিসেবে ব্যবহার করছে, যে প্রক্রিয়াকে তিনি ‘ruling party student organization (RPSO) phenomenon’ বা ‘ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন প্রবণতা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি মনে করেন, এই RPSO প্রবণতা জমিদারি প্রথার মতো বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহের প্রাতিষ্ঠানিক ও আইনি কাঠামোকে গতিরুদ্ধ করছে। বিশ্বায়নের কালে স্বচ্ছতার প্রয়োজনীয়তা যত বেশি অনুভূত হচ্ছে, বাংলাদেশ সর্বগ্রাসী দুর্নীতির দিকে এগোচ্ছে। আশঙ্কার ব্যাপার হলো, এই প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করছে সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনে সব সময় অগ্রগামী মধ্যবিত্তরা। তবে আশার আলো হচ্ছে নির্দলীয় ছাত্ররা জচঝঙ প্রবণতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর শক্তি ও সাহস দেখিয়েছেন। ছাত্রদের এই ‘রাজনৈতিক গোষ্ঠী’ ‘সমাজের পুনরুজ্জীবনী শক্তির প্রতিনিধিত্ব’ করে বলে মনে করেন তিনি (পৃ. ৭০-৯৩)।

ফকরুল আলমের পরিচ্ছেদে ছাত্ররাজনীতির পাশাপাশি সমান গুরুত্বের সঙ্গে এসেছে শিক্ষক রাজনীতির প্রসঙ্গও। তিনি দেখান, শিক্ষক রাজনীতি ক্ষমতাপিপাসু জাতীয় রাজনীতির বর্ধিতাংশ ছাড়া আর কিছু নয়। শিক্ষকদের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষণের ফলে ধ্বংস হচ্ছে চিন্তাচর্চা, গবেষণার ধারা, বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক পরিবেশ। ছাত্ররাজনীতি ও শিক্ষক রাজনীতির সুস্থ ধারা ফিরিয়ে আনতে হলে ডাকসুর প্রতিনিধিত্বশীল প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ফিরিয়ে আনতে হবে। ছাত্ররাজনীতি ও শিক্ষক রাজনীতির বিপথগামিতার কারণ নিহিত ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আইনের অপব্যবহারের মধ্যে। আশির দশক থেকে প্রতিটি সরকার এই আইনকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে এবং এর গণতান্ত্রিক প্রতিজ্ঞাকে অবমাননা করেছে। স্বাধীনতার পর প্রবর্তিত ‘restructuring formula’ বা এক পদ থেকে অন্য পদে পদোন্নতির পদ্ধতিও এর একটা কারণ। লেখক মনে করেন, বর্তমান পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তন করতে হলে ১৯৭৩ সালের আইনের ‘চেতনা’ পুনরুদ্ধার করতে হবে। যেসব শিক্ষকের কোনো প্রকাশনা নেই কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব জার্নাল ব্যতীত অন্য কোথাও প্রকাশনা নেই, তাদের কোনোভাবেই সহকারী অধ্যাপকের বেশি পদোন্নতি না দেওয়ার নীতি গ্রহণ করতে হবে। ছাত্ররাজনীতিকে সুফলদায়ী করার জন্য ডাকসু নির্বাচন চালু করতে হবে। জ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের শর্ত অনুযায়ী শিক্ষক-ছাত্র রাজনীতির পুনর্গঠনকে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ভিশন-২০২১’ রূপকল্প হিসেবে প্রস্তাব করেন (পৃ. ৯৪-১১৪)।

৩.

‘Pedagogy and curriculum’ শীর্ষক দ্বিতীয় অধ্যায়ে কারিকুলাম ও শিক্ষণবিজ্ঞান-সম্পর্কিত বিষয়সমূহ আলোচিত হয়েছে। এই অধ্যায়ের প্রথম পরিচ্ছেদে অতনু রাব্বানি বিশ্বায়নের পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভূত বর্তমান ‘জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি’র মানদণ্ড অনুযায়ী বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা বিশেষত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন প্রচুর তথ্য-উপাত্ত ও পরিসংখ্যান ব্যবহার করে। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে তুলনামূলক আলোচনা করে তিনি দেখিয়েছেন বাংলাদেশের পরিস্থিতি হতাশাজনক। ‘বিশ্ববিদ্যালয়-যোগ্য’ শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বাড়ছে বিপুলভাবে, ‘কর্মসংস্থান-যোগ্য’ স্নাতকের সংখ্যা কমছে। তাই প্রয়োজনীয় মানবসম্পদ তৈরিতে উচ্চশিক্ষার ব্যর্থতার প্রশ্ন উঠে আসছে। এর সমাধান হিসেবে তিনি প্রশিক্ষিত শিক্ষক, উচ্চতর গবেষণা ও ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’-এর সুবিধা নিয়ে নতুন কর্মশক্তির উত্পাদন সক্ষমতার সদ্ব্যবহার করে সক্ষমতা বৃদ্ধির ওপর জোর দিয়েছেন। রাব্বানির এই ‘জোগান-চাহিদা’ দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা কর্মসংস্থানহীন স্নাতক এবং শিক্ষার্থীদের বিপথগামী ও সহিংস রাজনীতিতে যুক্ত হওয়াকেও ব্যাখ্যা করে। রিসার্চগেটের গবেষণা আউটপুট বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশের আইসিডিডিআরবির দৃষ্টান্ত দিয়ে রাব্বানি দেখান, বাংলাদেশের পরিবেশেও ফলদায়ী গবেষণা হতে পারে। উঁচু প্রবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষায় বিনিয়োগের হার বাড়েনি এবং এখনো পর্যন্ত দেশে একটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই, যার প্রধান লক্ষ্য গ্র্যাজুয়েট রিসার্চ প্রোগ্রাম। রাব্বানি মনে করেন, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে গঠিত ‘কনসোর্টিয়াম’ হতে পারে উদ্ভাবনের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র (পৃ. ১১৫-১৩৮)।

মোহাম্মদ তানজিমউদ্দিন খান লিবারেল আর্টস ও সমাজবিজ্ঞান কারিকুলামের প্রাসঙ্গিকীকরণ (contexualization) চেয়েছেন শিক্ষা ও শিক্ষাদানের দৃষ্টিকোণ থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের কারিকুলাম বিশ্লেষণ করে এবং নিজের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি দেখিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনিক কাঠামোতে বিভাগের (department) তুলনামূলক স্বশাসনকে অপব্যবহার করে ‘ব্যক্তিস্বার্থ, কনসালটেন্সি অগ্রাধিকার, ফ্যাকাল্টি মেম্বারদের কায়েমি স্বার্থ’ সংরক্ষণের স্বার্থে কীভাবে কারিকুলাম ও কোর্স আউটলাইন তৈরি করা হচ্ছে। খান মনে করেন, ১৯৭৩ সালের আইনে উচ্চশিক্ষার কোনো সুনির্দিষ্ট শিক্ষা ও শিক্ষাদানসংক্রান্ত লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়নি এবং এই আইনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ক্ষেত্রে অনেক ঔপনিবেশিক কাঠামো রয়ে গেছে। উপরিউক্ত পরিস্থিতির জন্য তিনি এই আইন এবং আনু মুহাম্মদের মতো নব্য-উদারনীতিবাদী ব্যবস্থাকে দায়ী করেন (পৃ. ১৬৮-১৮০)।

মোহাম্মদ আবুল কাওসার কলা ও মানববিদ্যা কারিকুলাম প্রাসঙ্গিকীকরণ বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি ইতিহাস বিভাগকে কেস স্টাডি হিসেবে নিয়েছেন এবং আলোচনার ক্ষেত্রে প্রধানত বার্নেটের কারিকুলাম তত্ত্বের ওপর নির্ভর করেছেন। শিক্ষকদের সাক্ষাত্কারে প্রাপ্ত তথ্যের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ ও সক্ষমতা, চাকরির বাজার, শিক্ষাদানকারী প্রতিষ্ঠানের স্থানিক অবস্থান, বিভাগের অবকাঠামো ইত্যাদি মাপকাঠি ব্যবহার করে ইতিহাস বিভাগের কারিকুলামের কার্যকারিতা ও প্রায়োগিকতা বিশ্লেষণ করছেন। শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের আগ্রহ অনুযায়ী তাঁদের কোর্স সাজান, তবে কারিকুলাম নির্ধারণে কখনো তাঁদের যুক্ত করা হয় না। অনেক শিক্ষক শিক্ষার্থীদের চাকরির বাজারোপযোগী করে তোলার জন্য নতুন কোর্স চালু করেন। যেমন ইতিহাস বিভাগে ‘জেন্ডার স্টাডিজ’ খোলা হয়েছে, কারণ তার ফলে এনজিওগুলো শিক্ষার্থীদের নিয়োগ দিতে আগ্রহী হবে। এই বিভাগের কারিকুলামে স্থানীয় ইতিহাসকে মোটামুটি গুরুত্ব দেওয়া হয়। শিক্ষকদের পাঠদানপদ্ধতি অনেক ক্ষেত্রে ক্লাসের সাইজ দ্বারা নির্ধারিত হয়। সাধারণত ক্লাসের সাইজ বড় হওয়ায় শিক্ষাদান পদ্ধতি ‘ইন্সস্ট্রাক্টর-ফোকাসড’, ‘ইন্টারেক্টিভ’ নয়। কাওসার দেখান, প্রচলিত শিক্ষাদান পদ্ধতি ছাত্রদের স্বাধীন চিন্তা করতে উত্সাহিত করে না। শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের পছন্দ ও সক্ষমতা অনুযায়ী কোর্স নির্ধারণ করেন বলে দাবি করেছেন, কিন্তু সত্য হলো এই ব্যাপারে শিক্ষার্থীদের মতামত গ্রহণের কোনো ব্যবস্থা নেই। বাজারের চাহিদা আছে বলে যেসব নতুন কোর্স চালু করা হয়, তাও শিক্ষকদের ব্যক্তিগত ধারণাভিত্তিক। চাকরিদাতাদের পরামর্শ নিয়ে তাঁরা এসব উদ্যোগ গ্রহণ করেন না। এই অনুসন্ধানের ওপর নির্ভর করে তিনি সামগ্রিকভাবে কলা ও মানবিদ্যাভুক্ত বিভাগসমূহের কারিকুলাম পুনর্গঠনের প্রস্তাব করেন। তাঁর একটি ঢালাও প্রস্তাব হলো আরও বেশি বেশি কোর্স ইংরেজিতে চালু করলে শিক্ষার্থীরা বাজারের জন্য অধিকতর উপযুক্ত হবে (পৃ. ১৩৯-১৬০)।

ইন্টারনেটের যুগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সক্ষমতা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আতিক রহমান তাঁর প্রবন্ধে দেখিয়েছেন, অনলাইন ভর্তি পরীক্ষা, মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ, ডিজিটাল জার্নাল, রেফারেন্স তথ্যভান্ডার ইত্যাদি উদ্যোগ গ্রহণ করলেও ইন্টারনেট যুগের উচ্চশিক্ষা অবকাঠামোতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখনো পশ্চাদ্গামী। রহমান মনে করেন, যুগোপযোগী উদ্যোগ গ্রহণ করে শিক্ষার্থীদের ‘ডিজিটালি ইনফর্মড সিটিজেন’ হিসেবে তৈরি করতে হবে (পৃ. ১৮১-২০০)।

৪.

‘Campus life’ শীর্ষক পরবর্তী অধ্যায়ে এসেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের সামাজিক জীবনের বিভিন্ন দিক। এ এস এম আলী আশরাফ দেখিয়েছেন, দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের মেরুকরণের রাজনীতির ফলে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিকীকরণ’ হয়েছে। ইমতিয়াজ আহমেদ উদ্ভাবিত একটি শব্দ ব্যবহার করে তিনি দেখিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিকসদের বদলে কীভাবে ক্ষমতাসীন দলের অনুগামী ‘পার্টি-ডেমিকস’দের আধিপত্য চলছে। এই পার্টি-ডেমিকসরা ক্যাম্পাস জীবনের সর্বত্র তাঁদের গোষ্ঠীস্বার্থে প্রভাব বিস্তার করছেন। তবে তিনিও নির্দলীয় শিক্ষার্থীদের কার্যক্রমকে ‘আশার মরূদ্যান’ হিসেবে দেখতে চান। উন্নততর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য তাঁর সুপারিশ হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাঠামোর বিরাজনৈতিকীকরণ, প্রক্টর অফিসের সংস্কার, উন্নত দেশের মতো ক্যাম্পাস পুলিশ চালু করা এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে নেতৃত্বের যোগ্যতার বিকাশ এবং শিক্ষকদের গবেষণার জন্য বিনিয়োগ করা (পৃ. ২০১-২৩১)।

মো. রেজওয়ানুল হক ও মোহাম্মদ তানজিমউদ্দিন খান ক্যাম্পাস জীবনকে গুরুতরভাবে প্রভাবিত করছে এমন কিছু দিকে আলো ফেলেছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক প্রতিবেদন, আইন ইত্যাদির পাশাপাশি কয়েকটি কেস স্টাডির ওপর আলোচনা করেছেন। আবাসিক হলের কাঠামোগত ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা বিশ্লেষণ করে তাঁরা বিভিন্ন হলের ছাত্রদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন এবং কিছু গুরুতর আশঙ্কার জায়গা তুলে ধরেছেন। হলের অবকাঠামো, আবাসন, খাবার, একাডেমিক পরিবেশ, এক্সট্রাকারিকুলার কার্যক্রম এবং হলের প্রভোস্ট ও টিউটরদের ভূমিকা এবং হলের ছাত্ররাজনীতি ইত্যাদি। তাঁরা কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করেছেন (পৃ. ২৩১-২৫৫)। উল্লেখ্য, পরিচ্ছেদের শুরুতে তাঁরা দাবি করেছেন, ‘এই ধরনের কাজ এটাই প্রথম।’ তাঁদের এই দাবি আংশিক সত্য। ১৯৫৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের উদ্যোগে পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষক ও ১৯৭১ সালে শহীদ ড. মনিরুজ্জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের আর্থসামাজিক পটভূমি, বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও সামাজিক পরিবেশ ইত্যাদি অনুসন্ধান করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছিলেন।৫৮ শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে তাঁর নাম উচ্চারিত হয়, কিন্তু তাঁর গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদনটি নিয়ে কোনো আলোচনা নেই।

লাইলুফার ইয়াসমিন একটি সাংস্কৃতিক সমীক্ষা করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিশেষত ছাত্রীদের পোশাক বিশ্লেষণ করে তিনি বাঙালি ও মুসলিম পরিচয়ের দ্বন্দ্ব বিশ্লেষণের প্রয়াস পেয়েছেন। বিশ্বায়ন কীভাবে তরুণদের এই আত্মপরিচয়-সংকটকে আরও জটিল করে তুলছে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস তাতে কী ভূমিকা রাখছে তা অনুসন্ধান করে তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, ‘মুসলিম ও বাঙালি এখন আর পরস্পর সাংঘর্ষিক সত্তা নয়।’ (পৃ. ২৫৬-২৭২)

৫.

‘Governanace, politics and higher education’ শীর্ষক সর্বশেষ অধ্যায়ে ঐতিহাসিক ও সমসাময়িক কালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও এর রাজনৈতিকীকরণ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষায় দুর্নীতিবিষয়ক গবেষণার পথিকৃত্। মূলত তাঁর পূর্ব গবেষণার হালনাগাদ ও সংক্ষিপ্ত ভাষ্য বর্তমান প্রবন্ধে উঠে এসেছে।৫৯ ভর্তি-প্রক্রিয়া, উপাচার্য ও অন্যান্য শিক্ষক এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতির ধরন ও কারণ অনুসন্ধান করে তিনি দেখিয়েছেন শুধু আর্থিক দুর্নীতি নয়, patron-clientelism-এর রাজনৈতিক প্রক্রিয়া কীভাবে ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশে প্রদত্ত প্রশাসনের মৌলিক কাঠামোকে লঙ্ঘন করছে। কোনো কোনো আঞ্চলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের রাজনীতি না করার শপথ করিয়ে ভর্তি করাচ্ছে—এ রকম কিছু ইতিবাচক দিকও তিনি তুলে ধরেন (পৃ. ২৭৩-২৯৭)।

ঔপনিবেশিক কালের হেজিমনিক জ্ঞানকাঠামো এখনো আমাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক এলিটদের আচ্ছন্ন করে রেখেছে দাবি করে আমেনা মহসিন বলেন, ‘আমরা এখনো বুদ্ধিবৃত্তিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে উপনিবেশিত’ হয়ে আছি। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে রাজনৈতিকীকরণের প্রক্রিয়ার বিশ্লেষণ করেছেন বিশ্লেষণমূলক দৃষ্টিকোণ থেকে। তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে বিভিন্ন আইন-অধ্যাদেশের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি ‘রাজনৈতিক বিশ্ববিদ্যালয়’ করে রাখা হয়েছে। স্বাধীনতার পরও আমরা এই প্রক্রিয়া থেকে বের না হতে পারার ব্যর্থতাকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতার চেতনা কী ছিল, আর আমরা কী থেকে নিজেদের মুক্ত করেছি?’ তিনি মনে করেন, একাডেমিক উত্কর্ষ বিসর্জন দিয়ে জাতীয় রাজনীতির লেজুড়ভিত্তিক ছাত্ররাজনীতির ‘গৌরব’-এর ‘metanarrative’ থেকে আমাদের বেরিয়ে আসার সময় এসেছে। উপাচার্যসহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধা ও যোগ্যতাকেই প্রধান মাপকাঠি করা উচিত (পৃ. ২৯৮-৩১২)।

সর্বশেষ অধ্যায়ে ইফতেখার ইকবাল উচ্চশিক্ষা ও উচ্চতর গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে দৃঢ়মূল যাত্রা তা স্মরণ করে ভবিষ্যত্ নির্দেশের চেষ্টা করেছেন। উচ্চ পাণ্ডিত্যের অধিকারী শিক্ষক নিয়োগ, তুলনামূলক উন্নত বেতনকাঠামো, ফেলোশিপ ও এক্সচেঞ্জ ভিজিটের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক স্কলারলি নেটওয়ার্ক তৈরির মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার প্রথম যুগে শুধু দক্ষিণ এশিয়ায় নয়, বৈশ্বিক প্রেক্ষিতেই তার অবস্থান ঘোষণা করতে সক্ষম হয়েছিল। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তুলনা না করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক সত্তার সঙ্গে তুলনা করে দেখিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অতীত ইতিহাসের মধ্যেই তার অর্থপূর্ণ সংস্কারের প্রধান বিষয়গুলো খুঁজে পাওয়া যাবে (পৃ. ৩১৩-৩২৮)।

বাংলাদেশের উন্নয়ন বাজেট বাড়ছে, কিন্তু শিক্ষায় বিনিয়োগ কমছে। সামগ্রিক শিক্ষা বাজেটে উচ্চশিক্ষার জন্য বরাদ্দ ১ শতাংশেরও কম। অথচ এশিয়ার অন্যান্য দেশ চীনে তা ৬০ শতাংশ, ভারত, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ায় ৩৭-৩৮ শতাংশ। চীন শক্তিশালী অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হয়েছে শুধু তার দ্বৈত অর্থনীতির জন্য নয়, উচ্চশিক্ষায় অগ্রাধিকারের বদৌলতেও। এমডিজি-উত্তর পৃথিবীতে ‘জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি’ তৈরি করতে হলে এখন আর প্রাথমিক শিক্ষায় সাফল্য অর্জনই যথেষ্ট নয়, উচ্চশিক্ষায় প্রচুর বিনিয়োগ করা দরকার। এ জন্য বিভিন্ন উত্স থেকে সম্পদ বরাদ্দ করতে হবে। এ রকম একটি উপায় হলো ‘কালোটাকা’, যা বাংলাদেশের অর্থনীতির ৪০-৫০%, তা ‘সাদা’ করে আবাসন খাত এবং স্টক মার্কেটে বিনিয়োগ করা গেলে তার একটা বড় অংশ উচ্চশিক্ষা খাতে ব্যয় করার মাধ্যমে বৈধ করার বিধান সরকার করতে পারে।

উচ্চশিক্ষাব্যবস্থাকে কার্যকর ও ফলপ্রসূ করার জন্য প্রয়োজন স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন রূপকল্প নির্ধারণ করা। এ রকম লক্ষ্য না থাকায় বিশ্বব্যাংকের বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সঙ্গে নেওয়া প্রকল্পগুলো বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের অবস্থানের উন্নতি করতে প্রায় কোনো লক্ষণীয় প্রভাব ফেলতে ব্যর্থ হয়েছে। গবেষণার মান মূল্যায়নের জন্য যুক্তরাজ্যের REF (Research Excellence Framework) মডেল গ্রহণ করা যেতে পারে। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি আরও সুসংগঠিত সরকারি সংস্থা থাকা উচিত, যাতে ব্যক্তি-গবেষকেরা অর্থায়ন পেতে পারেন সহজে। গবেষণা-পৃষ্ঠপোষণের লক্ষ্যে এ রকম সংস্থার উদ্যোগে হতে পারে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যত্ নির্ভর করছে উচ্চশিক্ষা খাতে ইতিবাচক নীতিনির্ধারণী দৃষ্টিভঙ্গি এবং বৃহত্তর সম্পদ বরাদ্দের ওপর। রাজনৈতিক মতৈক্য থাকলে কীভাবে দ্রুততর সময়ে একটি বিশ্ববিদ্যালয় উন্নতি করতে পারে তার উদাহরণ কলকাতার প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি ব্রুনেই দারুসসালাম, রাসেল গ্রুপ ও আইভি লিগ প্রতিষ্ঠানসমূহ। এ রকম অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ উঠে এসেছে এই সংকলনের গবেষকদের কাছ থেকে। তবে এটি সংকলনগ্রন্থ হওয়ায় সমস্যা নিরূপণ ও সমাধান প্রস্তাবের ক্ষেত্রে অসামঞ্জস্য রয়ে গিয়েছে। তাই সুপারিশগুলো আমাদের কোনো সুনির্দিষ্ট গন্তব্যে নিয়ে যায় না। বিশেষত কোনো গবেষক বাজার অর্থনীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার সুপারিশ করেছেন, কেউ আবার সব সমস্যার মূল দেখেছেন নব্য উদারনীতিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আগেকার কিছু গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা অনালোচিত থেকে গেছে। দেশভাগের ফলে পরিবর্তিত আর্থসামাজিক কাঠামোতেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম গুরুতর সংকটের মুখে পড়েছিল। সেই সংকট চিহ্নিত করার লক্ষ্যেই মুনিরুজ্জামানের পূর্বোক্ত প্রতিবেদন প্রণীত হয়েছিল। দর্শন ও মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক গোলাম জিলানী করেছিলেন কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা।৬০ এই গবেষণাগুলো পর্যালোচনা করলে সমস্যা নিরূপণের কাজটা আরও সহজ হতো, সুপারিশগুলো হতে পারত আরও লক্ষ্যভেদী। তবু শতবর্ষপূর্তির প্রাক্কালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘পুনর্নির্মাণের’ কাজ যে শুরু হয়েছে, তার প্রমাণ এই গ্রন্থ। কারণ, পুনর্নির্মাণের পথে অপরিহার্য প্রথম পদক্ষেপ হতে হবে এই বিষয়ে বিপুল ও বিস্তৃততর গবেষণা।

তথ্যসূত্র

১.         M.A. Rahim, The History of the University of Dacca, University of Dacca, 1981

২.         Serajul Islam Choudhury (ed.), Dhaka University : Convocation Speeches, University of Dhaka, 2 Vol, 1988

৩.        দি ইউনিভার্সেল একাডেমি, ঢাকা, ডিসেম্বর ২০১৩

৪.         দি ইউনিভার্সেল একাডেমি, ঢাকা, ২০১৫

৫.         কল্যাণ প্রকাশন, ঢাকা, ২০০০

৬.        কল্যাণ প্রকাশন, ঢাকা, ২০০৪

৭.         নওয়াব সলীমুল্লাহ: জীবন ও কর্ম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১৯৮৬; নওয়াব আলী চৌধুরী: জীবন ও কর্ম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১৯৮৭

৮.        ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: স্মৃতি নিদর্শন, শস্যপর্ব, ঢাকা, ২০১১

৯.         রঙ্গলাল সেন, বাংলাদেশ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শিখা প্রকাশনী, ঢাকা, ২০০৩; রফিকুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশি বছর, অনন্যা, ঢাকা, ২০০৩

১০.       রতন লাল চক্রবর্ত্তীর পূর্বোক্ত বইটি এ ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তস্থানীয়। এ ছাড়া রয়েছে মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ইতিহাস, বিজয় প্রকাশ, ২০০৬

১১.       সৈয়দ রেজাউর রহমান, গৌরবোজ্জ্বল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মউর, ঢাকা, ২০০১

১২.       এই বিষয়ে লিখিত এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ হলো Zillur Rahman Siddiqui, Visions and Revisions : Higher Education in Bangladesh 1947-1992, UPL, 1997

১৩.      ড. মুহাম্মদ আবদুল্লাহ, নওয়াব সলীমুল্লাহ: জীবন ও কর্ম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১৯৮৬, পৃ. ১৫১-১৬৬; নওয়াব আলী চৌধুরী: জীবন ও কর্ম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১৯৮৭, পৃ. ১২৭-১৩৮

১৪.       Sufia Ahmed, ‘Nawab Khwaja Salimullah’, Journal of The Asiatic Society, Dacca, Vol. xxi, No. 3, December 1976, p. 169; উদ্ধৃত: ড. মুহাম্মদ আবদুল্লাহ, ১৯৮৬, পৃ. ১৫৫

১৫.       M.A. Rahim, ibid, p.5

১৬.      ড. মুহাম্মদ আবদুুল্লাহ, ওই

১৭.       ড. মুহাম্মদ আবদুল্লাহ, ১৯৮৬ , পৃ. ১৫৯-১৬০

১৮.      গোলাম মুরশিদ, রবীন্দ্রবিশ্বে পূর্ববঙ্গ পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্রনাথ, বাংলা একাডেমি, ১৯৮১, পৃ. ৬৪

১৯.      ভূঁইয়া ইকবাল, রবীন্দ্রনাথ ও মুসলমান সমাজ, প্রথমা, ২০১০, পৃ. ১৫২

২০.       সত্যেন্দ্রনাথ রায় (সম্পা), রবীন্দ্রনাথের চিন্তাজগত্, শিক্ষা চিন্তা, রবীন্দ্ররচনা সংকলন, পৃ. ১২৬,

২১.       ড. মুহাম্মদ আবদুল্লাহ, ওই, পৃ. ১৫৯-১৬০

২২.       রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাচিন্তা সম্পর্কে ধারণার জন্য দেখুন, সত্যেন্দ্রনাথ রায় (সম্পা), পূর্বোক্ত

২৩.      গোলাম মুরশিদ, ওই

২৪.       রতন লাল চক্রবর্ত্তী, ২০০২, পৃ. ৬৬

২৫.       Naomi Levine; ‘Introduction: Who Was Edwin S. Montagu’, Politics, Religion and Love : The Story of H.H. Asquith, Venetia Stanley and Edwin Montagu, based on the Life and Letters of Edwin Samuel Montagu, New York University Press, 1991, p. 4

২৬.      Denis Judd; Lord Reading: Rufus Isaacs, First Marquess of Reading, Lord Chief Justice viceroy of India 1860-1935, Faber & Faber, 1982.

২৭.       ড. মুহাম্মদ আবদুল্লাহ, ১৯৮৭, পৃ. ১৩০

২৮.      বাংলায় বিচ্ছিন্নতাবাদের নানা মাত্রা এবং এর উন্মেষে হিন্দু-মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের দায় নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন অমলেন্দু দে। দেখুন, বাঙালী বুদ্ধিজীবী ও বিচ্ছিন্নতাবাদ, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, ১৯৮৭

২৯.       ড. মুহাম্মদ আবদুল্লাহ, ১৯৮৬

৩০.      ভূমি সংস্কার বোর্ড, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার http://www.lrb.gov.bd/site/ page/9d7fa745-118e-41a5-96fd-7dd545d915c3)

৩১.      সরদার ফজলুল করিম (সম্পাদিত), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ববঙ্গীয় সমাজ, সাহিত্য প্রকাশ, দ্বিতীয় মুদ্রণ ২০০০, পৃ. ১৭

৩২.      রতন লাল চক্রবর্ত্তী, ২০০২, পৃ. ৮২-৮৬

৩৩.      অমূল্যভূষণ সেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলার বিপ্লব সাধনা’, রঙ্গলাল সেন ও অন্যান্য (সম্পা.), বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ: ঢাকা ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান, ইউপিএল, ২০০৯, পৃ. ২২

৩৪.      রতন লাল, ২০০২ , পৃ. ৬৪

৩৫.      ড. মোহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস ১৮৩০-১৯৭১, আগামী প্রকাশনী, তৃতীয় মুদ্রণ ২০০৬, পৃ. ৪৪-৪৯

৩৬.     তাঁর রাজনৈতিক উত্থানের একটি ভাষ্য এবং তখনকার মুসলমান ছাত্রদের রাজনৈতিক মানসের পরিচয় পাওয়া যাবে অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের সাক্ষাত্কারে। দেখুন, সরদার ফজলুল করিম (সম্পাদিত), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ববঙ্গীয় সমাজ, সাহিত্য প্রকাশ, দ্বিতীয় প্রকাশ ২০০০, পৃ. ৬১-৬৫; আবু আল সাইদ, ফজলুর রহমান: অনুদার ইতিহাসের এক দশক ১৯৩৭-৪৭, আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৭। এই বইয়ে ফজলুর রহমানের রাজনৈতিক জীবন ও সমসাময়িক রাজনৈতিক ইতিহাসের বিবরণ পাওয়া যাবে।

৩৭.      বদরুদ্দীন উমর, পূর্ব বাঙালার ভাষা আন্দোলন ও তত্কালীন রাজনীতি, প্রথম খণ্ড, মাওলা ব্রাদার্স, ১৯৭০, পৃ. ২৫৬-২৭৩

৩৮.     বদরুদ্দীন উমর, পূর্ব বাঙালার ভাষা আন্দোলন ও তত্কালীন রাজনীতি, তৃতীয় খণ্ড, জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন, ১৯৯৫, পৃ. ২৫০-৫১

৩৯.      দীপঙ্কর মোহান্ত, লীলা নাগ, বাংলা একাডেমি (জীবনী গ্রন্থমালা), ১৯৯৯; অজয় রায় ও অন্যান্য (সম্পাদিত), লীলা নাগ শতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি, সাহিত্য প্রকাশ, জানুয়ারি ২০০৩

৪০.       দেখুন, বাংলাপিডিয়া (২০১১), খণ্ড-১৪, পৃ. ৩৪২

৪১.       Syed Murtaza Ali, Personality Profiles, National Institute of Profiles Administration, Dacca, 1965

৪২.       শামসুজ্জামান খান, সেলিনা হোসেন ও অন্যান্য (সম্পাদিত), বাংলা একাডেমি চরিতাভিধান, পরিবর্ধিত তৃতীয় সংস্করণ, ২০১১

৪৩.      W. Adams, Third Report on the State of Education in Bengal-এর প্রকাশকাল এক শ বছর এগিয়ে লেখা হয়েছে ১৯৩৮, যা হবে ১৮৩৮। দুটি বইতেই এই একই ভুল তথ্য ছাপা হয়েছে।

৪৪.       Mabel Hartog, P. J. Hartog : A Memoir by his Wife, Constable, London, 1949, p. 4

৪৫.       Mabel Hartog, ibid, pp. 7-8

৪৬.      Mabel Hartog, ibid, pp. 11-23

৪৭.       লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে হার্টগের দায়িত্ব এবং তাঁর কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানতে দেখুন, Mabel Hartog, ibid, pp.45-64

৪৮.      SOAS প্রতিষ্ঠার জন্য হার্টগকে তখনকার লন্ডনের এসটাবলিশমেন্টের বিরুদ্ধে কী সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হয়েছিল তা জানতে দেখুন, Mabel Hartog, ibid, pp. 65-84। বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে SOAS-এর অবদান অতুলনীয়। এখান থেকে পিএইচডি করেছেন রফিউদ্দিন আহমেদ, সুফিয়া আহমেদ, আবদুল করিম, এম এ রহিম, এ আর মল্লিক, এ এফ সালাহউদ্দিন আহমেদ, সিরাজুল ইসলাম, ওয়াকিল আহমেদ, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম প্রমুখ বাংলাদেশি পণ্ডিত। এই কারণেও হার্টগের প্রতি এই জাতির কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত।

৪৯.      Hundred Years of History of University of Calcutta, 1957, p. 263, cited by M.A. Rahim, p. 10

৫০.       Mabel Hartog, ibid, p. 80

৫১.       Calcutta University Commission, 1917-19, Report Vol. 1, Part-2, 1919, pp. 121-242

৫২.       Mabel Hartog, ibid, p. 87

৫৩.      Calcutta University Commission, 1917-19, Report Vol. 1, Part-2, 1919, pp. 185-190

৫৪.       Serajul Islam (ed.). Dhaka University: Convocation Speeches, University of Dhaka, 1988, Vol.1. p. 30

৫৫.       Serajul Islam Choudhury, ibid, pp. 28-29

৫৬.      Serajul Islam Choudhury, ibid, p. 28

৫৭.       Serajul Islam Choudhury, ibid, p. 26

৫৮.      A. N. M. Muniruzzaman, The Living & Working Conditions of Students of the University and Colleges of Dacca, 1957: A Sample Survey, Department of Statistics, University of Dacca.

৫৯.      মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্নীতি: প্রকৃতি ও প্রতিকার, টিআইবি ও এ এইচ ডেভেলপমেন্ট পাবলিশিং হাউস, ২০০৮

৬০.      দেখুন, Ghulam Jilani, Teacher-Student Relationships at The Dacca University, University of Dacca, 1961; Ghulam Jilani and B. M. Omar, An Inquiry into the Factors Influencing the Academic Atmosphere of the Dacca University, Pakistan Institute of Human Relations, Publications No.1, Department of Philosophy, University of Dacca,1956