সম্পাদকীয়

যেকোনো কার্যকর গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সিভিল সমাজ একটি অবিচ্ছেদ্য উপাদান। পৃথিবীতে যে কয়টি রাষ্ট্রে গণতন্ত্র আজ প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে, সে সব কটি রাষ্ট্রে গণতন্ত্র এবং ন্যায়ের শাসনকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে সিভিল সমাজ প্রতিষ্ঠানগুলো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। এই যুক্তির রেশ ধরেই গণতন্ত্রকামী রাষ্ট্রগুলোতে সিভিল সমাজ সংগঠনগুলোর উত্পত্তি, বিকাশ, কার্যক্রম এবং ভবিষ্যত্ নিয়ে আলোচনা অব্যাহত আছে।

সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশে সিভিল সমাজ সম্পর্কে সরকারের বৈরী মনোভাব প্রতিফলিত হয়। সিভিল সমাজকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে। আবার সিভিল সমাজ তার যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পেরেছে, এমনটাও বলা যাবে না। কিন্তু রাষ্ট্রের সঙ্গে সিভিল সমাজের এমন সম্পর্ক কার্যকর গণতন্ত্র নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা। রাষ্ট্র ও বাজার—এই দুটি উপাদানের মধ্যে সিভিল সমাজের যে ভূমিকা রাখার কথা, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সিভিল সমাজ তা কতটুকু করতে পেরেছে তা গঠনমূলক সমালোচনার মাধ্যমে মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। স্বাধীনতার এত বছর পরও বাংলাদেশ কার্যকর গণতন্ত্রে পৌঁছাতে পারল না। এই প্রেক্ষাপট বিবেচনায় অন্যান্য উপাদানের মতো সিভিল সমাজের ভূমিকারও মূল্যায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় প্রতিচিন্তার এই সংখ্যায় আমরা বাংলাদেশে সিভিল সমাজ সংগঠনগুলোর বিকাশ, কার্যক্রম এবং ভবিষ্যেকন্দ্রিক আলোচনায় সচেষ্ট হয়েছি।

প্রথম প্রবন্ধটি লিখেছেন আকবর আলি খান। প্রবন্ধের শিরোনাম ‘বাংলাদেশে সিভিল সমাজ: সুশীল না দুঃশীল?’ প্রবন্ধটি লেখকের সম্প্রতি প্রথমা প্রকাশন হতে প্রকাশিত বই অবাক বাংলাদেশ: বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি (২০১৭) থেকে নেওয়া হয়েছে। যারা বইটি পড়েননি তাঁদের আগ্রহী করতে এই গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধটি ছাপা হল। এই প্রবন্ধের শুরুতে লেখক সিভিল সমাজের সংজ্ঞা এবং তাত্ত্বিক দিকগুলো আলোচনা করেছেন। এরপর লেখক বাংলাদেশে সিভিল সমাজের ভূমিকা বিশ্লেষণ করেছেন। লেখকের মতে, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সিভিল সমাজ সংগঠনের মতো সংগঠন ঠিকই আছে, কিন্তু এসব রাষ্ট্রে তা একটি ধারণামাত্র। সিভিল সমাজ সংগঠনগুলো তাদের কাছে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশিত ভূমিকা পালন করতে পারে না। বিদেশি অর্থের ওপর নির্ভরশীলতা সিভিল সমাজের যথাযথ ভূমিকা পালনে বাধা হিসেবে কাজ করে। অন্যদিকে, সিভিল সমাজ সংগঠনগুলো রাজনৈতিক সংগঠনের বিকল্প হতে পারে কি না, লেখক সেই প্রশ্নও তুলেছেন। লেখকের মতে, সিভিল সমাজ কখনোই রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর বিকল্প হতে পারে না। গণতান্ত্রিক এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হলে সিভিল সমাজ সংগঠন এবং রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকে পরস্পরের বিরোধী নয়, বরং সম্পূরক শক্তি হিসেবে কাজ করতে হবে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার যৌক্তিকতা তুলে ধরার ক্ষেত্রে ‘দুই অর্থনীতি’ তত্ত্বের গুরুত্ব সম্পর্কে আমরা সবাই অবগত আছি। এই তত্ত্বপ্রণেতাদের অন্যতম হলেন অর্থনীতিবিদ নুরুল ইসলাম। তিনি দীর্ঘকাল ধরে কাজ করেছেন বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থায়। কাজ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পাকিস্তান উন্নয়ন অর্থনীতি প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান, পরিকল্পনা কমিশন এবং জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থায়। বর্তমানে তিনি ওয়াশিংটনভিত্তিক আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ইমেরিটাস ফেলো। এই দীর্ঘ কর্মময় জীবনে নানা প্রতিষ্ঠানের কাজের ধরন, রাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্পর্ক, আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলোর নীতি ও ভূমিকা তিনি সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছেন। তাঁর এই বৈচিত্র্যময় কাজের অভিজ্ঞতার বর্ণনায় সিভিল সমাজ প্রতিষ্ঠানগুলোর বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে। প্রতিচিন্তার বর্তমান সংখ্যায় প্রবন্ধটির শিরোনাম ‘আমার অর্থনীতিবিদ হয়ে ওঠা’। মূল প্রবন্ধটি বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জার্নালে ইংরেজিতে ছাপা হয়েছিল। প্রতিচিন্তার উপদেষ্টা পর্ষদের সদস্য প্রবীণ এই অর্থনীতিবিদের পেশাজীবনের গুরুত্ব অনুধাবনপূর্বক আমরা এই লেখাটি প্রতিচিন্তার পাঠকদের জন্য ছেপেছি।

জাতিগঠন, তার বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ, মানবসম্পদ উন্নয়ন, গবেষণা এবং রুচি তৈরিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভূমিকা ঐতিহাসিকভাবেই সত্য। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিভিন্ন জাতির ইতিহাস নির্মাণে আঁতুড়ঘরের কাজ করেছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কথাগুলো একটা সময় পর্যন্ত নিশ্চিতভাবেই সত্য ছিল। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের আগে পর্যন্ত প্রায় সব জাতীয় আন্দোলনে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নেতৃত্বের জোগান দিয়েছিল, সরবরাহ করেছিল বুদ্ধিবৃত্তিক মালমসলা। একইভাবে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন বা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে সংগঠিত আন্দোলনগুলোতেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভূমিকা ছিল চোখে পড়ার মতো। কিন্তু একটা সময়ে এসে আমাদের গোটা শিক্ষাব্যবস্থার মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠা শুরু করল এবং এই আলোচনা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হালহকিকতও বাদ পড়ল না। বিশেষত গবেষণার ক্ষেত্রে অবদান এবং সিভিল সমাজ প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেহাল দশা আজ সর্বজনবিদিত। এই পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে যে নিয়ামকগুলো কাজ করেছে, সেগুলো উদ্ঘাটন করা না গেলে এই পরিস্থিতি থেকে নিস্তার পাওয়ার পথ প্রায় রুদ্ধ।

এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিচিন্তার এই সংখ্যায় বিশ্ববিদ্যালয় এবং সামগ্রিকভাবে সিভিল সমাজ প্রতিষ্ঠানগুলোর উত্পত্তি, বিকাশ, গবেষণা, নীতি প্রণয়নে এগুলোর প্রভাব ইত্যাদি বিষয় নিয়ে দুটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হলো। প্রথম প্রবন্ধটির শিরোনাম ‘বাংলাদেশে জ্ঞান উত্পাদন: সিভিল সমাজের কতিপয় সমস্যা’। মূল প্রবন্ধটির লেখক ম্যাথিল্ড ম্যাইটরট। এই প্রবন্ধে লেখক বাংলাদেশে নীতি প্রণয়ন এবং জ্ঞান উত্পাদন ও বিতরণের একটি প্রাতিষ্ঠানিক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ হাজির করেছেন। লেখকের মতে, অভ্যন্তরীণ আর্থিক সম্পদের ঘাটতি এবং থিংক ট্যাংক ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার ফলে সেগুলোর বিদ্যায়তনিক স্বাধীনতা দুর্বল হয়ে পড়ছে।

এরপরের প্রবন্ধটি মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং এর প্রথম উপাচার্য ফিলিপ হার্টগকেন্দ্রিক। রাশেদ রাহম লিখিত প্রবন্ধটির শিরোনাম ‘ইতিহাসের আলোকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’। ২০১৬ সালে প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত তিনটি বইয়ের ওপর ভিত্তি করে প্রবন্ধটি লেখা হয়েছে। এর মধ্যে দুটি বইয়ের লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা এবং স্যার ফিলিপ হার্টগ। অন্যটি হচ্ছে ইমতিয়াজ আহমেদ এবং ইফতেখার ইকবাল সম্পাদিত বই ইউনিভার্সিটি অব ঢাকা: মেকিং, আনমেকিং, রিমেকিং। এই প্রবন্ধটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, এর বিকাশ, শিক্ষা ও গবেষণার মান, ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি, আবাসন ব্যবস্থাসহ একটি সামগ্রিক আলোচনা উঠে এসেছে।

রাজনৈতিক বিতর্কে সম্প্রতি সুন্দরবন নতুন করে বিশেষ স্থান পেয়েছে। বিশ্বঐতিহ্যের অংশ ও বিশ্বের বৃহত্তম শ্বাসমূলীয় এই বনের কাছাকাছি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণকে কেন্দ্র করে এই বিতর্কের সূত্রপাত। বিদুেকন্দ্র নির্মাণ হলে ক্ষতি হবে কি হবে না বা হলে কতটুকু হবে সে বিতর্ক চলমান রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য, এর প্রাণপ্রকৃতি এবং বনের ওপর নির্ভরশীল মানুষকে নিয়ে যে হাজার বছরের বাস্তুসংস্থান বিদ্যমান, সে সম্পর্কে সেখানকার স্থানীয় মানুষের জ্ঞান ও ধারণা জানা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। প্রচলিত জ্ঞানভাষ্যে এই জ্ঞান অনুপস্থিত। কিন্তু সুন্দরবনকে ঘিরে যেকোনো সিদ্ধান্ত স্থানীয় মানুষের জ্ঞানকে বিবেচনায় রেখে নেওয়া দরকার। মানুষ ও অসংখ্য প্রাণপ্রকৃতি নিয়ে যে জটিল সম্পর্কের আধার এই বন, তা হাজার বছর ধরে তিলে তিলে অর্জিত লোকায়ত জ্ঞানের আলোকেই সবচেয়ে ভালোভাবে বোঝা সম্ভব। প্রতিচিন্তার পাঠকদের জন্য গবেষক পাভেল পার্থ লোকায়ত জ্ঞানের আলোকে সেই জটিল সম্পর্ক তুলে আনার চেষ্টা করেছেন । তাঁর লেখার শিরোনাম ‘বাদাবনের বিজ্ঞান’।

বর্তমান বিশ্বের অন্যতম সংকট জলবায়ু পরিবর্তন। এর ভয়াবহ প্রভাব নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। এই সংকট মোকাবিলার জন্য দরকার সমন্বিত বৈশ্বিক প্রয়াস। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় উগ্র বাজারভিত্তিক অর্থনীতির চালকেরা বড় বাধা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। মুনাফা কমে যাওয়ার আশঙ্কায় বড় কার্বন নির্গমনকারী কোম্পানিগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের বাস্তবতা স্বীকার করতে চাইছে না। রাজনৈতিক অর্থনীতিই জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বৈশ্বিক প্রয়াস গ্রহণে সবচেয়ে বড় বাধা। এ বিষয়ে প্রখ্যাত সাংবাদিক ও লেখক নাওমি ক্লাইনের দিস চেঞ্জেস এভরিথিং: ক্যাপিটালিজম ভার্সেস দ্য ক্লাইমেট বইটি বিশ্বব্যাপী সাড়া জাগিয়েছে। প্রতিচিন্তার পাঠকদের জন্য এবারের বই আলোচনা অংশে নওমি ক্লাইনের এই বইটি আলোচনা করেছেন খলিলউল্লাহ্।