বিশ্বায়নকে ত্রুটিমুক্ত করা কি সম্ভব?

বইয়ের প্রচ্ছদ
বইয়ের প্রচ্ছদ

ইন ডিফেন্স অব গ্লোবালাইজেশন—জগদীশ ভাগবতী, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০৪, আইএসবিএন: ০-১৯-৫১৭০২৫-৩।

ভূমিকা

চলমান বিশ্বরাজনীতির খোঁজখবর যাঁরা মোটামুটি রাখেন, তাঁরা সবাই জানেন যে বিশ্বব্যাপী একটি রক্ষণশীল পপুলিস্ট বা জনতুষ্টিবাদী ধারা ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে উঠছে। উদাহরণ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতা গ্রহণ আর যুক্তরাজ্যের ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়া বা ব্রেক্সিটের কথা বলা যায়। কিন্তু এর বাইরেও বিশ্বব্যাপী গত কয়েক বছরে অনেক দেশে রক্ষণশীল দলগুলোই ক্ষমতায় এসেছে অথবা ক্ষমতায় আসতে না পারলেও আগের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। এসব শক্তি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই শক্তিশালী হচ্ছে। এর ফলে গণতন্ত্রের ভবিষ্যত্ নিয়েও অনেক বিশ্লেষক প্রশ্ন তুলেছেন। এসব ঘটনার পেছনে মূল কারণ হিসেবে ধরা হচ্ছে পপুলিজম বা জনতুষ্টিবাদকে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী চলমান রক্ষণশীল জনতুষ্টিবাদের সারমর্ম হলো জনগণের চাহিদা অনুযায়ী নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসা বা ক্ষমতায় টিকে থাকা। তা যদি নৈতিকতা বা সমাজের দীর্ঘদিনের পরিচালিত মূল্যবোধ বা আদর্শবিরোধীও হয়, তবু জনগণ চাইলে সে অনুযায়ী রাষ্ট্রপরিচালনার প্রতিশ্রুতি দেওয়া। রাজনৈতিক ইতিহাস ও সংস্কৃতিভেদে জনতুষ্টিবাদ একেক দেশে একেক রকম হতে পারে। তবে ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য স্থানের সাম্প্রতিক জনতুষ্টিবাদের মধ্যে যে জায়গায় মিল পাওয়া যায় তা হলো দক্ষিণপন্থী জনতুষ্টিবাদী শক্তিগুলো বেশ কিছু রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়ে জনগণের অসন্তুষ্টিকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতায় এসেছে বা আসার অপেক্ষায় আছে।১

মোটাদাগে এসব গোষ্ঠীর জনপ্রিয়তার বড় কারণ হলো সমাজে সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান অসমতা। ২০০৮ সাল থেকে সম্পদ ক্রমেই বেশি আকারে পুঞ্জীভূত হয়ে আসছিল। উন্নত দেশের সরকারগুলো তাদের সামাজিক কর্মসূচিগুলোতে বাজেট কাটছাঁট করেছে, যার ফলে তা বেসরকারি হাতে আরও বেশি সম্পদ পুঞ্জীভূত হতে সহায়তা করেছে। এসব সম্পদে কোনো কর আরোপিত হয়নি, তাই তা সামাজিক কর্মসূচি বা জনকল্যাণে কাজে লাগেনি। এর ফলে ক্রমেই অভিবাসী, প্রবাসী ও অন্যান্য ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর প্রতি সেসব দেশে মানুষের ক্ষোভ বৃদ্ধি পেয়েছে।২ তারা মনে করছে, এসব অভিবাসী না থাকলে তারা আরও বেশি সুবিধা পেত।

জনতুষ্টিবাদ বামপন্থী, মধ্যপন্থী কিংবা ডানপন্থীও হতে পারে। বর্তমানে ডানপন্থী রক্ষণশীলেরা জনগণের চাহিদা ও আশঙ্কা অনুযায়ী প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করছে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় উগ্র জাতীয়তাবাদ, মৌলবাদ, রক্ষণশীলতার মতো মনোভাব বিভিন্ন আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক কারণে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে বিশ্বায়নের ফলে ছোট হয়ে যাওয়া বিশ্ব আবার ‘বড়’ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে। কারণ রক্ষণশীল রাজনৈতিক শক্তিগুলো জাতীয় স্বার্থের কথা বলে যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে, তা মোটাদাগে বিশ্বায়নবিরোধী বলা যায়।

বিশ্বায়ন এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে বিশ্বব্যাপী মানুষ, চিন্তাভাবনা ও পণ্য ছড়িয়ে পড়াকে বোঝায়। এর ফলে বিশ্বের বিভিন্ন সংস্কৃতি, সরকার ও অর্থনীতিগুলোর মধ্যে অনেক বেশি মিথস্ক্রিয়া ও একীভূতকরণ ত্বরান্বিত হয়। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ এই প্রক্রিয়ার চালক আর একে সহযোগিতা করে তথ্যপ্রযুক্তি।৩

কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জগদীশ ভাগবতী একজন খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ। তাঁর বই ইন ডিফেন্স অব গ্লোবালাইজেশন ২০০৪ সালে প্রকাশিত হয়। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বিশ্বায়নের একনিষ্ঠ সমর্থক হিসেবে তিনি বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। ১৩ বছর আগের একটি বই নিয়ে এখন আলোচনার উদ্দেশ্য হলো বর্তমান বিশ্বে বিশ্বায়নবিরোধী যে জোয়ার বইছে, সে প্রেক্ষাপটে বিশ্বায়নের পক্ষের আগের যুক্তিগুলো তুলে ধরা। এত দিন যেসব দেশকে বিশ্বায়নের সমর্থক ভাবা হতো, তারা কীভাবে বিশ্বায়নের মূল ধারণা থেকে সরে যাচ্ছে, তা বিশ্বায়নের পক্ষের যুক্তিগুলোর সঙ্গে বর্তমান ঘটনাগুলোর তুলনার মাধ্যমে বোঝা সহজ হবে। যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যের মতো বিশ্বায়নের ঘোর সমর্থকেরাও জনতুষ্টিবাদের কবলে পড়ে বিশ্বায়নের ধারণাবিরোধী পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। এই দিকটি বিবেচনা করেই ভাগবতীর বইয়ের মূল যুক্তিগুলো পুনরায় উপস্থাপন প্রয়োজনীয় মনে হলো।

সাধারণত পুঁজিবাদের বিরোধীরাই বিশ্বায়নবিরোধী বলে পরিচিত। তাদের যুক্তিতর্কগুলো মূলত বিশ্বায়নের ফলে সৃষ্ট রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক সমস্যাকে ঘিরে, বিশেষ করে দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশের প্রেক্ষাপটে। এসব বিষয়ে বিশ্বায়নের সমালোচকদের ‘কড়া’ জবাব হিসেবে জগদীশ ভাগবতীর এই বই বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। যদিও বিশ্বায়নের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ইত্যাদি রূপ রয়েছে, কিন্তু ভাগবতীর আলোচ্য বিষয় হলো অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন। তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে এই অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের ধারণা কাজ করে এবং কীভাবে আরও ভালো কাজ করতে পারে। বিশ্বায়নবিরোধীরা ভাবেন যে বিশ্বায়ন অর্থনৈতিকভাবে ফলপ্রদ হলেও দারিদ্র্য, লিঙ্গবৈষম্য, আদিবাসী ও মূলধারার সংস্কৃতির সুরক্ষা ইত্যাদি বিষয় বিশ্বায়নের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাঁরা মনে করেন, বহুজাতিক করপোরেশনগুলোর মাত্রাতিরিক্ত মুনাফার লালসা এই সামাজিকভাবে ধ্বংসাত্মক বিশ্বায়নের প্রধান শক্তি।

ভাগবতীর মতে, বিশ্বায়নের বিরোধীরা তথ্যপ্রমাণের বদলে আতঙ্ককে তাদের যুক্তি হিসেবে চালিয়ে দেয়। কিন্তু বিশ্বায়নের সমর্থকেরাও সঠিক পাল্টা যুক্তি দিতে পারে না। তিনি মনে করেন, বিশ্বায়ন বিষয়ে বিতর্ক ও উদ্বেগগুলোর পদ্ধতিগত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে এমন একটি আশাব্যঞ্জক বিশ্বব্যবস্থার রূপকল্প দেওয়া যায়, যা বিশ্বায়ন প্রক্রিয়াকে উন্নততর করবে।

এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই ভাগবতী ইন ডিফেন্স অব গ্লোবালাইজেশন গ্রন্থে তাঁর যুক্তিতর্ক তুলে ধরেছেন। মোট ৩০৮ পৃষ্ঠার বইটি পাঁচটি ভাগ ও উনিশটি অধ্যায়ে বিভক্ত। প্রথম ভাগে বিশ্বায়ন-বিরোধিতার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর উদ্দেশ্যে তিনি এই বিরোধিতা জানা-বোঝা এবং এর উদ্বেগগুলো সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, বেসরকারি সংগঠন বা এনজিওগুলো বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বায়ন-বিরোধিতার পালে হওয়াটা জোরে লাগছে এবং এই সংগঠনগুলোই চাইলে বিশ্বায়নের ফলাফলকে আরও ভালো করার লক্ষ্যে সঠিক শাসনব্যবস্থার নকশা তৈরি করতে পারে।

দ্বিতীয় ভাগে ভাগবতীর মূল লক্ষ্য ছিল বিশ্বায়নের মানবিক কোনো চেহারা নেই বলে যে দোষারোপ করা, হয় তা খণ্ডন করা। বিভিন্ন বিষয়, যেমন দারিদ্র্য, লিঙ্গসমতা, বহুজাতিক কোম্পানি কর্তৃক বাণিজ্য ও প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ ইত্যাদির সামাজিক প্রভাব ফলপ্রসূ বলে তিনি মনে করেন।

তৃতীয় ভাগে তিনি স্বল্পমেয়াদি পুঁজির প্রবাহ ও এক দেশ থেকে আরেক দেশে মানুষের চলাচলের মতো অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের দুটি প্রধান রূপ তুলে এনেছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন, স্বল্পমেয়াদি পুঁজির প্রবাহ মূলত স্টক মার্কেট ও অন্যান্য আর্থিক যন্ত্রে লেনদেনের মাধ্যমে স্বল্পমেয়াদি লাভের জন্য করা হয়। এটা এন্টারপ্রাইজগুলোর দীর্ঘমেয়াদি লাভের আশায় করা প্রত্যক্ষ ইক্যুইটি বিনিয়োগ থেকে ভিন্ন। স্বল্পমেয়াদি পুঁজির প্রবাহ ও মানব অভিবাসনের ফলে অনেক প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। তবে তিনি মনে করেন, বাণিজ্য ও প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের মতো বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে যে বইয়ে, সেখানে সেসবের সদুত্তর দেওয়া যাবে না। এর জন্য ভিন্ন একটি বইয়ে আলোচনা করতে হবে।

চতুর্থ ভাগে ভাগবতীর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হলো দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিবর্তনের নকশা। তিনি মনে করেন, এই পরিবর্তনের নকশাটা বিশ্বায়নের ‘সাধারণভাবে ইতিবাচক’ ফলাফলকে আরও বেশি ফলপ্রসূ করবে। বিশ্বায়নের মানবিক চেহারা থাকতে হবে বলে যেটা বলা হয়, তিনি সেটাকে বলছেন ভুল। তিনি মনে করেন, বিশ্বায়নের মানবিক চেহারা আছেই। কিন্তু আমরা সেই চেহারাটাকে আরও বেশি প্রীতিকর করতে পারি চাইলে। বইয়ের শেষ ভাগটি এক পাতার একটি উপসংহার।

বিশ্বায়নের সমর্থনে

ভাগবতী অনিয়ন্ত্রিত স্বল্পমেয়াদি পুঁজির প্রবাহকে সমর্থন করেন না। কিন্তু তিনি মুক্ত বাণিজ্য ও শ্রম, পুঁজি ও প্রযুক্তির অবাধ চলাচলের ভিত্তিতে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক একীভূতকরণের সমর্থক। তবে তিনি এই একীভূতকরণের ক্ষেত্রে অনেক সতর্কতা অবলম্বনের পক্ষে। যদিও বইয়ে খুব একটা উল্লেখ নেই, কিন্তু তাঁর বাণিজ্য তত্ত্ব থেকেই অর্থনৈতিক একীভূতকরণের সমর্থনটা এসেছে বলে অনুমান করা যায়। তিনি বলতে চান যে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জাগতিক জীবনমান উন্নয়নের সবচেয়ে বড় সুযোগ হলো অর্থনীতিকে মুক্ত করা। এসব যুক্তির পেছনে তিনি অসংখ্য প্রমাণ দিয়েছেন। এই বইয়ের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে উত্তর ও দক্ষিণ বলয়ের দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্ক। সে কারণে ভাগবতী উত্তর বলয় বা উন্নত দেশগুলোর বিশ্বায়নবিরোধীদের যুক্তি খণ্ডনের চেষ্টা করেননি।

ভাগবতী বিশ্বায়নবিরোধীদের দুটি শিবিরে ভাগ করেছেন। প্রথমটি হলো হার্ড কোর বিশ্বায়নবিরোধী বা বিশ্বায়ন-বিরোধিতা যাদের খুব গভীরে প্রোথিত। তাদের বিষয়ে তিনি খুব বেশি লেখেননি। বিশ্বায়ন-বিরোধিতার তিনটি ধারা—পুঁজিবাদ-বিরোধিতা, বিশ্বায়ন-বিরোধিতা (সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতা অর্থে) ও করপোরেট-বিরোধিতাকে তিনি কয়েক পাতায় তুলে ধরেছেন। এর বাইরে রক্ষণশীল, সাম্যবাদ ও আমেরিকা-বিরোধীদের যুক্তির পাল্টা যুক্তিও একটি অধ্যায়েই শেষ করেছেন। তাঁর মূল মনোযোগ ছিল দ্বিতীয় শিবিরের ওপর।

বিশ্বায়নবিরোধীদের দ্বিতীয় শিবিরে যারা, তারা মনে করে, অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন বেশ কিছু সামাজিক অসুস্থতার কারণ, যেমন দারিদ্র্য ও পরিবেশ বিপর্যয়। ভাগবতী তাদের সঙ্গে তর্ককে বেশি যুক্তিসংগত মনে করেন। এর ফলে তিনি প্রতিটি সামাজিক বিষয়ের ওপর একটি করে অধ্যায়ে তাঁর যুক্তিতর্কগুলো উপস্থাপন করেছেন। যেমন দারিদ্র্য, শিশুশ্রম, নারীর ক্ষমতায়ন, গণতন্ত্র, সংস্কৃতি, শ্রমের মান ও পরিবেশের ওপর বিশ্বায়নের প্রভাব। একটি অধ্যায়ে তিনি অনিয়ন্ত্রিত আর্থিক প্রবাহের (প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ নয়) বিরুদ্ধে শক্তিশালী সমালোচনা করেছেন। অন্য আরেকটি অধ্যায়ে করপোরেশনের বিরুদ্ধে যেসব যুক্তি দেওয়া হয়, সেগুলো খণ্ডন করতে চেয়েছেন। অভিবাসনের ওপর একটি অধ্যায় তিনি লিখেছেন। তিনি একটি বৈশ্বিক অভিবাসন সংস্থা গঠনেরও প্রস্তাব করেছেন।

প্রথম ভাগ

বিশ্বায়ন-বিরোধিতার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর ওপর প্রথম ভাগে ভাগবতী বিশ্বায়নবিরোধীদের যুক্তিগুলো তুলে ধরার পাশাপাশি বিশ্বায়নের পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন, বিশ্বায়ন শুধু অর্থনৈতিকভাবেই নয়, সামাজিকভাবেও ফলপ্রসূ। তবে তিনি মনে করেন বিশ্বায়ন ভালো, তবে যথেষ্ট ভালো নয়। এর ত্রুটি আছে। সেগুলোকে সঠিক নীতি প্রণয়নের মাধ্যমে সারাই করা সম্ভব। তিনি বলেছেন, বাণিজ্য ও প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের নেতিবাচক দিক রয়েছে। যেমন উপকূলীয় অঞ্চলে চিংড়ি চাষ থেকে রাসায়নিকের ফলে পার্শ্ববর্তী শ্বাসমূলীয় বনের ক্ষতি হয় এবং চিংড়ির জন্য যেসব খাবার দেওয়া হয় সেগুলো অবশিষ্ট থাকলে জেলে ও অন্যান্য পেশার মানুষের জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ক্ষেত্রে তিনি দুটি প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের কথা বলেছেন। একটি হলো ইতিমধ্যে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ ও সহায়তা দেওয়া। দ্বিতীয়টি হলো যে দূষণ করবে তাকে দূষণ ব্যবস্থাপনার খরচ বহন করতে হবে, যাতে করে মানুষের স্বাস্থ্য ও পরিবেশের ওপর উত্পাদনের ফলে দূষণের প্রভাব না পড়ে। এটাকে বলা হয় ‘পলুটার পে নীতি’। লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশবিষয়ক গ্রাহাম ইনস্টিটিউট এই নীতির সংজ্ঞা দিয়েছে এভাবে:

The ‘polluter pays’ principle is the commonly accepted practice that those who produce pollution should bear the costs of managing it to prevent damage to human health or the environment. For instance, a factory that produces a potentially poisonous substance as a by-product of its activities is usually held responsible for its safe disposal.৪

বাজার অতিমাত্রায় উন্মুক্ত করার ফলে মূল্য ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে অধিক অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। বিশ্বায়ন-বিরোধিতার এটা একটা কারণ। ভাগবতী মনে করেন, রাজনৈতিকভাবে এটা মোকাবিলা করা দরকার। যারা আমদানি প্রতিযোগিতার ফলে এ ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে, তাদের খাপ খাওয়ানোর জন্য অতিরিক্ত সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন।

বিশ্বায়ন কোন গতিতে অর্জিত হবে, সে ব্যাপারে ভাগবতী বলেন, বিশ্বায়ন প্রয়োজন অনুযায়ী হওয়া উচিত। সর্বোচ্চ গতিতে বিশ্বায়ন ঘটা ক্ষতিকর। তিনি মনে করেন, ১৯৯৭ সালে শুরু হওয়া এশিয়ার আর্থিক সংকটের পেছনে অবিবেচকের মতো অতিমাত্রায় পুঁজির প্রবাহ উন্মুক্ত করাই দায়ী। এটা বিশ্বায়নের অব্যবস্থাপনার ফল। তাই তিনি বলেন, …globalization must be managed so that its fundamentally benign effects are ensured and reinforced. Without this wise management, it is imperiled. (পৃ. ৩৫)। তিনি মনে করেন, এই ব্যবস্থাপনা অনেক বেশি সুন্দর ও কার্যকর হবে, যদি সরকার, আন্তর্জাতিক সংগঠন, করপোরেশন ও বিশ্বায়নের পক্ষের বুদ্ধিজীবীরা এনজিওগুলোর সঙ্গে একসাথে কাজ করে। এনজিওগুলোই সাধারণত বিশ্বায়নের বিরোধিতা করে থাকে। সে জন্য তিনি এনজিও বা সিভিল সমাজ গোষ্ঠীগুলো কারা, কীভাবে তাদের সংখ্যা এত বাড়ল, যেটা সিকি শতাব্দী আগেও অনুমান করা যায়নি এবং কীভাবে তাদের শক্তি ও আসক্তিকে বিশ্বায়নের উন্নতিতে ব্যবহার করা যায়, সে বিষয়ে অধ্যায় চারে আলোচনা করেছেন। তবে বাংলাদেশে আমরা দেখতে পাই, সময়ের সাথে সাথে এনজিওগুলো লাভজনক খাতে প্রবেশ করছে। বাজারের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত হওয়ার ফলে বিশ্বায়ন-বিরোধিতার বদলে বিশ্বায়নের পক্ষের শক্তি হিসেবেই আবির্ভূত হচ্ছে।

তবে বিশ্বায়নবিরোধীদের যুক্তি খণ্ডনের ক্ষেত্রে তিনি পাঠককে বিচার করতে সুযোগ দেননি বলে মনে হয়েছে। প্রতিপক্ষের বিশ্বাসের প্রত্যুত্তর দেওয়ার বদলে তিনি তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছেন। এর ফলে একজন গবেষক বা একাডেমিকের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। তিনি অনেক সময় ব্যাখ্যা দেওয়ার বদলে তার অবস্থানের বিবৃতি দিয়ে ফেলেছেন। যেমন এক জায়গায় বিশ্বায়নবিরোধীদের প্রতিবাদের বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি বলছেন, However, I would argue that seizures of people and property are not the way to organize the protests, but that the methods of non-violent resistance advanced by Mahatma Gandhi and practiced so well by Martin Luther King Jr. are the better way. (পৃ. ১৭০)। এখানে মহাত্মা গান্ধী ও মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের প্রতিবাদের পদ্ধতি কেন ভালো, সে বিষয়ে তিনি কোনো ব্যাখ্যা দেননি। তিনি যেহেতু বলছেন না যে এটায় তিনি ‘বিশ্বাস করেন’ (I believe) বা ‘মনে করেন’ (I think), বরং বলছেন তিনি ‘যুক্তি দিচ্ছেন’ (I would argue), সে ক্ষেত্রে এ ধরনের বক্তব্যের ব্যাখ্যা পাঠক আশা করতেই পারে। তা ছাড়া মনে রাখতে হবে, যে দুজনের কথা তিনি বলছেন তারা দুজনেই হত্যাকাণ্ডের শিকার। সুতরাং উদ্দেশ্য যত মহত্ হোক না কেন, পাঠককে তাদের প্রতিবাদের পদ্ধতি সম্পর্কে বিশদ ব্যাখ্যা না দিয়ে স্বতঃসিদ্ধ দাবি করা যুক্তিযুক্ত নয়।

দ্বিতীয় ভাগ

বইয়ের দ্বিতীয় ভাগে ভাগবতী বিশ্বায়নের মানবিক চেহারা তুলে ধরেছেন। বিশ্বায়নের ফলে দুনিয়াজুড়ে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সূচকে কেমন উন্নতি ঘটেছে, তা-ই বইয়ের এই অংশের আলোচ্য বিষয়।

দারিদ্র্য ও বিশ্বায়ন

ভাগবতী দারিদ্র্য বিমোচনে বিশ্বায়নের ভূমিকা তুলে ধরতে দুটি পদ্ধতির আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁর ভাষায়, একটি হলো তীক্ষ পর্যবেক্ষণ আর অপরটি হলো বস্তুনিষ্ঠ প্রমাণাদি। তিনি এই আলোচনায় বলেছেন যে দারিদ্র্য বিমোচনকে সব সময়ই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে—শেক্সপিয়ারের সময় থেকে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার সূচনালগ্নেও। স্বাভাবিক পর্যবেক্ষণেও যে কেউ বলতে পারে, এখন দারিদ্র্য আগের চেয়ে অনেক কম। আর বৈজ্ঞানিক প্রমাণের ক্ষেত্রে ভাগবতী সাধারণ অর্থনীতির যুক্তিতে দেখিয়েছেন কীভাবে বাণিজ্য বাড়লে প্রবৃদ্ধি বাড়ে আর প্রবৃদ্ধি বাড়লে দারিদ্র্য কমে। প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্য বিষয়ে বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন প্রবৃদ্ধির ধরন অনুযায়ী এর প্রভাব ভিন্ন হবে। যেমন বহির্বাণিজ্যে জোর দেওয়ায় পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর শ্রমবান্ধব পণ্য রপ্তানি বেড়েছে। এর ফলে কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য দ্রুত কমেছে। কিন্তু ভারতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা ও পুঁজিবান্ধব প্রকল্পে জোর দেওয়ায় প্রবৃদ্ধি কমেছে, তবে শ্রমের চাহিদা বেড়ে গেছে। সে কারণে দারিদ্র্য খুব একটা কমেনি (২০০৪ সালের প্রেক্ষাপটে)।

বিশ্বায়নের ফলে অসমতা বাড়ছে। ভাগবতী মনে করেন, অসমতা বৃদ্ধি চিন্তার বিষয়। কিন্তু সে ক্ষেত্রে কোন ধরনের সমাজে অসমতা বাড়ছে, সেটা বিবেচনায় নিতে হবে। তিনি মনে করেন, অনেক সময় অসমতা বাড়লেও তা সমাজে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। একটি সমাজে যদি এক হাজার জন লাখপতি থাকে আর অন্য কোনো সমাজে একজন কোটিপতি থাকে, তাহলে প্রথমটিতে অসমতা কম মনে হতে পারে। কিন্তু এক হাজার লাখপতি থাকলেও তারা তাদের আয় বিভিন্ন বিলাসী কর্মকাণ্ডে ব্যয় করবে। অন্যদিকে লাখপতিরা যেসব পণ্যে অর্থ ব্যয় করে, বিল গেটসের মতো ধনবান চাইলেও সেখানে অর্থ ব্যয় করে শেষ করতে পারবে না। তাই বাধ্য হয়েই সে সামাজিক কল্যাণমূলক কাজে তার অর্থ ব্যয় করে। তিনি সালা-ই-মার্টিনের করা গবেষণার উল্লেখ করে বলেন, বিশ্বব্যাপী অসমতা গত দুই দশকে কমেছে (২০০৪ সালের প্রেক্ষাপটে)।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু গবেষণায় দেখা যায়, বিশ্বব্যাপী অসমতা বাড়ছে। এর মধ্যে অক্সফামের গবেষণা প্রতিবেদন উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া ২০১৬ সালে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম ২০১৭ সালের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে ক্রমবর্ধমান অসমতাকে চিহ্নিত করেছে।

শিশুশ্রম ও বিশ্বায়ন

ছয় নম্বর অধ্যায়ে ভাগবতী শিশুশ্রম বিশ্বায়নের ফলে কমেছে না বেড়েছে তার বিশ্লেষণ করেছেন। বিশ্বায়নের ফলে শিশুশ্রম বৃদ্ধি পেয়েছে বলে সমালোচনা হয়। ভাগবতী মনে করেন, এই ব্যাপারটি বহুদিনের পুরোনো এবং ঐতিহাসিকভাবে চলে আসছে। এর সঙ্গে বিশ্বায়নের কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি মনে করেন, এর মূল কারণ সম্পূর্ণ ভিন্ন। শিশুশ্রমের মূল উত্স দারিদ্র্যের মধ্যে নিহিত। বিশ্বায়ন শিশুশ্রমের কারণ না হলেও এর ফলে শিশুশ্রম ব্যবহারের প্রণোদনা তৈরি হয় এবং ধীরে ধীরে তা স্থায়ী হয়, এমনকি বৃদ্ধি পায়। কিন্তু ভাগবতী মনে করেন, বিশ্বায়নের সঙ্গে শিশুশ্রমের এই ধরনের বিকৃত সম্পর্কের কোনো প্রমাণ নেই। তাঁর কথা হলো বিশ্বায়নের ফলে সামগ্রিক উন্নতি হয় এবং দারিদ্র্য হ্রাস পায়। ফলে শিশুশ্রম কমে ও শিক্ষার হার বাড়ে। শিক্ষার হার বাড়লে আবার প্রবৃদ্ধিও বাড়ে। এর ফলে একটি শুভচক্রের তৈরি হয়। তাঁর ভাষায়:

The truth is that globalization- wherever it translates into greater general prosperity and reduced poverty- only accelerates the reduction of childlabor and enhances primary school enrollment and hence literacy. And as I argued from my analysis of the East Asian miracle, literacy in turn enables rapid growth. So we have here a virtuous circle. (পৃ. ৬৮)।

কিন্তু তবুও ভাগবতী সতর্ক করে দিয়েছেন যে কিছু জায়গায় সঠিক নীতি গ্রহণ করতে হবে। যেমন শ্রম ঘাটতি থাকা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো, বিশেষ করে সৌদি আরবে, শ্রমের চাহিদা বাড়ার ফলে পাচার হয়ে যাওয়া নারী ও শিশুকে গৃহকাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব দেশে আধুনিক মানবাধিকার বা তার সুরক্ষা নেই। এ ছাড়া, শিশুদের যৌনপল্লিতে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। এগুলো বিশ্বায়নের ফলেই হচ্ছে এক অর্থে। কিন্তু ভাগবতী মনে করেন, এসব ঠেকাতে সঠিক নীতি প্রণয়ন দরকার, বিশ্বায়ন বন্ধ করা নয়।

নারীর ক্ষমতায়ন ও বিশ্বায়ন

বিশ্বায়নের ফলে নারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে না উপকৃত হয়েছে, সে বিষয়ে সাত নম্বর অধ্যায়ে আলোচনা করেছেন ভাগবতী। তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন, নারীরা বিশ্বায়নের ফলে উপকৃত হয়েছে। এ বিষয়ে তিনি দুটি কেস স্টাডি তুলে ধরেছেন। জাপানি বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর বিদেশে বিস্তার এবং বাণিজ্যের ফলে লিঙ্গ ব্যবধান। দুটি ক্ষেত্রে তিনি নারীদের উন্নতি দেখিয়েছেন।

আর্লি রাসেল হোসচিল্ড এক গবেষণায় দেখিয়েছেন, বিশ্বায়নের ফলে বৈশ্বিক সন্তান লালন-পালনের ক্ষেত্রে একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। নারীরা উপার্জনের তাগিদে উন্নত দেশে আসছে। নিজের দেশে তাদের সন্তানদের লালন-পালন করতে পারছে না। কিন্তু উন্নত দেশে অন্যের সন্তানকে লালন-পালন করছে। এর ফলে এসব নারীর মধ্যে মাতৃত্ব প্রশ্নে দুই ধরনের চিন্তা আসছে। ‘ভালো মা’ হতে হলে পরিবারের জন্য উপার্জন করতে হয়, কিন্তু সন্তানের পাশেও থাকতে হয়। কিন্তু সেটা তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। হোসচিল্ড মনে করেন, এর ফলে এসব নারীকে অনেক চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে। ভাগবতী এসব যুক্তি খণ্ডনের চেষ্টা করার পাশাপাশি, গৃহস্থালির কাজের জন্য নারীদের কোনো মূল্য যে দেওয়া হয় না, সে ব্যাপারে আলোচনা করেছেন। এ ছাড়া বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা, বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের নীতি, ইপিজেড ইত্যাদির ফলে নারীদের ক্ষমতায়ন হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।

গণতন্ত্র ও বিশ্বায়ন

ভাগবতী মনে করেন, বিশ্বায়ন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে গণতন্ত্রের পথে অগ্রসর হতে সহায়তা করে। প্রত্যক্ষ সংযোগের ক্ষেত্রে ভাগবতী বলেন, কৃষকেরা এখন প্রভাবশালী গোষ্ঠীগুলোর মাধ্যম ছাড়াই প্রযুক্তির ফলে তাদের উত্পাদিত পণ্য বিক্রি করতে পারছে। এর ফলে কৃষকেরা অনেক বেশি স্বাধীন হচ্ছে। নিজেকে স্বাধীন অনুভব করার ফলে বাজারের বাইরে রাজনৈতিক অঙ্গনেও তাদের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিনি বলেন, বিশ্বায়নের ফলে বাণিজ্য বৃদ্ধি পাওয়ায় কম্পিউটার অনেক বেশি সহজলভ্য এবং এর ফলে এসব কৃষকের বাজার শুধু দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং আন্তর্জাতিক বাজারেও তারা প্রবেশাধিকার পাচ্ছে।

বিশ্বায়নের সঙ্গে গণতন্ত্রের পরোক্ষ সংযোগের ক্ষেত্রে ভাগবতী মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও বুদ্ধিজীবী সেইমুর মার্টিন লিপসেটের ১৯৫৯ সালের সাম রিক্যুজাইটস অব ডেমোক্রেসি গ্রন্থের যুক্তি তুলে ধরেন। লিপসেট বলেছিলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলে সামাজিক উন্নয়ন, যেমন শিক্ষা, সামাজিক সমতা ও শ্রেণিকাঠামোয় পরিবর্তন ঘটে এবং তা গণতন্ত্রায়ণে ভূমিকা রাখে। তবে রালফ ডারেনডর্ফ ও স্যামুয়েল হান্টিংটনের মতো প্রথিতযশা রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা মনে করেন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন সব সময় এ ধরনের সামাজিক পরিবর্তন ঘটাবে, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাঁরা মনে করেন, সামাজিক পরিবর্তন অনেক সময় অস্থিতিশীল হতে পারে। গণতন্ত্রের বদলে নৈরাজ্যও সৃষ্টি করতে পারে। তবে ভাগবতীর বক্তব্য হলো:

...economic prosperity produces a middle class. This emerging middle class creates, however haltingly, an effective demand for democratization of politics: the new bourgeoisie, with wallets a little fatter, seeks a political voice, not just one in the marketplace. (পৃ. ৯৪)।

সংস্কৃতি ও বিশ্বায়ন

বিশ্বায়নের ফলে সংস্কৃতি ধ্বংস হচ্ছে না সমৃদ্ধ হচ্ছে, সেই আলোচনা পাওয়া যায় নয় নম্বর অধ্যায়ে। ইংরেজি ভাষা ও মার্কিন সংস্কৃতি অন্য ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর কর্তৃত্ব করছে। এ ধরনের সমালোচনার জবাবে ভাগবতী বলেন, ইউনেসকোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী উন্নয়নশীল দেশগুলোর সাংস্কৃতিক পণ্য রপ্তানি আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। তা ছাড়া সময়ের সঙ্গে সংস্কৃতি পরিবর্তনশীল। নতুন উদ্ভাবন, রাজনৈতিক পরিবর্তন যেমন গণতন্ত্রায়ণ ও বিশ্বায়নের ফলে সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আসবেই। এর ফলে সংবেদনশীল মানুষেরা স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ে।

ভাগবতীর মতে, সংস্কৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে যে অভিযোগ করা হয়, এটা আসলে দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্যের কারণে। তিনি বলেন, অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে নৃতাত্ত্বিক বা আদিবাসী অধিকারকর্মীর দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। অর্থনীতিবিদেরা যেখানে আদিবাসীদের মূলধারার অর্থনীতিতে সম্পৃক্ত করলে খুশি হয় এবং না করলে কষ্ট পায়, সেখানে নৃতাত্ত্বিকেরা এর বিরোধিতা করে এবং বিশ্বায়ন-প্রক্রিয়া থেকে আদিবাসীদের পৃথক রাখতে চায়।

তবে আসল কথা হলো, বিশ্বায়নের সঙ্গে সংস্কৃতির সম্পর্কের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অন্যদের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য থাকার বড় কারণ হলো বিশ্বায়নের ফলে যুক্তরাষ্ট্র তার সংস্কৃতিকে ছড়িয়ে দিতে পারছে, যেটা অন্যদের ক্ষেত্রে হচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্র সে জন্য তার সংস্কৃতির ওপর হুমকি আছে বলে মনে করে না।

মজুরি, শ্রমের মান ও বিশ্বায়ন

বিশ্বায়নের প্রভাবে মজুরি ও শ্রমের মানের অবস্থা কী দাঁড়ায় সে বিষয়ে দশ নম্বর অধ্যায়ে আলোচনা রয়েছে। ভাগবতী যুক্তি দিয়েছেন যে উনিশ শতকজুড়ে শ্রমিক শ্রেণির প্রকৃত মজুরি ও জীবনমান উন্নত হয়েছে। কার্ল মার্ক্স পুঁজির পুঞ্জীভবন সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। কিন্তু ভাগবতী মনে করেন, মার্ক্সের যুক্তি ভুল ছিল, কারণ পুঁজির পুঞ্জীভবনের ফলে শ্রমের চাহিদা বৃদ্ধি পায়, যা শ্রমিকদের জন্য মঙ্গলজনক। ধনী দেশগুলোয় বিশ্বায়নবিরোধীদের আশঙ্কা যে দরিদ্র দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য করলে তাদের নিজেদের দেশের শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরি কমে যাবে এবং তাদের মধ্যে কাঙাল তৈরি হবে। এ ছাড়া তাদের শ্রমের মানও পড়ে যাবে, কারণ দরিদ্র দেশগুলোর শ্রমমান নিম্ন। নিম্ন মানের শ্রমের মূল্য কম হওয়ায় বহুজাতিক কোম্পানিগুলো দরিদ্র দেশে তাদের উত্পাদন স্থানান্তর করেছে। তাই প্রতিযোগিতায় টিকতে হলে উন্নত দেশগুলোকে শ্রমের মানের ক্ষেত্রে আপস করতে হবে। এর ফলে শ্রমের মান ধরে রাখা কঠিন হবে। ভাগবতী মনে করেন, এসব আশঙ্কার কোনো প্রমাণ নেই। আশি ও নব্বইয়ের দশকে করা বেশির ভাগ গবেষণায় দেখা গেছে, বাণিজ্যের ফলে খুব ছোট অংশের প্রকৃত মজুরি কমেছে। ভাগবতী তথ্যপ্রমাণ দিয়ে দেখিয়েছেন বাণিজ্যের ফলে শ্রমিকেরা উপকৃত হয়েছে। প্রাযুক্তিক পরিবর্তনের কারণে অদক্ষ শ্রমের চাহিদার পতন সহনীয় হয়েছে। এ ছাড়া দরিদ্র দেশে শ্রমের মান নিম্ন বলে যে অভিযোগ আছে, তা-ও ধীরে ধীরে পরিবর্তন হচ্ছে। গরিব দেশগুলোয় এ ব্যাপারে রাজনৈতিক চাপ ক্রমেই বাড়ছে।

পরিবেশ ও বিশ্বায়ন

বহুদিন ধরেই পরিবেশবাদীরা অর্থনৈতিক বিশ্বায়নকে পরিবেশের জন্য হুমকি হিসেবে দেখে আসছেন। এই বিষয়ে এগারো নম্বর অধ্যায়ে ভাগবতীর বিশ্লেষণ রয়েছে। বাণিজ্য অর্থনীতিবিদ ও পরিবেশবাদীদের মধ্যে দার্শনিক ও জীবনযাত্রার পার্থক্যের ফলে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গিরও পার্থক্য রয়েছে। অর্থনীতিবিদেরা প্রকৃতিকে দেখেন মানুষের অধস্তন হিসেবে। কিন্তু পরিবেশবাদীরা এ ধরনের মনোভাব পোষণ করেন না। তাঁরা প্রকৃতির স্বাধিকারের কথা বলেন। পরিবেশগত নীতি প্রণয়ন না করে মুক্ত বাণিজ্য চালু করলে তা ক্ষতিকর হবে। তবে ভাগবতী তা মনে করেন না। তিনি বলতে চেয়েছেন, শুধু বাণিজ্য নীতি প্রণয়ন করেও বাণিজ্য ও পরিবেশ দুটোরই উন্নতি করা যায়। প্রমাণ হিসেবে তিনি বহুপক্ষীয় বাণিজ্য আলোচনার উরুগুয়ে রাউন্ডে কৃষির বাণিজ্য উদারীকরণের উদাহরণ দিয়েছেন। এর ফলে ইউরোপীয় ও দরিদ্র উভয় প্রকার দেশেই আয় ও জনকল্যাণ বাড়ার পাশাপাশি পরিবেশের মান বেড়েছে। কারণ কৃষি বাণিজ্য নীতির ফলে উচ্চদরের কীটনাশকনির্ভর কৃষির পরিবর্তে নিম্নদরের সারনির্ভর কৃষি শুরু হয়েছে (পৃ. ১৩৮)। তবে ভাগবতী মনে করেন, মুক্ত বাণিজ্যের সঙ্গে সঠিক পরিবেশগত নীতির সামঞ্জস্য সাধন করাই সবচেয়ে উত্তম নীতি।

কিন্তু যে বিষয়টি তিনি এড়িয়ে গেলেন, তা হলো বর্ধিত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, যেমন পণ্যের উত্পাদন ও ভোগই মুক্ত বাণিজ্যের সাফল্যের সূত্র। এর ফলে কলকারখানা, গাড়ি, আবর্জনা, গ্রিনহাউস গ্যাস, রাসায়নিক ইত্যাদি সবকিছুই বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এসবই পরিবেশদূষণের মূল কারণ। বিশ্বায়নের সাফল্য আর পরিবেশ বিপর্যয় একসূত্রে গাঁথা। প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের বদলে টেকসই উন্নয়নের ওপর জোর দেওয়াটাই উত্তম নীতি।

বহুজাতিক কোম্পানি ও বিশ্বায়ন

বিশ্বায়নের ফলে করপোরেশনগুলো অতিমাত্রায় মুনাফা করতে গিয়ে দরিদ্র দেশগুলোয় শ্রমিকদের শোষণ করে বলে বিশ্বায়নের সমালোচনা করা হয়। এই বিষয়ে ভাগবতী বারো নম্বর অধ্যায়ে আলোচনা করেছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন, শ্রমিকেরা অন্যান্য খাতে আগে যে মজুরি পেত করপোরেশনগুলো তার চেয়ে বেশি তাদের দিচ্ছে। এ বিষয়ে ভাগবতী উদাহরণ দিতে গিয়ে বলেন:

As it happens, several empirical studies do find that multinationals pay what economists now call a "wage premium": they pay an average wage that exceeds the going rate, mostly up to 10 percent and exceeding it in some cases, with affiliates of U.S. multinationals sometimes paying a premium that ranges from 40 to 100 percent (citation). The University of Michigan economist Linda Lim has reviewed much of the available evidence from a number of studies in Bangladeshi export processing zones, in Mexico, in Shanghai, in Indonesia, and in Vietnam, and reports that they overwhelmingly confirm the existence of such a premium (citation). (পৃ. ১৭২)।

ভাগবতী মনে করেন, খারাপ অভ্যন্তরীণ নীতির কারণে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে দোষারোপ করার পরিবর্তে নিজ নিজ দেশগুলোর সঠিক নীতি প্রণয়ন দরকার। এ অধ্যায়ে বহুজাতিক কোম্পানি-সম্পর্কিত আরও অনেক বিষয় নিয়ে বিশ্লেষণ দিয়েছেন ভাগবতী।

তবে এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে বিপুল অর্থ নিজেদের হাতে থাকার ফলে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো অনেক সময় আইনকানুনের তোয়াক্কা করে না। যে দেশে তারা ব্যবসা পরিচালনা করে, সে দেশের আইন না মানার অনেক উদাহরণ আছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এমন একটি ঘটনার উদাহরণ দেওয়া যায়। যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানি শেভরনের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের পিএসসি বা প্রোডাকশন শেয়ারিং কন্ট্রাক্টের শর্ত অনুযায়ী শেভরন তার চুক্তিভুক্ত গ্যাসক্ষেত্র অন্য কোনো কোম্পানির কাছে হস্তান্তর করতে চাইলে প্রথমে পেট্রোবাংলার অনুমোদন নিতে হবে। কিন্তু সম্প্রতি শেভরন বাংলাদেশ থেকে তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং তাদের অধীনে থাকা বিবিয়ানা, মৌলভীবাজার ও জালালাবাদ গ্যাসক্ষেত্রগুলো হিমালয় এনার্জি নামক একটি চীনা কোম্পানির কাছে ২০০ কোটি ডলারের বিনিময়ে হস্তান্তর করার উদ্যোগ নিয়েছে এবং সে অনুযায়ী চুক্তিও সম্পাদন করেছে। শেভরন বাংলাদেশকে এ বিষয়ে কিছু জানায়নি। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম রয়টার্স সংবাদ প্রকাশ করার পর বাংলাদেশ সরকার ও পেট্রোবাংলা শেভরনের কাছ থেকে অর্থের বিনিময়ে গ্যাসক্ষেত্রগুলো নিয়ে নেওয়ার আগ্রহ দেখায়। কিন্তু শেভরন এই আগ্রহকে পাত্তা না দিয়ে আগের সিদ্ধান্তে অটল থাকে। শেভরনের এ ধরনের কর্মকাণ্ড আইনবহির্ভূত ও উদ্ধতপূর্ণ।৫

এ বিষয়ে ভাগবতী তেরো বছর আগের এই বইয়ে যুক্তি দিয়েছিলেন যে দরিদ্র দেশগুলো চাইলে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর মধ্যে বাছাই করতে পারে। এসব কোম্পানির মধ্যে যেহেতু প্রতিযোগিতা আছে, সে ক্ষেত্রে দেশগুলো তাদের স্বার্থে সেই প্রতিযোগিতাকে ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু তাঁর উদ্বেগ হলো যেসব দেশে সুশাসন নেই, সেখানে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে। সুশাসনের অভাব থাকলে রাজনীতিবিদ ও আমলাদের ঘুষের মাধ্যমে এসব কোম্পানি কুক্ষিগত করে ফেলে। এর ফলে দরিদ্র দেশগুলো দর-কষাকষিতে পেরে ওঠে না। যার মানে দাঁড়াচ্ছে সুশাসনের অভাব মুখ্য বিষয়। এটি বিশ্বায়নের ত্রুটি নয়।

কিন্তু বহুজাতিক কোম্পানিগুলো, বিশেষ করে এই ধরনের তেল-গ্যাস কোম্পানিগুলোর এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের উত্স তাদের বর্ধিত অর্থনৈতিক শক্তি। এর সাথে সাথে তাদের সামাজিক ও সামরিক শক্তিও বৃদ্ধি পেয়েছে। কীভাবে তারা এ পর্যায়ে গেল, সে বিষয়ে অ্যান্থনি স্যাম্পসনের ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত দ্য সেভেন সিস্টার্স: দ্য গ্রেট অয়েল কোম্পানিজ অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ল্ড দে শেইপড গ্রন্থে বিশ্লেষণ রয়েছে। সেখানে টেক্সাকো, গালফ, এক্সন, শেভরন, শেল, বিপি ও মবিলের মতো বহুজাতিক কোম্পানিগুলো কারা তৈরি করল, এখন কারা চালায় এবং কাদের সঙ্গে তারা দ্বন্দ্বে জড়াচ্ছে, সে বিষয়ে বিস্তর আলোচনা রয়েছে।

এই বইয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ছিল ‘কে নিয়ন্ত্রণ করে?’ তেল-গ্যাসের ইতিহাসে দেখা যায়, একটি কার্টেল বা একচেটিয়া গোষ্ঠীই এর নিয়ন্ত্রণ করেছে সর্বদা। এর ফলে তাদের শক্তিমত্তার সঙ্গে উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলো পেরে ওঠে না।

তৃতীয় ভাগ

বইয়ের এই অংশে বিশ্বায়নের অন্যান্য দিকের মধ্যে ১৯৯৭ সালে সংঘটিত এশিয়ার আর্থিক সংকট ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন-প্রবাহ নিয়ে আলোচনা রয়েছে। দুটি ক্ষেত্রে ভাগবতী সমস্যার বিভিন্ন দিক তুলে ধরে সেগুলোর কারণ ও বিশ্বায়নের সঙ্গে যোগসূত্র খুঁজে বের করে সমাধানের কথা বলেছেন।

এশিয়ার আর্থিক সংকটের ক্ষেত্রে ভাগবতী মনে করেন আতঙ্ক ছড়িয়ে পুঁজির আউটফ্লো করায় এই সংকট ত্বরান্বিত হয়েছে। তিনি মনে করেন এসব ঘটেছে বিদেশি চাপে হঠকারী ও অবিবেচকের মতো আর্থিক উদারীকরণের ফলে। বিশ্বায়নের এই ধরনের নেতিবাচক দিক বিবেচনা না করে স্বল্পমেয়াদি পুঁজির উন্মুক্ত আন্তর্জাতিক প্রবাহ হতে দেওয়ার কারণে এশিয়ার মিরাকল ডেবাকলে পরিণত হয়েছিল। ভাগবতী মনে করেন, ভুল তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এক দেশ যখন ভুল সিদ্ধান্ত নিল, তখন অন্যরাও তাকে অনুসরণ করেছে। এর ফলেই এই সংকট সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেন:

The reason why capital inflows are tricky is simply because when confidence is shaken, the fact that the situation is inherently one of imperfect information implies that the actions of a few can initiate herd action by others. (পৃ. ২০২)।

ভাগবতী মনে করেন, এই ভুল সিদ্ধান্তের দায় ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর ছিল না। বাইরের চাপে তারা এ ধরনের নীতি গ্রহণ করেছিল। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগের মতো সংস্থাগুলোর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ওয়াল স্ট্রিটের বিভিন্ন বড় বড় কোম্পানি থেকে এসেছেন। আবার উল্টোটাও হয়েছে। এটাকে তিনি ওয়াল স্ট্রিট-ট্রেজারি-কমপ্লেক্স হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি মনে করেন, এই পাওয়ার এলিটরা সবাই একইভাবে চিন্তা করেন। এঁদের সম্মিলিত চাপেই অবিবেচকের মতো আর্থিক বাজার উন্মুক্ত করা হয়েছিল। তাঁর মূল বক্তব্য হলো এ ধরনের ভুল সিদ্ধান্ত না নিলে সংকট তৈরি হতো না। সুতরাং এর জন্য বিশ্বায়নকে দোষারোপ করা যায় না। ত্রুটিগুলো সারাই করাই উচিত মূল লক্ষ্য। আইএমএফ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সতর্ক বলেও তিনি মনে করেন।

অভিবাসনের আন্তর্জাতিক প্রবাহের ক্ষেত্রেও তিনি সঠিক নীতি প্রণয়নের ওপর জোর দেন। এই বিষয়ে অর্থনীতি ও নৈতিকতাকে আলাদা করার সুযোগ নেই এবং আন্তর্জাতিক অভিবাসন-প্রবাহের ব্যবস্থাপনার জন্য নীতি তৈরি করে এর সমাধান করতে হবে বলে তিনি মনে করেন। অনুমান করা হয় যে গরিব দেশগুলোকে সাহায্য দেওয়া ও বাণিজ্য বাড়ালে সীমান্ত অতিক্রম করার প্রবণতা কমবে। ভাগবতী মনে করেন, এটা তখনই সত্য হবে, যখন গরিব দেশগুলোর আয় ধনী দেশগুলোর সমান হবে। স্বল্প ও মধ্য মেয়াদে এই ধরনের অনুমান একদমই ঠিক নয়। তা ছাড়া, অভিবাসন হয়ে থাকে শ্রমের চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতে।

মেধা পাচার সম্পর্কে তিনি বলেন, কোন দেশ থেকে মেধা পাচার হচ্ছে, সেটা প্রথম বিবেচ্য। চীন, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন, তাইওয়ানের মতো দেশের বিশাল দক্ষ জনবল আছে। তাই এসব দেশের জনবল বাইরে গিয়ে কাজ করতে পারলে তা তাদের জন্য সুযোগ তৈরি করে। কিন্তু আফ্রিকার কোনো দেশ, যেখানে দক্ষ জনবল কম, সেখান থেকে অভিবাসন সেসব দেশের জন্য ক্ষতিকর। তাই ঢালাওভাবে মেধা পাচার নিয়ে মন্তব্য করা ঠিক নয়। বেশি জনবলের দেশগুলোর উচিত ডায়াসপোরা মডেল অনুসরণ করা, যাতে প্রবাসীরা তাদের উত্স দেশের প্রতি আকৃষ্ট হয়। তবে এ ক্ষেত্রে প্রবাসীদের ওপরও কর আরোপ করতে হবে, যেন তারা অধিকার ও কর্তব্যের আওতায় আসতে পারে। অবৈধ অভিবাসনের ব্যাপারে ভাগবতী বলেন, এগুলোকে বন্ধ না করে কীভাবে খাপ খাওয়ানো যায়, সেই নীতি গ্রহণ করতে হবে। এর ফলে সংশ্লিষ্ট দেশ তার অর্থনৈতিক সুবিধা অর্জন করতে পারে।

চতুর্থ ভাগ

এ ভাগে ভাগবতী বিশ্বায়নকে আরও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য সঠিক শাসনব্যবস্থা প্রণয়নের ওপর আলোকপাত করেছেন। সঠিক শাসনব্যবস্থার ব্যাপারে তিনি তিনটি বিষয়ে জোর দিয়েছেন। প্রথমত, বিশ্বায়নের মানবিক চেহারা আছে বলে যে যুক্তি তিনি তুলে ধরেছেন, সে প্রেক্ষাপটে সেসব সুবিধা বৃদ্ধি করার জন্য আন্তর্জাতিক শ্রম মান ও বাণিজ্য অবরোধ ও পদ্ধতির আপেক্ষিক গুণাগুণ বিষয়ে চলমান বিতর্কের ক্ষেত্রে নীতি গ্রহণ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, যেহেতু অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন সব সময় অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয়গুলোর উন্নতি করে না, তাই ‘সঠিক নীতি’ বলতে কী বোঝানো হচ্ছে, তা সংজ্ঞায়িত করতে হবে। তৃতীয়ত, বিশ্বায়নে উত্তরণ-প্রক্রিয়ায় ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে নীতি গ্রহণ করতে হবে। যেহেতু উত্তরণ ঘটলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিধা নিশ্চিত হবে, তাই কত দ্রুততায় বিশ্বায়নে উত্তরীত হওয়া উচিত, সে বিষয়ে আলোকপাত করতে হবে।

শাসনব্যবস্থার ক্ষেত্রে তিনি ‘শেয়ারড সাকসেস’ বা অংশীদারিমূলক সাফল্যের কথা বলেছেন। যেমন ‘পলুটার পে’ নীতি গ্রহণ করা হলেই চলবে না, তা পর্যবেক্ষণের জন্য এনজিওগুলোর সঙ্গে অংশীদারি গড়ে তুলতে হবে। তবে তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ইন্টারডিপেনডেন্স বা আন্তনির্ভরশীলতার নামে পাবলিক গুডসের ক্ষেত্রে কোনো শক্তিশালী দেশ সামাজিকভাবে ক্ষতিকর নীতি গ্রহণ করতে পারে, যেমন মেধা সম্পত্তি অধিকারের ক্ষেত্রে। সে ক্ষেত্রে বাকিদের সাবধানে পথ চলতে হবে।

বিশ্বায়নের নেতিবাচক দিকগুলোর সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ষোলো নম্বর অধ্যায়ে আলোচনা রয়েছে। তিনি মনে করেন, নেতিবাচক দিকের ভয়ে পরিবর্তন ঠেকিয়ে না দিয়ে সেগুলোকে মোকাবিলা করার জন্য সঠিক প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে হবে। নেতিবাচক প্রভাবের পূর্বানুমান করার জটিলতা ও অসুবিধার বিষয়েও আলোচনা করেছেন ভাগবতী।

এ ছাড়া এই ভাগে তিনি সামাজিক অ্যাজেন্ডাগুলোর ক্ষেত্রে অর্জনগুলোকে ত্বরান্বিত করার বিভিন্ন পদ্ধতি বলেছেন। বিশ্বায়নে উত্তরণের ক্ষেত্রে বাণিজ্য উদারীকরণ কোন গতিতে এগোবে, সে নিয়েও আলোচনা রয়েছে। স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিত্স বিশ্বায়নের সমালোচনা করে বলেছেন যে উন্নয়নশীল দেশে এমনিই বেকারত্বের হার অনেক বেশি। বাণিজ্য উদারীকরণ করা হলে তা আরও বেড়ে যাবে। এর জবাবে ভাগবতী বলেছেন, আমদানি খাত থেকে চাকরি গেলে বাণিজ্য উদারীকরণের ফলে যে রপ্তানি খাত সৃষ্টি হবে, সেখানে নতুন চাকরি সৃষ্টি হবে। ফলে জাতীয় আয়ে কোনো তারতম্য সৃষ্টি হবে না (পৃ. ২৫৫)। কিন্তু বিশ্বায়নের মানবিক চেহারা আছে—এটা প্রমাণ করতেই ভাগবতী এই বই লিখতে বসেছিলেন। এ রকম সরল অর্থনৈতিক সমীকরণে মানবিক চেহারা আছে বলে মনে হয় না। আমদানি খাতের শ্রমিকই যে রপ্তানি খাতে কাজ পাবে, সে রকম নিশ্চয়তা নেই। সুতরাং যার চাকরি যাবে তার সরাসরি ক্ষতির দিকটি এখানে গুরুত্ব পায়নি।

পঞ্চম ভাগ ও উপসংহার

শেষ ভাগটি এক পাতার একটি উপসংহার। এখানে ভাগবতী নতুন করে শুরু করার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি মনে করেন, বিশ্বায়নের সমালোচকেরা সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে জনগণকে উদ্বেলিত করতে চায়। কিন্তু শুধু আবেগ দ্বারা উদ্বেলিত না হয়ে যুক্তি দিয়ে সবকিছু বিবেচনা করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। বিশ্বায়নের মানবিক চেহারা নেই বলে যে অভিযোগ করা হয়, সেটি সত্যি নয়। আর তা যুক্তি দিয়ে বিশ্লেষণ করার উপাদানগুলো এই বইয়ে তিনি তুলে এনেছেন বলে মনে করেন।

শেষ কথা

ভাগবতী বিশ্বায়নের সমস্যাগুলোকে অস্বীকার করছেন না। তাই তিনি চতুর্থ ভাগে বিশ্বায়নের ঝুঁকিগুলোর সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর কথা বলেছেন। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য মুক্ত বাণিজ্য কৌশলই যে উত্তম, সেই বিশ্বাসে অনড় থেকেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর এমন কোনো অর্থনীতির দেশ নেই, যেটা সবার জন্য সুবিধা তৈরি করে উন্নত হয়েছে। যখন একটা দেশ ধনী হয় এবং অর্গানাইজেশন অব ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বা ওইসিডি মর্যাদা লাভ করে এবং তারপর প্রবৃদ্ধি কমে যায়, তখন মুক্ত বাণিজ্য অনেককে আরও খারাপ অবস্থার দিকে নিয়ে যেতে পারে। এটা বিশ্বায়নের বিরোধিতার একটা যুক্তি, যেখানে ভাগবতী তেমন কোনো মনোযোগ দেননি। বেশির ভাগ অর্থনীতিবিদের মতোই ভাগবতী বাজারব্যবস্থা যে পদ্ধতিতে কাজ করে, তা নিয়ে এতই সন্তুষ্ট যে অর্থনীতিবিদদের বাইরে অন্যদের ব্যাপক অসন্তুষ্টিকে স্বীকার করেন না। এই অসন্তুষ্টির সাথে পুঁজিবাদের প্রতি বৈরিতার কোনো সম্পর্ক নেই। এই বিষয়টা বোঝা যায় যখন ভাগবতী অধৈর্য হয়ে প্রশ্ন রাখেন যে এর বাইরে কোনো বিকল্প বেশি ভালো হতো কি না। সামাজিক পরিবর্তন যেগুলো বিশ্বায়নের ফলে হচ্ছে বলে মানুষ বিশ্বাস করে, সেগুলোর জট খোলার ক্ষেত্রে তার আরেকটু ব্যাখ্যা করা উচিত ছিল। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ওপর আলাদা করে অধ্যায় থাকা উচিত ছিল, কারণ বিশ্বায়নের বিরোধিতা যারা করে তাদের এসব আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে যথেষ্ট উদ্বেগ রয়েছে।

ভাগবতী বিশ্বায়নে বিশ্বাস করেন, কারণ তিনি মনে করেন, মুক্ত অর্থনীতির ফলে যে অর্থনৈতিক একীভূতকরণ, বাণিজ্য ও বিশেষায়িতকরণ ঘটবে, তার ফলে গরিব দেশগুলো উপকৃত হবে। কিন্তু তিনি বর্তমানের বিশ্বায়ন-প্রক্রিয়ার বদলে আরও বেশি মানবিক চেহারাসম্পন্ন বিশ্বায়ন চান এবং সে ক্ষেত্রে এনজিওগুলোকে বিশ্বায়নের বিরোধিতা করার পরিবর্তে এর বিবর্তনে সহায়তা করার কথা বলতে চান।

ইন ডিফেন্স অব গ্লোবালাইজেশন বিশ্বায়নের অনেক বিষয়ে চমত্কার একটি ধারণা পাওয়ার জন্য খুবই প্রয়োজনীয় একটি বই। ভাগবতীও বিশ্বায়নের বাস্তব উদাহরণ ও যুক্তি দিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন কেন অবরুদ্ধ অর্থনীতির চেয়ে উন্মুক্ত অর্থনীতি ভালো, যদিও উপস্থাপনা অনেকাংশেই আশানুরূপ নয়। বিশ্বায়ন বিষয়ে যেকোনো আগ্রহী পাঠক এ বইয়ে এ বিষয়ক অনেক তথ্যসূত্র পাবেন। তবে কিছু কিছু বিষয়ে আরও বেশি স্পষ্টতা এবং অনেক যুক্তির আরেকটু গভীর বিশ্লেষণ প্রয়োজন ছিল।

এই বই আলোচনার উদ্দেশ্য ছিল জগদীশ ভাগবতীর মতো বিশ্বায়নের বড় সমর্থক ও তাত্ত্বিকের যুক্তিগুলোকে উপস্থাপন করা। কারণ বর্তমানে বিশ্বায়ন হুমকির মুখে পড়েছে বলে বিশ্লেষকেরা বলছেন। সে হুমকিগুলো কী এবং কীভাবে তৈরি হচ্ছে, তা ভাগবতীর যুক্তির সঙ্গে বর্তমান ঘটনাগুলো মিলিয়ে নিলে বুঝতে সুবিধা হবে।

তথ্যসূত্র 

১.         Thomas Greven, ‘The Rise of Right-wing Populism in Europe and the United States: A Comparative Perspective’, Friedrich-Ebert-Stiftung, May 2016, p. 4. can be accessed at: http://www.fesdc.org/ fileadmin/user_upload/publications/RightwingPopulism.pdf

২.         Paul Denlinger, ‘2016: Why is right-wing populism on the rise across the world?’, Quora, June, 29, 2016, can be accessed at: https://www.quora.com/2016-Why-is-right-wing-populism-on-the-rise-across-the-world

৩.        Globalizatoin 101, ‘What is GLobalization’, can be accessed at: http://www.globalization101.org/what-is-globalization/

৪.         Graham Research Institute on Climate Change and the Environment, The London School of Economics and Political Science, can be accessed at:

            http://www.lse.ac.uk/GranthamInstitute/faqs/what-is-the-polluter-pays-principle/

৫.         ড. বদরুল ইমাম, ‘শেভরন কোম্পানির বিতর্কিত প্রস্থান প্রস্তুতি’, প্রথম আলো, ৪ মে, ২০১৬