মেকিং গ্লোবালাইজেশন ওয়ার্ক—জোসেফ ই স্টিগলিত্স, নরটন পেপারব্যাক ২০০৭ সম্ভবত, গত দুই দশকে সারা পৃথিবীতে বিশ্বায়ন শব্দটিই সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে। এর পক্ষে-বিপক্ষে অনেক কথা হয়েছে। কিন্তু গত এক বছরেরও কম সময়ে ব্রেক্সিট এবং মার্কিন নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো একজন জনতুষ্টিবাদী ব্যক্তির নির্বাচিত হওয়ার পর বিশ্বায়নের ভবিষ্যত্ হুমকির মুখে পড়ে গেছে। অন্যভাবে বললে, বিশ্বায়নের কারণেই এই দুটি যুগান্তকারী ব্যাপার ঘটেছে। প্রথমত, ব্রিটেন বিশ্বায়নের ‘কুপ্রভাব’ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে গেল। দ্বিতীয়ত, ট্রাম্পের মতো একজন খাপছাড়া ধনকুবের বিশ্বায়নবিরোধী স্লোগান দিয়ে বিশ্বায়নের নেতৃত্বদানকারী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন। এতকাল শুধু গরিব দেশগুলো বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ ছিল, এখন তাদের সঙ্গে ধনী দেশগুলোও যুক্ত হলো। বাস্তবতা হলো, বিশ্বায়নবিরোধী সবচেয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া এখন সেখানেই দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কেন এমন হলো, কথা ছিল, বিশ্বায়নের বদৌলতে সবারই উন্নয়ন হবে। এটি মূলত অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন নিয়ে লিখিত। ঠিক এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ ই স্টিগলিত্স মেকিং গ্লোবালাইজেশন ওয়ার্ক নামের বইটি লিখেছেন। স্টিগলিত্স ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত তত্কালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিনটনের কাউন্সিল অব ইকোনমিক অ্যাডভাইজার্সের চেয়ারম্যান এবং ১৯৯৭ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রধান অর্থনীতিবিদ হিসেবে কাজ করেছেন। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি বুঝতে পারেন, বিশ্বায়ন নিয়ে মানুষের মধ্যে এত অসন্তোষ কেন। হোয়াইট হাউস ও বিশ্বব্যাংকের একদম কেন্দ্রে বসে তিনি দেখেছেন, কীভাবে নীতি প্রণীত হয়। ফলে বিশ্বব্যাংক ছাড়ার পর তিনি প্রথমে গ্লোবালাইজেশন অ্যান্ড ইটস ডিসকনটেন্টস নামে একটি বই লেখেন। সেই বইয়ে তিনি আন্তর্জাতিক অর্থব্যবস্থা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতার বিবরণ লিপিবদ্ধ করেন। তিনি দেখিয়েছেন, বিশ্বায়নের কারণে যত মানুষের উপকৃত হওয়ার কথা ছিল, তত মানুষ উপকৃত হয়নি। আর বক্ষ্যমান বইয়ের মুখবন্ধে তিনি বলেন, এই সমস্যার জাদুকরি সমাধান নেই তা সত্য। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই পরিবর্তনের সুযোগ আছে। সে যেমন আমাদের নীতি প্রণয়নের জায়গায় পরিবর্তনের সুযোগ আছে, তেমনি অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান, বিধিবিধান ও মনোভাবেও পরিবর্তন আনার সুযোগ আছে। এতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বিশ্বায়ন অধিকতর কার্যকর হবে। তিনি বলেন, কিছু কিছু পরিবর্তন অনিবার্যভাবেই আসবে। চীন ও ভারতের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, প্রথম দেশটি বিশ্ব অর্থনীতিতে উত্পাদক হিসেবে এবং দ্বিতীয় দেশটি আউটসোর্সিংয়ে সফলতা অর্জন করায় ইতিমধ্যে বৈশ্বিক চিন্তা ও নীতিতে পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। কিছুদিন আগেই জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন কার্যালয়ের পরিচালক ড. সেলিম জাহানের সাক্ষাত্কার নিলাম। বিশ্বায়ন প্রসঙ্গে তিনি বললেন, বিশ্বায়নের বদৌলতে পণ্য, পুঁজি ও সেবার অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত হয়েছে। কিন্তু মানুষের অবাধ যাতায়াত নিশ্চিত হয়নি। আবার বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালের রীতিতে চলছে। অর্থাত্ বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট হবেন একজন মার্কিন নাগরিক, আর আইএমএফের প্রধান হবেন একজন ইউরোপীয় নাগরিক। এরপর রাশিয়া এখনো জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য। কথা হচ্ছে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এসব চলতে পারে না। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানে কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে হবে। বিশ্বব্যবস্থায় ভারসাম্য আনার জন্যই এটা দরকার।
ব্যাপারটা হলো, দুটি বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকা দেখার পর উন্নত দেশগুলোর বোধোদয় হয়, এসব করে লাভ নেই। বরং এবার যুদ্ধবিগ্রহ থামিয়ে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে চলতে হবে। সে কারণেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে নানা রকম বহুপক্ষীয় প্রতিষ্ঠানের উদ্ভব হয়। ১৯৪৫ সাল থেকে আন্তর্জাতিকতাবাদই সব ক্ষেত্রে প্রাধান্য পেতে থাকে। তারা সহযোগিতা ও বহুপক্ষীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শান্তি, নিরাপত্তা, আর্থিক স্থিতিশীলতা ও টেকসই পরিবেশের মতো বৈশ্বিক সেবা সবার দ্বারে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। তাদের মডেলটা এ রকম: জাতিরাষ্ট্রগুলোকে এক সূত্রে বেঁধে অভিন্ন মানদণ্ড, রীতি ও চুক্তির ভিত্তিতে পরিচালনা করা।
জাতির মহিমা খুঁজতে গিয়ে হিটলার কী করেছিলেন, তা আমাদের অজানা নয়। তাঁর কারণে সারা পৃথিবীতে রক্তস্রোত বয়ে গিয়েছিল, যাকে বলে হলোকাস্ট। ধ্বংস হতে বসেছিল এতকালের সভ্যতা। এটাকে দ্বিপক্ষীয় ব্যবস্থার চূড়ান্ত পরিণতি বলা যেতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তত্কালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল ১৯৪১ সালে আটলান্টিক সনদ স্বাক্ষর করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালের বিশ্বব্যবস্থা হিসেবে এতে ঘোষণা করা হয়, শান্তির ভিত্তি হচ্ছে স্বাধীনতা। তাই দ্বিপক্ষীয় ব্যবস্থা সংকুচিত করতে হবে। ছোট দেশ বড় দেশের করদ রাজ্য হিসেবে থাকতে পারে না। আর কোনো ভূমি দখল নয়, নতুন করে জোরপূর্বক শুল্ক আরোপ নয়; অন্যদিকে সমুদ্র স্বাধীন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির জয় ও আটলান্টিক সনদ থেকে আমরা এক নতুন বৈশ্বিক চুক্তি পেলাম। অর্থাত্ তখন থেকে আন্তর্জাতিক নিয়ম ও প্রতিষ্ঠান মেনে চলে সব দেশ বৈশ্বিক খেলায় অংশ নিতে শুরু করে। এটাকে বহুপক্ষীয় বিশ্ববাদ বলা যায়। ফ্রান্স ও জার্মানির মধ্যে পুনঃসমঝোতা হয়, যার মাধ্যমে ইউরোপের মতো দীর্ঘ দ্বন্দ্ব-বিবাদে জর্জরিত অঞ্চল সহযোগিতার অসাধারণ নজির স্থাপন করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে জাতীয় সার্বভৌমত্বের রাশ টেনে ধরা হলো, ফলে পৃথিবীর সমৃদ্ধির চাকা অনেক দ্রুতগতিতে ছুটতে শুরু করল। কোটি কোটি মানুষ দারিদ্র্যের চক্র থেকে বেরিয়ে এল। আপেক্ষিকভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হলো।
বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে স্টিগলিত্স আমাদের বলেন, গত দেড় শতকে পৃথিবীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র ছিল জাতিরাষ্ট্র। কিন্তু বিশ্বায়নের কারণে এই জাতিরাষ্ট্রের ভূমিকা ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। একদিকে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক শক্তি, অন্যদিকে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের রাজনৈতিক দাবি—এ দুইয়ে মিলে এমনটা হচ্ছে। পৃথিবীর দেশগুলো ক্রমশ অঙ্গীভূত হচ্ছে, ফলে অনেক ক্ষেত্রেই এখন সামষ্টিক ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই, একত্রে কাজ করতে গেলে সমন্বয়ের বিকল্প নেই। আমাদের সামনে এখন এত এত সমস্যা আছে, যেগুলো কেবল বৈশ্বিক পরিসরেই সমাধান করা সম্ভব: বাণিজ্য, পুঁজি ও পরিবেশ। বিশেষ করে, পরিবেশের কথা আমরা বলতে পারি, কারণ, বাংলাদেশের মতো দেশ বৈশ্বিক উষ্ণায়নে কিঞ্চিত্ ভূমিকা রাখলেও এ কারণে যে কটি দেশ বেশি ভুগছে, বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। স্টিগলিত্স আমাদের বলছেন, জাতিরাষ্ট্র দুর্বল হলেও আন্তর্জাতিক পরিসরে এমন কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি, যার মাধ্যমে বিশ্বায়নসৃষ্ট সমস্যাসমূহ কার্যকরভাবে আমলে নেওয়া সম্ভব।
এই পরিপ্রেক্ষিতে স্টিগলিত্স বলছেন, অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের গতি রাজনৈতিক বিশ্বায়নের গতি ছাড়িয়ে গেছে। আমাদের বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থাটা বিশৃঙ্খল ও সমন্বয়হীন হয়ে পড়েছে। একগাদা কিছু প্রতিষ্ঠান গজিয়ে উঠেছে, কিছু মতৈক্য ও বন্দোবস্ত আছে, কিন্তু বৈশ্বিক সরকার-জাতীয় কিছু গড়ে ওঠেনি। বিভিন্ন দেশের অর্থমন্ত্রীরা আন্তর্জাতিক মুদ্রা সংস্থায় গিয়ে অর্থনৈতিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন। তাঁদের সিদ্ধান্ত কীভাবে পরিবেশ বা বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় প্রভাব ফেলছে, সে ব্যাপারে তাদের ভ্রুক্ষেপ নেই। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন নিয়ে পরিবেশমন্ত্রীরা হয়তো কিছু করার আহ্বান জানাতে পারেন, কিন্তু সেটা চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো ক্ষমতা তাঁদের হাতে নেই।