বিশ্বায়ন: বিতর্কিত এক ভুবন

There are decades where nothing happens and there are

weeks where decades happen- Lenin

সারসংক্ষেপ

‘বিশ্বায়ন—এক বিতর্কিত ভুবন’ নামে এই প্রবন্ধের মূল আলোচ্য বিষয় হলো বিশ্বব্যাপী সমাজ, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, রাষ্ট্র এবং অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যে যোগাযোগ গড়ে উঠেছে, তার চরিত্র বিশ্লেষণ করা। অতি প্রাচীনকাল থেকে এই যোগাযোগ নানা মাত্রায় গড়ে উঠলেও সোভিয়েত শাসনব্যবস্থার পতনের পর থেকে সেটি দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই যোগাযোগে মুখ্য ভূমিকায় রয়েছে শক্তিশালী রাষ্ট্র, বহুজাতিক করপোরেশন এবং আমেরিকার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ওয়াশিংটন সমঝোতার (Washington Consensus) সঙ্গে যুক্ত চারটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, বিশ্বব্যাংক এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা আন্তর্জাতিক পুঁজির প্রসারে যেমন ভূমিকা রাখে, তেমনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরাশক্তিগত ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ রাখতে তাদের বিশেষ অবদান রয়েছে। বিশ্বায়নের নামে মানুষ, রাষ্ট্র, সমাজ ও জাতিকে একীভূত করে বিশ্ব পুঁজি নতুন নতুন ক্ষমতাকাঠামোর জন্ম দিচ্ছে ঠিকই। কিন্তু সেই সঙ্গে পুঁজির ক্ষমতাবলয়ে পৃথিবীর বৃহত্তর জনগোষ্ঠী কেবল অর্থনৈতিকভাবে শোষিত হচ্ছে তা-ই নয়, তার সঙ্গে সঙ্গে জন্ম নিচ্ছে সামাজিক অস্থিরতা, আত্মপরিচয়ের সংকট, ধর্মীয় উগ্রপন্থার অসীম বিস্তার, স্থানীয় সংস্কৃতির উচ্ছেদ। বিশ্বায়নের অনুষঙ্গ হিসেবে এগুলোর ওপর আলোকপাত করা এ প্রবন্ধের আরও একটি উদ্দেশ্য।

মুখ্য শব্দগুচ্ছ

বিশ্বায়ন, আত্মপরিচয়ের সংকট, ওয়াশিংটন সমঝোতা, আন্তর্জাতিক পুঁজি, সংস্কৃতির উচ্ছেদ, ক্ষমতাকাঠামো, নিও লিবারেল অর্থনীতি, টার্বো ক্যাপিটালিজম (Turbo Capitalism), ক্যাপিটালিজম অব নাথিং, মৃদু সর্বত্যাগবাদী (Gentle Nihilism) মনোভাব।

ভূমিকা

বেশ কয়েক দশক ধরে বিশ্বব্যাপী আমরা এক অদ্ভুত প্রবাহ লক্ষ করছি। সেই প্রবাহ মহাপ্রলয়ের মতো দেশ, অঞ্চল, জাতি ও রাষ্ট্রকে গ্রাস করে অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলেছে। বিগত বিশ বছর ধরে অস্ট্রেলিয়ার সিডনি শহরে বাস করে এই প্রবাহকে দেখার সুযোগ পেয়েছি খুব কাছ থেকে। চোখের সামনেই দেখতে পেয়েছি ‘ডাউন আন্ডার’ নামে পরিচিত এই দেশের সবচেয়ে জনবসতিপূর্ণ ওই শহর বিগত দুই দশকের মধ্যে কীভাবে বদলে গেল। যে নিভৃত আঞ্চলিকতা তার গায়ে এককালে সেঁটে ছিল, সেই জীবনকে ঝেড়ে ফেলে সে আবির্ভূত হচ্ছে নতুন এক রূপে। তার কপালে বিশ্ব শহরের তিলক। নানা বর্ণ, জাতি, আকার ও প্রকৃতির মানুষ এখানে বাস করে। এমনকি আয়তনে ক্ষুদ্র, দরিদ্র এবং বিশ্বরাজনীতিতে গুরুত্বের পরিমাপে নগণ্য হয়েও টুকরো টুকরো বাংলাদেশ এই শহরেরই আনাচকানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। স্বদেশের স্বাগতিক এই উপস্থিতি এককালে দুষ্প্রাপ্য থাকলেও আজ পরিস্থিতি বদলে গেছে। দেশীয় রকমারি দ্রব্যের সঙ্গে এখানকার সুপারমার্কেটে হোঁচট খাওয়াটা আজ বলা চলে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। পোশাকশিল্পের সঙ্গে ইলিশ, মুগ, মসুর, সরিষার তেল, দেশে তৈরি হাঁড়ি-পাতিল, চানাচুর, মসলার অভাব নেই। দৈনন্দিন জীবনের রকমারি অপরিহার্য দ্রব্যগুলোও আজ প্রবাসী বাঙালির হাতের পূর্ণ নাগালে। এই শহরের আনাচকানাচে ব্যাঙের ছাতার মতো আরও গজিয়ে উঠেছে বাঙালি রেস্তোরাঁ, দোকানপাট। ট্যাক্সি ভ্রমণে বাংলাদেশি ড্রাইভারের সাক্ষাত্ও বিরল নয়। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও রয়েছে বাঙালির সরব উপস্থিতি। হাজার হাজার স্বদেশি শিক্ষার্থী এখানকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে লেখাপড়া করে। আর উপরিপাওনা হিসেবে বাংলাদেশকে জানেন, চেনেন বা তার দৈনন্দিন জীবনের খোঁজখবর রাখেন, এমন অস্ট্রেলীয় নাগরিকের সংখ্যাও যত্সামান্য নয়। বস্তুত সে সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আমাদের ইদানীংকালীন সাফল্যের কল্যাণে।

এই চিত্রপটের উল্টো আরও একটি দিক আছে। রোমাঞ্চের দিক থেকে সেটি কম গুরুত্বের নয়। কথাটি তো কোনো অত্যুক্তি নয় যে বাংলাদেশে বসে বিদেশের অভাববোধ আজ বড় একটা হয় না। রাজধানী ঢাকা শহরের বিলাসী সুপারমার্কেট তার সাক্ষাত্ প্রমাণ। সেখানে বিদেশি দ্রব্যের প্রচণ্ড প্রতাপে বাংলাদেশের ঘরকনে, গিন্নি এবং আপামর বাঙালির হূদয় ক্রমাগত সিক্ত হচ্ছে। পরিমাণগত দিক থেকে এই আসক্তির প্রতাপ এতই গভীর যে দূর অতীতের ব্রিটিশ বা পাকিস্তানি আমলের অধীনস্থ মানসিকতাকেও মলিন করে দেয়। যে আনুগত্য পুরোনো ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার প্রতি এককালে আমরা দেখিয়েছি, এই নতুন আনুগত্য তার চেয়েও ভয়ংকর, যেহেতু এবার তার প্রভাববলয়ে যারা অন্তর্ভুক্ত তারা সাধারণ মধ্যবিত্তের বিশাল এক বাহিনী—কেবল সৌভাগ্যবান এবং মুষ্টিমেয় বিত্তবান শ্রেণি নয়। আরও রয়েছে মূল্যবান, বিলাসী এবং এককালে নাগালের বাইরে থাকা দ্রব্যের বিপুল ভান্ডার। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এদের অনেকে এতই পরাক্রমশালী যে পশ্চিমা বিশ্বের বিত্তশালীদের দলে তাদের স্বাছন্দ্যে অন্তর্ভুক্ত করা চলে। ইন্দ্রিয়সুখ নিবারণের যাবতীয় উপাদানে ভরপুর এসব বিদেশি ভান্ডার এদের জন্য আজ উন্মুক্ত। ম্যাকডোনাল্ডস, কেএফসি, পিত্জা হাট—আধুনিক ভোগবাদী সভ্যতার নির্ভুল সব প্রতীক বাংলার মাটিতে বেসাতি বসিয়ে বিদেশের খণ্ড খণ্ড কিন্তু নিঃসন্দেহে ঘনীভূত উপস্থিতিকে নিশ্চিত করছে। বিদেশি পণ্যের বাঙালীকরণের সাম্প্রতিক এই ধারা অনেকটা অজান্তেই স্থান করে নিচ্ছে আমাদের মানসিকতায়। ইংরেজি শিক্ষার বাধাহীন বিস্তার, বিদেশি স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার তীব্র বাসনা, পোশাক-পরিচ্ছদে বিদেশি ছাপ, বাংলা কথোপকথনে ইংরেজি শব্দের উদার প্রয়োগ, উচ্চারণভঙ্গিমায় ইংরেজির দ্বারস্থ হওয়া—এসবই বাঙালির সমষ্টিবদ্ধ জীবনে যোগ করছে নতুন মাত্রা। ফলে কোনটি স্বদেশ আর কোনটি বিদেশ, কাকে দেশপ্রেম বলব আর কার গলায় ঝুলিয়ে দেব দেশত্যাগী ‘বিশ্বাসঘাতক’-এর সংজ্ঞা, সেই অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব্বে আজ জর্জরিত হচ্ছি আমরা সবাই।

কেবল সিডনি বা ঢাকা শহরকেই বা বলি কেন। প্রবণতাটি যে সীমিত বা স্থানীয় গণ্ডি পেরিয়ে আজ বিশ্বপ্রক্রিয়ায় পরিণত হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। পৃথিবীর প্রতিটি শহর, দেশ, জাতি কোনো না কোনোভাবে এই অবিশ্বাস্য দ্বিমুখী প্রবণতায় প্রভাবিত হচ্ছে। আর সে কারণে এককালের সনাতনী রূপকে আগলে রাখা সম্ভব হচ্ছে না কারও পক্ষে। মানুষের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয় বদলে যাচ্ছে। এত কিছু ঘটে চলেছে অথচ প্রবণতাটি কেন জানি আমাদের দেশীয় প্রেক্ষাপটে তেমন আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়নি। কেন হয়নি তার সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যাখ্যা থাকলে সান্ত্বনার ব্যাপার ছিল। কিন্তু যেসব বিজ্ঞান থেকে আমরা জ্ঞান লাভ করি, তারা এ ক্ষেত্রে কেন কোনো সহায়ক ইতিবাচক ভূমিকা রাখল না, সে প্রশ্ন গুরুত্বের বিচারে সামান্য নয়। সমাজবিজ্ঞানের কথা ধরা যায়। বহুদিন ধরে তাঁরা স্থানীয় সমাজ নিয়ে আমাদের ভাবতে শিখিয়েছে, নিজেরা ভেবেছেন। জোর দিয়েছেন স্থানীয় সমাজের মূল্যবোধের ওপর। তত্ত্ব গড়েছেন কীভাবে সমাজকে স্থিতিশীল রাখা যায়। কিন্তু বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সমাজদেহে যেসব পরিবর্তন অন্তঃস্রোতের মতো বয়ে চলেছে তার কোনো খবর রাখা হয়নি। ওই একই অভিযোগ রয়েছে নৃবিজ্ঞানী সমাজের প্রতি। তারাও খণ্ডিতভাবে জাতি, রাষ্ট্র বা স্থানীয়তার ওপর জোর দিতে গিয়ে স্থানীয় জীবন, সংস্কৃতি ও ভাষার বৈচিত্র্যের মধ্যে জ্ঞানচর্চাকে সীমাবদ্ধ রেখেছে—বৈশ্বিক প্রভাবকে অনেকটা উপেক্ষা করে। সব মিলিয়ে বিশ্বায়ন শব্দটি আমাদের ধ্যানে কখনো গবেষণাযোগ্য বিষয় হিসেবে স্থান করে নেয়নি। তবে আশার কথা, বিষয়টি ধীরে ধীরে আমাদের নজরে আসতে শুরু করেছে। হতে পারে বাংলাদেশ যেভাবে বিশ্বায়ন-প্রবাহে ভেসে চলছে, সেটি আজ কারও দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়। বিশ্বায়ন তো কেবল পোশাকশিল্পসহ সীমিত কিছু অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডেই দৃশ্যমান নয়। তার প্রভাব আজ লক্ষ করছি নানা ক্ষেত্রে। সেই প্রভাবে আক্রান্ত হচ্ছে আমাদের আদর্শের জগত্, আত্মপরিচয়, সংস্কৃতি, ধর্ম, কৃষ্টির বলয়—জীবনের আরও নানা দিক। ফলে বিশ্বায়নকে উপেক্ষা করার দিন শেষ। প্রয়োজন তাকে নিয়ে বিস্তৃত আলোচনায় অবতীর্ণ হওয়া।

বিশ্বায়নকেন্দ্রিক আলোচনার ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। একটি তার শুরু নিয়ে। অনেকে মনে করেন যে সেটি অতি সাম্প্রতিক সময় থেকে ধরা প্রয়োজন। সাম্প্রতিক বলতে তাঁরা বোঝেন সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পতন থেকে। যেসব কারণে বিশ্বায়ন আজ এত গতিশীল, সেগুলো ওই সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পতনের সময় থেকে লক্ষ করা গেছে। বস্তুত ওই সময় থেকে পৃথিবী অনেক বেশি উন্মুক্ত হয়ে ওঠে। নানা দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অবাধ বাণিজ্য এবং পণ্য চলাচলের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। যোগাযোগব্যবস্থায় গুণগত পরিবর্তন এসে দূর হয়েছে সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা। ফলে আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় পৃথিবীর রূপ আজ অনেক বেশি খোলামেলা। বিশ্বায়নের কৃতিত্ব সে কারণে যদি কাউকে দিতে হয় তাহলে সেটি ওই ১৯৯১ সালকে। এই বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গিকে অযৌক্তিক বলছি না। কিন্তু একেবারে সাম্প্রতিক সময় থেকে তাকে দেখা আমার কাছে ঠিক মনে হচ্ছে না। সমাজবিজ্ঞানের প্রখ্যাত তাত্ত্বিক সি রাইট মিলস কী লিখেছিলেন সেটি তো আমরা জানি। যেকোনো সামাজিক ইস্যুকে তিনি বিশ্লেষণ করতে উপদেশ দিয়েছিলেন চারটি দিকের প্রতি মনোযোগী হয়ে। ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সমস্যাকে দেখা ছিল তার মধ্যে প্রধান। সে কারণে বিশ্বায়নের ভ্রূণ যদি খুঁজতে হয়, তাহলে ১৯৯১ সাল থেকে শুরু করা ঠিক হবে। সেই ভ্রূণ গভীর অতীতে নিহিত। যত সীমিত আকারেই হোক না কেন, আরও গভীর অতীতে গিয়ে তাকে বুঝতে হবে।

এ তো গেল পদ্ধতিগত দিক। এর সঙ্গে যোগ করতে হবে বিশ্বায়নের কাঠামোগত দিককে। অনেকে ভাবেন বিশ্বায়ন মানেই আমেরিকাকরণ। সেভাবে বিশ্বায়নকে বলা হয় ম্যাকডোনাল্ডকরণ, কোকাকোলাকরণ বা হলিউডকরণ। মেনে নিচ্ছি আমেরিকার অবদান মুখ্য। কিন্তু তাই বলে অন্যান্য দেশ বা অঞ্চলের কোনো ভূমিকা নেই, সেটি ভাবা ভুল। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন অঞ্চল বা দেশ নানাভাবে বিশ্বায়নকে এগিয়ে নিয়েছে। বস্তুত কার অবদান কতটুকু সেটি নির্ভর করেছে ওই সব দেশের অভ্যন্তরীণ উন্নয়নের মাত্রার ওপর। অর্থাত্ তুলনামূলকভাবে কে কার থেকে কতটুকু এগিয়ে ছিল। হয়তোবা এই কারণে বিশ্বায়নের সুফল সব দেশ বা অঞ্চল সমানভাবে ভোগ করেনি। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশ দুর্বল দেশকে শোষণ করেছে। বিশ্বায়নের চালিকাশক্তি হিসেবে তারাই রেখেছে সবচেয়ে বড় ভূমিকা। যারা বিশ্বায়নের কড়া সমর্থক, তারা অসাম্যের এই অন্তর্নিহিত দিকটি উপেক্ষা করে থাকেন। বিশ্বপুঁজির বিরুদ্ধে সমালোচনাকে বেশ সুচতুরভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়। সাধারণ মানুষের পক্ষেও অসাম্যের চিত্রটি বুঝে ওঠা কঠিন। কারণ পুঁজি এবং পুঁজিবাদী উত্পাদন আজ জাতিরাষ্ট্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। একই পণ্যের বিভিন্ন অংশ উত্পাদিত হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। ফলে শোষণের দায়ভার কার ওপর পড়বে তা নিয়ে দ্বিধা আছে। শোষণকে হয় পুরোপুরি অস্বীকার করা হচ্ছে অথবা তার দায়ভার কে নেবে সে বিষয়ে সুস্পষ্ট অবস্থান নেওয়া যাচ্ছে না। এই অসমতার প্রতিফলন আমরা লক্ষ করি কয়েকটি পর্যায়ে—আঞ্চলিক, আন্তদেশীয় ও অন্তর্দেশীয়। ফলে ক্ষমতা ও সম্পদের অসম বিতরণের এই দিকটি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত। উদ্ভূত এই অসাম্যের সঙ্গে আরও যোগ হচ্ছে আমাদের আত্মপরিচয়, সংস্কৃতি, ধর্ম, দীর্ঘদিন ধরে লালিত এবং ধারণ করা মূল্যবোধ ও বিশ্বাসের জগত্। সংকটের কালো মেঘ এগুলোকেও আচ্ছন্ন করছে। ফলে বিশ্বায়নের প্রভাবকে দেখতে হবে বহুমাত্রিক, বহুস্তরবিশিষ্ট, বহুকেন্দ্রিক এবং বৈষম্যপূর্ণ প্রক্রিয়া হিসেবে।

বিশ্বায়নের অন্য দিক হচ্ছে কঠোর শ্রেণিবিভক্তি। ওই শ্রেণিবিভক্তির কারণে ক্ষমতা ও সম্পদের ক্ষেত্রে দেখা দিচ্ছে প্রবল অসমতা। তা নিয়ে মানুষের মনে ক্ষোভ আছে। কিন্তু ক্ষোভ প্রকাশের নির্ভরযোগ্য এবং সত্ বাহক খুঁজে পাওয়া কঠিন। পশ্চিমা বিশ্বে জাতীয়তাবাদী মনোভাবের উত্থান, দেশকেন্দ্রিক ভাবনা এবং জনসন্তুষ্টিপ্রবণ রাজনীতির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাওয়ার একটি কারণ এই বিশ্বায়নবিরোধী অনুভূতি। ব্রেক্সিট একটি উদাহরণ হতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের উত্থান অথবা সার্বিকভাবে ডানপন্থী রাজনীতির নবায়িত প্রভাব আমাদের হতভম্ব করলেও তাকে বিশ্বায়নবিরোধী উচ্ছ্বাস হিসেবেই ভাবতে হয়। সংঘাত কেবল উত্তর ও দক্ষিণের (ধনী দেশ ও গরিব দেশ) মধ্যে সীমাবদ্ধ—এ ভাবনাকে বাদ দিতে হবে। প্রতিটি দেশে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব দিন দিন বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। বিশ্বায়নবিরোধী অনুভূতি আগামী দিনগুলোতে কীভাবে প্রকাশ পাবে তার সঠিক চিত্র তুলে ধরা কঠিন। কিন্তু বিষয়টি যেন আমাদের দৃষ্টি এড়িয়ে না যায়।

বিশ্বায়ন আসলে কী?

বিশ্বায়নকে বোঝা যতটা সহজ মনে হয় ততটা সহজ না। একটি সমস্যা হচ্ছে আমরা নানা পেশার মানুষ। নানা দিক থেকে বিশ্বায়নকে দেখি। তবে সহজ একটি সংজ্ঞা দিয়ে শুরু করা যায়। বিশ্বায়নকে বলতে পারি স্থান ও কালের সংকোচন (রবার্টসন ১৯৯৬: ৯)। আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল অবশ্য এই সংজ্ঞায় সন্তুষ্ট হবে না। তারা বলবে, ‘এটি এমন একটি প্রক্রিয়া যা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পণ্য, সেবা ও পুঁজিবাজারের একাঙ্গীকরণ ঘটায়। এই একাঙ্গীকরণ কয়েক দশক ধরে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য ও মুদ্রা চলাচলের ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জিত হয়েছে। পৃথিবীর প্রতিটি অঞ্চল—সে প্রত্যন্ত আর কেন্দ্রীয় হোক, এই একাঙ্গীকরণ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়েছে’ (হেল্ড, ২০০৪: ২৫)। প্রখ্যাত মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ডেভিড হেল্ড বিশ্বায়নের সংজ্ঞা দিয়েছেন রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে। তিনি বলছেন, বিশ্বায়ন হচ্ছে দূরের জনগোষ্ঠী একে অপরের সঙ্গে যেভাবে সংযুক্ত হয়েছে, যেভাবে নানা প্রতিষ্ঠান সেই সংযোগকে সফল করে তুলছে, যে ধরনের পরিবর্তন ওই সংগঠনগুলোতে লক্ষ করা যাচ্ছে এবং যেভাবে গোটা বিশ্বে ক্ষমতার বিশেষ ধরন ছড়িয়ে পড়ছে তারই একটি চিত্র মাত্র (হেল্ড, ২০০৪: ১)। হেল্ড স্বভাবতই জোর দিচ্ছেন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংগঠনের ওপর, ক্ষমতাকাঠামোর ওপর। সেই প্রক্রিয়ায় এমন একধরনের বিশ্বরাজনীতি গড়ে উঠছে, যেখানে নাগরিক হিসেবে আমাদের আনুগত্য রাষ্ট্রের চেয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার প্রতি অনেক বেশি। রাষ্ট্রের ক্ষমতা সংকুচিত হচ্ছে। তার পাশাপাশি নাগরিক সমাজ নানাভাবে অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে—প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে।

এই দুই সংজ্ঞাকে মিলিয়ে দেখলে বিশ্বায়নের সার্বিক চিত্র আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে ওঠে। সেটি বস্তুত পুরোনো পুঁজিবাদের এক নতুন স্তরমাত্র, তাতে সন্দেহ নেই। প্রায় ১৫০ বছর আগে কার্ল মার্ক্স এই দিকটির প্রতি ইঙ্গিত করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘প্রতিটি দেশে বুর্জোয়া শ্রেণির মূল লক্ষ্য বিশ্ববাজারের শোষণ। সেই উদ্দেশ্যে বুর্জোয়া শ্রেণি উত্পাদন এবং পণ্য ভোগকে সর্বজনীন করে গড়ে তুলতে চায়। একটিমাত্র দেশে উত্পাদন যে ধরনের সনাতনী চাহিদা পূরণ করত তার বদলে নতুন চাহিদা সৃষ্টি করা পুঁজিবাদের দেহের মধ্যে রয়ে গেছে। স্বনির্ভরতা এবং দেশীয় বিচ্ছিন্নতার জায়গায় আমরা লক্ষ করি নানা ধরনের লেনদেন এবং বিশ্বজনীন পারস্পরিক নির্ভরশীলতা’ (মার্ক্স ও এঙ্গেলস, ২০০৭: ১৯)। বিশ্বায়নের এই চরিত্র এবং তার অন্তর্নিহিত প্রবণতা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান যখন ক্ষমতায় এলেন তখন আরও তীব্র হলো। বাজারের হাতে তিনি সবকিছু ছেড়ে দিলেন। জর্জ বুশও অর্থনীতিকে বাজারভিত্তিক নিও লিবারেল ধারায় নিয়ে বিশ্বায়নকে বেগবান করলেন। নিজের প্রভাব এবং অর্থনৈতিক পেশিশক্তি ব্যবহার করে উন্নয়নশীল এবং দরিদ্র দেশকেও এই ধাঁচের সমাজ গড়ার পরামর্শ দেওয়া হলো। তাতে সহায়তা করল বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থা। এরই নাম দেওয়া হলো কাঠামোগত অ্যাডজাস্টমেন্ট। ওই নাম ব্যবহার করে বহুজাতিক করপোরেশনগুলো অবাধ বিনিয়োগের সুযোগ পেল দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে।

ওয়াল্লেস্টাইন নামে একজন আমেরিকান তাত্ত্বিক বিশ্বায়নের এই দিকটি লক্ষ করেছিলেন। তাকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে তিনি বেশ ভালো করেই বুঝেছিলেন কীভাবে পুঁজি একদিকে যেমন একক/অভিন্ন বিশ্ব অর্থনীতির জন্ম দিচ্ছে, অন্যদিকে সব ধরনের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাগুলোকে ধ্বংস করছে। সেই পথে পুঁজিবাদকে তিনটি পর্যায় পার হতে হয়েছে। সেগুলোর প্রতিটিকে তিনি ‘ব্যবস্থা’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। প্রথমটি ছিল ক্ষুদ্র (মিনি) ব্যবস্থা। মিনি বলার কারণ ওই ব্যবস্থা অর্থনীতি, সাংস্কৃতিক, সামাজিক বা রাজনৈতিক দিক থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল। সেই ব্যবস্থা আজ কোথাও টিকে নেই। পরবর্তী সময়ে সেটি নানাভাবে ছড়িয়ে পড়ে জন্ম নিল বড় আকারের সাম্রাজ্যের। তৃতীয় ব্যবস্থা যখন জন্ম নিল তখন পুঁজিবাদ বিশ্বব্যবস্থায় পরিণত হতে চলেছে। সেখানে পণ্য আমদানি-রপ্তানি প্রথম পর্যায়ে প্রাধান্য পেলেও পরবর্তী সময়ে পণ্য উত্পাদন ওই অর্থনীতিতে মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। লাভের আশায় পণ্য উত্পাদন করা এবং সেগুলো বাজারজাত করা—এভাবে জন্ম নেয় বাজারকেন্দ্রিক বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। প্রাথমিক পর্যায়ে পুঁজিবাদী অর্থনীতি বেশ ভঙ্গুর ছিল। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে জন্ম নিলেও তাদের মধ্যে লক্ষ করা গেছে প্রবল প্রতিযোগিতা। সেই প্রতিযোগিতায় মাত্র একটি ব্যবস্থা টিকে গেল। সেটি ইউরোপীয় পুঁজিবাদ। তার জন্মকালকে বিশেষজ্ঞরা ১৪৫০ সাল থেকে ধরেন। ওই সময় পর্তুগাল ও স্পেন ধীরে ধীরে নৌপথে বাণিজ্যের বিভিন্ন পথ আবিষ্কার করে (ভাস্কো দা গামা ভারতের পথে এবং কলম্বাস আমেরিকায়)। ওই নৌযোগাযোগের সুযোগ নিয়ে পুঁজি শান্ত ও তৃপ্ত না থেকে অক্টোপাসের মতো বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। সে কারণে কোনো রাখঢাক না করে বিশ্বায়নকে অনেকে ম্যানিক ক্যাপিটালিজম (manic capitalism), টার্বো ক্যাপিটালিজম (turbo capitalism) অথবা সুপরা টেরিটরিয়াল ক্যাপিটালিজম (supra territorial capitalism) বলে সম্বোধন করছেন। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে জাতিরাষ্ট্রের কাঠামোর বাইরে না রেখে এই পুঁজিবাদ তার উন্নতি নিশ্চিত করতে পারে না। ভৌগোলিক সীমানা দিয়ে বাধা এবং নানা আইন পাস করে রাষ্ট্র নানাভাবে অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলেও পুঁজি সরকার প্রণীত এসব নিয়মশৃঙ্খলা থেকে মুক্ত হয়ে এক উন্মুক্ত সীমান্তবিহীন বিশ্ব অর্থনীতির জন্ম দিতে চায় (deterritorialisation)। এই প্রক্রিয়াকে আমরা নাম দিয়েছি বিশ্বায়ন।

অষ্টাদশ শতাব্দীতে অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ বলেছিলেন, যারা দেশের মালিক, তারাই দেশের নীতি তৈরি করবে। মালিক বলতে তিনি বুঝিয়েছিলেন বণিকশ্রেণি এবং শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিককে। সে অর্থে আজকের বিশ্বায়নের চালিকাশক্তি হচ্ছে পুঁজিবাদী অর্থনীতি এবং বহুজাতিক করপোরেশন। বহুজাতিক করপোরেশনের উদাহরণ হতে পারে কোকাকোলা, ম্যাকডোনাল্ড, কেএফসি, ওয়ালমার্ট, শেল, বিপি, সিটি ব্যাংক, ম্যানহাটন চ্যাসিজ ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পোরস ইত্যাদি নানা সংস্থা। এরা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী। এদের অনেকেই দেশীয় অর্থনীতি থেকেও বড়। আমেরিকার কোম্পানি ওয়ালমার্টের বাত্সরিক আয় দেশ ধরে হিসাব করলে ষষ্ঠ স্থানে। তার আগে আছে কেবল আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, চীন, জাপান। এই বিশাল প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে যারা নিয়ন্ত্রণ করে তাদের বিশ্ব পুঁজিবাদী শ্রেণি বলতে পারি। তারা এমন এক পণ্য সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে, যেটি কঞ্জুমারিজম বা পণ্য ভোগবাদী সংস্কৃতি নামে পরিচিত। এই সংস্কৃতির মূল বাহক টেলিভিশন ও মিডিয়া। এক হিসাব থেকে জানা যায়, ১৬ বছরের যেকোনো আমেরিকান যুবক ৩ লাখ টেলিভিশন বিজ্ঞাপনের সঙ্গে পরিচিত হবে ওই স্বল্প জীবনকালে। বিশ্ব পুঁজি এভাবে ভোগবাদী সংস্কৃতিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে গোটা বিশ্বে।

বিশ্বায়নের আর একটি শক্তি হচ্ছে শক্তিশালী রাষ্ট্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো কিছু দেশ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও অর্থনীতির একটি কাঠামো নির্মাণ করে দিয়েছিল। সেই কাঠামোর মধ্যে আছে জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা ও বিশ্বব্যাংক। ইতিমধ্যে যে বাজারসভ্যতা গড়ে উঠেছে এরা তাকে লালন করে। এমনভাবে তারা তাদের নীতিমালা গঠন করে যেন বিশ্ব পুঁজি তার দ্বারা উপকৃত হয়। আরও রয়েছে কিছু সংগঠন যেগুলো রাষ্ট্রপুঞ্জের সহায়তায় গড়ে উঠেছে। তাদের দায়িত্ব শান্তিপূর্ণভাবে অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেনদেন করা। সেই সঙ্গে আছে বৈশ্বিক সিভিল সমাজ, যার মধ্যে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বা গ্রিনপিস, আন্তর্জাতিক কমিউনিটি অব জাস্টিস, সাহায্য বিতরণের বহুবিধ বেসরকারি সংগঠন। এভাবে বিশ্বায়নের একটি দীর্ঘ ও জটিল কাঠামো গড়ে উঠেছে। মাকড়সার জালের মতো সেটি সব দেশ, সমাজ ও জনপদকে যুক্ত করে তার শাসন ও শোষণ চালিয়ে যাচ্ছে।

আদি বিশ্বায়ন

তবে বিশ্বায়নের মূল ভিত পুঁজিবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত হলেও তার শেকড় রয়ে গেছে অতীতে। সেই বিশ্বায়নকে আধুনিক অর্থে বিশ্বায়ন না বলে বলতে পারি আরখাইক (Archaic) বিশ্বায়ন। অর্থনীতি ও রাজনীতির বাইরে যেসব বহুমুখী আদান-প্রদান হয়ে থাকে যেমন সাংস্কৃতিক, জ্ঞানসম্পর্কিত, ধর্মীয়, ধর্মান্তঃকরণ সেগুলো এককালে বিশ্বায়নের প্রকৃত শক্তি ছিল। সেই যুগ ছিল রোমাঞ্চকর এক যুগ। গ্রিক, রোমান সভ্যতা ওই যুগেরই কীর্তি, যার ওপর ভর করে আমাদের আধুনিক জীবন গড়ে উঠেছে। নীল নদের কূল ঘেঁষে ফারাওদের সাম্রাজ্যের কথা বলতে গিয়ে আমরা মিসরীয় সভ্যতার কথা বলি। সিন্ধু নদ ও গঙ্গার ধার ঘেঁষে গড়ে ওঠা সভ্যতা আমাদের আকুল করে। মেসোপটেমিয়া, ব্যাবিলন বা পারস্য সাম্রাজ্য এই প্রাচীন যুগের ছকের বাইরে নয়। বাইরে নয় সুদূর দক্ষিণ আমেরিকার ইনকা বা অন্যান্য সভ্যতা। এসব সভ্যতা বিশাল মহিরুহের মতো পণ্ডিত এবং জ্ঞানী ব্যক্তির সমাগমে ভরপুর ছিল। ভরপুর ছিল যুদ্ধবিগ্রহে, দূরের বাণিজ্য পথে নানা পণ্যের আদান-প্রদানে। যাদের চিন্তাধারা এ সময় সমাজকে আন্দোলিত করে গেছে তাদের মধ্যে রয়েছে চীনের পণ্ডিত কনফুসিয়াস। রয়েছে ভারতবর্ষের মহান রচনা রামায়ণ এবং মহাভারত—গ্রিক উপাখ্যান ইলিয়াড, ওডিসি। তাদের রচিত সাহিত্যিক বা দার্শনিক কাজ নানাভাবে নানা পথে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল। ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন থাকা সত্ত্বেও তাদের বাণী সমাজ ও মানুষকে প্রভাবিত করে গেছে। আর কী অদ্ভুতভাবেই না তারা ছিল একে অপরের সদৃশ। গ্রিক পণ্ডিত হোমার, সক্রেটিস, প্লেটো বা অ্যারিস্টটলের চিন্তাধারার সঙ্গে ভারতবর্ষে গড়ে ওঠা সমসাময়িক চিন্তার কি কোনো সাদৃশ্য নেই? রামায়ণ-মহাভারতের মতো পৌরাণিক গ্রন্থে যে আদর্শ সমাজের কথা, মানুষের মঙ্গলভাবনার উপদেশ আছে, সেই ভাবনার সঙ্গে কি সাদৃশ্য দেখি না হোমার, প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের?

যেসব ধর্মবিশ্বাস ওই সময় জন্ম নিয়েছিল তাদের বাণীর মধ্যেও ছিল অভিন্ন দিক। পারস্যের জরাস্ত্রিয়ান (Zoroastrian) ধর্ম, চীনের মেজি (Mozi 400BC) বা খ্রিষ্টধর্ম তার প্রমাণ হতে পারে। এই ধর্মের প্রতিটিই ভালোবাসার কথা বলে গেছে। মানুষকে সৃষ্টির সেরা হিসেবে বিবেচনা করেছে (যদিও ভারতের জৈন ধর্মের কথা ভিন্ন)। ইহুদি ধর্মের মতো নৈতিক নিয়মকানুনের কথা বলেছে বাকি অন্যান্য ধর্ম। হয়তো কিছুটা ভিন্ন ভাষায় ওই একই কথা বলতে চেয়েছে বৌদ্ধধর্ম বা ইসলাম ধর্ম। অহিংসা এবং বাহুল্যকে পরিহার করার উপদেশ রয়েছে জরাস্ত্রিয়ান ধর্মে। সেখানেও বিশুদ্ধ চিন্তা, কর্ম ও কথোপকথনে সঠিক ভাষা ব্যবহারের ওপর রয়েছে বিশেষ জোর। কনফুসিয়ান ধর্মও এই স্রোতোধারারই অংশ। সেখানেও রয়েছে নৈতিক বিশুদ্ধতার বাণী। ফলে সব ধর্মে ভিন্নতা থাকলেও বিভেদকে নয়, মানবজাতির অদৃশ্য ঐক্যকে প্রাধান্য দিতে দেখি।

ঐক্যের কথা যদি বলি তাহলে তার ব্যাপ্তি কিন্তু আরও প্রশস্ত। ঐক্যের দিক থেকে দেখলে মিল পাওয়া যাবে বৌদ্ধধর্মের সাথে গ্রিক স্তোইকদের। হেলেনীয় সভ্যতায় জেন নামে যে বিখ্যাত দার্শনিক ছিলেন, তিনিই এই স্তোইক দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। স্তোইকরা উপদেশ দিয়ে গেছেন সংযমী হতে। সংযমের মাধ্যমে ইন্দ্রিয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার এই উপদেশবাণীর সঙ্গে প্লেটোর দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির বিশেষ সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। সাধারণ মানুষের চরিত্রে প্লেটো কামনার বিশেষ প্রভাব লক্ষ করেছিলেন, যেটি এলিট এবং জ্ঞানী ব্যক্তিদের মধ্যে সাধারণত অনুপস্থিত থাকে। সে কারণে রাষ্ট্রের মঙ্গলভাবনা ভেবে তিনি জ্ঞানী ব্যক্তিদের ওপর শাসনভার ন্যস্ত করা অপরিহার্য মনে করেছিলেন। খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ বছরের দিকে চীনে গড়ে ওঠা আইনবাদীদের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গেও এই দৃষ্টিভঙ্গির যথেষ্ট সাদৃশ্য দেখি। প্রাচীন প্রতিটি সভ্যতার চিন্তাজগতের মধ্যে এই সাদৃশ্য ও অভিন্নতা অভূতপূর্ব। সেদিক থেকে ভাবলে বিশ্বায়নের শুরুকে প্রাচীন যুগ থেকে ধরাটা যুক্তিসিদ্ধ। কীভাবে সেই অভিন্ন চিন্তাপ্রবাহ জন্ম নিল আর কীভাবেই বা মনীষীরা একই চিন্তার কক্ষপথ পরিভ্রমণ করলেন, সেটি রীতিমতো বিস্ময়কর হতে পারে। কিন্তু ওই বিস্ময়কে সাময়িকভাবে সংযত রেখে আমরা বলতে পারি, প্রাচীন ওই আদি জ্ঞানকাঠামোই সেই আধ্যাত্মিক ভিত (Spiritual foundation), যার ওপর ভর করে এবং নানা আঁকাবাঁকা পথ অতিক্রম করে সীমিত আকারে হলেও জন্ম নিয়েছিল পরস্পর-সম্পর্কিত আজকের আধুনিক জীবনের প্রাথমিক ভিত।

মধ্যযুগে (খ্রিষ্টাব্দ ৪৭৬ থেকে ১৪০০ সালের মধ্যবর্তী সময়) ইউরোপ এক অন্ধকার যুগে প্রবেশ করে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত হয়ে গোটা ইউরোপে রাজনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ এবং সামাজিক ক্ষেত্রে স্থবিরতা দেখা দেয়। অর্থনৈতিকভাবে খণ্ডিত এবং বিভক্ত হয়ে সেখানে সামন্তবাদী উত্পাদনব্যবস্থা গড়ে ওঠে, যা বলতে আমরা বুঝি কৃষিনির্ভর অর্থনীতি। এর ফলে মানুষের জীবন আঞ্চলিক পরিবেশের মধ্যে সীমিত হয়ে আসে। সে সময় ব্যবসা-বাণিজ্যে ছিল না কোনো গতি। তার সঙ্গে আরও যোগ হয়েছিল রাজাদের মধ্যে প্রবল বিরোধ। ইউরোপ তার নিজের গণ্ডির মধ্যে এমনভাবে সেঁটে ছিল যে বাকি বিশ্ব সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণা গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। অনেকের ধারণায় সভ্যতার বিকাশে এই যুগের অবদান যথেষ্ট নয়। কিন্তু সেটি সঠিক নয়। প্রাচীন সমাজের সঙ্গে তুলনা করলে মধ্যযুগের অবদান কিন্তু কম নয়। প্রাচীন সমাজ মূলত গড়ে উঠেছিল দাসশ্রমের ওপর ভিত্তি করে। সেখানে দাসদের কোনো অধিকার ছিল না। দাস ছিল দাস-মালিকের সম্পত্তি। যেসব ভবন এবং নিদর্শনকে প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন হিসেবে আমরা জানি—যেমন মিসরের পিরামিড, গ্রিসের আক্রোপলিস, রোমের স্থাপত্য—সেগুলো দাসের শ্রমে নির্মিত হয়েছিল। অথচ অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়ে তারা ছিল বঞ্চিত ও নিপীড়িত। মধ্যযুগে খ্রিষ্টধর্মের অনুশাসনে নানা ধরনের বাধা থাকলেও ওই ধর্ম কিন্তু মানুষকে সমান দৃষ্টিতে দেখার নির্দেশ দিয়েছে। আরও রয়েছে শ্রমকে বিনা পয়সায় ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা। পবিত্র বাইবেলের সেন্ট ম্যাথিউতে লেখা আছে শ্রমকে মূল্য দিয়ে কেনার কথা।

এর সঙ্গে যোগ করতে পারি অন্য আরও কিছু অগ্রগতির দিক, বিশ্বায়নে যার গুরুত্ব অপরিসীম। আজ যেভাবে আমরা লিখি সেটি আমরা পেয়েছি মধ্যযুগ থেকে। আমাদের আইনি ব্যবস্থা মধ্যযুগ থেকে ধার করা। রেনেসাঁ বা আধুনিক যুগ নিয়ে আমাদের যে গর্ব তা-ও শূন্যের ওপরে গড়ে ওঠেনি। তার প্রাথমিক ভিত মধ্যযুগই তৈরি করে দিয়েছিল। বিজ্ঞানের প্রাথমিক বিকাশেও মধ্যযুগের ছিল বিশেষ অবদান। প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল খ্রিষ্টাব্দ ১১ শতাব্দীর দিকে—একটি ইতালির শহর বলোনিয়ায়, অন্যটি ফ্রান্সের প্যারিসে। এই দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব বিষয়ে জ্ঞান দান করা হতো তার মধ্যে আইন, ধর্মতত্ত্ব, চিকিত্সাশাস্ত্র এবং লিবারেল আর্ট ছিল প্রধান। এখানে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষারও ব্যবস্থা ছিল। ছিল তর্ক এবং আলোচনার সুযোগ। ব্যাংকিং ব্যবস্থাও গড়ে ওঠে এই মধ্যযুগে। বিশেষ করে বিল অব এক্সচেঞ্জ, ডিপোজিট ব্যাংকিং এবং বন্ড ব্যবস্থা। এই বন্ড প্রথা ফ্লুরেন্স শহরে দুটি পাবলিক ফান্ডকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে—একটিকে বলা হতো মন্তে ফান্ড (Monte Delle Doti) এবং অন্যটি ডাওরি ফান্ড (Dowry Fund)। বিশ্বব্যাপী তার মূল্য কী ছিল সেটি বলাই বাহুল্য। বই প্রকাশনা এবং ইলাস্ট্রেশন ব্যবহার করার রীতি আমরা প্রথমে লক্ষ করি মধ্যযুগে। আর প্রেম? প্লেটোনিক প্রেম বলতে যা বোঝায়, যেখানে ইরোটিক প্রেমের সঙ্গে আধ্যাত্মিক প্রেমের মিলন রয়েছে—সেটিও তো গড়ে ওঠে মধ্যযুগে। যান্ত্রিক ঘড়ি এবং কম্পাসের আবিষ্কার হয়েছে মধ্যযুগে—ইউরোপে ও চীনে—যুগপত্ভাবে।

বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত জ্ঞানেরও কোনো অভাব মধ্যযুগে ছিল না। ওই জ্ঞান ছাড়া মধ্যযুগের গোথিক স্টাইলের গির্জা বা দালানকোঠা, যা কিনা সভ্যতার গৌরব এবং মানুষের সৃষ্টিশীলতার প্রমাণ—নির্মাণ করা যেত কি? যদি বলি ম্যাগনাকার্টা (১২১৫ সালে প্রথম এই চার্টার লেখা হয়। পরবর্তী সময়ে প্রতিবছর এটি নবায়ন করা হতো) সেটি লেখার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে মধ্যযুগ। ম্যাগনাকার্টার মূল কথা শাসকের ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করা। পোপ গ্রেগরির সময় থেকে (খ্রিষ্টাব্দ ৫৯০-৬০৪) চার্চ শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়ে দ্বিকেন্দ্রিক ক্ষমতাকাঠামো গড়ে ওঠে। তাতে করে কারও পক্ষে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা প্রয়োগ করা সম্ভব হয়নি। ম্যাগনাকার্টার উদ্দেশ্য ছিল সেটিই। সেদিক থেকে ভাবলে খ্রিষ্টধর্মই ম্যাগনাকার্টার জন্ম দিয়েছিল, যদিও পরোক্ষভাবে।

যদি ভাবি পুঁজিবাদী অর্থনীতির প্রাণশক্তির কথা, সেখানেও কিন্তু মধ্যযুগের ভূমিকা রয়েছে। অনেকের মতে, নুরসিয়ার বেনেডিক্ট (St Benedict of Nursia, ৪৮০-৫৪৩) মন্তেকাসিনোতে যে আশ্রম গড়ে তুলেছিলেন সেখানে যেসব নীতি শিক্ষা দেওয়া হতো তার মধ্যে সংযমী হওয়া এবং অলসতাকে ঘৃণা করার সংস্কৃতি প্রাধান্য পেয়েছে। একধরনের লিখিত কর্মপ্রথা দিয়ে আশ্রমের দৈনন্দিন জীবন নিয়ন্ত্রিত হতো। তার মধ্যে অন্যতম ছিল অলসতাকে আত্মার শত্রু হিসেবে দেখা। তিনি আশ্রমের সবাইকে বাধ্য করতেন কায়িক ও মানসিক শ্রমে। চিন্তার এই বিশেষ ধরনটি ম্যাক্স ওয়েবারের প্রোটেস্ট্যান্ট এথিকের অন্যতম স্তম্ভ বলে মনে করা হয়। আধুনিক দর্শনের বিকাশেও মধ্যযুগের অবদান রয়েছে। দার্শনিক অগাস্টিন (St Augustine), বথিয়াস (Boethius), থমাস আকিউনাসের (Thomas Aquinas) লেখা এবং জ্ঞান সেকালের দার্শনিক জ্ঞানের বিকাশে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। কৃষির ক্ষেত্রেও বিশেষ অগ্রগতি দেখিয়েছিল মধ্যযুগের ইউরোপ। নতুন ধরনের লাঙল এবং ঘাড় দিয়ে লাঙল টেনে নেওয়ার সুবিধার্থে ঘোড়ার জন্য কলার উদ্ভাবন করে ইউরোপ কৃষিতে অনেক এগিয়ে গিয়েছিল। সম্রাট সারলেমনের সময়ে লেখার পদ্ধতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে। দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলন এবং দুই শব্দের মধ্যে খালি জায়গা রাখার প্রচলন তাঁর সময়েই ঘটে। মধ্যযুগ বিশ্বায়নে কোনো অবদানই রেখে যায়নি বা রাখলেও সীমিত ছিল, সে দাবি অনেকটা অযৌক্তিক বলেই মনে হয়।

তবে মধ্যযুগে এশিয়াই ছিল বিশ্বায়নের কেন্দ্রবিন্দু। এশিয়া কৃষিভিত্তিক অঞ্চল ছিল, সে কথা মানছি। কিন্তু তার পাশাপাশি সেখানে গড়ে উঠেছিল আরও এক জীবন, যে জীবন সামাজিক, অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক শিল্প-সাহিত্য ও ভাস্কর্যের দিক থেকে বিপুল অগ্রগতি অর্জন করে। তার প্রমাণ মিলবে ভারতবর্ষ, চীন ও তুরস্কের ইতিহাসে। ভারত, চীন ও তুরস্ককে নিয়ে গড়ে ওঠে বিশাল কেন্দ্রীভূত তিনটি সাম্রাজ্য—মোগল সাম্রাজ্য, মিং বংশের শাসন এবং অটোমান সুলতানদের শাসন। সভ্যতার এই তিন কেন্দ্র মধ্যযুগের শেষের দিকে ইউরোপকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছিল বহু দূর। তারাই ছিল সে কালের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সামরিক শক্তির ধারক। তারাই শক্তিধর এবং উন্নত সমাজ গড়ে তুলে ১৪০০ সালের পর থেকে এশিয়াকে বিশ্বায়নের অগ্রবাহিনীতে পরিণত করে। ভৌগোলিকভাবে তিনটি বিচ্ছিন্ন বিন্দুর মতো দেখালেও নিজ এলাকায় প্রতাপের সঙ্গে শাসন করে তারা বহু জাতি, ভাষা ও সংস্কৃতির মিলনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যোগাযোগ ও বাণিজ্যের প্রসার ঘটিয়ে আন্তদেশীয় সম্পর্ককে তারাই নিয়েছিল নতুন পর্যায়ে। যে প্রক্রিয়ায় বিশ্বব্যাপী যোগাযোগ আরও ঘনীভূত হয়েছিল তার মধ্যে সাম্রাজ্য বিস্তার, আমলাতন্ত্রের বিকাশ এবং বাণিজ্যের বিস্তার ছিল প্রধান। নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে এশীয় সাম্রাজ্যগুলো তাদের এই গৌরবময় জীবনের সমাপ্তি টানে। তারা নিজেদের পতনকে রুখতে পারেনি। পারেনি ঘুরে দাঁড়াতে। নতজানু হতে হয়েছে ইউরোপের কাছে। গভীর সংকটে নিমজ্জিত হয়ে পরাধীনতা স্বীকার করে নিতে হয়েছে, যদিও ইউরোপের সমকক্ষ হওয়ার সব পূর্বশর্ত তাদের ছিল। মধ্যযুগের শেষের দিকে ইউরোপে যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক শক্তি অঙ্কুরে অঙ্কুরে বৃদ্ধি পেতে থাকে সেই শক্তি ১৬০০ সালের শুরু থেকে পরবর্তী ৫০০ বছর গোটা বিশ্বের ওপর তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করবে। মধ্যযুগের অচলায়তন থেকে উঠে এসে ইউরোপ আরও শক্তিমত্ত হয়ে সারা বিশ্বে প্রমাণ করবে তার শ্রেষ্ঠত্ব, বিশেষ করে নৌশক্তির ওপর ভর করে।

আধুনিক বিশ্বায়ন

বিশ্বায়নের মূল শক্তি পুঁজিবাদ। প্রথম ধাপে পুঁজিবাদ বণিক পুঁজির মাধ্যমে বৃদ্ধি পেয়েছিল। ওই পুঁজির বিকাশে বিশেষ ভূমিকা ছিল ভাস্কো দা গামা বা ক্রিস্টোফার কলম্বাসের নৌ-অভিযান। মধ্যযুগ শেষ হওয়ার কিছু আগে ইউরোপের সমুদ্রবর্তী এলাকায় ধীরে হলেও শহরকেন্দ্রিক সভ্যতা এবং বাণিজ্য কেন্দ্র গড়ে উঠতে থাকে। ভেনিস, জেনোয়া, কায়রো, কনস্টান্টিনোপলের মতো বেশ কিছু বন্দর-শহরে নানা ধরনের অর্থনৈতিক তত্পরতা লক্ষ করা যায়। ধীরে ধীরে সেগুলো বহির্বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়। আফ্রিকার আন্তসাহারা বাণিজ্য পথ দিয়ে ভূমধ্যসাগর, লোহিত সাগর, কৃষ্ণ সাগর এবং ভারতীয় মহাসাগরের পার্শ্ববর্তী দেশের মধ্যে বাণিজ্য যোগাযোগ থাকলেও ১৫ শতাব্দীর প্রথম দিকে বিশ্ব বাণিজ্য পরিমাণগত এবং স্থানগতভাবে সংকুচিত হতে থাকে। দীর্ঘ সমুদ্র ভ্রমণের জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তির অভাব এর প্রধান কারণ। বাণিজ্যের দিক থেকে ভাবলে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কার পৃথিবীকে একেবারে বদলে দিয়েছিল। তার নৌ-অভিযান দুই ধরনের পরিবর্তন নিয়ে আসে। প্রথম পরিবর্তন, গোটা দক্ষিণ আমেরিকা এবং ক্যারিবীয় অঞ্চল স্পেন ও পর্তুগালের দখলে আসে। ১৫১৯ সালে করটেজ মেক্সিকোতে অবতরণ করার পর স্থানীয় অ্যাজটেকদের পরাজিত করে ওই অঞ্চলের ওপর দখল প্রতিষ্ঠা করে। ১০ বছর পর ফ্রান্সিস্কো পিজারো পেরু জয় করে। মেক্সিকো ও পেরুকে স্প্যানিশ সাম্রাজ্যের প্রধান কেন্দ্রে আনার কারণ ছিল স্বর্ণ। দীর্ঘ সময় ধরে প্রচুর স্বর্ণ মজুত ছিল সেখানকার মন্দিরগুলোতে। ওই অঞ্চলের মানুষ তাদের ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতায় স্বর্ণ ব্যবহার করত। স্বর্ণ ও রুপার চালান স্পেনকে পাল্টে দেয়। এই স্বর্ণভান্ডার একপর্যায়ে শেষ হলো বটে। কিন্তু তার জায়গায় এল রুপা। স্পেনীয়রা যখন দক্ষিণ আমেরিকার রুপা নিয়ে চীনে আসে তখন থেকে চীন ইউরোপ সম্পর্কে বিশেষভাবে উত্সাহী হয়। চীনের মিং সাম্রাজ্যে রুপা ছিল সব ধরনের বিনিময়ের মাধ্যম। রুপার প্রচুর চাহিদা থাকায় আন্দিসে (দক্ষিণ আমেরিকায়) রুপার খনিসংলগ্ন শহরগুলোর গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। পতোসি (Potosi) নামের এক শহর কয়েক দশকের মধ্যে লন্ডনের চেয়েও বড় শহরে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু বেশি পরিমাণে রুপা আমদানি হওয়ায় চীনা অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়। একই সঙ্গে সামাজিক অস্থিরতাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। একে মিং সাম্রাজ্যের পতনের একটি প্রধান কারণ হিসেবে অনেকে ভাবেন। প্রশান্ত মহাসাগর দিয়ে চীনের সঙ্গে বাণিজ্য বৃদ্ধি পাওয়ায় চীন থেকে মেক্সিকোতে সিল্ক, চিনামাটির তৈরি দ্রব্য রপ্তানি শুরু হয়। চীনের ক্ষেত্রে আরও গুরুত্বপূর্ণ ছিল আলু, মিষ্টি আলু ও ভুট্টা। আমেরিকা থেকে আসা এই তিন ধরনের খাদ্যশস্য চীনের দক্ষিণ ও পশ্চিম অঞ্চলকে একেবারে পাল্টে দিয়েছিল। এসব শস্য যেকোনো মাটিতে হতো। সে কারণে অনুর্বর অঞ্চলে সেগুলো চাষ করে চীনের চেহারা বদলে গিয়েছিল (মান, ২০১১)।

দ্বিতীয় পরিবর্তন এসেছিল পণ্য-বাণিজ্যে। কলম্বাসের পর থেকে বাণিজ্য বৃদ্ধি পেয়েছিল বহুগুণ। ১৪৯২ সালে কলম্বাস যখন আমেরিকা পাড়ি দেন তখন চীন ও ইউরোপের মধ্যে তেমন যোগাযোগ ছিল না। অথচ এর এক শ বছর পর গোটা পৃথিবীর চেহারা পাল্টে গেল। স্পেনের জাহাজ চীনা বন্দরে নোঙর করার সুযোগ পেল। দক্ষিণ আমেরিকার খনিতে আফ্রিকান দাসের শ্রমে খনন করা রুপা এল চীনে। স্পেনের বস্ত্র ব্যবসায়ীরা চীন থেকে আমদানি করল সিল্ক। ধনী ব্যক্তিরা মাদ্রিদ, মক্কা বা ম্যানিলাতে বসে অভ্যস্ত হলো আমেরিকায় উত্পাদিত তামাকের স্বাদে। একপর্যায়ে মিষ্টি আলু চীনে জনসংখ্যার বিস্ফোরণ ঘটাল। ইউরোপ থেকে পেরুতে আনা পাখির মল সেখানকার জমির উর্বরতা বাড়াল। ম্যালেরিয়ার জীবাণুবাহী মশা আমেরিকায় গিয়ে ধ্বংস করল বহু জীবন। ইউরোপের সঙ্গে এই বিনিময় সম্পর্ক ছিল আরও গভীর। ইউরোপ থেকে পাঠানো জীবজন্তু, উদ্ভিদ ও মাইক্রোব সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। আমেরিকা থেকে তামাক, আলু এবং টার্কি পাখি ইউরোপে এসে সেখানকার খাদ্যাভ্যাস এবং কৃষিকে বদলে দেয়। ইউরোপ থেকে আমেরিকায় রপ্তানি হয় ঘোড়া, গম এবং গুটিবসন্ত, কেঁচোসহ আরও অনেক পোকামাকড়। ওই কেঁচো আমেরিকার জঙ্গলকে পরিবর্তন করে দিয়েছিল। কেঁচো অনেক উদ্ভিদ বা গাছের বৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং পাখিদের খাবার হিসেবে কাজ করে। মোট কথা পোকামাকড়ে ভর্তি বাগান বা জঙ্গল পোকাহীন জঙ্গলের থেকে ভিন্ন। এই আন্তমহাদেশীয় যোগাযোগ এবং বিনিময়কে কলম্বিয়ান এক্সচেঞ্জ বলা হয়। এই বিনিময়ের ফলে যোগাযোগ উন্নীত হয়েছিল সন্দেহ নেই, কিন্তু সেই সঙ্গে তার অপকারিতার দিককে উপেক্ষা করা যায় না। লাখ লাখ আমেরিকান আদিবাসীর মৃত্যু হয়েছিল নানা অজানা রোগে। ওই রোগ ইউরোপীয়রা তাদের সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল, যার সম্পর্কে স্থানীয় মানুষেরা কিছুই জানত না। জানত না কীভাবে ওই রোগব্যাধির চিকিত্সা করতে হয়। এভাবে বাণিজ্য পুঁজির বিকাশ ঘটিয়ে বিশ্বায়ন-প্রক্রিয়া এগিয়ে গেল আরও এক ধাপ। এ পর্যায়ে যে চারটি দেশ বিশেষ ভূমিকা রাখে তারা হলো স্পেন, পর্তুগাল, হল্যান্ড ও ইংল্যান্ড। বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে তাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বও নানাভাবে পৃথিবীকে প্রভাবিত করে গেছে।

তবে যে দেশ বিশ্বায়নকে আধুনিক ধাপে পৌঁছে দিল সে দেশটি হচ্ছে আমেরিকা। আমেরিকার ওই সাফল্য এসেছে তার প্রভূত রাজনৈতিক, সামাজিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতাকে বিশ্বের ওপর চাপিয়ে দিয়ে। কীভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটিয়ে অন্য সব দেশকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে গেল এবং বিশ্বায়নকে পৌঁছে দিল নতুন যুগে সে রীতিমতো কল্পকাহিনির মতো শোনাতে পারে। তবে সেই কাহিনির শুরু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকে করাই ভালো। ওই যুদ্ধের ধাক্কাটা ছিল সত্যিই প্রবল, এমনই প্রবল যে গোটা ইউরোপ পরিণত হয়েছিল এক বিশাল ধ্বংসস্তূপে। ওই ধ্বংসলীলা থেকে কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তুলনামূলকভাবে সবচেয়ে কম ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে বেরিয়ে আসতে পেরেছিল। আমেরিকার উত্থানের সেই বিস্ময়কর ঘটনা কীভাবে ঘটল তার বর্ণনা আমরা পাই স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক ডেভিড কেনেডির বক্তব্য থেকে। ২০০১ সালে তিনি অস্ট্রেলিয়ায় এসেছিলেন সেখানকার লা ট্রোব বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিতে। বক্তৃতার নাম ছিল ‘রাইজ টু পাওয়ার’। সেই বক্তৃতায় ১৯৪০ সালের আমেরিকাকে তিনি দরিদ্র একটি দেশ হিসেবে বিচার করেছেন। পরিসংখ্যান সেকালে আজকের মতো উন্নত ও সহজলভ্য ছিল না। কিন্তু যে হিসাব সে সময় হাতে আসত তাতে আমেরিকাকে আর্থসামাজিক দিক থেকে ধনশালী কোনো দেশ বলা যাবে না। বেকারত্বের হার সেখানে ছিল ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ। ৪৫ শতাংশ জনগণ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত। আফ্রো আমেরিকান জনগণের অবস্থা আরও শোচনীয়। তাদের ৯৫ শতাংশই বেকার। হতাশাব্যঞ্জক এই অবস্থা থেকে আমেরিকা কীভাবে শক্তিশালী দেশে পরিণত হলো? ডেভিড কেনেডির মতে, আমেরিকার ভাগ্য বদলে দিয়েছিল যুদ্ধের সময়ে নেওয়া প্রশাসনিক দুটি কৌশল।

ওই দুই কৌশলের একটির ওপর আলোচনা এখানে গুরুত্বপূর্ণ। তবে তার আগে যুদ্ধে সামরিক ও বেসামরিক ক্ষয়ক্ষতির একটি তুলনামূলক হিসাব তুলে ধরা যাক। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ব্রিটেনের সাড়ে তিন লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। তার মধ্যে এক লাখ ছিল বেসামরিক। যুগোস্লাভিয়ার ২০ লাখ মৃতের মধ্যে ১০ লাখ ছিল বেসামরিক। জাপানের ৩০ লাখের মধ্যে ১০ লাখ ছিল বেসামরিক। পোল্যান্ডের ৮০ লাখের মধ্যে ৬০ লাখ ছিল বেসামরিক। জার্মানির ৬৫ লাখের মধ্যে ১০ লাখ বেসামরিক। সোভিয়েত ইউনিয়নের ২ কোটি ৪০ লাখের মধ্যে ১ কোটি ৬০ লাখ বেসামরিক। যুদ্ধে আমেরিকার ক্ষয়ক্ষতি কী ছিল? সেটি দেখাতে গিয়ে কেনেডি বলছেন, যে চার লাখ পাঁচ হাজার চার শ মানুষ মারা গিয়েছিল তার মধ্যে মাত্র ছয়জন ছিল বেসামরিক। এর অর্থ হচ্ছে, যুদ্ধে আমেরিকার বেসামরিক ক্ষয়ক্ষতি ছিল না বললেই চলে। জনসম্পদের দিক থেকে বিচার করলে এর তাত্পর্য কিন্তু অত্যন্ত গভীর। ইউরোপের ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এবং অনেক দূরে থাকায় যুদ্ধের তাপ তার গায়ে সেভাবে লাগেনি যেভাবে লেগেছিল ইউরোপের অন্যান্য দেশের গায়ে। সে কারণে যুদ্ধ সত্ত্বেও তার অর্থনীতি বড় ধরনের সংকট থেকে বেঁচে গেল। এমনকি দেখা গেল সে সময় তার অর্থনীতি পেছনে যায়নি, বরং এগিয়েছে সামনে ১৫ শতাংশ হারে। এই অর্জন সম্ভব হয়েছিল বিশেষ একটি কৌশলের কারণে। ১৯৪২ সালের ৬ অক্টোবর ডোনাল্ড নেলসন নামের একজন উচ্চপদস্থ আমলা যে সিদ্ধান্ত নেন সেটি ইতিহাসে ৯০ ডিভিশন গ্যাম্বল নামে পরিচিত। যুদ্ধের সময়ে ওয়ার প্রোডাকশন বোর্ডের প্রধান হিসেবে তাঁর দায়িত্ব ছিল অর্থনীতিকে শান্তিকালীন থেকে যুদ্ধের সময়ের জন্য উপযুক্ত করে তোলা। তার অর্থ হচ্ছে, তাকে একদিকে সামরিক বাহিনীকে শক্তিশালী রাখার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে, আবার জনগণের জীবনযাত্রার মান যেন কোনো রকম পরিবর্তন না হয় সেটিও দেখতে হবে। প্রাথমিকভাবে তিনি এবং তাঁর কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ২১৫ ডিভিশন গড়ে তোলার। ওই সংখ্যাকে সঠিক ভাবা হলেও পরবর্তী সময়ে তিনি তা বাতিল করে মাত্র ৯০ ডিভিশন গড়ে তোলার লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করেন। এর ফলে ১২৫ ডিভিশনের সমতুল্য অতিমাত্রায় কর্মদক্ষ মানুষ যুদ্ধে না গিয়ে দেশের অভ্যন্তরে বেসামরিক উত্পাদনে যোগ দেওয়ার সুযোগ পায়। সামরিক ডিভিশনের সংখ্যা কমানো মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হলেও ওই সিদ্ধান্তই কিন্তু আমেরিকার অর্থনীতিতে বয়ে এনেছিল বিপুল সুফল। অন্য দেশের মতো জনসম্পদের সংকটে না পড়ে মহাযুদ্ধের ধ্বংসলীলা থেকে আমেরিকা বেরিয়ে এসেছিল গায়ে প্রায় কোনো দাগ না নিয়ে। সে সময়ের ইংল্যান্ড বা রাশিয়ার জীবনযাত্রার মানের সঙ্গে আমেরিকার জীবনমানের তুলনা করলে সেটি বোঝা যায়। তাতে দেখা যায়, ওই দুই দেশে জীবনযাত্রার মান নেমে গিয়েছিল ৩০ শতাংশ। আমেরিকার শক্তিশালী অর্থনীতির আরও কিছু নমুনা পাওয়া যায়। যুদ্ধ-পরবর্তী ইউরোপকে অর্থনৈতিক দুর্গতি থেকে উদ্ধার করেছিল নিজের অর্থনৈতিক শক্তির কারণে। সে নিজে তার অর্থনৈতিক এবং ভূকৌশলগত স্বার্থের দিকে তাকিয়েছে সে কথা সত্যি। তার পুঁজি এবং অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান ইউরোপের বাজারের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সুযোগ যেন পায় এবং অর্থনৈতিকভাবে অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে শক্তিশালী হয়ে বেরিয়ে আসে, সেটি ভাবতে আমেরিকা ভোলেনি। বিশ্ব পরাশক্তিতে পরিণত হয়ে গোটা বিশ্বকে তার অর্থনীতির আওতায় এনে বিশ্বব্যাপী যোগাযোগে গুণগত পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে ওই বিশেষ কৌশলকে সাধুবাদ জানাতে হয়।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর আমেরিকায় অর্থনীতি-সংক্রান্ত এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে। সেই নীতির মূল প্রবণতাটি ছিল আমেরিকার অর্থনীতিকে রাজনীতি এবং বৈদেশিক নীতির সঙ্গে যুক্ত করা। সংযোগটি পুঁজিবাদী দেশে আগে বড় একটা দেখা যায়নি। ব্রিটেন যেমন ল্যাসে ফেয়ার (laissez fair) নীতির আওতায় বাজার এবং অর্থনীতিকে যত দূর সম্ভব রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত রেখে এসেছে। কিন্তু তার ঠিক উল্টোটা দেখা গেল আমেরিকার ক্ষেত্রে। অত্যন্ত সচেতনভাবে আমেরিকার নেতারা রাষ্ট্রকে অর্থনীতির সহায়ক হিসেবে গড়ে তুলল। সেই সুযোগটি তখনকার ইউরোপই আমেরিকার জন্য সৃষ্টি করে দিয়েছিল। যুদ্ধের পর জাপান, জার্মানি, স্পেন বা ইতালির মতো দেশ পৃথিবীর কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছিল। সেটি তাদের অনুসৃত মানবতাবিরোধী ফ্যাসিবাদী আদর্শের কারণে। ওই আদর্শ দিয়ে এই দেশগুলো বিশ্ব কর্তৃত্বের স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু যুদ্ধে তাদের পরাজয় ওই আদর্শের পরাজয় হিসেবে প্রমাণিত হলো। ওই নৈতিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রীয় পুঁজি ইউরোপীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হলো। প্রথমে প্রশান্ত মহাসাগর এলাকায় আমেরিকা তার একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। জাপান তার হাতের মুঠোয় চলে আসে অতি সহজে। সে সময় জাপানের অর্থনীতিকে চাঙা করতে আমেরিকা এগিয়ে এসেছিল ভূকৌশলগত কারণে। জাপানের শাসনতন্ত্রও লেখা হয়েছিল ওয়াশিংটন ডিসিতে। এরপর ইউরোপ। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে প্রচুর বিনিয়োগ করে আমেরিকা তার প্রভাববলয় সৃষ্টি করে। ওই মার্শাল প্ল্যানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছিল রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে। ১৯৫০ ও ১৯৭০ সালের মধ্যবর্তী সময়ে একমাত্র সামরিক সাহায্য হিসেবে আমেরিকা ইউরোপকে দিয়েছিল দুই ট্রিলিয়ন ডলার (শেফা ২০০৯: ২)। অস্ট্রেলিয়া তার এককালের বিশ্বস্ত রক্ষাকর্তা ব্রিটেনের বদলে বন্ধু হিসেবে বেছে নিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে। কোরিয়া, চীন, মালয়া, ভিয়েতনাম ইত্যদি এলাকায় নানা যুদ্ধে অংশ নিয়ে এবং সেখানকার অর্থনীতি এবং প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করে আমেরিকা বিশ্বব্যাপী নিবিড় এক নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে। এই নেটওয়ার্কে আরও অন্তর্ভুক্ত হয় নানা ধরনের প্রতিষ্ঠান—অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক। এভাবে আমেরিকা, ইউরোপ ও এশিয়া—এই তিনটি পুঁজিবাদী অঞ্চলকে একই বৃত্তে এনে বিশাল ও শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা তার পক্ষে সম্ভব হয়। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক যোগাযোগের সঙ্গে পরবর্তী সময়ে আরও যুক্ত হয় সামরিক ও দেশীয় গোয়েন্দা সংস্থা, জাতীয় নিরাপত্তাকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠান, অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান, নতুন প্রচার বিভাগ, বুদ্ধিজীবিদের নানা প্রতিষ্ঠান এবং মিডিয়া নেটওয়ার্ক।

আরও একটি কৌশল আমেরিকা নিয়েছিল। সেই কৌশলের উদ্দেশ্য ছিল নানা ধরনের আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা এবং সেসব প্রতিষ্ঠানের ওপর তার একচেটিয়া ক্ষমতা এবং প্রভাব নিশ্চিত করা। সামরিক ক্ষেত্রেও তার অপ্রতিদ্বন্দ্বী অবস্থান অর্জনে এ দেশ প্রচুর বিনিয়োগ করে। গড়ে তোলে উদারনৈতিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার কাঠামো। তার সাংস্কৃতিক-আদর্শিক আধিপত্যের দিকটি ঠিক রাখতেও আমেরিকা বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এভাবে দেশটি তার ক্ষমতার বিচ্ছুরণ পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে দেয়, যে ক্ষমতা আজ আরও বৃদ্ধি পেয়েছে নানাভাবে, নানা ক্ষেত্রে।

অর্থনীতি বা করপোরেশনের গল্প

শক্তিশালী দেশ হতে গেলে প্রথমে প্রয়োজন হয় অর্থনীতিকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করানো। আন্তরাষ্ট্রীয় অন্তর্দ্বন্দ্ব, বাধা অতিক্রম করে কীভাবে পণ্যের বাজার অবারিত এবং অবাধ করে দেশীয় বাজারের সীমাবদ্ধতা উতরে গোটা বিশ্বে পণ্য ছড়িয়ে দেওয়া যায়, সে প্রশ্নের মীমাংসা ভালো করেই করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর বিশ্বে অর্থনীতির তিনটি কেন্দ্র গড়ে ওঠে—আমেরিকা, ইউরোপ ও জাপান। আমেরিকা তার অর্থনৈতিক সাহায্য দিয়ে জাপান এবং ইউরোপের অর্থনীতিকে চাঙা করেছিল বিনা কারণে বলা যাবে না। চাঙা করতে অবশ্য তাকে ব্যবহার করতে হয়েছিল যাকে বলে একদিকে ‘গাজর অন্যদিকে লাঠি’। ইউরোপ ও জাপানে আমদানিকৃত পণ্যের (মার্কিন পণ্য এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত) ওপর আমেরিকা বেশি ট্যারিফ আরোপের নির্দেশ দেয়। এতে করে ইউরোপীয় পণ্য উত্পাদন বৃদ্ধি পায়। মার্কিন কোম্পানিগুলো এই সুযোগ নিয়ে ইউরোপে বিপুলভাবে বিনিয়োগ শুরু করে। মুদ্রার বিনিময়ের ক্ষেত্রে সুবিধাজনক হার দিয়ে আমেরিকা ইউরোপীয় এবং জাপানি পণ্যকে মার্কিন বাজারে সহজলভ্য করার সুযোগ করে দেয়। ফলে দেখা গেল ১৯৭১ সালে মার্কিন বাণিজ্যে প্রায় ২.৩ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি দেখা দিয়েছে (শেফা ২০০৯: ৩)। এই ঘাটতি কমাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দুই দফায় ডলারের অবমূল্যায়ন করে। একটি ১৯৭১ সালে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের আদেশে। অন্যটি ১৯৮৫ সালে জি ৫-এর (পরবর্তী সময়ে জি ৭) বৈঠকে, যাকে বলা হয় প্লাজা চুক্তি (শেফা ২০০৯: ৪৪)। ডলারের অবমূল্যায়ন মার্কিন অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করেছিল। প্রথমত, ইউরোপ ও জাপান থেকে প্রচুর পুঁজি বিনিয়োগ হলো আমেরিকার অর্থনীতিতে। সেই সঙ্গে আমেরিকায় সুদের হার বাড়িয়ে দেওয়ায় ইউরোপ ও জাপানের পুঁজি আমেরিকার ট্রেজারি বন্ড কিনতে উত্সাহী হলো। তবে ডলারের অবমূল্যায়ন প্রথমে আঘাত করে জাপানি অর্থনীতিকে। জাপানি ইয়েনের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় তার অর্থনীতিতে প্রচুর অর্থের সমাগম হয়। পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পায়। এমনভাবে যে অনেকে তখন বলত একমাত্র টোকিও শহরের জমির মূল্য গোটা আমেরিকার জমির মূল্যের চেয়ে বেশি (শেফা ২০০৯: ২২)। অর্থনীতিতে এর ফলে যে বুদ্বুদ তৈরি হয় সেটি ৯০ দশকের দিকে ফেটে পড়ে। জাপানি অর্থনীতিতে দেখা দেয় মন্দা। ইউরোপের অর্থনীতিও যে ভালো ছিল তা নয়। তার কারণ যদিও ভিন্ন। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর জার্মানির একত্রীকরণে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠনে যে খরচ হয়েছিল সেটি ওই মন্দার প্রধান কারণ বলে ধরা হয়। ইউরোপ ও জাপানের এই দুর্ভোগের সুযোগ নিয়ে আমেরিকান করপোরেশনগুলো তাদের প্রভাবকে নিশ্চিত করে।

তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নতি এবং গোটা বিশ্বকে তার বলয়ে অন্তর্ভুক্ত করার ইতিহাস দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ থেকে শুরু হয়নি। শুরু হয়েছে ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে। ইউরোপের মতো আমেরিকায় পুঁজিবাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিযোগিতা দিয়ে (যাকে ফ্রি মার্কেট বলি)। সেই প্রতিযোগিতা ছিল রক্তাক্ত। তার ফল হিসেবে মাঝেমধ্যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থেমে গেছে। অর্থনীতিতে দেখা দিয়েছে মন্দা। সেই ধরনের মন্দা আমরা লক্ষ করেছি ১৮৭৩ থেকে ১৮৭৮ বা ১৮৯৩ সাল থেকে ১৮৯৭ সালের মধ্যবর্তী সময়ে। অর্থনীতির সংকোচনের কারণে ১৮৭৫ সালের দিকে আমেরিকায় প্রায় ৪৭০০০ কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল। সেই সঙ্গে আন্তকোম্পানি প্রতিযোগিতাও হয়েছিল তীব্র। আন্তপ্রতিযোগিতা, ব্যবসায় ভাটা, লাভের পরিমাণ কমে আসার মতো অর্থনৈতিক দুর্যোগের সমাধান হিসেবে আমেরিকায় সে সময় জন্ম নেয় কারটেল (Cartel)। কারটেলের মূল লক্ষ্য ছিল প্রতিযোগী কোম্পানিগুলোর মধ্যে একধরনের অলিখিত চুক্তি সই করে নিজেদের মধ্যে বাজার ভাগ করে নেওয়া। সেই চুক্তির মূল উদ্দেশ্য ছিল কোনো কোম্পানি যেন এককভাবে পণ্যের মূল্য হ্রাস করে বাজারের ওপর একক আধিপত্য সৃষ্টি করতে না পারে। এর ফলে আমেরিকায় এ সময় জন্ম নেয় নানা ধরনের বাণিজ্যিক অ্যাসোসিয়েশন। এরাই পরিণত হয় কারটেলে। তবে কারটেল খুব যে কার্যকর ছিল তা না। দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক উন্নতির কথা ভাবলে কারটেল প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কারটেলের অধীনে মূল্য নিয়ন্ত্রণে যেহেতু কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না, সেহেতু তার কার্যকারিতা একপর্যায়ে কমে আসে এবং জন্ম নেয় ট্রাস্টের। ট্রাস্টের অধীনে প্রতিযোগী মালিকেরা ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করে পণ্যের মূল্য নির্ধারণ ছেড়ে দিত ট্রাস্টি বোর্ডের হাতে। সেই মূল্য সব কোম্পানির জন্য বাধ্যবাধকতামূলক ছিল। তবে ১৮৯০ সালের দিকে ট্রাস্টের এই অনৈতিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আইন পাস করা হয়। তাকে শেরম্যান অ্যান্টি ট্রাস্ট আইন (Sherman Anti-Trust Law) বলা হয়ে থাকে। এতে ট্রাস্টকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়। এর প্রত্যুত্তরে শিল্পপতিরা হোল্ডিং কোম্পানি গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। এরা অন্য কোম্পানি কিনতে পারত। এই ধরনের হোল্ডিং কোম্পানির মধ্যে অন্যতম ছিল জেনারেল মোটরস। অর্থনীতির প্রধান সেক্টর হিসেবে এসব কোম্পানির আওতায় একপর্যায়ে চলে এল ব্যাংকিং, শিল্প উত্পাদন, মাংস প্রক্রিয়াকরণ, তেল পরিশোধন শিল্প, রেললাইন এবং ইস্পাত শিল্প। গড়ে উঠল বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান।

হিসাবটা মিলিয়ে নিলেই বুঝি কী দ্রুততার সঙ্গে সেখানে করপোরেশনভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে উঠেছিল। গৃহযুদ্ধের সময় (১৮৬৫ সাল) আমেরিকায় ৪০০ জন মিলিয়নিয়ার ছিলেন। ১৮৯২ সালে সেই সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছিল ৪০৭২। ১৯০৬ সালে ছয়টি রেল কোম্পানি দেশের ৯৫ শতাংশ রেললাইনের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিল। বিভিন্ন কোম্পানি এ সময় থেকে একত্র হতে থাকে। এটি লক্ষ করা গেল ১৮৯৭ সালের দিকে। ১৮৯৭ সালে এই একত্রীকরণের কারণে বড় কোম্পানির সংখ্যা ৬৯ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১৮৯৮ সালে দাঁড়াল ৩০৩-এ। সেটি আরও বৃদ্ধি পেয়ে ১৮৯৯ সালে পৌঁছাল ১২০৮-এ। উদাহরণ হিসেবে রকফেলারের নাম উল্লেখ করা যায়। তার নিয়ন্ত্রণে ছিল পেট্রোলিয়াম কোম্পানি (স্ট্যান্ডার্ড অয়েল কোম্পানি)। সেটি সম্ভব হয় তেল উত্তোলন এবং পরিবহনব্যবস্থায় নতুন পদ্ধতি প্রয়োগ করে, বিতরণে নতুন ব্যবস্থাপনা এনে রকফেলার বাজারে একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। রকফেলারের দেখাদেখি অ্যালকোহল এবং চিনি বিশোধনে যুক্ত শিল্পেও গড়ে ওঠে ট্রাস্ট। অ্যান্ড্রু কার্নেগি ইস্পাত উত্পাদনকে নিয়ন্ত্রণ করে তার করপোরেশনের সাহায্যে। ফলে অর্থনীতিতে একটির পর একটি ক্ষেত্রে একেকটি করপোরেশন অকল্পনীয় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে অর্থনীতির পুরো দিককে নিয়ন্ত্রণ করল। এভাবে শেষ হলো প্রাথমিক পর্যায়ের মুক্ত প্রতিযোগিতার যুগ। শুরু হলো বৃহত্ আকারের কম্প্রেশনের যুগ। সম্পদ কেন্দ্রীভূতের সঙ্গে যারা যুক্ত ছিল, তাদের ধনসম্পদ অকল্পনীয় দ্রুততার সঙ্গে বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৮৬৯ থেকে ১৯১০ সালের মধ্যবর্তী সময়ে আমেরিকার শিল্প উত্পাদন ৩ বিলিয়ন থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১৩ বিলিয়নে পৌঁছায়। ১৮৭০ সালে ইস্পাত কারখানার উত্পাদন ছিল ৬৮০০০ টন। সেটি ১৮৯০, অর্থাত্ ২০ বছরের ব্যবধানে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৪.২ মিলিয়ন টনে (ডিজিটাল হিস্ট্রি, পৃ. ১)। এই প্রবৃদ্ধির মূলে ছিল নতুন ধরনের অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত ব্যবস্থাপনা, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত বাষ্পচালিত ইঞ্জিনের ব্যবহার, রেললাইন নির্মাণ, ইলেকট্রিক মোটরের ব্যবহার, অন্তর্দাহ বিস্ফোরণ জাতীয় ইঞ্জিনের ব্যবহার, রসায়নের ব্যবহারিক প্রয়োগ ইত্যাদি। এই করপোরেশনভিত্তিক পুঁজি গুণগত বিচারে অন্য যেকোনো প্রতিষ্ঠান থেকে ভিন্ন। সেখানে কেবল নতুন ধরনের পণ্যই উত্পাদিত হয় না; নতুন ধরনের ব্যবস্থাপনা, নতুন প্রযুক্তির বিকাশ এবং রাজনীতির সঙ্গে শক্ত যোগসূত্র করপোরেশনগুলোকে রাষ্ট্রের চেয়েও শক্তিশালী করে তোলে। এর ফলে দুর্নীতি বাড়তে থাকে। রাজনৈতিক নেতাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার ওপরও তারা প্রভাব ফেলে। এভাবে আমেরিকায় জন্ম নেয় অলিগোপলির (Oligopoly)। হাতে গোনা কয়েকটি কোম্পানির হাতে আজ সে কারণে গোটা দেশের অর্থনীতি জিম্মি হয়ে পড়েছে। ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন, মুষ্টিমেয়ের হাতে সম্পদের কেন্দ্রীভবনের ফলে এসব প্রতিষ্ঠান এত বড় আকার ধারণ করেছে যে রাষ্ট্র আজ তাদের কাছে অনেকটা নতজানু হয়ে আছে। করপোরেশনের ওপর খবরদারি করার কোনো সাহস তাদের নেই।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নব্বইয়ের দশক থেকে দ্বিতীয় বিপ্লব ঘটে। সেটি প্রযুক্তির ক্ষেত্রে। সেটি শুরু হয়েছিল তুমুল প্রতিযোগিতা দিয়ে, যে প্রতিযোগিতা ইতিমধ্যে আমরা লক্ষ করেছিলাম ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে। এবার এই প্রতিযোগিতা দেখা দিল নানা ধরনের টেক কোম্পানির মধ্যে। সিলিকন ভ্যালি নামে পরিচিত জায়গাটি এর ফলে পরিণত হয় অনেকটা যুদ্ধক্ষেত্রে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেখানেও প্রতিযোগিতা কমে এল। বহু কোম্পানি প্রতিযোগিতায় হেরে গিয়ে বিদায় নিল। জন্ম নিল গুগল, ফেসবুক, মাইক্রোসফট, আমাজনের মতো মেগাকোম্পানির। এই বিপ্লবের গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে এদের সম্পদের পরিমাণ আকাশচুম্বী। এরা উত্পাদন করে আমেরিকার বাইরে গিয়ে—চীন, ভিয়েতনাম, কোরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা বা মেক্সিকোর মতো দেশে, যেখানে শ্রমশক্তি সস্তা। সে কারণে লাভের পরিমাণও বেশি। পরিবেশ নিয়ন্ত্রণসংক্রান্ত আইন এসব দেশে হালকা থাকায় পরিবেশদূষণ করলেও কোম্পানি পার পেয়ে যেতে পারে। ট্যাক্সের ক্ষেত্রেও রয়েছে নানা সুবিধা। কর্মচারীর সংখ্যাও কমে গেছে। অ্যাপেল কোম্পানির ২০১৪ সালের আয় অনুযায়ী সম্পদের পরিমাণ ছিল ১৮২.৯ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু তার কর্মচারীর সংখ্যা ৯২ হাজার। এ টিঅ্যান্ডটির আয় ওই একই সালে দাঁড়িয়েছিল ১৩১.৬ বিলিয়ন ডলারে। সেখানে কাজ করেন আড়াই লাখ কর্মচারী। ভেরিজন নামের আরও একটি কোম্পানি আছে। তার আয় ছিল ১২৭.১ বিলিয়ন ডলার। কর্মচারীর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৭৮ হাজার। অন্যান্য বড় বড় করপোরেশনের ক্ষেত্রেও এই একই কথা খাটে। তাদের মধ্যে ইয়াহু, সিসকো, হিউইট প্যাকার্ড, গুগল, আইবিএম, মাইক্রোসফট, ওরাকল, ফেসবুক ইত্যাদি এমন সব পণ্য নিয়ে আজ হাজির হচ্ছে, যা আমাদের জীবনকে সহজ করে দিলেও তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাবের কাছে গোটা বিশ্ব নতজানু হয়ে আছে। এদের হাতে রয়েছে লবি করার বিশাল বাহিনী। শুধু ব্রাসেলস শহরেই রয়েছে তিরিশ হাজার লবিস্ট, যারা এসব কোম্পানির স্বার্থ দেখাশোনা করে (দ্য ইকোনমিস্ট, ২০১৬)। এভাবে তারা অর্জন করেছে এমনই শক্তি যে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া ক্ষুদ্র দেশের পক্ষে প্রায় অকল্পনীয়। পৃথিবীর ১০০টি সবচেয়ে বড় অর্থনীতিকে যদি ধরা হয় তাহলে তার মধ্যে ৫১টি হচ্ছে এসব বড় করপোরেশন। বাদবাকি ৪৯টি হচ্ছে দেশ (শাহ, ২০১৭:২)।

আজ বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর প্রায় অর্ধেকই হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। সবচেয়ে বড় ৫০০ কোম্পানিকে যদি ধরা হয় তাহলে দেখব সেখানে ২২৭টি (অর্থাত্ ৪৫ শতাংশ) কোম্পানি আমেরিকান, ১৪১টি ইউরোপীয়, ৯২টি এশিয়ার। বস্তুত এই তিনটি অঞ্চল মিলে বহুজাতিক এবং সেই অর্থে বিশ্ব অর্থনীতিকে তারা নিয়ন্ত্রণ করে (৯১ শতাংশ)। অন্য দেশের দুর্দশাটা বোঝা যায় যখন দেখি ৫০০টি কোম্পানির মধ্যে লাতিন আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার রয়েছে মাত্র ১১টি (পেট্রাস ও ভেল্টমেয়ার, ২০০৫: ২৭)। কেবল মেক্সিকো ও ব্রাজিলে বিশ্বমানের কোম্পানি আছে কয়েকটি। আফ্রিকায় একটিও নেই। মধ্যপ্রাচ্যে যে ৬টি আছে তার ৪টিই সৌদি আরবের। আর রাশিয়ার রয়েছে ৭টি। আর যদি সব কোম্পানির হিসাব কষা হয় তাহলে ৭৩ শতাংশ করপোরেশনের জন্মস্থান ইউরোপ ও আমেরিকায়। আরও যদি ঘনিষ্ঠভাবে আমেরিকার আধিপত্য বুঝতে হয় তাহলে দেখা যাবে যে বড় ১০টির মধ্যে ৮টিই মার্কিন কোম্পানি, ২টি ইউরোপীয়। আর ২০টির মধ্যে ১৫টি আমেরিকান, ৪টি ইউরোপীয় এবং ১টি জাপানি (পেট্রাস ও ভেল্টমেয়ার, ২০০৫: ২৭)। যেসব ক্ষেত্রে আমেরিকার আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত, সেগুলো হতে পারে শিল্পপ্রতিষ্ঠান (জেনারেল ইলেকট্রিক); তেল ও গ্যাস (এক্সন মবিল); সফটওয়্যার (মাইক্রোসফট); ওষুধ (ফাইজার); ব্যাংক (সিটিকর্প); সুপারমার্কেট (ওয়ালমার্ট); বিমা (আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল গ্রুপ) এবং আইটিতে (ইনটেল)। এভাবে ইউরোপীয় ও আমেরিকান পুঁজি আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা হয়ে বিশ্ব অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে। আমেরিকা ও ইউরোপীয় কোম্পানির সম্পদের পরিমাণ হচ্ছে ২.৫ ট্রিলিয়ন ডলার (ফিন্যান্সিয়াল টাইমস, ২০০৪)। ২০০৩ সালে আমেরিকান কোম্পানিগুলো ইউরোপে বিনিয়োগ করেছিল ৮৭ বিলিয়ন ডলার। ইউরোপীয় কোম্পানিরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগ করেছে ৩৭ বিলিয়ন ডলার। বস্তুত দুই বছরের মধ্যে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বৃদ্ধি হচ্ছে যথাক্রমে ৩১ ও ৪২ শতাংশ। এভাবে অক্টোপাসের মতো আট-দশ বাহু দিয়ে বিশ্বপুঁজি গোটা বিশ্বকে তার গ্রাসের মধ্যে আবদ্ধ করেছে। যেটি আজ দাঁড়িয়েছে তা হচ্ছে আমেরিকার জনসংখ্যা পৃথিবীর জনসংখ্যার ৪.৭ শতাংশ হলেও তার বাজার বিশ্ববাজারের ৩১ থেকে ৩৫ শতাংশ।

ওয়াশিংটন সমঝোতা (Washington Consensus)

গোটা বিশ্বের ওপর মার্কিন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে প্রয়োজন ছিল রাজনীতি, অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নীতির মধ্যে সমন্বয়। সেটি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান ইতিমধ্যে তাঁর ১৯৪৭ সালের ভাষণে উল্লেখ করেছিলেন। একধরনের অনুকূল আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার গুরুত্ব ব্রিটেন তার সময়ে বুঝেছিল। সে কারণে সাম্রাজ্য বিস্তার করতে গিয়ে ব্রিটেন প্রথমে কর্ন আইনের (১৮১৫-১৮৪৬) আওতায় প্রথম আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলে। সেই ব্যবস্থায় কয়েকটি স্তম্ভ ছিল। প্রথমত, মুক্ত বাণিজ্য। দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রের ক্ষমতা কমিয়ে লেসে ফেয়ারের আওতায় অর্থনৈতিক উন্নতি আনা। তৃতীয়ত, স্বর্ণ স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করা। স্বর্ণের সঙ্গে প্রতিটি দেশীয় মুদ্রা যুক্ত করে তাদের মূল্য নির্ধারণ করা। চতুর্থত, শ্রমের সহজ বিতরণ নিশ্চিত করা। পঞ্চমত, আন্তর্জাতিক সম্পত্তি অধিকার। এই পাঁচ স্তম্ভের ওপর ভিত্তি করে ব্রিটেন তার আধিপত্য টিকিয়ে রাখলেও সেই ব্যবস্থা প্রথম মহাযুদ্ধের পর ভেঙে পড়ে।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে বৈশ্বিক নিয়ম গড়ে তোলে, সেখানে দুই ধরনের কৌশল গ্রহণ করা হয়। একদিকে উদারনীতিভিত্তিক বৈশ্বিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার কাঠামো নিশ্চিত করা। সেখানে কয়েকটি দিক ছিল গুরুত্বের—তার মধ্যে বহুজাতিভিত্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রথা চালু করা; বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আঁতাত গড়ে তোলা; যৌথ নিরাপত্তার উদ্যোগের ওপর জোর দেওয়া; সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক আইন-নিয়ন্ত্রিত কাঠামো গড়ে তোলা। এভাবে আমেরিকা তার তৈরি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যে অন্যান্য দেশকে অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম হয়। প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছিল ১৯৪৪ সালে অনুষ্ঠিত ব্রেটন উডস সম্মেলনে। ওই সম্মেলনে বিশ্বশান্তির চিন্তা মাথায় রেখে গড়ে তোলা হয়েছিল ওয়াশিংটন সমঝোতা নামের একটি কাঠামো। এই সমঝোতার মূলনীতি আজ বাস্তবায়িত হচ্ছে চারটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, বিশ্বব্যাংক ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা। এই প্রতিষ্ঠানগুলো একে অপরের পরিপূরক। তারা ভবিষ্যত্ বিশ্বরাজনীতি ও অর্থনীতি-সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান বের করার দায়িত্ব লাভ করলেও তারাই আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্বের মূল হাতিয়ার এবং বিশ্বায়নের প্রধান বাহক।

জাতিসংঘের জন্ম হয়েছিল ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর সান ফ্রান্সিসকো শহরে। প্রথম পর্যায়ে ৫১টি দেশ এই সংগঠনে যোগ দেয়। ২০০৬ সালের মধ্যে জাতিরাষ্ট্রের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৯২। প্রতিষ্ঠানটির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের দিক হলো ১. বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ২. বিশ্বশান্তির বিরুদ্ধে হুমকি যৌথভাবে মোকাবিলা করা। ৩. শান্তিপূর্ণভাবে সমস্যার সমাধান করা। ৪. সুবিচার এবং আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি অনুগত থাকা। ৫. সম-অধিকার এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের ভিত্তিতে সম্পর্ক গড়ে তোলা। ৬. অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মানবিক সমস্যার সমাধানে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা নিশ্চিত করা। মানবাধিকার নিশ্চিত করা। বর্ণ, ধর্ম, ভাষা, লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য দূর করা। শান্তি প্রতিষ্ঠায় দূরদর্শিতার পরিচয় দেওয়া। এসব মহত্ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে জাতিসংঘকে ৬টি প্রধান ক্ষেত্রে বিভক্ত করা হয়েছে। ১. সাধারণ পরিষদ ২. নিরাপত্তা পরিষদ ৩. অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিল ৪. ট্রাস্টি কাউন্সিল ৫. আন্তর্জাতিক বিচার কোর্ট ৬. জাতিসংঘ সেক্রেটারিয়েট। জাতিসংঘ একদিকে যেমন বিশ্বায়নের পথকে উন্মুক্ত করে দিয়েছে, তেমনি বিশ্বকে করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমা বিশ্বের অধীন। জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠনের প্রতিটির ওপর ভোটাধিকারবলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রশক্তি তাদের প্রভাব নিরঙ্কুশ করতে সক্ষম হয়েছে। প্রধান সংস্থা নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো অধিকার থাকায় বিশ্বের শক্তিশালী কিছু দেশের প্রভাব ও ক্ষমতা অনেক বেশি। সাধারণ পরিষদে সম-অধিকার থাকলেও তার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন বাধ্যতামূলক না হওয়ায় তার গুরুত্ব তেমন অনুভূত হয় না।

আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা। এই সংস্থা গড়ে তোলার কারণ ১৯৩০ সালের মতো অর্থনৈতিক মন্দা ভবিষ্যতে এড়িয়ে যাওয়া। তবে আইএমএফ প্রতিষ্ঠার পেছনে যে কমিশন দায়িত্বে ছিল তার ওপর আমেরিকার ট্রেজারির বিপুল প্রভাব লক্ষ করা গেছে। ট্রেজারির দায়িত্বে যিনি ছিলেন তাঁর নাম হ্যারি ডেক্সটার হোয়াইট। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এবং পরবর্তী সময়ে জাতিসংঘের হেড কোয়ার্টার ওয়াশিংটন ডিসি এবং নিউইয়র্কে স্থাপন করার পেছনে ওই চাপ বিশেষ কাজে দেয়। এই সংস্থার ওপর দায়িত্ব আসে মার্কিন ডলারকে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা, আন্তর্জাতিক মুদ্রার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করা; আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রসার; বিনিয়োগ স্থায়ী করা; একাধিক উপায়ে ঋণ পরিশোধের নিয়ম রাখা; অর্থনৈতিক সংকটে পড়লে সদস্যদেশকে সাহায্য করা; জাতীয় আয়ের ভিত্তিতে জাতিরাষ্ট্রের অনুদান নির্ধারণ করা ইত্যাদি। তবে ব্যালেন্স অব পেমেন্টকে সুষম করার প্রাথমিক যে দায়িত্ব ধার্য হয় সেটি বদলে পরবর্তী সময়ে তৃতীয় বিশ্বের অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তনকে মূল লক্ষ্য হিসেবে ধরা হয়। নানা ধরনের শর্ত আরোপ এবং আন্তর্জাতিক পুঁজির জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করার পরামর্শ দিয়ে এসব দেশের ওপর এই সংগঠন আমেরিকার মাত্রাতিরিক্ত প্রভাব নিশ্চিত করেছে। কাঠামোগত প্রোগ্রাম বলতে অর্থনৈতিক এবং মুদ্রানীতির কাঠামোর মধ্যে দরিদ্র এবং ঋণগ্রস্ত দেশগুলোকে টেনে আনা বোঝায়। এসব দেশে ব্যক্তিমালিকানা এবং উদারনীতিবাদী অর্থনৈতিক মডেল অনুসরণের উপদেশ দেওয়া হয়। এর মধ্যে আরও অন্তর্ভুক্ত মুদ্রা অবমূল্যায়নের উপদেশ, রপ্তানি বৃদ্ধির লক্ষ্যে শুল্কমুক্ত নীতি প্রবর্তন করা, কোটামুক্ত করা, ভর্তুকি উঠিয়ে দেওয়া, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা, ভারসাম্য বাজেট প্রণয়ন করা (কর বৃদ্ধি এবং সামাজিক কল্যাণের খাতকে সংকুচিত করা)। এগুলো উন্নয়নশীল দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের সমান। ভোটের ক্ষেত্রেও তারতম্য রয়েছে। ভোটদানের ক্ষমতা নির্ধারণ করা হয়েছিল জাতীয় আয়ের ওপর ভিত্তি করে। সেই হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোট ভোট ৩ লাখ ৭১ হাজার ৭৪৩, অর্থাত্ মোট ভোটের ১৬ দশমিক ৮৩ শতাংশ। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের সাহায্য নেওয়ার ক্ষেত্রে রয়েছে নানা ধরনের শর্ত, যার কারণে সুবিধার চেয়ে অনেক উন্নয়নশীল দেশ অসুবিধার মধ্যে আটকা পড়ে। এই প্রতিষ্ঠানের তদারকির কারণে জাতিরাষ্ট্রের সার্বভৌম বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেকে। ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সংকটে স্পেন, গ্রিস বা অন্যান্য দেশের অর্থনীতি চাঙা করার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল নেতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে।

বিশ্বব্যাংক একধরনের কো-অপারেটিভের মতো কাজ করে। ১৮৫ জন সদস্যের সবাই এক একজন শেয়ারের মালিক। বিশ্বব্যাংকের নিয়ন্ত্রণভার বোর্ড অব গভর্নরের হাতে ন্যস্ত। গভর্নর হলেন প্রতিটি রাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী। তাঁরা বছরে একবার বিশ্বব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য তহবিলের সঙ্গে মিলিত হন। বিশ্বব্যাংক উত্পাদনের উদ্দেশ্যে পুঁজি বিনিয়োগ করে, যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতির পুনর্গঠনে সাহায্য করে, ব্যক্তিগত বিদেশি বিনিয়োগ উত্সাহিত করে। এই লক্ষ্যে প্রায় ১০ হাজার বিশেষজ্ঞ ওয়াশিংটনে প্রতি দেশ থেকে কাজ করে এবং ১০০টির বেশি দেশে তার আঞ্চলিক অফিস আছে। তবে ব্যাংকের উদ্দেশ্য দারিদ্র্য বিমোচন হলেও তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন আছে। অনেকে তাকে মার্কিন আধিপত্যের প্রতীক হিসেবে দেখে। অন্যদিকে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা বাণিজ্য প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে উদারনীতিবাদকে উত্সাহিত করে। সরকারি পর্যায়ে বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরিত করা, বাণিজ্য আইনের কাঠামোয় কাজ করা এবং বাণিজ্য বিরোধ নিষ্পত্তি করা এই সংস্থার প্রধান কাজ। বাণিজ্যে কর প্রয়োগ না করে বিশ্ব বাণিজ্যকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে এই সংস্থা গড়ে তোলা হয়। কিন্তু কথা হচ্ছে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার পরিচালনায় সব দেশের অংশগ্রহণ থাকলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব ওর ওপর অন্যান্য দেশের চেয়ে অনেক বেশি। যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আদালত আছে সেখানে যেকোনো দেশ বাণিজ্য ইস্যু নিয়ে বিচার দাবি করতে পারে। কিন্তু সেই আদালতের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।

সামরিক শক্তি

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যবস্থার ওপর তার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভুত্ব টিকিয়ে রেখেছে বাহুবল দিয়ে। এ ক্ষেত্রে সে সচরাচর আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের নিয়মাবলির প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে একলা চলো নীতি অনুসরণ করে। ফলে ব্রেটন উডসের আওতায় যে উদারনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল সেটি প্রায় ক্ষেত্রে লঙ্ঘন করা হয় নানা যুক্তি দেখিয়ে, নানা দেশের ওপর রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ করে অথবা হুমকি দেখিয়ে। আমেরিকার পক্ষে একলা চলো নীতি বাস্তবায়ন করা কঠিন নয়। কারণ সমসাময়িক বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাহুবলের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। পৃথিবীর মিলিটারি বাজেট যদি ১ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন ডলার হয়, তাহলে সেখানে আমেরিকার অংশ ৩৭ শতাংশ। প্রতিরক্ষা খাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বছরে ৫৯৭ থেকে ৬২০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে। অন্য দেশের সঙ্গে এই ব্যয়ের তুলনা করা যায়। চীন পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তর অর্থনীতি হয়েও তার সামরিক বাজেটকে ৩৫০ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে রেখেছে। সামরিক বাজেটের দিক থেকে ভাবলে তৃতীয় স্থানে সৌদি আরব। তার বাজেট ৮৭ বিলিয়ন। রাশিয়াকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিপক্ষ হিসেবে ভাবলেও সামরিক খাতে তার ব্যয় মাত্র ৬৬ বিলিয়ন ডলার। বাকি দেশগুলোর ক্ষেত্রেও ওই একই চিত্র লক্ষ করা যায়। ইংল্যান্ডের সামরিক বাজেট হচ্ছে ৫৫ বিলিয়ন, ভারতের ৫১ বিলিয়ন, ফ্রান্সের ৫০ বিলিয়ন, জাপানের ৪০ বিলিয়ন এবং জার্মানির ৪০ বিলিয়ন (তথ্য আল-জাজিরা)। তার অর্থ হচ্ছে, সামরিক খাতে আমেরিকার বাজেট চীন, সৌদি আরব, রাশিয়া, ইংল্যান্ড, ভারত, ফ্রান্স ও জাপানের সম্মিলিত বাজেটের চেয়েও বেশি (Stockholm International Peace and Research Institute ২০১৬)।

যুক্তরাষ্ট্রের কোনো উপনিবেশ নেই বলে আমরা জানি। কিন্তু সেটি আমেরিকা পুষিয়ে নিয়েছে অন্য দিক থেকে। ৪০টিরও বেশি দেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। সেগুলো উপনিবেশের চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর। ঘাঁটিগুলো আমেরিকার ফরোয়ার্ড ডেপ্লয়মেন্ট হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। সেগুলো অঞ্চলভিত্তিক এবং একীভূত কমান্ডের অধীনে। ইউরোপীয় কমান্ডের (EUCOM) অধীনে মোতায়েন আছে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার সৈন্য। এর হেডকোয়ার্টার জার্মানির স্টুটগার্ট শহরে। এর অধীনে বেলজিয়ামে আছে ১ হাজার ৩৬০ জন, জার্মানিতে ১৭ হাজার ৫০০, গ্রিসে ৬৩৫, ইতালিতে ১১ হাজার, স্পেনে ২ হাজার ৪৩৩, ব্রিটেনে ১১ হাজার এবং ভূমধ্যসাগরে ১৪ হাজার। প্রশান্ত মহাসাগরীয় (USPACOM) কমান্ডের সদর দপ্তর পার্ল হারবারে। সেখানে রয়েছে আমেরিকার প্যাসিফিক ফ্লিট এবং তৃতীয় নৌবহর। তা ছাড়া সেনা উপস্থিতি রয়েছে হাওয়ায়ে, যার সংখ্যা ২৮ হাজার জন, দক্ষিণ কোরিয়ায় ৬৬ হাজার, জাপানে ৩৭ হাজার, অস্ট্রেলিয়ায় ১ হাজার ২০০। মধ্যপ্রাচ্য কমান্ডের (USCENCOM) সদর দপ্তর মিসরের সাইনায়ে। মার্কিন সেনাবাহিনীর উপস্থিতি রয়েছে সৌদি আরব, কাতার, বাহরাইন এবং অন্যান্য মুসলিম দেশে। আমেরিকার দক্ষিণ কমান্ডের (USSOCOM) সদর দপ্তর পানামায়। এর অধীনে হন্ডুরাসে আছে ৫৬ জন সৈন্য, পানামায় ৬ হাজার ২০০ জন। আটলান্টিক কমান্ডের (USLANTCOM) সদর দপ্তর ভার্জিনিয়ার নরফরকে। এর অধীনে কিউবার গুয়ানতানামো বেতে আছে ১ হাজার ৬৪০ জন, আইসল্যান্ডে ২ হাজার ৫০০ জন, আজর দ্বীপপুঞ্জে ৯৭০ জন। এ ছাড়া ভারত মহাসাগরে রয়েছে দিয়েগু গার্সিয়া সামরিক ঘাঁটি। অর্থাত্ এমন কোনো অঞ্চল পৃথিবীতে নেই, যে অঞ্চল মার্কিন কর্তৃত্বের বাইরে। ২০০১ সালের দিকে প্রতিরক্ষা দপ্তরের দেওয়া বিবৃতিতে দেখা যায়, গোটা বিশ্বে আমেরিকার ৭২৫টি সামরিক ঘাঁটি আছে।

লে পানিচ এবং সাম গিন্দিন লক্ষ করেছেন, ১৮৬৯ থেকে ১৮৯৭ সালের মধ্যে আমেরিকান নৌবাহিনী ৫ হাজার ৯৮০টি সামরিক ঘটনার সঙ্গে যুক্ত ছিল (পানিচ লিও ও কলিন লেস সম্পা: সোস্যালিস্ট রেজিস্টার ২০০৪: ৩১৩)। এগুলোর উদ্দেশ্য ছিল আমেরিকার বাণিজ্যিক, রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করা। আমেরিকা দক্ষিণ আমেরিকাকে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে নিজের অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করে। ১৯৫০ সালে পুয়ের্তোরিকোতে স্বাধীনতার দাবিকে নস্যাত্ করা হয় মার্কিন সৈন্য দিয়ে। ১৯৫১ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত মার্কিন সৈন্য কোরিয়ায় অনুপ্রবেশ করে। ১৯৫৩ সালে ইরানে নির্বাচিত মোসাদ্দেক সরকারকে উত্খাতে সিআইএ ভূমিকা রাখে। ভিয়েতনামে ১৯৬০ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত সামরিক হস্তক্ষেপ ইতিহাসে আগ্রাসী নীতির অন্যতম উদাহরণ হয়ে আছে। ১৯৬৪ সালে পানামাতে আমেরিকা সৈন্য পাঠিয়ে পানামা খালের ওপর ওই দেশের সার্বভৌমত্বের দাবি নস্যাত্ করে। ১৯৬৫ সালে ইন্দোনেশিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপ এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। সেই হস্তক্ষেপে ১০ লাখের বেশি কমিউনিস্ট নিহত হয়েছিল। ১৯৬৫-১৯৬৭ সালে ডমিনিকান রিপাবলিক এবং গুয়াতেমালায় আমেরিকা হস্তক্ষেপ করে। কম্বোডিয়ায় ১৯৬৯ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর সঙ্গে যুক্ত আছে মার্কিন সমরনীতি। ১৯৮১ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত নিকারাগুয়ায় হস্তক্ষেপের কথা আমরা জানি। ১৯৮৩-১৯৮৪ সালে গ্রানাডাতে মার্কিন বাহিনী হামলা করে বিপ্লবকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে। ১৯৮৭-৮৮ সাল পর্যন্ত ইরান-ইরাক যুদ্ধে ইরাকের পক্ষে মার্কিন বাহিনী হস্তক্ষেপ করে। ১৯৮৯ সালে পানামায় সরকার উচ্ছেদ করার লক্ষ্যে কয়েক হাজার সেনা পাঠানো হয়। ১৯৯০-৯১ সাল পর্যন্ত ইরাকের বিরুদ্ধে আমেরিকা সেনা পাঠায়। ২০০৩ সালে ইরাক দখল করতে দেখি। ২০০১ সালে আফগানিস্তান, ২০১৪ সালে সিরিয়া, ইরাক ইত্যাদি অঞ্চলে সামরিক হস্তক্ষেপ তার সামরিক ইতিহাসের কলঙ্ক হয়ে আছে।

সামরিক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কথা ধরা যাক। কারণ সেখানেই তৈরি হচ্ছে সবচেয়ে উন্নততম মারণাস্ত্র। সামরিক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের প্রথম ১১টির মধ্যে ৯টি আমেরিকার, ২টি ইউরোপীয়। এই সামরিক শিল্পই কিন্তু ১৯৩০ সালের অর্থনৈতিক মন্দা থেকে আমেরিকাকে উদ্ধার করেছিল। প্রেসিডেন্ট রিগ্যান ক্ষমতায় আসার পাঁচ বছর আগে আমেরিকার নিওকনরা (নব্য রক্ষণশীলেরা) ‘কমিটি অন দ্য প্রেজেন্ট ডেনজার’ নামে একটি কমিটি গঠন করে। ৬১ জন ডিরেক্টরের মধ্যে ছিলেন প্রধান প্রধান নিওকন, যাঁদের অনেকেই পরবর্তী সময়ে রিগ্যানের প্রশাসনে যোগ দেন। তাঁদের মধ্যে ডোনাল্ড রামসফেল্ড, জর্জ সুলটস, রিচার্ড পারলস, উইলিয়াম ক্রিস্টল, রিচার্ড পাইপ্স উল্লেখযোগ্য (প্রেট্রাস ও ভেল্টমেয়ার, ২০০৫: ১৮৬)। ক্লিনটনের সময় তাঁরা ‘প্রজেক্ট ফর অ্যান আমেরিকান সেঞ্চুরি’ গঠন করেন। তাঁদের লক্ষ্য মধ্যপ্রাচ্যের তেলের খনি। কন্ডোলিত্সা রাইস এবং কলিন পাওয়েল তৈরি করেন ‘ডিফেন্স গাইডেন্স’ প্ল্যানিং, যেখানে আরও জোরেশোরে আমেরিকান নীতি বাস্তবায়ন করার কথা বলা হয়। ইরাক ও আফগানিস্তান দখল করার মূল লক্ষ্য ছিল মধ্য এশিয়ায় প্রবেশ করা এবং রাশিয়ার আশপাশে সামরিক ঘাঁটি গড়ে তোলা। আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে আমেরিকার লক্ষ্য হচ্ছে মধ্য এশিয়া দিয়ে তেল এবং গ্যাস পাইপলাইন ভারত মহাসাগরে আনা। এভাবে রাশিয়া ও ইরানকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হবে বলে আমেরিকার আশা। ন্যাটো নামে যে সামরিক প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়, সেটিও এই সার্বিক মার্কিন প্রভাবিত নেটওয়ার্কের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এর পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক বিশেষ ধরনের অবকাঠামো গড়ে তুলেছে, যা তার অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতাকে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করে। আজকের ইন্টারনেটের বদৌলতে একধরনের সুপার হাইওয়ে গড়ে তুলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যোগাযোগের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে।

সাংস্কৃতিক ও আদর্শিক শক্তি

প্রখ্যাত চিন্তাবিদ এডওয়ার্ড সাইদ কোনো একসময় লিখেছিলেন, সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তার সংস্কৃতিকে ব্যবহার করে সাম্রাজ্যের কর্তৃত্ব টিকিয়ে রাখতে। কথাটা মিথ্যা নয়। ইতিহাসে দেখেছি সংস্কৃতি এবং আদর্শ এমন একটি জগত্, যাকে ব্যবহার করে নানা শক্তিধর দেশ তার ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য তার সময়ে সেটি করেছিল। রোমান সাম্রাজ্য থেকে শুরু করে পারস্য সাম্রাজ্য বা রুশ বা অটোমান সাম্রাজ্য—সবাই তাদের চারপাশে আদর্শের বেষ্টনী গড়ে না তুলে শাসন করেনি বা বিশ্বপ্রভুত্ব টিকিয়ে রাখেনি। যে আদর্শই (টীকা ১) ধরি না কেন, সেখানে নানা ধরনের প্রতীকী শব্দ থাকে। সেগুলো ব্যবহার করা হয় নানা লক্ষ্য নিয়ে। তার মধ্যে অন্য দেশের সংস্কৃতি নিজের সংস্কৃতি থেকে পৃথক করে দেখা একটি। সেই দেখার মধ্যে থাকে উন্নাসিকতা, ঘৃণার ছোঁয়া। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও নিজেকে অন্যান্য সব সভ্যতা বা সংস্কৃতি থেকে ভিন্নভাবে তুলে ধরে (Orientalist)। সেই ভিন্নতাকে নানাভাবে মানুষের মনে প্রোথিত করা হয় মিডিয়া বা অন্যান্য মাধ্যমের সহায়তায়। আমেরিকা ব্যতিক্রমী (American exclusivenessএকটি দেশ—এই দাবি করে আমেরিকার জীবনধারাকে সর্বজনীন হিসেবে দেখার পরামর্শ দেওয়া হয়। তাকে উদাহরণ হিসেবে নিয়ে অন্যান্য সমাজে আমেরিকান স্টাইলে জীবন পরিচালনার উপদেশ থাকে। বিগত বছরগুলোতে আমেরিকা এভাবে সে তার হেজিমনি (টীকা ২) প্রতিষ্ঠা করেছে। গড়ে তুলেছে এমন একটি আদর্শিক কাঠামো, যেখানে অন্য দেশকে নানাভাবে হেয় করা হয়, ভুল তথ্য দিয়ে তাদের ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়। নানা ধরনের শব্দ চয়ন করে নিজের ক্ষমতার আশপাশে এভাবে গড়ে তোলা হয়েছে অদৃশ্য এক প্রতিরক্ষা অঞ্চল।

এ ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দুই ধরনের কৌশল গ্রহণ করে। একদিকে তাকে দেখি কঠিন বা দমনমূলক শক্তি প্রয়োগ করতে। সেই কঠিন শক্তির (coercive power) মধ্যে রয়েছে আইন, সামরিক বাহিনী, পুলিশ ও জেলখানা। প্রতিপক্ষের মনে ত্রাস, ভয়-ভীতি সৃষ্টি করে তার ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জের ঊর্ধ্বে রাখার স্বপ্ন দেখা হয়। সেটি আমরা দেখেছি নানা ক্ষেত্রে—ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান, লিবিয়ার মতো দেশে। প্রয়োজনে আমেরিকা অন্য দেশের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার নামে অন্য দেশে আগ্রাসন চালিয়েছে। আরও রয়েছে নিপীড়ন। সন্ত্রাস দমনের নামে কীভাবে গণহারে আফগানিস্তান বা ইরাক থেকে যুদ্ধবন্দী বা সন্দেহভাজনদের নিয়ে কিউবার গুয়ানতানামো বে নামক স্থানে আটক রাখা হয়েছিল। তবে এরই পাশাপাশি আছে নরম শক্তির প্রয়োগ। নরম শক্তি (persuasive power) বলতে বোঝায় আদর্শ দিয়ে অন্যের মনকে প্রভাবিত করা। সেটি করা হয় নানা উপায়ে—পরিবারকে ব্যবহার করে, চার্চকে দিয়ে নানা কিছু প্রচার করে, শিক্ষা ও মিডিয়াকে কাজে লাগিয়ে। আদর্শগত যুদ্ধটি তো আর এক দিনের ব্যাপার নয়। সে কারণে এটি পরিচালিত হয় রাষ্ট্রের সহায়তায়। এখানে আমেরিকা কী ধরনের যুদ্ধ পরিচালনা করে তার কিছু নমুনা তুলে ধরা যায়। পাবলিক ডিপ্লোম্যাসির ওপর মার্কিন উপদেষ্টা কমিশন বলে একটি শাখা আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্টে রয়েছে। ওই শাখা থেকে ২০০৫ সালে বলা হয়েছে, আমেরিকা তার প্রভাব বজায় রাখতে কী ধরনের পাবলিক কূটনীতির আশ্রয় নিয়ে থাকে। এই কূটনীতির মূল দিক হচ্ছে তথ্য দিয়ে অথবা কোনো জনগোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত থেকে বিদেশি নাগরিকদের প্রভাবিত করা। এই কূটনীতির মধ্যে পড়ে প্রচার, সংস্কৃতি, শিক্ষা, তথ্য, নাগরিক আদান-প্রদান। পাবলিক কূটনীতির জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বছরে ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে। সাংস্কৃতিক কূটনীতিও এর অন্যতম অংশ। তার মধ্যে রয়েছে শিল্প-সংস্কৃতি, মার্কিন সিনেমা, সংগীত, সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি আদান-প্রদান, অন্য দেশের সঙ্গে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সহযোগিতার নামে মার্কিন জীবনধারা প্রচার করা (ইজাদি, ২০১ পৃ. ১৬)।

এই সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আমেরিকার একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় বিশেষভাবে কার্যকর। সংস্কৃতি বলতে এখানে উচ্চমানের সংস্কৃতি বলছি না। বলছি প্রাত্যহিক জীবনাভ্যাসের সঙ্গে যুক্ত যেসব গণভিত্তিক সংস্কৃতি, সেগুলোকে। যেমন খাদ্যাভ্যাস। মার্কিন ধাঁচে যেসব রেস্তোরাঁ বা ফাস্ট ফুডের দোকান চালু আছে, সেগুলোর বিশেষ ভূমিকা রয়েছে মার্কিন প্রভাবকে ছড়িয়ে দেওয়ার। ম্যাকডোনাল্ড, কেএফসি, কোকাকোলার মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠান তার উদাহরণ। মিডিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে দেখি হলিউড বা ডিজনিল্যান্ডকে। এগুলো উন্নয়নশীল দেশে বাণিজ্যিক পর্যায়ে বিতরণ করা হয় তুলনামূলকভাবে কম মূল্যে। ফলে ওই সব দেশ ওই ধরনের সিনেমা তৈরি করে না। এভাবে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক উপাদানের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। অনেকে একে দেখে থাকেন ইলেকট্রনিক সাম্রাজ্যবাদ হিসেবে। ইংরেজি ভাষারও গুরুত্ব রয়েছে। বই প্রকাশ থেকে শুরু করে পাঠ্যসূচি তৈরি করে উন্নয়নশীল দেশের ওপর সেগুলো চাপিয়ে দেওয়া হয়। সাহিত্য ছায়াছবি, ইন্টারনেট, সংগীত ইত্যাদি ধরনের মার্কিন সাংস্কৃতিক পণ্য রপ্তানি করে সাংস্কৃতিক আধিপত্য নিশ্চিত করা হয়ে থাকে। আজ ৫০ থেকে ৯০ শতাংশ ছবি ইউরোপে আসে আমেরিকার হলিউড থেকে। সে তুলনায় ইউরোপের নিজস্ব ছবির পরিমাণ মাত্র ৩ শতাংশের বেশি নয়। তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশে হলিউডের ছবির পরিমাণ ৮০ শতাংশ পর্যন্ত হতে দেখি। এসব ছবিতে আমেরিকার জীবনধারা তুলে ধরা হয় এবং তাকে আদর্শ হিসেবে দেখার তাগিদ থাকে। সাদা অ্যাংলো-সাক্সন প্রোটেস্ট্যান্ট সংস্কৃতিকে দেখানো হয় সমাজের স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে। ঐতিহাসিক ছবিতে আমেরিকাকে দেখানো হয় বিশ্বসভ্যতার ধারক হিসেবে, যেন বিশ্বকে নানা ধরনের আপদ-বিপদ থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব একমাত্র তার। ইরান, রাশিয়া, চীন, উত্তর কোরিয়াকে শত্রু বানানো হয়। অন্যদিকে ইতিহাসে ব্যক্তির ভূমিকাকে বড় করে দেখানো হয়। ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা আমেরিকার মূল্যবোধ হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। তার প্রতিফলন লক্ষ করি এয়ারফোর্স ওয়ান (১৯৭৭ সালের ছবি), ইনডিপেনডেন্স ডে (১৯৯৬), সেভিং প্রাইভেট রায়ান (১৯৯৮) ইত্যাদি ছবিতে। এমনকি অন্যান্য দেশের লোকগাথাকে বিকৃত করতে হলিউড দ্বিধা করে না। যেমন ডিজনি মুভি মুলান (১৯৯৮)। মিডিয়ার গুরুত্ব অস্বীকার করা কঠিন। সিএনএনের মতো মিডিয়া দর্শকের কাছে সংবাদ পরিবেশন করে আমেরিকার জীবন ও রাজনীতির আলোকে। সেখানে নিরপেক্ষতার আড়ালে পশ্চিমা বিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা হয়। তা ছাড়া এমন সব ইস্যুর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়, যেগুলো অন্য দেশের জন্য প্রাসঙ্গিক নয়। যেমন গে (Gay) অধিকার প্রচার করা। আফ্রিকার মতো দেশে এই ইস্যু অনেকটা অপ্রাসঙ্গিক হলেও আমেরিকা সাবসাহারার মতো অঞ্চলে ৩৫০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে গে অধিকার প্রচারকাজে। আরও রয়েছে নানা দেশে তার সমর্থক রাজনীতিবিদ, রাষ্ট্রনায়ক। ইরানের এককালের রেজা শাহ পাহলভি, ইরাকের সাদ্দাম হোসেন, মিসরের হোসনি মোবারক, পাকিস্তানের জেনারেল মোশাররফ অথবা আফগানিস্তানের হামিদ কারজাই তার কিছু উদাহরণ।

যদি এ সবকিছুকে সংক্ষেপে প্রকাশ করা হয়, তাহলে দেখি এই বিশাল কাঠামো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসী নীতিকে তুলে ধরছে নানাভাবে, নানা পথে। সেই আগ্রাসী রাষ্ট্রের তাত্ত্বিক কাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে অর্থনীতি ও রাজনীতিতে নব্য রক্ষণশীল ধারা প্রবর্তন করে। প্রফেসর অ্যান্ড্রু বাকভিচ (বাকভিচ, ২০০৯: ৩৪) আমেরিকার রাষ্ট্রব্যবস্থায় পাঁচটি প্রধান বৈশিষ্ট্য লক্ষ করেছেন। বৈশিষ্ট্যগুলো হচ্ছে, আমেরিকার বিশ্বনেতৃত্বকে (domination) কল্যাণকর বলে ধরে নিতে হবে। অর্থাত্ আমেরিকার উদ্দেশ্য অন্যের মঙ্গল করা। ধরে নিতে হবে মার্কিন নেতৃত্বের ক্ষেত্রে যেকোনো ধরনের দুর্বলতা (lapse) বিশ্বব্যাপী বিশৃঙ্খলার জন্ম দেবে। সে কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মনে করে বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে এবং তার জন্য সামরিক শক্তি প্রয়োগ করা জরুরি হলেও ন্যায়সংগত। অন্যান্য দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের লক্ষ্যে আমেরিকার সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করা প্রয়োজন এবং যদি প্রয়োজন হয় তাহলে একাধিক অঞ্চলে আমেরিকার সামরিক তত্পরতা কার্যকর করা প্রয়োজন। আমেরিকার বহির্দেশীয় কূটনীতি এবং রাজনীতি হবে আক্রমণাত্মক এবং যেকোনো শক্তিকে পরাজিত করা তার একমাত্র লক্ষ্য। এভাবে তার নিজের এক জগত্ তৈরি করে অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি ও আদর্শের জগেক সে নিয়ন্ত্রণ করে।

বিশ্ব ট্র্যাজেডির কথকতা

বিশ্বায়ন-প্রক্রিয়া দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে আজ যে পর্যায়ে পৌঁছেছে সেখানে তার একটি সার্বিক মূল্যায়ন হওয়া প্রয়োজন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা থেকে একটি উদ্ধৃতি নিয়ে সেটি শুরু করতে চাই। রবিঠাকুর প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের এক সমালোচনায় লিখেছেন, ‘মহাভারতের অপেক্ষা মহান ট্র্যাজেডি কে কোথায় দেখিয়াছ? স্বর্গারোহণ কালে দ্রৌপদী ও ভিমার্জুন প্রভৃতির মৃত্যু হইয়াছিল বলিয়াই যে মহাভারত ট্র্যাজেডি তাহা নহে, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ভিম কর্ণ দ্রৌন এবং শত সহস্র রাজা ও সৈন্য মরিয়াছিল বলিয়াই যে মহাভারত ট্র্যাজেডি তাহা নহে—কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যখন পাণ্ডবদিগের জয় হইল তখনি মহাভারতের যথার্থ ট্র্যাজেডি আরম্ভ হইল। তাহারা দেখিলেন জয়ের মধ্যেই পরাজয়। এতো দুঃখ এতো যুদ্ধ এতো রক্তপাতের পর দেখিলেন হাতে পাইয়া কোন সুখ নাই, পাইবার জন্য উদ্দমেই সুখ; যতটা করিয়াছেন তাহার তুলনায় যাহা পাইলেন তাহা অতি সামান্য।’ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৯৮৯ পৃষ্ঠা ৫)। কথাটা কিন্তু গভীরভাবে সত্য এবং সে সত্য কেবল মহাভারতের চরিত্রের জন্য প্রযোজ্য নয়। বিগত তিন দশক ধরে বিশ্বায়ন অভূতপূর্ব সাফল্য দেখিয়ে এসেছে। যোগাযোগব্যবস্থা থেকে শুরু করে বাণিজ্য, অর্থ বিনিয়োগ, যাতায়াত, অভিবাসন—সব ক্ষেত্রে এসেছে গভীর ও বিস্তৃত পরিবর্তন। বহু দরিদ্র দেশ ধনী হয়েছে। ধনী দেশ আরও ধনী হয়েছে। সমাজের দরিদ্র স্তরের মানুষের জীবনে এসেছে প্রাচুর্য। আন্তরাষ্ট্রীয় যোগাযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। নানা ধরনের চুক্তি সই করে বিভিন্ন দেশ বাণিজ্য আঁতাত গড়ে তুলেছে। তাতে করে সৃষ্টি হয়েছে মুক্তবাণিজ্যের সুযোগ। তবে বিশ্ব অর্থনীতির জন্ম হয়েছে বলে যে কথাটি শোনা যায়, সেটি আসলে কয়েকটি প্রধান প্রধান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্লক ছাড়া কিছু না। তার মধ্যে ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও এশিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করা যায়, যার অভ্যন্তরে গড়ে উঠছে পুঁজিবাদের বিভিন্ন ধরন। এর বাইরে যারা আছে তারা ওই তিন অঞ্চলের চাপে নিষ্পেষিত হচ্ছে। এরই সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে পুরোনো ধাঁচের ভূরাজনীতি, যেখানে জাতিস্বার্থ প্রবল গতিতে জন্ম দিচ্ছে যুদ্ধংদেহী মনোভাবের। ফলে মাথাচাড়া দিচ্ছে এক নব্য সাম্রাজ্যবাদ। এ সবকিছুকে বিশ্বায়নের সাফল্য হিসেবে মন্তব্য করলেও এরই মধ্যে লুকিয়ে আছে ট্র্যাজেডি। আছে সংকট, পতন, ধ্বংসের বীজ। সে কারণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেওয়া ট্র্যাজেডির মর্মকথাটি বিশ্বায়নের ক্ষেত্রে ঠিক ঠিক খেটে যায়।

ক্যাপিটালিজম অব নাথিং

বিশ্বায়ন-প্রক্রিয়ায় গতি জোগায় পুঁজিবাদী অর্থনীতি। এদ্রিয়ান উলদ্রিজ (উলদ্রিজ, ২০১৭) নামে এক ব্রিটিশ পণ্ডিত, আজকের দিনের পুঁজিবাদকে ‘ক্যাপিটালিজম অব নাথিং’ বলে দাবি করেছেন। অতীত দিনের পুঁজিবাদের মতো তার নানা সাফল্য আছে। কিন্তু তার পাশাপাশি রয়েছে বিপুল মানুষের দুর্ভোগের ইতিহাস, দারিদ্র্যের কঠোরতা, হতাশা, যুদ্ধবিগ্রহ এবং রাষ্ট্রের আগ্রাসী নীতি। এর সঙ্গে নতুন যে উপাদান যুক্ত হয়েছে তা হলো—বড় বড় কোম্পানির হাতে প্রচুর সম্পদ কেন্দ্রীভূত হলেও ওই সব কোম্পানিতে নিয়োজিত শ্রমিক বা কর্মচারীদের সংখ্যা কমছে ক্রমাগত। গুগলের মতো বিশাল কোম্পানির শ্রমশক্তি মাত্র ৫০ হাজার। অথচ অর্থের দিক থেকে বিশ্বের অন্যতম বড় এক কোম্পানি। এই ‘ক্যাপিটালিজম অব নাথিং’-এর আরও একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এর কারণে আমেরিকার মতো বড় অর্থনীতির দেশে মানুষ চাকরি খোয়াচ্ছে, বেকার হচ্ছে। বহু চাকরি চলে যাচ্ছে বিদেশে। ডালাস, টেক্সাসের মতো এককালের বিত্তশালী মুখরিত শহর আজ হয়ে পড়ছে নিঃস্ব। আজ পুঁজির গন্তব্যস্থান দেশের বাইরে, যেখানে শ্রম সস্তা; পরিবেশ রক্ষা আইন প্রবলভাবে অনুসরণ করা হয় না; শুল্কের ক্ষেত্রেও রয়েছে প্রচুর সুবিধা। শ্রমশক্তিকে প্রতিনিধিত্ব করার ট্রেড ইউনিয়ন নেই। ফলে কোম্পানির মুনাফা অনেক বেশি। দেশের অভ্যন্তরেও ঘটছে এই ধারার প্রয়োগ। মার্কিন কোম্পানি পুঁজি স্থানান্তর করছে দেশের এমন সব অঞ্চলে, যেখানে শ্রমিকের স্বার্থরক্ষার কোনো প্রতিরক্ষা নেই। জেনারেল ইলেকট্রিক নামের কোম্পানি তার পুঁজি এবং ব্যবসা সরিয়ে নিয়েছে মিয়ামিতে। সেখানে শ্রমের জন্য যে মূল্য দিতে হয়, সেটি আগের স্থানের তুলনায় প্রায় অর্ধেক। ট্রেড ইউনিয়ন অনুপস্থিত। এ ছাড়া রাজনীতিতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার বদলে জনপ্রিয় হচ্ছে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ ও রক্ষণশীল নীতি। প্রবণতাটি বিচ্ছিন্ন নয়। গোটা বিশ্বে এটি দৃশ্যমান।

আমেরিকার ক্ষেত্রে বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে ক্ষোভ এবং তার রাজনৈতিক প্রকাশ ঘটতে দেখি ডোনাল্ড ট্রাম্পের দুটি স্লোগান থেকে, যা কিনা উগ্র জাতীয়তাবাদী—‘আবার আমেরিকাকে শক্তিশালী এবং মহান করো’ এবং ‘আমেরিকানদের জন্য আমেরিকা’। এই স্লোগানের উদ্দেশ্য বিশ্বায়নসৃষ্ট সংকট থেকে আমেরিকাকে উদ্ধার করা। সে সংকট অনেকের ধারণায় প্রজন্মগত, যার শুরু হয়েছিল ২০০৮ সালের বৈশ্বিক ফিন্যান্স ব্যবস্থার পতন দিয়ে। তার সঙ্গে আরও যোগ হয়েছে উগ্রবাদ। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও (ফ্রিডম্যান, দ্য আটলান্টিক) এই সংকটের প্রতিফলন দেখছেন অনেকে। বিগত ১৫ বছরে আমেরিকার বৈদেশিক নীতি সফল হয়নি। উত্তর কোরিয়াকে পারমাণবিক অস্ত্র থেকে বিরত রাখতে পারেনি। ইরানকে শায়েস্তা করতে পারেনি। মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব কমেনি (দ্য আটলান্টিক, ২০১৬)। ইরাক ও আফগানিস্তানে শান্তি আসেনি। সেখানে প্রগতিশীল, পশ্চিমা ঘেঁষা সরকার এবং রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। জিহাদি শক্তিকে দমাতে পারেনি। আরব বসন্তের পর মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন প্রভাব বৃদ্ধি পায়নি। পূর্ব ইউরোপে রাশিয়াকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেনি। পারেনি এশিয়ায় চীনের শক্তিকে খর্ব করতে। ব্যর্থ হয়েছে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন বিরোধের মীমাংসা করতে। অথচ আমেরিকার প্রতিটি প্রজন্ম বড় হয়েছে মার্কিন সাফল্যকে গ্যারান্টি হিসেবে ধরে নিয়ে।

ফলে বর্তমান প্রজন্মের দায়িত্ব এই সংকট থেকে উদ্ধার করা, জাতীয় আত্মপরিচয়কে ঝালিয়ে নেওয়া, নতুন আত্মপরিচয় গড়ে তোলা—বিদ্যমান কাঠামোয় পরিবর্তন এনে নতুন কাঠামো গড়া, ঠিক যেমন বনভূমির বৃদ্ধির জন্য নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে আগুন ধরাতে হয়, নদীর নাব্যতার জন্য প্রয়োজন হয় বন্যার (দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট, ২০১৭)। যে পথ এ ক্ষেত্রে অনুসরণের উপদেশ দেওয়া হচ্ছে, তাতে রয়েছে উগ্র জাতীয়তাবাদ, সামরিক শক্তি বৃদ্ধি, মুক্ত বাণিজ্য বিরোধিতা, মুসলিম-বিরোধিতা এবং খ্রিষ্ট-ইহুদি ঐতিহ্যে নতুন আমেরিকা গড়ে তোলা। বিশ্বায়নবিরোধী এই প্রবণতা ইউরোপেও লক্ষ করার মতো। সেখানে তার রূপ যদিও কিছুটা ভিন্ন। আক্রোশটা সেখানে প্রথমে পড়তে দেখি ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিরুদ্ধে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিশ্বায়নের বড় প্রতীক। দেশের মধ্যকার সীমান্ত বিলোপ করে, একক অর্থনীতি ও মুদ্রাব্যবস্থায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে এবং কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার আওতায় দেশের নীতি গড়ে তুলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিশ্বসংযোগের প্রকৃত উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। অথচ ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়ল। ফ্রান্স, হল্যান্ডের নানা দেশে ইউরোপীয় ইউনিয়নবিরোধী তুফান আজ ঘোরতর আকার ধারণ করছে। উদ্বাস্তু এবং বহিরাগত অভিবাসীর বিরুদ্ধে অবস্থান, তাদের উচ্ছেদ আন্দোলন এবং দেশের তাবত্ সমস্যার জন্য তাদের দায়ী করা বিশ্বায়নবিরোধী প্রবণতার অন্য দিক। মুসলিম জাতিবিদ্বেষের ভূমিকাও কম নয়। ফ্রান্সে বিশ্বায়নবিরোধী রাজনৈতিক নেত্রী ন্যাশনাল ফ্রন্ট পার্টির মেরিন লে পেনের জনপ্রিয়তা বেড়েছে মুসলিম-বিরোধিতার কারণে। নেদারল্যান্ডসে ‘পার্টি ফর ফ্রিডমে’র নেতা গিয়ার্ট উইলডার্সের জনপ্রিয়তার মূলে মুসলিম-বিরোধিতা। ইমিগ্রেশন-বিরোধী জার্মান পার্টির নেতা উয়ে জুঙ্গের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে একই কারণে। গ্রিসে ‘গোল্ডেন ডন’ পার্টির নেতা নিকস মিকালোলিয়াকসের দল তৃতীয় বৃহত্ রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে জার্মানির অতিমাত্রায় কঠোর কৃচ্ছ্রতার উপদেশকে বিরোধিতা করছে। হাঙ্গেরির ‘জোবিক পার্টি’র নেতা গাবোর ভেনার জনপ্রিয়তা ইদানীংকালে বৃদ্ধি পেয়েছে। সুইডেনে ‘সুইডিশ ডেমোক্র্যাটস পার্টি’র নেতা জিম্মি একেসনের অভিবাসনবিরোধী, ইউরোপীয় ইউনিয়নবিরোধী নীতি জনপ্রিয়। এভাবে লক্ষ করা যাচ্ছে বিশ্বায়নবিরোধী নানা শক্তির উত্থান। এই সঙ্গে যোগ হচ্ছে প্রবল সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে ক্ষোভ। একক পৃথিবী এবং বিশ্ব অর্থনীতির ধারণা নাকচ হচ্ছে। অসাম্যের দিক থেকে ভাবলে বিশ্বায়নের কুফল দুই দিক থেকে প্রতিভাত হয়। একদিকে উন্নয়নশীল দেশ এবং পশ্চিমা দেশের মধ্যে দূরত্ব আরও প্রসারিত হচ্ছে, অন্যদিকে প্রতিটি রাষ্ট্রে কিছু মানুষ অভূতপূর্ব দ্রুততার সঙ্গে সম্পদের মালিক হয়ে বাকি সমাজ থেকে পৃথক হচ্ছে। যে সমাজকে সে পরিত্যাগ করছে সেখানে রয়ে গেছে লাখ লাখ দরিদ্র মানুষ।

সামাজিক বৈষম্য

বিশ্বায়নের কারণে সব দেশ একইভাবে উপকৃত হচ্ছে না। উন্নয়নশীল দেশগুলো অতি উন্নত দেশের সমকক্ষ হওয়া দূরের কথা, উল্টো আন্তরাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও সম্পদের ক্ষেত্রে গড়ে উঠছে ভয়ানক অসমতা। দক্ষিণ আমেরিকায় ১৯৯০ সালে ১৮৩ মিলিয়ন মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত। সেই সংখ্যা ১৯৯৫ সালে বেড়েছে (এখন দাঁড়িয়েছে ২৩০ মিলিয়ন) (রবিনসন ২০১২: ২৫)। সেখানে ৫৯ মিলিয়ন মানুষ আজও ক্ষুধার্ত থাকে। ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। ১০ লাখের হাতে অর্থ নেই চিকিত্সার সুযোগ নেওয়ার। ১৩ লাখের বিশুদ্ধ পানির ঘাটতি আছে। আর ১৭ লাখের কোনো স্বাস্থ্যকর শৌচাগার নেই (রবিনসন, ২০১২: ২৫)। পূর্ব এশিয়ার উন্নতি নিয়ে আমরা গর্ব করি। বলি চীনের অগ্রগতির কথা। কোরিয়া থেকে শুরু করে টাইগার অর্থনীতি নামে পরিচিত দেশগুলোর ধনশালী হওয়ার কাহিনি। কিন্তু সেখানে মানুষের গড় আয় পশ্চিমা দেশের গড় আয়ের মাত্র ১৩ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের হিসাবমতে, গত ২০ বছরের মধ্যে যারা দিনে এক ডলারে জীবন যাপন করত, তাদের সংখ্যা কমলেও ছয় বিলিয়ন মানুষের মধ্যে ১-২ বিলিয়ন মানুষ ঠিকই ১৯৮৭-১৯৯৮ সালের মতো দিনে এক ডলার দিয়ে জীবন ধারণ করছে (ওয়েড, ২০১২: ১৮৮)। অসমতা আরও বোঝা যায় ১৯৬০ ও ১৯৯৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে ধনী পাঁচটি দেশের মাথাপিছু আয়ের সঙ্গে দরিদ্র পাঁচটি দেশের মাথাপিছু আয়ের অনুপাত থেকে, যা বৃদ্ধি পেয়েছে আড়াই গুণ। ১৯৩৭ সালে বিশ্বের ১৪৭টি দেশের মধ্যে ১০০টি গত ৩০ বছরে অর্থনৈতিক অবনতির শিকার হয়েছে। ছয় বিলিয়ন জনসাধারণের মধ্যে পাঁচ বিলিয়ন বাস করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। সেখানে তাদের প্রতিদিনের আয় দুই ডলারের বেশি নয়। প্রায় ১-৩ বিলিয়ন মানুষ দিনে মাত্র এক ডলার দিয়ে জীবন যাপন করে।

বিশ্বব্যাংকের অন্য হিসাবে দেখা যায়, এক বিলিয়ন শিশুর প্রতি দুজনের মধ্যে একজন দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করে। ৬৪০ মিলিয়ন মানুষের মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। ৪০০ মিলিয়ন বিশুদ্ধ পানি থেকে বঞ্চিত, ১০-১১ মিলিয়ন প্রতিবছর মৃত্যুবরণ করে পাঁচ বছরে না পৌঁছাতেই (২৯ হাজার শিশু প্রতিদিনে)। ১৮ মিলিয়ন মানুষ মৃত্যুবরণ করে যে সংখ্যা সকল মৃত্যুর তিন ভাগের এক ভাগ এবং মৃত্যুর কারণ ক্ষুধা। প্রতিদিন ৫০ হাজার নারী-পুরুষের মৃত্যু হচ্ছে ক্ষুধা, নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, ম্যালেরিয়া, হাম ও জন্মসংক্রান্ত কারণে। অথচ দরিদ্র দেশগুলোতে ন্যূনতম শিক্ষা ও কল্যাণের পেছনে বছরে ৩০ থেকে ৪০ বিলিয়ন খরচই যথেষ্ট। দুঃখজনকভাবে এই অর্থের জোগান দেওয়া সম্ভব না হলেও চকোলেট এবং চুইংগামের পেছনে কেবল আমেরিকা ব্যয় করছে ২৭ বিলিয়ন, অ্যালকোহলের পেছনে ৭৩ বিলিয়ন, গাড়ির পেছনে ৬০০ বিলিয়ন। ইউরোপের ক্ষেত্রে ওই চিত্র ভিন্ন নয়। সিগারেট ও অ্যালকোহলের পেছনে সেখানে ব্যয় হয় ১৫০ বিলিয়ন, কুকুর-বিড়ালের পেছনে ১৭ বিলিয়ন। আর সামরিক খাতে? সেখানে তো খরচ আকাশচুম্বী। আমেরিকা লকহিড মার্টিন কোম্পানির তৈরি যুদ্ধজাহাজ এফ-৩৫-এর পেছনে ব্যয় হবে ১ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলার (স্যর, ২০১৭)। ওই অর্থ দিয়ে আমেরিকার সব শিক্ষার্থীর শিক্ষা খরচ মেটানো যেত। সব নিম্ন আয়ের মানুষের মেডিকেল বিমা করা যেত অন্তত তিন বছরের জন্য। বিশ্বের চারদিকে চারবার তিন মিটার উঁচু প্রাচীর নির্মাণ করা যেত (স্যর, ২০১৭)। এরই বিপরীতে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ২২৫ জনের সম্পদের পরিমাণ আজ দাঁড়িয়েছে এক ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি। এই পরিমাণ ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন দরিদ্র মানুষের বার্ষিক আয়ের চেয়েও বেশি। ৪৮টি দেশের জাতীয় আয় পৃথিবীর তিনজন সবচেয়ে ধনী ব্যক্তির সম্মিলিত আয়ের চেয়েও কম। এই অসমতা চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। আশঙ্কার কথা, সেই অসমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে কেবল উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে নয়। প্রতিটি দেশের অভ্যন্তরে সম্পদের বিভাজন প্রায় একই হারে বাড়ছে।

রাষ্ট্রের ভূমিকা কমে এসেছে

বিশ্বায়নের কারণে জাতিরাষ্ট্র তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলছে। বিশ্বায়নের মূল দার্শনিক ভিত উদারনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। অর্থনীতি, সমাজজীবন এবং রাজনীতিতে উদারনীতির প্রতিফলন নানাভাবে ঘটে। এটি যে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সংকটকে ঘনীভূত করতে পারে, সেটি আগে কেউ ভাবেনি। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লিও স্ট্রস (লিও স্ট্রস ১৮৯৯-১৯৭৩) সেটি লক্ষ করেছিলেন। অর্থনীতিতে উদারনীতি ভোগবাদী সমাজের জন্ম দেয়। তার চেয়েও বড় কথা, উদারনীতি সবকিছুকে প্রশ্ন করতে শেখায়। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের উপযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। শাসকশ্রেণির গ্রহণযোগ্যতাকে নিয়ে মানুষ প্রশ্ন করে। ফলে জন্ম নেয় এক জাতীয় নরম সর্বত্যাগবাদী (gentle nihilism) মনোভাবের। সমাজের প্রতিটি দিককে প্রশ্নবোধক করে তোলার যে সংস্কৃতি, তার কারণে আজ জন্ম নিচ্ছে একধরনের আপেক্ষিকতার (relativism)। এর ফলাফল—মূল্যবোধবর্জিত, লক্ষ্যহীন এবং সুখবাদী (hedonistic) এক সমাজ। এই সুখবাদ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে তার সংহতি বিনষ্ট করছে। মানুষ স্বার্থপর হচ্ছে। সমাজের বাঁধন ভেঙে পড়ছে। অথচ বিকল্প এমন কোনো আদর্শ নেই, যা কিনা সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে। ঐক্যবদ্ধ করার একমাত্র পথ হিসেবে লিও স্ট্রস বলেছেন কল্পকথা সৃষ্টির কথা। এমনভাবে যেন সেগুলোকে মানুষ সত্য হিসেবে গ্রহণ করে। সেই নীতির প্রতিফলন নানাভাবে লক্ষ করা যায় পশ্চিমা বিশ্বের ইদানীংকালীন রাজনীতিতে। জর্জ বুশের আমলে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বিভিন্ন বিভাগে যাঁরা দায়িত্বশীল পদে নিয়োজিত ছিলেন তাঁরা প্রত্যেকে লিও স্ট্রসের অনুসারী পল উলফভিচ (ডেপুটি সেক্রেটারি, প্রতিরক্ষা), এলেন কেইস (উপসেক্রেটারি, রাষ্ট্র); উইলিয়াম ক্রিস্টল, আলেন ব্লুম। তাঁরা মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে ইরাকবিরোধী প্ল্যাটফর্মে সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করতে চেয়েছিল এবং সফলও হয়েছিল। ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সিতে ‘বিকল্প সত্যের’ নামে মিথ্যাকে সত্য হিসেবে প্রচার করার তোড়জোড় চলছে এবং সেভাবে গড়ে তোলা হচ্ছে নানা ধারণা। তবে সেটিও কত দিন টিকিয়ে রাখা যাবে, তাতে সন্দেহ আছে।

অন্যদিকে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের গুরুত্ব প্রতিপন্ন হচ্ছে নানাভাবে। আগে বহুজাতিক/আন্তর্জাতিক মিটিং এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকা মুখ্য ছিল। আজ আন্তর্জাতিক মুদ্রাবাজার জাতীয় সরকারের অর্থনৈতিক নীতিমালাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। বিভিন্ন রেটিং কোম্পানি যেমন ‘স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পোরস’ রাষ্ট্রের ওপর খবরদারি করে। কোনো রাষ্ট্রের গুরুত্ব কতটুকু তা নির্ণীত হয় সরকারের অর্থ তহবিলের পরিমাণ দিয়ে, অর্থনীতিতে ব্যক্তিমালিকানার উপস্থিতি কতটুকু সেটি বিচার করে। এই ক্রেডিট বিশ্লেষণ নির্ণয় করে ব্যাংকের কাছে রাষ্ট্র কতটুকু দায়বদ্ধতা এবং তা পরিশোধ করার ক্ষমতা রাষ্ট্রের কতটুকু তার ওপর। ঋণদানকারী সংস্থাগুলো বাজারকেন্দ্রিক অর্থনীতির পক্ষে। জাতীয় সরকার ঋণের আশায় এমন সব রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নীতি প্রবর্তন করতে বাধ্য হয় যেগুলো আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ পুঁজির পক্ষে যায়। ওই নীতি বাস্তবায়নে ব্যর্থ হলে পুঁজি স্থানান্তরিত হয় সেসব দেশে, যেখানে রেটিং ভালো। ওয়াশিংটন পোস্ট প্রকাশিত ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে আইএমএফের নীতিমালা কী সেটি যথেষ্ট উদ্বেগজনক। সেই নীতিতে উল্লেখ আছে, যেসব দেশে সমস্যা বিদ্যমান তাদের পেনাল্টি রেটে ঋণ দেওয়া হবে। অর্থাত্ ৪-৫ এর বেশি হারে। রাষ্ট্রকে প্রমাণ করতে হবে তাদের যথেষ্ট পরিমাণে স্বর্ণ মজুত আছে, বিদেশি ব্যাংককে ব্যবসা করার অধিকার নিশ্চিত করবে এবং স্থানীয় ব্যাংককে কিনে নেওয়ার অধিকার রাখবে। ধার গ্রহণকারী রাষ্ট্র দেউলিয়া নীতির প্রতি বিশ্বস্ত থাকবে যে নীতি আমেরিকা ও ইউরোপে প্রযোজ্য। এভাবে অর্থনীতি সম্পৃক্ত হচ্ছে রাজনীতির সঙ্গে। কোনো দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা, সামাজিক স্থিতিশীলতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া এবং অন্য বহু ফ্যাক্টর নির্ভর করে আন্তর্জাতিক অর্থ সংস্থাগুলোর ওপর। তা ছাড়া বিশ্বায়নের ফলে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণক্ষমতা কমছে। জাতীয় নিরাপত্তা, অভিবাসন, মুদ্রা বিনিময়, অর্থ ও বিনিয়োগ, বাণিজ্য, কারখানার উত্পাদন, স্বাস্থ্য এবং ছোঁয়াচে রোগ নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রের বাইরে অবস্থানরত প্রতিষ্ঠানের হাতে চলে যাচ্ছে অথবা তাদের সিদ্ধান্তকে রাষ্ট্রের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বহুজাতিক করপোরেশনগুলো অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ের ওপর প্রভাব ফেলে। আন্তর্জাতিক অথবা আঞ্চলিক সংগঠনের সদস্যপদও তার সার্বভৌমত্বকে ক্ষুণ্ন করছে। যেসব বাণিজ্য ব্লক যেমন ইসি, নাফটা, অ্যাপেক, সার্ক আছে তারাও খর্ব করছে সরকারের নিয়ন্ত্রণকে। সর্বোপরি বিশ্বায়ন রাষ্ট্রের ভিতকে দুর্বল করে ফেলছে।

আত্মপরিচয়ের সংকট ও ধর্মের উত্থান

উদারনীতির প্রভাব উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর পড়ছে অন্য একভাবে। জাতিরাষ্ট্র যে ধরনের সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে তার মধ্যে প্রধান বলতে আত্মপরিচয়ের সংকটকে বোঝায়। আধুনিক জাতিরাষ্ট্র ইউরোপ ও আমেরিকায় গড়ে উঠেছিল আধুনিক জীবনধারা এবং ধর্মনিরপেক্ষতার আশ্রয়ে। ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা যখন ভেঙে পড়ে তখন এশিয়া, আফ্রিকা বা দক্ষিণ আমেরিকায় ইউরোপের অনুকরণে জাতিরাষ্ট্রের জন্ম হয়। এই জাতিরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে দুই ধরনের দ্বন্দ্ব বিদ্যমান ছিল। প্রথমত বহু জাতিরাষ্ট্র গঠিত হয়েছিল জাতি ধারণাকে কৃত্রিমভাবে তৈরি করে। প্রকৃত জাতিবোধ সেখানে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তে। সে ধরনের চক্রান্তে ভারতবর্ষে ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হলো। সেখানে জাতিপরিচয় কৃত্রিমভাবে ধর্ম দিয়ে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছিল। ডুরান্ড লাইন টেনে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে বিভেদরেখা আঁকা হয়েছিল প্রকৃত জাতিপরিচয়কে উপেক্ষা করে। অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর মধ্যপ্রাচ্যে জাতিরাষ্ট্রের জন্ম হয় কৃত্রিম পথে—১৯১৬ সালের শাইকস-পিকট ব্রিটিশ-ফরাসি ষড়যন্ত্রে স্বাক্ষরিত চুক্তির ফল হিসেবে। ১৯৫০ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যবর্তী সময়ে এসব রাষ্ট্র টিকে ছিল সোভিয়েত অথবা মার্কিন সাহায্য নিয়ে। তাদের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা ঢাকা পড়েছিল ঠান্ডাযুদ্ধের দ্বিমুখী সংঘাতের আড়ালে (ককবার্ন, ২০১৬)। সেই পর্দা আজ সরে গেছে। তাদের সংকটও সে কারণে দিনের আলোর মতো স্বচ্ছ হয়ে উঠেছে।

দ্বিতীয় সংকট, কয়েক যুগ ধরে জাতীয়তাবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত জাতিরাষ্ট্র পরিণত হয়েছে স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায়। গণতন্ত্রের নাম ব্যবহার করে শাসিত হলেও ক্ষমতায় অধিষ্ঠিতরা দেশ শাসন করেছে আইনের ঊর্ধ্বে দাঁড়িয়ে। শক্তি দিয়ে শাসন করায় বিদ্রোহ দমনে কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে। সেই স্বৈরাচারী চরিত্র এত দিন ঢাকা পড়ে ছিল দুই পরাশক্তির অন্তর্দ্বন্দ্বের আড়ালে। জাতিরাষ্ট্রের ব্যর্থতার সুযোগে যে নতুন আদর্শের আশ্রয়ে মানুষ সংঘবদ্ধ হতে চায় তার একটি হচ্ছে ধর্ম। তার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে নানা দেশে। আধুনিক জীবনের পরিবর্তে সেখানে নতুন জীবন গড়ার তাগিদ লক্ষ করা যায়। পূর্বপুরুষের ইতিহাস, তাদের ঐতিহ্য ধারণ করা; তাদের বীরদের আদর্শকে প্রতিফলিত করা সেখানকার রাজনীতিতে বিশেষ প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই ধরনের ধর্মীয় রাষ্ট্র সংখ্যালঘুদের ভূখণ্ড থেকে বের করে একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। ভারতে বিজেপির উদ্দেশ্য সেটি। বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর উদ্দেশ্য হিন্দু উচ্ছেদ করা। মিয়ানমারে বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মুসলিম রোহিঙ্গাদের উত্খাত করতে চায়। পাকিস্তানে সুন্নিরা মোহাজিরদের উত্খাত করতে আগ্রহী। আফগানিস্তানে হাজারা সম্প্রদায়কে দেশান্তরিত করা সুন্নি সম্প্রদায়ের লক্ষ্য। শিয়াপ্রধান দেশকে সুন্নিমুক্ত করা, সুন্নিপ্রধান দেশকে শিয়ামুক্ত করা, ইউরোপকে মুসলিমমুক্ত করা এক বৈশ্বিক প্রবণতায় পরিণত হয়েছে। এসব থেকে বোঝা যায়, যে জাতিরাষ্ট্র আধুনিক, গণতান্ত্রিক এবং জাতীয়তাবাদের ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছিল, সেই জাতিরাষ্ট্র আজ আদর্শগতভাবে গভীর সংকটে নিমজ্জমান। তার কাঠামো ভেঙে পড়ছে। ধর্মের ভাষা আজকের দিনের সাম্রাজ্যবিরোধী জাতীয়তাবাদভিত্তিক স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধ শক্তিতে পরিণত হয়েছে। জাতিরাষ্ট্রের যারা কর্ণধার ছিল তারা স্বৈরাচারী শাসনকে টিকিয়ে রেখেছিল সমাজতান্ত্রিক এবং প্রগতিশীল শক্তিকে পদানত করে। সেটি করতে গিয়ে তারা সে সময় ধর্মীয় শক্তির সঙ্গে আঁতাত করেছিল। আজ ধর্মীয় শক্তি ঘুরে দাঁড়িয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।

জার্মান সমাজবিজ্ঞানী টোনিজ (১৮৮৭-১৯৭১) সমাজকে দুই ভাগে ভাগ করেছিলেন। একটি প্রাক্-আধুনিক সমাজ। তাকে তিনি বলেছিলেন জেমেনসাফট (Gemeinschaft)। আর আধুনিক সমাজকে জেসেলসাফট (Gesellschaft)। প্রথমটিতে মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠে ঘনিষ্ঠ ও উষ্ণ সম্পর্ক। সেই সম্পর্ক বন্ধুত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত, অভিন্ন পরস্পর বিশ্বাস বোধ দিয়ে গাঁথা। দ্বিতীয় সম্পর্কটির ধরন অস্থায়ী, হালকা, অগভীর, চুক্তিভিত্তিক এবং স্বার্থের ওপর নির্মিত। বস্তুগত উন্নতির কারণে সমাজে জন্ম নেয় ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা। বিশ্বায়নের কারণে সেই বিচ্ছিন্নতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বায়নের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত প্রধান পাঁচটি প্রবাহ মানুষকে বিভ্রান্তিতে ফেলছে। ওই প্রবাহকে আপাদুরাই (আপাদুরাই ১৯৯০: ৪) নামের একজন নৃবিজ্ঞানী বলছেন স্কেপ। বিশ্বায়নের প্রধান প্রবাহ মানুষকে নিয়ে (Ethnoscapes)। মানুষের স্রোতোধারা এক স্থান থেকে চলেছে অন্য স্থানে। এর মধ্যে আছে ভ্রমণকারী, উদ্বাস্তু, অভিবাসী, অতিথি শ্রমিক আরও আছে অগণিত মানুষ, যারা সার্বক্ষণিকভাবে গতির সঙ্গে বাঁধা। মানুষকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে হচ্ছে নানা কারণে। গ্রাম থেকে মানুষ স্রোতের মতো ধেয়ে আসছে শহরপানে। উদ্বাস্তুরা চলেছে উন্নত দেশগুলোতে। অতিথি শ্রমিক গ্রাম ছেড়ে বড় শহরের দিকে চলছে। মানবশ্রমের এই স্রোতোধারার মূলে রয়েছে আন্তর্জাতিক পুঁজির চরিত্রগত পরিবর্তন। আন্তর্জাতিক পুঁজি আজ তার সুবিধামতো স্থানান্তরিত হচ্ছে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে। পুঁজি কোথায় যাবে নির্ভর করছে মুনাফার পরিমাণ কোথায় বেশি তার ওপর। এই অস্থিতিশীল জীবনে মানুষের কল্পনার কোনো স্থায়িত্ব নেই। সংস্কৃতির সঙ্গে স্থানের যোগাযোগ বিনষ্ট হচ্ছে। প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নতির কারণে বিদেশে বসবাসরতদের পক্ষে স্বদেশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা সম্ভব হচ্ছে, যদিও তার সঙ্গে দেশীয় সংস্কৃতির বিচ্ছেদ ঘটে গেছে (cultural deterritorialisation) বহু আগে। এই স্থানান্তরণ থেকে জন্ম নিচ্ছে অনিশ্চিত এক ভবিষ্যত্।

সংবাদ ও তথ্যের ক্ষেত্রেও চলছে একই ধারা (Mediascapes)। সেই সঙ্গে আছে আদর্শের প্রবাহ (Ideoscapes)। প্রতিটি প্রবাহ বিশ্ব যোগাযোগকে বাড়িয়ে দিলেও বিশ্বব্যাপী জন্ম দিচ্ছে বিচ্ছেদের। সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন, টেলিভিশন ও ছায়াছবির মাধ্যমে বহু চিত্র মানুষের সামনে হাজির হচ্ছে বটে কিন্তু যে ছবি সৃষ্টি করে সেটি খণ্ডিত বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করে (টমলিনসন, ২০১২:১৪৮)। ইউরোপীয় আদর্শের প্রচার, তার ধারণা ও প্রত্যয় (concepts & images) বিশ্বজনীন হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার ফলে অন্যান্য সমাজে তার ভিত নেই। শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সবকিছু তার অভ্যন্তরীণ যুক্তি হারিয়ে ফেলছে (lack of internal logic)। মিডিয়া চলচ্চিত্র যে ধরনের মিথ্যা কল্পিত জীবনের প্রতিফলন করে (Simulacra) তাকে বাস্তবে প্রয়োগ করতে গিয়ে উল্টো ফল পাওয়া যায়। এই অভ্যন্তরীণ অসামঞ্জস্য এবং বিচ্ছিন্নতার কারণে মানুষের মধ্যকার যোগাযোগ বাহ্যিকভাবে এগিয়ে গেলেও স্থান (sense of place) সম্পর্কে ধারণার বিলুপ্তি ঘটছে। যে বিশ্বে আজ আমরা বাস করি, সেটি শিকড় বা ভিতবিহীন। ধর্ম এই সংকটকে একজাতীয় উগ্র আদর্শে পরিণত করে সংকটকে আরও ঘনীভূত করছে।

জাতীয় সংস্কৃতির সামনে এই চ্যালেঞ্জের কারণে মানুষের আত্মপরিচয় কী, তার শিকড় কোথায় ইত্যাদি প্রশ্ন আজ গভীর আধ্যাত্মিক প্রশ্নে পরিণত হয়েছে। কোনো আশ্রয় না পেয়ে মানুষ ধর্মের আশ্রয় নিচ্ছে। এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ধর্মের অতি উগ্র এবং জঙ্গি ধারার আবির্ভাব ঘটছে। ফলে বাজার এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের দিক থেকে পৃথিবী যদিও ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে মানুষ হচ্ছে বিভক্ত। সে কারণে জাতীয়তাবাদ এবং জাতীয় আত্মপরিচয় আন্দোলন শক্তিশালী হচ্ছে। আঞ্চলিক অর্থনৈতিক জোটের জন্ম হচ্ছে। মানুষের আত্মপরিচয় কী, তার শিকড় কোথায় ইত্যাদি প্রশ্ন আজ মানুষের জীবনে ভূমিকা রাখছে অনেক বেশি। স্থানীয় সমাজ বৈশ্বিক প্রভাবকে তার সংস্কৃতিতে ব্যবহার করার কারণে মিশ্রণ ঘটছে সংস্কৃতির (Creolisation)। তাতে করে সংকট আরও গভীর হচ্ছে। বিশ্বায়নের এই কুফলগুলো সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলা আজকের দিনের প্রধান দায়িত্ব। সেই প্রতিরোধ কেবল বিশ্বায়নকে বিরোধিতা করার জন্য নয়। কীভাবে তাকে মানবিক করা যায়, কীভাবে সত্যিকার বৈশ্বিক ভ্রাতৃত্ব গড়ে তোলা যায়, সেটিই মুখ্য।

টীকা

1.       Ideology is defined as the ways in which the meaning conveyed by symbolic forms serves to establish and sustain relations of power. (Oktar 2001, 320)?

 2.      In Hall’s (1977) word 'Hegemony' exists when a ruling class is able not only to coerce a subordinate class to conform to its interests, but exerts a 'total social authority' over those classes and the social formation as a whole. 'Hegemony' is in operation when the dominant class fractions not only dominate but direct-lead; when they not only possess the power to coerce but actively organise so as to command and win the consent of the subordinated classes to their continuing away. (Hall, Stuart. 1977 'Culture, the Media and the Ideological effect.' In Mass Communication and Society. Edited by James Curran and others. 315-348, London : Edward Arnold.

গ্রন্থপঞ্জি

Anderson, Ian & Robert J. Figgins (ed) (2012). Globalization: Background, Agreements & Current Issues. NY Nova Science Publishers

            Appadurai, A (2012). ‘Disjuncture and Difference in the Global Cultural Economy’, Lechner Frank & John Boli (ed) The Globalisation Reader, -4th ed, Chicester : Blackwell Publishers, 2012, pp. 98-104

            Bacevich, A (2009). American Empire. Harvard University Press, Harvard

            Bardhan, A (2012). ‘The Twin Excesses-Financialisation and Globalisation–caused the crush’, in Lechner Frank & John Boli (ed) The Globalisation Reader, -4th ed, Chicester : Blackwell Publishers, 2012, pp. 203-205

            Bello, W (2012). ‘The Global South : The WTO and Deglobalisation’, in Lechner Frank & John Boli (ed) The Globalisation Reader, -4th ed, Chicester : Blackwell Publishers, 2012, pp. 490-493

            Brawley Mark (2003). The Politics of Globalisation. Toronto, Broadview Press

            'Breaking down the US defennce budget', Aljazeera 28 February 2017

            Capling Anna and Richard Higgott (2012). ‘The Future of the Multilateral Trade System–What Role for the World Trade Organisation?’, in Lechner Frank & John Boli (ed) The Globalisation Reader, -4th ed, Chicester : Blackwell Publishers, 2012, pp. 260-264

            Cowen, T (2012) ‘Why Hollywood Rules the World, and Whether we should care’, in Lechner Frank & John Boli (ed) The Globalisation Reader, -4th ed, Chicester : Blackwell Publishers, 2012, pp. 379-384

            Edelman Mark and Anjelique Haugerud (2005). The Anthropology of Development and Globalisation. Melbourne : Blakwell Oublishing

            Ferguson, N (2007), ‘Sinking Globalisation’, in Mark Kesselman (ed) The Politics of Globalisation : A Reader, Boston : Wadsworth, pp. 50-56

            Financial Times, June 9, 2004

            Foad Izadi ‘US Public Diplomacy : A Theoretical Treatise’, In The Journal of Arts Management, Law and Society, 2016, Vol 46, NO 1, 13-21

            Freedland, J, ‘Hail Bush : A new Roman empire’, The Guardian but taken from Sydney Morning Herald, 19 September 2002

            Freedman, T (2007). The World is Flat, NY : Picador

            Gereffi, G (2012), ‘The Global Economy : Organisation, Governance, and Development’, in Lechner Frank & John Boli (ed) The Globalisation Reader, -4th ed, Chicester: Blackwell Publishers, 2012, pp. 170-179

            Harding, J (2012), ‘Counter–Capitalism: Globalisation's Children Strike Back’, in Lechner Frank & John Boli (ed) The Globalisation Reader, -4th ed, Chicester: Blackwell Publishers, 2012, pp. 494-499

            Heinberg, R, ‘Behold Caesar : George W. Bush & the American Empire’, New Dawn Magazine, n. 76, January –February 2003

            Held, D (2004). Global Covenant : The Social Democratic Alternative to the Washington Consensus. Cambridge: Polity Press.

            Held David & Anthony McGrew (2007). Globalisation Theory : Approaches and Controversies. Cambridge: Polity Press

            Hurrell Andrew & Ngaire Woods (1999). Inequality, Globalisation and World Politics. Oxford : Oxford University Press

            Ikenbury, G. J. (2007), ‘Globalisation as American Hegemony’, In David Held & McGrew (ed) Globalisation Theory: Approaches and Controversies. Cambridge: Polity Press

            Jha Prem Sankar (2006). The Twilight of the Nation State. New Delhi, Pluto Publication

            Jones Andrew (2006). Dictionary of Globalisation. Cambridge: Polity Press

            Jones Andrew (2010) Globalisation : Key thinkers, Cambridge Polity Press

            Lechner, F (2012), ‘Religious Rejection of Globalisation’, in Lechner Frank & John Boli (ed) The Globalisation Reader, -4th ed, Chicester : Blackwell Publishers, 2012, pp. 419-424

            Mann, C (2011). 1493: Uncovering the New World Columbus Created. Alfred A. Knopf

            Marx K & Frederich Engels (2007), ‘The Manifesto of the Communis Party’, in Mark Kesselman (ed) The Politics of Globalisation : A Reader, Boston : Wadsworth, pp. 16-20

            Michael T (2017) ‘Donald Trump to increase military spending, but how much does the US and the world spend?’, News 1 March 2017

            Mullard, M (2004). The Politics of Globalisation and Polarisation. Cheltenham : Edward Elgar

            Osterhammel Jurgen & Niels P. Petersson (2003). Globalisation : A Short History. Princeton : Princeton University Press

            Panitch Leo & Colin Leys (Ed). Socialist Register 2004 : Global Capitalism and American Capitalism. Merlin Press, New York

            Petras James and Henry Veltmeyer (2005). Empire with Imperialism : The Globalising Dynamic of Neo-Liberal Capitalism. Manitoba : Zed Books

            Ritzer G (2004), ‘An Introduction to McDonaldization’, In Ritzer (ed) The McDonaldization of Society: A Reader, Thousand Oaks : Pine Forse Press, pp. 4-24

            Robertson R (1996). Globalisation: Social Theory and Global Culture. London: Sage Publications

            Robertson, R (2012), ‘Globalisaiton as a problem’, Lechner Frank & John Boli (ed). The Globalisation Reader, -4th ed, Chicester: Blackwell Publishers, 2012, pp. 88-94

            Robinson, W (2012), ‘Globalisation: Nine Theses on Our Epoch’, In Lechner Frank & John Boli (ed) The Globalisation Reader, -4th ed, Chicester : Blackwell Publishers, 2012, pp. 22-27

            Rodrik, D (2012), ‘Has Globalisation gone too far?’, in Lechner Frank & John Boli (ed) The Globalisation Reader, -4th ed, Chicester : Blackwell Publishers, 2012, pp. 231-236

            Roy, O (2012), ‘Globalised Islam: The Search for a New Ummah’, in Lechner Frank & John Boli (ed) The Globalisation Reader, -4th ed, Chicester : Blackwell Publishers, 2012, pp. 396-400

            Schotte (2005). Globalisation : A critical introduction. NY : Palgrave McMillan

            Scholte J. A (2000) Globalisation A Critical Introduction, London MacMillian

            Shah, A., ‘The Rise of Corporation,’ Global Issues, 2017

            Sklair L (2012), ‘Sociology of the Global System’, in Lechner Frank & John Boli (ed) The Globalisation Reader, -4th ed, Chicester : Blackwell Publishers, 2012, pp. 57-63

            Slaughter, Ann- Marie (2012), ‘A new World Order’, in Lechner Frank & John Boli (ed) The Globalisation Reader, -4th ed, Chicester : Blackwell Publishers, 2012, pp. 265-270

            Soar, Daniel (2017). ‘The Most Expensive Weapon Ever Built,’ London Review of Books Vol. 39, No 7, 30 March 2017.

            Stiglitz, J (2007), ‘Globalisation's Discontent’, in Mark Kesselman (ed) The Politics of Globalisation : A Reader, Boston : Wadsworth, pp.86-95

            Strange, S (2012), ‘The Declining Authority of States,’ in Lechner Frank & John Boli (ed) The Globalisation Reader, -4th ed, Chicester : Blackwell Publishers, 2012, pp. 219-225

            The Economist 17 September 2017 (The Superstar Company : A Giant Problem).

            Tilly, C (1990). Coercion, Capital and European States AD 1990 – 1992. Oxford: Blackwell

            Thussu, D (2012), ‘Mapping Global Media Flow and Contra-flow’, in Lechner Frank & John Boli (ed) The Globalisation Reader, -4th ed, Chicester : Blackwell Publishers, 2012, pp. 352-357

            Tomlinson, J (2012), ‘Cultural Imperialism’, in Lechner Frank & John Boli (ed) The Globalisation Reader, -4th ed, Chicester : Blackwell Publishers, 2012, pp. 343-351

            Urry J (2003). Global Complexity. Cambridge Polity Press

            Vreeland, J (2012), ‘The International Monetary Fund’, in Lechner Frank & John Boli (ed) The Globalisation Reader, -4th ed, Chicester : Blackwell Publishers, 2012, pp. 253- 259

            Wade, R. (2007), ‘Globalisation and its Limits’, in Mark Kesselman (ed) The Politics of Globalisation : A Reader, Boston : Wadsworth, pp. 37-49

            Wade, R. (2012), ‘Is Globalisation reducing Poverty and Inequality?’, in Lechner Frank & John Boli (ed) The Globalisation Reader, -4th ed, Chicester: Blackwell Publishers, 2012, pp. 187-193

            Woff, M. (2007), ‘Why globalization Works’, in Mark Kesselman (ed) The Politics of Globalisation : A Reader, Boston : Wadsworth, pp.74-85

            Wooldridge, A (2017) ABC Radio National, Australia, 29 January 2017 'The Guilded Age'

            রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্র রচনাবলী, দশম খণ্ড প্রবন্ধ, কলিকাতা শ্রী সরস্বতী প্রেস লিমিটেড মার্চ ১৯৮৯, পৃষ্ঠা ৫