সম্পাদকীয়

চলতি সংখ্যাটি প্রতিচিন্তার ২০তম সংখ্যা। ধারাবাহিকভাবে ২০টি সংখ্যা বের করা প্রতিচিন্তার জন্য একটা মাইলস্টোন। প্রতিচিন্তা সময়মতো বের করার জন্য তাগিদ আমরা সব সময় অনুভব করি। সব সময় যে পারি, তেমনটি নয়। নানা কারণে প্রতিচিন্তার বর্তমান সংখ্যাটি বের করতে আমাদের বিলম্ব হলো। সে জন্য পাঠকের কাছে বিশেষভাবে দুঃখিত। বিগত দিনগুলোয় যাঁরা বিজ্ঞাপন দিয়ে সহায়তা করেছেন, তাঁদের প্রতি রইল কৃতজ্ঞতা। আমাদের সঙ্গে থেকে সহযোগিতা করার জন্য উপদেষ্টা পর্ষদ ও সম্পাদনা পর্ষদের সদস্যদের জানাই অভিনন্দন।

আধুনিক মানুষ ও সমাজ স্বাভাবিকভাবেই সভ্য ও যুক্তিগ্রাহ্য আচরণে অভ্যস্ত। কিন্তু সাম্প্রতিক বিশ্বের রাষ্ট্র ও সমাজ পর্যায়ে অযৌক্তিক ও অমানবিক আচরণ ঘটে চলেছে ঘরে-বাইরে। তবে মানুষের এই আচরণ আদি-মনোবৃত্তিক। আদিম মানুষের এমন কিছু প্রবৃত্তি ছিল, যা যুক্তিবোধ ও সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে ঘৃণিত বলে চিহ্নিত হওয়া শুরু হয়েছিল। শক্তির জোরে কোনো মানুষ বা জাতিগোষ্ঠীর ওপর পাশবিক বর্বরতা বা নৃশংসতা এমনই একটি প্রবৃত্তি। কিন্তু এমন সব প্রবৃত্তি ঘৃণিত বলে প্রচারিত হলেও তা বন্ধ হয়নি। সময়ে সময়ে তার পুনরাবৃত্তি আমরা দেখেছি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। একবিংশ শতাব্দীতে আরও একটি ভয়ানক নৃশংসতা প্রত্যক্ষ করছে দুনিয়া। মিয়ানমার সরকার তার দেশের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাস্তুচ্যুত করতে বেছে নিয়েছে পাশবিক নির্যাতনের পন্থা। দলে দলে এসব রোহিঙ্গা শরণার্থী আশ্রয় নিচ্ছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশের মতো বিপুল জনসংখ্যা ও স্বল্প সম্পদসম্পন্ন একটি দেশে তা সন্দেহাতীতভাবেই এক বড় বোঝা। কূটনৈতিক দক্ষতা ব্যবহার করে এই সংকটের আশু সমাধান করতে হবে।

প্রতিচিন্তার এবারের সংখ্যায় তিনটি জাতিগত নিধন বা এথনিক ক্লিনজিং বিষয়কে তুলে আনা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথমটি হলো মিয়ানমার সরকারের নেওয়া রোহিঙ্গাদের চলমান জাতিগত নিধন। দ্বিতীয়টি শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধ-পরবর্তী তামিলদের সঙ্গে ক্ষমতাশালী সিংহলিদের দ্বন্দ্ব। তৃতীয়টি হলো বহুকাল ধরে ঝুলে থাকা ফিলিস্তিনিদের নির্মূলপ্রক্রিয়া।

প্রতিচিন্তার এই সংখ্যা সাজানো হয়েছে কয়েকটি বিষয়ের সংমিশ্রণে। এর একটি হলো বাংলাদেশের রাজনীতি ও বিকাশমান মধ্যবিত্তের সম্পর্কের দিকটি। একটি শক্তিশালী মধ্যবিত্ত শ্রেণি যেকোনো সমাজে গণতান্ত্রিক উত্তরণে বড় ভূমিকা রাখে এবং ধর্মের রাজনৈতিক প্রভাব হ্রাস করে বলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা মত দেন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কি তা প্রযোজ্য? সে বিষয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের অবতারণা করেছেন আলী রীয়াজ।

নার্সিং একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পেশা। বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে স্বাস্থ্য এক বিরাট জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ বিষয়ে নার্সদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু আমাদের সমাজের বাস্তবতায় নার্সিং পেশাকে যেমন সম্মানজনক হিসেবে দেখা হয় না, তেমনি নার্সদের ভূমিকাও আশানুরূপ নয়। এ কারণে এই পেশায় দক্ষ জনবল তৈরি হচ্ছে না। সমকালীন বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক ও গবেষক শাহাদুজ্জামান নার্সদের নিয়ে একটি এথনোগ্রাফিক গবেষণা করেছেন। এই পেশা সম্পর্কে নার্সদের মনোভাবনা এবং তাঁদের সম্পর্কে সমাজের মনোভাবনা নার্সদের চোখ দিয়ে তিনি দেখেছেন। প্রবন্ধটি সেজ থেকে অনুবাদ করেছেন রোকেয়া রহমান।

রোহিঙ্গা সংকট চলমান রয়েছে। সে বিষয়ে এখনই চূড়ান্ত মতামত দেওয়া কঠিন। তবে নিউ ইয়র্কার ম্যাগাজিনে সাংবাদিক হান্নাহ বিচের একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমারের সংগ্রামী নেত্রী হিসেবে দুনিয়াব্যাপী পরিচিত অং সান সু চির মানবাধিকার প্রশ্নে নীরব ভূমিকা বিষয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের অবতারণা করা হয়েছে। সু চির বর্তমান অবস্থান কি নতুন কোনো ঘটনা, নাকি তাঁর পূর্বের অবস্থানেরই ধারাবাহিকতা? গৃহবন্দী সু চিকে মিয়ানমারের জনগণ ও বিশ্ববাসী যেসব গুণে সমৃদ্ধ বলে ধরে নিয়েছিল, তা আসলে কতটুকু সঠিক ছিল? এসব মৌলিক প্রশ্নের হয়তো স্বতঃসিদ্ধ উত্তর এখনই পাওয়া যাবে না, কিন্তু ব্যক্তি সু চি কি বদলেছেন, নাকি এমনই ছিলেন—তার কতিপয় প্রমাণ এই লেখায় মিলবে।

এ ছাড়া রোহিঙ্গা সংকটের সূচনা থেকে বর্তমান পর্যন্ত ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ বাঁকগুলো এবং সাম্প্রতিক সময়ে ঘটা বড় ঘটনাগুলো একত্র করে একটি সময়ক্রম আমরা প্রতিচিন্তার পাঠকদের সামনে হাজির করেছি। পাঠক এখান থেকে পুরো সংকটটি একটি জায়গায় পাবেন। ওয়্যার ডট কমের ওয়েবসাইটে আলাল ও দুলাল কালেক্টিভ  কর্তৃক সময়ক্রমটি প্রকাশিত হয়েছে। দুটি লেখাই ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন খলিলউল্লাহ।

দক্ষিণ এশিয়াজুড়েই জাতিগত সংকট চলমান রয়েছে। বর্তমানে আরাকানে যা চলছে, শ্রীলঙ্কার তামিলদের ক্ষেত্রেও তেমন জাতিগত সংকট রয়েছে। লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল ইলমের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার সিংহলি সরকারের দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের অবসান ঘটেছে ঠিকই, কিন্তু সংকট পুরোপুরি নিরসন হয়নি। শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধ-পরবর্তী যে সংকট চলছে, তার সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ায় জাতিরাষ্ট্রের সংকটের সাদৃশ্য রয়েছে। আলতাফ পারভেজের নিবন্ধটিতে এই সংকটের স্বরূপ ধরা পড়েছে।

সবশেষে রয়েছে একটি বই আলোচনা। বই আলোচনাটি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের অনেক বছরের পুরোনো একটি জাতিগত নিধনকে কেন্দ্র করে করা হয়েছে। জাতিগত নিধনের চিত্র সারা দুনিয়ায় একই রকম। আরাকানে মিয়ানমার সরকার যেমন রোহিঙ্গাদের নিশ্চিহ্ন করছে, তেমনি ইসরায়েলও ফিলিস্তিনিদের বহুদিন ধরে ক্রমান্বয়ে নিশ্চিহ্ন করায় প্রবৃত্ত রয়েছে। প্রবাসী ইসরায়েলি ইতিহাসবিদ ও সমাজতান্ত্রিক কর্মী ইলান পেপে তাঁর দ্য এথনিক ক্লিনজিং অব প্যালেস্টাইন গ্রন্থে ফিলিস্তিনিদের নিশ্চিহ্নকরণের ইতিবৃত্ত বর্ণনা করেছেন। আর সেই বইটি নিয়ে আলোচনা করেছেন আসজাদুল কিবরিয়া।