ক্রোনিজম: পুঁঁজিবাদের এক কদর্য রূপ

বইয়ের প্রচ্ছদ
বইয়ের প্রচ্ছদ

চায়না’স ক্রোনি ক্যাপিটালিজম: দ্য ডাইনামিকস অব রেজিম ডিকোয়—মিনঝিন পি, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০১৬, আইএসবিএন: ৯৭৮০৬৭৪৭৩৭২৯৭।

১৯৮৯ সালে চীনে গণতন্ত্রের দাবিতে যে আন্দোলন শুরু হয়, তাতে দেশটির ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে গিয়েছিল। দাপ্তরিক নথিপত্র অনুসারে সে বছরের ১৮ মে চীনের ১৩২টি শহরে একযোগে ৬০ লাখ মানুষ প্রতিবাদ বিক্ষোভে অংশ নেয়। তিয়েনআনমেন স্কয়ারের সেই বিক্ষোভ কমিউনিস্ট পার্টি বল প্রয়োগে দমন করে। এরপর দলের ভবিষ্যত্ নেতাদের মধ্যে আনুগত্য পুনঃসৃষ্টিতে সব স্তরের নেতাদের রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি লুটপাটের সুযোগ দেওয়া হয়। আর এভাবেই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জবাবে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় লুটপাটের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়, যার মাধ্যমে শুরু হয় ক্রোনি ক্যাপিটালিজম বা দল বেঁধে লুটপাটের পুঁজিবাদ। দ্য ইকোনমিস্ট ১-এর সংজ্ঞায় ক্রোনি ক্যাপিটালিজম হলো সেই বন্দোবস্ত, যার মাধ্যমে পুঁজিপতিরা রাজনীতিকদের কাছ থেকে মূল্যবান সম্পদ লাভ করে থাকে। আরেকটু বিস্তৃত করে বলা যায়, এটা পুঁজিপতি ও রাজনীতিকদের মধ্যকার বন্দোবস্ত, যার মাধ্যমে পুঁজিপতিরা বৈধ বা অন্য উপায়ে সম্পদ আহরণ করেন এবং রাজনীতিকেরা ক্ষমতা টিকিয়ে রাখে। অর্থাত্ একদিকে চীনের শনৈঃ শনৈঃ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে, অন্যদিকে ১৯৯০ সালের পর সেখানে এরূপ ব্যাপক দুর্নীতি শুরু হয়।

ক্যালিফোর্নিয়ার ক্লেয়ারমন্ট ম্যাককেনা কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মিনঝিন পি চায়না’স ক্রোনি ক্যাপিটালিজম গ্রন্থে চীনের লুটপাটতন্ত্রের পুঙ্খানুপুঙ্খ চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন, তবে খুব সংযত ভাষায়। বইটি পড়লে বোঝা যায়, চীনে দুর্নীতি কোন মাত্রায় পৌঁছেছে। মিনঝিন পি দেখিয়েছেন, রাষ্ট্রীয় সম্পদের ওপর পার্টির নেতাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হলেও চীনে কখনোই আনুষ্ঠানিকভাবে বেসরকারীকরণ ঘটেনি। সেখানে রাষ্ট্রীয় সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণের বিকেন্দ্রীকরণ ঘটলেও মালিকানার অধিকারের ব্যাপারটা পরিষ্কার করা হয়নি। ফলে যারা শাসন করে, তারা ‘সমাজের সম্পদ আহরণে চূড়ান্ত সুযোগ পেয়েছে’। অর্থাত্ চীনে মালিকানার অধিকার আর নিয়ন্ত্রণের অধিকারের মধ্যে সীমারেখা টানা হয়েছে। আর যেখানে মালিকানার ব্যাপারটা অনিশ্চিত, সেখানে নিয়ন্ত্রণই মুখ্য ব্যাপার—মিনঝিন পি আমাদের বলছেন।

অত্যন্ত কষ্টসাধ্য গবেষণা ও তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে বইটি লিখেছেন মিনঝিন পি। মনগড়া কথা নেই এতে। প্রতিটি কথার পেছনে তিনি বিপুল তথ্যপ্রমাণ হাজির করেন। বইটির বিন্যাস দেখলেই ব্যাপারটা বোঝা যায়। ৩৬৫ পৃষ্ঠা বইটির মূল অংশ শেষ হয়েছে ২৬৮ পৃষ্ঠায়, বাকি ৯০ পৃষ্ঠাজুড়ে আছে পরিশিষ্ট, সংক্ষিপ্ত নামের বিবরণ, টীকা, স্বীকৃতি ও নির্ঘণ্ট। লেখক আমাদের বলছেন, ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের ধারণা এমনিতে অনেক জনপ্রিয় হলেও এর ওপর গবেষণা করতে গেলে বিদ্যায়তনের মানুষদের অন্তত দুটি কঠিন কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। প্রথম চ্যালেঞ্জটি হচ্ছে এমন একধরনের বিশ্লেষণী কাঠামো তৈরি করা, যার মধ্যে ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের মূল ধারণার নির্যাস থাকবে এবং সেটা এর অভিজ্ঞতাভিত্তিক অনুসন্ধানে প্রয়োগ করা। সে জন্য তিনি ‘অভিজাতদের মধ্যকার যোগসাজশ’ শীর্ষক এক ধারণার প্রস্তাব দেন, যার আলোকে এই ক্রোনি ক্যাপিটালিজম পাঠ করা হবে বা তিনি যেভাবে সেটা করেছেন। এই ধারণা প্রয়োগের যৌক্তিকতা হলো, ক্ষমতায় যে ধরনের রাজনৈতিক দলই থাকুক না কেন, এই ব্যাপারটা সব ক্ষেত্রেই দেখা যায়। দ্বিতীয়ত, এ-বিষয়ক তথ্য-উপাত্ত পাওয়া কঠিন, কারণ এর জন্মই হয়েছে ১৯৯০-এর দশকে। আর কোনো দেশের সরকারই সাধারণত এ ব্যাপারে তদন্ত করতে বা মুখ খুলতে চায় না।

এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত খুব বেশি গবেষণা না হলেও যে অল্প কিছু মানুষ এ নিয়ে গবেষণা করেছেন, তাঁরা এই বিষয়ে একমত যে এই দল বেঁধে দুর্নীতি অধিকতর পরিশীলিত ও ধ্বংসাত্মক, আর সেটা চিহ্নিত করাও কঠিন। মিনঝিন পি বলেন, তত্ত্বগতভাবে এবং বাস্তবে এই ধরনের যোগসাজশমূলক দুর্নীতি ব্যক্তিগত দুর্নীতি থেকে অধিকতর ধ্বংসাত্মক। কারণ, এতে রাষ্ট্রের সাংগঠনিক ও নিয়মতান্ত্রিক রূপটি ধ্বংস হয়ে যায়। একই সঙ্গে তা যেমন চিহ্নিত করা কঠিন হয়ে যায়, তেমনি এর খেলোয়াড়েরাও বেশি লাভবান হন। আমাদের দেশের পরিভাষায় যাকে সিন্ডিকেট ঘুষ বলা যায়। এই ব্যবস্থায় ঘুষ না দিয়ে কারও উপায় থাকে না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটি কার্যালয়ের ৫০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে ৪৫ জন বা ৫০ জনই ঘুষ খেলে তার প্রাতিষ্ঠানিক চরিত্র থাকে না। মানুষেরও তখন ঘুষ না দিয়ে উপায় থাকে না। তবে ওই কার্যালয়ের যদি ১০ জন ঘুষ নিত, তাহলে সমস্যা এত গভীর হতো না।

যাহোক, বইটির ভূমিকায় লেখক চীনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের বক্তৃতা থেকে যে উদ্ধৃতি দিয়েছেন, তা আমাদের চোখ খুলে দেয়: ‘বিভিন্ন খাতে ও অঞ্চলে যে দুর্নীতি হচ্ছে, তা পরস্পর-সম্পর্কিত। গোপন সমঝোতার মাধ্যমে দুর্নীতি ক্রমেই বাড়ছে। কর্মী ও নির্বাহী কর্মকর্তারা যোগসাজশ করে ক্ষমতার অপব্যবহার করছে। ক্ষমতার সঙ্গে ক্ষমতার বিনিময়, ক্ষমতার সঙ্গে টাকা ও ক্ষমতার সঙ্গে যৌনতার বিনিময়—এসব যেন নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে গেছে। কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীদের মধ্যকার যোগসাজশ ও ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে অধস্তনদের যোগসাজশ পরস্পর গ্রন্থিত হয়ে গেছে। আর তারা বিভিন্ন কায়দায় ও গোপনে পারস্পরিক সুবিধা বিনিময় করছে।’

সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যে ব্যাপারটা মিনঝিন পি আমাদের বলেন, তা হলো, এই দল বেঁধে লুটপাটতন্ত্রের ব্যাপার দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উপজাত হিসেবে ঘটেনি। বরং দেশটির কমিউনিস্ট পার্টির কৌশলগত সিদ্ধান্তের ফল হিসেবে এটি ঘটেছে। লেখক অত্যন্ত সুচারুভাবে দেখিয়েছেন, কীভাবে দলের প্রতিটি পর্যায়ে দুর্নীতি হচ্ছে। এতে দলের প্রতিটি শাখাই বিপথগামী হচ্ছে এবং সরকারের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব খর্ব হচ্ছে। আর সি চিন পিং যেভাবে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু করেছেন, তাতে দুর্নীতি তো কমবে না, বরং এতে শাসক অভিজাত শ্রেণির মধ্যে বিভাজন তৈরি হবে এবং দলের পতন ত্বরান্বিত হবে। যদিও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনমত সেখানে আছে।

‘ক্রোনিজম ইন অ্যাকশন: কলিউশন বিটুইন অফিশিয়ালস অ্যান্ড বিজনেসম্যান’ শীর্ষক অধ্যায়ে মিনঝিন পি দেখিয়েছেন, একদলীয় ব্যবস্থায় রাজনৈতিক অভিজাত ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে যোগসাজশটা একদম পরিষ্কার। এখানে রাজনৈতিক ক্ষমতা থাকলে তা দ্রুতই বিপুল সম্পদে পরিণত হতে পারে। তবে বেসরকারি খাতে অংশীদার না থাকলে এই যোগসাজশের রূপান্তর ঘটে না। জীবনভর রাজনীতি করতে তো একটা মাশুল দিতে হয়, আর সেটাই তাদের বিনিয়োগ। সে কারণে দলের ভেতরে পুরস্কারস্বরূপ যে পদ দেওয়া হয়, তা প্রত্যাখ্যান করা আকর্ষণীয় ব্যাপার নয়। আবার রাজনৈতিক পদ ছাড়ার ঝুঁকিও আছে। এতে দলীয় নেতাদের রোষানলে পড়ার ভয় থাকে। তারা নিজেরা বেসরকারি খাতে যেতে পারে না বলে আত্মীয়স্বজনদের ওই জায়গায় বসায়। ফলে তারা যেমন দলের বড় পদে থাকতে পারে, তেমনি বিপুল সম্পদও বানাতে পারে। ধরা পড়ার সুযোগও আছে। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় যে পরিমাণ সম্পদ বানানো সম্ভব, সেটা ধরা পড়ার ক্ষতির তুলনায় বেশি লাভজনক।

বইটির পরিশিষ্টে দেওয়া তথ্য-উপাত্তে দেখা যায়, দুর্নীতি যত বেশি দিন ধরে চলবে, ততই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের পদোন্নতির সম্ভাবনা বাড়ে। দুর্নীতি শুরু করার পর গ্রেপ্তার হতে ওই কর্মকর্তাদের গড়ে আট বছর সময় লেগেছে। মেয়াদের মধ্যে এই শ্রেণির ৫০ জন শীর্ষ দুর্নীতিবাজের মধ্যে ৪২ জন পদোন্নতি পেয়েছে। অর্থাত্ দীর্ঘ মেয়াদে দুর্নীতির কালে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের পদোন্নতির এই উচ্চ হার (৮৪ শতাংশ) থেকে বোঝা যায়, দুর্নীতি চিহ্নিত হওয়ার হার অনেক কম।

তবে চীনের অর্জনও কম নয়। ১৯৪৯ সালে যে দেশের সিংহভাগ মানুষ আফিম খেয়ে ঘুমাতে যেত, সেই দেশের অর্থনীতি এখন পৃথিবীতে এক নম্বর। এখন তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে টেক্কা দিচ্ছে। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের বিকল্প প্রতিষ্ঠান বানানোর চেষ্টা করছে। অন্যদিকে আজ সারা পৃথিবীতে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমে আসার পেছনে এক চীনের দারিদ্র্য হ্রাস উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৭৮ সালে দেশটির গ্রামীণ এলাকায় চরম দরিদ্রের সংখ্যা ছিল ২৫ কোটি, যেটা ২০০৫ সালে ২ কোটি ৩৬ লাখে নেমে আসে২। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ১৯৯১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত পৃথিবীতে দৈনিক এক ডলারের নিচে বসবাসকারী দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমেছে ২৭ কোটি ৪০ লাখ। এর মধ্যে শুধু চীনে কমেছে ১৫ কোটি ১০ লাখ, যা উন্নয়নশীল দেশে দারিদ্র্য থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত মানুষের ৭৫ শতাংশ (খবর ২০০৬)। অক্টোবরে অনুষ্ঠিত চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ১৯তম কংগ্রেসের উদ্বোধনী অধিবেশনে সি চিন পিং যে প্রতিবেদন পাঠ করে শোনান, সেখানে উল্লেখ করেছেন, গত পাঁচ বছরে চীনে ছয় কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠে এসেছে। ২০১২ সালে চীনে দারিদ্র্যের হার ছিল ১০ শতাংশ, এখন তা কমে নেমেছে ৪ শতাংশে। দারিদ্র্য বিমোচনের এই তত্পরতা অব্যাহত থাকবে এবং ২০২০ সালের মধ্যে চীনে আর কোনো মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকবে না।

অর্থনৈতিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে চীন এক বিস্ময়। ১৯৭৮ সালে দেং জিয়াও পিংয়ের আমলে সংস্কার কর্মসূচি শুরু হওয়ার পর ২০০২ সাল পর্যন্ত তার গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৮ দশমিক ১ শতাংশ৩। ব্যাপারটা এমন দাঁড়ায় যে ২০০৫ সালের চীনের প্রকৃত মাথাপিছু জিডিপি ১৯৮০ সালের তুলনায় আট গুণ বেশি হয়ে যায়। এই দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে গ্রামীণ দারিদ্র্যও দ্রুতগতিতে কমে। ফলে অবকাঠামো, সামাজিক সেবা ও দরিদ্রের জীবিকার পরিবেশের যথেষ্ট উন্নতি হয়। কিন্তু একই সময়ে সেখানে বণ্টনের বৈষম্যও অনেকটা বেড়েছে (সারণি-১)। চীনে এখনো সাড়ে পাঁচ কোটির বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে মানবেতর জীবন যাপন করে। তাদের মাথাপিছু দৈনিক ভোগের পরিমাণ এক মার্কিন ডলারের কম। আর হিউরান রিসার্চ ইনস্টিটিউটের জরিপে বলা হচ্ছে, চীনে সবচেয়ে ধনী তিন ব্যক্তির প্রত্যেকে তিন হাজার কোটি মার্কিন ডলারের সম্পদের মালিক। চীনে অঞ্চলভেদে উন্নয়নের ফারাকও বিস্তর। যেমন পাহাড়-পর্বতময় গুইঝু প্রদেশের মানুষের গড় বার্ষিক আয় সাংহাই এলাকার মানুষের গড় আয়ের তিন ভাগের এক ভাগ থেকেও কম৪। অন্যদিকে তার শহর ও গ্রামীণ আয়ের পার্থক্য উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। অথচ এই দেশ নিজেকে সমাজতান্ত্রিক দাবি করে, যেখানে সমাজতন্ত্রের মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ধীরে ধীরে সব ধরনের বৈষম্যের অবসান।

সারণি-১

চীনে ব্যয় বণ্টনের গিনি সহগ

স্থান                             সাল          

            ১৯৭৮      ১৯৮৮      ১৯৯৭      ২০০২    

জাতীয়     ০.৩০      ০.৩৮      ০.৩৪      ০.৪৫     

গ্রামীণ      ০.২১      ০.৩০      ০.৩৪      ০.৩৮     

শহুরে      ০.১৬      ০.২৩      ০.২৯      ০.৩৪     

উত্স: Huang et. al. 2009

চীনের এই অভাবনীয় উন্নতির মূল কারণ হচ্ছে বিশ্বায়ন, আমরা সবাই সেটা জানি। সংস্কারের পর তারা ধীরে ধীরে সারা পৃথিবীর কারখানা হয়ে ওঠে। আর সেটা সম্ভব হয়েছে শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিতে ব্যাপক বিনিয়োগের ফলে। মানবসম্পদ বিকাশে তারা যথেষ্ট বিনিয়োগ করেছে, যার ফল তারা এখন পাচ্ছে। উত্পাদন ও বাণিজ্যে তারা যথেষ্ট অগ্রগতি অর্জন করেছে। সর্বনিম্ন থেকে সর্বোচ্চ—সব ধরনের পণ্যই তারা উত্পাদন করে থাকে। এই প্রক্রিয়া থেকে আমাদের শেখার আছে অনেক কিছু।

বক্ষ্যমাণ বইয়ের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। মিনঝিন পি বইটির ‘ইন বেড উইথ দ্য মাফিয়া’ অধ্যায়ে বলেছেন, এই যে সংঘবদ্ধ অপরাধ তার যেমন স্থানীয় সরকারের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব আছে, তেমনি সংগঠিত অপরাধী চক্র ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে যে যোগসাজশ—রাষ্ট্রের অখণ্ডতার ওপর তার প্রভাব আরও সুদূরপ্রসারী। দৃশ্যত, এই ধরনের যোগসাজশের কারণে চীনা রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলাজনিত ও প্রশাসনিক সক্ষমতা ধ্বংস হচ্ছে। একদিকে সংগঠিত অপরাধের পরিসর বড় হচ্ছে, অন্যদিকে তারা সব পদস্থ কর্মকর্তাকে ঘুষ দিয়ে কাজ হাসিল করতে ইচ্ছুক। ফলে রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোয় দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের চক্র ক্রমেই বড় হচ্ছে। চীনের ক্ষমতাদম্ভী রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা মন্ত্রণালয় যার অধীনে গোপন পুলিশের কার্যক্রম চলে, তার বড় কর্তারা সংগঠিত অপরাধী চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে। অথবা তারা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ এসেছে। তবে সংগঠিত অপরাধী চক্রের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যোগসাজশের ফলে স্থানীয় সরকারের এই সূক্ষ্ম রূপান্তর ঘটেছে, যেটা আবার সম্ভব হয়েছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অবৈধ বেসরকারীকরণের কারণে। আর এতে এই দুই ধরনের যোগসাজশের মধ্যে সংযোগ স্থাপিত হয়: কর্মকর্তাদের মধ্যকার যোগসাজশ এবং কর্মকর্তা ও সংগঠিত অপরাধী চক্রের মধ্যকার যোগসাজশ। পৃথিবীতে কোনো কিছু তো কেউ এমনি এমনি দেয় না, তার একটা বিনিময়মূল্য থাকে। কর্মকর্তারা ঘুষ খেলে দাতাদের তো বিনিময়ে কিছু দিতে হয়।

উদার গণতান্ত্রিক দেশগুলোর সঙ্গে চীনের পার্থক্য এই জায়গায় যে সেখানে ক্ষমতার ভারসাম্য নেই। দেশটির সরকারের কাঠামোই এমন, যেখানে দুর্নীতির রাশ টেনে ধরা সম্ভব নয়। ব্যাপারটা এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে দলটির শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে চারিত্রিক সততা বা সাধুতার অভাব আছে। ভূমি-সম্পদ উন্নয়ন, খনি ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে দুর্নীতি সবচেয়ে বেশি। দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তারা উচ্চপদস্থ ও নিম্নপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে থাকেন। তাদের অর্থলোলুপতায় প্রতিটি প্রদেশ আক্রান্ত হয়েছে। কিছু অঞ্চল তো মাফিয়া রাজ্যে পরিণত হয়েছে। প্রশাসনিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের জন্য স্থানীয় পর্যায়ের পার্টি নেতারা ‘পুঁজিবণ্টন, বড় ঠিকা দেওয়া ও ভূমির ব্যবহার নির্ধারণ করার’ অধিকার পেয়েছে। আর যায় কোথায়, স্থানীয় ব্যবসায়ীরা এই স্থানীয় নেতাদের ঘুষ দিয়ে সহজে কাজ বাগিয়ে নেয়। নিয়ন্ত্রণ শিথিল হওয়ায় তারা সেই ক্ষমতা ব্যক্তিগত মুনাফার জন্য ব্যবহার করতে পারে। শুধু যেসব খাতে ব্যাপক প্রতিযোগিতা আছে বা যেখানে সম্পদের অধিকার চমত্কারভাবে সংজ্ঞায়িত আছে, যেমন ভোক্তা পণ্য ও উচ্চপ্রযুক্তির উত্পাদনশীল খাতে, সেখানে এসব দুর্নীতি নেই।

তবে সি চিন পিং দুর্নীতিকে প্রধান শত্রু জ্ঞান করে শুদ্ধি অভিযান চালাচ্ছেন, যদিও এর সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত হিসাব-নিকাশও জড়িয়ে আছে। কিন্তু দুর্নীতিবিরোধী অভিযান এখন তাঁদের প্রধান অগ্রাধিকার। ২০১৭ সালের অক্টোবরে দলটির ১৯তম কংগ্রেস চলাকালীন চায়না ডেইলির ২০ অক্টোবরের সংখ্যায় প্রথম সম্পাদকীয় ছিল দুর্নীতিবিরোধী অভিযান নিয়ে। এতে বলা হয়েছে, চীনা কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, সে নিজেকে কীভাবে পরিচালনা করছে। তারা বলছে, দল পরিচালনার চারটি মৌলিক কৌশলের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কঠোরভাবে দলীয় শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করা। দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের কিছু পরিসংখ্যানও তারা প্রকাশ করেছে। চায়না ডেইলি সূত্রে জানা যায়, ব্যুরো পর্যায়ের আট হাজার কর্মকর্তা ও গ্রামীণ পর্যায়ের ৬০ হাজার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গের কারণে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এর সঙ্গে মন্ত্রী পর্যায়ের ৪৪০ জন কর্মকর্তাকে ইতিমধ্যে অভিযুক্ত করা হয়েছে বা তাদের ক্ষমতার অপব্যবহারের বিষয়ে তদন্ত হচ্ছে। অন্যদিকে যেসব দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন, তাঁদের ধরার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে কাজ করছে তারা। আবার তারা ইতিমধ্যে ৩ হাজার ৪৫৩ জন পলাতক আসামিকে ফিরিয়েও এনেছে৫।

এক নজরে গত পাঁচ বছরে চীনের দুর্নীতি দমনবিষয়ক আরও কিছু তথ্য

ষ           শৃঙ্খলা পরীক্ষা কমিশন ও তত্ত্বাবধায়ক এজেন্সিগুলো ২০ লাখ ৬৭ হাজার শৃঙ্খলাভঙ্গের ঘটনা তদন্ত করেছে। তারা ১৫ লাখ ৫০ হাজার মামলা দায়ের এবং ১৫ লাখ ৩০ হাজার দলীয় সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। এ ছাড়া তারা ৫৮ হাজার সন্দেহভাজন কর্মকর্তাকে বিচারিক কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করেছে।

ষ           ৩ হাজার ৪৫৩ জন পলাতক আসামি চীনে ফিরে এসেছে। ইন্টারপোলের রেড নোটিশের ১০০ জন শীর্ষ পলাতক ব্যক্তির মধ্যে ৪৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

ষ           নগর, শহর ও গ্রামের নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের সময় ৯ হাজার ৩০০ জন কর্মকর্তা পর্যবেক্ষণ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হলে তাদের পদোন্নতি দেওয়া হয়নি।

ষ           পদোন্নতি ও পদাবনতি বিধি অনুসারে গ্রাম ও তার ওপরের পর্যায়ের ২২ হাজার কর্মকর্তার অবস্থান পরিবর্তিত হয়েছে।

ষ           ছয় লাখের বেশি অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দলের সাংগঠনিক ও মানবসম্পদ বিভাগ কর্মকর্তাদের সতর্ক ও তিরস্কার করেছে।

ষ           ব্যক্তিগত বিষয়ে যথাযথ প্রতিবেদন পেশ না করায় ১ লাখ ২৫ হাজার কর্মকর্তাকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে তাদের ক্ষমতা প্রয়োগের সঙ্গে সম্পর্কিত পারিবারিক ও সম্পদবিষয়ক প্রসঙ্গ জড়িত (সূত্র: চায়না ডেইলি, ২০ অক্টোবর, ২০১৭)।

পৃথিবীতে এখন স্নায়ুযুদ্ধ নেই, আবার মার্কিন সাম্রাজ্যও অস্তগামী। এশিয়া হয়ে উঠছে উন্নয়নের কেন্দ্র, যার নেতৃত্বে আছে চীন ও ভারত। চীন নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় পশ্চিমের সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সে যে নতুন ও উন্নত ব্যবস্থার সন্ধান দেবে—এমনটা এখনো মনে হচ্ছে না। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক অধ্যাপক প্রণব বর্ধন এ প্রসঙ্গে মনে করেন, ‘চীনা নেতারা বিশ্বাস করে, তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মডেল পশ্চিমাব্যবস্থার চেয়ে উন্নত। তারা এখন অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার “নতুন যুগের” ধারণা ফেরি করে বেড়াচ্ছে। কিন্তু এই ব্যবস্থার যতই আকর্ষণ থাকুক না কেন, তার কিছু মৌলিক গলদ আছে। আর তা সহজেই সব জায়গায় অনুসৃত হতে পারবে না।’ কারণ হিসেবে তিনি বলেন, এর জন্য চীনা কমিউনিস্ট পার্টির মতো মহিরুহ সংগঠন লাগবে। সঙ্গে লাগবে তার মতো বিশাল ও সমৃদ্ধিশালী বাজার, যে কারণে তারা বিদেশি বিনিয়োগ নিজের মতো করে কাজে লাগাতে পেরেছে। স্বাভাবিকভাবেই সেটা সবার পক্ষে সম্ভব নয়৬।

যাহোক, সংক্ষেপে বলা যায়, চীনের দুর্নীতি সম্ভব হয়েছে সম্পত্তির অধিকার নিয়ে অস্পষ্টতা, বিকেন্দ্রীকৃত প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও গণতান্ত্রিক ভারসাম্যের অভাব যেমন: স্বাধীন বিচার বিভাগ, মুক্ত গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার অভাবের কারণে। এসবের উন্নতি হলেই কেবল দুর্নীতি চিরস্থায়ীভাবে হ্রাস পেতে পারে। কিন্তু চীনে গণতান্ত্রিক ভারসাম্য আসার সম্ভাবনা নিকট ভবিষ্যতে দেখা যাচ্ছে না। ২০১৭ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ১৯তম কংগ্রেসে বর্তমান প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং নিজের ক্ষমতা আরও কুক্ষিগত করেছেন। যারা তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারত, তারা এখন আর মাঠেই নেই, তাদের বেশির ভাগের ঠাঁই হয়েছে শ্রীঘরে। দুর্নীতির অভিযোগে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মিনঝিন পি তাঁর এক প্রবন্ধে বলেছেন, সির হাতে এখন লাগামহীন ক্ষমতা৭। তবে সি চিন পিং ২০৫০ সালের মধ্যে চীনকে মহান আধুনিক সমাজতান্ত্রিক দেশে পরিণত করার লক্ষ্যে বিপুল কর্মযজ্ঞ শুরু করেছেন।

মিনঝিন পি ১৯৮০-এর দশকে চীনের আশার দিনগুলোয় সাংহাই শহরে বেড়ে উঠেছেন। কিন্তু এখন তাঁর মধ্যে আশার ছিটেফোঁটা নেই: ‘এমনকি বিপ্লবী কায়দায় পুরোনো ব্যবস্থা উত্খাত হলেও উদার গণতন্ত্র আসবে, তা নয়। এই ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের রেশের কারণে...যারা বিপুল পরিমাণ অবৈধ অর্থ উপার্জন করেছে, তারা নতুন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করবে, যেখানে ওই গণতন্ত্রের টিকে থাকার আশাও থাকবে খুব ক্ষীণ।’ তাঁর ভয়, একদলীয় ব্যবস্থা উত্খাত হলে কী হবে, তা বোঝা যায় রাশিয়া ও ইউক্রেনকে দেখে, যদিও চীনের এই ব্যবস্থা ১৯৮৯ সালে ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছিল। আজকের চীন রাষ্ট্র বুঝতে চাইলে এই বই পাঠ অত্যাবশ্যকীয়। তবে এটা আর যা-ই হোক, সমাজতন্ত্র নয়।

তথ্য নির্দেশ

১. The Economist’s Books and Arts, “To have and to Hold”: Review of China’s Crony Capitalism: The Dynamics of Regime Decay, <https://www.economist.com/news/books-and-arts/21708644-how-chinas-elite-has-taken-control-economyand-country-have-and-hold>

২.          মোস্তফা কামাল মুজেরী, “অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্য বিমোচন: বাংলাদেশ এবং চীনের সামপ্রতিক অভিজ্ঞতার একটি তুলনামূলক চিত্র”, বাংলাদেশ উন্নয়ন সমীক্ষা, খণ্ড ৩১, বার্ষিক সংখ্যা, ১৪২০।

৩.         প্রাগুক্ত

৪.          মশিউল আলম, “চীনা-সমাজতন্ত্রের-প্রধান-দ্বন্দ্ব”, দৈনিক প্রথম আলো, ৩০ অক্টোবর ২০১৭ <http://www.prothomalo.com/opinion/article/1354631/>

৫.          সম্পাদকীয়, চায়না ডেইলি, ২০ অক্টোবর, ২০১৭

            <http://www.chinadaily.com.cn/opinion/>

৬.         Pranab Bardhan, “China’s Solitary Development Model”, Project Syndicate, 5 December, 2017,

            <https://www.project-syndicate.org/commentary/china-model-xi-jinping-new-option-to-democracy-by-pranab-bardhan-2017-12>

৭.          মিনঝিন পি, “সির হাতে লাগামহীন ক্ষমতা”, দৈনিক প্রথম আলো, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৭ <http://www.prothomalo.com/opinion/article/1398241/%E0%A6%B8%E0%A6%BF%E0%A6%B0-%E0%A6%B9%E0% A6%BE%E0%A6%A4%E0%A7%87-%E0%A6%B2%E0% A6%BE%E0%A6%97%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A6%B9%E0%A7%80%E0%A6%A8->ÞgZv|