ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের অগ্রগতিতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের প্রতিক্রিয়া

 ‘১৯ সেঞ্চুরি অ্যান্ড আফটার’ (১৯ শতক ও তারপর) শিরোনামে ১৯২৭ সালের জুলাই সংখ্যায় লন্ডন জার্নাল-এ একটি নিবন্ধ ছাপা হয়। এই নিবন্ধ কিছুটা মনোযোগ দাবি করে। ভারতের অবস্থার পরিবর্তন নিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ কী ভাবছে তা এই নিবন্ধে বেশ ভালোভাবে বোঝা যায়। এ পর্যন্ত যেসব লক্ষণ দেখা গেছে তাতে বোঝা যায় ভারতের পরিস্থিতি বিপ্লবী ঝোঁকের দিকে মোড় নিয়েছে। এসব লক্ষণের মানে হলো নিষ্ক্রিয়তার সমাপ্তি এবং জাতীয় বিপ্লবী সংগ্রামের একটি সক্রিয় সময়কাল। এমন একটি সাম্প্রতিকতম লক্ষণ হচ্ছে ভারতে একটি কমিউনিস্ট পার্টির বৈধ উপস্থিতি, যার কথা আমরা সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলেছি।

ভারতে উচ্চতর ব্রিটিশ প্রশাসনিক ক্যাডারের একজন অবসরপ্রাপ্ত সদস্য স্ট্যানলি রাইস ‘কমিউনিজম ইন ইন্ডিয়া’ (ভারতে কমিউনিজম) শিরোনামে লন্ডন জার্নাল-এ প্রকাশিত নিবন্ধটির লেখক। বর্তমানে তিনি লন্ডনের ‘ইস্ট ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশন’-এর সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এই আধা সরকারি সংগঠনটি ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী প্রচারণার জন্য বিশেষায়িত। তিনি লন্ডনের এশিয়াটিক রিভিউ-এর সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। এটা ইংল্যান্ডের ঔপনিবেশিক রাজনীতির ওপর একটি নির্ভরযোগ্য জার্নাল। সব

প্রমাণ থেকে দেখা যায়, স্ট্যানলি রাইস ভারতবিষয়ক ব্রিটিশ মন্ত্রণালয়ের বেশ কাছের মানুষ। সে জন্য তার মতামতকে আধা সরকারি ভাষ্য হিসেবে বিবেচনা করা যায়।

নিবন্ধটি শুরু হয়েছে এশিয়ায় ইউএসএসআরের (সোভিয়েত ইউনিয়ন) নীতি বিষয়ে ব্রিটিশ প্রচারণার সাংবাদিকতাসুলভ বর্ণনা দিয়ে। ‘সমগ্র প্রাচ্য রাজনীতির ওপর গ্রাস শক্তিশালীকরণে’ এবং ‘এশিয়া মহাদেশকে বলশেভিক আধিপত্যের আওতায় আনতে’, ‘প্রাচ্যের প্রভুত্ব’ অর্জনে ‘রাশিয়ান’ পরিকল্পনার মতো গতানুগতিক কথাবার্তা আমরা বলে থাকি। এসব কিছুর ‘মূল লক্ষ্য’ হলো ‘ইংল্যান্ডের ধ্বংসের দিকনির্ণয় করা’।

যাহোক, নিবন্ধের আসল প্রস্থানবিন্দু হলো লেখকের বিশ্বাস, যাকে তিনি বর্ণনা করেছেন ‘চীনা উদ্যোগ’ হিসেবে, সেই উদ্যোগের ‘পরাজয়’। ‘পশ্চিম সীমান্তে একটি পার্শ্ব আক্রমণ’ হিসেবে এই উদ্যোগ নিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। তাঁর মতে, ‘নিশ্চিতভাবেই বলশেভিক মতবাদ তার পরাজয় নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। এটা তার স্বভাব নয়—এক দিকে ব্যর্থ হওয়ার মানেই অন্য দিকে প্রচেষ্টা জোরদার করার লক্ষণ। এশিয়া মহাদেশব্যাপী খুঁজলে ভারতের মতো এমন লাভজনক আর কোনো ক্ষেত্র নেই।’

‘ভারত কেন এত লাভজনক ক্ষেত্র’, সে বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে অনেকগুলো কারণ রয়েছে।’ যেমন ‘যদিও ইরাক ও ফিলিস্তিনে ইংল্যান্ড আক্রমণের শিকার হতে পারে, কিন্তু এগুলো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অংশ নয়: যদিও পারস্যে তার স্বার্থ রয়েছে এবং আরবে প্রভাব রয়েছে, তাই সেখানে সোভিয়েত আক্রমণ ক্ষতি করতে পারবে কিন্তু গুরুতর ধ্বংস সাধন করতে পারবে না। ইন্দো-চীনে ফরাসিরা জাতীয়তাবাদ বা অন্য যেকোনো ধরনের স্বশাসন থেকে তাদের মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে এবং তাদের ওপর কোনো আক্রমণকে গ্রেট ব্রিটেনের ওপর আরও গুরুতর আক্রমণের প্রস্তুতি হিসেবেই দেখতে হবে। বাস্তব উদ্দেশ্য বিবেচনায় আফগানিস্তানে তেমন বড় কোনো হিসাবনিকাশ নেই; সেখানে যা-ই অর্জন হোক না কেন, তা ভারতে সক্রিয় হওয়ার পথ করে দেবে। সবশেষে, এই সবগুলো জায়গায় জনসংখ্যা খুবই কম এবং কাঙ্ক্ষিত ফলাফল সৃষ্টির বিবেচনায় তাদের সংগঠন খুবই প্রাচীন। ভারত ও চীনের জনসংখ্যা এশিয়ার মোট জনসংখ্যার ১৭ শতাংশ। যদি এই অংশকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা ব্যর্থ হয়, তাহলে অবশ্যই সবচেয়ে আকর্ষণীয় ক্ষেত্রটিও হবে সামান্য ক্ষুদ্রতর অংশ।’

যাহোক, নিবন্ধের লেখক কেন ভাবছেন যে ‘বলশেভিকরা’ তাদের কার্যক্রম চীন থেকে ভারতে স্থানান্তর করবে, তার সবগুলো কারণ ওপরের উক্তিতে সম্পূর্ণ স্পষ্ট হয় না। এ ছাড়া অন্যান্য কারণ রয়েছে। এটা বোঝা যায় যে ‘বলশেভিকদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে চীনের চেয়ে ভারতে তাদের বেশি ভালো নজির রয়েছে। যদিও ভারতীয় জনতার প্রকৃত দারিদ্র্য চীনের দুঃখের গভীরতায় পৌঁছাতে পারে না, তবু আমাদের ক্রমাগত বলা হয়েছে, লাখ লাখ মানুষ সব সময় ক্ষুধার্ত থাকে এবং এ ছাড়া, সেখানে পঞ্চাশ মিলিয়ন আউটকাস্ট রয়েছে।’

লেখকের মতে, ‘কমিউনিস্ট দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে শুধু ব্রিটিশ হওয়ার বিরাট সুবিধা ভারতের রয়েছে। ফলে মনোযোগ দেওয়া সম্ভব। চীনে ব্রিটেনই একমাত্র অগ্রগামী শক্তি এবং অন্যান্য শক্তির সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের ঝামেলায় জড়ানো থেকে বিরত রাখতে খুবই সূক্ষ্ম ব্যবস্থাপনা দরকার, বিশেষ করে জাপানের সঙ্গে ঝামেলায় জড়ানোর ক্ষেত্রে বিভিন্ন কারণে সোভিয়েত ইউনিয়ন এখনো প্রস্তুত নয়। সবশেষে, হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে। সেটা রাজনৈতিক কারণে হোক বা অন্য কোনো কারণে; তারা যেকোনো সময়ে যেকোনো জায়গায় সম্মুখ সংঘাতে জড়াতে পারে। তাদের দ্বন্দ্ব যতই রাজনৈতিক হবে ততই মঙ্গল; ব্রিটিশদের আরও বেশি দিন টিকিয়ে রাখতে এই একটি পথই আছে।’

কিন্তু ভারতে ‘রাশিয়ান’ প্রভাব বৃদ্ধির প্রধান উপাদান ‘এসব বর্ণনারও আওতার বাইরে’। স্ট্যানলি রাইস মনে করেন এই উপাদান হলো ‘জাতীয়তাবাদের নীতি, যা ভারতীয় বুদ্ধিজীবীদের সব শ্রেণিকে পাকড়াও করেছে।’ প্রাচ্য দেশগুলোর জাতীয়তাবাদের বিশ্লেষণই এখানে অনুসরণ করা হয়। ‘প্রাচ্যে, যেকোনো মূল্যে’ জাতীয়তাবাদ তাদের মধ্যে একটি প্রপঞ্চ হিসেবে বিবেচিত হয়, ‘সেসব মানুষের উদ্দেশ্য বা পদ্ধতি যা-ই হোক না কেন, তারা বিদেশি নিয়ন্ত্রণ থেকে তাদের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করছে।’ ‘বলশেভিকদের জন্য এটাই যথেষ্ট।’ আমরা নিশ্চিত, ‘বলশেভিকদের কাজ হচ্ছে জাতীয়তাবাদের এই স্ফুরণকে উসকে দেওয়া এবং এর মধ্যে অন্তর্নিহিত হীনতার অনুভূতি থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা আদায় করা।’

স্ট্যানলি রাইসের মনে জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞায় যে সামাজিক শ্রেণি রয়েছে তা মূলত বুদ্ধিজীবী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি, যারা বিশেষভাবে ‘হীনম্মন্যতার অনুভূতিতে’ ভোগে। তাদের বৈরিতা কমাতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ সুবিধাদান নীতি অনুসরণ করছে। যেমন স্ট্যানলি রাইস লিখেছেন, ‘সরকারি চাকরির উচ্চতর পর্যায়ে ভারতীয়দের উন্মুক্ত নিয়োগ এবং রাষ্ট্রীয় বিষয়াবলিতে বেসরকারি উপাদান সংশ্লেষ করার মাধ্যমে হীনম্মন্যতার অনুভূতি ক্রমান্বয়ে দূর করা হচ্ছে।...যাহোক, এ ছাড়া আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো ধীরে ধীরে নতুন পেশা চালু করা হচ্ছে। যেমন এত দিন পর্যন্ত ইঞ্জিনিয়ারিং, অর্থায়ন, বাণিজ্য ও চিকিত্সা পেশায় চাকরি না থাকায় ব্যাপক অসন্তোষ ছিল।’

নিবন্ধের লেখক মনে করেন সুবিধাদানের নীতি ‘জাতীয়তাবাদ হটাতে’ পারবে না। কারণ হিসেবে তিনি যোগ করেন, জাতীয়তাবাদ ‘রাজনৈতিক নীতি হিসেবে সব রাজনৈতিক দলের স্থির বিশ্বাসে পরিণত হওয়ার আগ পর্যন্ত তার ভিত্তিকে বিস্তৃত করেছে’। এমন অবস্থা বলশেভিকদের হস্তক্ষেপের জন্য একটি প্রত্যক্ষ প্রণোদনা এবং ‘নির্যাতিত বা দাসত্বে পরিণত জাতিকে মুক্ত’ করার নামে তারা ‘বিশ্ব বিপ্লব প্রতিষ্ঠায় প্রথম পদক্ষেপ’ নেবে, যা ‘নিঃসন্দেহে মস্কোর নির্দেশে ও সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের আওতায় জনতাকে ক্ষমতা’ প্রদান করবে। ভারতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সংকট এমন এক তীব্র পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যে ‘স্পষ্টভাবেই, একটা এসপার-ওসপার হবে। জাতীয়তাবাদী দুর্দশাকে অবশ্যই কাজে লাগাতে হবে; আবেগপূর্ণ ও অপক্ব তরুণদের অবশ্যই পক্ষভুক্ত করতে হবে এবং এই দেশের ভেতরে মস্কোর দৃঢ় অবস্থান নিশ্চিত করতে যদি প্রয়োজন হয় তাহলে এসব তরুণকে বলিদানও দিতে হবে। যদি আগুন নিভে করুণ জ্বলন্ত অঙ্গারে পরিণত হয়, তাহলে আর দ্বিতীয় সুযোগ পাওয়া যাবে না।’

সে জন্যই স্ট্যানলি রাইস আশা করছেন ‘ভারতে একটি ব্যাপক অভিযান ঘটবে, সেটা হতে পারে চীনে রাশিয়ার সম্পূর্ণ সাফল্য বা সম্পূর্ণ ব্যর্থতার মাধ্যমে অভিযানের সমাপ্তির পরে। কিন্তু সেটা সম্পূর্ণ ব্যর্থতার কারণেই হবে, কারণ অন্যথায় রাশিয়া ক্ষমতা দৃঢ় করতে এবং পরবর্তী ধাপের প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত থাকবে।’

কিন্তু এই ‘অভিযানের’ ফলাফলকে সাম্রাজ্যবাদী লেখক আশাবাদ হিসেবে দেখেন, কারণ ‘যদিও রাশিয়া আফগানিস্তানে তার ভিত্তি প্রস্তুত করছে এবং অনেকাংশেই ভারতীয় সরকারের নজরদারি এড়িয়ে যেতে পারবে, কিন্তু ভারতীয় চৌকস নেতাদের পটানো তার জন্য সহজ হবে না। ভেবেছিল তার জোয়াল ব্রিটিশদের ওপর চাপিয়ে দেবে; কিন্তু এমন গ্রিক উপহার বহনকারী ত্রাণকর্তার চেয়ে ভারতীয় নেতারা নিজেদের মুক্তি নিজেরা সম্পন্ন করতেই স্বাচ্ছন্দ্য

বোধ করবে। যদি কোনো অদ্ভুত কারণে কমিউনিজম আরও সাফল্য অর্জনে উত্সাহিত করার আশায় পর্যাপ্ত ভিত্তি তৈরি করতে চায়—আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে পাঞ্জাব আফগানিস্তানের পাশেই অবস্থিত—সে ক্ষেত্রে ভারতীয় সংবিধানের সিগফ্রেড লাইন উড়িয়ে দিতে হবে, কিন্তু তবু তাদের এ দেশের ধর্ম, জাতপাত ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের আরও ভয়ানক হিন্ডেনবার্গ লাইন মোকাবিলা করতে হবে।’

ওপরের উক্তিতে আমরা সাম্রাজ্যবাদী প্রচারণা সম্পর্কে দুটি গুরুত্বপূর্ণ লাইনের নির্দেশ পাই, যেগুলো ভারতের বিপ্লবী অবস্থার ভীতি এবং ব্রিটিশ বিশ্বরাজনীতির প্রয়োজনীয়তা মেটাতে এখন শুরু করা হবে। প্রথমেই আমরা দেখি যে সোভিয়েত ইউনিয়নকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যে সে ভারতের ওপর তার ‘জোয়াল’ চাপিয়ে দিতে চায়। দ্বিতীয়ত ‘দেশের ধর্ম, জাতপাত ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানে’ এটা পরিপূর্ণ কাজে লাগাতে চায়। অন্যভাবে বললে, জনতার বিপ্লবী চেতনা দমনে ভারতীয় মতাদর্শ ও সামাজিক সংবিধানের যা কিছু সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল তা কাজে লাগানো।

কিন্তু স্ট্যানলি রাইসের অন্তরে একটা অস্বস্তি কাজ করছে। কারণ তাঁর ‘ধর্ম ও জাতপাতের হিন্ডেনবার্গ লাইন’, যার আড়ালে তিনি ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য সুরক্ষা করতে চান, তা খুব ভালো অবস্থায় নেই। ভারতীয় জনতা যে তাদের ‘দেবতাদের’ ওপর আস্থা হারাচ্ছে সে ব্যাপারে স্ট্যানলি রাইস তাঁর সন্দেহ লুকাতে পারেননি। দেশে ঘটে চলা শিল্পবিপ্লবের সময়ে ‘নিজেদের ধর্মের প্রতি মনেপ্রাণে অনুরক্ত থাকা’ ভারতীয় জনগণের জন্য কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে স্ট্যানলি রাইস স্পষ্টতই উদ্বিগ্ন। তিনি দুঃখের সঙ্গে স্বীকার করছেন যে ভারত ‘বিশ্বের অন্যতম শিল্পভিত্তিক দেশে পরিণত হয়েছে এবং তার শিল্পগুলো ব্যাপকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে।’ একইভাবে তিনি অদ্ভুতভাবে ব্যক্ত প্রত্যাশায় ডুবে আছেন যে ‘শিল্প ভারতের হূিপণ্ড নয়, এবং’—তিনি প্রচণ্ড ভক্তি ও জোরের সঙ্গে বলেন—‘যদি সৃষ্টিকর্তা দয়ালু হন তবে কখনোই শিল্প ভারতের হূিপণ্ড হবে না।’

এ রকম ভাষা থেকেই এটা স্পষ্ট বোঝা যায় যে এই লেখকের মতো ইংল্যান্ডে রক্ষণশীলদের একটি অংশ সব উপনিবেশে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা ক্রমবর্ধমান হুমকিতে আতঙ্কিত। এর ফলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার নিরাপত্তায় উপনিবেশ দেশগুলোর ধর্মীয় মানসিকতার ওপরই তাঁরা ভরসা রাখছেন।

মূলত ‘হিন্দু সমাজের পুরো কাঠামো যে দার্শনিক মতবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত’ তা হলো মৃত্যুর পরে মুক্তি। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের এই সমর্থনকারী আশা করেন যে ‘ভারতে কমিউনিজম ব্যাপক পরিসরে আস্তানা গাড়ার সম্ভাবনা খুবই কম’ এবং ‘যেকোনো দেশের তুলনায় সম্ভবত ভারতে কমিউনিস্টদের বিপ্লবী মতবাদ গৃহীত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম।’

যাহোক, এটাই সম্পূর্ণ প্রশ্নের সমাপ্তি নয়। এটা বোঝা যায় যে ভারতে কমিউনিজমের অসম্ভবতা নিয়ে জনাব রাইস যে উপসংহারে পৌঁছেছেন তা ‘মস্কোর উত্সাহীদের তাদের প্রচেষ্টা থেকে বিরত করবে না’। ‘এই উত্সাহীরা’ ‘দারিদ্র্য নিরসন, জাতপাত বৈষম্যের বিলোপসাধন, একটি পার্থিব স্বর্গের প্রতিশ্রুতি, সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের ধ্বংসের নামে’ ‘সারা ভারতব্যাপী’ ‘সহিংসতা ও বিপ্লব’ ছড়িয়ে দেবে। এটাও সব নয়, ‘চীনের ঘটনাগুলো ভারতে অলক্ষিত থাকছে না।’ ‘রাশিয়ান বলশেভিজম যে বিদেশিকে চীনাদের ধ্বংসকারী ও নির্যাতনকারী হিসেবে অভিশপ্ত করেছে, সেই বিদেশির প্রতিপত্তি কমেছে এবং তার অনেক চেষ্টার পরও জাতীয়তাবাদী শক্তি ক্ষমতায় এসেছে এবং ধীরে ধীরে তাকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করছে।’

এর সর্বমোট ফলাফল হলো ‘ভারতে কমিউনিস্ট কার্যক্রমকে হিসাবের মধ্যে রাখতে হবে’। তাদের জন্য ব্রিটিশ সরকারি নথিপত্র এখানে উদ্ধৃত করা হয়েছে। এটা বলা হয় যে ‘(কমিউনিস্ট) পার্টির তেমন কোনো সাফল্য নেই।’ কিন্তু ‘এটা অতিরিক্ত আশাবাদের কোনো কারণ নয়’—স্ট্যানলি রাইস তাঁর পাঠকদের মনে করিয়ে দেন। কারণ, তিনি বিরাট কিছু আবিষ্কার করেছেন এমন সুরে বলেন যে ‘নীতির দিক থেকে কমিউনিজম বিপ্লবী এবং বিপ্লবের জন্য কাজ করা কোনো ছোট দল তাদের কার্যবিবরণী প্রচার করে বেড়ায় না এবং বাড়ির ছাদ থেকে তাদের কার্যক্রম ঘোষণা করে না।’

ব্যাপক আশঙ্কার সঙ্গে স্ট্যানলি রাইস মনে করিয়ে দেন যে ভারতে তাঁর ভ্রমণের সময়ে কমরেড সাক্লাতভালার ‘উন্মুক্ত সমাবেশে বিশাল জনগোষ্ঠী উপস্থিত হয়েছিল।’ ‘শ্রমিকদের বিশাল সমাবেশে কমিউনিজম প্রচার করা হয়’ এবং ‘মিল, বন্দর, রেলওয়েতে ধর্মঘট যে আন্দোলনেরই ফসল, তা প্রমাণ করে’। আমাদের বলা হয়েছিল যে ‘রাজনৈতিক দাবিদাওয়া, সাম্প্রদায়িক সংঘাত ও শ্রম অসন্তোষের কারণে সৃষ্ট অস্থিরতাকে কমিউনিস্ট পার্টি ব্যবহার করতে পারে এবং সম্ভবত করবে, এবং রাশিয়ানরা কাজে লাগাবে।’

সে জন্যই স্ট্যানলি রাইস ঘোষণা করছেন যে ‘যদি এসব চলতে দেওয়া হয়, তাহলে কমিউনিজম মাথাচাড়া দেবে।’ পুরো নিবন্ধের উপসংহারটি এমন যে ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলন বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং যথাসময়ে ব্রিটিশ সরকারের উচিত এর প্রতি নজর দেওয়া এবং তা দমনে ব্যবস্থা নেওয়া। ঘটনাক্রমে নিবন্ধের লেখক উপসংহার টেনেছেন যে আন্দোলন দমন শুরু করার ‘এখনই সময়’। ভারতে কমিউনিজমের বিরুদ্ধে লড়াই করার দুটি বাস্তবসম্মত পদ্ধতি সুপারিশ করা হয়েছে। একটি পদ্ধতি হচ্ছে মিথ্যা ও অপবাদের মাধ্যমে প্রচারণা চালানো। যেমন নিবন্ধে দাবি করা হয়েছে ‘ভারতকে জানতে দিন কমিউনিজম কী, রাশিয়ার জন্য এর মানে কী, চীনে কী, এমনকি ইংল্যান্ডেই বা কী। এটা ব্যাখ্যা করুন সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার শব্দগুলো বলতে কী বোঝায়। এগুলো এখন তোতা পাখির মতো বলা হয় এবং বেশির ভাগ মানুষের কাছেই বোধগম্য নয়। কিন্তু তবু এই শব্দগুলো তাদের উত্সাহ জাগায় এবং আবেগ উসকে দেয়।’ অন্যটি হলো পুলিশি সন্ত্রাসের মাধ্যমে দমনের প্রত্যক্ষ পদ্ধতি। তিনি লেখেন, ‘যে কমিউনিস্ট সামাজিক শৃঙ্খলা নষ্ট করছে তার পেশা বন্ধ করে দিন। ভারতীয় সরকার এটা দেখাক যে সে দায়িত্বহীন বক্তা ও লেখকদের চিত্তবিকার সহ্য করবে না। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা এবং জনগণের কাছে এর যা মানে, তা বাক্স্বাধীনতার আবেগপ্রবণ অনুভূতির চেয়ে নিশ্চিতভাবেই বেশি মূল্যবান—শত্রুকে হেলাফেলা করা অনেকটা দুর্যোগকে শাস্তি প্রদান করার মতো বিষয়।’

অনুবাদ: খলিলউল্লাহ্