[গোলাম আম্বিয়া খান লুহানী যৌবনে ভারতের জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী আন্দোলনে উত্সাহী ছিলেন। অক্টোবর বিপ্লব সংঘটনের সময় তিনি ছিলেন লন্ডনে। সেখানে তিনি সক্রিয় হয়ে ওঠেন। ১৯২১ সালে তিনি কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের তৃতীয় কংগ্রেসে যোগ দিতে সোভিয়েত রাশিয়ায় যান। ১৯২৫ সালে তিনি প্যারিসে বিপ্লবী এম এন রায়ের স্ত্রীর সঙ্গে কমিউনিস্ট ভাবাদর্শের একটি সংবাদপত্র এবং ভারতে বিপ্লব সংঘটনের জন্য কাজ করেন। ১৯২৮ সালে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নে থেকে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালসহ অন্যান্য সংগঠনের কাজ করেছেন। তিনি কমিন্টার্নের ষষ্ঠ সম্মেলনে অংশ নেন। ১৯৩৭ সালে স্তালিনের শাসনামলে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং সাজাপ্রাপ্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। অনেক কাজের মধ্যে তিনি কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের হয়ে অনেক প্রতিবেদন লিখেছেন। সেই ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত বিবেচনায় রেখে প্রথম আলো ও প্রতিচিন্তার সম্পাদক মতিউর রহমান তাঁর গবেষণার প্রয়োজনে রাশিয়ার আর্কাইভ থেকে লুহানী-সংক্রান্ত নানা দলিলপত্র সংগ্রহ করেছেন। তাঁর সেই সংগৃহীত দলিলপত্র থেকে লুহানীর করা দুটি প্রতিবেদন অনুবাদ করে ছাপা হলো।]
১৯২৭ সালের ৪ জুলাইয়ের প্রতিবেদনে ভারতে একটি কমিউনিস্ট পার্টির আইনি উপস্থিতির তথ্য দিয়েছিলাম। ২১ মে বোম্বেতে অনুষ্ঠিত পার্টির বার্ষিক অধিবেশনে গৃহীত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো আমরা বিস্তারিত উল্লেখ করেছিলাম। এ ছাড়া আমরা দলের সভাপতিমণ্ডলী, নির্বাহী কমিটি ও অন্য পদাধিকারী সদস্যদের তালিকা তাঁদের কারও কারও বৈশিষ্ট্যসহ দিয়েছিলাম।
দলের অঙ্গসংগঠনের মধ্যে মস্কোর পূর্বাঞ্চলীয় টয়লারের কমিউনিস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের (কেইউটিভি) সাবেক কিছু ছাত্র রয়েছেন বলে মনে হয়। কিন্তু কমিন্টার্নের সঙ্গে সম্ভাব্য সম্পর্কের দৃষ্টিকোণ থেকে পার্টির ধরন যাচাই করার জন্য সব প্রয়োজনীয় তথ্য এখনো আমাদের হাতে নেই।
যা হোক, এই মুহূর্তে আগের দেওয়া প্রতিবেদনের তথ্যের সঙ্গে আরও যথেষ্ট পরিমাণ তথ্য যোগ করা সম্ভব। যেমন বোম্বে বৈঠকে গৃহীত পার্টির বার্ষিক প্রতিবেদন আমাদের কাছে আছে। প্রতিবেদনটি ছোট পুস্তিকা আকারে বৈধভাবে প্রকাশিত। আমরা ইতিমধ্যে সিদ্ধান্তগুলো ও পদাধিকারী সদস্যদের যে তালিকা দিয়েছি, তা ছাড়া প্রতিবেদনে রয়েছে (ক) ‘ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির গঠনতন্ত্র’, (খ) একটি ‘ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’ এবং (গ) ১৯২৬-২৭ সময়কালের দলীয় কার্যক্রমের বর্ণনা।
সিপিআইয়ের (ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি) গঠনতন্ত্র
নিচে আমরা গঠনতন্ত্রের ধারাগুলো উল্লেখ করলাম:
১. নাম: দলের নাম হবে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি।
২. সদস্যতা: যারা কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের নির্ধারিত কর্মসূচিতে সম্মত, শুধু তারাই সদস্যতার জন্য যোগ্য হবে।
৩. চাঁদা: প্রত্যেক সদস্যের বছরে চাঁদার পরিমাণ ১২ রুপির কম হবে না এবং তা চারটি কিস্তিতে দিতে হবে। নির্বাহী কমিটি এটা নির্ধারণ করবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে তা সদস্যতা বাতিলের শামিল হবে।
৪. ভর্তি ফি: সদস্যতা ফরমে স্বাক্ষর করতে ১ রুপি দিতে হবে। সদস্যতার জন্য প্রত্যেক আবেদনকারীকে অন্তত দুজন পার্টির নির্বাহী সদস্য কর্তৃক তার ফরম প্রতিস্বাক্ষরিত হতে হবে।
৫. বার্ষিক সভা: ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি সব সদস্যকে নিয়ে একটি বার্ষিক সভা করবে। অবসরে যাওয়া নির্বাহী, কংগ্রেস ও ট্রেড ইউনিয়ন দলগুলোর প্রতিবেদন সম্পর্কে আলোচনা ও তা গ্রহণের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ হবে এই সভা এবং একইভাবে আসন্ন বছরের জন্য কর্মসূচি নির্ধারণ করবে। বার্ষিক সভার মূল কাজ হবে পদাধিকারী সদস্য ও একজন কেন্দ্রীয় নির্বাহী নির্বাচিত করা, এবং হিসাবের নিরীক্ষিত বিবৃতি ও আলোচ্যসূচির অন্যান্য সিদ্ধান্তের ওপর আলোচনা করা।
৬. প্রশাসনের দায়িত্ব: যখন সভা চলবে না, তখন পার্টির বিষয়াবলি নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাহী পরিষদের ওপর ন্যস্ত থাকবে। এই পরিষদ নির্বাচিত হবে কেন্দ্রীয়করণ নীতির ভিত্তিতে, আঞ্চলিকতার ভিত্তিতে নয়। পরিষদ নির্বাচন করা হবে সমগ্র পার্টি সদস্যদের মধ্য থেকে এবং তা কোনোক্রমেই পার্টির সিদ্ধান্তের সঙ্গে অসামঞ্জস্য কোনো কাজ করবে না।
৭. নিম্নোক্ত নির্বাহী কার্যালয়গুলো পার্টির থাকবে: পাঁচ সদস্যের সভাপতিমণ্ডলী, একজন সাধারণ সম্পাদক, একজন কোষাধ্যক্ষ। পার্টির কোনো সভাপতি থাকবে না। প্রতিটি সভায় সভা চলাকালীন ওই সভার সভাপতি নির্বাচিত করা হবে।
৮. কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি: পার্টির কেন্দ্রীয় নির্বাহী গঠিত হবে সভাপতিমণ্ডলীর পাঁচজন সদস্য, সাধারণ সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষ, এবং পার্টি দ্বারা নির্বাচিত আরও আটজন সদস্য নিয়ে। নির্বাহী কমিটি বছরে সাধারণত তিনবার বৈঠক করবে। সাধারণ সম্পাদক সভাপতিমণ্ডলীর সঙ্গে পরামর্শ করে বৈঠকের সময় ও স্থান ঠিক করবে।
৯. কেন্দ্রীয় নির্বাহীর জন্য বিজ্ঞপ্তি: সাধারণ সম্পাদক কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির জন্য আলোচ্যসূচি প্রকাশ করবে, যেখানে বৈঠকের তারিখ, সময় ও স্থান উল্লেখ করা থাকবে। বৈঠকের পরিপূর্ণ ২০ দিন আগে এটা প্রকাশ করতে হবে।
১০. যখন কেন্দ্রীয় নির্বাহীর কোনো বৈঠক থাকবে না, তখন জরুরি বিষয়ে সাধারণ সম্পাদক সভাপতিমণ্ডলীর সঙ্গে পরামর্শক্রমে সদস্যদের মতামত প্রদানের জন্য আহ্বান করবে। বেশির ভাগ সদস্যের মতামত, কেন্দ্রীয় নির্বাহীর বৈঠকে সিদ্ধান্ত পাস করানোর মতোই কার্যকরী হবে।
১১. সভাপতিমণ্ডলী: নিম্নোক্ত উদ্দেশ্যে পার্টি একটি সভাপতিমণ্ডলী নির্বাচিত করবে: (ক) কেন্দ্রীয় নির্বাহী কর্তৃক নির্দেশিত অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করা এবং তা সমাধানে সুপারিশ করা, (খ) দলের অন্য অঙ্গসংগঠন কর্তৃক ব্যক্তির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের বিরুদ্ধে ব্যক্তির অভিযোগ তদন্ত করা এবং সে বিষয়ে তাদের মতামত কেন্দ্রীয় কমিটির নির্দিষ্ট পদক্ষেপের জন্য প্রেরণ করা, (গ) ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস ও জাতীয় কংগ্রেসের মতো অন্য রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় ছোট দলীয় গোষ্ঠীগুলোকে তত্ত্বাবধান এবং সংগঠিত করা, (ঘ) বিভিন্ন রাজনৈতিক শাখায় কাজ করছে এমন গোষ্ঠীগুলোর নেতাদের প্রতিবেদন গ্রহণ করা এবং তা নির্বাহী সদস্যদের মধ্যে প্রচার করা, (ঙ) নির্বাহীর অনুমতিতে সব বৈদেশিক বিষয় দেখাশোনা করা।
১২. সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যপদের প্রার্থীদের অবশ্যই সম্ভাব্য সর্বোচ্চ পর্যায়ের পার্টি সদস্য হতে হবে। তাদের অবশ্যই রাজনৈতিক অঙ্গনে অন্তত পাঁচ বছরের জন্য সক্রিয় কর্মী হিসেবে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে।
১৩. বৈদেশিক দপ্তর: কেন্দ্রীয় নির্বাহীর অনুমতিক্রমে সভাপতিমণ্ডলী একটি বৈদেশিক দপ্তর পরিচালনা করবে, যা হবে মতাদর্শগত কেন্দ্র। এটা গঠিত হবে সেসব কমরেডকে নিয়ে, যারা দেশের ভেতরে কাজ করার মতো অবস্থায় নেই। বৈদেশিক দপ্তর কেন্দ্রীয় নির্বাহীর প্রতিনিধিত্ব করবে এবং এমন অঙ্গসংগঠন হিসেবে কাজ করবে, যা পার্টির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক রক্ষা করবে। কিন্তু এই দপ্তর কোনোভাবেই পার্টির কর্মসূচি ও সিদ্ধান্তের সঙ্গে অসামঞ্জস্য কিছু করবে না। বৈদেশিক দপ্তর তাদের সুবিধামতো জায়গায় নিয়মিত অফিস করবে এবং কেন্দ্রীয় নির্বাহী ও কমির্ন্টানের সবার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখবে। এ ছাড়া ভারতীয় বিষয়গুলোর প্রচার বাড়াবে।
১৪. দলীয় শৃঙ্খলা: পার্টির সব সদস্য ও সংগঠনের কাছ থেকে যথাযথ শৃঙ্খলা কাম্য। যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে না, ততক্ষণ সব প্রশ্ন আলোচনার জন্য সম্পূর্ণভাবে উন্মুক্ত থাকবে। যখনই কোনো সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে, তখন সব সদস্য ও সংগঠন তা দ্রুততার সঙ্গে কার্যকর করবে।
১৫. দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ হলে দায়িত্বপ্রাপ্ত দলীয় সংগঠন ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে তার মধ্যে রয়েছে সংগঠনের ভর্ত্সনা করা, স্থগিত করা, এমনকি বাতিলকরণের মাধ্যমে নতুন করে সদস্যতা নিবন্ধন করা। ব্যক্তির সদস্যতার বিরুদ্ধে যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে তার মধ্যে রয়েছে ভর্ত্সনা, কার্যালয় থেকে অপসারণ বা বিতাড়ন। জরুরি বিষয়ের ক্ষেত্রে সভাপতিমণ্ডলী ব্যবস্থা নিতে পারবে এবং পার্টির নির্বাহীর কাছে আপিল করা যাবে।
১৬. উপদল: যেকোনো শ্রমিক শ্রেণি, রাজনৈতিক ও জাতীয় সংগঠনে যদি দুই বা ততোধিক কমিউনিস্ট থাকে তাহলে পার্টির প্রভাব বৃদ্ধি ও এর নীতি প্রয়োগের উদ্দেশ্যে একটি উপদল অবশ্যই সংগঠিত করতে হবে। এই উপদলগুলো স্বাধীন হবে না। এগুলো পার্টির শৃঙ্খলা ও কর্মসূচির অধীনে থাকবে।
১৭. জাতীয় কংগ্রেস নির্বাহীর মতো সব সংগঠন, যেমন সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটি ও ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের নির্বাহীর মতো পার্টি উপদল গঠন করবে, যেগুলো সভাপতিমণ্ডলীর নিয়ন্ত্রণের অধীনে থাকবে। এ ক্ষেত্রে নির্বাহী কমিটি কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত উপদলের নেতারা তাঁদের সম্পাদিত কাজের প্রতিবেদন স্ব স্ব সংগঠনে জমা দেবেন। যেকোনো বিষয়ে যদি উপদলের সদস্যদের মতপার্থক্য হয়, তাহলে নির্বাহী কমিটির বৈঠক না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা সভাপতিমণ্ডলীর মাধ্যমে পরিচালিত হবেন।
১৮. উপদলের কাজের সংগঠন বা শাখা দ্বারা নির্ধারিত প্রতিটি প্রশ্ন উপদলের বৈঠকে আগে আলোচনা করে নিতে হবে এবং তাদের সিদ্ধান্তের একটি প্রতিবেদন সাধারণ সম্পাদককে পাঠাতে হবে, যিনি এটা সভাপতিমণ্ডলীদের কাছে প্রচার করবেন। যেকোনো প্রশ্নে সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে উপদলের সদস্যরা একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করবেন এবং ওই সংগঠনের বৈঠকে দৃঢ়ভাবে ভোট দেবেন। এটা করতে ব্যর্থ হলে তা দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের শামিল হবে।
১৯. ন্যূনতম কর্মসূচি: ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি তার বার্ষিক সভায় নিয়মিত কর্মসূচি ও নীতি প্রণয়ন করবে যা জাতীয় কংগ্রেস ও ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের মাধ্যমে কার্যকর করা হবে এবং কমরেডদের উপদল নামে দলীয় গোষ্ঠী গঠন করবে, যা পার্টির পক্ষে সেখানে কাজ করবে। এ ছাড়া পার্টি ন্যূনতম কর্মসূচি তৈরি করবে, যার ভিত্তিতে বিদ্যমান শ্রমিক ও রাজনৈতিক দলগুলোর সহায়তা চাইবে।
২০. অন্য রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোতে কমিউনিস্ট পরিচালনার জন্য আইন তৈরি করার ক্ষমতা কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির থাকবে। কিন্তু সেগুলো এই গঠনতন্ত্রের দ্বারা নির্ধারিত আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারবে না।
২১. কেন্দ্রীয় কার্যালয়: কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের স্থান নির্ধারিত হবে নির্বাহী কমিটি দ্বারা। এই কার্যালয়ে পার্টির নথিপত্র থাকবে এবং এখান থেকে প্রকাশনা বের করা হবে।
সিপিআইয়ের ইতিহাস
‘কেন্দ্রীয় নির্বাহী’ স্বাক্ষরিত বার্ষিক প্রতিবেদনে বর্তমান পার্টির ভিত্তির ব্যাপারে নিম্নে বর্ণিত বিষয়গুলো ছিল:
‘আমাদের মতামত হলো, ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস আপনাদের জানানো প্রয়োজন। আমাদের মনে হয়, এর ফলে আমাদের মধ্যে যাদের এ ব্যাপারে ভুল ধারণা আছে, তা স্পষ্ট হবে। আপনারা জানেন যে আমাদের আন্দোলন যেমন বিদেশ থেকে আমদানি করা নয়, তেমনি ভারতে প্রচারণা চালানোর জন্যও রাশিয়া নিয়ন্ত্রিত কোনো গোষ্ঠী নয়। কায়েমি স্বার্থবাদীরা ভারতে সোভিয়েতকে অপ্রিয় করতে এসব বলে থাকে। সত্যি বলতে, সামাজিক শক্তির ক্রমবিকাশই আমাদের সবাইকে একত্র করেছে এবং এই পার্টি গঠনে সাহায্য করেছে। কয়েক বছর ধরে ভারত তার রাজনৈতিক মুক্তির জন্য সংগ্রাম করে চলেছে। যুদ্ধের ফলে চারদিকে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে এবং সবখানেই আমজনতা বিপ্লবী মেজাজে রয়েছে। কিন্তু দৃঢ় নেতৃত্বের অভাবে তারা চূড়ান্ত কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না। এই সন্ধিক্ষণেই জনাব গান্ধী তাঁর অসহযোগ আন্দোলনের ধারণা নিয়ে হাজির হন এবং আমজনতা ব্যাপক উত্সাহ নিয়ে এই আন্দোলনে শামিল হয়। এর ফলে গান্ধী বারদোলিতে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির কাছে পরাজিত হওয়ার আগ পর্যন্ত ভারত ব্যাপক এক রাজনৈতিক অভ্যুত্থানের দোরগোড়ায় এসে পৌঁছায়। তারপর থেকেই মতপার্থক্যের কারণে অসহযোগ আন্দোলনের ফৌজ কমে আসছিল। এদিকে এই আন্দোলনের নেতৃত্বকে কেউ চ্যালেঞ্জ করেনি এবং এখনো ভাসা-ভাসা রয়ে গেছে। নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। আন্দোলনকে অর্ধেক শেষ করে দেয় সরকারের নির্যাতন, আর বাকিটা করে যারা অনীহাসহকারে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল তারা এবং যারা তাদের নিজেদের খেল খেলার সুযোগ পেয়েছিল। সংসদীয় প্রতিরোধের স্লোগান নিয়ে স্বরাজ পার্টির আবির্ভাব ঘটে এবং তারা শেষ পর্যন্ত কানপুরে কংগ্রেসকে দখল করার আগ পর্যন্ত কংগ্রেসের মধ্যে মতদ্বৈধতা সৃষ্টি করছিল। এরই মধ্যে গান্ধী বন্দীদশা থেকে ছাড়া পেলেও বিরোধীদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয়। এর ফলে অসহযোগ আন্দোলন শুরুর সময় যে অবস্থা ছিল, তার চেয়ে ভালো কোনো অবস্থা তৈরি হয়নি। অবস্থা স্থির থাকেনি। স্বরাজ পার্টির মধ্যেই ঝগড়া-বিবাদ সৃষ্টি হয়। আরও একটি দল গঠিত হয়েছিল, যা স্বরাজি কর্মসূচি থেকে ভিন্ন ছিল না।
কংগ্রেসের মধ্যে নেতৃত্বের জন্য এ রকম দ্বন্দ্ব যখন চলছিল, তখন তরুণ শক্তি অতিষ্ঠ হয়ে নিজেদের পথ খোঁজার চেষ্টা করছিল। এর একটি অংশ গিয়ে যোগ দেয় ব্যর্থ সন্ত্রাসী দলে, আর অন্যরা বিক্ষিপ্তভাবে ছোট দল গঠন করে, যেমন “তরুণদের সংগঠন” (ইয়ং ম্যান’স অ্যাসোসিয়েশন) ইত্যাদি। এ সময়ই ভারতে প্রথম কমিউনিজমের নাম শোনা গেল। হিজরত আন্দোলনে (ভারতের বাইরে মুসলিম দেশগুলোয় জাতীয়-বিপ্লব সংগ্রামে সংহতি জানানোর রাজনৈতিক-ধর্মীয় আন্দোলন) যোগ দিতে যেসব তরুণ ভারত ছেড়েছিল এবং যারা পরে তাসখন্দ বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিবাসন নিয়েছিল, তারা ১৯২৮ সালে তাসখন্দ থেকে নতুন রাজনৈতিক চিন্তা ও প্রশিক্ষণ নিয়ে আফগানিস্তান হয়ে ভারতে ফিরে আসে। দেশে ফেরার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের গ্রেপ্তার করা হয় এবং দীর্ঘমেয়াদি কারাদণ্ড দেওয়া হয়। যারা তখনো বাইরে ছিল যেমন কমরেড এস. উসমানি ও নালিনি ভুষনদাস গুপ্ত, তারা একটি গণদল সংগঠিত করার দায়িত্ব নেন এবং কংগ্রেস ও খেলাফত কর্মীদের সঙ্গে কাজ করা শুরু করেন। অ্যাংলো-ভারতীয় পেনাল কোডের ১২১ ধারায় ষড়যন্ত্রের অভিযোগে কমরেড এম আহমেদ এবং এস এ দাঙ্গেসহ তাঁরাও গ্রেপ্তার হন। এই মামলা ব্যাপক প্রচারণা পায় এবং কমিউনিজমের একটি অস্পষ্ট ধারণার জন্ম হয়। এর ফলে জাতীয় বিপ্লবের একটি ধারণা সৃষ্টি হয়, যা ভারতের বিশ্বমানের বিপ্লবী নেতারা প্রস্তাব করেন। কানপুরেই কমিউনিস্টদের বিচার ও সাজা দেওয়া হয়। তাই আদালতে যে কর্মসূচি নিয়ে অভিযোগ এসেছে তার সিলমোহর (কানপুরে) অন্য যেকোনো স্থানের চেয়ে বেশি ছিল। জনাব সত্যভক্ত এই সুযোগ গ্রহণ করেন এবং ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি নাম ও চরিত্র নিয়ে কানপুরে একটি পার্টি শুরু করেন। এই পার্টি বেশ কিছু লোককে আকৃষ্ট করে এবং তারা পার্টির সদস্য হিসেবে নাম লেখান। এই দলের আদর্শ হিসেবে স্বাধীনতার দাবি ছিল সবার আগে। দলের নাম জনপ্রিয় করতে বেশ কিছু প্রচারণা তৈরি করা হয়। কিন্তু দেখা গেল, এত কিছুর পরও সেসব কাজে অন্তর্নিহিত মার্ক্সীয় কিছু ছিল না। উল্টো এমন কিছু কাজ করা হয়েছিল, যা এখানে উল্লেখ করা অপ্রয়োজনীয়, সেগুলো ভারতের মতো স্বল্প কমিউনিজম জানাশোনা দেশে কমিউনিজম দর্শনেরই দুর্নাম কুড়িয়েছিল। দুই বছর টিকে থাকার পর কানপুরে ভারতীয় কমিউনিস্টদের একটি সম্মেলন আহ্বান করা হয়। এটাকে প্রথম কমিউনিস্ট সম্মেলন হিসেবে ঘোষণা করা হয়। কয়েকজন কমরেড পার্টি দখলের সিদ্ধান্ত নেন, যাদের সংখ্যা ছিল প্রায় ২০০-২০৬। সঠিক সংখ্যা বলা যাচ্ছে না, কারণ জনাব সত্যভক্তের কাছে যে রেকর্ড ছিল তা তিনি আমাদের কাছে হস্তান্তর করেননি। এমনকি যে তহবিল তিনি সংগ্রহ করেছিলেন, তারও কোনো হিসাব বিবৃতি দেননি। যদিও আমরা সংগঠনটি দখল করতে সক্ষম হয়েছিলাম, কিন্তু পার্টি ছিল একটি শর্তাধীন অবস্থায়। পার্টির কোনো গঠনতন্ত্র যেমন ছিল না, তেমনি কোনো কর্মসূচিও ছিল না। বিভিন্ন মানুষকে সংগঠিত করতে নির্বাহী চারজন আঞ্চলিক সংগঠককে নিয়োগ দেয়, যার উদ্দেশ্য ছিল এই বিষয়ে তাদের মতামত লিপিবদ্ধ করা।’