১৯২৬-২৭ সময়কালে 'ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি'র গঠনতন্ত্র, ইতিহাস ও কার্যক্রম

 [গোলাম আম্বিয়া খান লুহানী যৌবনে ভারতের জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী আন্দোলনে উত্সাহী ছিলেন। অক্টোবর বিপ্লব সংঘটনের সময় তিনি ছিলেন লন্ডনে। সেখানে তিনি সক্রিয় হয়ে ওঠেন। ১৯২১ সালে তিনি কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের তৃতীয় কংগ্রেসে যোগ দিতে সোভিয়েত রাশিয়ায় যান। ১৯২৫ সালে তিনি প্যারিসে বিপ্লবী এম এন রায়ের স্ত্রীর সঙ্গে কমিউনিস্ট ভাবাদর্শের একটি সংবাদপত্র এবং ভারতে বিপ্লব সংঘটনের জন্য কাজ করেন। ১৯২৮ সালে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নে থেকে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালসহ অন্যান্য সংগঠনের কাজ করেছেন। তিনি কমিন্টার্নের ষষ্ঠ সম্মেলনে অংশ নেন। ১৯৩৭ সালে স্তালিনের শাসনামলে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং সাজাপ্রাপ্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। অনেক কাজের মধ্যে তিনি কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের হয়ে অনেক প্রতিবেদন লিখেছেন। সেই ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত বিবেচনায় রেখে প্রথম আলো ও প্রতিচিন্তার সম্পাদক মতিউর রহমান তাঁর গবেষণার প্রয়োজনে রাশিয়ার আর্কাইভ থেকে লুহানী-সংক্রান্ত নানা দলিলপত্র সংগ্রহ করেছেন। তাঁর সেই সংগৃহীত দলিলপত্র থেকে লুহানীর করা দুটি প্রতিবেদন অনুবাদ করে ছাপা হলো।]

১৯২৭ সালের ৪ জুলাইয়ের প্রতিবেদনে ভারতে একটি কমিউনিস্ট পার্টির আইনি উপস্থিতির তথ্য দিয়েছিলাম। ২১ মে বোম্বেতে অনুষ্ঠিত পার্টির বার্ষিক অধিবেশনে গৃহীত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো আমরা বিস্তারিত উল্লেখ করেছিলাম। এ ছাড়া আমরা দলের সভাপতিমণ্ডলী, নির্বাহী কমিটি ও অন্য পদাধিকারী সদস্যদের তালিকা তাঁদের কারও কারও বৈশিষ্ট্যসহ দিয়েছিলাম।

দলের অঙ্গসংগঠনের মধ্যে মস্কোর পূর্বাঞ্চলীয় টয়লারের কমিউনিস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের (কেইউটিভি) সাবেক কিছু ছাত্র রয়েছেন বলে মনে হয়। কিন্তু কমিন্টার্নের সঙ্গে সম্ভাব্য সম্পর্কের দৃষ্টিকোণ থেকে পার্টির ধরন যাচাই করার জন্য সব প্রয়োজনীয় তথ্য এখনো আমাদের হাতে নেই।

যা হোক, এই মুহূর্তে আগের দেওয়া প্রতিবেদনের তথ্যের সঙ্গে আরও যথেষ্ট পরিমাণ তথ্য যোগ করা সম্ভব। যেমন বোম্বে বৈঠকে গৃহীত পার্টির বার্ষিক প্রতিবেদন আমাদের কাছে আছে। প্রতিবেদনটি ছোট পুস্তিকা আকারে বৈধভাবে প্রকাশিত। আমরা ইতিমধ্যে সিদ্ধান্তগুলো ও পদাধিকারী সদস্যদের যে তালিকা দিয়েছি, তা ছাড়া প্রতিবেদনে রয়েছে (ক) ‘ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির গঠনতন্ত্র’, (খ) একটি ‘ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’ এবং (গ) ১৯২৬-২৭ সময়কালের দলীয় কার্যক্রমের বর্ণনা।

সিপিআইয়ের (ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি) গঠনতন্ত্র

নিচে আমরা গঠনতন্ত্রের ধারাগুলো উল্লেখ করলাম:

১.          নাম: দলের নাম হবে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি।

২.          সদস্যতা: যারা কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের নির্ধারিত কর্মসূচিতে সম্মত, শুধু তারাই সদস্যতার জন্য যোগ্য হবে।

৩.         চাঁদা: প্রত্যেক সদস্যের বছরে চাঁদার পরিমাণ ১২ রুপির কম হবে না এবং তা চারটি কিস্তিতে দিতে হবে। নির্বাহী কমিটি এটা নির্ধারণ করবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে তা সদস্যতা বাতিলের শামিল হবে।

৪.          ভর্তি ফি: সদস্যতা ফরমে স্বাক্ষর করতে ১ রুপি দিতে হবে। সদস্যতার জন্য প্রত্যেক আবেদনকারীকে অন্তত দুজন পার্টির নির্বাহী সদস্য কর্তৃক তার ফরম প্রতিস্বাক্ষরিত হতে হবে।

৫.          বার্ষিক সভা: ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি সব সদস্যকে নিয়ে একটি বার্ষিক সভা করবে। অবসরে যাওয়া নির্বাহী, কংগ্রেস ও ট্রেড ইউনিয়ন দলগুলোর প্রতিবেদন সম্পর্কে আলোচনা ও তা গ্রহণের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ হবে এই সভা এবং একইভাবে আসন্ন বছরের জন্য কর্মসূচি নির্ধারণ করবে। বার্ষিক সভার মূল কাজ হবে পদাধিকারী সদস্য ও একজন কেন্দ্রীয় নির্বাহী নির্বাচিত করা, এবং হিসাবের নিরীক্ষিত বিবৃতি ও আলোচ্যসূচির অন্যান্য সিদ্ধান্তের ওপর আলোচনা করা।

৬.         প্রশাসনের দায়িত্ব: যখন সভা চলবে না, তখন পার্টির বিষয়াবলি নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাহী পরিষদের ওপর ন্যস্ত থাকবে। এই পরিষদ নির্বাচিত হবে কেন্দ্রীয়করণ নীতির ভিত্তিতে, আঞ্চলিকতার ভিত্তিতে নয়। পরিষদ নির্বাচন করা হবে সমগ্র পার্টি সদস্যদের মধ্য থেকে এবং তা কোনোক্রমেই পার্টির সিদ্ধান্তের সঙ্গে অসামঞ্জস্য কোনো কাজ করবে না।

৭.          নিম্নোক্ত নির্বাহী কার্যালয়গুলো পার্টির থাকবে: পাঁচ সদস্যের সভাপতিমণ্ডলী, একজন সাধারণ সম্পাদক, একজন কোষাধ্যক্ষ। পার্টির কোনো সভাপতি থাকবে না। প্রতিটি সভায় সভা চলাকালীন ওই সভার সভাপতি নির্বাচিত করা হবে।

৮.          কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি: পার্টির কেন্দ্রীয় নির্বাহী গঠিত হবে সভাপতিমণ্ডলীর পাঁচজন সদস্য, সাধারণ সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষ, এবং পার্টি দ্বারা নির্বাচিত আরও আটজন সদস্য নিয়ে। নির্বাহী কমিটি বছরে সাধারণত তিনবার বৈঠক করবে। সাধারণ সম্পাদক সভাপতিমণ্ডলীর সঙ্গে পরামর্শ করে বৈঠকের সময় ও স্থান ঠিক করবে।

৯.          কেন্দ্রীয় নির্বাহীর জন্য বিজ্ঞপ্তি: সাধারণ সম্পাদক কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির জন্য আলোচ্যসূচি প্রকাশ করবে, যেখানে বৈঠকের তারিখ, সময় ও স্থান উল্লেখ করা থাকবে। বৈঠকের পরিপূর্ণ ২০ দিন আগে এটা প্রকাশ করতে হবে।

১০.        যখন কেন্দ্রীয় নির্বাহীর কোনো বৈঠক থাকবে না, তখন জরুরি বিষয়ে সাধারণ সম্পাদক সভাপতিমণ্ডলীর সঙ্গে পরামর্শক্রমে সদস্যদের মতামত প্রদানের জন্য আহ্বান করবে। বেশির ভাগ সদস্যের মতামত, কেন্দ্রীয় নির্বাহীর বৈঠকে সিদ্ধান্ত পাস করানোর মতোই কার্যকরী হবে।

১১.        সভাপতিমণ্ডলী: নিম্নোক্ত উদ্দেশ্যে পার্টি একটি সভাপতিমণ্ডলী নির্বাচিত করবে: (ক) কেন্দ্রীয় নির্বাহী কর্তৃক নির্দেশিত অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করা এবং তা সমাধানে সুপারিশ করা, (খ) দলের অন্য অঙ্গসংগঠন কর্তৃক ব্যক্তির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের বিরুদ্ধে ব্যক্তির অভিযোগ তদন্ত করা এবং সে বিষয়ে তাদের মতামত কেন্দ্রীয় কমিটির নির্দিষ্ট পদক্ষেপের জন্য প্রেরণ করা, (গ) ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস ও জাতীয় কংগ্রেসের মতো অন্য রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় ছোট দলীয় গোষ্ঠীগুলোকে তত্ত্বাবধান এবং সংগঠিত করা, (ঘ) বিভিন্ন রাজনৈতিক শাখায় কাজ করছে এমন গোষ্ঠীগুলোর নেতাদের প্রতিবেদন গ্রহণ করা এবং তা নির্বাহী সদস্যদের মধ্যে প্রচার করা, (ঙ) নির্বাহীর অনুমতিতে সব বৈদেশিক বিষয় দেখাশোনা করা।

১২.        সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যপদের প্রার্থীদের অবশ্যই সম্ভাব্য সর্বোচ্চ পর্যায়ের পার্টি সদস্য হতে হবে। তাদের অবশ্যই রাজনৈতিক অঙ্গনে অন্তত পাঁচ বছরের জন্য সক্রিয় কর্মী হিসেবে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে।

১৩.        বৈদেশিক দপ্তর: কেন্দ্রীয় নির্বাহীর অনুমতিক্রমে সভাপতিমণ্ডলী একটি বৈদেশিক দপ্তর পরিচালনা করবে, যা হবে মতাদর্শগত কেন্দ্র। এটা গঠিত হবে সেসব কমরেডকে নিয়ে, যারা দেশের ভেতরে কাজ করার মতো অবস্থায় নেই। বৈদেশিক দপ্তর কেন্দ্রীয় নির্বাহীর প্রতিনিধিত্ব করবে এবং এমন অঙ্গসংগঠন হিসেবে কাজ করবে, যা পার্টির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক রক্ষা করবে। কিন্তু এই দপ্তর কোনোভাবেই পার্টির কর্মসূচি ও সিদ্ধান্তের সঙ্গে অসামঞ্জস্য কিছু করবে না। বৈদেশিক দপ্তর তাদের সুবিধামতো জায়গায় নিয়মিত অফিস করবে এবং কেন্দ্রীয় নির্বাহী ও কমির্ন্টানের সবার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখবে। এ ছাড়া ভারতীয় বিষয়গুলোর প্রচার বাড়াবে।

১৪.        দলীয় শৃঙ্খলা: পার্টির সব সদস্য ও সংগঠনের কাছ থেকে যথাযথ শৃঙ্খলা কাম্য। যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে না, ততক্ষণ সব প্রশ্ন আলোচনার জন্য সম্পূর্ণভাবে উন্মুক্ত থাকবে। যখনই কোনো সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে, তখন সব সদস্য ও সংগঠন তা দ্রুততার সঙ্গে কার্যকর করবে।

১৫.        দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ হলে দায়িত্বপ্রাপ্ত দলীয় সংগঠন ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে তার মধ্যে রয়েছে সংগঠনের ভর্ত্সনা করা, স্থগিত করা, এমনকি বাতিলকরণের মাধ্যমে নতুন করে সদস্যতা নিবন্ধন করা। ব্যক্তির সদস্যতার বিরুদ্ধে যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে তার মধ্যে রয়েছে ভর্ত্সনা, কার্যালয় থেকে অপসারণ বা বিতাড়ন। জরুরি বিষয়ের ক্ষেত্রে সভাপতিমণ্ডলী ব্যবস্থা নিতে পারবে এবং পার্টির নির্বাহীর কাছে আপিল করা যাবে।

১৬.        উপদল: যেকোনো শ্রমিক শ্রেণি, রাজনৈতিক ও জাতীয় সংগঠনে যদি দুই বা ততোধিক কমিউনিস্ট থাকে তাহলে পার্টির প্রভাব বৃদ্ধি ও এর নীতি প্রয়োগের উদ্দেশ্যে একটি উপদল অবশ্যই সংগঠিত করতে হবে। এই উপদলগুলো স্বাধীন হবে না। এগুলো পার্টির শৃঙ্খলা ও কর্মসূচির অধীনে থাকবে।

১৭.        জাতীয় কংগ্রেস নির্বাহীর মতো সব সংগঠন, যেমন সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটি ও ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের নির্বাহীর মতো পার্টি উপদল গঠন করবে, যেগুলো সভাপতিমণ্ডলীর নিয়ন্ত্রণের অধীনে থাকবে। এ ক্ষেত্রে নির্বাহী কমিটি কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত উপদলের নেতারা তাঁদের সম্পাদিত কাজের প্রতিবেদন স্ব স্ব সংগঠনে জমা দেবেন। যেকোনো বিষয়ে যদি উপদলের সদস্যদের মতপার্থক্য হয়, তাহলে নির্বাহী কমিটির বৈঠক না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা সভাপতিমণ্ডলীর মাধ্যমে পরিচালিত হবেন।

১৮.        উপদলের কাজের সংগঠন বা শাখা দ্বারা নির্ধারিত প্রতিটি প্রশ্ন উপদলের বৈঠকে আগে আলোচনা করে নিতে হবে এবং তাদের সিদ্ধান্তের একটি প্রতিবেদন সাধারণ সম্পাদককে পাঠাতে হবে, যিনি এটা সভাপতিমণ্ডলীদের কাছে প্রচার করবেন। যেকোনো প্রশ্নে সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে উপদলের সদস্যরা একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করবেন এবং ওই সংগঠনের বৈঠকে দৃঢ়ভাবে ভোট দেবেন। এটা করতে ব্যর্থ হলে তা দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের শামিল হবে।

১৯.        ন্যূনতম কর্মসূচি: ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি তার বার্ষিক সভায় নিয়মিত কর্মসূচি ও নীতি প্রণয়ন করবে যা জাতীয় কংগ্রেস ও ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের মাধ্যমে কার্যকর করা হবে এবং কমরেডদের উপদল নামে দলীয় গোষ্ঠী গঠন করবে, যা পার্টির পক্ষে সেখানে কাজ করবে। এ ছাড়া পার্টি ন্যূনতম কর্মসূচি তৈরি করবে, যার ভিত্তিতে বিদ্যমান শ্রমিক ও রাজনৈতিক দলগুলোর সহায়তা চাইবে।

২০.        অন্য রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোতে কমিউনিস্ট পরিচালনার জন্য আইন তৈরি করার ক্ষমতা কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির থাকবে। কিন্তু সেগুলো এই গঠনতন্ত্রের দ্বারা নির্ধারিত আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারবে না।

২১.        কেন্দ্রীয় কার্যালয়: কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের স্থান নির্ধারিত হবে নির্বাহী কমিটি দ্বারা। এই কার্যালয়ে পার্টির নথিপত্র থাকবে এবং এখান থেকে প্রকাশনা বের করা হবে।

সিপিআইয়ের ইতিহাস

‘কেন্দ্রীয় নির্বাহী’ স্বাক্ষরিত বার্ষিক প্রতিবেদনে বর্তমান পার্টির ভিত্তির ব্যাপারে নিম্নে বর্ণিত বিষয়গুলো ছিল:

‘আমাদের মতামত হলো, ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস আপনাদের জানানো প্রয়োজন। আমাদের মনে হয়, এর ফলে আমাদের মধ্যে যাদের এ ব্যাপারে ভুল ধারণা আছে, তা স্পষ্ট হবে। আপনারা জানেন যে আমাদের আন্দোলন যেমন বিদেশ থেকে আমদানি করা নয়, তেমনি ভারতে প্রচারণা চালানোর জন্যও রাশিয়া নিয়ন্ত্রিত কোনো গোষ্ঠী নয়। কায়েমি স্বার্থবাদীরা ভারতে সোভিয়েতকে অপ্রিয় করতে এসব বলে থাকে। সত্যি বলতে, সামাজিক শক্তির ক্রমবিকাশই আমাদের সবাইকে একত্র করেছে এবং এই পার্টি গঠনে সাহায্য করেছে। কয়েক বছর ধরে ভারত তার রাজনৈতিক মুক্তির জন্য সংগ্রাম করে চলেছে। যুদ্ধের ফলে চারদিকে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে এবং সবখানেই আমজনতা বিপ্লবী মেজাজে রয়েছে। কিন্তু দৃঢ় নেতৃত্বের অভাবে তারা চূড়ান্ত কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না। এই সন্ধিক্ষণেই জনাব গান্ধী তাঁর অসহযোগ আন্দোলনের ধারণা নিয়ে হাজির হন এবং আমজনতা ব্যাপক উত্সাহ নিয়ে এই আন্দোলনে শামিল হয়। এর ফলে গান্ধী বারদোলিতে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির কাছে পরাজিত হওয়ার আগ পর্যন্ত ভারত ব্যাপক এক রাজনৈতিক অভ্যুত্থানের দোরগোড়ায় এসে পৌঁছায়। তারপর থেকেই মতপার্থক্যের কারণে অসহযোগ আন্দোলনের ফৌজ কমে আসছিল। এদিকে এই আন্দোলনের নেতৃত্বকে কেউ চ্যালেঞ্জ করেনি এবং এখনো ভাসা-ভাসা রয়ে গেছে। নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। আন্দোলনকে অর্ধেক শেষ করে দেয় সরকারের নির্যাতন, আর বাকিটা করে যারা অনীহাসহকারে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল তারা এবং যারা তাদের নিজেদের খেল খেলার সুযোগ পেয়েছিল। সংসদীয় প্রতিরোধের স্লোগান নিয়ে স্বরাজ পার্টির আবির্ভাব ঘটে এবং তারা শেষ পর্যন্ত কানপুরে কংগ্রেসকে দখল করার আগ পর্যন্ত কংগ্রেসের মধ্যে মতদ্বৈধতা সৃষ্টি করছিল। এরই মধ্যে গান্ধী বন্দীদশা থেকে ছাড়া পেলেও বিরোধীদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয়। এর ফলে অসহযোগ আন্দোলন শুরুর সময় যে অবস্থা ছিল, তার চেয়ে ভালো কোনো অবস্থা তৈরি হয়নি। অবস্থা স্থির থাকেনি। স্বরাজ পার্টির মধ্যেই ঝগড়া-বিবাদ সৃষ্টি হয়। আরও একটি দল গঠিত হয়েছিল, যা স্বরাজি কর্মসূচি থেকে ভিন্ন ছিল না।

কংগ্রেসের মধ্যে নেতৃত্বের জন্য এ রকম দ্বন্দ্ব যখন চলছিল, তখন তরুণ শক্তি অতিষ্ঠ হয়ে নিজেদের পথ খোঁজার চেষ্টা করছিল। এর একটি অংশ গিয়ে যোগ দেয় ব্যর্থ সন্ত্রাসী দলে, আর অন্যরা বিক্ষিপ্তভাবে ছোট দল গঠন করে, যেমন “তরুণদের সংগঠন” (ইয়ং ম্যান’স অ্যাসোসিয়েশন) ইত্যাদি। এ সময়ই ভারতে প্রথম কমিউনিজমের নাম শোনা গেল। হিজরত আন্দোলনে (ভারতের বাইরে মুসলিম দেশগুলোয় জাতীয়-বিপ্লব সংগ্রামে সংহতি জানানোর রাজনৈতিক-ধর্মীয় আন্দোলন) যোগ দিতে যেসব তরুণ ভারত ছেড়েছিল এবং যারা পরে তাসখন্দ বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিবাসন নিয়েছিল, তারা ১৯২৮ সালে তাসখন্দ থেকে নতুন রাজনৈতিক চিন্তা ও প্রশিক্ষণ নিয়ে আফগানিস্তান হয়ে ভারতে ফিরে আসে। দেশে ফেরার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের গ্রেপ্তার করা হয় এবং দীর্ঘমেয়াদি কারাদণ্ড দেওয়া হয়। যারা তখনো বাইরে ছিল যেমন কমরেড এস. উসমানি ও নালিনি ভুষনদাস গুপ্ত, তারা একটি গণদল সংগঠিত করার দায়িত্ব নেন এবং কংগ্রেস ও খেলাফত কর্মীদের সঙ্গে কাজ করা শুরু করেন। অ্যাংলো-ভারতীয় পেনাল কোডের ১২১ ধারায় ষড়যন্ত্রের অভিযোগে কমরেড এম আহমেদ এবং এস এ দাঙ্গেসহ তাঁরাও গ্রেপ্তার হন। এই মামলা ব্যাপক প্রচারণা পায় এবং কমিউনিজমের একটি অস্পষ্ট ধারণার জন্ম হয়। এর ফলে জাতীয় বিপ্লবের একটি ধারণা সৃষ্টি হয়, যা ভারতের বিশ্বমানের বিপ্লবী নেতারা প্রস্তাব করেন। কানপুরেই কমিউনিস্টদের বিচার ও সাজা দেওয়া হয়। তাই আদালতে যে কর্মসূচি নিয়ে অভিযোগ এসেছে তার সিলমোহর (কানপুরে) অন্য যেকোনো স্থানের চেয়ে বেশি ছিল। জনাব সত্যভক্ত এই সুযোগ গ্রহণ করেন এবং ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি নাম ও চরিত্র নিয়ে কানপুরে একটি পার্টি শুরু করেন। এই পার্টি বেশ কিছু লোককে আকৃষ্ট করে এবং তারা পার্টির সদস্য হিসেবে নাম লেখান। এই দলের আদর্শ হিসেবে স্বাধীনতার দাবি ছিল সবার আগে। দলের নাম জনপ্রিয় করতে বেশ কিছু প্রচারণা তৈরি করা হয়। কিন্তু দেখা গেল, এত কিছুর পরও সেসব কাজে অন্তর্নিহিত মার্ক্সীয় কিছু ছিল না। উল্টো এমন কিছু কাজ করা হয়েছিল, যা এখানে উল্লেখ করা অপ্রয়োজনীয়, সেগুলো ভারতের মতো স্বল্প কমিউনিজম জানাশোনা দেশে কমিউনিজম দর্শনেরই দুর্নাম কুড়িয়েছিল। দুই বছর টিকে থাকার পর কানপুরে ভারতীয় কমিউনিস্টদের একটি সম্মেলন আহ্বান করা হয়। এটাকে প্রথম কমিউনিস্ট সম্মেলন হিসেবে ঘোষণা করা হয়। কয়েকজন কমরেড পার্টি দখলের সিদ্ধান্ত নেন, যাদের সংখ্যা ছিল প্রায় ২০০-২০৬। সঠিক সংখ্যা বলা যাচ্ছে না, কারণ জনাব সত্যভক্তের কাছে যে রেকর্ড ছিল তা তিনি আমাদের কাছে হস্তান্তর করেননি। এমনকি যে তহবিল তিনি সংগ্রহ করেছিলেন, তারও কোনো হিসাব বিবৃতি দেননি। যদিও আমরা সংগঠনটি দখল করতে সক্ষম হয়েছিলাম, কিন্তু পার্টি ছিল একটি শর্তাধীন অবস্থায়। পার্টির কোনো গঠনতন্ত্র যেমন ছিল না, তেমনি কোনো কর্মসূচিও ছিল না। বিভিন্ন মানুষকে সংগঠিত করতে নির্বাহী চারজন আঞ্চলিক সংগঠককে নিয়োগ দেয়, যার উদ্দেশ্য ছিল এই বিষয়ে তাদের মতামত লিপিবদ্ধ করা।’

২১ মে, ১৯২৭ সালের বোম্বে বৈঠক আয়োজন করতে, ক্রমান্বয়ে নেওয়া পদক্ষেপগুলো বর্ণনা করে বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে:

‘কানপুর থেকে আসার পরপরই কমরেড মুজাফ্ফর আহমদ কলকাতায় সব আঞ্চলিক সংগঠকদের নিয়ে একটি বৈঠক ডাকেন। কানপুরে নেওয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বোম্বেতে পার্টির সদর দপ্তর রাখা কঠিন হয়ে পড়ায় তা সরিয়ে দিল্লিতে নেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে এই বৈঠক আহ্বান করা হয়। একই সময়ে তখনকার হিন্দু-মুসলিম উত্তপ্ত সমস্যা নিয়ে একটি ইশতেহার জারি করা হয়। ইশতেহারে বলা হয়, একমাত্র অর্থনৈতিক কর্মসূচিভিত্তিক কোনো গণসংগঠনের পক্ষেই বিভিন্ন সম্প্রদায়কে একটি একক মঞ্চে একত্র করা সম্ভব। পরবর্তী সময় বার্মিজ ও কেন্দ্রীয় প্রাদেশিক সরকার ইশতেহারটি নিষিদ্ধ করে দেয়। প্রায় ৭০০ রুপি প্রতিশ্রুত ছিল, যার মধ্যে ৬০০ রুপি সংগ্রহ করা হয়েছিল।’

‘পরবর্তী সময় দিল্লিতে একটি নিয়মিত কার্যালয় চালু হয়, যার দায়িত্বে ছিলেন কমরেড বাগেরহট্টা। তার সঙ্গে পরে যুক্ত হন কমরেড ঘাটে। সেই সঙ্গে সংগঠনের কাজও শুরু হয়।

তখন নভেম্বরের শেষে দিল্লিতে একটি প্রচারণা সম্মেলন আয়োজনের সিদ্ধান্ত হয়। সাধারণ সম্পাদকেরা দেশব্যাপী একটি প্রচারণা ভ্রমণে বের হন, কিন্তু অভ্যর্থনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক কমরেড এইচ এ নাসিমের কার্যালয়ে আকস্মিক হামলার ফলে সম্মেলন অনুষ্ঠান করা সম্ভব হয়নি। বিদেশি সংগঠনসহ আমাদের অন্যান্য যোগাযোগ বৈধ বলে স্বরাষ্ট্র সদস্য আশ্বস্ত করলেও এটা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে আমাদের যোগাযোগে হস্তক্ষেপ করা হয়েছিল। এর ফলে নবীন দলটি বেশ শক্ত একটি ধাক্কা খায়, যা সারাতে আরও দুই-তিন মাস সময় লেগেছিল।’

‘এই সময়ের মধ্যে লাহোর দল ফেব্রুয়ারির শেষে একটি সাধারণ সম্মেলন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেয়। একটি অভ্যর্থনা কমিটিও গঠন করা হয়। যোগাযোগ কর্মকর্তা (আরও) কমরেড সাক্লাতভালাকে সম্মেলনে সভাপতিত্ব করার নিমন্ত্রণ জানান এবং লাহোরে থাকা কমরেড মুজাফ্ফর সাক্লাতভালা পৌঁছালে তার সঙ্গে সাক্ষাত্ করতে বোম্বেতে ছুটে যান। কমরেড সাক্লাতভালা নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন এই বলে যে আমরা তৃতীয় আন্তর্জাতিকের (থার্ড ইন্টারন্যাশনাল) সঙ্গে সম্পৃক্ত কোনো নিয়মিত কমিউনিস্ট পার্টি নই এবং তিনি যে সংগঠনের প্রতিনিধিত্ব করেন, সেখানে তার নিজের কাজ আছে। গণমাধ্যমে সেই চিঠির যে কপি তিনি প্রকাশ করেন, তা পার্টির প্রতি সহানুভূতিহীন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। শেষতক, সম্মেলন করার পরিকল্পনা বাদ দিতে হয়েছিল। কারণ পার্টির ক্রমবিকাশের এই পর্যায়ে বিতর্ক এড়িয়ে যাওয়াই কাম্য ছিল।

‘পরবর্তী সময় কমরেড সাক্লাতভালা আমাদের সবাইকে দিল্লিতে ডেকেছিলেন। তত দিনে তার দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটাই বদলে ছিলেন। দিল্লিতে সাক্লাতভালার সঙ্গে ব্যাপারটি নিয়ে আলোচনা করা হয়। তিনি ভারতে একটি কমিউনিস্ট পার্টি থাকার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আমাদের সঙ্গে একমত হন।

‘সঙ্গে সঙ্গেই আমরা দিল্লিতে বৈঠক করি এবং একটি গঠনতন্ত্র ও একজন নির্বাহী নির্বাচিত করতে ২৯ মে বোম্বেতে একটি সাধারণ বৈঠক করার সিদ্ধান্ত নিই।’

সিপিআইয়ের কার্যক্রম

বার্ষিক প্রতিবেদনে বিভিন্ন অঞ্চলে কাজের নিম্নোক্ত রেকর্ড পাওয়া যায়:

বাংলা: বিভিন্ন প্রদেশে শুরু হওয়া শ্রমিক ও কৃষক পার্টি গঠন ও বিকাশে পার্টির সদস্যরা সাহায্য করেছেন। বাংলায় আমাদের কমরেডদের কাজের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন। তারা এই প্রদেশে বিদ্যমান কৃষক ও শ্রমিক পার্টি পুনর্নির্মাণ করেছেন এবং এটাকে একটি শক্তিশালী সংগঠনে পরিণত করেছেন। নগণ্য অর্থায়ন ও কমরেড মুজাফ্ফরের ভগ্ন স্বাস্থ্য থাকা সত্ত্বেও ‘লাঙল’ যা করেছে তা এই প্রদেশে প্রলেতারিয়েত উদ্দেশ্য সাধনে অনেক অবদান রাখবে (গণবাণী [কৃষক-শ্রমিক পার্টির আনুষ্ঠানিক মুখপত্র]-এর সঙ্গে ‘লাঙল’-কে গুলিয়ে ফেলা যাবে না)।

লাহোর: কমরেড দরবেশী, মজিদ, রেমোহান্দার ও হাসান শিক্ষামূলক উদ্দেশ্যে একটি নিয়মিত সংগঠন শুরু করতে বারবার চেষ্টা করেছেন। তারা ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস কার্যক্রমে সফলতার সঙ্গে সুস্পষ্ট অংশগ্রহণ করেছেন এবং প্রায় আধা ডজন ইউনিয়ন সংগঠিত করেছেন। তারা জাতীয় কংগ্রেসেও ভালো কাজ দেখিয়েছেন এবং আরও ভালো ফলাফলের ব্যাপারে আমরা আশাবাদী। সম্প্রতি, উইকলি মেহনাতকাশ নামে তারা একটি উর্দু সাপ্তাহিক বের করছেন। এটা উর্দু জানা জেলাগুলোয় মানুষকে শিক্ষিত করার ক্ষেত্রে চমত্কার কাজ করছে।

বোম্বে: বর্তমান নেতৃত্বের বিরুদ্ধে এখানে একটি শক্তিশালী বামপন্থী সংগঠন প্রয়োজন ছিল। আমাদের কমরেডরা সফলভাবে ডব্লিউঅ্যান্ডপি (ওয়ার্কারস অ্যান্ড পিজ্যান্টস পার্টি) সংগঠন তৈরি করেছে, যা ইতিমধ্যে তাদের নিজস্ব মুখপত্র ক্রান্তি-এর মাধ্যমে শিল্প শ্রমিকদের মধ্যে কাজ শুরু করেছে। বেশ কিছু ট্রেড ইউনিয়নও গঠন করা হয়েছে। এসব ইউনিয়ন সম্প্রতি দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এআইটিইউসি (সর্ব-ভারতীয় ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসে)-এ প্রভাবশালী অবস্থান নিতে পেরেছে। অন্যান্য প্রদেশ থেকে ফিরে আসা কমরেডদের সহায়তায় তারা কমরেড থেংগি ও ঘাটেকে যথাক্রমে প্রশাসনিক ও সহকারী সচিব হিসেবে এবং কমরেড জগলেকারকে আলোচনা কমিটিতে নিযুক্ত করতে পেরেছে। কংগ্রেস সংগঠনেও বোম্বে দলটি সক্রিয়, কমরেড জগলেকার আবার যার যুগ্ম সচিব। এআইসিসিতে (সর্ব-ভারতীয় কংগ্রেস কমিটি) তারা সফলভাবে কমরেড নিম্বকার ও জগলেকারকে ফিরিয়ে এনেছেন, যারা গুয়াহাটিতে আমাদের কর্মসূচির জন্য এবং বোম্বেতে অনুষ্ঠিত এআইসিসির বৈঠকে যথেষ্ট সংগ্রাম করেছেন।

রাজপুতনা: রাজপুতনা প্রদেশে সাধারণ সম্পাদক কমরেড বাগেরহট্টা পণ্ডিত অর্জুনলাল শেঠির সাহায্যে প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটিতে কার্যকর সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে সক্ষম হয়েছেন। এই প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটি সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটির জন্য বরাদ্দকৃত ৭টি আসনের মধ্যে ২ জন সদস্য, ২ জন প্রজাতন্ত্রীকে ফিরিয়ে এনেছে। ট্রেড ইউনিয়ন কার্যক্রম শুরু করা যাচ্ছিল না, কারণ কমরেড বাগেরহট্টা আমাদের পার্টির সর্ব-ভারতীয় সংগঠনের জন্য তার সময় ও শক্তির বহুলাংশ ব্যয় করছিলেন। সম্প্রতি ডব্লিউঅ্যান্ডপি (ওয়ার্কারস অ্যান্ড পিজ্যান্টস) শুরু করা হয়েছে এবং শিল্প শ্রমিকদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

মাদ্রাজ: কমরেড সিঙ্গারাভেলু চমত্কার প্রচারণার কাজ করছেন এবং ট্রেড ইউনিয়ন ও ধর্মঘটসংক্রান্ত কাজে তার বেশির ভাগ সময় ব্যয় করছেন। শ্রমিক ও কিষান পার্টি ছাড়া সেখানে আর কোনো সংগঠন নেই। পৌরসভার সদস্য হিসেবে কমরেড সিঙ্গারাভেলু সেখানে প্রচারণার কাজ করছেন।

সংযুক্ত প্রদেশ ও অন্যান্য প্রদেশ: অন্যান্য প্রদেশে কাজ সংঘটিত করতে প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে, কিন্তু পর্যাপ্ত আর্থিক সম্পদের অভাবে আমরা কার্যকরী বাম দল সংগঠিত করতে পারিনি, যদিও নির্দিষ্ট প্রদেশে কিছু কমিউনিস্ট আগ্রহ প্রকাশ করেছে। সংযুক্ত প্রদেশে বিশেষ করে কমরেড আসাদ সোবহানি শ্রমিক কার্যক্রমের একটি অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন। আমরা আশা করি তরুণেরা সামনে এগিয়ে আসবেন এবং দায়িত্ব গ্রহণ করবেন।

দেশে পার্টির সাধারণ অবস্থান সম্পর্কে বার্ষিক প্রতিবেদনে নিম্নোক্ত অনুচ্ছেদটি ছিল:

‘পার্টি গঠনের সময় আমরা যেমন সমর্থন আশা করছিলাম, তা পেতে সক্ষম হইনি। ছাত্র ও তরুণ বুদ্ধিজীবী, যারা আমাদের পার্টির জন্য কিছু সচেতন শ্রমিক দিতে পারত, তাদের মধ্যে প্রচারণা চালাতে এবং এই পর্যায়ে পার্টির কর্মসূচি বাড়ানোর জন্য সব শ্রমিক ও কৃষক সংগঠনের কাছে পৌঁছাতে আমাদের মূল সমস্যা ছিল অর্থের অভাব। আমাদের কমরেডরা যেন বিভিন্ন প্রদেশের অবস্থা মূল্যায়নের জন্য সব গুরুত্বপূর্ণ শিল্পকেন্দ্রে যেতে পারে এবং প্রলেতারিয়েতদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারে, সে জন্য অন্তত অল্প পরিমাণে হলেও তহবিল সংগ্রহে শক্তি ব্যয় করা অপরিহার্য। এটা করতে পারলে আমরা পার্টির কর্মসূচি বাড়াতে পারব এবং আমাদের নিজেদের পার্টি সম্পর্কে জনগণকে একটি সঠিক ধারণা দিতে পারব। পার্টির একটি কেন্দ্রীয় মুখপত্র চালু করার জন্য চেষ্টা করা হয়েছে। আমাদের কমরেডদের কাছ থেকে সামান্য সাহায্য পাওয়া সত্ত্বেও একটি পার্টি মুখপত্র চালু করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। কারণ নিজস্ব ছাপাখানা ছাড়া এটা সম্ভব নয়, যেহেতু যখন প্রয়োজন হতো, তখন কোনো ছাপাখানাই দুর্ভোগ পোহাতে চাইত না।’

সিপিআই সম্পর্কে ব্রিটিশ সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে নিম্নোক্ত অনুচ্ছেদটি দিয়ে বার্ষিক প্রতিবেদন শেষ করা হয়েছে:

‘যদিও শাসকেরা কোনোভাবেই আমাদের সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষে জড়ায়নি এবং এখনো পর্যন্ত আমাদের সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে কিছুই বলা যাচ্ছে না, তবুও আমাদের যোগাযোগ বাধাগ্রস্ত করা এবং আমাদের কলকাতা ইশতেহার ও গ্রেট ব্রিটেন কমিউনিস্ট পার্টির অন্যান্য প্রকাশনা এবং সম্প্রতি অন্য সব কমিউনিস্ট পার্টি ইত্যাদিসহ তৃতীয় আন্তর্জাতিক ও অন্যান্য নিষিদ্ধ করার মধ্য দিয়ে এটা প্রমাণিত হয় যে, সরকার আমাদের প্রচারণা কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করতে চায়। গত বছর সরকার আমাদের যোগাযোগকে বৈধ বলে স্বীকৃতি দেয়, কিন্তু বাস্তবে সেটা তারা স্বীকার করেনি। কারণ আমরা ভয় পাচ্ছি যে আমাদের উদ্দেশে পাঠানো অনেক চিঠি কখনোই আমাদের কাছে এসে পৌঁছায়নি। উত্তর-পূর্ব সীমান্ত প্রদেশে আমাদের কমরেডদের অনেক ঝামেলার মধ্যে ফেলা হয়েছে। তিন বছরের সাজা থেকে ছাড়া পাওয়ার পরপরই কমরেড শাফিগুয়ার মৃত্যুর কথা অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে। কমরেড জি আর দরবেশী রাষ্ট্রীয় নজরদারির আওতায় রয়েছেন। তিনি যত জায়গায় যান, তাকে জানাতে হয়। সীমান্ত সরকার এ ধরনের স্বেচ্ছাচারপূর্ণতার কোনো কারণ দেখায়নি। কমরেড উসমানি এখনো জেলে আছেন এবং তিনি যক্ষ্মা ও রক্তশূন্যতায় ভোগা সত্ত্বেও তাকে সঠিক চিকিত্সা দেওয়া হচ্ছে না।’

অনুবাদ: খলিলউল্লাহ্