তলস্তয়ের দেশে বলশেভিক বিপ্লব

এক

যশোরের কালীগঞ্জ বাজার থেকে কোটচাঁদপুর যাওয়ার প্রধান সড়ক। সড়কের দুধার ঘেঁষে রয়েছে সারি সারি বৃক্ষ। সারা বছর তারই ছায়ায় আধো আলো আধো অন্ধকার পরিবেশ বিরাজ করে। প্রচণ্ড রোদে পথচারীদের স্বস্তি দেয় এই বনাশ্রিত পরিসরটুকু। সাত কিলোমিটার যাওয়ার পর ডান হাতে পড়বে এলাঙ্গি নামের একটি গ্রাম। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় আমি এখানে আশ্রয় নিয়েছিলাম। বয়সে তখন তরুণ। সে কারণে সমস্যা ছিল দুদিক থেকে। মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করার ইচ্ছা অনেকবার ব্যক্ত করেছি। কিন্তু বাবার বাধায় সেটি হয়ে ওঠেনি। অন্যদিকে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রোশে পড়ারও শঙ্কা ছিল। বাবা-মা চেয়েছিলেন সেই শঙ্কাবোধ থেকে আমাকে মুক্ত রাখতে। মনে আছে, তখনো ঘোর অন্ধকার। সূর্য ওঠার অনেক বাকি। মা একটি ব্যাগে কিছু খাবার এবং কাপড়চোপড় সযত্নে গুছিয়ে দিয়ে আমাকে বললেন, ‘যুদ্ধের কারণে তোকে এলাঙ্গি যেতে হবে। যুদ্ধ চলছে। সেখানেই থাকবে।’ জায়গাটিকে নিরাপদ ভেবে সিদ্ধান্তটি নিয়েছিলেন বাবা। যুদ্ধের কারণে আমাদের পরিবার তখন গ্রামে আশ্রয় নিয়েছে। বাস-ট্রেনে করে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। আমি এবং আমার বাবা রওনা হলাম হেঁটে। ২৫ কিলোমিটার পথ। তখনো চারদিক ঘোর অন্ধকার। হেঁটে চলেছি গ্রামের ধূলিময় রাস্তা দিয়ে। মাঝেমধ্যে উন্মুক্ত মাঠ, জলে ভরা খাল-বিল। কৃষকের বাড়ির উঠানের ওপর দিয়ে এগিয়ে চলেছে আমার ক্লান্ত দুখানি পা। রাস্তার পাশে পোড়াবাড়ির ধ্বংসাবশেষ। জিজ্ঞাসা করি ‘কারা পোড়াল?’ উত্তর এল, ‘পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গতকাল এসেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজে।’ অতি সন্তর্পণে পাকিস্তানি সেনাদের দৃষ্টি এড়িয়ে কোথাও সোজা পথ, কোথাও আঁকাবাঁকা পথ ধরে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে অবশেষে পৌঁছালাম এলাঙ্গি গ্রামে। এই গ্রাম বাবার মায়ের জন্মস্থান।

বাবার বয়স যখন দশ তখন আমার দাদি এবং দাদা দুজনেই মারা গিয়েছিলেন। দাদির মৃত্যুটি ছিল আকস্মিক। ব্যাসিলারি আমাশয় নামের এক রোগে তিনি গত হয়েছিলেন দুই দিনের ব্যবধানে। সে সময় ওই রোগের কোনো ঔষধি প্রতিকার ছিল না। ফলে মারা গিয়েছিলেন যাকে বলে বিনা চিকিত্সায়। এ নিয়ে বাবার মনে দুঃখের সীমা ছিল না। মাঝেমধ্যে আমাদের সঙ্গে যখন তিনি মায়ের গল্প বলতেন তখন দেখতাম তাঁর চোখ দুটো ছলছল করছে। বাবার নানিমাকে আমি দেখেছি অনেকবার। তিনি দীর্ঘায়ু পেয়েছিলেন। একেবারে একচিলতে শরীর। বয়স নব্বই-পঁচানব্বই হবে। মুখের মাংস ঝুলে পড়ছে। চোখের দৃষ্টি নিথর। ধবধবে সাদা শাড়ি পরে পরিসর সীমিত একটি ঘরে তাঁর আশ্রয়। সারা দিন কাটিয়ে দিতেন বিছানার ওপর বসে। দুই পা একসঙ্গে করে হাত দুটো দুই হাঁটুর ওপর রেখে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতেন। মাঝেমধ্যে মন্ত্র পড়ার মতো বিড়বিড় করতেন। নিজের সঙ্গেই যেন কথা বলছেন। কখনো মনে হতো যেন কোনো গভীর ধ্যানে মগ্ন। সেই মগ্নতা ভেঙে যেত ক্ষণিকে যখন কারও পায়ের শব্দ পেতেন। মাঝেমধ্যে দেখেছি শুয়ে আছেন। শোয়া বলে না। মায়ের গর্ভে শিশু যেভাবে মাথা এবং পা এক বিন্দুতে এনে শরীরটাকে ধনুকের মতো বেঁকিয়ে রাখে, ঠিক সেই রকম। ভাবি জন্ম আর মৃত্যুর মধ্যে কতই বা পার্থক্য! সন্দেহ বোধ করি প্রৌঢ়ত্ব আর শিশুকালের মধ্যে ব্যবধান বলে কিছু আছে কি না। মাঝেমধ্যে তাঁর পাশে গিয়ে আমি বসেছি। বসে থেকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো উপভোগ করেছি তাঁর সান্নিধ্য। আমার সারা গায়ে হাত বুলিয়ে দিতেন কী আদর করে! ভেবেছি আমার দাদি মেহেরুন্নেছাকে আমি দেখিনি বটে। কিন্তু যিনি তাঁর গর্ভধারিণী তাঁর পাশেই তো বসে আছি আমি। যেন অনুভব করছি মেহেরুন্নেছার স্পর্শ। কেমন ছিলেন তিনি জানি না। তাঁর কোনো ছবিও নেই আমাদের পারিবারিক সংগ্রহে। কিন্তু বাবা বলতেন তাঁর গায়ের রং ছিল এমনই ফরসা যে নীল রঙের শিরা-উপশিরাগুলো দেখা যেত সুস্পষ্টভাবে। বংশ মানসম্মান রক্তের যে ধারা এই বৃদ্ধার দেহে প্রবাহিত তার সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততার কথা ভেবে মন এক আবেগের স্রোতে ভেসে যেত। ভাবলেশহীনভাবে তাঁর পাশে বসে আমি কাটাতাম দীর্ঘ মুহূর্ত।

এই নারীর স্নেহেই বড় হয়েছিলেন আমার বাবা। কিন্তু তারপরও কঠোর অনাথ জীবন তাঁর মনের সব উষ্ণতা এবং জীবনের স্বাভাবিক প্রবণতাগুলো ধ্বংস করে দিয়েছিল অনেকটা অলক্ষ্যে। সেই নির্দয় মনোজগত্ তাঁর ব্যবহারিক জীবনে প্রতিফলিত হতে দেখেছি। আলাপ ব্যবহারে দেখেছি রুক্ষতার ছাপ। রাগী ছিলেন প্রবলভাবে। ছেলেমেয়েদের রাখতেন কঠোর শাসনের বাঁধনে। জীবনে অতিমাত্রিক উচ্ছলতা কখনো পছন্দ করতেন না। মায়ের প্রতি ছিল গভীর ভালোবাসা। সেটি জেনেছি তাঁর লেখা ডায়েরির পাতায়। কিন্তু ভালোবাসার সেই অনুভূতি প্রায়ই ভোঁতা হয়ে তার জায়গায় স্থান করে নিত নির্মম কঠোরতা। যদি সততার কথা বলি তাহলে সেখানে তিনি ছিলেন অতুলনীয়। কোটচাঁদপুর হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় পাস করে তিনি পড়তে গিয়েছিলেন কলকাতার রিপন কলেজে। এই এলাঙ্গি গ্রামে ছোটবেলায় আমি এসেছি বহুবার। মানুষের মুখে শুনেছি বাবার ছোটবেলার নানা কাহিনি। স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে যে কটি মাস এখানে কাটিয়েছি, সে সময়কে আমি আমার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় বলে মনে করি। আজও মনে পড়ে বাবার মামাতো ভাইয়ের স্নেহ ও আদর। এ যেন আত্মার টান। সেই টান আমাকে বহুবার বহু কারণে নিয়ে এসেছে এলাঙ্গি গ্রামের অতি কাছের কিছু মানুষের সান্নিধ্যে। মুক্তিযুদ্ধের তীব্রতা এখানেও কমবেশি উপলব্ধি করেছি। লক্ষ করেছি গ্রামের আশপাশে মুক্তিযোদ্ধারা কীভাবে সক্রিয় আছে। তাদের সাহায্য করতে সচেষ্ট হয়েছি। একবার এখানে আশ্রয় নেওয়া এক বড় ভাইয়ের সঙ্গে (তাঁর নাম দুলাল) গিয়েছিলাম ট্রেনলাইন উপড়ে ফেলতে। হাতে লোহার রড। সঙ্গে একটি রেঞ্জ। সেই রেঞ্জ দিয়ে খুলতে চেষ্টা করেছিলাম ট্রেনলাইনের নাটবল্টু। পারিনি। ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছি। সময়টি আমার জন্য ছিল আশা-নিরাশার মধ্যে বাস করা। রাতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের খবর শুনে ভরসায় বুক বেঁধেছি। আবার সব আশা-ভরসা ভেসে গেছে মুক্তিযুদ্ধের কোনো দুঃসংবাদ, ব্যর্থতা অথবা বিশেষ কোনো মৃত্যুসংবাদে। দাদার বাড়ির পাশের রাস্তা দিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের টহল ছিল প্রায় প্রতিনিয়ত। সামরিক গাড়ির কনভয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ধীরগতিতে এগিয়ে যেত কোটচাঁদপুরের দিকে। আবার ফিরে যেত যশোর ক্যান্টনমেন্টে। বাড়ির জানালা দিয়ে আড়চোখে তাদের চেহারা দেখেছি। জিপ গাড়ি থামিয়ে মাঝেমধ্যে তারা রাস্তার দুপাশে হেঁটে চলা মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করত। দু-একজনকে তুলে নিত জিপে। উত্তেজনা ভীতি আশঙ্কা—সব মিলিয়ে কেটে গেছে ওই কয়েক মাস। একদিন দেখি বাবার সর্বকনিষ্ঠ মামাতো ভাই উধাও। কেউ জানে না কোথায় হাওয়া হয়ে গেলেন তিনি। পরে জানা গেল পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে ধরে নিয়ে গেছে তাদের ক্যাম্পে। এলাঙ্গি গ্রামে এ ধরনের ঘটনা তেমন ঘটতে শুনিনি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ যতই সমাপ্তির দিকে এগিয়ে গেছে, পাকিস্তানি সেনারা ততই হয়ে উঠেছে মরিয়া।

১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর। দিনটির কথা ঠিক মনে আছে। দুপুরে হঠাত্ রটে গেল পাকিস্তানি সেনারা কালীগঞ্জ বাজার থেকে অগ্রসর হচ্ছে কোটচাঁদপুরের দিকে। আমরা পালাচ্ছি। মাঠ অতিক্রম করে যাচ্ছি পাশের গ্রাম গুড়পাড়ায়। মাঠ পার হতে গিয়ে পড়লাম বিপদে। পাকিস্তানি মর্টার আক্রমণ চলছে মাঝেমধ্যে। মনে হচ্ছে মাথার ওপর দিয়ে উড়ছে মর্টার। তার বিকট শব্দ আকাশ-বাতাসকে প্রকম্পিত করছে। মাটিতে শুয়ে জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করলাম। ওপরে নীল আকাশ। চারদিকে শীতের শস্যহীন খালি মাঠ। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে পুনরায় প্রাণ নিয়ে পালানোর চেষ্টা। আমার সঙ্গে ছিল আমার দুই বোন এবং বাবা। রাত কাটল প্রায় না ঘুমিয়ে। প্রচণ্ড গোলাগুলি চলল রাতভর। ঘুম আসে না। উঠানে সবাই জড়ো হয়ে বসে আছি। বাবা ভয়ে সন্ত্রস্ত। কী হবে দুই যুবতী মেয়েকে নিয়ে। যদি পাকিস্তানি সেনারা এই গ্রাম আক্রমণ করে? কী হবে আমার মতো যুবককে নিয়ে। জীবন-মরণের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে ভাবি নানা কথা। ভোরের দিকে গোলাগুলি থেমে এল। সকালে উঠে দাদার বাড়ির দিকে এগোচ্ছি। পুকুরের ধারে পৌঁছে দেখি এক ভারতীয় শিখ সেনার মৃতদেহ গোলার আঘাতে চূর্ণ-বিচূর্ণ হওয়া নারকেলগাছের একেবারে গোড়ায় শায়িত অবস্থায় আছে। দেহে প্রাণ নেই। বুকের জায়গাটিতে চাপ চাপ রক্ত। পা নেই। হাতে তখনো বন্দুকটি ধরা। ভাবি কোথায় কোন সুদূর পাঞ্জাব থেকে আসা এই তরুণ সেনা। দেহটি পড়ে আছে এই গ্রামের মাটিতে। বাবা-মা, পরিবার-পরিজন আত্মীয়স্বজন জানল না বাংলার প্রত্যন্ত এই গ্রামে চিরশায়িত আছে তাদের সন্তান, ভাই, স্বামী বা আর কেউ। বাংলার মাটিকে মুক্ত করতে গিয়ে জীবন দিল অকৃপণভাবে।

দাদার বাড়ির প্রায় কাছাকাছি এসে পৌঁছেছি। দেখি পিচঢালা রাস্তার ওপর লাশের ছড়াছড়ি। নানা ধরনের অস্ত্রশস্ত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে চারদিকে। পাকিস্তানি সেনাদের নিথর দেহ। মাঝেমধ্যে ভারতীয় সেনার মৃতদেহ পড়ে আছে রক্তাক্ত অবস্থায়। কালভার্টের নিচে অথবা পাশে বিলের পানিতে। হঠাত্ দেখি আহত এক পাকিস্তানি সেনা মাথা নিচু করে বসে আছে। চোখে-মুখে আতঙ্ক। মুক্তিযোদ্ধারা তাকে আটক করেছে গত রাতে। আশপাশে পাকিস্তান বাহিনীর কোনো চিহ্ন নেই। বুঝি দলছুট হয়ে অবধারিত মৃত্যুর মুখে সে এখন দাঁড়িয়ে। সবার কাছে প্রাণভিক্ষা চাইছে। দৃশ্যটি কেন জানি আমার দুর্বিষহ মনে হলো। স্থান ত্যাগ করে আমি চলে এলাম বাড়িতে। জানি না কী হয়েছিল পরে। তবে দুপুর গড়াতেই দেখি শত শত ভারতীয় সেনা কোটচাঁদপুরের দিক থেকে এলাঙ্গি গ্রামে এসে হাজির। বুঝতে বাকি নেই তারা এসেছে ভারতের ধর্মপুর এবং পুটিখালি সীমান্ত অতিক্রম করে জীবননগর বৈদ্যনাথপুর হয়ে কোটচাঁদপুর এবং এলাঙ্গি গ্রামে। এসেই তারা দখল করে নিল স্কুলের মাঠটি। দাদার দোতলা বাড়ি হঠাত্ পরিণত হলো ভারতীয় বাহিনীর কমান্ড পোস্টে। দুপুর গড়াতেই দেখি ভারতীয় বিমানবাহিনীর জেট বিকট গর্জন করে ছুটে চলেছে কালীগঞ্জের দিকে। দুই মিনিট পর প্রচণ্ড বিস্ফোরণ। বুঝতে বাকি রইল না বোমাটি পড়েছে কালীগঞ্জ সুগার মিলের ওপরে অথবা কাছাকাছি কোথাও। জানতাম সেখানে রয়েছে পাকিস্তানি সেনাদের গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘাঁটি। কুণ্ডলী পাকিয়ে কমলা রঙের ধোঁয়া উড়ছে আকাশে। স্বাধীনতার যে বেশি বাকি নেই, সেটি বুঝতে দেরি হলো না।

আমার মায়ের মামাতো ভাই আবদুর রাজ্জাক যুদ্ধ চলাকালে একটি বই আমাকে পড়তে দিয়েছিলেন। চাচা পেশায় ছিলেন উকিল। কিন্তু ওকালতির চেয়ে তাঁর মন ছিল রাজনীতিতে। বিশ্ব ইতিহাসের ওপর তাঁর ছিল প্রচণ্ড দখল। এমনিতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে প্রথম শ্রেণি নিয়ে বের হননি। আর বিশেষ জ্ঞান ছিল গাছপালার ওপর। প্রায় সব গাছের লাতিন নাম তিনি জানতেন। তাঁর সঙ্গে রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে প্রায় বিব্রত বোধ করেছি। ‘বল তো এই গাছের নাম কী?’ দুই আঙুলের ফাঁকে সিগারেট চেপে বুকের ধোঁয়ার সবটুকু নাকের দুই বহির্গমন দিয়ে বের করতেন। মনে হতো যেন বাষ্পচালিত ট্রেনের ইঞ্জিন থেকে বেরোচ্ছে সেই ধোঁয়া। চাচার বড় ভাই ছিলেন একজন পণ্ডিত ব্যক্তি। তিনি বেশ কয়েকটি ভাষাও জানতেন। শুনেছি কিছুকাল প্রখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলীকে কাবুলে থাকাকালীন ফারসি ভাষা শিখিয়েছিলেন। বিলেতে যাওয়ার পথে থেমেছিলেন আফগানিস্তানে। ইরানেও কাটিয়েছিলেন কয়েক মাস। সেখানে রেজা শাহ পাহলভি পরিবারের কাউকে ইংরেজি শিখিয়েছিলেন বলেও শুনেছি। আমার বাবার সঙ্গে আড্ডায় চাচা সোভিয়েত ইউনিয়নের গল্প করতেন। গল্প বলতেন নানা ঢঙে। বলতেন, ‘এই না হলে দেশ! সুখী সমাজ হতে গেলে আমাদের দেশকেও গড়তে হবে ওইভাবে।’ বর্ণনা দেওয়ার ব্যাপারে তাঁর ছিল অতুলনীয় প্রতিভা। বাম রাজনীতি করতে গিয়ে একবার তিনি যশোর থেকে কলকাতা গিয়েছিলেন পায়ে হেঁটে। সে ব্রিটিশ আমলের কথা। শুনেছি তাঁকে বহুবার রাত কাটাতে হয়েছে প্রত্যন্ত গ্রামের কোনো মসজিদ বা কৃষকের গৃহে। তখন পাকিস্তান আমল। কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ। চাচাও আত্মগোপনে। বাম রাজনীতির সে এক দুর্যোগময় সময়। চাচা নিজের কথা ভুলে মানুষের উপকার করতে চাইতেন। নড়াইলের তেভাগা আন্দোলনের প্রখ্যাত কৃষকনেতার মৃত্যুর পর চাচা তাঁর কন্যাকে বিয়ে করেছিলেন স্বেচ্ছায়। নানা সংকট থেকে পরিবারটিকে মুক্ত রাখাই ছিল প্রধান উদ্দেশ্য। তারপর থেকে নড়াইলে বাড়ি করে সেখানেই তিনি বসবাস শুরু করেন, যদিও তাঁর ওকালতি ছিল যশোর শহরে। চাচার মুখে শুনেছি আরও অনেক গল্প। আত্মগোপনকালে প্রখ্যাত লেখক এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা সত্যেন সেনের সঙ্গে সখ্য ছিল। একটি গল্প তিনি একবার আমাকে শুনিয়েছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি সত্যেনদাকে একটি চিঠি দিয়েছিলেন গোপনে পার্টির নেতৃস্থানীয় একজনের কাছে পৌঁছে দিতে। খামটি তিনি রেখেছিলেন বগলদাবা করে। সেটি নাকি হারিয়ে গিয়েছিল পথে। যে বইটি তিনি আমাকে পড়তে দিয়েছিলেন তার রং মেটে। সাইজে বেশ মোটা। নিউজপ্রিন্টে ছাপা। ওপরে লেখা ‘প্রশ্নোত্তরে সোভিয়েত ইউনিয়ন’। স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে বইটির পাতা উল্টেছি বহুবার। দাদার বাড়ির দোতলার ছাদে বসে। যুদ্ধ চলাকালে শুনেছিলাম সপ্তম নৌবহরের কথা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিসিঞ্জারের কুটিল রাজনীতি আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনকে প্রায় থামিয়ে দিয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন আমাদের পাশে এসে দাঁড়ানোয় তা আর সম্ভব হয়নি। ফলে সহানুভূতির এক বিস্তীর্ণ ভুবন ওই দেশকে ঘিরে আমার মনোজগতে স্থান করে নিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে সেটি আরও শিলায়িত হয়েছিল ওই বইটি পড়ে। নানা ধরনের প্রশ্ন ও উত্তর ছিল বইটির প্রতিটি পাতায়। অক্টোবর বিপ্লবের কথা, লেনিনের কথা, প্রতিবিপ্লবীদের কথা, সোভিয়েত রাষ্ট্র গঠনের কথা, সাধারণ মানুষের সংগ্রামের কথা, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কথা। আমার জ্যেষ্ঠ বোনকে প্রায়ই বলতাম, ‘দেখিস, একদিন আমিও যাব ওই দেশে। দেখে আসব দেশটি কেমন।’

আগের কিছু স্মৃতি মনে পড়ে। তখন ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজে পড়ি। শিগগির উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা। কলেজের লাইব্রেরিতে হঠাত্ চোখে পড়ল বিশ্বখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের একটি লেখা। লেখাটি সমাজতন্ত্রের ওপর। নাম ‘কেন সমাজতন্ত্র?’ লেখাটি প্রথম ছাপা হয়েছিল ১৯৪৯ সালের মে মাসে। সেখানে তিনি সমাজতান্ত্রিক সমাজকে সবচেয়ে উত্কৃষ্ট সমাজ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। তথ্যপ্রমাণ দিয়ে দেখিয়েছিলেন কী কারণে সমাজতন্ত্রই সেই আদর্শ যে আদর্শ দিয়ে গড়া সম্ভব প্রকৃত মানবসমাজ। লেখাটি পড়ে মনে হয়েছিল এ তো কেবল মহাজ্ঞানধারী কোনো পদার্থবিজ্ঞানী নন। এ তো একাধারে বিশাল মাপের এক সমাজবিজ্ঞানীর লেখা। সেই প্রবন্ধে তিনি বলেছিলেন কেন সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি চালু করতে হবে। দেখিয়েছিলেন পুঁজিবাদী অর্থনীতি কীভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। ব্যক্তিমালিকানা কীভাবে ব্যক্তি এবং সমাজের সম্পর্ককে বিকৃত করে দেয়, যেখানে সাধারণ মানুষের পাওয়ার কিছুই থাকে না। থাকে না জীবনের কোনো নিশ্চয়তা বা ভরসা। যে ধরনের রীতিনীতি ওই সমাজ গড়ে তোলে আইনস্টাইন তাকে সমাজজীবনের জন্য নেতিবাচক ভেবেছিলেন। সেই নীতি তাঁর ধারণায় সাধারণ মানুষের জীবনকে নিঃশেষিত করে দেয়। ধ্বংস করে দেয় জীবনস্পৃহাকে। পঙ্গু করে দেয় স্বাদ-আহ্লাদকে। আইনস্টাইন স্বপ্ন দেখেছিলেন এমন এক সামাজিক সম্পর্কের যে সম্পর্ক পুঁজিবাদী অর্থনীতির লোভ-লালসাগত উদ্বেগ থেকে বিরত থাকে। মানুষের মনকে পঙ্গু করে দেয় না। আরও ভেবেছিলেন এমন এক শিক্ষাব্যবস্থার কথা, যা প্রাধান্য দেবে সামাজিক মঙ্গল-ভাবনাকে। মুনাফা বা ভোগদখলের মানসিকতা সৃষ্টি তার কাজ নয়। সেই সময় থেকে কেটে গেছে বহুকাল। আইনস্টাইনের প্রতিটি কথা আমার মনকে সেদিন ভরিয়ে দিয়েছিল। আপেক্ষিক তত্ত্বের স্রষ্টা আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল সমাজতান্ত্রিক আদর্শে।

তবে একই সঙ্গে আইনস্টাইনের লেখায় লক্ষ করেছিলাম একটি সতর্কবাণী। সে দিকটি আমি কখনো ভুলিনি। আমার মনে হয়েছিল সেটিই ছিল তাঁর লেখার সবচেয়ে মূল্যবান দিক। তিনি সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে পরিকল্পিত সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি ভালো। কিন্তু সেই ব্যবস্থাই আবার ব্যক্তিকে শৃঙ্খলিত করতে পারে, যদি আমলাতন্ত্র বা পার্টি সর্বশক্তিমান হয়ে ওঠে। তাঁর উপদেশ ছিল যেভাবেই হোক আমলাতান্ত্রিক একনায়কত্বকে রুখতে হবে। যেন মাথাচাড়া দিয়ে সে উঠতে না পারে। নিশ্চিত করতে হবে ব্যক্তির অধিকার এবং স্বাধীনতাকে। অন্যথায় সমাজতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণের সব চেষ্টা হবে ব্যর্থ। কীভাবে আমলাতান্ত্রিক একনায়কত্বকে রোখা যাবে তার একটি ধারণা তিনি দিয়েছিলেন। বলেছিলেন সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে গড়ে তুলতে হবে গণতান্ত্রিক ফ্রেমওয়ার্ক এবং পরিবেশ। সেই ফ্রেমওয়ার্কের প্রকৃত রূপ কী সেটি ওই লেখায় স্থান পায়নি। কিন্তু নিঃসন্দেহে ওই দায়িত্ব তিনি হস্তান্তর করেছিলেন ভবিষ্যত্ প্রজন্মের কাছে। জানি আইনস্টাইনের ওই ভাবনাটি গড়ে উঠেছিল দুই আদর্শের প্রভাবে। জার্মানিতে বসবাসকালে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক সমাজকে তিনি প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। আকৃষ্ট হয়েছিলেন তাঁর অর্থনীতির প্রতি। আবার হিটলারের ফ্যাসিবাদী শাসন যে গভীর সংকটের সৃষ্টি করেছিল, তা থেকে পালিয়ে তিনি এসেছিলেন আমেরিকায়। সেখানে পরিচিত হয়েছিলেন গণতন্ত্রের সঙ্গে। দেখেছিলেন ব্যক্তিস্বাধীনতার মূর্ত বহিঃপ্রকাশ। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের এক শ বছর পর আজ তাঁর কথাগুলো বারবার মনে পড়ে। মনে পড়ে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতনের কারণ খুঁজতে গিয়ে। রাজনীতিবিদদের কোনো প্রজন্ম কি আইনস্টাইনের ওই সতর্কবাণীর প্রতি মনোযোগ দিয়েছিল? ‘না’ বলেই ধারণা করি। সমাজতন্ত্রীরা আইনস্টাইন পড়েননি। পড়লেও উপেক্ষা করেছেন তাঁর সবচেয়ে মূল্যবান কথাটি। ঊনবিংশ শতাব্দীর অত্যন্ত শক্তিশালী এবং সৃজনশীল সাহিত্য এবং দার্শনিক ঐতিহ্যকেও তারা ভালো করে অনুধ্যান করেছিল কি না সন্দেহ করি। সে সাহিত্য হোক না ফরাসি, জার্মান অথবা রুশ। প্রতিটি সাহিত্যভান্ডারই শৈল্পিক মাধ্যম ব্যবহার করে মানুষের মনোজগতের স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দিয়েছে। যে ব্যক্তিস্বাধীনতা পুঁজিবাদী সমাজে অবদমিত হয় সাহিত্যিক ও দার্শনিক সমাজ তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে। কিন্তু কেউ কি ভেবেছিল সেই স্বাধীনতাই আবার সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার অধীনে নিষ্পেষিত হবে? সমাজতন্ত্র কি দাবি করেনি একমাত্র ওই আদর্শই মানুষের সার্বিক বিকাশকে নিশ্চিত করবে। প্রস্ফুটিত করবে মানুষের সব সম্ভাবনাকে। কোনো বৃত্তায়নের মধ্যে আবদ্ধ না রেখে তার সুপ্ত প্রতিভাকে মূর্ত করে তুলবে? ‘ডক্টর জিভাগো’ বা আরও অন্যান্য লেখা পড়ে কিন্তু বারবার মনে বেজেছে সমাজতন্ত্রের ব্যর্থতার দিকটি। শ্রমিক কৃষকের সঙ্গে বুদ্ধিজীবীর চিন্তার সংযোগ ঘটেনি। না হলে কীভাবে তারই অভ্যন্তরে গড়ে উঠল পুঁজিবাদের হিংস্র এবং কর্তৃত্ববাদের নব্য সংস্করণ। এই ব্যর্থতাই কি সমাজতন্ত্রকে পরিণত করেছিল যান্ত্রিক এক ব্যবস্থায়, যা কিনা ধ্বংস করল তার অভ্যন্তরীণ সৃজনশীলতাকে? মাঝেমধ্যে মনে হয় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব যেন কেমোথেরাপি দিয়ে ক্যানসারের চিকিত্সা করা। যে থেরাপি ধ্বংস করে শরীরের সুস্থ এবং পীড়িত—উভয় সেলকে। ফলে ভাবি সমাজতন্ত্রের মধ্যেই কি রয়ে গেছে একনায়কত্বের বীজ? তাহলে ব্যক্তিবিশেষকে, যেমন জোসেফ স্তালিন বা আরও কাউকে, দোষারোপ করে কী লাভ!

যা-ই হোক, আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধ শেষ হলো। নতুন রাষ্ট্র। ফিরে এলাম বুয়েটে। শেরেবাংলা হলের দক্ষিণ প্রান্তের ৪০৫ নম্বর রুম। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ায় মন নেই। চারদিকে আশান্বিত যুবসমাজ ঘিরে রেখেছে আমাকে। চলছে মিটিং-মিছিল। নানা জাতীয় উদ্দীপনার ঢেউ আঘাত করছে চারদিক থেকে। রাত করে আড্ডা। গভীর রাতে দল বেঁধে মোরগ-পোলাও খাওয়ার মধ্যে কী আনন্দ পেয়েছি জানি না। বুয়েটে চলছে ছাত্র ইউনিয়নের নানা সম্মেলন। পোস্টার লেখা মিছিল। এ এক গভীর আনন্দ। নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়নের একচ্ছত্র আধিপত্য। সে এক অন্য আমেজের মধ্যে বাস করা। এরই মধ্যে ঘটে গেল এক অঘটন। হঠাত্ একদিন কী এক সামান্য কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রফেসর অপমানিত হলেন ছাত্রলীগের এক মাস্তানের হাতে। মাস্তানটি নাকি পিস্তল উঁচিয়ে প্রফেসরকে শাসিয়েছিল। প্রতিবাদে বুয়েটব্যাপী ছড়িয়ে পড়ল চাপা বিক্ষোভ। মনে আছে বিশাল মিছিল করে আমরা গিয়েছিলাম বঙ্গভবনে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করতে। এর প্রতিকার পেতে। মুজিব বেরিয়ে এলেন। ধৈর্য ধরতে বললেন। বললেন কী জটিল সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশ। চারদিকে অস্ত্রের ছড়াছড়ি। উদ্ধার করব কী করে? অস্ট্রেলিয়ার এবিসি রেডিওর সাংবাদিক আমার দিকে এগিয়ে এল। আমাকে ওই বিক্ষোভ সম্পর্কে কিছু বলতে বলল। সেদিন কী বলেছিলাম তা ঠিক ঠিক মনে আছে। বলেছিলাম এই সরকার মুখে সমাজতন্ত্রের কথা বলছে। সোনার বাংলার কথা বলছে। আসলে তার পক্ষে এসব পূরণ করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। দেখি আমার পাশ ঘিরে ক্রোধের একঝাঁক চোখ। ছেলেগুলো ছাত্রলীগের। তাদের দেখেছি বুয়েটের মিছিল-মিটিংয়ে। ভয় পেয়ে গেলাম। আমাদের ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা আমাকে আগলে রাখল। ফিরে এলাম হোস্টেলে হতাশা এবং আশার মিশ্র এক অনুভূতি নিয়ে।

ইতিমধ্যে খবরের কাগজে সোভিয়েত ইউনিয়নে উচ্চশিক্ষার জন্য বাংলাদেশ সরকার ১৫টি স্কলারশিপের কথা ঘোষণা করেছে। বন্ধুদের অনেকে আবেদনপত্র জমা দিয়েছে। আমি দিইনি। তার কারণ পরিষ্কার। সরকার আওয়ামী লীগের। আমি বামপন্থী রাজনীতি করি। ফলে অবধারিত ভাগ্য জেনে আবেদন করার তাড়না অনুভব করিনি। আমার এক রুমমেট আশরাফ ভাই। তিনি অবশ্য নাছোড়বান্দা। বললেন, ‘তোমার কিছুই করতে হবে না। শুধু এই ফর্মে নাম স্বাক্ষরটা করো। বাকিটা আমরা করে নেব। রুমের সবাই দরখাস্ত করছে। তুমি করবে না কেন।’ যুক্তিটি গ্রহণ না করে পারলাম না। তা ছাড়া সোভিয়েত দেশ দেখা বা সেখানে পড়াশোনা করার সুযোগ আমার কাছে ছিল যথেষ্ট আকর্ষণীয়। সে সঙ্গে আরও ছিল অর্থ সমস্যা। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফল ভালো করায় সরকার মাসিক ১২০ টাকা বৃত্তি দিয়েছিল দুই বছরের জন্য। প্রথম পাঁচ মাসেই দেখি ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট শূন্য। এই কয় মাসে বৃত্তির সব টাকা খরচ করে ফেলেছি। এদিকে লেখাপড়ার অবস্থাও নয়ছয়। তিন মাস হয়ে গেছে ক্লাস শুরু হয়েছে। একদিন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ক্লাসে ঢুকেই বের হয়ে এলাম। দেখি প্রফেসর ব্ল্যাকবোর্ডে কী সব সংকেত ব্যবহার করে লিখে চলেছেন যার সবটুকুই আমার কাছে দুর্বোধ্য। সে এক দুঃস্বপ্নের মতো আমার অবচেতন মনে স্থান করে নিয়েছিল। আজও অনেক সময় স্বপ্নে দেখি আমি মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পরীক্ষা দিইনি। আমাকে পুনরায় পরীক্ষা দিতে হবে। অনেকটা বাধ্য হয়েই দরখাস্ত করার সম্মতি দিতে হলো। এরই মধ্যে তিন মাস কেটে গেল। দরখাস্তের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। হঠাত্ একদিন দেখি সেক্রেটারিয়েট থেকে একজন পিয়ন আমাকে খুঁজছে। হাতে সরকারি ছাপসহ সিলগালা করা একটি চিঠি। পিয়ন বলল, স্যার সুখবর আছে। খামটি খুলে দেখি সেখানে মস্কোতে আমার স্কলারশিপের খবর।

১০ আগস্ট ১৯৭২ সাল। তেজগাঁও বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে আছে এরোফ্লোটের ইলুশিন ১৮ বিমান। বুয়েটের হোস্টেল থেকে এয়ারপোর্টে এলাম বোনের সঙ্গে। আমাকে বিদায় দিতে এসেছে বুয়েটের আরও কয়েক বন্ধু। লালচে রঙের একটি স্যুটকেস গুছিয়ে নিয়েছি। সেখানে আমার কিছু কাপড়চোপড়। কয়েকটি বই। মায়ের দেওয়া একটি কাঁথা। মা-বাবা কেউ আসেননি বিদায় দিতে। জানি স্বাধীনতাযুদ্ধের পর রাস্তাঘাটের অবস্থা করুণ। মনে আছে যশোরে গিয়ে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে আমাকে আটবার ফেরি পার হতে হয়েছিল। সকালে রওনা দিয়ে সন্ধ্যারাতে পৌঁছেছিলাম যশোর শহরে। ইতিমধ্যে দুই প্রপেলার বিকট শব্দ করে উঠল। ঘড়িতে বাজে সকাল ৯টা ৩০ মিনিট। আমাদের প্লেন উড়ল আকাশে। প্রথমে করাচি, তারপর তাসখন্দ। সেখানে সাময়িক যাত্রাবিরতি। ভোররাতে পৌঁছালাম মস্কোর সেরেমেটিয়েভ বিমানবন্দরে। ১৮ ঘণ্টা বিমানভ্রমণের ক্লান্তি সারা দেহে লেগে আছে। একেবারে নুয়ে পড়ছে দেহ। বিমানবন্দরে রাখা একটি বেঞ্চে গা এলিয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। জেগে উঠলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তার ডাকে। দুঃখ প্রকাশ করলেন বিলম্বের জন্য। বললেন, ‘চলো। মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসেছি তোমাদের নিতে।’ আমার সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে আরও ছয়জন শিক্ষার্থী। তারাও পড়তে এসেছে মস্কোতে। বাসে উঠলাম। বাস চলছে দ্রুতগতিতে। চারপাশে কল্পনার সেই জগত্ মূর্ত হয়ে উঠছে একের পর এক। যে দেশকে স্বপ্নে ভেবেছি সে দেশ এখন চোখের সামনে ধরা দিচ্ছে তার দিগন্ত উন্মোচিত করে।

মিকলুকো মাকলায়া স্ট্রিট। মস্কোর দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল। সেখানেই মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়। গোটা এলাকাজুড়ে ৮টি হোস্টেল। প্রতিটি পাঁচতলা করে। ৩ নম্বর হোস্টেলের চারতলা নিয়ে তৈরি হয়েছে সাময়িক কোয়ারেন্টাইন। এয়ারপোর্ট থেকে সোজা এসে পৌঁছালাম সেখানে। এখানে থাকতে হবে এক সপ্তাহ। নানা ধরনের মেডিকেল চেকআপ হবে। তারপর পাওয়া যাবে বাইরে যাওয়ার অনুমতি। সন্ধ্য্যা হয়ে এল। দিনের কাজ শেষ করে সবাই যার যার গৃহে ফিরে গেছে। চারদিক নিশ্চুপ। মস্কোতে আমার প্রথম রাত। চোখে ঘুম নেই। কাচের জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছি। দেখি টকটকে লাল তারা জ্বলছে ক্রেমলিন টাওয়ারে। পাশে বাঙালি কে একজন বলল, ‘ওটা জানো কী? ওটা হচ্ছে কেজিবির কেন্দ্রীয় ভবন।’ সেখান থেকে জ্বলছে ওই আলো। ওই আলো এমনি সেমনি আলো নয়। গোয়েন্দা কাজে লাগে।’ মস্কোর ক্রেমলিন সম্পর্কে আমার জ্ঞান সীমিত। অগত্যা তার দাবিকে স্বীকার করে নিতে হলো। সেটি যে ভ্রান্ত তা কেবল উদ্ধার হলো এক সপ্তাহ পর। ওই তারার ধারণাটি কিন্তু বহুদিন ধরে আমার কল্পনায় টিকে ছিল। পরে জেনেছি সেটি ছিল ক্রেমলিনের স্পাস্কায়া টাওয়ার, যার মাথায় রয়েছে রুবি পাথরের জ্বলজ্বল করা ওই তারাটি। ১৯৩৭ সালে তারাটি বসানো হয়েছিল টাওয়ারের ওপর।

দেখতে দেখতে কেটে গেল এক সপ্তাহ। নানা ধরনের মেডিকেল চেকআপ হলো। সাদাপোশাকে সোভিয়েত ডাক্তার এবং নার্স নানান সব পরীক্ষা করল। দেখল শরীর স্বাস্থ্য ঠিক আছে কি না। অবশেষে কোয়ারেন্টাইনের বাধাধরা জীবন থেকে মুক্তি পেলাম। দেখি হোস্টেলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে পাকিস্তান থেকে পড়তে আসা কয়েকজন ছেলেমেয়ে। তারা এসেছে আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে। তাদের নেতা শাহেদ ভাই। ভারত থেকে এসেছে দুই মেয়ে—সুনিতা ও রোশনি। দুজনের বাড়ি ভারতের উজ্জয়ন শহরে। তাদের বাবা সেখানকার উঁচু দরের রাজনৈতিক নেতা। উজ্জয়ন দিল্লি থেকে বেশি দূরে নয়। ২০১২ সালে সেখানে গিয়েছিলাম বেড়াতে। আমার বন্ধু বদরুল হাসান ও তার স্ত্রী উমার সঙ্গে দেখা করতে। তারা বলল, রোশনি মারা গেছে বেশ কিছুদিন আগে। দুঃখে বুক ফেটে গেল। মস্কোতে যখন আমি অসহায় তখন তার কৃপায় সিক্ত হয়েছি। আমাকে রান্না করে খাইয়েছে বহুবার। প্রবাসজীবনের প্রাথমিক অসহায়ত্বকে অতিক্রম করার মানসিক শক্তি জুগিয়েছে। অথচ আজ সে নেই। যাই হোক, হোস্টেল থেকে বের হতেই শাহেদ ভাই বললেন, ‘চলো আজ মস্কো শহর দেখব। সেখানে ক্রেমলিন, লেনিনের মোসোলিয়াম। আছে আরও কত কিছু দেখার। মিকলুখো মাকলায়া মেট্রো স্টেশন থেকে ট্রেনে চেপে প্রসপেক্ট ভিরনাদস্কি, লেনিন পাহাড়, ফ্রুঞ্জে, পার্ক কুলতুরি স্টেশন পার হয়ে অবশেষে পৌঁছালাম সেন্ট্রাল স্টেশনে। ট্রেনের ভাড়া মাত্র ৫ কোপেক। মেট্রোরেলের সেবা দেখে তো আমি অবাক। প্রতিটি স্টেশন যেন এক-একটি শিল্পকর্ম। ফ্রেস্কোতে ভরা। ভাবলাম, এই না হলে সমাজতন্ত্র। বুক দুরু দুরু করছে। অবশেষে ক্রেমলিন দেখব, দেখব অক্টোবর বিপ্লবের নেতা লেনিনের মৃতদেহ। দেখব সোভিয়েত ক্ষমতার কেন্দ্রকে।

স্টেশন থেকে বেশ কিছুটা হাঁটাপথ। পথটি একটু পাহাড়ি। হঠাত্ চোখের সামনে ভেসে উঠল কল্পনার সেই রেড স্কয়ার, যার ছবি দেখেছি কতবার কতভাবে। ছোট ছোট লাল ইট দিয়ে মোড়ানো প্রশস্ত খোলামেলা জায়গা। সামনে ক্রেমলিনে ঢোকার বিশাল গেট। মাঝেমধ্যে দেখি কালো রঙের লিমোজিন দ্রুতগতিতে ক্রেমলিনের ভেতর ঢুকছে, আবার বের হচ্ছে। ক্রেমলিনের উঁচু প্রাচীরটির পাশে রয়েছে সবুজ গাছের মেলা। দেয়ালের ধার ঘেঁষে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের কবর। স্তালিন, ডেরজিন্সকি, কালিনিনসহ আরও অনেকের। আরও আছে ইউরি গ্যাগারিন, জেনারেল জুকভ, আমেরিকান সাংবাদিক জন রিড, যিনি বিখ্যাত হয়েছিলেন অক্টোবর বিপ্লবের ওপর টেন ডেজ দ্যাট শুক দ্য ওয়ার্ল্ড বইটি লিখে। ক্রেমলিনের দেয়ালের ঠিক মাঝখানে আশ্রয় নিয়ে আছে লেনিনের মোসোলিয়াম। গাঢ় লাল মার্বেল পাথর দিয়ে তৈরি তার চার দেয়াল। গেটের সামনে বন্দুকধারী দুই প্রহরী দাঁড়িয়ে আছেন পাথরের মূর্তির মতো। বোঝার উপায় নেই তারা জীবন্ত মানুষ। প্রতি ঘণ্টা অন্তর বদল হচ্ছে প্রহরী। দেখার মতো এক দৃশ্য বটে। সবকিছু দেখছি আর অভিভূত হচ্ছি। মনের মধ্যে সুকান্ত ভট্টাচার্যের সেই কবিতার লাইন—‘বিপ্লব স্পন্দিত বুকে মনে হয় আমিই লেনিন।’ মোসোলিয়ামের সামনে মানুষের লাইন। সেই লাইনে আমাদেরও দাঁড়াতে হলো। এবার এল ঢোকার পালা। ঢুকেই দেখি শায়িত অবস্থায় আছে একটি দেহ। মুখমণ্ডল ঠিক ঠিক মিলে যায় লেনিনের সঙ্গে। পরিধানে কালো স্যুট। দেহটিকে ঘিরে রয়েছে শক্তিশালী আলোর ফোয়ারা। তাতে করে দেহটি দেখায় অনেক বেশি উজ্জ্বল। লেনিনের দেহের বাঁ পাশ দিয়ে অতি ধীরে হেঁটে যাওয়ার নির্দেশ পেলাম। লেনিনের মাথার কাছে এসে ভাবলাম আর একবার ভালো করে দেখে নিই। কিন্তু দণ্ডায়মান কর্মকর্তার কণ্ঠ থেকে এল দ্রুত স্থান ত্যাগের নির্দেশ।

অনেকে বলেন রুশ বিপ্লব কোনো বিপ্লব ছিল না। ছিল একটি অভ্যুত্থান মাত্র। তাদের ভাষায় লেনিন ষড়যন্ত্র করে রাশিয়ার ক্ষমতা দখল করে নিয়েছিলেন। এসব অভিযোগ কিন্তু আমি কখনো সঠিক বলে মনে করিনি। বিপ্লব হঠাত্ করে কোথাও ঘটে না। তাকে প্রস্তুত করতে হয়। বিপ্লবের সব পূবশর্ত রাশিয়ায় ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল বেশ আগে থেকে। আগে বলতে বেশ পেছনে যেতে পারি। ১৭৭৩ সালের কথা। পুগাচভ নামের একজন আর্মি লেফটেন্যান্ট কৃষকদের অধিকার নিয়ে জারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। সেই বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও রাশিয়ার জনগণের মনে পুগাচভ সম্মান পেয়েছিল বীর হিসেবে। জারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ আরও হয়েছে। তার মধ্যে ১৮২৫ সালের সেনাবাহিনীর বিদ্রোহ অন্যতম। ওই বছর ডিসেম্বর মাসে বেশ কিছু অফিসার জারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। ইতিহাসে একে ডিসেম্বরিস্টদের আন্দোলন বলা হয়। সে বিদ্রোহও ব্যর্থ হয়েছিল। বেশ কয়েকজন অফিসারকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলেও জারের বিরুদ্ধে আন্দোলন থেমে থাকেনি। তবে সব বিদ্রোহের মধ্যে ১৯০৫ সালে যা ঘটেছিল, সেটি ছিল সবচেয়ে তাত্পর্যপূর্ণ। লেনিন তাকে বলেছিলেন ১৯১৭ সালের বলশেভিক বিপ্লবের ড্রেস রিহার্সেল। ১৯০৫ সালে শ্রমিকেরা জারের প্রাসাদের দিকে মিছিল করে যাচ্ছিলেন রুটির দাবি নিয়ে। রুশ-জাপান যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার অর্থনীতি ভালো যাচ্ছিল না। নানা কারণে মানুষ কাটাচ্ছিল দুর্বিষহ জীবন। কৃষক শ্রেণির জীবনও ছিল নানাভাবে নিগৃহীত এবং দারিদ্র্যে ভরা। হঠাত্ সেই শান্তিপূর্ণ মিছিলে সেনাবাহিনী গুলিবর্ষণ করল। বহু শ্রমিকের মৃত্যু হলো। ১৯০৫ সালের ওই ঘটনার পর রাশিয়ার জার বাধ্য হয়ে হাতে নিলেন কিছু সংস্কারকাজ। কিন্তু সেগুলো যথেষ্ট ছিল না। অসন্তোষের মূল কারণগুলো ঠিকই থেকে গেল রাশিয়ায়।

প্রথম মহাযুদ্ধ যখন শুরু হলো ওই অসন্তোষ তখন ভিন্ন রূপ নিয়েছে। জার যুদ্ধ চালিয়ে যেতে ইচ্ছুক। সাধারণ জনগণ যুদ্ধের বিপক্ষে। যুদ্ধের কারণে লোকালয় ধ্বংস হচ্ছে। শস্যের খেত আগুনে পুড়ে কৃষি উপযোগিতা হারাচ্ছে। মানুষ না খেয়ে মরছে। কৃষিতে বৈষম্য প্রকট হয়ে উঠছে নানা কারণে। জমির ওপর কৃষকের কোনো অধিকার নেই। রাজতন্ত্রের আশপাশ ঘিরে যে শক্তিশালী অভিজাত শ্রেণি গড়ে উঠেছে, তাদের হাতে রয়েছে অধিকাংশ উর্বর জমির মালিকানা। শ্রমিক শ্রেণি সংখ্যায় যে খুব বড়, তা নয়। কিন্তু সেন্ট পিটার্সবার্গ এবং মস্কোর মতো বড় শহরগুলোতে তাঁদের লক্ষণীয় উপস্থিতি এড়িয়ে যাওয়া কঠিন। তারাও যুদ্ধের বিরুদ্ধে। বিরুদ্ধে রাজতন্ত্রের। সেনাবাহিনীর জওয়ানরা যুদ্ধে ক্লান্ত। তাঁরাও ঘরে ফিরতে চায়। অথচ যুদ্ধ শেষ করার কোনো তাগিদ জার অনুভব করেননি। পরিবেশটি এমন হয়ে উঠেছিল যে বিপ্লব বা বিক্ষোভ বা প্রতিবাদ বেশ অবশ্যম্ভাবী বলেই মনে হচ্ছিল। ঘটল ঠিক তা-ই। জার বেরিয়েছিলেন ট্রেনভ্রমণে। তাঁর ট্রেনকে গন্তব্যস্থানে না পাঠিয়ে রেলশ্রমিকেরা ট্রেনটিকে পাঠালেন অন্য পথে। ট্রেন এসে পৌঁছাল এমন এক প্রত্যন্ত জায়গায় যেখান থেকে ফেরার পথ নেই। ক্ষমতা থেকে জার অপসারিত হলো। ক্ষমতায় এল অন্তর্বর্তীকালীন এক সরকার। সেই সরকার গঠিত হয়েছিল রাশিয়ার ডুমা বা পার্লামেন্টের সদস্যদের নিয়ে। পাঁচমিশালি সব রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি নিয়ে গড়া ওই সরকারের প্রধান হলেন কেরেন্সকি। কাজান শহরের যে স্কুলে লেনিন পড়তেন, কেরেন্সকির বাবা ছিলেন সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক। লেনিনের মতাদর্শে বিশ্বাসী কেউ ওই সরকারে ছিলেন না। কিন্তু লেনিন ওই সরকারের দুর্বলতা ভালোভাবেই বুঝেছিলেন এবং সেটি উন্মোচিত করেছিলেন অত্যন্ত নিপুণ হাতে।

‘এপ্রিল থিসিস’ নামে লেনিন যে লেখাটি লিখেছিলেন, সেটি বিপ্লবের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সেখানেই তিনি বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন। থিসিসটি আমি পড়েছি মস্কোতে ছাত্র থাকা অবস্থায়। সেখানে ১০টি নির্দেশনামা ছিল। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে তিনি বুর্জোয়া সরকার হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। উপদেশ দিয়েছিলেন তাঁর সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক থেকে দূরে থাকার। লেনিনের মূল কথা ছিল প্রথম মহাযুদ্ধ বন্ধ করতে হবে যেকোনো মূল্যে। জমি কৃষকদের হাতে বিতরণের ব্যবস্থা করতে হবে। খাদ্য (রুটি) সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধকে গৃহযুদ্ধে পরিণত করে সমগ্র ইউরোপে পুঁজিবাদের সংকটকে তীব্র ও গভীর করতে হবে। সেভাবেই তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন বিশ্ব প্রলেতারিয়াত বিপ্লবের। যে অন্তর্বর্তী সরকার বহাল ছিল, সে সরকার অবশ্য রাশিয়ার মানুষের মন বোঝেনি। সরকার জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত বহাল রাখল। যুদ্ধকে দেশপ্রেমিক দায়িত্ব বলে ঘোষণা করল। এতে করে মানুষের দুর্দশা বাড়ল। যুদ্ধ আনল আরও ধ্বংস। উদ্ভূত সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে লেনিন ভুল করলেন না। থিসিসে তিনি আরও বললেন, রাশিয়ায় যেটি ঘটছে সেটি বিপ্লবের প্রথম ধাপ। পরের ধাপে বুর্জোয়ার হাত থেকে ক্ষমতা নিতে হবে। ক্ষমতা দিতে হবে শ্রমিক ও কৃষকের হাতে। তার নির্দেশ হলো রাশিয়ায় কোনো পার্লামেন্টারি রিপাবলিকের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন সোভিয়েত রিপাবলিকের, যেখানে ক্ষমতা থাকবে সোভিয়েত প্রতিনিধিদের হাতে। ভূমি সংস্কারের কথা ছিল তাঁর ৬ নম্বর থিসিসে। ব্যাংক জাতীয়করণ এবং একটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক গড়ে তোলারও নির্দেশ ছিল, যার দায়িত্বে থাকবে কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণির প্রতিনিধি। সবশেষে ছিল একটি সতকর্বাণী। তিনি বলেছিলেন, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা বলশেভিকদের আশু দায়িত্ব নয়। প্রথমে নিশ্চিত করতে হবে উত্পাদন এবং পণ্য বিতরণের ওপর শ্রমিক ডেপুটিদের নিয়ন্ত্রণ। তারপরই ভাবতে হবে সমাজতন্ত্রের কথা।

অক্টোবর বিপ্লব এবং লেনিন আমাদের মনে প্রায় সমার্থক হয়ে আছেন। এই অর্থে না যে বিপ্লব তাঁর হাতে সফল হয়েছিল। লেনিন ছিলেন রাজনৈতিক দূরদর্শী একজন মানুষ। সেই সঙ্গে তাঁর ছিল আন্দোলন পরিচালনার বুদ্ধিদীপ্ত ক্ষমতা। সেটি কেবল বিপ্লবের বাস্তব দিককে ঘিরে না। তাঁর প্রতিভা কেবল মানুষের মন বুঝে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের মধ্যেসীমিত ছিল না; আরও ছিল তাত্ত্বিক দিক থেকে রাশিয়াকে সঠিক বিশ্লেষণের ক্ষমতা। বিপ্লবের আদর্শগত প্রস্তুতি তিনি শুরু করেছিলেন বহু আগে। বস্তুত ১৮৯৩ সাল থেকে। ওই সময় তিনি লিখেছিলেন রাশিয়ার কৃষকদের দুর্দশার কথা। ভূমির ওপর কুলাক শ্রেণির আধিপত্যের বিরুদ্ধে রাগান্বিত বাক্যালাপ করেছেন তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে। ১৮৯৪ সালে তাঁর লেখার বিষয়বস্তুতে স্থান পেয়েছিল সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের অন্তর্দ্বন্দ্ব। ‘রাশিয়ায় পুঁজিবাদের বিকাশে’ (১৮৯৯ সাল) সংখ্যাগত তথ্য দিয়ে তিনি দেখিয়েছিলেন কীভাবে পুঁজিবাদের সম্ভাবনাগুলো অঙ্কুরিত হচ্ছে রাশিয়ার মাটিতে। ‘কী করিতে হইবে’ (১৯০২) লেখায় পার্টির উদ্দেশ্য এবং কৌশল নিয়ে আলোচনা করেছেন। প্রবন্ধের নামটি তিনি নিয়েছিলেন চেরনশেভস্কি নামের রুশ সাহিত্যিকের একই নামে লেখা উপন্যাস থেকে। ‘এক পা আগে দুই পা পেছনে’ (১৯০৪), ‘সামাজিক বিপ্লবে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের দুটি কৌশল’ (১৯০৪) ছিল পার্টির তাত্ত্বিক ও বাস্তব কৌশলগত দিকগুলোকে আরও ধারাল করে উপস্থাপন করা। দর্শনের ওপর সমালোচনাধর্মী লেখাগুলো আমাকে পড়তে হয়েছিল ছাত্র থাকা অবস্থায়। ‘বস্তুবাদ এবং এম্পিরিও ক্রিটিসিজমে’ (১৯০৯) তত্কালীন দার্শনিক মাখকে তিনি দ্বিধাহীনভাবে সমালোচনা করেছিলেন। ‘সাম্রাজ্যবাদ: পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ ধাপ’ (১৯১৬), ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ (১৯১৭) ছিল অক্টোবর বিপ্লবের প্রস্তুতির ক্ষেত্রে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান।

বিপ্লবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে সুইজারল্যান্ডের জুরিখ শহর থেকে লেনিনের পেত্রোগ্রাদ শহরে ফিরে আসা। ওই শহরে তিনি বেশ কিছু সময় রাজনৈতিক নির্বাসনে কাটিয়েছিলেন। ইতিমধ্যে রাশিয়ায় চলেছে বিপুল পরিবর্তন। জারকে হটানো গেছে। ক্ষমতা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হাতে। কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অকর্মণ্য। রাজনৈতিক শূন্যতা, নেতৃত্বের অভাব, প্রথম মহাযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, কৃষক শ্রেণির পর্যুদস্ত অবস্থা—সব মিলিয়ে বিপ্লবের অগ্নস্ফুিলিঙ্গ আকাশে-বাতাসে। মার্চের ৩০ তারিখে লেনিন জুরিখ থেকে ট্রেনে চাপলেন। সঙ্গে ২৬ জন সহকর্মী। রওনা হলেন সেন্ট পিটার্সবার্গের উদ্দেশে। প্রথমে এসে পৌঁছালেন সুইডেনে। সেখান থেকে ফেরি। তারপর ট্রেন। অবশেষে ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিংকি। হেলসিংকি পৌঁছে শঙ্কায় ভরে উঠল লেনিনের মন। কোনোভাবে তাঁকে কেউ প্রতারিত করছে কি না। গ্রেপ্তারের ভয় ছিল। কিন্তু সব সংশয় কাটিয়ে তিনি পৌঁছালেন জারের রাজধানী সেন্ট পিটার্সবার্গে ১৭ দিন পর। ফিনল্যান্ড রেলস্টেশন। লেনিনের ট্রেন এসে পৌঁছাল অনেক দেরিতে। ট্রেনভ্রমণের সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিল জার্মান সরকার। তাদের ধারণা ছিল এই ব্যক্তিটি রাশিয়াকে বাধ্য করতে পারে যুদ্ধ বন্ধে। জার্মানির সঙ্গে অসম চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য হলে রাশিয়া দুর্বল হয়ে পড়বে। জার্মানির বিজয় হবে নিশ্চিত। এ কারণে লেনিনকে অনেকে জার্মানির গুপ্তচর হিসেবে সে সময় প্রচার করেছিলেন। তাঁকে গ্রেপ্তারেরও আদেশ ছিল। এপ্রিলের ১৬ তারিখের কথা। ফিনল্যান্ড স্টেশনে লেনিনকে অভ্যর্থনা জানাতে এসেছেন মস্কো সোভিয়েতের সদস্যরা। স্টেশনের যে ঘরটি নির্দিষ্ট ছিল জারের বিশ্রামাগার হিসেবে, সেটি ইতিমধ্যে শ্রমিকদের দখলে। ঘরে ঢুকে লেনিন দেখলেন অগণিত শ্রমিক তার আগমন অপেক্ষায় সেখানে সমবেত হয়েছে। মস্কো সোভিয়েতের প্রতিনিধি ছিলেন একজন মেনশেভিক। লেনিনের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। কিন্তু তিনি সাদর অভিনন্দন জানালেন লেনিনকে। বললেন, ‘কমরেড লেনিন, আমরা আপনাকে সাদর সম্ভাষণ জানাচ্ছি। এই মুহূর্তে বৈপ্লবিক গণতন্ত্রের প্রধান কাজ বিপ্লবকে রক্ষা করা ভেতর ও বাইরের শত্রু থেকে।’ লেনিন উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘প্রিয় কমরেড, সৈনিক, নাবিক এবং শ্রমিক ভাইয়েরা। আমি আপনাদের সাদর সম্ভাষণ জানাচ্ছি। আপনারা বিপ্লবকে জয়যুক্ত করেছেন। আপনারা বিশ্ব প্রলেতারিয়াত বাহিনীর সবচেয়ে অগ্রসর বাহিনী। সাম্রাজ্যবাদী দস্যুদের পরিচালিত যুদ্ধ ইউরোপে গৃহযুদ্ধের আগুন জ্বালাবে। উদয় হবে বিশ্বব্যাপী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সূর্য। পুঁজিতান্ত্রিক সমাজের পতন আজ অবশ্যম্ভাবী।’

স্টেশনের বিশ্রামঘর থেকে বেরিয়ে লেনিন মুখোমুখি হলেন বিশাল জনতার। অপেক্ষমাণ জনতার উদ্দেশে কিছু বলতেই হয়। মোটর গাড়ির ওপর দাঁড়িয়ে তিনি জনতার উদ্দেশে ভাষণ দিলেন। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, সেই ভাষণই বদলে দিয়েছিল বিশ্বরাজনীতিকে। লেনিন বড় মাপের কোনো তাত্ত্বিক ছিলেন না। ট্রটস্কি বা অন্যদের মতো মার্ক্সীয় তত্ত্বের বিশুদ্ধতা নিয়ে তিনি নিজেকে ব্যস্ত রাখেননি। তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল বিপ্লব এবং বিপ্লব। রাজনৈতিক মতপার্থক্যকে তিনি কখনো নরম ভাষায় সমালোচনা করেননি। তাঁর যুক্তি ও আক্রমণ ছিল তীক্ষ ও ক্ষুরধার। তর্ক-বিতর্কের মূল বিষয় ছিল বিপ্লবকেন্দ্রিক। তত্ত্ব নিয়ে নয়; মানুষ বিপ্লব চায়, সেটি তিনি ভালো করেই উপলব্ধি করেছিলেন। কাজান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময় বিপ্লবের ধারণাটি তাঁর মনে বদ্ধমূল হয়েছিল। তাঁর ভাই আলেকজান্ডার জারের হত্যা ষড়যন্ত্রে অভিযুক্ত হয়েছিলেন। পরে তাঁকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল। সেটি লেনিনের মনে প্রচণ্ড দাগ কেটেছিল। বিপ্লবের এক শ বছর পর লেনিনের কথা ভাবি। আরও অনেক ভাবনা মনে আসে। ভাবি সে সময়কার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদি জার্মানির সঙ্গে শান্তিচুক্তি করত, যদি কৃষকের হাতে জমি বিতরণের প্রতি দৃঢ় ভূমিকা নিত, তাহলে লেনিনের পক্ষে কি ওই সরকারকে অপসারণ করা সম্ভব হতো? সে ক্ষেত্রে কি রাশিয়ার ভাগ্য বদলে যেত না? হয়তোবা বিপ্লব এড়িয়ে রাশিয়া অনুসরণ করত পশ্চিমা বিশ্বের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। জানি, ইতিহাস আকস্মিকতায় ভরা। সবকিছু নিয়মমাফিক চলে না। উত্থান-পতনে ভরা মানুষের ইতিহাস। সে কারণে যা ঘটে গেল, সেটিই মেনে নিতে হলো রাশিয়ার মানুষকে।

দুই

পয়লা সেপ্টেম্বর দেখতে দেখতে এসে গেল। ১৯৭২ সাল। রাশিয়ায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ভিন্ন ধাঁচের। তারা আমাদের মতো পয়লা জানুয়ারি থেকে শিক্ষাবর্ষ শুরু করে না। সেখানে পয়লা সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয় স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস। আমার হোস্টেল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস একেবারে নিকটে। যাওয়ার পথে রয়েছে কিছু দোকানপাট। দোকানগুলো থেকে আমি কিনি রুটি, দুধ, মাখন, ডিম বা মুরগি। সোভিয়েত সমাজে পণ্যসম্ভারের দিক থেকে দীনতা সুস্পষ্ট। দোকানগুলোতে নির্দিষ্ট সময়ে পাওয়া যায় কিছু পণ্য। বাদ বাকি সময়ে পণ্যের ভান্ডার খালি। এটি আমার কাছে খুবই অবাক লাগত। আমাদের হোস্টেল থেকে বেশ কিছু দূরে ছিল একটি কাঁচাবাজার। ঘরে উত্পাদিত অল্পস্বল্প শাকসবজি অথবা ফলের আচারজাতীয় পণ্য নিয়ে দেখতাম কোনো বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা বসে আছে। কিন্তু সেসব পণ্যের মূল্য ছিল আমাদের শিক্ষার্থীদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। ভাবলাম, বিশাল সোভিয়েত অর্থনীতিতে ব্যক্তি-উদ্যোগ কত ক্ষুদ্র মাপের। মস্কো শহরের একেবারে কেন্দ্রে কেনাকাটা করতে গিয়েছি অনেকবার। সেখানেও লক্ষ করেছি বৈচিত্র্যের দর্শনীয় অভাব। বহু দ্রব্য দোকানে ঝুলছে ঠিকই কিন্তু গুণগত মান ক্রেতাদের মন কাড়তে ব্যর্থ হচ্ছে। দৈনন্দিন জীবনের চাহিদা পূরণ, চাহিদার ক্ষেত্রে বৈচিত্র্যের দিকটি নিয়ে এখানে কেউ ভেবেছে বলে মনে হয় না। ভাবলেও সেটি বাস্তবে রূপায়ণ হয়নি। পুঁজিবাদী সমাজে মানুষের চাহিদা তৈরি হয় কখনো কৃত্রিমভাবে, কখনো সত্যিকার চাহিদার কথা ভেবে। সেই চাহিদা পূরণ করে পুঁজি। এখানে সবকিছু জনগণের মালিকানা। কথাটি আমি অবশ্য সোজাভাবে দেখিনি। কাগজ-কলমে মালিকানা নিশ্চিত হলেও প্রকৃত মালিক হচ্ছে পার্টি। গোটা পার্টি না। ক্ষুদ্রসংখ্যক একটি এলিট গ্রুপ। তাদের দায়িত্বে আছে কলকারখানা বা যৌথ খামারের পরিচালনার ভার। সে কারণে তাদের হাতে প্রকৃত ক্ষমতা। ক্ষমতা আরও আছে আমলাতন্ত্রের হাতে। তাদের জীবন শুনেছি খারাপ না। ডিনারের টেবিলে ক্যাভিয়ার সালমন বা আরও দামি খাবারের ঘাটতি নেই। অথচ তাদের বিপরীতে সাধারণ মানুষ যারা সম্পদের আসল মালিক বলে রাজনৈতিক ইশতেহারে উল্লেখ আছে, তারা জীবন কাটায় স্বল্প গুণমানের খাদ্যদ্রব্য বা পরিধানের বস্ত্র নিয়ে। সমাজতন্ত্রের এই দুর্বলতার দিকটি এখানকার টেলিভিশনে তুলে ধরতে দেখেছি, যদিও খুব সূক্ষ্মভাবে। ফলে প্রায়ই মনে হয়েছে, সমাজতন্ত্রের কেন্দ্রীয় প্ল্যানিং যদি মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে ব্যর্থ হয় তাহলে বিকল্প কোনো দোমিশালি ব্যবস্থা নিয়ে ভাবা হলো না কেন? পণ্যের ঘাটতি বা ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী পণ্য উত্পাদনের প্রতি অবহেলার কোনো সমাধান বের করা হলো না কেন? আইনস্টাইন তাঁর লেখায় বলেছিলেন, পার্টি আর আমলাতন্ত্র যদি একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হয় তাহলে জনগণের জন্য সেটি কোনো সুখবর নয়। কথাটি যে কত সত্য, সেটি সোভিয়েত অভিজ্ঞতা থেকে দেখি।

যা-ই হোক, শুরু হলো বিশ্ববিদ্যালয়ে রুশ ভাষা শেখার ক্লাস। আমাদের ক্লাসটি একতলায়। ঢুকে দেখি ক্লাসভর্তি নানা দেশের ছাত্রছাত্রী চেয়ারে আসন নিয়ে বসে আছে। ভারতবর্ষ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা থেকে আসা সব ছাত্রছাত্রী। সোভিয়েত শিক্ষাব্যবস্থায় লেখাপড়া কেমন হবে, তা নিয়ে আমার মনে শঙ্কা ছিল। ক্লাসে গিয়ে বসলাম। একটু পর ক্লাসে ঢুকলেন আমাদের শিক্ষিকা। শুরু হলো শিক্ষাদান। দেখি তিনি সঙ্গে নিয়ে এসেছেন একটি ক্যাসেট প্লেয়ার। ক্লাস শুরু করলেন রুশ ভাষায় গাওয়া একটি গান দিয়ে। গানটি রাশিয়ার সবচেয়ে বড় নদী ভল্গাকে নিয়ে। গানের কথাগুলো এখনো মনে বাজে। রুশ ভাষা থেকে ভাষান্তর করলে গানটি শোনায় এ রকম : ‘হে আমার ভল্গা! কোন সুদূর অজানা দেশ থেকে তুমি বয়ে চলেছ আবহমানকাল ধরে। ভল্গা, তোমার শেষ কোথায় জানি না। গমখেতের সোনালি রং, বরফঢাকা দিগন্তের শুভ্রতার ধার ঘেঁষে তুমি বয়ে চলেছ কতকাল ধরে। অথচ আমার বয়স মাত্র সতেরো। মা বলেছিল, পুত্র, এমন তো হতে পারে, ঘরে ফেরার পথে রাস্তার ক্লান্তি তোমাকে দুর্বল করবে। তখন তুমি ভাসিয়ে দিয়ো তোমার দেহ ওই ভল্গা নদীর জলে। বিধৌত হয়ে পুনরায় জেগে উঠবে পূর্ণ শক্তি নিয়ে...’। গানের কথাগুলো স্বদেশপ্রেমে ভরা। শুনলে এখনো কেন জানি আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ি। ভেবেছিলাম ক্লাস শুরু হবে লেনিন বা মার্ক্সের কোনো বিপ্লবী উদ্ধৃতি দিয়ে। সমাজতন্ত্রের কথা দিয়ে। সমাজতন্ত্রের কোনো নামকরা কবির কথা দিয়ে। কোনোটিই ঠিক হলো না। পরে ঠিক বুঝেছিলাম আমাদের শিক্ষক তাঁর ক্লাস কেন শুরু করেছিলেন ভল্গা নদী দিয়ে। রুশ জাতির দীর্ঘ ইতিহাস, যে বিশাল অঞ্চল নিয়ে রাশিয়ার ভূখণ্ড এবং যার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে এই ভল্গা, তার বুক ভরে আছে হাজার বছরের ইতিহাসে। যেসব উত্থান-পতন রাশিয়ার ভাগ্যে লেখা ছিল তার প্রতিটির সঙ্গে যুক্ত এই ভল্গা নদীর স্রোতোধারা। এই নদী অবলোকন করেছে নানা উত্থান-পতন। উত্তরের শ্বেত সমুদ্র (‘হোয়াইট সি’) এবং বাল্টিক সাগর থেকে বেরিয়ে ভল্গা পড়েছে কৃষ্ণসাগর ও কাস্পিয়ান সাগরে। তার কোনো এক পারে রয়েছে রুশ বিপ্লবের নেতা লেনিনের জন্মস্থান কাজান শহর। আরও রয়েছে ইতিহাস বিখ্যাত নগরী ভল্গাগ্রাদ। ১৯৩৩ সালে স্তালিন ভল্গা নদীর সঙ্গে মস্কো শহরের ক্ষুদ্র নদী মস্কোভাকে সংযুক্ত করেছিলেন জলের সংস্থান করতে। তাতে করে রাজধানী মস্কোর গুরুত্ব বেড়ে গিয়েছিল। অন্যথায় মস্কো হয়তো বিচ্ছিন্ন থাকত রাশিয়ার বাকি অঞ্চল থেকে।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ এসে গেল হঠাত্ করে। সেই ইতিহাসের সঙ্গে যাঁরা পরিচিত তাঁরা জানেন, মানব ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়েছিল এই ভল্গা নদীর তীরে। সে এক জীবনমরণ যুদ্ধ, যে যুদ্ধ নির্ধারণ করবে কে জয়ী হবে, কে হবে পরাজিত। ১৯৪২ সালের জুন মাস থেকে ১৯৪৩ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যবর্তী সময়ে অর্থাত্ মাত্র আট মাসের ব্যবধানে ২০ লাখ রুশ ও জার্মান জীবন হারিয়েছিল এই শহরের ওপর দখল প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে। হিটলারের জার্মান বাহিনী ভল্গা নদী দখলে জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছিল কেন, তার কারণ জানি। লক্ষ্য ছিল ককেশীয় অঞ্চলের তেলসমৃদ্ধ এলাকা তাদের দখলে আনতে। সোভিয়েতের লাল আর্মি এবং ভল্গাগ্রাদের মানুষ দাঁড়িয়েছিল তাদের পথ রোধ করে। ভল্গাগ্রাদ মাথা নত করেনি। অনেক ঐতিহাসিকের মতে সেই যুদ্ধই ঘুরিয়ে দিয়েছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মোড়। প্রমাণ করেছিল রাশিয়া কী করতে সক্ষম। সেই কালক্ষণ থেকে অনেক সময় কেটে গেছে। রুশ জাতি সেই বিষাদময় ইতিহাসের কথা ভোলেনি। এত বছর পর আজও যাঁরা এই নদীর ওপর দিয়ে জাহাজে ভ্রমণ করেন তাঁদের চোখে পড়ে এক বিশাল মূর্তি। মা রাশিয়ার মূর্তি ‘মাতৃভূমি তোমাকে ডাকে’। মায়ের ডাকে উদ্বুদ্ধ হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবী সে সময় সামরিক বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। রক্ষা করেছিল মাতৃভূমিকে। মামায় কুর্বান নামক স্থানে নির্মিত এই মূর্তির দিকে তাকিয়ে রুশ মানুষ নিশ্চুপ হয়ে যায়। যুদ্ধের সময় এই শহর রক্তে স্নাত হয়েছিল। তার নোনতা স্বাদ এখনো হয়তো লেগে আছে ভল্গা নদীর জলে। ১৭ তলা সমান উঁচু এই মূর্তি আজও মানুষের কাছে বেদনা-দুঃখ এবং বিজয়ের প্রতীক হয়ে আছে। রুশ জাতির গৌরবময় বিজয়ের এই নিদর্শন আজও জানিয়ে দিচ্ছে রাশিয়ার শক্তিকে। এ জাতি মাথা নত করে না। ওই মূর্তি হয়তো বলছে, কেউ যদি ভুলক্রমেও রাশিয়াকে আক্রমণ করে তাহলে তার পরিণতি হবে ঠিক হিটলারের মতো।

দেখতে দেখতে প্রথম সেমিস্টার শেষ হয়ে এল। এখন দুই সপ্তাহের বিরতি। জানতে পেলাম বিশ্ববিদ্যালয় সাত দিনের শিক্ষাসফরের আয়োজন করেছে নবাগত শিক্ষার্থীদের জন্য। মস্কো থেকে তাদের নেওয়া হবে লেনিনগ্রাদ শহরে। রুশ বিপ্লবের শহর এই লেনিনগ্রাদ। শহরটি দেখার উত্তেজনা আমাকে গ্রাস করল। সব মিলিয়ে তিরিশ জন ছাত্রছাত্রী। ইতিমধ্যে শীতের আগমনবার্তা শুনতে পাচ্ছি। মস্কোতে বরফ পড়তে শুরু করেছে। গোটা শহর এখন বরফের হাতে জিম্মি। এ বরফ এখনো পেজা পেজা। সবাই বলছে এক সপ্তাহের মধ্যে পুরোদমে শীত নামবে। ভাবছি যাব আরও উত্তরের শহর লেনিনগ্রাদে। সেখানে বাল্টিক সাগরের হিমেল বাতাস। নিশ্চয় ঠান্ডা অনেক বেশি। শীতকে মোকাবিলা করার প্রাথমিক ব্যবস্থা নিতে হয়। ছোট্ট একটি সুটকেস গুছিয়ে নিলাম। পুরু কোট, মাথায় পশমের টুপি, হাতে পুরু দস্তানা পরে এলাম লেনিনগ্রাদস্কি ভকজালে। ভকজাল রুশ শব্দ। অর্থ রেলস্টেশন। এখান থেকে সব ট্রেন যায় রাশিয়ার উত্তর-পশ্চিমে। ট্রেনের নাম ক্রাস্নায়া স্ত্রেলা। বাংলায় ‘লাল তীর’। একটি কুপেতে চারজন করে যাত্রীর ব্যবস্থা। রাত ১০টা ৩০ মিনিটে ট্রেন ছাড়ল। ট্রেনের কামরায় সবকিছু গুছিয়ে এবার একটু বসেছি। দেখি ট্রেনের মহিলা অ্যাটেনডেন্ট চা-বিস্কিট এবং দই নিয়ে হাজির। রুশ ভাষায় তাকে কীভাবে ধন্যবাদ জানাতে হয় সেটি অবশ্য শিখে নিয়েছি। ইতিমধ্যে ট্রেন গতি পেয়েছে। জানালা দিয়ে দেখতে পাচ্ছি ল্যাম্পপোস্টগুলো দ্রুত অপসারিত হচ্ছে আমার দৃষ্টি থেকে। মাঠ ও প্রান্তর সাদা বরফে আবৃত।

লেনিনগ্রাদকে নিয়ে ভাবছি। এই প্রথম দেখব বিপ্লবের সেই তীর্থস্থান। দেখব দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় শহরটি কী সাহস দেখিয়ে একটানা ৯০০ দিন জার্মান অবরোধের মধ্যে কাটিয়েছিল। মানুষ মরল। না খেয়ে কঙ্কাল হলো। আলো নেই। বোমার আঘাতে রাস্তাঘাটের জরাজীর্ণ অবস্থা। মানুষ মানুষের মাংস খেলো। না খেয়ে কাটাল দিনের পর দিন। শিশুসন্তানকে বিদায় দিল। তবুও দেশপ্রেম জয়ী হলো। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ এক দিনের জন্য বন্ধ থাকল না। মাইনাস ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রায়ও জীবন থেমে থাকল না। খুব ভোরে দেখি আমাদের ট্রেন মস্কোভস্কি রেলস্টেশনে প্রবেশ করছে। অবশেষে আমরা এসে পৌঁছালাম লেনিনগ্রাদ শহরে। রেলস্টেশন থেকে হাঁটাপথে হোটেল। কিছুক্ষণ পর প্রাতরাশ। তারপর লেনিনগ্রাদ শহর ঘুরে দেখার পালা। প্রথম গন্তব্যস্থান নিভা নদীর কূলে নোঙর করা যুদ্ধজাহাজ ‘অরোরা’। জাহাজটির নির্মাণ তারিখ ১৮৯৭ থেকে ১৯০০ সালের মধ্যে। ১৯০৫ সালে রুশ-জাপান যুদ্ধে জাহাজটি অংশ নিয়েছিল। ১৯১৭ সালের ২৫ অক্টোবর এই জাহাজের কামান থেকে করা ফাঁকা গুলি ছিল বলশেভিক বিপ্লবের সংকেত। কামানের সেই সংকেত পেয়ে শ্রমিক ও পেত্রগ্রাদের মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বিপ্লবে। শীতকালীন প্রাসাদে সে সময় অবস্থান করছিল রাশিয়ার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। প্রাসাদ দখল করতে কোনো প্রতিরোধের মুখোমুখি হতে হয়নি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সব মন্ত্রীকে গ্রেপ্তার করা হলো। পতন হলো রাশিয়ার বুর্জোয়া সরকারের। এভাবে যুদ্ধজাহাজ অরোরা ইতিহাসে রেখে গেল বিশেষ অবদান। বলশেভিক বিপ্লবে তার এই অবদান লিপিবদ্ধ আছে ইতিহাসের পাতায়। সিনেমায় তাকে দেওয়া হয়েছে বিশেষ গুরুত্ব। জাহাজের ভেতরে ঢুকি। সবই ঝকঝকে পরিষ্কার। আমাদের গাইড বলল, কামানটি নাকি এখনো ঠিক তাক করে আছে শীতকালীন প্রাসাদের দিকে। অনেকে ইতিহাসের এই বর্ণনাকে সত্যি বলে গ্রহণ করেন না। তাঁদের ধারণায়, শ্রমিক ও সৈনিকের বাহিনী ঠিক এভাবে দল বেঁধে অরোরার সঙ্গে সময়কে মিলিয়ে শীতকালীন প্রাসাদ আক্রমণ করেনি। যা-ই হোক, সেটি বড় কথা না। বড় কথা হলো আমার মন তখন চলে গেছে ১৯১৭ সালের সেই উত্তাল তরঙ্গে বাঁধা সময়ে।

পরের দিন লেনিনগ্রাদ শহর ঘুরে দেখার পালা। আমরা এলাম রাশিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় জার পিটারের মূর্তির কাছে। এই মূর্তিকে বলা হয় মেদনি ভসাদনিক। তার অর্থ ধূসর ঘোড়সওয়ার। পিটার ছিলেন এক অদ্ভুত শাসক। তাঁর রাজত্বকাল ছিল ১৬৭২ থেকে ১৭২৫ সাল পর্যন্ত। নেভা নদীর ধারে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল মূর্তিটি। তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে তাঁকে নিয়ে ভাবি। ভাবি রুশ জাতির সম্মান ও গৌরব বৃদ্ধির জন্য তাঁর মতো অন্য কোনো জার অবদান রেখে গেছেন কি না। জারদের মধ্যে একমাত্র তিনিই গণমানুষের ক্রোধের সম্মুখীন হননি। রাশিয়াকে তিনি বিশাল সাম্রাজ্যে পরিণত করতে চেয়েছিলেন এবং সফল হয়েছিলেন। রাশিয়ার অর্থনীতি ও প্রযুক্তিগত বিকাশ এবং জাহাজশিল্পের অগ্রগতির জন্য পাশ্চাত্যের দ্বারস্থ হতে তিনি দ্বিধা করেননি। তাঁর হাতে ঘটেছিল রাশিয়ার সাংস্কৃতিক বিপ্লব। প্রাচীন রুশ জাতির নানা মূল্যবোধকে প্রতিস্থাপিত করে তিনি ইউরোপীয় রেনেসাঁ এবং এনলাইটেনমেন্ট যুগের ভাবধারার সঙ্গে তাল মিলিয়ে রাশিয়াকে দিয়েছিলেন বদলে। রুশ সেনাবাহিনীর পোশাক জার্মান সেনাবাহিনীর আদলে রাখতে দ্বিধা করেননি। সাধারণ মানুষের ঐতিহ্যবাহী রুশ পোশাকের বদলে ইউরোপীয় ধাঁচের পোশাক পরার আবেদন তার মধ্যে ছিল। যেসব স্বপ্ন তাঁর মনকে বেঁধে রেখেছিল সেগুলোর রূপায়ণে তিনি কুণ্ঠিত হননি। তিনি জানতেন রাশিয়ার কোনো সামুদ্রিক বন্দর নেই। দক্ষিণে কৃষ্ণসাগর এবং কাস্পিয়ান সাগর অটোমানদের দখলে। উত্তরে বাল্টিক সাগর সুইডেনের প্রভাবে। বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে রয়েছে কেবল আরখাঙ্গেলস্ক দিয়ে হোয়াইট সাগরে ঢোকার সামান্য ব্যবস্থা। সেটি বুঝে তিনি শক্তিশালী নৌবাহিনী গড়ে তোলার কাজে মন দিয়েছিলেন। ১৬৯৮ সালে অটোমানদের পরাজিত করে তাগানরোগে একটি সামুদ্রিক ঘাঁটি এবং বন্দর গড়ে তুলেছিলেন। ছদ্মবেশ নিয়ে গিয়েছিলেন ইউরোপে। হল্যান্ডে পৌঁছে নৌবিদ্যাশাস্ত্রে জ্ঞান লাভ করেছিলেন রাশিয়ার জন্য বৃহত্ আকারের জাহাজ নির্মাণের আশা নিয়ে। সেই বিদ্যা তিনি শিখেছিলেন ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সহায়তায়। তাঁর সঙ্গে ছিল একদল বিশেষজ্ঞ। তাঁদের নিয়ে তিনি ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন। অক্সফোর্ড থেকে শুরু করে নানা জায়গায় প্রত্যক্ষ জ্ঞান অর্জন করে তবেই ফিরেছিলেন দেশে। সেই জ্ঞান ব্যবহার করেছিলেন রাশিয়ার উন্নয়নের কাজে। ভাবি, একটি দেশকে গড়তে হলে এ ধরনের সুদূরপ্রসারী চিন্তাশীল নেতৃত্বের কত প্রয়োজন। সামন্ততান্ত্রিক রাশিয়াকে বদলে দিয়ে নতুন সমাজ গড়ার আকাঙ্ক্ষা হঠাত্ করে লেনিনের মাথায় আসেনি। পিটার দ্য গ্রেটের মতো ইতিহাসের অনেক ব্যক্তিত্ব সেখানে অবদান রেখে গেছেন কিছুটা হলেও।

এবার পেত্রোদ্ভরেস্তে যাওয়ার পালা। লেনিনগ্রাদ থেকে পঁচিশ কিলোমিটার দূরে। বাসে করে আমাদের যাত্রা শুরু হলো। সেখানে জার পিটারের আমলের একটি প্রাসাদ রয়েছে। একে অনেকে বলেন পিটারগফ। প্রাসাদটিকে অনেকে তুলনা করেন ফ্রান্সের ভার্সাই প্রাসাদের সঙ্গে। ফিনল্যান্ড উপসাগরের একেবারে পাশে তার অবস্থান। বতর্মানে ইউনেসকোর সংরক্ষিত একটি নিদর্শন। এই প্রাসাদ থেকে সমুদ্রে যাওয়ার একটি প্রশস্ত খাল খনন করা হয়েছিল। এখানে আছে অজস্র ফোয়ারা, যার মধ্যে সবচেয়ে বড়টি হচ্ছে স্যামসন ফোয়ারা। পাশেই রয়েছে চার্চ। কিন্তু রাজপ্রাসাদকে যে মনোযোগ দিয়ে সাজিয়ে রাখা হয়েছে তার বিন্দুমাত্র দেওয়া হয়নি ওই চার্চের প্রতি। ধর্মের প্রতি এই আচরণ অক্টোবর বিপ্লবের জন্য কালো অধ্যায় হয়ে আছে। অক্টোবর বিপ্লব ধর্মকে একবারে ভিন্ন দৃষ্টি দিয়ে দেখতে শিখিয়েছিল। রাষ্ট্রের পরিচালনায় এক বিশেষ অভিযান চলেছিল, যে অভিযানে ধর্মকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা নেওয়া হয়েছিল। উগ্র নাস্তিকতাবাদ কোনো আকস্মিক প্রবণতা বলা ঠিক হবে কি না, জানি না। সেটি কমিউনিস্ট নীতির কেন্দ্রীয় প্রত্যয় কি না, সেটিও সঠিক করে বলা কঠিন। শুনেছি বিপ্লবের পর সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় স্কুলের সিলেবাস থেকে ধর্মকে বাদ দিয়েছিল। ধ্বংস করা হয়েছিল প্রায় সব গির্জা এবং ধর্মমন্দির। তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা ছাড়াও হাজার হাজার বিশপ ও ধমর্যাজক প্রাণ হারিয়েছিলেন গোয়েন্দা সংস্থার হাতে। পরবর্তী সময়ে সেগুলোকে নাকি পরিণত করা হয়েছিল গণশৌচাগারে। নানা ধরনের প্রচারধর্মী সংগঠন গড়ে উঠেছিল। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ‘লিগ অব দ্য গডলেস’। চার্চ বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হলে মানুষের মনে ধর্মের প্রভাব কমে আসবে—এই ধারণা সোভিয়েত বিপ্লবের পর বেশ জোরদার হয়েছিল। কিন্তু সোভিয়েত রাষ্ট্র যখন দেখল সেটি বাস্তবে ঘটছে না, তখন রাষ্ট্রের চেষ্টা বাড়ল আরও এক দফা। ১৯৩৬ থেকে ১৯৩৭ সালের মধ্যে স্তালিন নাকি কয়েক হাজার বিশপকে হত্যার আদেশ দিয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালের একটি পোস্টার আমার মনে পড়ে। পোস্টারটিতে একজন মহাকাশচারী বলছেন, ‘আমি তো মহাকাশে ঘুরেছি অনেক। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার সাক্ষাত্ পাইনি।’ আজ বিপ্লবের এক শ বছর কেটে গেছে। রাশিয়ার অর্থোডক্স চার্চ ধর্মবিশ্বাসীদের ভিড়ে পরিপূর্ণ। কী কারণে ধর্মের প্রতি মানুষের আকর্ষণ, তার কারণ হয়তো এই যে ধর্মীয় অভ্যাস ও অভিজ্ঞতা মানুষের প্রকৃতিগত।

লেনিনগ্রাদের হেরমিটেজ জাদুঘর পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তর। সেখানে সংরক্ষিত রয়েছে ৩০ লাখ ঐতিহাসিক চিত্রকলা এবং অন্যান্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। প্রতিটির সামনে যদি এক মিনিট করেও সময় ব্যয় করি তাহলে পুরো জাদুঘর দেখতে আমার লাগবে এগারো বছর। এগুলো সব রাখা হয়েছে ৩০০টি হলঘরে। জাদুঘরটি জার রোমানভের শীতকালীন প্রাসাদে অবস্থান নিয়ে আছে। এখানে আছে খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীর গ্রিক সিন্থিয়ান স্বর্ণের নানা দ্রব্য। আছে পিকাসোর ব্লু পর্যায়ের চিত্রকলা (১৯০১-১৯০৪ সালের শৈল্পিক কাজ যেখানে পিকাসো ব্যবহার করেছেন নীল ও হালকা সবুজ রং)। আছে রেম্ব্রান্ত টিসিয়ান, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি অথবা মাইকেলেঞ্জেলোর কাজ। আছে ব্রিটিশ শিল্পীদের কাজ। আছে ইমপ্রেশনিস্ট, পোস্ট ইমপ্রেশনিস্ট এবং আধুনিককালীন ধারার শিল্পকর্ম। তাদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত মনে, সিজান, ভ্যান গঘ, গগুইন ও ম্যাতিস। এই সংগ্রহ শুরু হয়েছিল ৩০০ বছর আগে। পিটার দ্য গ্রেট ইউরোপ থেকে নানা ধরনের শিল্পকর্ম নিয়ে এসেছিলেন। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ক্যাথেরিন দ্য গ্রেট নিজে কিনেছিলেন রেনেসাঁ যুগের নানা কাজ। ১৮৫২ সালে জার প্রথম নিকোলাস এই প্রাসাদকে জাদুঘরের মর্যাদা দিয়েছিলেন। কেবল ১৯১৭ সালের পর জাদুঘরটি রাষ্ট্রের অধীনে আসে এবং সাধারণ মানুষের জন্য তার দরজা খুলে দেওয়া হয়। অনেকে বলেন, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় রুশ সেনাবাহিনী অনেক শিল্পকর্ম ড্রেসডেন বা অন্যান্য শহর থেকে নিয়ে এসেছিল, যেগুলো এখন এখানে প্রদর্শিত হচ্ছে।

জাদুঘর থেকে বেরিয়ে নিয়েভস্কি প্রসপেক্তের দিকে এগোচ্ছি। দৃষ্টিতে ধরা পড়ল প্রশস্ত এক সড়কপথ। দুই ধারে বিলাসী হাতে গড়া নানা ভবন, অট্টালিকা, দোকানপাট। সেখানে কেটে গেল প্রায় অর্ধেক বেলা। রাস্তাটি নেভস্কি নামে এক রুশ যুবরাজের নামে। তিনি ছিলেন নভগোরদের শাসক। সুইডিশ ও জার্মান বাহিনী নভগোরদ রাজতন্ত্রকে বিভিন্ন সময়ে আক্রমণ করেছে। বিভিন্ন সময়ে ওই রাজতন্ত্র কাটিয়েছিল দুর্যোগময় সময়। কিন্তু যুবরাজ শক্ত হাতে বহিঃশত্রুর আক্রমণকে প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। প্রশস্ত সড়কটি লেনিনগ্রাদের সাংস্কৃতিক জীবনের কেন্দ্রবিন্দু। রাস্তাটির প্রণেতা ছিলেন পিটার দ্য গ্রেট। এই সড়ক দিয়ে যেতে হয় মস্কো কিংবা নভগোরদ। তার ওপর আছে বিখ্যাত কাজান চার্চ। অষ্টাদশ শতাব্দীর শপিং মল। জাতীয় গ্রন্থাগার। রুশ সাহিত্যিক নিকলায় গোগোল এই নেভস্কি প্রস্পেক্ত সম্পর্কে গল্প লিখেছিলেন। সেখানে তিনি দক্ষ হাতে তুলে ধরেছিলেন রাশিয়ায় পুঁজিবাদের উত্থানকে। সে সঙ্গে মানুষের জীবনে প্রেম এবং ভালোবাসাকে। দস্তয়েভস্কির ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্টও লেখা হয়েছিল এই প্রস্পেক্তকে ঘিরে। ঊনবিংশ শতাব্দীর রুশ লেখকেরা যে ক্যাফেতে সমবেত হতেন সেটি চালু আছে এখনো। সেন্ট পিটার্সবার্গ ভ্রমণ করে জারের ক্ষমতার নানা নিদর্শন প্রত্যক্ষ করলাম। সেই সঙ্গে চোখ জুড়িয়ে গেল মানুষের হাতে গড়া বিশাল এক শৈল্পিক ভান্ডার দেখে। সেখানে সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার ছিল না। অথচ তাদের শ্রমের ফসল দিয়ে জার গড়ে তুলেছিলেন বিপুল ধনসম্পদ এবং নয়নভোলানো রাজপ্রাসাদ। মনোরঞ্জনের জন্য তৈরি করেছিলেন থিয়েটার ও জাদুঘর। সবই রাজতন্ত্র এবং অভিজাত শ্রেণির প্রয়োজনে। সাধারণ রুশ নাগরিকের জীবনকে উপেক্ষা করে।

যে সামাজিক বৈষম্য রুশ সমাজে স্থান করে নিয়েছিল তার প্রতিফলন দেখি ঊনবিংশ শতাব্দীর রুশ সাহিত্যে। কল্পনায় নানা চরিত্রের সমাবেশ ঘটিয়ে পুশকিন, তলস্তয়, লেরমন্তভ, দস্তয়েভস্কি, চেখভ, তুরগেনিয়েভ, চেরনশেভস্কির মতো মহান কথাশিল্পীরা তাঁদের কারুকার্যময় সাহিত্যকর্মে রেখে গেছেন নানা দিকনির্দেশনা। তাঁদের সাহিত্যকর্মকে যখন বলশেভিক বিপ্লবের পাশে রাখি এবং তুলনা করি বিপ্লবোত্তর রুশ জীবনকে, তখন তার মধ্যে খুঁজে পাই বলশেভিক বিপ্লবের দুর্বল ও সবল দিকগুলো। পুশকিনের কবিতায় দেখি মুক্ত মানুষের নানা আকাঙ্ক্ষা যা জারের রাশিয়ায় প্রায় নিষিদ্ধ ছিল বলা চলে। তাঁর লেখা ‘বরিস গদুনভ’ ছিল এ ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র। সেখানে পুশকিন দেখিয়েছেন শাসক এবং সাধারণ মানুষের সম্পর্ক কত নিষ্ঠুর হতে পারে। ইফগেনি আনেগিন তাঁরই লেখা একটি কবিতার বই। জীবনে প্রেমের স্থান সেখানে জুড়ে আছে সবটুকু। কিন্তু তার মধ্য দিয়ে পুশকিন এঁকেছেন অত্যাচারী সমাজের চিত্র। সে দিক থেকে ভাবলে পুশকিন ছিলেন একজন বিদ্রোহী কবি। ক্যাপ্টেনের মেয়ে তিনি লিখেছিলেন পুগাচভের বিদ্রোহ নিয়ে, যা কিনা রুশ বিপ্লবীদের উত্সাহিত করেছিল। এটি তিনি লেখেন ১৮৩৬ সালে। দ্বিতীয় ক্যাথেরিনের শাসনকালে ১৭৭৩ থেকে ১৭৭৫ সালের মধ্যবর্তী সময় পর্যন্ত ইমিলিয়ান পুগাচভের বিদ্রোহ চলেছিল। সে সময় রাশিয়ায় কৃষক অসন্তোষ তুঙ্গে। পাশাপাশি চলছে অটোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। সব মিলিয়ে রুশ জীবন সে সময় ছিল বেশ জটিল। ১৮২৫ সালে জারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভকারী ডিসেম্বরিস্টদের নিয়ে তাঁর একটি লেখা আছে। সেখানে আছে স্বাধীনতা ও ব্যক্তিত্ব বিকাশের কথা। তিনি নিজে ডিসেম্বরিস্টদের আদর্শের মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

ঊনবিংশ শতাব্দীর রুশ সাহিত্যের বড় দিক হচ্ছে, দেশটির নানা কোণ থেকে এসেছিলেন রংবেরঙের নানা সাহিত্যিক। হয়তো সে কারণে তাঁদের কাজে লক্ষ করি জীবনকে তুলে ধরার নানা ঢং। তাঁদের লেখনীর বিষয়বস্তু ভিন্ন। প্রত্যেকে জীবনের অন্তর্নিহিত সত্যকে উন্মোচন করেছেন নানা পথে। রাশিয়ার দক্ষিণ প্রান্তের প্রত্যন্ত শহর তাগানরগে চেখভ এঁকেছেন নানা মানুষের চরিত্র। তুরগেনিয়েভ জীবনের বড় সময় কাটিয়েছেন প্যারিসে। এঁদের শৈল্পিক প্রকাশভঙ্গির পার্থক্য চোখে পড়ার মতো। প্রখ্যাত কবি পুশকিন তাঁর কবিতার পঙিক্ত দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন রাশিয়ার ওই সময়কার জীবন। দস্তয়েভস্কি মানুষের মনস্তাত্ত্বিক জগতের অন্তর্নিহিত প্রবণতা এঁকেছেন নানা মাধ্যম ব্যবহার করে। তলস্তয় ব্যবহার করেছেন বিশাল ক্যানভাসে আঁকা বহু চরিত্রের জীবন থেকে নেওয়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনা। চেখভ এঁকেছেন সাধারণ জীবনের ঘটনাবলি, যার মধ্য দিয়ে উন্মোচন করেছেন জীবনের গভীর সত্যকে। তাঁর গল্পে প্লট মুখ্য নয়। তার চেয়ে তিনি জোর দিয়েছেন ব্যক্তির মেজাজ ও চরিত্রের ওপর। তাঁর গল্পে লক্ষ করি ধনী এবং আপাতদৃষ্টিতে সফল মানুষের ব্যথা, রোগ, শোক এবং জীবনের অবশ্যম্ভাবী ব্যর্থতার কাহিনি। সেখানে লিপিবদ্ধ আছে কীভাবে সেগুলোর সঙ্গে ওই মানুষগুলো সংগ্রাম করে এবং টিকে থাকে। ট্র্যাজেডি এবং কমেডির সংমিশ্রণে তিনি গড়ে তুলেছেন অপূর্ব সাহিত্যকর্ম। অন্যদিকে তলস্তয়ের লেখায় প্রতিফলিত হতে দেখি তাঁর নিজের পারিপার্শ্বিকতা। গ্রামীণ জীবনের বাস্তবতা। কৃষকের সুখ-দুঃখের কাহিনি।

রাশিয়ার তুলা শহরের পাশেই ইয়াসনায়া পলিনা নামের গ্রাম। সেখানেই তলস্তয়ের আদি গৃহ। ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বছর শেষ হওয়ার বেশি বাকি নেই। আমাদের ভাষা শিক্ষক শেষ দুই দিন দুটি ট্যুরের ব্যবস্থা করেছিলেন। একটি তলস্তয়ের বাড়িতে, যেটি এখন রাষ্ট্রীয় জাদুঘর। অন্যটি দস্তয়েভস্কির জাদুঘর, যেটি মস্কোতে অবস্থিত। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি মস্কো থেকে ২০০ কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দিয়ে সকাল ১০টার দিকে তলস্তয়ের বাড়িতে পৌঁছাল। হেঁটে চলেছি তলস্তয়ের জমিদারবাড়ির দিকে। দুপাশে বারচের বনরাশি। তার গা ঘেঁষে সবুজ ঘাসের বিস্তীর্ণ মাঠ। হৈমন্তিক শিশিরে ভেজা ওই মাঠের পাশ দিয়ে চলে গেছে আঁকাবাঁকা রাস্তা। বিশ মিনিট হাঁটার পর চোখে পড়ল তলস্তয়ের গৃহ। কী অপূর্ব পরিপাটি করে সাজানো তাঁর নামের এই জাদুঘরটি। তলস্তয়ের স্মৃতি সেখানে মিশে আছে প্রতিটি কোনায়। আমাদের গাইড সবাইকে জড়ো করলেন একটি কক্ষে। সেখানে পরিচিত হলাম তলস্তয়ের জীবনের নানা জানা-অজানা কথার সঙ্গে। এখানেই তিনি রচনা করেছিলেন তাঁর বিখ্যাত সব সাহিত্যিক কর্ম ওয়্যার অ্যান্ড পিস, আন্না কারেনিনা বা ভস্ক্রিসেনিয়ে।

তলস্তয়ের এই বইগুলো আমি পড়েছি। প্রতিটির মধ্যে লক্ষ করেছি গভীর অন্তর্ভেদী দৃষ্টি দিয়ে আঁকা মানুষের সাধারণ জীবনের খুঁটিনাটি দিক তুলে ধরার অপূর্ব কৌশল। ভাবি, নিশ্চয় কাজান বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে অধ্যয়নের প্রভাব তাঁর লেখায় প্রতিফলিত হয়েছে, যেখানে ফরাসি দার্শনিক মন্তেস্কুর আইনতত্ত্বকে তিনি তুলনা করেছিলেন ক্যাথেরিন দ্য গ্রেটের লেখা নাকাজ নামের আইনি রচনার সঙ্গে। তার প্রতিফলন লক্ষ করেছি ভস্ক্রিসেনিয়া বা ‘পুনরুজ্জীবন’ নামের সাহিত্যকর্মে। সেখানে নিখলুদভ নামের এক জমিদারপুত্র দরিদ্র এক চাকরানিকে বশীভূত করেছিলেন। অপরাধের শাস্তি হিসেবে মাস্লভা বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়। মেয়েটি পরে বেশ্যাবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়েন। নিখলুদভের সঙ্গে তাঁর দেখা হয় কোর্টে। সেখানে তিনি জুরির সদস্য, যে জুরি বিচার করবেন মাইস্লভকে অন্য এক অপরাধের জন্য। নিখলুদভের মন অনুশোচনায় ভরে যায়। নিজ অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে তিনি সিদ্ধান্ত নেন মাইস্লভের সঙ্গে সাইবেরিয়ায় নির্বাসনে যাওয়ার। তলস্তয় এখানে নিপুণ হাতে এঁকেছেন রাশিয়ার বিচারব্যবস্থার অবিশ্বাস্য মিথ্যাচারকে। কারাগারের অবর্ণনীয় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। খ্রিষ্টধর্মের অনুশোচনার তত্ত্বকে ব্যবহার করে সামাজিক অসাম্য এবং শোষণের প্রতিকার আশা করেছেন। কিন্তু একই সঙ্গে অনুভব করেছেন ওই তত্ত্বের অসারতা। রাশিয়ার পর্বতপ্রমাণ সমস্যা সমাধানে সেটি কতটুকু কার্যকর, সেটি তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। রচনাটির জনপ্রিয়তা এতই ছিল যে তাঁর বিক্রি ওয়্যার অ্যান্ড পিস কিংবা আন্না কারেনিনার বিক্রি মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ওয়ার অ্যান্ড পিসে ভিন্ন দিক থেকে উন্মোচিত হতে দেখি তলস্তয়ের মেধা। সেখানে তিনি তুলে ধরেছেন মানুষের বুদ্ধির সীমাবদ্ধতাকে। যেকোনো যুদ্ধ হচ্ছে তাঁর ধারণায় বিশৃঙ্খলা ছাড়া কিছু না। যত পরিকল্পনা করি না কেন, যুদ্ধের ফলাফল নির্ভর করবে সুযোগের ওপর। এ থেকে তিনি ধারণা করেছিলেন নির্দিষ্ট কোনো মডেল দিয়ে মানুষের জীবনকে আঁকা সম্ভব না। কারণ ইতিহাস কোনো সূত্র মেনে চলে না এবং সে কারণে ইতিহাসে ধারাবাহিকতা বলে কিছু নেই। নেই ঐতিহাসিক অবশ্যম্ভাবিতা বলে কিছু। তাঁর ধারণায় মহান মানুষের চিন্তা দিয়ে নির্মিত হয় ইতিহাস। সাধারণ মানুষও প্রাত্যহিক জীবনে যেসব ক্ষুদ্র সিদ্ধান্ত নেয়, সেটিও সাহায্য করে ইতিহাসের বৃহত্তর ধারার গঠনে। সত্যকে তিনি দেখেছেন একেবারে অসনাতনী দৃষ্টিকোণ থেকে। তাঁর মতে, সত্য কোনো সুনির্দিষ্ট কাঠামো থেকে মেলে না। দৈনন্দিন জীবনই বলে দেয় কোনটি সত্য, কোনটি মিথ্যা। তলস্তয় বা দস্তয়েভস্কি পড়ে আমার একটিই ধারণা হয়েছে। লেনিন, ট্রটস্কি বা অন্যান্য রুশ বিপ্লবী রুশ সাহিত্য অধ্যয়ন করেছেন ঠিকই। উচ্ছ্বসিত প্রশংসাও করেছেন। বিশেষ করে চেরনশেভস্কির হোয়াট ইজ টু বি ডান? অথবা তলস্তয়, দস্তয়েভস্কি, চেখভের সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী দিকগুলোকে। ভালোবেসেছেন জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে তাদের দেওয়া বক্তব্যকে। জারের বিচার বিভাগের অন্তসারশূন্যতাকে। অথবা ভূমিদাসের অধিকার নিয়ে লেখাগুলোকে। কিন্তু একই সঙ্গে তাঁরা উপেক্ষা করেছেন মানুষের মনোজগতের অন্তর্নিহিত সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো, যার প্রতি রুশ বিপ্লব নজর দিতে ভুলে গেছে। অথচ বিপ্লবের সব আয়োজন তো কেবল মানুষের কল্যাণের লক্ষ্য নিয়ে। রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তি সেখানে বড় না। দার্শনিক রচনা এবং ইতিহাসের সূত্র অনুসন্ধান করাও তার একমাত্র লক্ষ্য হিসেবে ভাবা কঠিন। শত সহস্রবার নানা শৈল্পিক মাধ্যমে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার পরও বলশেভিক বিপ্লবের নেতারা এই দিকটি কেন উপেক্ষা করলেন, তার তাত্ক্ষণিক যৌক্তিকতা খুঁজে পাইনি।

এবার মস্কোতে অবস্থিত প্রখ্যাত সাহিত্যিক ফিওদর দস্তয়েভস্কির জাদুঘর দেখার পালা। জাদুঘরটি মস্কোর দস্তয়েভস্কি লেনে। জীবনের বেশির ভাগ সময় তিনি সেন্ট পিটার্সবার্গে কাটালেও দস্তয়েভস্কির জন্ম এই মস্কো শহরে। এর আগে ঘুরে এসেছি লেনিনগ্রাদের কুজনেতস্কি লেনের দস্তয়েভস্কি জাদুঘরটি। যে ফ্ল্যাটে দস্তয়েভস্কি বসবাস করতেন সেটিই আজ এই অত্যন্ত প্রতিভাবান সাহিত্যিকের জাদুঘর হিসেবে পরিচিত। সেখানে তিনি স্ত্রী আন্না স্নিটকিনার সঙ্গে কাটিয়েছিলেন দীর্ঘকাল। সেখানে আছে নানা সময়ে তোলা দস্তয়েভস্কির ছবি। ব্যক্তিগত ব্যবহারিক জিনিসপত্র। আমাদের ট্যুর গাইড বললেন, ‘ওই দেখো ওখানে এই বাড়ির পাশে একটি মর্গ ছিল। সেখানে লাশ কাটা হতো। আর তার পাশেই ছিল একটি পাগলাগারদ।’ মনে পড়ল এই দুই প্রতিষ্ঠানের প্রভাব দস্তয়েভস্কির লেখায় কি সুস্পষ্টভাবেই না প্রতিফলিত হয়েছে। অজান্তেই মনে এল দস্তয়েভস্কির ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট, যেখানে রয়েছে চশমখোর বৃদ্ধ এক নারীর হত্যাদৃশ্য। খুনির মানসিক ও মনস্তাত্ত্বিক প্রবণতাগুলোর সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ। সেই ধারায় সাহিত্য রচনাকে অনেকে অবশ্য পছন্দ করেননি। সামাজিক ইস্যুগুলোকে তিনি উপেক্ষা করছেন। তাঁদের প্রতি যতটুকু গুরুত্ব সমকালীন সাহিত্যিকেরা তাঁর থেকে আশা করেছিলেন সেটুকু তাঁর লেখায় স্থান পাচ্ছে না, এ ধরনের অভিযোগ অনেকেই করেছিলেন। লেখক তুরগেনিয়েভ তাঁর প্রবন্ধে এই অভিযোগ তুলেছিলেন। তত্কালীন সাহিত্য সমালোচকদের মধ্যে প্রথিতযশা বিলিন্সকির লেখায় একই সমালোচনা বারবার ঘুরেফিরে এসেছে। মানুষের মনস্তাত্ত্বিক জগতের ওপর দস্তয়েভস্কি কেন গুরুত্ব দিয়েছিলেন, তার কারণ খুঁজে পাই তাঁর দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে। সেই দৃষ্টিভঙ্গির অনেকটাই তৈরি হয়েছিল তাঁর জীবন অভিজ্ঞতা থেকে। তিনি বিপ্লবী তত্পরতা থেকে দূরে ছিলেন না, যদিও বুদ্ধিজীবীরা বিপ্লবকে যেভাবে দেখেছিলেন তিনি ছিলেন তাঁর বিরোধী। বিপ্লবী তত্পরতায় অংশ নেওয়ার অপরাধে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন। মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের দিন ঠিকই তাঁকে নেওয়া হলো ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে। গুলির ঠিক আগ মুহূর্তে এল জারের ক্ষমা। জীবন ও মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে যে মনস্তাত্ত্বিক ঝড় তাঁর মনের ওপর দিয়ে বয়ে গিয়েছিল, সেটি তাঁর লেখায় তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন জীবনের জটিল প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে। জীবনের মূল্য কতটুকু, সেটি তিনি বুঝেছিলেন অত্যন্ত নিবিড়ভাবে। তাঁর লেখা উপন্যাস দ্য ইডিয়ট-এ সেটি লক্ষ করা কঠিন না। সেখানে আমি তলস্তয়ের সঙ্গে তার মনোগত কিছু সাদৃশ্যের দিকও লক্ষ করেছি। বিপ্লবী তত্ত্বের বস্তুবাদী বা ইতিহাসের পূর্বনির্ধারণবাদের বিরুদ্ধে তিনি কেন দাঁড়িয়েছিলেন, সেটি বোঝা কঠিন না। জন্ম ও মৃত্যুর মধ্যে যে সূক্ষ্ম ভেদরেখা তার সীমান্তে এসে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন। মৃত্যুর হাত থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন দৈবক্রমে। সেই শিউরে ওঠা অনুভূতির জাল তাঁকে আবিষ্ট রেখেছিল জীবনের বাকি দিনগুলো।

ফায়ারিং স্কোয়াডের হাত থেকে তিনি রক্ষা পেয়েছিলেন ঠিকই। কিন্তু সাইবেরিয়ায় নির্বাসন থেকে রক্ষা পাননি। সেখানকার অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি লিখেছিলেন দ্য হাউস অব দ্য ডেড। তলস্তয়ের মতো এখানেও তিনি ব্যক্তিস্বাধীনতার ওপর জোর দিয়েছেন। তার মধ্যেই দেখেছেন মনুষ্যত্বের প্রকৃত রূপকে। সেখানে তিনি আরও লিখেছিলেন দ্য নোটস ফ্রম আন্ডারগ্রাউন্ড। এটিও দস্তয়েভস্কির দার্শনিক মনোজগেক বোঝার একটি উপযুক্ত রচনা। সেখানে তিনি বুদ্ধিদীপ্ত আক্রমণ চালিয়েছেন বিপ্লবী ও উগ্রপন্থীদের বিরুদ্ধে। লেনিনের মতো বিপ্লবীরাও দাবি করেছেন মানুষ তার ধীশক্তি দিয়ে প্রকৃতি এবং মনোজগতের সবকিছু বুঝতে পারে। সেই আশাবাদ আমি দেখেছি লেনিনের লেখা মেটেরিয়ালিজম অ্যান্ড এম্পিরিও ক্রিতিসিজম নামের দার্শনিক রচনায়। ইতিহাসের অবধারিত রায় সম্পর্কে মানুষ জানতে পারে। ইতিহাসের গতিধারা কী, সেটিও মানুষ তার মেধা দিয়ে নির্দিষ্ট করতে পারে। সেই ধরনের আত্মপ্রত্যয়ী দৃষ্টিভঙ্গি আমি লক্ষ করেছি মার্ক্স বা এঙ্গেলসের রচনায়। রুশ বিপ্লবীরা সেই ধারার পথিকৃত্ ছিলেন। তাঁরা ভেবেছিলেন, ব্যক্তির মনস্তত্ত্বকে বোঝা কঠিন না। কারণ ব্যক্তির মনোজগত্ বস্তুজগতের নিয়মতান্ত্রিকতার মতো করে চলে নির্দিষ্ট আইনের অধীনে। ইতিহাসও চলে আইন দিয়ে। এই ধারণাই কিন্তু ইউটোপীয় আদর্শভিত্তিক সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়ার ধারণাকে মূর্ত করে তুলেছিল। জাগিয়েছিল সেই আশাবাদ, যা দিয়ে তারা ভেবেছিল ইউটোপীয় কাল্পনিক জগতের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। সেই দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাবে বিপ্লবীরা ব্যক্তিস্বাধীনতাকে গুরুত্ব দেয়নি। ব্যক্তির সবকিছুই যদি ঐতিহাসিক আইনের আওতায় চলে, তাহলে তার স্বাধীনতার প্রশ্নটিও অবান্তর। ঊনবিংশ শতাব্দীর বিপ্লবীদের লেখায় বারবার এই ধারণাই প্রতিধ্বনিত হতে দেখি—সেই আইন জানো যে আইন দিয়ে সমাজ পরিচালিত হয়। যে আইন দিয়ে মানুষের প্রকৃতির অন্তর্নিহিত দিকগুলো ফুটে ওঠে। অথচ সেটি যে একমাত্র সত্য, তা তো না। যার প্রমাণ তলস্তয় বা দস্তয়েভস্কির লেখা।

দস্তয়েভস্কি তাঁর ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্টকে নিজের দার্শনিক অবস্থানের একটি বিবৃতি হিসেবে দেখেছিলেন। এই সাহিত্যকর্মে তিনি আক্রমণ করেছেন সব প্রচলিত বিশ্বাসবোধকে। বাতিল করে দিয়েছেন সব প্রত্যয়কে, যে প্রত্যয়গুলো এতকাল ধরে আমরা সভ্যতার মূল ভিত হিসেবে দেখেছি। সেই প্রত্যয়ের দুটি উদাহরণ হতে পারে ভালো ও মন্দের ধারণা। আমরা ধরেই নিয়েছি ভালো বলে একটা কথা আছে। মন্দ বলেও একটা কথা আছে এবং তারা একে অপরের বিপরীত। সেই বিশ্বাস নিয়ে আমরা বলেছি সমাজে কিছু ভালো মানুষ আছে। আছে কিছু মন্দ মানুষ। এই পদ্ধতিকে প্রসারিত করে আরও ভাগ করেছি সমাজ ও জীবনের বাকি সবকিছুকে। আদর্শের দিক থেকে বলেছি, এটি ভালো আদর্শ, ওটি মন্দ আদর্শ। সমাজতন্ত্র ভালো, পুঁজিবাদ ভালো নয়। বৈপরীত্যের যে জগত্ আমরা সৃষ্টি করেছি এবং যার মধ্যে বাস করে গড়ে তুলেছি আমাদের ধ্যানধারণা, আদর্শ ও জীবনধারা দস্তয়েভস্কি তাকে দেখেছেন ধর্মীয় কুসংস্কার হিসেবে। ভালো ও মন্দের ধারণার প্রাচীন উত্স হচ্ছে ধর্মগ্রন্থ বাইবেল। কিন্তু মানুষের কাজে-কর্মে এই ভালো-মন্দের ধারণাটি যথেষ্ট আপেক্ষিক বলে প্রমাণিত হয়েছে। সোভিয়েত অভিজ্ঞতা থেকে আজ যদি বলি সমাজতন্ত্র মন্দ এবং পুঁজিবাদ ভালো তাহলে কি ভুল হবে? আজ যাকে ভালো বলে মনে করি আগামীকাল সেটি মন্দ হয়ে যায় কেন? ভালো-মন্দের ধারণা যদি সত্যি-মিথ্যা হয় তাহলে অপরাধবোধের ধারণাকেও বাতিল করতে হয়। সেভাবেই ভেবেছিলেন দস্তয়েভস্কি এবং বাতিল করতে চেয়েছিলেন মানুষসৃষ্ট এই প্রত্যয়গুলোকে। তার জায়গায় তিনি গুরুত্ব দিতে চেয়েছিলেন ব্যক্তির চারিত্রিক গুণাবলির প্রতি। সেই বিশ্বাসবোধকে অনুসরণ করে তিনি মানুষকে দুই গ্রুপে ভাগ করেছিলেন। একটি গ্রুপে তিনি রেখেছিলেন স্বল্পসংখ্যক অসাধারণ কিছু মানুষকে। তার বিপরীতে সাধারণ মানুষের

বিশাল বাহিনী। অসাধারণ মানুষ হিসেবে তিনি দেখেছিলেন ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ান, রোমান সম্রাট সলোন বা জুলিয়াস সিজারের মতো বীর পুরুষকে। তাঁরা অসাধারণ ব্যক্তিগুণ দিয়ে সমাজপ্রগতিকে এগিয়ে নেন। তাঁদের তুলনায় সাধারণ মানুষের ভূমিকা ইতিহাসে নগণ্য। তাঁদের কাজ মানবপ্রজাতির প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা। এই ধারণাই পরবর্তী সময়ে নিটসের মতো দার্শনিকের জন্ম দিয়েছিল। হিটলারও নিজেকে মহান এবং অসাধারণ ভেবে নিটসের দার্শনিক মতাদর্শকে সমর্থন করেছিলেন।

আরও এক চিন্তার ধারা দস্তয়েভস্কি গড়ে তুলেছিলেন। সেটি মানুষের আত্মহননকে নিয়ে। দ্য পজেজসড নামের রচনায় তিনি কেন আত্মহত্যাকে মহিমান্বিত করেছিলেন তার কারণ উল্লেখ করেছেন। তিনি দেখেছিলেন আত্মহত্যার প্রচেষ্টার মধ্যে কোনো ব্যক্তিস্বার্থ নেই। ফলে কাজটি একেবারে বিশুদ্ধ। আত্মধ্বংস মানুষকে মুক্ত করে সব সামাজিক বাধা এবং নিয়মতান্ত্রিকতা থেকে। সেটিই মানুষের সবচেয়ে বড় পাওয়া। ধারণাটি তিনি গড়ে তুলেছিলেন সাইবেরিয়ার নির্বাসন জীবনের দিনগুলোতে, কিন্তু কেন? তিনি কি ব্যক্তিস্বার্থের প্রবল স্রোতোধারার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেননি? করেছেন। ধারণাটি কি সমাজতান্ত্রিক সমাজের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য নয়? ব্যক্তিস্বার্থের কারণে কি কমিউনিস্ট আন্দোলন পথচ্যুত হয়নি। ধারণাটির সঙ্গে অদ্ভুত সাদৃশ্য লক্ষ করেছি শিয়া ইসলামে আত্মত্যাগের ধারণাটির সঙ্গে। মৃত্যুর সময়কে নিজের মতো করে নির্ধারণ করার স্বাধীনতা এবং কাজটির মধ্যে যে স্বার্থহীনতার দিক আছে সেটি দস্তয়েভস্কি লক্ষ করেছিলেন। জোর করে চাপিয়ে দেওয়া কোনো ধারণা বা বিশ্বাস-কাঠামোকে তিনি সুস্থ মনে করেননি। কারণ সব পরিকল্পিত ধারণা মানুষের ব্যক্তিত্বকে দমিয়ে রাখে। ধারণাগুলো রাজনীতির অঙ্গনে প্রয়োগ করার সাহস কারও হয়নি। দস্তয়েভস্কির চিন্তার জগতে ভাসমান সব ধারণার কিছু কিছু দিক সমসাময়িক বিপ্লবী যোদ্ধাদের মনে কোনো দাগ কাটেনি বলেই ধারণা করি। বলশেভিক বিপ্লবের ব্যর্থতার কারণ তার মধ্যে লুকিয়ে আছে কি না জানি না।

তিন

প্রায় এগারো বছর কেটে গেল রাজধানী শহর মস্কোতে। লেখাপড়া শেষ হওয়ার পথে। এই দীর্ঘ সময় আমি উরাল পর্বতমালার পশ্চিম অংশের প্রায় সব শহর এবং রিপাবলিক ঘুরে দেখেছি। দেখেছি ইউক্রেন, বেলারুশিয়া, মলদোভিয়ার নানা শহর। সোভিয়েত রাশিয়ার এই পশ্চিম অংশকে কেবল ইউরোপের অংশ হিসেবে দেখা হয়। বাকিগুলোকে ধরা হয় এশিয়ার অংশ হিসেবে। এই অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারটা কিন্তু ছোটখাটো কোনো জিনিস না। ভৌগোলিকভাবে কোন দেশকে কোন অঞ্চলে রাখা হবে বা রাখা হবে না প্রশ্নটি কিন্তু একান্তই রাজনৈতিক। সোভিয়েত ইউনিয়নকে ইউরোপে অন্তর্ভুক্ত না করার প্রধান কারণ হচ্ছে দেশটি সমাজতান্ত্রিক। ইউরোপ নামের যে ভূখণ্ডকে আজ আমরা জানি সেটি কিন্তু ইতিহাসের সব পর্যায়ে ওই নামে ছিল না। তার ভৌগোলিক সীমানাও সর্বক্ষেত্রে এক ও অভিন্ন থাকেনি। তার নামকরণের সঙ্গে গ্রিক পৌরাণিক বিশ্বাসজগতের সম্পর্ক রয়েছে, কিন্তু তবুও মধ্যযুগে তাকে বলা হতো ‘হোলি রোমান এম্পায়ার’। সেই এম্পায়ার ভেঙে পড়ার পর ছোট-বড় নানা দেশ নিয়ে ইউরোপ আত্মপ্রকাশ করল। অনেকেই সে সময় প্রশ্ন তুলেছিল ইতালি ও গ্রিসকে নিয়ে। তাদের ইউরোপের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা সঠিক মনে করেনি অনেকে। এই দেশগুলোর সঙ্গে মরক্কো, লিবিয়া, লেবানন বা তুরস্ক অর্থাত্ এশিয়া/উত্তর আফ্রিকার জনগোষ্ঠীর বিশেষ সাদৃশ্য রয়েছে। আবার অটোমান সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবে তারা মুসলিম সভ্যতারও অংশ। এই বাদ দেওয়া বা অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল রোম সাম্রাজ্য যখন পুব ও পশ্চিমে ভাগ হয়ে গেল তখন থেকে। রোমের পুব অংশ ইউরোপ কি না এ নিয়েও মতভেদ ছিল, যেহেতু তার রাজধানী কনস্টান্টিনোপল বা আজকের ইস্তাম্বুল। ফলে যা হওয়ার তা-ই হলো। ইউরোপ থেকে বাদ পড়ল তুরস্ক এবং পার্শ্ববর্তী আরও অন্যান্য দেশ।

তবে সে যা-ই হোক, আমার ভ্রমণ তালিকায় বাকি রয়েছে দুটি অঞ্চল। বাল্টিক সাগরের ধার ঘেঁষে তিনটি রিপাবলিক এবং মধ্য এশিয়ার মুসলিম রিপাবলিকগুলো। তিনটি বাল্টিক রিপাবলিকের (এস্তোনিয়া, লাটভিয়া ও লিথুয়ানিয়া) প্রতি আমার আগ্রহের অন্ত নেই। তারা সোভিয়েতের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর বিজিত দেশ হিসেবে। ফলে জানতে চেয়েছিলাম সেখানে জাতিগত অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নের সমাধান হয়েছে কি না এবং সোভিয়েত ব্যবস্থার প্রতি মানুষের মনোভাব কী। তবে এই তিনটি রিপাবলিককে সোভিয়েত ইউনিয়নের পশ্চিম অঞ্চল থেকে আমি পৃথক করে ভেবেছি নানা কারণে। লক্ষ করেছি রাশিয়া, ইউক্রেন ও বেলারুশ থেকে বাল্টিক রিপাবলিকগুলোর জাতিগত বৈশিষ্ট্যের মধ্যে বেশ ভিন্নতা রয়েছে। যে ধরনের ভিন্নতা একজন লক্ষ করবেন স্লাভ জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান বা ফিন জাতি-গোত্রের মধ্যে। তবে ইতিহাসে পড়েছি এস্তোনিয়ার সঙ্গে ফিনদের রয়েছে গভীর জাতিভিত্তিক সম্পর্ক। অন্যদিকে লাটভিয়া ও লিথুয়ানিয়া জাতিগতভাবে ভিন্ন ধাঁচের মানুষের দেশ। তাদের বলা হয় বাল্ট (এই শব্দ থেকে বাল্টিক নামটি এসেছে)। ইতিহাসের বিবর্তনে এবং জাতি মিশ্রণের কারণে এসব দেশের মানুষের গায়ের রং বা আদি ডিএনএ বদলে গেছে। স্লাভস সুইডস ভাইকিং রোমা ইহুদি বা বাল্টিক জার্মানদের সঙ্গে মিশে সেখানে এসেছে বিপুল পরিবর্তন। সোভিয়েতের অধীনেও ঘটেছে বাড়তি মিশ্রণ। সোভিয়েত শাসনব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর নানা অজুহাতে বাল্টিক অঞ্চলে রুশ জাতিভুক্ত মানুষের বসতি বৃদ্ধি পায়। ফলে সেখানকার জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই আজ রুশ বংশোদ্ভূত। ধারণা করি সেটি ঘটেছিল রুশ আধিপত্যকে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে খর্ব করতে।

মস্কো রেলস্টেশন থেকে লিথুয়ানিয়ার রাজধানী ভিলনুসের পথে রওনা হয়েছি। ভিলনুস দেখার পর সেখান থেকে যাব বাকি দুটি রিপাবলিকে। ১৯৭৭ সালের জুন মাস। আমারই এক বন্ধু আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল মস্কোর আন্তর্জাতিক সাহিত্যের লাইব্রেরিতে। সে-ই হোটেলের ব্যবস্থা করেছে। বাল্টিক রিপাবলিকগুলো দেখাবে এই প্রতিজ্ঞা সে অনেকবার করেছিল। অবশেষে সেটি সত্য প্রমাণিত হচ্ছে। রাতে মস্কো থেকে রওনা হয়ে সকালে ভিলনুসে পৌঁছালাম। নেমেই বুঝতে পারি রাশিয়ার অন্য শহরগুলো থেকে ভিলনুস কত ভিন্ন। কোনো বড় শহর না। মনে হলো পায়ে হেঁটে শহরটি কয়েক ঘণ্টার মধ্যে দেখা সম্ভব। হোটেলে চেকইন করে বন্ধুর সঙ্গে গেলাম শহর ঘুরতে। নেরিস নদীর ধার দিয়ে চলেছি শহরের পুরোনো অংশের দিকে। সেখানে দেখলাম ‘গেট অব ডন’। রাজা মিন্দোগাসের মূর্তি। জেদিমিনাস অ্যাভিনিউ দিয়ে হেঁটে চলেছি। পথে পড়ল মধ্যযুগের কয়েকটি ক্যাসেল। ইতিমধ্যে বিকেল হয়ে এসেছে। বন্ধু বলল, ‘চলো আমার বন্ধুদের আখড়ায় তোমাকে নিয়ে যাব।’ সেখানে গিয়ে দেখি জনা দশেক আমাদের বয়সী যুবক বসে আছে। দুজন বয়স্ক। পরিচয়ে জানলাম তারা এখানকার কবি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। কিছু মেয়েবন্ধুও আছে তাদের সঙ্গে। আমাকে একটি বিয়ারের বোতল ধরিয়ে দিয়ে সে অন্যদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। নানা বিষয় নিয়ে আলাপ হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রতি তাদের উত্সাহের অভাব নেই। তাদের উত্তর দিতে দিতে বেশ সময় কেটে গেল। সন্ধে হওয়ার আগে বন্ধু বলল, ‘চলো ক্যাফেতে যাই।’ সবাই মিলে রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছি। শহরটির রাস্তা সরু। আমাদের পুরান ঢাকার মতো। পিচঢালা রাস্তার বদলে কালো ইটের রাস্তা। পাশে দোকানগুলোও ভিন্ন ধাঁচের। পথে পড়ল বেশ কয়েকটি গির্জা। খ্রিষ্টধর্মের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির নামে গির্জাগুলোর নামকরণ করা। প্রায় একই চিত্র চোখে পড়ল পরবর্তী সময়ে যখন এস্তোনিয়ার রাজধানী তালিন এবং লাটভিয়ার রাজধানী রিগাতে গিয়েছিলাম।

ঐতিহাসিক দিক থেকে বাল্টিক রিপাবলিকগুলো অন্য রিপাবলিকগুলো থেকে ভিন্ন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে তারা স্বাধীন দেশ ছিল। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজনৈতিক কাঠামোয় তাদের অন্তর্ভুক্তি ঘটেছিল জার্মান-সোভিয়েত ষড়যন্ত্রের কারণে। ১৯৩৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও জার্মানি একে অপরের বিরুদ্ধে আগ্রাসন না করার একটি গোপন শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। সেই চুক্তিকে দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের নামানুসারে বলা হয় মলোটভ-রিবেনথ্রপ চুক্তি। চুক্তিতে তিনটি বাল্টিক রিপাবলিককে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব-বলয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। অন্যদিকে পোল্যান্ডের অর্ধেকের ওপর দেওয়া হয়েছিল জার্মান স্বার্থের স্বীকৃতি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে জার্মানি কালবিলম্ব না করে পোল্যান্ড দখল করে নেয়। তারপর আক্রমণ করে এস্তোনিয়া, লিথুয়ানিয়া ও লাটভিয়া। যুদ্ধ যখন শেষের দিকে তখন সোভিয়েত রেড আর্মি ওই তিনটি বাল্টিক দেশ দখল করে নেয়। সেভাবেই তারা সোভিয়েত ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে।

ইতিমধ্যে হাঁটতে হাঁটতে আমরা ক্যাফের কাছাকাছি চলে এসেছি। আলাপ চলাকালে বেশ ভালোই বুঝতে পারি তাদের মধ্যে সোভিয়েত বিরোধিতা কত তীব্র ও গভীর। প্রায় প্রত্যেকে সোভিয়েত শাসনকে ঔপনিবেশিক কর্তৃত্ববাদ বলে মনে করে।

বন্ধুদের সঙ্গে আলাপকালে একজন আমাকে ডেকে নিল। বলল, ‘চলো একটু দূরে যাই। জানো তো ভিলনুসকে জার্মান কবি গ্যেটে ইতালির শহর ভেনিসের সঙ্গে তুলনা করেছিল। আর নেপোলিয়ন তাকে বলত, “উত্তরের জেরুজালেম”। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে এখানে ইহুদিদের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল বলে। কিন্তু শহরটি আগের মতো নেই। আগের মর্যাদা হারিয়ে ফেলেছে সোভিয়েত শাসনের কারণে।’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, যেটুকু দেখলাম তাতে তো চোখ জুড়িয়ে যায়। এই তোমাদের নদী নেরিস। কি অপূর্বভাবে বয়ে চলেছে একেবারে ভিলনুস শহরের বুক ভেদ করে। আর তোমাদের ‘গেট অব ডন’। সেখানে যে চার্চটা একটু আগে ঘুরে এসেছি সেটি তো অপূর্ব এক কীর্তি। তাকে নিয়ে শুনেছি নানা কল্পকাহিনি আছে। শুনেছি ১৭০৩ সালে সুইডেন যখন তোমাদের দেশ আক্রমণ করল তখন নাকি মা মেরির কল্যাণে এই গেট অব ডনের বিশাল গেট ভেঙে পড়েছিল সুইডিশ সৈন্যদের ওপর।

এদিকে বাকি সব বন্ধু আমাদের খোঁজ করছে। দেখি ওদিক তাকিয়ে ব্যাগ থেকে অতি ধীর হাতে সে একটি বড় কাগজ বের করল। বলল, ‘দেখো তো কিছু বুঝতে পারো কি না?’ কাগজটি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখছি। দেখি পেনসিলে আঁকা একটি মানুষের মুখ। নানা ধরনের ছোটখাটো আঁচড়। মানুষের চেহারাটা খুব যে বোঝা যায় তা না। কিন্তু যতটুকু বোঝা যায় তাতে দেখি চেহারার ওপর পড়েছে উদ্বেগ, হিংস্রতা এবং ভীতি। এক জাতীয় ইমপ্রেশনিস্ট ঢঙে আঁকা মানুষের মনের গভীর দিকটি তার আচ্ছাদন থেকে সরিয়ে দেখার প্রয়াস। কিছুক্ষণ ছবির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এটি কি বিশেষ কারও ছবি?’ বলল, ‘না। আমার প্রতিকৃতি। দেখছ না কী ক্লান্তি এই চেহারায় ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছি? সোভিয়েত শাসনে তোমাকে হলফ করে বলতে পারি আমার চেনা অনেকেই এভাবে কষ্ট পাচ্ছে। আমরা আমাদের জাতিপরিচয় হারিয়েছি। আমরা এখন কেউ না।’ কিছুক্ষণ স্থির হয়ে রইলাম। ইতিহাসের ক্লাসে প্রফেসরের মুখে শুনেছি বাল্টিক অঞ্চলের মানুষেরা কত সুখী। অথচ এখানে এসে শুনি একেবারে ভিন্ন কথা। বিয়ারের বোতল থেকে আর এক ঢোঁক গিলে বন্ধু বলল, ‘আমি পালানোর পথ বের করেছি। কোনো দূতাবাসে গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় চাইব ভাবছি।’ বললাম, ‘বিপদ ডেকে এনো না। শেষে জেলে পচতে হবে।’ সে কোনো কথা বলল না। বিদায় নেওয়ার সময় ছবিটি আমার হাতে তুলে দিয়ে কেবল বলল, ‘এটা তোমাকে দিলাম আমার উপহার হিসেবে।’ তার দেওয়া ছবিটি অনেক দিন সঙ্গে রেখেছি। কিন্তু কখন যে সেটি হারিয়ে গেছে জানি না।

ইতিমধ্যে বেশ রাত হয়ে গেছে। বন্ধুদের বিদায় জানিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম। ভাবি বাকি দুটো রিপাবলিক ভিলনুস থেকে খুব যে ভিন্ন হবে তা না। মনে হলো সোভিয়েত প্রচার এবং বিপ্লবের মর্মবাণীর মধ্যে কত গভীর বিভেদরেখা। তিনটি বাল্টিক রিপাবলিক কার্যত ছিল সোভিয়েতের উপনিবেশ। বিপ্লবের সমতার বাণী জাতিগত সমতা সৃষ্টিতে ব্যর্থ হয়েছে। সেটি আর কোনো রাখঢাক ব্যাপার না।

দুই বছর পরের কথা। এবার সাইবেরিয়া যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তবে ভ্রমণে নয়। কাজে। যাকে বলে কায়িক পরিশ্রম। ভাবলাম কাজের মাধ্যমে মানুষের সঙ্গে পরিচিত হওয়া এবং প্রত্যন্ত সোভিয়েত এলাকা সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার এটি হচ্ছে মোক্ষম সুযোগ। তা ছাড়া রয়েছে বাড়তি উপার্জনের সম্ভাবনা। যে সময়ের কথা বলছি সে সময় সোভিয়েত সরকার বাইকাল-আমুর মূল ট্রেন লাইন নির্মাণের মহা উদ্যোগ নিয়েছে। প্রতিদিন টেলিভিশনের খবরে তার নানা অগ্রগতির বর্ণনা দেখি। সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হলো না। সেখানে আমি যাব দুই মাসের জন্য একটি ছাত্র ব্রিগেডের সঙ্গে যুক্ত হয়ে। সোভিয়েত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা গ্রীষ্মের ছুটিতে এ ধরনের কাজে যোগ দেয়। আমাদের জন্য বরাদ্দ হয়েছে সিমিগোরস্ক নামের একটি স্থান। জায়গাটি দক্ষিণ-পূর্ব সাইবেরিয়ার ইরকুটস্ক এলাকার একটু উত্তর-পশ্চিমে। এখানে বয়ে গেছে আঙ্গারা লেনা এবং তুঙ্গুস্কা নামের নদী ও তাদের শাখা-প্রশাখা। সেখানে পৌঁছাতে গেলে প্রথমে মস্কো থেকে প্লেনে করে যেতে হয় নভোসিবিরস্ক। তারপর ট্রেনে চেপে সিমিগরস্ক। ট্রেনে ২ হাজার কিলোমিটার পথ। অতিক্রম করতে আমাদের সময় লাগল ২৫ ঘণ্টা। সিমিগরস্ক এসে পৌঁছালাম ভোরে। স্টেশন থেকে বাসে করে দুই কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছালাম গন্তব্যস্থানে।

তুঙ্গুস্কা নদীর একটি শাখা এই শহরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে। তারই ধারে ৪০ সদস্যের ব্রিগেডটির বাসস্থান। বাসস্থান বলতে বিশাল দুটি তাঁবু। প্রতিটিতে ২০ জন করে। টয়লেট আছে। কিন্তু গোসল বা হাত-মুখ ধোয়ার ব্যবস্থা নদীর জলে। ছাত্র ব্রিগেডের জীবন অনেকটা মিলিটারি ধাঁচের। তারপর দিনের কাজ চলবে সন্ধ্যা পর্যন্ত। মধ্যখানে স্বল্প বিরতি। ফলে খুব ভোরে ওঠার নিয়ম। নদীতে গিয়ে দেখি বরফের আবরণে ঢাকা পড়ে আছে নদীর জল। জলে হাত দিতেই বরফের আবরণ তার অবগুণ্ঠন সরিয়ে আমাকে অভ্যর্থনা জানাল। সকালের প্রাতরাশ শেষে কঠোর পরিশ্রমের শুরু। ইস্পাতের পাত তুলে বসাতে হবে স্লিপারের ওপর। সেই সঙ্গে আছে সঠিক মাপজোক রক্ষার ব্যাপার। মোটা মোটা পেরেক গেঁথে রেললাইনের পাতের বাঁধুনিকে শক্ত করার কাজ আমাদের। এই কাজ ধরাবাঁধা নিয়মে চলে। ফলে দেখতে দেখতে কেটে গেল দুই মাস। সাক্ষাত্ হলো বহু মানুষের সঙ্গে, যারা রেললাইন নির্মাণের দায়িত্ব নিয়ে এখানে এসেছে রাশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। তবে কাজের ফাঁকে ফাঁকে লক্ষ করেছি নানা ধরনের অব্যবস্থা। যন্ত্রপাতি নেই। অপেক্ষা করো দিনের পর দিন। ৬০ কিলোমিটার যেয়ে আনতে হবে নানা ধরনের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। যেসব স্থানীয় শ্রমিক আমাদের সঙ্গে কাজ করে তারা আসে, মদ্যপান করে। তাদের নিয়ে নানা ঝামেলা। কাজে মন নেই। কোনো রকম সময় কাটিয়ে ঘরে ফেরা। ফলে আমাদের সময় যখন শেষ হলো তখন দেখি কাজ তেমন এগোয়নি। মানুষের মধ্যে লক্ষ করেছি অনুপ্রেরণার অভাববোধ। কাজের ক্ষেত্রেই বলি বা জীবনের অন্য আরও কোনো ক্ষেত্রে। অবশ্য সে সঙ্গে উপভোগ করেছি মানুষের সরলতা। তাদের আতিথেয়তা এবং ন্যূনতম চাহিদা পূরণের তৃপ্তি নিয়ে আনন্দ পাওয়া। আবার দেখেছি পশ্চিমা পণ্যের প্রতি প্রবল আকর্ষণবোধ, সোভিয়েত ব্যবস্থার প্রতি ক্ষোভ।

তবে যে বাসনাকে দীর্ঘকাল ধরে আমার প্রবাস-জীবনে আমি লালন করে রেখেছিলাম সেটি বাস্তবে ঘটল ১৯৭৯ সালে। মধ্য এশিয়ার বেশ কয়েকটি রিপাবলিকে পঁচিশ দিনের ভ্রমণের ব্যবস্থা করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক বিভাগ। মধ্য এশীয় রিপাবলিকগুলো বহু আগে থেকে রুশ সাম্রাজ্যের অধীনে। সেটি তার প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার একটি কারণ। অন্যটি হচ্ছে ধর্ম। সোভিয়েত ব্যবস্থায় ইসলাম ধর্মের অবস্থান কী, সেটিও দেখার ইচ্ছা ছিল। প্রায় ১০০ জন ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে মিলে আমার যাত্রা শুরু হলো। প্রথমে আজারবাইজানের রাজধানী বাকু শহর। সেখান থেকে চারটি বাসে করে উজবেকিস্তান, কাজাখস্তান, কিরগিজিয়া দেখা। সব শহরে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় অথবা কলেজের হোস্টেলে। আজারবাইজানে দেখলাম বাকু, সুমগাইট, গাঞ্জা, সাকি শহরগুলো। উজবেকিস্তানে তাসখন্দ ও সমরখন্দ। কাজাখস্তানে বিসকেক, অশ কারাকুল, বেস্টর পাহাড়, খান তেংরি, লেনিন চূড়া আর কিরগিজে ফ্রুঞ্জে শহর। শহর ছাড়াও বেশ কয়েকটি সোভিয়েত স্টাইলের যৌথ খামার প্রকল্প (কালখোজ ও সাবখোজ) দেখা এবং কয়েকটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানে যাওয়া এই সফরে অন্তর্ভুক্ত। বাকুতে পৌঁছে এক সন্ধ্যায় একটি রেস্তোরাঁয় পরিচয় হলো স্থানীয় এক ছাত্রের সঙ্গে। তাকে নানা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করি। দেখি সোভিয়েত ইউনিয়নের ব্যাপারে সে বেশ খ্যাপা। বলল, ‘জানো তো আজারবাইজান তেলের জন্য বিখ্যাত। এই তেলের জন্য এখানে গণহত্যা হয়েছিল। তাকে আমরা বলি মার্চ গণহত্যা। সেটি ঘটেছিল ৩০ মার্চ, ১৯১৮ সালে। সেই সময়ে বারো হাজার আজারবাইজানি মুসলিমের মৃত্যু হয়েছিল। বিপ্লবের পরপরই লেনিন বলেছিল বাকুর তেল ছাড়া সোভিয়েত রাশিয়া টিকবে না। সে কারণে রেড আর্মি আজারবাইজান আক্রমণ করল। রুশ বিপ্লবের ঠিক আগে আজারবাইজান স্বাধীনতা ঘোষণা করলেও ওই তেলের কারণে লেনিনের নির্দেশে আজারবাইজান আক্রমণ করা হয়েছিল। সে সূত্র ধরেই কিন্তু আমরা ১৯২০ সালে সোভিয়েত ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলাম।’ একটু অবাকই হলাম। এ কথা কারও থেকে শুনিনি। ইতিহাসের ক্লাসেও না। আজারবাইজানের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক তো অনেক আগের বলে জানি। ১৮২৬-২৮ সালে পারস্য সাম্রাজ্যের সঙ্গে যুদ্ধে রাশিয়া আজারবাইজানের কিছু অংশ দখল করে নিয়েছিল। কিন্তু সম্পর্কের মূলে যে তেল সেটি এভাবে কখনো জানিনি।

মধ্য এশিয়ার রাজনৈতিক ও ভূকৌশলগত গুরুত্ব কতখানি সে তো জানি। অনেকে মধ্য এশিয়াকে বলতেন বিশ্বরাজনীতির ‘রাউন্ড অ্যাবাউট’। অন্য কথায় বিশ্ব যোগাযোগের কেন্দ্রবিন্দু। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যে সিল্ক রুট সেকালে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল সেটি মধ্য এশিয়ার ওপর দিয়ে গেছে। পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে সেখানে বাণিজ্যের বিস্তার ঘটে বিপুল পরিসর নিয়ে। বিশ্বের নানা স্থান থেকে সেখানে এসেছে নানা ধরনের পণ্যসম্ভার নিয়ে ব্যবসায়ীর কারাভান। সম্পদের আকর্ষণে লাখ লাখ মানুষ পতঙ্গের মতো এসেছে নতুন জীবনের সন্ধানে। তারই পরিণতিতে এখানে দেখেছি নানা ধরনের সাম্রাজ্য বা খানাতের জন্ম হতে। পরাক্রমশালী শাসকের হাতে মানুষ এবং লোকালয় নিষ্পেষিত হয়েছে। লাখ লাখ মানুষ চেঙ্গিস খান অথবা তৈমুর লংয়ের মতো দুর্ধর্ষ সেনাপতি এবং রাষ্ট্রনায়কের অধীনে এসেছে। তাদের হাতে জীবন দিয়েছে। সে সময়ের বৃহত্ শক্তি রাশিয়া ও ইংল্যান্ডও জড়িয়ে পড়েছিল মধ্য এশিয়ার রাজনীতিতে। ষষ্ঠদশ শতাব্দীর দিকে রাশিয়ার জার মধ্য এশিয়ার প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিয়েছিলেন তাঁর দেশের তুলার চাহিদা মেটাতে। রাশিয়া মধ্য এশিয়ার কর্তৃত্ব নিজের হাতে নিতে অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল নানা যুদ্ধে। অবশেষে ওই বিস্তীর্ণ অঞ্চল যেখানে জনসংখ্যার অধিকাংশ মুসলমান এবং জাতিগতভাবে তুর্কি, পশতুন, উজবেক বা তাতার, তারা রুশ সাম্রাজ্যের অধীনে এল।

আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু আরও বলল, ‘বলশেভিক বিপ্লবের পর মধ্য এশিয়াকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়েছিল। প্রতিটি অঞ্চলকে রিপাবলিকের মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল। আরও বলা হয়েছিল তারা যদি সোভিয়েত ব্যবস্থায় থাকতে না চায় তাহলে স্বাধীন হতে পারবে। কিন্তু এসব ছিল কথার কথা। রাশিয়ার মূল লক্ষ্য ছিল এখানকার তুলা। হয়তো জানো না ১৯২১ থেকে ১৯২৭ সাল পর্যন্ত রাশিয়া নতুন অর্থনৈতিক নীতি চালু করেছিল। তার আওতায় মধ্য এশিয়ায় তুলা উত্পাদন বৃদ্ধির ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল।’ একটু থেমে আমার বন্ধু বলল, ‘তবে সবচেয়ে বড় আঘাত আসে ১৯৩০ সালে। সে সময় কৃষিতে কালখোজ অথবা সাভখোজ নামের সমষ্টিবদ্ধ চাষব্যবস্থা চালু হয়। এতে করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকের জীবনে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। এর বিরুদ্ধে তারা বিক্ষোভ করে। কিন্তু বিক্ষোভ দমন করা হয়েছিল কঠোর হাতে। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো রুশ অধিবাসীরা এসে স্থানীয় মানুষের চারণভূমি দখল করে নিয়েছিল। জানোই তো আমাদের মূল পেশা হচ্ছে পশুপালন। ফলে চারণভূমিকে চাষাবাদে এনে আমাদের জীবনে বড় ক্ষতি হয়ে গেল। এর বিরুদ্ধে সে সময় প্রতিবাদ হয়েছিল। কিন্তু রুশরা মধ্য এশিয়ার রিপাবলিকগুলোর কমিউনিস্ট পার্টিতেও পরিবর্তন আনল। নেতৃত্বে বসানো হলো রুশ নাগরিকদের। জীবনের বাকি দিকগুলোতেও রুশিকরণ হয়েছে।’ আমি বললাম, ‘তা তো দেখতেই পাচ্ছি তোমার নামে। তোমার নাম হচ্ছে করিম। কিন্তু সোভিয়েত ব্যবস্থায় হয়েছে করিমভ, যেটি রুশ নামের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।’ বন্ধু একটু হাসল। মধ্য এশিয়ার বাকি রিপাবলিকগুলোতেও রুশ জাতিগোষ্ঠীর মানুষ এখনো জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশের কাছাকাছি। জানি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় পশ্চিম ফ্রন্টের আশপাশ এলাকা থেকে সোভিয়েত শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো সরিয়ে আনা হয়েছিল মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন রাজধানীতে। যুদ্ধের ধ্বংসলীলা থেকে দূরে রেখে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উত্পাদন সুষ্ঠুভাবে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে পরিকল্পনাটা সে রকমই ছিল। শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আরও এসেছিল বহু রুশ নাগরিক, যারা ওই সব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ছিল। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর তারা রাশিয়ায় ফিরে যায়নি। নতুন জীবন শুরু করেছে এখানে। ফলে মধ্য এশীয় রিপাবলিকগুলোতে রুশ জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় অতি দ্রুত। অবশ্য জনসংখ্যার জাতিগত কাঠামো বদলে দেওয়ার প্রচেষ্টা এখানেও সুপরিকল্পিতভাবে নেওয়া হয়েছিল বলে ধারণা করি।

উজবেকিস্তানের রাজধানী তাসখন্দে এসে পৌঁছালাম। আমাদের ট্যুর গাইডের নাম সলিমভ। বয়সে একেবারে তরুণ। কেবল মস্কোর ট্যুরিস্ট প্রশিক্ষণকেন্দ্র থেকে পাস করে বেরিয়েছে। হোস্টেলের লাউঞ্জে বসে তার সঙ্গে দু-চারটি কথা বলছি। সে বলল, ‘বলশেভিক বিপ্লবের পর সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিরোধ কিন্তু গড়ে উঠেছিল এই তাসখন্দ শহরে। এখানকার মুসলিম সমাজ ছিল মধ্য এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে রক্ষণশীল।’ আমি একটু অবাক হলাম। ভাবলাম, যে দেশে উলুগ বেগের মতো বিজ্ঞানীর জন্ম হয় সেখানে মানুষ রক্ষণশীল হয় কীভাবে! যা-ই হোক, সলিমভ বলল, ‘মুসলমানরা বিপ্লবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিল। বিপ্লবের বিরুদ্ধে তারা গড়ে তুলেছিল সাদা আর্মি। সেটি এখানে ‘বাস্মাচি’ নামে পরিচিত। বুঝি কেবল উলুগ বেগের দেশ হিসেবে উজবেকিস্তানকে দেখলে ভুল হবে। তাসখন্দ ছিল রাশিয়ার জারের গুপ্তচর কেন্দ্র। মধ্য এশিয়ার ওপর কর্তৃত্ব নিয়ে রাশিয়া ও ইংল্যান্ডের মধ্যে যে ‘গ্রেট গেম’ চলছিল সেই খেলায় গুপ্তচরের প্রধান ঘাঁটি ছিল এই শহরে। ১৯১৭ সালের ১৬-২০ এপ্রিলে এখানে তুর্কিস্তানের মুসলিমদের নিয়ে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেখানে মুসলমান সমাজ নামে একটি সংগঠন গড়ে বলশেভিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করা হয়েছিল। ভাবি ১২১৯ সালে চেঙ্গিস খান এই শহরকে ধ্বংস করেছিল ঠিকই। কিন্তু একইভাবে ১৮৬৫ সালে রুশ জেনারেল মিখায়েল চেমিয়ায়েভ জারের আদেশ অমান্য করে তাসখন্দ আক্রমণ করেছিল এবং শহরটির দখল নিতে হত্যা করেছিল অসংখ্য নারী ও পুরুষকে। সেই দুই দিনের যুদ্ধের পর শহরটি এল রুশদের হাতে। রুশ অর্থোডক্স চার্চের এক ধর্মগুরু যিশুর ক্রস হাতে নিয়ে শহরে ঢুকল। জার চেমিয়ায়েভকে সম্মান করে তার নাম দিল ‘তাসখন্দের সিংহ’। কিন্তু উজবেক মুসলিম সমাজ তাকে দেখল একজন গণহত্যাকারী হিসেবে। ভাবি রুশ বিরোধিতার শেকড় এখানে কত গভীরে।

সমরখন্দ শহরে এলাম। শহরটি মধ্য এশিয়ার সবচেয়ে পুরোনো এবং দুই ভাগে বিভক্ত। পুরোনো শহরে রয়েছে নানা ধরনের মাদ্রাসা। রয়েছে তৈমুর লংয়ের মাজার। নানা ধরনের তুর্কি গোত্র দীর্ঘকাল উজবেকিস্তান শাসন করেছে। শুনেছি খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৩ সালে আলেকজান্ডারও এই শহর আক্রমণ করেছিল। ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে এই শহর ছিল তুর্কিদের অধীনে। অষ্টম শতাব্দীতে আরবরা এসে তার দখল নিল। ইরানিরা শাসন করেছিল নবম থেকে দশম শতাব্দী পর্যন্ত। চেঙ্গিস খানও এই শহর আক্রমণ করেছিল। দেখি পুরোনো শহরের ছয়টি গেট রয়েছে আর সব রাস্তা একটি কেন্দ্রে এসে সংযুক্ত হয়েছে। এখানে দেখতে গেলাম উলুগ বেগের তৈরি জ্যোতির্বিদ্যার পর্যবেক্ষণকেন্দ্র। এটি তিনি ১৪২০ সালে নির্মাণ করেছিলেন। তৈমুর লংয়ের শাসনকালে উলুগ বেগ এখানে একটি মাদ্রাসা নির্মাণ করেছিলেন। সেই মাদ্রাসা পরবর্তী সময়ে পরিণত হয়েছিল জ্যোতির্বিদ্যার ওপর একটি নামকরা বিদ্যাপীঠে। উলুগ বেগ সেখানে বছর দিনক্ষণকে যেভাবে পরিমাপ করেছিলেন তার সঙ্গে আধুনিককালের হিসাবের তফাত মাত্র এক মিনিট বেশি। আমাদের গাইডকে বললাম, ‘সবকিছু তো দেখলাম। কিন্তু এখানে কি মসজিদগুলোতে মুসল্লিদের ভিড় হয়?’ সলিমভ বলল, ‘কাল শুক্রবার। একটি মসজিদে নিয়ে যাব। নিজেই দেখবে।’ পরের দিন উজবেকিস্তানে আমাদের সফরের শেষ দিন। দিনটি মুক্ত রাখা হয়েছে। নিজে কিছুদূর হেঁটে গেলাম বিবি খানম মসজিদে। দেখি দুপুর গড়াতেই মানুষের ভিড়। মাথায় টুপি। গায়ে চাদর। অজুর ব্যবস্থা আছে। সবকিছুই পরিপাটি করে সাজানো। মসজিদটি পুরোনো। অনেকটা আজেরি ঢঙে গড়া। আমিও অজু করে ঢুকলাম মসজিদের ভেতর। কয়েক শ মানুষ মওলানা সাহেবের খুতবা শুনছে। রুশ ভাষায় কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘সবকিছু ঠিক আছে?’ কেউ তেমন কথা বলল না। কেবল খুশি হলো এটুকু শুনে যে আমার দেশ বাংলাদেশ এবং আমি একজন মুসলমান।

চার

আমাদের সফরের শেষ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছি। কিরগিজ রিপাবলিকের রাজধানী ফ্রুঞ্জে শহরটি দেখা বাকি। কিন্তু তার আগে যাব আলা তু পর্বতমালায়। সেখানে থাকব চার দিন। স্থানটি ফ্রুঞ্জে শহর থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে। এটি তিয়ানশান পর্বতমালারই একটি অংশ। সেখানেই রয়েছে বিখ্যাত আলা আরচা ন্যাশনাল পার্ক। ফ্রুঞ্জে শহরের নাম লেনিনের বিশ্বস্ত এক কমরেড মিখায়েল ফ্রুঞ্জের নামানুসারে রাখা হয়েছিল। আমাদের বাস ফ্রুঞ্জে শহর ত্যাগ করে চলেছে ওই পর্বতমালার দিকে। দেখি গ্রীষ্মকাল সত্ত্বেও বেশ শীত। পর্বতের সাদা চূড়ায় বরফ জমা। চূড়ার দিকে যতই এগিয়ে যাই ততই ভাবি অক্টোবর বিপ্লবের কথা। ওই পর্বতশৃঙ্গ কেন জানি আমার কাছে প্রতিভাত হলো রূপক হিসেবে। ভাবি সারা বিশ্বে কী আলোড়ন সৃষ্টিই না করেছিল সেই বিপ্লব। ঠিক ওই পাহাড়ের চূড়ার মতো উঁচু এবং বিশাল মূর্তির গুরুগম্ভীরতা নিয়ে আশান্বিত এক পৃথিবীর জন্ম দিয়েছিল। সব সত্ত্বেও বিশ্বের সাধারণ মানুষ তারই মধ্যে দেখেছিল আশার আলো—শোষণের যুগ শেষ হবে। বুক বেঁধেছিল। জীবন দিয়েছিল। আমার চাচার মতো আরও অনেক বিপ্লবী জীবনের সবকিছু বাজি ধরে দাঁড়িয়েছিল ওই বিপ্লবের পেছনে। জানি সেই বিপ্লবের পথ মসৃণ ছিল না। নানা প্রতিবন্ধকতা এসে দাঁড়িয়েছিল তার পথ আগলে। বিপ্লবের পরপরই পার হতে হয়েছিল পশ্চিমা বিশ্বের প্ররোচিত শ্বেত প্রতিবিপ্লবীদের আগ্রাসন। যেতে হয়েছিল তিরিশের দশকে বিশ্বব্যাপী মন্দার মধ্য দিয়ে। ফ্যাসিবাদের কালো শক্তিকে অসীম সাহসিকতা দেখিয়ে মোকাবিলা করেছিল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে প্রাণ দিয়েছিল তার দুই কোটি সন্তান। সত্তর দশকে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা পার হতে হয়েছিল। সোভিয়েত সমাজকে মুক্ত করেছিল সামন্তবাদী জারতন্ত্রের পশ্চাত্পদতা থেকে। স্বল্প সময়ের মধ্যে শিল্পায়ন এবং আধুনিকায়নের বিপুল সম্ভার সাজিয়ে এগিয়ে গেল দেশটি। নানা ক্ষেত্রে পাল্লা দিয়ে পুঁজিবাদী বিশ্বের নেতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার পশ্চিমা মিত্রদেশগুলোকে পেছনে ফেলল। মহাকাশ অভিযানে যোগ করল নতুন মাত্রা।

দুঃখজনক হলেও ওই পর্বতশৃঙ্গের মতো রুশ বিপ্লবের দেহে ইতিমধ্যে বরফ জমতে শুরু করেছে। ১৯৮২ সালে সোভিয়েতে লেখাপড়া শেষ করে দেশে ফিরেছি। দেখতে দেখতে ১৯৮৯ সালের নভেম্বর মাস এসে গেল। বুঝতেই পারি সময়টা সোভিয়েত কমিউনিস্ট সরকারের জন্য ভালো যাচ্ছে না। আফগান যুদ্ধে পরাজিত রুশ সৈন্যরা দেশে ফিরেছে। অর্থনীতি সংকটের মুখে। জনমনে তার বিরুদ্ধে অসন্তোষ। গণতন্ত্রের আন্দোলন ধীরে হলেও দানা বাঁধছে। মানুষ চায় নির্বাচন। চায় মুক্তবাজার অর্থনীতি। সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মিখায়েল গর্বাচভ সেটি বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি বললেন গ্লাসনস্তের কথা। গণতন্ত্রের কথা। পেরেস্ত্রোইকার কথা। অর্থনীতি পুনর্গঠনের কথা। বোঝাই যাচ্ছে কমিউনিস্ট পার্টির শাসন শেষ হওয়ার পথে। এমন সময় এল এক আকস্মিক ঘোষণা। ৯ নভেম্বর পূর্ব জার্মানির সরকার ঘোষণা করল তাদের নাগরিকদের পশ্চিম জার্মানি যেতে বাধা নেই। ঘোষণার পরপরই শুরু হলো বার্লিন দেয়ালকে ঘিরে মানুষের জমায়েত ও উত্তেজনা। দেয়ালের একদিকে পূর্ব বার্লিনের মানুষ। উল্টোদিকে পশ্চিম বার্লিনের। উভয়ে মিলে ভাঙতে শুরু করল দেয়াল। ১৪০ কিলোমিটার লম্বা দেয়ালের প্রতীকী ধ্বংস সেদিন সমাপ্ত হলো। বাকি থাকল তার বস্তুগত অপসারণ। যে দেয়াল ১৯৬১ সাল থেকে মার্কিন-সোভিয়েত শীতল যুদ্ধের প্রতীক হয়ে ছিল, তার সমাপ্তি এখন কেবল সময়ের ব্যাপার। দেয়াল ভাঙার কাজ শুরু হলো ১৯৯০ সালের ১৩ জুন। শেষ হলো দুই বছর পর, ১৯৯২ সালে। সেই সঙ্গে ধসে পড়ল সোভিয়েত সমাজব্যবস্থা। শেষ হলো বিশ্ব ইতিহাসে মানবিক সমাজ বিনির্মাণের সবচেয়ে বড় প্রয়াস?

জানি বলশেভিক বিপ্লবের সফলতা ও ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা শেষ হয়নি। তার কারণ খুঁজে বের করার প্রক্রিয়া আজও চলমান। কিন্তু কয়েকটি দিক তো ইতিমধ্যে স্পষ্ট। কমিউনিস্ট পার্টি কীভাবে আমলাতান্ত্রিক এক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হলো সেটি দেখার বিষয়। ব্যক্তিস্বাধীনতা কেন নিষ্পেষিত হলো ওই সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায়, সেটি নিয়েও ভাবতে হবে। লোভ-লালসা, সম্পদ কুক্ষিগত করার মতো প্রকৃতিগত প্রবৃত্তিগুলোর সঙ্গে সমষ্টি স্বার্থের সমন্বয় কীভাবে সম্ভব, সেটিও দেখার বিষয়। দেখার বিষয় কমিউনিস্ট আদর্শকে। একই আদর্শের চারপাশে যেসব নক্ষত্রের জন্ম হয়েছিল সেই বৈচিত্র্যময় আদর্শের জায়গায় সংকীর্ণ একপেশে সমাজতত্ত্ব গড়ে উঠল কীভাবে? কেন গ্রামসির তত্ত্বকে অন্তর্ভুক্ত করা গেল না সমাজতন্ত্রের মূলধারায়? কেন আরও সব বিপ্লবীকে দেখা হলো প্রতিবিপ্লবী হিসেবে? কেন কমিউনিস্ট আন্দোলনের অভ্যন্তরীণ বিরোধ তীব্র হলো? কেন ধর্মের প্রশ্নে সহনশীল নীতি প্রয়োগ করা সম্ভব হলো না? এ ধরনের প্রশ্নসহ আরও রয়েছে হাজার প্রশ্ন, যার উত্তর খুঁজতে চাই। কমিউনিস্ট নীতিমালাকে আদর্শ হিসেবেই আমি দেখি। পুঁজিবাদের অবিশ্বাস্যভাবে অমানবিক সমাজকে প্রতিস্থাপন আজ যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি আশু। কিন্তু বলার অপেক্ষা রাখে না যে তার স্থানীয় প্রয়োগের ক্ষেত্রে আনতে হবে সংশোধন, পরিবর্ধন ও পরিবর্তন।