সমাজে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাব

ভূমিকা

জ্ঞানই শক্তি। যদিও আমরা সবাই প্রবাদটি জানি, কিন্তু জ্ঞান ছড়ানোর ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ভূমিকা খুব কম মানুষই বোঝে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর কল্যাণে যে কেউ ইন্টারনেটের মাধ্যমে অবারিত জ্ঞানের সাগর থেকে তাদের জ্ঞানের ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে পারে। আমাদের এই বর্তমান আধুনিক বিশ্বে সামাজিক মাধ্যম আমাদের সমাজ, অর্থনীতি ও সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে যে প্রভাব ফেলছে তা অনস্বীকার্য। সামাজিক মাধ্যম এক নতুন গণমঞ্চ, যা মানুষের মধ্যকার চিন্তাচেতনার আদান-প্রদানে, মানুষে মানুষে যোগাযোগে, কোনো উদ্দেশ্যে সবাইকে সমবেত করতে, পরামর্শ পেতে ও দিতে সুযোগ তৈরি করে দেয়। সামাজিক মাধ্যমগুলো যোগাযোগের প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করে যোগাযোগের মাধ্যমগুলোকে বিকেন্দ্রীকরণ করেছে এবং যোগাযোগের নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে, যাতে দমনাত্মক দেশগুলোর সবাই সমান ও গণতান্ত্রিকভাবে নিজেদের মতামত প্রকাশ করতে পারে। এই গণমাধ্যমগুলো বৈচিত্র্যময় স্বতঃস্ফূর্ত, আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক, পাণ্ডিত্যপূর্ণ-অপণ্ডিতচিত সব ধরনের লেখাকেই ধারণ করে ও বিকাশের সুযোগ করে দেয়। এই গণমাধ্যম সমস্বার্থের গোষ্ঠীগুলোকে নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রের পরিধি বাড়িয়ে দেয়, যেমনটা দেখা যায় ছাত্রদের সমন্বিত দলবদ্ধ প্রকল্পের কাজে। সামাজিক মাধ্যমগুলো শিক্ষা, অর্থনীতি, রাজনীতি, শ্রেণিবৈষম্য, স্বার্থ, সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়ে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের পর্যালোচনাগুলোকে এক জায়গায় নিয়ে আসে।

যদিও এই সামাজিক মাধ্যমগুলো আমাদের সমাজ, দেশ ও সংস্কৃতির দেয়াল ভেঙে সব মানুষকে কাছাকাছি নিয়ে এসেছে, কিন্তু এর সবকিছুরই একটা মূল্য আছে। সামাজিক মাধ্যমগুলোর কিছু খারাপ প্রভাবও আমাদের জীবনে দৃশ্যমান। কারণ অন্তঃকরণের-বিচ্ছিন্নকরণের সংযুক্তি ও বৈশ্বিক পরিব্যাপ্তি আমাদের কৃষ্টিকে ধীরে ধীরে ক্ষয়িষ্ণু করে দিচ্ছে। সামাজিক মাধ্যমগুলো আমাদের পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থা হরণ করছে এবং মানবিক, শারীরিক ও অনুভূতির সাহচর্যকে ভার্চ্যুয়াল যোগাযোগ দ্বারা প্রতিস্থাপিত করছে। এই মাধ্যমগুলো আমাদের আত্মসংযম কেড়ে নিয়ে নিজেদের স্বাধীন চিন্তাশক্তিকে অকেজো করে দিয়েছে এবং সেই সব অবান্তর তথ্যের প্রতি আমাদের বিশ্বাসপ্রবণ করে তুলছে, যা আমরা কোনো বাছবিচার ছাড়াই প্রতিনিয়ত গলাধঃকরণ করে চলেছি।

শ্লেষাত্মকভাবে বলতে গেলে, সামাজিক মাধ্যমগুলো ধীরে ধীরে আমাদের একটা অসামাজিক প্রজন্মে রূপান্তরিত করছে। এখন আমরা টেলিফোনের কথোপকথনের চেয়ে খুদে বার্তা আদান-প্রদানকে অধিক গুরুত্ব দিচ্ছি এবং সরাসরি সাক্ষাতের থেকে অনলাইনে কথা বলাই শ্রেয় মনে করছি। এমনকি অনেকে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়াকে সহজলভ্য প্রচারমাধ্যম, যেমন ফেসবুক, টুইটার ও ইনস্টাগ্রামের মাধ্যমে প্রতিস্থাপন করেছে। জোনাথন ফোয়ার তাঁর প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘সামাজিক মাধ্যমের প্রতিটা পদক্ষেপ আমাদের আবেগময় উপস্থিতিকে এড়িয়ে যাওয়া সহজ করে দিয়েছে, যেখানে মানবিকতা জানানোর থেকে তথ্য দেওয়া সহজ।’ গড়িয়ে যাওয়া প্রতিটি দিন আমাদের এই কথার সত্যতার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়।

আমাদের জীবনে সামাজিক মাধ্যমগুলোর তিন ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ও সেগুলো নিয়ে বিভিন্ন গবেষকের গবেষণায় প্রাপ্ত প্রমাণাদি নিয়ে আলোচনা করাই এই প্রবন্ধের মুখ্য উদ্দেশ্য। তিন ধরনের নেতিবাচক দিকের প্রথমে রয়েছে—সামাজিক মাধ্যমগুলো মানুষের মাঝে অনলাইন যোগাযোগের মিথ্যে ও অগভীর সম্পৃক্ততা এবং বাহ্যিক বন্ধুত্বকে জিইয়ে রেখে তাদের মানসিক বৈকল্য ত্বরান্বিত করে। দ্বিতীয়ত, সামাজিক মাধ্যম মানুষের পারিবারিক ও ব্যক্তি জীবন থেকে মূল্যবান সময় কেড়ে নিয়ে তাদের আসক্ত করে ফেলে। ফলে তাদের সামাজিক দক্ষতা ধীরে ধীরে হ্রাস পায় এবং অসামাজিক আচরণ বেড়ে যায়। সবশেষে, সামাজিক মাধ্যমগুলো অপরাধীদের জন্য একটা হাতিয়ারে পরিণত হচ্ছে, যা খুব সহজে ব্যবহার করে তারা বিভিন্ন রকমের অপরাধ কর্ম সম্পাদন করে। এই গবেষণার তৃতীয় বিশ্লেষণে জটিল মানসিক সমস্যার সঙ্গে অপরাধপ্রবণতার সংযোগ দেখানো হয়েছে।

[বিস্তারিত দেখুন জানুয়ারি–মার্চ ২০১৮ সংখ্যা (২২তম সংখ্যা)৷