সম্পাদকীয়

মানবসভ্যতা একটি বড় ধরনের সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি—কোনো কিছুই এই সংকটের বাইরে নয়। এই সংকটের বহুমুখী কারণ রয়েছে। বিশ্ব প্রবেশ করেছে এমন এক যুগে, যেখানে তথ্যপ্রযুক্তি নির্ধারণ করছে যাবতীয় মানবিক কর্মকাণ্ড। সবকিছুই আগের চেয়ে বেশি গতিসম্পন্ন। তাই সংকটও ঘনীভূত হয় আগের চেয়ে বেশি দ্রুত। আদর্শিক দ্বন্দ্বগুলো আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি ভাগে বিভক্ত ও জটিল। তাই সমাধানের কোনো শর্টকাট পদ্ধতি কাজ করছে না। প্রযুক্তি যত দ্রুত মানবসমাজকে আষ্টেপৃষ্ঠে তার জাল দিয়ে বাঁধতে পারছে, মানুষ তত দ্রুত তার প্রতিক্রিয়ায় সাড়া দিতে পারছে না। ফলে তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন সংকট।

সবচেয়ে গুরুতর সংকট দেখা দিচ্ছে মূল্যবোধের প্রশ্নে। সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় দেখা যাচ্ছে সব ক্ষেত্রে। সামাজিক এসব মূল্যবোধ গঠনে রাষ্ট্রীয় মূল্যবোধের রয়েছে অপরিসীম ভূমিকা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং তত্পরবর্তী রাষ্ট্র গঠনে কয়েকটি মৌলিক মূল্যবোধকে পথপ্রদর্শকের পর্যায়ে উন্নীত করা হয়েছিল। এই মূল্যবোধগুলো ধীরে ধীরে গঠিত হয়েছিল সব মানুষের অংশগ্রহণে জনযুক্তিচর্চার মাধ্যমে। বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদসহ অন্য প্রাজ্ঞ নেতারা সে সময়ে জনযুক্তিচর্চায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। এর পাশাপাশি বিশেষভাবে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ অর্থনীতিবিদেরা এই প্রক্রিয়াকে জ্ঞানভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। সামাজিক মূল্যবোধ হিসেবে এই জনযুক্তিচর্চার ভূমিকাকে অনেক প্রথিতযশা রাষ্ট্রচিন্তাবিদ ও দার্শনিক স্বীকার করেন। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রশ্নে পুরোনো মূল্যবোধগুলোর আকাল দিনের পর দিন বাড়ছে। তাই সেই মূল্যবোধগুলোর পুনরুজ্জীবনের মাধ্যমেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পুনর্জাগরণ ঘটানো সম্ভব। এই প্রেক্ষাপটে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহানের ‘মূল্যবোধের রূপান্তর: জনযুক্তিচর্চার আকাল ও পুনরুজ্জীবন’ প্রবন্ধটি আমরা ছাপছি। লেখাটি সারওয়ার মুরশিদ ও নূর জাহান মুরশিদ স্মারক বক্তৃতা উপলক্ষ করে তৈরি করা হয়েছে। উক্ত দুজন ব্যক্তিই আমাদের সমাজে বিশেষ সময়ে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। প্রবন্ধটি অনুবাদ করেছেন প্রতীক বর্ধন।

সংকটের আরেক উপাদান হয়ে দাঁড়িয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। পৃথিবীর অন্যতম জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হলো ফেসবুক। এসব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ফলে মানুষ এখন পৃথিবীব্যাপী যোগাযোগ ও তথ্য ভাগাভাগির এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। ফলে অনেকে আবার স্বীয় স্বার্থে এই মাধ্যমকে অনৈতিকভাবে কাজে লাগাতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। এই মাধ্যম ব্যবহার করে রাজনীতি প্রভাবিত করাও সাধারণ প্রবণতা হয়ে উঠেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন থেকে শুরু করে যুক্তরাজ্যের ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে যাওয়া, কিংবা রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে জাতিগত নির্মূল অভিযান জায়েজ করা ইত্যাদি ক্ষেত্রে ফেসবুকের অপব্যবহার হয়েছে বলে সমালোচনার ঝড় বইছে। অভিযোগ রয়েছে, ফেসবুকের মাধ্যমে মানুষকে প্রভাবিত করা হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতায় আসা এবং ব্রেক্সিটের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ফেসবুক ব্যবহারকারীকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে তাদের প্রভাবিত করা হয়েছে। যার প্রতিফলন ঘটেছে ভোটের ক্ষেত্রে। বিশাল আকারের তথ্যভান্ডারকে হীন স্বার্থে ব্যবহারের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা নামের প্রতিষ্ঠানটি। রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে জনমত গঠনে রয়েছে ফেসবুকের ভূমিকা। ফেসবুকের প্রধান মার্ক জাকারবার্গ এসব অভিযোগ স্বীকারও করেছেন।

রোহিঙ্গা ইস্যুটি বাংলাদেশের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন বা ব্রেক্সিটের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সরাসরি যুক্ততা না থাকলেও এগুলোর প্রভাব আমাদের রাজনীতি ও অর্থনীতিতেও রয়েছে। ফলে এসব ঘটনায় নিষ্ক্রিয় থাকার কোনো সুযোগ নেই। তা ছাড়া বাংলাদেশের নির্বাচন ও রাজনীতিতেও ফেসবুকের প্রভাব পড়তে পারে। প্রতিচিন্তার এই সংখ্যায় তাই ফেসবুক নিয়ে দুটি লেখা ছাপা হলো। একটি লেখায় তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সঙ্গে রাজনৈতিক সক্রিয়তার কোনো যোগসূত্র আছে কি না। যারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে, তারা কি শুধু রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ভার্চ্যুয়াল জগতেই সীমাবদ্ধ রাখে, নাকি বাস্তব জীবনে তারা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় হয়? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়েছে সেজ জার্নালে প্রকাশিত ড্যানিয়েল লেন এবং আরও চারজন গবেষকের যৌথ একটি নিবন্ধে। লেখকদের তিনজন মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক। বাকি দুজন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। লেখাটি অনুবাদ করেছেন খলিলউল্লাহ্।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ে অপর লেখাটিতে সমাজে, সাধারণত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যে প্রভাব রয়েছে, তার একটি বিশ্লেষণ রয়েছে। এখানে মানসিক স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে অপরাধপ্রবণতায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ভূমিকা ইত্যাদি আলোচনা করা হয়েছে। গবেষণাটি করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সান্তা ক্লারা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার অংশ হিসেবে। জ্যাকব আমেদির ‘সমাজে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাব’ নামে নিবন্ধটি অনুবাদ করেছেন মো. ফাহাদ হোসেন।

রোহিঙ্গা ইস্যুটি চলমান রয়েছে। সেই প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আমরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বরিশাল বিভাগের রাখাইন জাতিগোষ্ঠীর ভূমি সংকট নিয়ে পাভেল পার্থর একটি নিবন্ধ ছাপছি। এখানে ভূমি বেদখলের ঘটনাকে ভূমি সংকটের কেন্দ্রীয় উপাদান ধরে আলোচনা করা হয়েছে। উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের জাতিগোষ্ঠীর কথা বিবেচনা না করে পরিচালিত হলে এই সমস্যা স্থান-কাল-পাত্রভেদে একই রকম হয়ে থাকে। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, বর্তমানে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে জাতিগত সমস্যার পাশাপাশি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফলেই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে সহিংসতার মাধ্যমে উচ্ছেদ করা হয়েছে। রাখাইনদের নিজস্ব কিছু প্রবাদবাক্যের মধ্যেই ভূমি সংকটের সূত্র আছে। সেগুলোই লেখক রাখাইন প্রবীণ ও নবীনদের বয়ানের মধ্য দিয়ে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।

এ ছাড়া রাখাইন ও রোহিঙ্গা ইস্যু বোঝার জন্য আমরা ‘বার্মা পাঠসূত্র’ নামে আলতাফ পারভেজের একটি লেখা ছাপছি। এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো রাজনৈতিক শব্দকোষ আকারে ছাপা হলো। বিভিন্ন সময়ে খবরে বা লেখাজোখায় এসব বিষয়ের উল্লেখ থাকে। কিন্তু বিস্তারিত না জানার কারণে ঘটনাগুলোর সংযোগ ঘটাতে সমস্যা হয়। এই পাঠসূত্র সেদিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আমরা মনে করি।

আত্মপরিচয়ের জায়গা থেকেও আমরা এক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এই বিষয়ে যাঁরা কাজ করেছেন, তাঁদের মধ্যে দিপেশ চক্রবর্তী উল্লেখযোগ্য নাম। তিনি প্রথম আলোর সাংবাদিক ইফতেখার মাহমুদের সঙ্গে বাঙালি মুসলিম জাতীয়তাবাদ নিয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাত্কারধর্মী এই লেখাটিতে জাতীয়তাবাদ ছাড়াও বর্তমানের সবচেয়ে আলোচিত বৈশ্বিক সমস্যা জলবায়ু পরিবর্তন নিয়েও দিপেশ কথা বলেছেন।

জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে অনেক আলোচনার মধ্যে এখন উল্লেখযোগ্য হলো জলবায়ু অর্থনীতি। এই সংকট মোকাবিলায় এমন কিছু বৈশ্বিক সমাধান বিবেচিত হয়ে আসছে, যেখানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা যাবে। এর ফলে সৃষ্টি হয়েছে জলবায়ু অর্থনীতির। এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন পিটার নুয়েল ও ম্যাথু প্যাটারসন। ক্লাইমেট ক্যাপিটালিজম নামক এই বইটি নিয়ে আলোচনা করেছেন খলিলউল্লাহ্।