নিবেদিতা নাগ: জন্মশতবর্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি

তখন পাকিস্তান সরকার কমিউনিস্টদের বন্দী করে কারাগারে পাঠাচ্ছিল। ১৯৪৮ সালে সরকার কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ করল। আমি তখন কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সদস্য ছিলাম।

[জগত্খ্যাত, বাংলাদেশের কোটি মানুষের হূদয়ে দোলা দেওয়া কালো মানুষের নেতা, দক্ষিণ আফ্রিকার বিজয়ী প্রয়াত বিপ্লবী প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলার জন্মশতবর্ষ উদ্যাপনের অনুষ্ঠানে, ১৮ জুলাই ২০১৮ সালের বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যায় বসে ছিলাম বাংলাদেশ জাদুঘরের মূল আলোচনা মঞ্চে। মুঠোফোনে কলকাতা থেকে সুজয় নাগের ডাক বেজে উঠল। খুদে বার্তায় তিনি জানালেন, তাঁর প্রয়াত মা, বাংলাদেশের স্বনামধন্য কমিউনিস্ট নেত্রী নিবেদিতা নাগের জন্মশতবর্ষ পূর্ণ হবে ২০১৮ সালের ৪ আগস্ট।

বিহ্বল হয়ে গেলাম। পৃথিবীজুড়ে বিশ শতকে কমিউনিস্ট আন্দোলনের যখন উত্তাল বিপ্লব চলছিল, সে সময়ে সাদা মানুষের দেশ থেকে শ্বেতাঙ্গ শাসকগোষ্ঠীর শাসন চেপে বসেছিল দক্ষিণ আফ্রিকায় ও ভারতবর্ষে। এই দুই দেশেই নানা সামাজিক-রাজনৈতিক পশ্চাত্পদতা সত্ত্বেও কমিউনিস্ট বাম রাজনীতির উত্থান ঘটেছিল। সেই বিশাল ও বিপুল কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাস সৃষ্টিকারী নেলসন ম্যান্ডেলার বৈপ্লবিক জয়ের ইতিহাস অনিবার্যভাবে পৃথিবীসেরা ইতিহাসের অন্যতম। বিপ্লবী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার জন্মশতবর্ষ উদ্যাপনের বছরে (২০১৮) ভারতবর্ষের ইংরেজ শাসনে জর্জরিত পরাধীন পূর্ব বাংলার-পূর্ব পাকিস্তানের (১৯৪৭ সালের আগে এবং পরে) কখনো আত্মগোপনকারী, কখনো কারাবাসী, কখনো প্রকাশ্য রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত কমিউনিস্ট নেত্রী নিবেদিতা নাগের (জন্ম ৪ আগস্ট ১৯১৮—মৃত্যু ৫ মে ২০১৩) জন্মশতবর্ষ পূর্ণ হওয়ার আনন্দ আমার মন আপ্লুত করে দিয়েছে।

বিহ্বল হয়ে গেলাম। পৃথিবীজুড়ে বিশ শতকে কমিউনিস্ট আন্দোলনের যখন উত্তাল বিপ্লব চলছিল, সে সময়ে সাদা মানুষের দেশ থেকে শ্বেতাঙ্গ শাসকগোষ্ঠীর শাসন চেপে বসেছিল দক্ষিণ আফ্রিকায় ও ভারতবর্ষে। এই দুই দেশেই নানা সামাজিক-রাজনৈতিক পশ্চাত্পদতা সত্ত্বেও কমিউনিস্ট বাম রাজনীতির উত্থান ঘটেছিল। সেই বিশাল ও বিপুল কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাস সৃষ্টিকারী নেলসন ম্যান্ডেলার বৈপ্লবিক জয়ের ইতিহাস অনিবার্যভাবে পৃথিবীসেরা ইতিহাসের অন্যতম। বিপ্লবী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার জন্মশতবর্ষ উদ্যাপনের বছরে (২০১৮) ভারতবর্ষের ইংরেজ শাসনে জর্জরিত পরাধীন পূর্ব বাংলার-পূর্ব পাকিস্তানের (১৯৪৭ সালের আগে এবং পরে) কখনো আত্মগোপনকারী, কখনো কারাবাসী, কখনো প্রকাশ্য রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত কমিউনিস্ট নেত্রী নিবেদিতা নাগের (জন্ম ৪ আগস্ট ১৯১৮—মৃত্যু ৫ মে ২০১৩) জন্মশতবর্ষ পূর্ণ হওয়ার আনন্দ আমার মন আপ্লুত করে দিয়েছে।

বিপ্লবী নেলসন ম্যান্ডেলাকে জেনেছি উইনি ম্যান্ডেলার হূদয়-জাগানিয়া ব্যাকুলতায় লেখা বই পড়ে। ১৯৯৫ সালে বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত বিশ্ব নারী সম্মেলনে এবং ঢাকায় উইনি ম্যান্ডেলার সঙ্গে দেখা, কথা ও জানার মধ্য দিয়ে রচনা করেছি উইনির চোখে ম্যান্ডেলা (সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, ১৯৮৮, ১৯৯১, ২০০৮)।

পাঠক-আকর্ষিত এই বই নেলসন ম্যান্ডেলা ও উইনি ম্যান্ডেলার জীবন-আনন্দ, বিচ্ছেদ-বেদনা—সবই আমাদের হূদয় উদ্বেল করে তোলে নিঃসন্দেহে। সেই কাহিনি বিপ্লবমথিত হূদয়-জাগানিয়া। অন্যদিকে, জন্মশতবর্ষ সূত্রে গাঁথা পূর্ব বাংলার, পূর্ব পাকিস্তানের ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট বিপ্লবী নেত্রী নিবেদিতা নাগের লেখা ও সম্পাদিত যে দুটি বই আমার এবং জিজ্ঞাসু পাঠকের বহু প্রশ্নের উত্তর দিতে পেরেছে, সেই বই দুটি পড়ে তাঁর সম্পর্কে ও নেপাল নাগের কর্মকাণ্ড জেনেছি। শ্রদ্ধেয় নিবেদিতা নাগ স্বাক্ষরিত (২০ নভেম্বর ২০০৪) ‘স্নেহের মালেকাকে’ লেখা বই দুটি হাতে নিয়ে বসেছি আজ ২৮ জুলাই ২০১৮। একটি বই নেপাল নাগ স্মৃতিচারণা; নিবেদিতা নাগ সংকলিত। কলকাতা ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লি. থেকে বেরিয়েছে জুলাই ১৯৯৬ সালে। দ্বিতীয়টি নিবেদিতা নাগ রচিত ঢাকা থেকে কলকাতা (প্রকাশক আলোচনা চক্র, কলকাতা-৫৬, ৪ আগস্ট ২০০৮)। বই দুটি আমার দুর্লভ বই সংগ্রহের শেলফে যত্নে রেখেছি ১৪ বছর ধরে। সযত্নে রাখব আমার আজীবন বই পড়ার চর্চায়। ‘নিবেদিতা দিদি’ সম্বোধনে প্রথম তাঁকে ডেকেছি, দেখেছি এবং শ্রদ্ধা জানিয়েছি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় নিবেদিতা নাগ ও নেপাল নাগ এবং পূর্ব পাকিস্তান থেকে চলে যাওয়া অরুণ চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী রেখা চৌধুরী (কারামুক্ত হয়ে) অসুস্থ কমরেডদের এবং পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিযোদ্ধাদের সব সহযোগিতা দিয়েছেন। পূর্ব পাকিস্তানে তাঁর বৈপ্লবিক কাজের বিষয়ে জেনেছি। তাঁর জীবনসঙ্গী নেপাল নাগ ছিলেন পূর্ববঙ্গ ও পূর্ব পাকিস্তানের গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় নেতা এবং আদমজী এলাকার শ্রমিক আন্দোলনের গোপন-প্রকাশ্য সুযোগ্য নেতা। তাঁরা দুজন জীবনসঙ্গী-দম্পতি প্রথমে পূর্ব পাকিস্তানের গোপন কমিউনিস্ট পার্টির এবং পরে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় সাম্যবাদী আদর্শে যুক্ত থেকে কমিউনিস্ট পার্টি সিপিএমের সঙ্গে যুক্ত থেকে নিবেদিত ছিলেন শোষিত মানুষের সংগ্রামে। ছেলে সুজয় নাগের রিউম্যাটিক হার্টের অসুখ হওয়ায় নিবেদিতা নাগ ১৯৫৫ সালে পূর্ব পাকিস্তান থেকে কলকাতায় চলে যান। অন্যদিকে নেপাল নাগ ১৯৬৪ সালে ভাগ হওয়া আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট পার্টির চীনের নীতির পক্ষে সমর্থন জানিয়ে কলকাতায় সিপিএমের রাজনীতিতে যুক্ত হন। চরম অসুস্থ অবস্থায় তিনি প্রয়াত হন ১৯৭৮ সালের ৫ অক্টোবর।

যদিও ১৯৫৫ সাল থেকে ঢাকা ছেড়ে কলকাতাবাসী হয়েছেন (বাধ্য হয়ে), তবু নিবেদিতা নাগ মনের দিক থেকে আজীবন যুক্ত ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের কমিউন-বাসী (গোপন পার্টি-জীবনযাপন) থাকাকালীন ‘আত্মগোপনের জীবনযাপনের’ স্মৃতিচারণে। তাঁর বাবার সূত্রে পারিবারিক বৈপ্লবিক নানা স্মৃতিসম্ভারে তিনি ছিলেন পরিপূর্ণ। সাহসী, কর্মঠ, উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত এবং উন্নত জীবনের সফল প্রয়োগে শিক্ষকতার সাফল্যে তিনি স্বপ্রতিষ্ঠিত ছিলেন। নারী আন্দোলন ও সাম্যবাদী আন্দোলনে সারা জীবন সাফল্যের সঙ্গে কৃতী মানুষ হওয়ার উদাহরণ প্রতিষ্ঠা করেছেন। সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করেছেন ঢাকার কারাজীবন। তাঁর লেখা বই, আলোচনা, বিভিন্ন প্রবন্ধ ও সাক্ষাত্কার থেকে জানা যায় তাঁর বেঁচে থাকা ৯৫ বছরের সুখ-দুঃখ-কৃতিত্ব-দাম্পত্য জীবন-বিপ্লবী জীবন-নারী আন্দোলন-কর্মজীবন-সমাজসেবার স্বর্ণময় কাহিনি। সেসব কাহিনির সূত্র ধরে নিবেদিতা দিদির সাক্ষাত্কার নিয়েছি কলকাতায় বীরেশগুহ রোডে তাঁর নিজের ২৬ নম্বর বাড়িতে।

সাক্ষাত্কারটি দুই কিস্তিতে নিয়েছি। ‘বাংলাদেশের গণ-আন্দোলনে নারীর ভূমিকা (১৯৪৭-২০০০)’ বিষয়ে গবেষণামূলক একটি বই লেখার প্রস্তুতির সময়ে নিবেদিতা নাগের প্রথম সাক্ষাত্কার নিয়েছি ২০১২ সালের ৫ জানুয়ারি। তিনি বই লিখেছেন, নানা প্রসঙ্গে তাঁর সংগ্রামমুখর ও কর্মমুখর বিপ্লবী জীবনের কথা বলেছেন ও লিখেছেন। বাংলাদেশের ঢাকায় (পূর্ববঙ্গ থেকে পূর্ব পাকিস্তানে উত্তরণের সময়কালে) তাঁর শিক্ষাজীবন, বিপ্লবী জীবনের কর্মকাণ্ড, পেশাগত শিক্ষকতা, বিপ্লবী কমিউনিস্ট নেপাল নাগের সঙ্গে পূর্বরাগ-প্রেম ভালোবাসার বিয়ে, বিপ্লবী সংসারজীবন, আত্মগোপনের সময়ে সন্তানসম্ভবা, স্বাস্থ্যহীনতা সত্ত্বেও আসন্ন মাতৃত্বের আনন্দ, নেপাল নাগের অসুস্থতা—সব ছাপিয়ে বিপ্লব-আন্দোলনের স্মৃতি রোমন্থনে তিনি কলম চালিয়ে উপহার দিয়েছেন অনেক তথ্য। ঢাকায় জেলজীবনের অধ্যায়টির বিষয়ে তাঁকে প্রশ্ন করে যতটুকু জেনেছি, তা প্রথম সাক্ষাত্কারে তুলে ধরলাম।

দ্বিতীয় সাক্ষাত্কারটি নিয়েছি ২০১২ সালের ৩০ মে। সারা দিন ধরে কথোপকথনের মধ্য দিয়ে আন্তরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ হয়ে মনপ্রাণ তৃপ্ত হয়েছিল। এই সাক্ষাত্কার রেকর্ডিং করেছিলেন বাংলাদেশের দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার কলকাতার আলোকচিত্রী ভাস্কর মুখার্জি।]

(বিস্তারিত দেখুন এপ্রিল-জুন ২০১৮ সংখ্যায়)