সম্পাদকীয়

কিছু মানুষ কর্মের মাধ্যমে নিজের যুগ ছাপিয়ে হয়ে ওঠে শাশ্বত। বেঁচে থাকে মানুষের চেতনায়, প্রেরণায়। প্রথিতযশা সমাজবিজ্ঞানী ও দার্শনিক কার্ল মার্ক্সকে অনেকগুলো পরিচয়ে পরিচিত করা যায়। কিন্তু সব ছাপিয়ে তিনি হয়ে আছেন মানুষের মুক্তির প্রেরণাশক্তি হিসেবে। জার্মানিতে জন্ম নেওয়া এই কালজয়ী ব্যক্তিটি তাঁর আজীবন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এমন সব চিন্তার জগত্ সৃষ্টি করে গেছেন, যা আজও কোটি মানুষের মুক্তির অনুপ্রেরণা জুগিয়ে আসছে। গত ৫ মে ছিল তাঁর দুই শততম জন্মবার্ষিকী। এই উপলক্ষে প্রতিচিন্তার এ সংখ্যায় কার্ল মার্ক্সের কাজকে পাঠকের সামনে তুলে আনা হয়েছে বিভিন্ন আঙ্গিকে। এই সংখ্যার বিভিন্ন লেখায় তাঁর চিন্তার ব্যবচ্ছেদ যেমন আছে, তেমনি নানা দেশে তাঁর চিন্তাকে যেভাবে ধারণ করা হয়েছে এবং এখনো টিকে আছে, সেই আলোচনাও রয়েছে।

অনেকে বলছেন, পৃথিবীতে একধরনের আদর্শিক শূন্যতা বিরাজ করছে। ফলে মানুষ পুরোনো বিশ্বাস আঁকড়ে বাঁচতে চাইছে। সব ধরনের আদর্শই দিন দিন অসাড় হয়ে পড়ছে। কোনো একটি নির্দিষ্ট আদর্শ মানুষকে তার জীবনপ্রণালি নির্দিষ্ট করে দিতে পারছে না। ফলে মানবজাতির আদর্শগত ভবিষ্যত্ নিয়ে সন্দেহ দানা বাঁধছে। সবগুলো আদর্শিক পথ নিয়েই নতুন করে ভাবনা আগের চেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। প্রতিচিন্তার এই সংখ্যায় তাই আবুল কাসেম ফজলুল হকের ‘মার্ক্সবাদ ও মানবজাতির আদর্শগত ভবিষ্যত্’ নামে একটি প্রবন্ধ ছাপা হলো। এখানে লেখক নিজের আদর্শগত অবস্থান থেকে মার্ক্সবাদকে আত্মসমালোচনার মুখে দাঁড় করিয়েছেন। এ ছাড়া তিনি মানবজাতির বিদ্যমান আদর্শগুলোর ব্যাপারে পুনর্দৃষ্টিপাত করেছেন। লেখকের দেওয়া হাবিবুল্লাহ বাহার স্মারক বক্তৃতাটিই প্রবন্ধ আকারে ছাপা হয়েছে।

বদরুল আলম খানের প্রবন্ধে পাওয়া যায় মার্ক্সের ব্যক্তিজীবনের কিছু দিক। মার্ক্সের চিন্তার আলোকে আমাদের দেশের বর্তমান হালচাল উঠে এসেছে এই লেখায়। প্রবন্ধটি ‘ট্রায়ের শহরের প্রমিথিউস’ নামে ছাপা হলো। মার্ক্সের জন্মনগরী ট্রায়ের। গ্রিক পুরাণমতে, প্রমিথিউস স্বর্গ থেকে আগুন এনে এগিয়ে নিয়েছিলেন মানবসভ্যতাকে। তেমনি মার্ক্সও তাঁর চিন্তা দিয়ে জগত্ বদলে দেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন। এই সাযুজ্য তুলে ধরতেই লেখক মার্ক্সকে ট্রায়ের শহরের প্রমিথিউস হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। গ্রিক পুরাণে পাওয়া যায়, প্রমিথিউস নশ্বর পাথর হতে হলেও শক্তিমান গ্রিক দেবতা জিউসের দাসত্ব না করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিল। মার্ক্সও পুঁজিবাদের অধীনে সৃষ্ট মানব দাসত্ব যেমন করতে অস্বীকার করেন, তেমনি তিনি সেই দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙে নতুন মানবসমাজ গড়ার স্বপ্নও দেখেছিলেন।

মার্ক্সের এসব প্রত্যয়ই ছড়িয়ে ছিটিয়ে জন্ম নিয়েছে বিশ্বব্যাপী নানা মুক্তির সংগ্রাম। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের নেতৃত্বে রুশ বিপ্লব। সারা দুনিয়া কাঁপানো সেই বিপ্লব ছিল মার্ক্সের দেখা স্বপ্ন বাস্তবায়নের একটি উল্লেখযোগ্য ধাপ। বাস্তবায়ন-কৌশলে ভুলত্রুটিসহ নানা কারণে সেই বিপ্লবের ফলে জন্ম নেওয়া সোভিয়েত ইউনিয়ন শেষ পর্যন্ত টিকে থাকেনি। কিন্তু বিপ্লবের যে ঢেউ জন্ম নিয়েছিল, তা থেমে থাকেনি। সোভিয়েত ইউনিয়ন ছাড়া আরও নানা জায়গায় জন্ম নিয়েছিল বিপ্লবী স্ফুলিঙ্গ। মার্ক্সবাদের সঙ্গে ধর্মের একটি আপাতবিরোধ থাকলেও আমরা দেখি মুসলিম-বিশ্বে মার্ক্সবাদ কেমন ছাপ ফেলে গেছে। এ প্রসঙ্গে বলতে হয় ইরানের কথা। সেখানে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য তাত্ত্বিক হিসেবে ধরা হয় আলি শারিয়াতিকে। তিনি মার্ক্সবাদের নিগূঢ় অর্থের সঙ্গে একমত হলেও ধর্মের ব্যাপারে মার্ক্সের চিন্তার সঙ্গে দ্বিমত করেছেন। কিন্তু সেই মতবিরোধ কতটুকু যুক্তিসংগত ছিল, তা নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। মার্ক্সের চিন্তা মার্ক্সবাদ রূপে বিকশিত হওয়ার পেছনে অনেকের অবদান রয়েছে। মার্ক্সবাদের সব বক্তব্যই যে মার্ক্সের দেওয়া এমন নয়। এই পার্থক্যের জের ধরে আরেকজন ইরানি তাত্ত্বিক আসেফ বায়াত আলি শারিয়াতির যুক্তিকে খণ্ডন করার চেষ্টা করেছিলেন। লেখাটি পুরোনো হলেও এর প্রাসঙ্গিকতা আজও রয়ে গেছে। সেই বিবেচনায় আসেফ বায়াতের লেখাটি আমরা বাংলায় অনুবাদ করে ছাপছি।

মার্ক্সের চিন্তাকে উপজীব্য করে উপমহাদেশেও বিপ্লবের ঢেউ লেগেছিল। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে মার্ক্সের চিন্তার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু মার্ক্স নিজেও ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশদের উপনিবেশবাদের সমালোচনায় সরব ছিলেন। মার্ক্সের সেসব লেখাজোখার আলোকে মোফাখ্খারুল ইসলাম তৈরি করেছিলেন তাঁর প্রবন্ধটি। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসন ও মার্ক্সের লেখনী নিয়ে এই প্রবন্ধটি বাংলায় অনুবাদ করে ছাপা হলো।

পরিবর্তনশীল বিশ্বে মার্ক্সবাদ কতটা প্রাসঙ্গিক, তা নিয়ে বিতর্কও চলছে পুরোদমে। আজকের বৈশ্বিক সমস্যায় মার্ক্সবাদ কীভাবে কাজে লাগবে, সে নিয়ে রয়েছে অনেক আলোচনা। তাই মার্ক্সের জন্মভূমি জার্মান দেশে মার্ক্সকে কীভাবে দেখা হচ্ছে, তা জানা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। মুহাম্মদ তানিম নওশাদ জার্মান ভাষায় প্রকাশিত লেখাজোখার আলোকে কার্ল মার্ক্সের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে লিখেছেন এই সংখ্যায়।

মার্ক্সবাদের আলোকে জীবন গড়ার অনেক নায়ক আমাদের দেশেও জন্মেছেন। তাঁদেরই একজন নিবেদিতা নাগ। আজীবন সংগ্রামী এই নেত্রী প্রয়াত হয়েছেন ২০১৩ সালে। ২০১৮ সালের ৪ আগস্ট তাঁর জন্মশতবর্ষ পূরণ হলো। মালেকা বেগম দুই কিস্তিতে তাঁর সাক্ষাত্কার নিয়েছিলেন। মার্ক্সের দুই শততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে প্রতিচিন্তার এই সংখ্যা। তাই এই সংখ্যায় বাংলার এই মার্ক্সবাদী নারী নেত্রীর জন্মশতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানোর লোভ সংবরণ করা দায়। সেই লক্ষ্যেই মালেকা বেগমের নেওয়া এই সাক্ষাত্কারটি ছাপছি। সেই সঙ্গে এই আলোচনায় উঠে আসা কিছু বামপন্থী ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে তরুণ প্রজন্মকে জানানোর উদ্দেশ্যে সাক্ষাত্কারের শেষে কিছু টীকা যুক্ত করা হয়েছে।

সারা দুনিয়াতেই বৈষম্যের পাশাপাশি অন্যতম বৈশ্বিক সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে পরিবেশের সংকট। এ বিষয়ে কার্ল মার্ক্সের চিন্তা নিয়ে রয়েছে নানা বিতর্ক। অনেকেই মার্ক্সকে দেখেন পরিবেশের ব্যাপারে উদাসীন ব্যক্তি হিসেবে। এ ব্যাপারে বেশ কিছু মার্ক্সবাদী উত্তর দিয়েছেন এর আগে। কিন্তু সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে মার্ক্সের কিছু ব্যক্তিগত নোটবুক। এগুলো প্রাকৃতিক বিজ্ঞানবিষয়ক। সেখানে রাজনৈতিক অর্থনীতির সমালোচনায় মার্ক্স কীভাবে বাস্তুতন্ত্র ও পরিবেশকে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন, তার প্রমাণাদি পাওয়া যায়। জাপানি মার্ক্সবাদী পণ্ডিত কোহেই সাইতো তাঁর সাম্প্রতিক কার্ল মার্ক্সে’স ইকোসোশ্যালিজম গ্রন্থে সেই বিষয়গুলো সবিস্তারে তুলে এনেছেন। এই সংখ্যায় সাইতোর বইটি নিয়ে আলোচনা করেছেন খলিলউল্লাহ্।

আরও দুজন স্বনামধন্য মার্ক্সবাদী অর্থনীতিবিদ সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন। একজন ঢাকায় জন্ম নেওয়া অশোক মিত্র, অন্যজন মিসরীয় বংশোদ্ভূত ফরাসি অর্থনীতিবিদ সামির আমিন। অশোক মিত্র ভারত সরকারের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা, পশ্চিববঙ্গ সরকারের অর্থমন্ত্রী ও ভারতের রাজ্যসভার সদস্য ছিলেন। অন্যদিকে সামির আমিন ইউরোসেন্ট্রিজম শব্দটি আবিষ্কারের মাধ্যমে সাড়া ফেলেছিলেন। এর মাধ্যমে তিনি পশ্চিমা সভ্যতার প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট বিশ্ববীক্ষাকে বুঝিয়েছিলেন। প্রতিচিন্তার এই সংখ্যায় তাঁদের প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।