রমজান ইবাদতের মাস। মহান রবের নৈকট্য লাভের মাস। ইবাদতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলো নামাজ। আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের প্রধান সহায়ক নফল বা বাড়তি ইবাদত। ইবাদতের জন্য দিন অপেক্ষা রাত উত্তম। আল্লাহ বলেন, ‘হে কম্বলাবৃত! রাতে দণ্ডায়মান হও কিছু অংশ বাদ দিয়ে; অর্ধরাত্রি অথবা তদপেক্ষা কিছু কম অথবা তদপেক্ষা বেশি এবং কোরআন তিলাওয়াত করো সুবিন্যস্তভাবে ও স্পষ্টভাবে। আমি তোমার প্রতি অবতীর্ণ করেছি গুরুত্বপূর্ণ বাণী। নিশ্চয় ইবাদতের জন্য রাত্রিতে ওঠা প্রবৃত্তি দমনে সহায়ক এবং স্পষ্ট উচ্চারণের অনুকূল। নিশ্চয় দিবাভাগে রয়েছে তোমার দীর্ঘ কর্মব্যস্ততা। তুমি নিজ পালনকর্তার নাম স্মরণ করো এবং একাগ্রচিত্তে তাতে নিমগ্ন হও (সুরা-৭৩ মুজাম্মিল, আয়াত: ১-৮)।’
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, ‘হে বস্ত্রাবৃত! ওঠো, সতর্ক করো, আপন পালনকর্তার মাহাত্ম্য ঘোষণা করো, স্বীয় পোশাক পবিত্র করো এবং অপবিত্রতা থেকে দূরে থাকো। অন্যকে কিছু দান করে অধিক প্রতিদান আশা করবে না। আর তোমার পালনকর্তার উদ্দেশে ধৈর্য ধারণ করো (সুরা-৭৪ মুদ্দাচ্ছির, আয়াত: ১-৭)।’
ফরজ নামাজের পর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হলো তাহাজ্জুদ নামাজ। আল্লাহর রাব্বুল ইজ্জাত প্রিয় নবীজি (সা.)-কে লক্ষ্য করে কোরআন কারিমে বলেন, ‘এবং রাত্রির কিছু অংশ তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করো, ইহা তোমার এক অতিরিক্ত কর্তব্য। আশা করা যায়, তোমার প্রতিপালক তোমাকে প্রতিষ্ঠিত করবেন প্রশংসিত স্থানে—মাকামে মাহমুদে (সুরা-১৭ ইসরা, আয়াত: ৭৯)।’
রহমতের শ্রেষ্ঠ মাস রমজান। রহমতের শ্রেষ্ঠ সময় তাহাজ্জুদের সময়। শবে কদরসহ বছরের বিশেষ রাতগুলোতে সূর্যাস্তের পর আল্লাহ তাআলা দুনিয়ার নিকটতম আসমানে অবতরণ করেন। তাহাজ্জুদের সময়ে প্রতি রাতেই আল্লাহ তাআলা প্রথম আসমানে এসে বান্দাদের আরজি ও আবেদন-নিবেদন শোনেন।
সন্ধ্যারাতে ঘুমিয়ে মধ্যরাতের পর শয্যাত্যাগ করাকে তাহাজ্জুদ বলা হয়। তাহাজ্জুদ নামাজের সময় রাতের দুই-তৃতীয়াংশ অতিবাহিত হওয়ার পর থেকে তথা রাত দুইটার পর থেকে ফজরের ওয়াক্ত শুরু হওয়ার আগপর্যন্ত। সাহ্রির সময় শেষ হলে তথা ফজরের ওয়াক্ত শুরু হলে তাহাজ্জুদের ওয়াক্ত শেষ হয়। তাই তাহাজ্জুদের আগে ঘুমানো এবং ঘুম থেকে উঠে তাহাজ্জুদ পড়া উত্তম।
প্রিয় নবীজি (সা.) প্রতি রাতেই তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করতেন। তাই এটি সুন্নত, অতিরিক্ত হিসেবে নফল। নবীজি (সা.)-এর জন্য এটি অতিরিক্ত দায়িত্ব ছিল। পাঁচ ওয়াক্ত নির্ধারিত নফলের মধ্যে তাহাজ্জুদ সর্বোৎকৃষ্ট আমল। হজরত আলী (রা.) বলেছেন, ‘যঁারা রাত জেগে তাহাজ্জুদ পড়েছেন, তাঁরাই আধ্যাত্মিক জগতে আল্লাহর নৈকট্য লাভে ঊর্ধ্বারোহণ করেছেন (দিওয়ানে আলী, নাহজুল বালাগা)।’ তাহাজ্জুদ হলো মোক্ষ লাভের মোক্ষম মাধ্যম। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘ফরজ নামাজগুলোর পর উত্তম নামাজ হলো তাহাজ্জুদ (মুসলিম, আলফিয়্যাহ, পৃষ্ঠা: ৯৭, হাদিস: ৪০৫)।’
মানুষের মধ্যে এ বিষয়ে নানা কুসংস্কার বিদ্যমান আছে। যেমন ‘তাহাজ্জুদ অন্ধকারে পড়তে হয়’, ‘তাহাজ্জুদ গোপনে পড়তে হয়’, ‘তাহাজ্জুদ পড়লে জিন আসে’ কিংবা ‘তাহাজ্জুদ শুরু করলে নিয়মিত আদায় করতে হয়।’ এসব ভয়ে ও বিভ্রমে অনেকে তাহাজ্জুদ পড়েন না। প্রকৃতপক্ষে এসব ভুল ধারণা। তবে কারও ঘুমের ব্যাঘাত যেন না হয় এবং প্রচার মানসিকতা যেন না থাকে, এ বিষয়ে যত্নশীল ও সতর্ক থাকতে হবে। তাহাজ্জুদ নিয়মিত আদায় করতে পারলে তা অতি উত্তম।
প্রত্যেকের উচিত নিজে ইবাদত করার পাশাপাশি আপনজন ও নিকট স্বজনদের ভালোবাসা ও আন্তরিকতার মাধ্যমে ইবাদতে শামিল করার চেষ্টা করা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা সেই স্বামীর প্রতি রহম করেন, যে নিজে রাতে উঠে তাহাজ্জুদ পড়ে এবং তার স্ত্রীকে জাগায়। যদি সে উঠতে অস্বীকার করে, তবে তার মুখমণ্ডলে পানি ছিটা দেয় (আবু দাউদ ও নাসায়ি, আলফিয়্যাহ, পৃষ্ঠা: ৯৭, হাদিস: ৪০৭)।’
নফল নামাজে রুকু, সিজদাসহ প্রতিটি রুকন বা পর্ব দীর্ঘ করা সুন্নত। এ জন্য রুকু ও সিজদায় তাসবিহ অনেকবার পড়া যায় এবং অন্যান্য পর্বেও বেশি পরিমাণে বিভিন্ন দোয়া, মাসুরা, যা কোরআন-হাদিসে আছে পাঠ করা যায়। একই রাকাতের একই সুরা বারবার এবং বিভিন্ন সুরা ও বিভিন্ন আয়াত পড়া যায়। এ জন্য সুন্নত ও নফল নামাজে কিরাতে তিলাওয়াতের তারতিব বা ধারাবাহিকতা বজায় রাখাও জরুরি নয়।
রমজান মাসে ফরজ রোজা পালনের জন্য সাহ্রি খাওয়ার সুন্নত আদায়ের জন্য উঠতে হয় এবং সাহ্রির সময়ই হলো তাহাজ্জুদের সময়। সুতরাং রমজানে তাহাজ্জুদ আদায় করা খুবই সহজ। তাহাজ্জুদ ২ রাকাত করে ৮ রাকাত, ১২ রাকাত বা আরও কম বা বেশিও পড়া যায়। রমজানের নফলের সওয়াব ফরজের সমান, ফরজের সওয়াব ৭০ গুণ। তাই রমজানে তাহাজ্জুদের সহজ ও সুবর্ণ সুযোগ কাজে লাগানোই বুদ্ধিমানের কাজ।
● মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম। [email protected]