চুরি যাওয়া ভোট

আঁকা: আসিফুর রহমান
আঁকা: আসিফুর রহমান

ভোট নিয়ে আমার আম্মার খুব দুঃখ। আম্মা প্রতিবার ভোট দিতে গিয়ে গড়বড় করে ফেলেন।
একবার কলাগাছ মার্কায় ভোট দিতে গিয়ে আম্মা ভোট দিয়ে এলেন রিকশা মার্কায়। হুডঅলা রিকশার ছবি দেখে আম্মা ভেবেছিলেন ওটাই কলাগাছ।
আরেকবার মোমবাতি মার্কায় ভোট দিতে গিয়ে আম্মা ভোট দিয়ে এলেন বল্লম মার্কায়। আম্মার দোষ নেই। জ্বলন্ত মোমবাতির আঁকা ছবি দেখতে তো বল্লমের মতোই।
ভোট দিতে গিয়ে গড়বড় করেন—এই নার্ভাসনেসের কারণে গতবার সিল মারতে গিয়ে হাত কাঁপছিল। শেষ পর্যন্ত সিল মেরে দেখলেন, সিল গিয়ে পড়েছে দুটো মার্কার মাঝখানে!
কদিন আগে ফোন করে বললাম, ‘আম্মা এইবার টেনশন নেই। কলাগাছ মনে করে রিকশায়, মোমবাতি মনে করে বল্লম আর হাত কাঁপাকাঁপি করতে গিয়ে যে মার্কাতেই গিয়ে সিল পড়ুক না কেন, ভোট পড়বে নৌকাতেই। এবার নির্বাচন কমিশন যে ব্যালট পেপার ছাপিয়েছে, তাতে নাকি সবই নৌকার প্রতীক।
আওয়ামী লীগ নির্বাচন করছে, প্রতীক নৌকা। ওয়ার্কার্স পার্টি ইলেকশন করছে। তাদের কোনো কোনো প্রার্থীর প্রতীক নৌকাই। জাসদ (ইনু) ইলেকশন করছে, তাদেরও কোনো কোনো প্রার্থীর প্রতীক নৌকা। পত্রিকায় দেখলাম, তরীকত ফেডারেশন ইলেকশন করছে, প্রতীক নৌকাই! জাতীয় পার্টি (মঞ্জু) আর বিএনএফের প্রতীক আলাদা। বাইসাইকেল আর টিভি। এই শুনে আমার এক সহকর্মী বলল, ওরা বুদ্ধি করে প্রতীক বদলায় নিতে পারে। নৌকাভর্তি বাইসাইকেল কিংবা নৌকাভর্তি টিভি!
আম্মাকে বললাম, ‘অভিনন্দন আম্মা। এইবার আর ভোট মিস নেই!’

দুই.
শৈশবে ভোটের পোস্টার সংগ্রহ করা ছিল আমাদের নেশা। ভোটের মাইকিংয়ের গাড়ির পেছনে ছুটে ছুটে আমরা পোস্টার নিতাম। মাইকিংগুলো শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে যেত। একটা স্লোগান তো এখনো মনে পড়ে—একটা ভোটের মূল্য আছে, ভোট দেবেন না কলাগাছে।
পরে বুঝেছি কথাটা কত সত্যি। একটা ভোট ব্রিটিশ সিংহাসনে বসিয়েছিল রাজা প্রথম জর্জকে। একটা ভোটের ব্যবধানে অ্যারন বার মার্কিন প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি। এক ভোটের কারণে অভিশংসন থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন অ্যান্ড্রু জনসন, টিকিয়ে রাখতে পেরেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্টের গদি। এক ভোটের কারণে ওয়াশিংটন রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এক ভোটের ব্যবধানে মার্কিন সংবিধানের ১৯তম সংশোধনী পাস হয়েছে, যার ফলে নারীরা পেয়েছেন ভোটাধিকারের স্বীকৃতির মতো গুরুত্বপূর্ণ অধিকার।
১৮৪৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানার সুইজারল্যান্ড কাউন্টির ফ্রিম্যান ক্লার্ক নামের এক ভোটার নির্বাচনের দিন খুবই অসুস্থ ছিলেন। শেষে ছেলের কোলে চড়ে ভোট দিতে এসেছিলেন। বাড়ি ফেরার পথেই ক্লার্ক মারা যান। সেই ক্লার্ক রাজ্য সিনেটরের পদে ভোট দিয়েছিলেন ডেভিড কেলসোকে।
ভোটের ফলাফলে দেখা যায়, কেলসো এক ভোটের ব্যবধানে নির্বাচিত! সেই কেলসো সিনেটর হিসেবে ভোট দেন এডওয়ার্ড হানিংগানকে। এবার মাত্র এক ভোটের ব্যবধানে নির্বাচিত হয়েছিলেন হানিংগান! ঘটনা এখানেই শেষ নয়। মার্কিন সিনেটে মহাগুরুত্বপূর্ণ একটি বিল পাস হয় মাত্র ২৭-২৫ ভোটের ব্যবধানে। যে দুটো ভোট মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল, তার একটি দেন হানিংগান। এক ভোটের কারণে কত কিছুই না হয়ে গেছে। আর এর সবকিছুই শুরু হয়েছিল সেই অসুস্থ ভোটার ক্লার্কের দেওয়া একটি ভোটের কারণেই!
একটি ভোটের কত মূল্য! অথচ এবার জাতীয় নির্বাচনে চার কোটি ৮৩ লাখ ভোটারই ভোট দিতে পারেননি। বিনা ভোটেই নির্বাচিত হয়ে গেছেন ৩০০ আসনের ১৫৩ জন সাংসদ! এই ভোটাররা জানতেই পারলেন না তাঁদের জনপ্রতিনিধি কে—মহামান্য কোনো নেতা, নাকি কলাগাছ!

তিন.
লেখাটা গুরুগম্ভীর হয়ে যাচ্ছে। লেখাটাকে এবার আমরা হালকা করব। আসেন একটা কৌতুক শুনি। চুরি করা কৌতুক অবশ্য:
ভোটার নেই, নির্বাচনী আমেজ নেই, মিটিং-মিছিল নেই, স্লোগানের হট্টগোল নেই। কিন্তু তার পরও এক নেতা হাজার হাজার পোস্টার ছাপিয়েছেন। প্রেসের লোক এসে বলল, ‘স্যার, এত পোস্টার ছাপাইলেন, বিলটা কিন্তু এখনো পাইলাম না।’ নেতা বললেন, ‘খাড়াও মিয়া। সংসদে তো যাইতেছিই। তখন তো খালি বিলই পাস করমু।’
কী বললেন? চুরি করা কৌতুক কেন? আরে ভাই, এই মহান গণতন্ত্রের কালে ভোটের অধিকারই চুরি হয়ে যাচ্ছে, আর এ তো স্রেফ কৌতুক চুরি।
কী বললেন, পুরা লেখাটাই জঘন্য হয়েছে? নির্বাচনী কৌতুক জমল না? ভাই, আপনাকে রস+আলো পড়তে কে বলছে? ভোট আর ভোটের ফল গণনা দেখেন। এর চেয়ে ভালো কৌতুক আর কই পাবেন!