আমার বন্ধু রুবেল

.
.

ছোটবেলায় পড়েছি, আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে, তা নিয়েই পরিবেশ। কিন্তু রুবেলের ক্ষেত্রে ঘটনা ভিন্ন। রুবেলের চারপাশে যা কিছু আছে, তা নিয়েই তার ফেসবুক স্ট্যাটাস। আমাদের জীবন কেবলই যাতনাময় হলেও রুবেলের তা নয়। তার জীবন ফেসবুকময়। প্রতিদিন ‘গুড মর্নিং ফ্রেন্ডস, এইমাত্র ঘুম থেকে উঠলাম’ টাইপ স্ট্যাটাস দেওয়ার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে দিন শুরু করে সে। দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো, আমি শুধু রুবেলের ক্লাসমেটই নই, রুমমেটও। দিনের অধিকাংশ সময়ে তার এই অনলাইন অত্যাচার সহ্য করতে হয় আমাকে। রুবেল গভীর রাত পর্যন্ত বাতি জ্বালিয়ে ফেসবুকে চ্যাটিং করে, আমি কিছুই বলি না। পাশে শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করি। বাতি জ্বললে আমার ঘুম হয় না।
রুবেলের চারপাশে কিছু ঘটলে সে স্ট্যাটাস দেবেই, না ঘটলেও সমস্যা নেই। ‘কেন কিছু ঘটছে না’—এই মর্মে একটা দীর্ঘ স্ট্যাটাস রচনা করবে সে। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, মানুষ তার স্ট্যাটাস পড়ে। শুধু পড়েই না, লাইকও দেয়, এমনকি ‘চরম লিখসেন ভাই’ টাইপের কমেন্টও করে।
রুবেলের কাছে ফেসবুকই সব, আমরা পানিভাত। রুবেলের প্রেমিকাটাও ওরই মতো; সারা দিন ফেসবুকে পড়ে থাকে। এখনো দুজন অনলাইনে চ্যাট করছে। আমি বললাম, ‘সন্ধ্যায় বিয়ের দাওয়াত আছে, যাবি?’
‘আমার প্যান্ট নাই।’
‘মানে!’
‘প্যান্ট ইস্তিরি করা নাই।’
‘তোর যেতে হবে না।’
‘গেলে সাবধানে যাইস, দেশের অবস্থা ভালো না। ব্যাপক ধরপাকড় চলতেসে। তোর তো বাটপার টাইপ চেহারা; নিশ্চিত পুলিশ ধরবে। ধরলে আমারে ফোন দিস।’
মনটাই ভালো হয়ে গেল। পাটিগণিত যেমন ভুল বুঝি, রুবেলকেও তেমনই ভুল বুঝেছি। দিন-রাত ফেসবুকে পড়ে থাকলেও ছেলেটা ভালো। আমাকে নিয়েও ভাবে। বললাম, ‘ফোন দিলে কী করবি?’
‘স্ট্যাটাস দিব, ‘‘আমার বন্ধুকে পুলিশ ধরেছে’’—কী দারুণ একটা স্ট্যাটাস হবে!’
মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। গত মাসে টিপু কারাতে শিখতে বলেছিল, রাজি হইনি। এখন আফসোস হচ্ছে, কারাতে জানলে ল্যাং দিয়ে রুবেলের পা ভাঙতাম। সময় থাকতে শিখিনি, কী আর করা, কম্বল টেনে শুয়ে পড়লাম।
সন্ধ্যায় দেখি, রুবেল তার ল্যাপটপের ব্যাগ নিয়ে ফিটফাট হয়ে রেডি। বলল, ‘একা একা যাবি ভেবে খারাপ লাগল, রেডি হয়ে গেলাম। তা ছাড়া আজ ক্যানটিনে জঘন্য সবজি রেঁধেছে।’
‘ল্যাপটপ নিচ্ছিস ক্যান?’

.
.

‘ল্যাপটপ হলে রেখে যাওয়া ঠিক না। কখন কে আইডি হ্যাক করে ফেলবে, তার ঠিক আছে? তা ছাড়া একটা চেক ইন...প্রতি মুহূর্তে কত গুরুত্বপূর্ণ স্ট্যাটাস দেওয়া যায়।’ যেতে যেতে এসবই বোঝাচ্ছিল রুবেল।
অনুষ্ঠানে গিয়ে আমি বর-কনে দেখি, রুবেল দেখে হোমপেজ। আমি নিশ্চিত, এরই মধ্যে বিবাহসংক্রান্ত একটা স্ট্যাটাসও দিয়েছে সে। খাওয়া ও বিদায় পর্ব শেষ করতে করতে রাত হয়ে গেল। বাস না পেয়ে রিকশা নিলাম আমরা। ফেসবুককেন্দ্রিক বাসের সময়সূচি চালু করলে কত সুবিধা, তা বোঝাচ্ছিল রুবেল। হঠাৎ কোত্থেকে দুই তরুণ এসে রিকশা থামাল। সঙ্গে সঙ্গে চারপাশ থেকে ছুটে এল আরও কয়েকজন। রুবেলের পেটে বিশাল এক ছুরি ঠেকিয়ে মিষ্টি সুরে একজন বলল, ‘চুপচাপ থাকুন, আপনাকে কিচ্ছু দিতে হবে না, আমরাই নিচ্ছি।’ এরপর সঙ্গে যা ছিল, সব নিয়ে যেমন হঠাৎ এসেছিল, তেমনি হঠাৎ চলে গেল। আমরা হতবাক। অনেকক্ষণ পর আমি বললাম, ‘পকেটে একটা টুথপিক ছিল, ওটাও নিয়ে গেছে।’ রুবেল কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ‘ল্যাপটপ-মডেমও নিয়ে গেছে, একটা স্ট্যাটাস যে দেব, সে উপায় নাই।’
রিকশাচালক দয়া করে আমাদের হলে নামিয়ে দিল। রুবেল দ্রুত পাশের রুমের জহির ভাইকে গিয়ে বলল, ‘জহির ভাই, একটা স্ট্যাটাস দেওয়া যাবে?’ এরপর ছিনতাইকারীদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের পুরো ঘটনাটা ‘দেশের নিরাপত্তাব্যবস্থা ও যুবসমাজের অধঃপতন’ শীর্ষক একটা স্ট্যাটাস লিখে রুমে ফিরে এল।
কিছুক্ষণ পর আমাদের আরেক রুমমেট এসে বলল, ‘রুবেল, তোর ফোন।’ রুবেল ‘হ্যালো, কে?’ বলেই ফোন নিয়ে বারান্দায় চলে গেল। একটু পর হতাশমুখে ফিরে বলল, ‘জেরিনের সঙ্গে বোধ হয় ব্রেকআপ হয়ে গেল রে!’
‘শাবাশ!’
‘ছিনতাইয়ের ঘটনাটা ওকে আগে না জানিয়ে স্ট্যাটাস দিয়েছি, এ জন্যই ব্রেকআপ। আমার কাছে নাকি ওর চেয়ে ফেসবুক বড়!’
‘ঠিকই তো।’
‘আমার কি ওর মোবাইল নাম্বার মুখস্থ? আমি যে ফেসবুক পাসওয়ার্ড ছাড়া কিছু মনে রাখতে পারি না, এইটা ও জানে না?’
‘এখন কী করবি?’
‘জহির ভাইয়ের কাছে যাব। ব্রেকআপের ব্যাপারটা ক্লিয়ার করে রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস ‘‘সিঙ্গেল’’ করতে হবে।’
ওর কথা শুনে আমি বোধ হয় বিশ্বের দীর্ঘতম নিঃশ্বাস ফেলার রেকর্ডটা ভঙ্গ করলাম।