একই ছাদের নিচে থাকার স্বপ্ন

গুলশানের এক বাড়ির বারান্দায় একটা বিদেশি খাঁচা। খাঁচার ভেতর এক জোড়া টিয়াপাখি। মেয়ে টিয়াটার নাম টুকি, ছেলেটার নাম টাকি। অনেক দিন থেকেই তারা এক খাঁচার বাসিন্দা। প্রতিদিনের মতো আজও ঘুম থেকে উঠে টুকি দেখল, খাঁচার শিকগুলো কামড়ে বাঁকা করার চেষ্টা করছে টাকি।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে টুকি বলল, ‘ওগুলো লোহার শিক। জানোই তো নাড়াতে পারবে না। তাও রোজ টানাটানি করো কেন?’
: তোমার মুখের দিকে তাকিয়েই তো বের হওয়ার চেষ্টা করি।
: সত্যি? তুমি আমাকে নিয়ে এত ভাবো?
: হ্যাঁ। তোমাকে দেখলেই মনে হয়, এই মেয়ের সঙ্গে এখানে আর এক মুহূর্তও নয়। তখনই শিক ধরে টানাটানি করি। যদি কিছু হয়।
: আমার জায়গায় অন্য কোনো মেয়ে হলে বহু আগেই তোমাকে ছেড়ে চলে যেত।
: অন্য কোনো মেয়ে হলে কি খাঁচার মালিক খাঁচা খুলে দিত? তাই তো বলি, তোমার জন্যই এই খাঁচায় আটকে আছি!
: উফ! অসহ্য! আমার মরণ হয় না কেন?
: আমিও তো তা-ই ভাবি। সমস্যাটা কোথায়?
: তুমি আমার সঙ্গে আর একটা কথা বলবে না। নো টক।
ফলে সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে গেল টুকি-টাকির কথা। দুজনেই ভাবছে, ‘ও যদি আগে কথা না বলে তাহলে আমি বলব না।’ এরই মাঝে একবার খাঁচার দরজা খুলে খাবার দিয়ে গেল একজন। মরিচ খেতে খেতে টুকি বলল, ‘কেউ একজন দেখুক, খাবার দেওয়া হয়েছে।’ জবাবে খাঁচার অন্য পাশ থেকে বিকট শব্দে গান শুরু করল টাকি। টুকিও কম যায় না। সবগুলো মরিচ একাই সাবাড় করে চুপচাপ কান ঢেকে বসে রইল সে। একটু পর টাকি খাবার খেতে এসে দেখে, একটা মরিচও নেই!

ওদের পরিচয় হয়েছিল সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম বার্ডসবুকে। এক ঘুঘু স্ট্যাটাসে লিখেছিল, ‘আজকালকার টিয়াগুলা বেয়াদব। মুরব্বি মানে না।’ কমেন্টে এর তীব্র প্রতিবাদ করেছিল টাকি। তাকে সমর্থন দিচ্ছিল টুকি। একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে টুকি-টাকি দুজনকেই ব্লক করে দেয় সেই ঘুঘু। তারপর আস্তে আস্তে ঘনিষ্ঠ হতে থাকে টুকি-টাকি। রাত জেগে চ্যাটিং, কত কথা...

দ্বিতীয় পর্বের খাবার আসতে এখনো অনেক দেরি। এদিকে ব্যাপক খিদে পেয়েছে টাকির। কিন্তু কিছু বলছে না। হঠাৎ পুরোনো কথা মনে পড়ে গেল তার।
: টুকি, সেই দিনগুলোর কথা তোমার মনে পড়ে?’

টুকিও আবেগে আপ্লুত হয়ে বলল, ‘হ্যাঁ। সেসব দিন আমার মনে এখন কচকচে ছোলার মতোই নতুন, টাটকা।’
: মনে আছে, আমাদের প্রথম দেখার কথা?
‘হ্যাঁ’ বলেই টুকি চোখের সামনেই দেখতে পেল সেই সব ঘটনা। ওদের পরিচয় হয়েছিল সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম বার্ডসবুকে। এক ঘুঘু স্ট্যাটাসে লিখেছিল, ‘আজকালকার টিয়াগুলা বেয়াদব। মুরব্বি মানে না।’ কমেন্টে এর তীব্র প্রতিবাদ করেছিল টাকি। তাকে সমর্থন দিচ্ছিল টুকি। একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে টুকি-টাকি দুজনকেই ব্লক করে দেয় সেই ঘুঘু। তারপর আস্তে আস্তে ঘনিষ্ঠ হতে থাকে টুকি-টাকি। রাত জেগে চ্যাটিং, কত কথা। বর্তমান পাখি সমাজের নৈতিক অবক্ষয়, দোয়েল ভালো গান গায়, নাকি কোকিল? পক্ষী সমাজের উন্নয়নে টিয়াদের করণীয় এসব নিয়ে আলোচনা তো ছিলই, ছিল নিজেদের সুখ-দুঃখের কথাও। একপর্যায়ে দুজনই বুঝতে পারে, তারা একে অপরকে ভালোবাসে।
ওদের আর আটকে রাখবে কে? দুজন একসঙ্গে উড়ে বেড়ায়। মরিচ-খেতে বসে মরিচ খায়। কত আনন্দ তাদের মনে! একদিন, এক গাছের নিচে পেয়ারা পড়ে থাকতে দেখে ছুটে গেল দুজনে। পেয়ারা খেতে খেতে টুকি বলল, ‘আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি টাকি।’
: আমিও।
: ইশ্, কবে যে আমরা দুজন এক ছাদের নিচে থাকতে পারব!
: চিন্তা কোরো না। খুব বেশি দেরি নেই।
সঙ্গে সঙ্গে ঝুপ করে একটা শব্দ হলো। টুকি-টাকি হতভম্ব হয়ে দেখল, তারা জালে আটকে আছে। সেই থেকে তারা দুজন একই খাঁচায় বন্দী।

স্মৃতিচারণা শেষে দীর্ঘশ্বাস ফেলল দুজনই। টুকি ডানার অগ্রভাগ দিয়ে চোখের জল মুছে বলল, ‘তোমার জন্যই আজ আমার এই অবস্থা। এসব কিছুর জন্য তুমি দায়ী। তুমিই আমাকে পেয়ারাগুলো দেখিয়েছিলে।’
: ও তাই! পেয়ারা দেখালেই খেতে হবে? ‘চলো পেয়ারা খাই’ এ কথা কে বলেছিল? তুমি! ইউ! তুমিই দায়ী।
: ইশ্, তোমার মতো বেকারের সঙ্গে না ঘুরে ওই জ্যোতিষীর টিয়ার প্রস্তাব মেনে নিলে আজ কত সুখে থাকতাম। কার ভাগ্যে কী আছে না আছে সেই খাম বাছতাম।
: আমিও যদি তোমার সঙ্গে না জড়িয়ে সার্কাসের দলে যোগ দিতাম! কত মানুষ খেলা দেখে তালি দিত! আহা, মীনা কার্টুনে মিঠু চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাবটাও তোমার জন্য ফিরিয়ে দিলাম। বিগ মিসটেক! বড় ভুল।
: তোমাকে ভালোবেসে আমিও ভুল করেছি। তোমার জন্যই আমি বাবা-মা, বন্ধুবান্ধব ছেড়ে এই খাঁচায় বন্দী! কত দিন ঠোঁটে লিপস্টিক, নখে নেইলপলিশ দিয়ে বাইরে ঘুরি না!
: ভুলে যেয়ো না, তুমিই কিন্তু এক ছাদের নিচে থাকতে চেয়েছিলে। তার মানে তোমার মনে আগে থেকেই এই ষড়যন্ত্র ছিল। সব তোমার দোষ।
: তোমার।
: না তোমার।
: বেরিয়ে যাও এখান থেকে।
: তুমি বেরিয়ে যাও।
: আমার সঙ্গে কথা বলবে না। নো টক।
ফলে আবারও সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে গেল টুকি-টাকির কথা। বাইরে থেকে ওদের ঝগড়া দেখছিল এক তরুণ আর এক তরুণী। তরুণীটি বলল, ‘দেখেছ, ওরা কত কিউট! কি সুইট করে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। পরস্পরকে খুব ভালোবাসে ওরা।’
: আসলেই। আমরা কবে ওদের মতো এক ছাদের নিচে থাকব?
: চিন্তা কোরো না। খুব বেশি দেরি নেই।