বীরপুরুষের দেশে

মনে করো, মাকে নিয়ে যাচ্ছি...না না, অনেক দূরে নয়! এই তো, এই ঢাকা শহরে। মা আর আমি আছি এক রিকশার ওপর চড়ে। মায়ের গায়ে সবুজ রঙের শাড়ি। মায়ের কপালে লাল রঙের টিপ। মা যেন আমার একদম বাংলাদেশ। মাকে সে কথা বলতেই বলল, ‘বাহ্, তুই তো ছোট্ট বয়সেই অনেক ভারী ভারী চিন্তা করতে শিখে গেছিস!’

মা জানে না, আমার বয়স অল্প হলে কী হবে, আমি আরও অনেক অনেক অনেক চিন্তা করতে পারি। এই যেমন রাস্তাঘাটে সবাই যে যার মতো চলাফেরা করে, আমি জানি এটা ভুল। আমি জানি, সবাইকে ট্রাফিক আইন মেনে চলতে হবে। পদচারী–সেতু দিয়ে রাস্তা পার হতে হবে। কিংবা রাস্তা যখন পেরিয়ে যাব, তখন ডানে-বাঁয়ে তাকাতে হবে। এসব আমি জানি, মায়ের হাত ধরে ধরে আমি এভাবেই তো রাস্তা পার হই। কিন্তু অনেককেই দেখি, কোনো দিকে না তাকিয়ে, ফোনে কথা বলতে বলতে রাস্তা পার হয়ে যায়।

আবার রাস্তায় যেসব যানবাহন চলাফেরা করে, সেগুলোও যেন কেমন পাগল পাগল হয়ে থাকে। তারা ধা করে আসে, শাঁ করে বেরিয়ে যায়। লোক ওঠাতে তারা খুবই ব্যস্ত। তারা এতই উদ্ভট আচরণ করে যে মমতাজ আন্টি তাদের নিয়ে গান করেন। বলেন, ‘বন্ধু তুই লোকাল বাস, আদর করে ঘরে তুলস, ঘাড় ধইরা নামাস!’ মানে, বাসগুলোর ব্যবহার যে খুব খারাপ, এটা বোঝা যায়। যেটা আমি বুঝি, মমতাজ আন্টি বোঝেন, রাস্তার প্রায় সবাই বোঝে, সেটা বড় বড় মানুষেরা বোঝেন না। তাঁরা তাই তাদের কিচ্ছু বলেন না। আমরা কিছু বলতে গেলেই বলেন, ‘তোমরা ছোট, তোমরা কী বোঝো! তোমরা চুপ থাকো!’

আমরা চুপ থাকি। চুপ থেকে বড়দের অদ্ভুত অদ্ভুত কাণ্ডকারখানা দেখি। কাণ্ডগুলো এতই অদ্ভুত যে কখনো কখনো আমরা হেসে ফেলি, আবার কখনো কখনো আমাদের চোখে পানি চলে আসে। সেবার আমাদের স্কুলের ফারিয়াকে একটা বাস ধাক্কা দিল। আমরা সবাই মিলে তাকে ধরে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। ফারিয়ার কষ্ট দেখে আমাদের চোখে পানি চলে এল। কিন্তু আমাদের বড়রা অন্যের কষ্টের কথা শুনলে কেমন হো হো করে হাসে। সে হাসি দেখে আমাদের বুকের রক্ত হিম হয়ে আসে। আমরা কিছু বলতে গেলেই সেই বড়রা বলে, ‘আহ্, চুপ থাকো তো তোমরা! তোমাদের না স্কুল আছে! যাও, স্কুলে যাও!’

তাই আমরা আর কিছু বলি না। আমি তো বলিই না। মায়ের হাত ধরে যখন ঘুরতে বের হই, রিকশায় চড়ে যখন হেলতে-দুলতে যাই, তখন কিছু বলতেও ইচ্ছা করে না। মনে হয়, মায়ের মুখের দিকে শুধু তাকিয়ে থাকি। কিন্তু তাকিয়ে থাকতে থাকতেই হঠাৎ খেয়াল করলাম, হা রে রে রে রে বলে দূর থেকে একটা বাস ছুটে আসতে থাকল আমাদের সামনে। পেছনে তাকিয়ে দেখি আরও দুটি বাস—একে অপরের সঙ্গে পাল্লাপাল্লি করে ছুটে আসছে! আর আসতে না আসতেই, একটা বাস, আমাদের রিকশাটাকে দিল এক ধাক্কা!

মা আমাকে শক্ত করে ধরে থাকল ঠিকই, কিন্তু মা নিজেই পড়ে গেল। মায়ের কপাল ফেটে রক্ত বের হলো। সবুজ শাড়ি হয়ে গেল লাল। বাসগুলো ডাকাতের মতো হা রে রে রে রে করতে থাকল। মায়ের মুখ ভয়ে একেবারে শুকিয়ে গেছে যেন। বড় বড় মানুষ তখন অনেক দূরে। তারা দূর থেকে আরও আরও দূরে চলে যাচ্ছে।

মায়ের কপালে রক্ত, মায়ের চোখে ভয়...এখনো কি আমি চুপ থাকব?

না, মাকে আমি বললাম, ‘আর ভয় পেয়ো না, মা।’ আমি ওই হা রে রে রে করা বাসগুলোর সামনে রুখে দাঁড়ালাম। আর কী কাণ্ড! আমার সঙ্গে ছুটে এল আমার সমানই শত শত ছেলেমেয়ে। ডাকাতের মতো বাসগুলো আমাদের দিকে তাকিয়ে কত চোখ রাঙাল। বারবার তাদের চাকাগুলো উঠিয়ে দিতে চাইল আমাদের বুকের ওপরে। কিন্তু আমাদের সংখ্যা আরও বাড়তে থাকল। ওরা সবাই একসঙ্গে বলল, ‘আমরা আমাদের মাকে জখম দেখতে পারব না! আমরা আমাদের মাকে নিরাপদ রাখতে চাই!’ ঝড় এল, বৃষ্টি এল, শিলার মতো এল বড়দের বকুনি, কিন্তু আমরা আমাদের জায়গা থেকে সরলাম না। মাকে বারবার বলতে থাকলাম, ‘ভয় পেয়ো না মা! ভয় পেয়ো না! আমরা আছি! আমরাই আছি!’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বীরপুরুষ’ কবিতাটা তো আমাদের মুখস্থ। আমরা সেখান থেকে লাইনগুলো পড়তে থাকলাম—

এত লোকের সঙ্গে লড়াই ক’রে

ভাবছ খোকা গেলই বুঝি মরে।

আমি তখন রক্ত মেখে ঘেমে

বলছি এসে, ‘লড়াই গেছে থেমে।’

তুমি শুনে পাল্‌কি থেকে নেমে

চুমো খেয়ে নিচ্ছ আমায় কোলে।

বলছ, ‘ভাগ্যে খোকা সঙ্গে ছিল,

কী দুর্দশাই হত তা না হলে!’