নাটকের মানুষের জীবনঘনিষ্ঠ আচরণ

ছবি: ফেসবুক থেকে
ছবি: ফেসবুক থেকে

হাজার হাজার নাটকের ভিড়ে মাত্র দুয়েকটা নাটকই সুড়ঙ্গের ভেতর আলো হয়ে ধরা দেয়। মন্ত্রী এখন পাবলিক বাসে নাটকটি ঠিক তেমনই একটি। যাঁরা ইতিমধ্যে নামটি পড়ে বিভ্রান্ত হচ্ছেন, তাঁদের জানিয়ে দিই নাটকটির নাম এই অধম সমালোচক দিয়েছে—যেহেতু নাটকটির কোনো নাম উল্লেখ করা হয়নি। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, থ্রি-জি থেকে দেশ ফোর-জি হয়ে গেছে, আর এরই ধারাবাহিকতায় নাটকটি টিভিতে নয়, ইউটিউবে নয়, নেটফ্লিক্সে নয়, প্রচারিত হয়েছে ফেসবুকে। স্বল্পদৈর্ঘ্যের বিরতিহীন এ নাটকের প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন একজন মন্ত্রী। তবে তাঁর আসল পরিচয় তিনি একজন অভিনয়শিল্পী—তারানা হালিম। নাটকের লোক নাটকে ফিরে এসেছেন দেখে আপামর জনতা যারপরনাই খুশি। কেউ কেউ বলছেন, পাটের মতো বাংলাদেশের নাটকেও একসময় স্বর্ণযুগ ছিল। আর তারানা হালিম সেই স্বর্ণযুগের এক মিষ্টি অভিনেত্রী। এরপর কত যদু কত মধু হয়ে গেছে, কিন্তু তারানা হালিমের হাসির মাধুর্য কিছুতেই মুছে যায়নি।

দুর্দান্ত এ নাটকের চিত্রনাট্য, চিত্রায়ণ ও অভিনয় নিয়ে দুটি কথা—

চিত্রনাট্য

সরকারি অফিসের মতো সরকারি চিত্রনাট্যগুলোও সাধারণত একই রকম বৈচিত্র্যহীন হয়। নচিকেতা বলেছেন, ‘বারোটায় অফিস আসি, দুটোয় টিফিন/ তিনটেয় যদি দেখি সিগন্যাল গ্রিন/ চটিটা গলিয়ে পায়, নিপাট নির্দ্বিধায়/...চারটায় চলে আসি বাড়ি/ আমি সরকারি কর্মচারী...।’ কিন্তু এই নাটকের চিত্রনাট্যে আমরা তেমন কোনো কর্মচারীকে দেখতে পাই না। আমরা দেখি, দুপুরে এক কর্মক্লান্ত চ্যালেঞ্জিং টাইম পার করা কর্মকর্তা বাড়ি ফেরার জন্য গণপরিবহনে উঠে পড়েছেন; পেছনে ফেলে এসেছেন প্রটোকল।

কবিগুরু যতই বলুন, ‘তুই ফেলে এসেছিস কারে...’, নাটকের প্রট্যাগনিস্ট কিছুতেই সেসব মনে করছেন না। বরং জানালার পাশে বসে হাসিমুখে জানাচ্ছেন গুলশান যাবেন তিনি। এখানে আমরা নাটকের দ্বিতীয় প্রধান চরিত্র জনৈক যাত্রীকে পাই। যিনি ‘যেতে নাহি দেব’ মানসিকতায় বারবার আমাদের প্রধান চরিত্রকে জানাতে থাকেন, এভাবে গুলশান যেতে অনেক সময় লাগবে। কিন্তু প্রধান চরিত্র ‘আমি জেনেশুনে বিষ করেছি পান’ মুডে হাসতে থাকেন এবং বাসে চড়েই গুলশান অভিমুখে রওনা দেন।

এখানে বলতেই হয় যে শত শত আজগুবি গল্পের সময়ে এমন একটি বাসভ্রমণের কাহিনি নিঃসন্দেহে অভিনব। প্রধান চরিত্র বাসে ওঠার পর বাসের ভেতর যে আনন্দঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়, তা চোখকে আরাম দেয়। প্রতিদিন ঠেলাঠেলি করে বাস থেকে বাসায় ফেরা মানুষের মধ্যে এক ঐতিহাসিক আবেগের সৃষ্টি হয়। তাঁরা বিদেশি বন্ধুকে মেসেঞ্জারে লেখেন, ‘আমি আর আমাদের মন্ত্রী একই বাসে বাসায় ফিরি!’ বিদেশি বন্ধু মেসেজ সিন করেন, কিন্তু কোনো রিপ্লাই দেন না।

চিত্রায়ণ

এই নাটকে ক্যামেরার কাজ ভালো হয়েছে। ফারুকী ঘরানার চিত্রধারণের কারণে মনে হয়, দৃশ্যগুলো যেন কেউ মোবাইল ফোনের ক্যামেরা দিয়ে ধারণ করছে। ফলে একটা দারুণ বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি হয়েছে পুরো নাটকে। প্রধান চরিত্র ও দ্বিতীয় প্রধান চরিত্র জনৈক যাত্রীর মধ্যে কথোপকথনের মধ্যে কখনো কখনো অন্য যাত্রীদের যে হাস্যমুখী রি–অ্যাকশন ফ্রেমে বন্দী করা হয়েছে, তা তুলনারহিত। কোনো কোনো জায়গায় আইয়ুব বাচ্চু পর্যন্ত হার মেনে যেন গেয়ে উঠেছেন, ‘আমি তো ফ্রেমে পড়িনি, ফ্রেম আমার ওপরে পড়েছে!’ চমকপ্রদ ক্যামেরার কাজে পুরো বাসটাকে দারুণভাবে দেখা গেছে। সবার ঝকঝকে হাসি দেখে দর্শকের মনে হতেই পারে, সুখী বাসটি আসলে কোনো টুথপেস্টের বিজ্ঞাপনের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে।

অভিনয়

একটা নাটকের জান-প্রাণ-সাকিব আল হাসান হলো অভিনয়। অভিনয় ভালো না হলে ভালো চিত্রনাট্যতেও যে কিছু হয় না, এমন উদাহরণ প্রচুর আছে। ভুল এক্সপ্রেশন, ভুল হাসি কতটা খারাপ হতে পারে, তা আমরা কিছুদিন আগেই শাজাহান খান অভিনীত নাটকে দেখেছি। কিন্তু মন্ত্রী এখন পাবলিক বাসে নাটকটিতে তেমন কোনো অসংগতি নেই। দুঁদে অভিনয়শিল্পী তারানা হালিম শুরু থেকেই ছিলেন তামিমের মতো সপাট। প্রতিটি শটেই তিনি কভার ড্রাইভ, স্ট্রেইট ড্রাইভ, ডান্সিং ডাউন দ্য উইকেটে এসে খেলেছেন। ফলে নাটক হয়েছে চার-ছক্কার হইহই!

নেতিবাচক দিক

এই নাটকে কোনো নেতিবাচক দিক নেই। কথায় বলে, শেষ ভালো যার, সব ভালো তার। তারানা হালিমের শেষটা ভালো হয়েছে—নিশ্চয়ই তিনি এখান থেকে আবার শুরু করতে পারবেন। মনে রাখতে হবে, তিনি অভিনয়ের মানুষ; অভিনয় দিয়েই তাঁর ফেরা উচিত। কিন্তু কিছু অতি উৎসাহী, অতি বুদ্ধিমান, বেশি বোঝা লোক বলছেন, ‘নির্বাচনের আগে আগে এগুলো কেবলই লোক দেখানো একটা বিষয়, আসলে আলোচনায় আসতে এমন নাটকের অবতারণা!’ তাঁদের উদ্দেশে বলতে চাই, আপনাদের এমন কথায় আমার সহমত নাই! নেতিবাচকতা ছেড়ে আসুন ইতিবাচক দিকে ধাবিত হই। আর প্রার্থনা করি যেন মন্ত্রী এখন পাবলিক বাসে নাটকটির সিক্যুয়েল তৈরি হয়; যে সিক্যুয়েলে একে একে আমাদের সব মন্ত্রী অভিনয় করবেন। আর অভিনয় করতে করতে ভুলে যাবেন অভিনয়ের কথা! ভাববেন, এই তো জীবন!

নাটকের সব কলাকুশলীর জন্য শুভ কামনা। এমন নাটক আরও চাই, ভাই!