এবির ব্যান্ড

আঁকা: ষুভ
আঁকা: ষুভ

হাতখরচ, অজুহাত খরচ—সব শেষ হয়ে গেছে। বাড়ি এবার ফিরতেই হবে। মাসের টাকা নিয়ে এসে আবার নতুন মাস শুরু করতে হবে। এ অবস্থায় ট্রেনের টিকিট কাটতে গিয়ে শুনলাম, আইয়ুব বাচ্চু আসবেন! কনসার্ট!

মাথা নষ্ট অবস্থা! আইয়ুব বাচ্চুর কনসার্ট, আর আমি থাকব না? তা হবে না, তা হবে না!

বাড়ি যাওয়া বন্ধ। মাকে পুরোনো ধাঁচে চিঠি লিখলাম—টাকা ফুরিয়ে গেছে। শরীরে জ্বর। মাকে লেখা এসব চিঠি অবশ্যই বাবাকে উদ্দেশ করে—বাবা বুঝতেন। তিনি টাকা পাঠাতেন। এবার কোনো কারণে দেরি হতে লাগল। কনসার্ট হবে স্টেডিয়ামে। টিকিটে অন্তত লাগবে ৫০ টাকা। যে সময়ের কথা বলছি, তখন ৫০ টাকা আমার জন্য অনেক বড় ব্যাপার। দিন ঘনাতে থাকে, আমার মুখ শুকিয়ে আসতে থাকে। টাকার অভাবে কি এবির কনসার্ট দেখা হবে না? ‘রুপালি গিটার’ শোনা হবে না?

পৃথিবীর ওপর বিস্তর অভিমান হতে লাগল। মনে হলো, এ ফকিরি জীবনের কোনো মূল্য নেই। তবে ফকিরি হোক আর আমিরি, জীবনে বন্ধুর মূল্য অনেক। কনসার্টের দিন তাজ এল। পকেটে দুটি টিকিট। রাজনীতিনিষ্ঠ ভাইয়ের সহযোগিতায় ব্ল্যাকে টিকিট কাটা হয়েছে। পঞ্চাশের টিকিট নিয়েছে আড়াই শ। তাজ আমাকে একটা টিকিট দিল। ওই সময় সম্ভব হলে তাজকে আমি তাজমহল লিখে দিতাম। শুধু তাজমহল আমার নামে না বলে...

পরে অবশ্য জেনেছিলাম, তাজ দুটি টিকিট কিনেছিল তার বান্ধবীর কথা ভেবে। বান্ধবীর পছন্দ ছিল উচ্চাঙ্গসংগীত। তাই সে কনসার্টে যায়নি। সেদিনই আমি ধরে নিয়েছিলাম, এ প্রেম টিকবে না। আমাকে অবাক করে তাজ আর সেই বান্ধবীটির বিয়ে হয়। এখন তাদের মধুর সংসার। পৃথিবীতে কখন কী হয় বোঝা মুশকিল!

যা হোক, যথাসময়ে কনসার্ট শুরু হলো। যথাসময়ে মানে রাতে। মানে একটু দেরি করে। তাতে কিছু আসে-যায় না। কনসার্ট দেরি করে শুরু হওয়া মানেই যথাসময়ে শুরু হওয়া। এবি উঠলেন আরও রাতে। প্রথমে ঝংকার উঠল গিটারে। ধিকিধিকি আলো, হাজারো মানুষ, আর সুরের মূর্ছনা। আমি চলে গেলাম ঘোরের মধ্যে। সম্ভবত এবিও চলে গেলেন ঘোরের মধ্যে। গান গাইতে গাইতে তিনি একপর্যায়ে তাঁর হাতের কালো কালো ব্যান্ডগুলো খুলে ছুড়ে মারতে লাগলেন দর্শকদের উদ্দেশে।

যার জন্টি রোডসের স্বভাব, সে ঝাঁপিয়ে ক্যাচ করছে, যার জাম্বুর স্বভাব, সে ধাক্কা মেরে পাশের জনকে আছড়ে ব্যান্ড কুড়াচ্ছে। আমার স্বভাব আফ্রিদীয়। বুক চিতিয়ে যাই বিশাল কিছু করব বলে, কিন্তু ফিরি শূন্য রানে; মানে একেবারে শূন্য হাতে। এবির হাতের ব্যান্ড ফুরিয়ে গেল, আমার কিছুই কুড়ানো হলো না। ‘ক্যাচ মিস তো কনসার্ট মিস’—এমন একটা বিষণ্ন বেদনা নিয়ে ফিরলাম। হলো না, এবির ব্যান্ড পাওয়া আমার হলো না।

কিন্তু মেসে ফিরতে না–ফিরতেই আবিষ্কার করলাম, তাজ একটা ব্যান্ড ক্যাচ করেছে। করতে গিয়ে হাত ছিঁড়ে ফেলেছে। কিন্তু তার মুখে যুদ্ধজয়ের হাসি। ব্যান্ডটা সে ইতিমধ্যে হাতে পরেও ফেলেছে। তাজের ডান হাতটাকে মনে হচ্ছে এবির হাত। কালো ব্যান্ডটা সেখান থেকে আমাকে ভেঙচি কাটছে। আমার ভেতরটা কেঁদে উঠল। আরও বেশি না, এটুকু কান্নাতেই মনে হলো উড়াল দিই আকাশে। মনে মনে স্থির করলাম, ব্যান্ডটা আমাকে পেতেই হবে, যে করেই হোক।

‘ছলে বলে কৌশলে’ বলে একটা জিনিস বাংলা প্রবাদে আছে। এবির ব্যান্ড পাওয়ার জন্য আমি তিনটাই এস্তেমাল করলাম। প্রথমে ছিল ছল। দুইদিন পরই তাজকে বললাম, ‘আজকের পত্রিকা দেখেছিস?’

: না। ক্যান?

: ঘটনা বরিশালের।

: কী ঘটনা?

: একজন এবির এ রকম ছুড়ে দেওয়া ব্যান্ড হাতে পরেছিল…

: তো?

: চোর এসে তার হাতসহ নিয়ে গেছে।

: হাতসহ নিয়ে গেছে মানে? হাত কীভাবে নিয়ে যায়?

: কেটে নিয়ে গেছে। গাছকাটা করাত নিয়ে এসেছিল। জানালা দিয়ে করাত ঢুকিয়ে হাত কেটে নিয়ে গেছে। পত্রিকায় হাতের নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। কেউ যদি হাত এনে দিতে পারে, তাহলে এক লাখ টাকা পুরস্কার!

: ওটা হাতের জন্য না। হাতে যে এবির ব্যান্ড আছে সে জন্য। সত্যি এ ব্যান্ডের জন্য এক লাখ পুরস্কারও কিছু না!

হিতে বিপরীত হলো। তাজ মনে করে নিল, এই ব্যান্ডের মূল্য এক লাখের বেশি। তবে আমি দমে গেলাম না। ছলের পরেই আসে বল। আমি বল প্রয়োগ করলাম। ‘ওটা দিয়ে দে’ বলে ট্রিপল এইচের মতো একদিন ঝাঁপিয়ে পড়লাম তাজের ওপর। কিন্তু তাজও কম যায় না। রকের মতো সে–ও ‘ইফ ইউ স্মেল...’ বলে ওপরের দিকে তাকিয়ে রুখে দাঁড়াল। ডব্লিউডব্লিউইর চ্যাম্পিয়নশিপেও এতক্ষণ লড়াই হয়নি, যতক্ষণ আমার আর তাজের মধ্যে হাঙামা হলো। আমাদের যুদ্ধ রুম থেকে ডাইনিং পর্যন্ত গড়াল। তাজের হাত থেকে ব্যান্ড খুলে নিতে পারলাম না। তবে আমাদের ধস্তাধস্তি আর জিনিসপত্র ছোড়াছুড়িতে তিনটা বাল্ব, দুটি জগ আর একটা প্লাস্টিকের চেয়ার ভেঙে গেল। মেসের মালিকও মেস থেকে আমাদের বের করে দিল এক দিনের নোটিশে।

আমি হাল ছাড়লাম না, বরং কণ্ঠ ছাড়লাম জোরে। আর সে কণ্ঠ গিয়ে আছড়ে পড়ল তাজের বান্ধবী পর্যন্ত। বান্ধবী বলল, ‘কী হয়েছে?’

: সর্বনাশ হয়েছে!

: মানে?

: মানে তাজের হাতে একটা কালো রঙের প্লাস্টিকের ব্যান্ড দেখছ না?

: হুম। ওটা আইয়ুব বাচ্চুর।

: শোনো, আইয়ুব বাচ্চুকে যা মানায় তা কি অন্য সবাইকে মানায়, মানাবে? আমি যদি এখন ‘আমি কষ্ট পেতে ভালোবাসি তাই তোমার কাছে ছুটে আসি’ গাই, হবে?

: হতেও পারে...

: আরে না না। কী বলো এসব! হবে না। এবির মতো কেউ হতে পারবে না। এবি এবিই। আর তাজ তাজই। সবাই তো ওকে নিয়ে হাসাহাসি করছে।

: কেন?

: আরে, তাজের কবজি পাতলা, ফরসা আর সুন্দর না?

: তো?

: তো সবাই তো তাজকে মেয়ে-মেয়ে বলছে!

: কী বলেন এসব? কারা বলছে এসব?

: সবাই বলছে, সবাই। তুমি কার মুখ বন্ধ করবা? তার চেয়ে ভালো তাজের হাতই…

পরের ঘটনা অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। কিছুটা আনন্দের, বিছুটা বেদনার! তাজের বান্ধবী তাজের হাত থেকে ওই ব্যান্ড খুলে নিয়েছিল, এটা আনন্দের। তাজের বান্ধবী ওই ব্যান্ড নিজে পরা শুরু করেছিল, এটা হলো বেদনার!

তবে মধুর যে ঘটনাটা ঘটেছিল, তা হলো ব্যান্ডটা পরার পর থেকে তাজের বান্ধবীও এবির গান শুনতে শুরু করেছিল। তার প্রিয় গান হয়ে উঠেছিল ‘ফেরারি এ মনটা আমার…’।

তবে ওদের মন আর ফেরারি থাকেনি। বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে ওরা এখন সুখে আছে। মাঝেমধ্যে তাজের বাসায় গেলে তাজের বউয়ের হাতটা দেখি। এখনো সেখানে এবির ব্যান্ডটা শোভা পায়। তাজের বউ বলে, ‘এইটা আমাদের প্রেমের স্মৃতি তো, তাই খুলিনি।’

ব্যান্ডটা আসলে আমাদের প্রেমেরও স্মৃতি। এবির প্রতি প্রেমের স্মৃতি। এবি চলে গেলেন। কিন্তু রেখে গেলেন আমাদের শৈশব আর কৈশোরের প্রেমের স্মৃতি।