ঝামেলা

গত রাতে মারাত্মক দুইটা ভুল করে ফেলেছেন জহির সাহেব, যার খেশারত এখন দিতে হচ্ছে তাঁকে। প্রথম ভুল, আজকে ঈদের দিনে রান্নার জন্য সেমাই, দুধ, কিশমিশ, বাদাম, তেল, লবণ—সবই কিনেছেন, শুধু চিনি বাদে। আর দ্বিতীয় ভুল, ইলিশ মাছের পরিবর্তে পাঙাশ মাছ কিনেছেন বলে।তাঁর স্ত্রী ময়না বেগম রাতে ব্যাগ খোলেননি। সকালে, মানে রান্না করতে গিয়ে দেখেন চিনি নেই। নামের সঙ্গে মিল রেখেই ময়না বেগম অনবরত মুখ চালাতেই থাকেন। রান্নাঘর থেকে তাঁর রাগী গলা শোনা যাচ্ছে, ‘চিনি না কিনে উনি ঢ্যাং ঢ্যাং করে শুধু সেমাই নিয়ে চলে এলেন। ঘটে কি একটুও বুদ্ধি নেই!!’জহির সাহেব বড়সড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কলপাড়ে গেলেন গোসল করতে। সকাল সাতটা বাজে, নয়টায় ঈদের জামাত। গোসল করতে গিয়ে তিনি আনমনা ছিলেন বলে বাম চোখে সাবানের ফেনা ঢুকে জ্বালা করতে লাগল। গোসল শেষে তিনি তাঁর কলেজ পড়ুয়া মেয়েকে গিয়ে বললেন—‘মা সাথি, আমার পাঞ্জাবি আর পাজামাটা দে তো, নামাজে যেতে হবে।’সাথি এ মুহূর্তে বাম হাতে গভীর মনোযোগের সঙ্গে মেহেদি লাগাচ্ছে। ইদানীং মেহেদি প্লাস্টিকের টিউবে থাকে, আর লাগানোর অল্প সময়ের মধ্যে লাল হয়ে যায়। এসব প্যাকে আবার ডিজাইন বই ফ্রি দেওয়া হয়, যার একটা এখন সাথির সামনে বিছানো। সাথিও তার মায়ের আচরণ কিছুটা পেয়েছে। খুবই বিরক্ত হয়ে সে বলল—‘দেখছো না বাবা, আমি মেহেদি দিচ্ছি। আমি তোমার পাঞ্জাবি কীভাবে খুঁজে দেব? ’এ যুগের ছেলেমেয়েদের লজ্জা-পর্দার বালাই নেই। বাবাকে সরাসরি না বলে দিল! তিনি ময়না বেগমের কাছে গিয়ে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন—‘শুনছো, আমার পাঞ্জাবিটা কোথায়? একটু দেখে দেবে? ময়না বেগম রাগের সঙ্গে বললেন—‘বড় আলমারিতে রাখা আছে। খুঁজলেই পাবে। আমার হাতে রাজ্যের কাজ। চিনি তো আনোনি, চোখের মাথা খেয়েছ, এখন কি আমি লবণ দিয়ে সেমাই রাঁধব...।’জহির সাহেব আস্তে করে সরে এলেন। বড় লোহার আলমারি খুলে তিনি দেখলেন, ছয়টি তাক ভর্তি শুধু কাপড় আর কাপড়। এই কাপড়ের সমুদ্রে তিনি তাঁর পাঞ্জাবি কীভাবে খুঁজে পাবেন ভেবে দম বন্ধ হয়ে এল। হাতড়ে হাতড়ে যাও বা পাঞ্জাবি পেলেন, পায়জামাটা পেলেন না। তিনি ওপরের তাক থেকে খুঁজতে খুঁজতে সবার নিচের তাকে কুচড়োমুচড়ো অবস্থায় পেলেন পায়জামাটা। এটির এমন বেহাল দশা যে পাঁপড়ভাজাও লজ্জা পাবে। যাকগে, বুড়ো মানুষের অত রংঢং দরকার নেই ভেবে তিনি পাঞ্জাবিটা গায়ে গলালেন। এবং আশ্চর্য হয়ে দেখলেন, সাদা পাঞ্জাবির ঠিক বুকের ওপর আয়রনে পুড়ে কালো হয়ে গেছে। নিশ্চয় লন্ড্রি দোকানের কাজ। তিনি আরও আশ্চর্য হলেন, যখন দেখলেন বেদম কুঁচকানো পায়জামাটার বাঁধার ফিতাটা নেই। এখন তিনি পায়জামা বাঁধার ফিতা কোথায় পাবেন? আবারও ভয়ে ভয়ে ময়না বেগমের কাছে গিয়ে বললেন—‘ইয়ে, আমার পায়জামার ফিতাটা পাচ্ছি না। কী করব?‘দড়ি দিয়ে বেঁধে নাও। মরণ। চিনি ছাড়া এতগুলো সেমাই আমি কীভাবে রান্না করব?জহির সাহেব খুঁজে খুঁজে কোথাও কোনো দড়ি পেলেন না, অগত্যা তিনি কষ্টেসৃষ্টে পায়জামাটা গিঁট্টু দিয়ে নিলেন।‘মা সাথি, আতর-টাতর থাকলে দে তো, কেমন যেন পুরোনো গন্ধ বেরোচ্ছে পাঞ্জাবি থেকে।’‘ভাইয়ার টেবিলে পারফিউম আছে, ওখানে থেকে নিয়ে নাও।’জহির সাহেব গেলেন তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলের ঘরে। গিয়ে দেখেন সোহাগ বিচিত্র ভঙ্গিতে ঘুমিয়ে আছে। টেবিলের ওপর থেকে পারফিউমের একটি ক্যান হাতে নিলেন। পারফিউমের ইংলিশ নামের বাংলা করলে দাঁড়ায় কুঠার বা কুড়াল। সুগন্ধির নাম কুড়াল হয় কোন যুক্তিতে, তাঁর মাথায় ঢুকল না। তিনি সোহাগকে ডাক দিলেন—‘সোহাগ, সোহাগ, উঠ। ঈদগাহে যাবি না?’‘বাবা, তুমি যাও।’ নিজের, পরিবার, সমাজের ওপর প্রচণ্ড বিতৃষ্ণা নিয়ে তিনি রাস্তায় বেরোলেন।রাস্তায় চলার সময় অপেক্ষাকৃত কম বয়েসী ছেলেরা তাঁর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসতে লাগল, মাঠের পথ ধরে যেতে গিয়ে চিকন আলে পা পিছলে ছপাৎ করে জল-কাদায় মাখামাখি হলেন। সবকিছু সহ্য করে ঈদগাহে এসে পৌঁছুলেন। নামাজ শেষে বাড়ির পথ ধরলেন।মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন, এখন থেকে ছেলেমেয়েদের কঠিন শাসনে রাখবেন। বাড়ি গিয়ে যদি দেখেন, সোহাগ এখনো ঘুমুচ্ছে, তাহলে বেত দিয়ে তার পিঠ ভাঙবেন। বাড়ি ঢুকেই তিনি সোজা সোহাগের ঘরে ঢুকলেন। সোহাগ বিছানায় নেই। কোথায় গেল ভাবতে ভাবতেই লাল একটা পাঞ্জাবি পরা সোহাগ ঘরে ঢুকেই বাবাকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করল, এরপর কোলাকুলি।‘কোথায় ছিলে বাবা? ঈদগাহে তোমাকে পেলাম না। নিশ্চয় আগে এসেছ। তোমার জন্য একটা টুপি কিনেছি গতকাল...।’ বলে সে পকেট থেকে খুব সুন্দর কালো রঙের ওপর সোনালি জরির কাজ করা একটা টুপি বের করে জহির সাহেবের ভেজা মাথায় পরিয়ে দিল। সেই মুহূর্তে সাথি হাতে একটা হালকা নীল রঙের পাঞ্জাবি নিয়ে ঘরে ঢুকে বলল—‘বাবা, তোমার জন্য এ পাঞ্জাবিটা আমি সেলাই করেছি। মনেই নেই যে সকালে তোমাকে পরতে দেব।’‘ওগো শুনছো... (গত বছর দেওয়া গোলাপি রঙের শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে ময়না বেগম ঘরে ঢুকলেন), সেমাই রান্না হয়েছে। জহুরা ভাবির ওখান থেকে চিনি ধার করে এনেছি। চলো, সবাই খাবে।’জহির সাহেবের চোখ জলে ভরে উঠছে। সব উপেক্ষা করে তাঁর ছেলেমেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। রাশিদুল ইসলামউজানগ্রাম, কুষ্টিয়া