গুম

আঁকা: জুনায়েদ
আঁকা: জুনায়েদ

বিছানায় শুয়ে আছে লিটন। তার মেজাজ বেশ খারাপ। শহরের উত্তাপ মাপার জন্য লোক আছে। কিন্তু মেজাজ কতটা উত্তপ্ত তা দেখার কেউ নেই। থাকলে বোঝা যেত, ঢাকার আবহাওয়ার চেয়েও লিটনের মেজাজ অনেক বেশি গরম। আয়-রোজগার নেই। মেজাজ গরম হওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট। এমন সময় দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল নান্নু। নান্নু লিটনের বন্ধু। তারা একসঙ্গে চুরি-ছিনতাই করে। তবে কেউই এ পেশায় তেমন নাম করতে পারেনি। তৃণমূল পর্যায়ের ছিনতাইকারীরা জাতীয় এমনকি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাজ করছে। অথচ তারা এখনো প্রতিষ্ঠিত ছিনতাইকারী হতে পারেনি। এ নিয়ে দুজনই হতাশ।
বিছানা থেকে উঠে নান্নুর দিকে তাকাল লিটন। বিশালদেহী নান্নুর মুখ গামছায় প্যাঁচানো। লিটন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘তোর মুখ ঢাকা ক্যান? আফ্রিকান পোকা কামড়াইসে? নাকি তোর লাভার থাবড়া দিসে?’
: ওই সব কিছু না। মানসম্মান সব বুড়িগঙ্গায় ভাইসা গেল। এত দিন ধইরা ক্রাইম করতাসি, আজ পর্যন্ত পত্রিকায় ছবি আইল না। দেশে এত টিভি চ্যানেল...পকেটমার ধরা পড়লেও আজকাল লাইভ দেখায়। অথচ আমারে কোনো টিভিতে দেখাইল না। এই মুখ মানুষরে কেমনে দেখাই? লজ্জা লাগে।
: করস ছিনতাই, আবার লজ্জাও পাস! তবে কথাডা ঠিক। কী করলাম এত দিন! অপরাধীর খাতায় নাম নাই! থানার সামনে চা-বিড়ি খাই, পুলিশ ধরে না। নাম না জানলে মাইনষে ডরাইব কেমনে? সপ্তাহে দুই-তিনটা ট্রিপ মারি। ফোন, ল্যাপটপ, কিছু টাকা...এইগুলায় জীবন চলে?
: যে ফোন নিই, সেগুলাই ঠিকমতো চলে না। জীবন চলব কেমনে? কালকে এক ব্যাটার আইফোন নিলাম। পরে দেখি চায়নিজ মাল। থ্রিজি সাপোর্ট করে না। পরিশ্রম বৃথা। পাবলিক ইদানীং বাটপার হইয়া গেসে। সব দুই নাম্বার। আমগো দিয়া মনে হয় ক্রাইম হইব না। রিকশা চালামু।
: ছাগল, রিকশা চালাইতে পারলে কী আর ছিনতাই করতাম?
: তাইলে কী করুম?
: সবাই যা করে, তাই। ব্যাংক লুট নইলে অপহরণ। ইজি কাম। প্রতিদিনই পাঁচ-সাতজন কইরা গুম হইতাসে।
: করা যায়। গুমের কাজ খারাপ না। সিনামায় কত দেখসি। সহজ আছে। তা ছাড়া একটা কিডন্যাপ করতে পারলে সমাজে স্ট্যাটাস বাড়ব। নানা পার্টি কল দিব।
: মেইন রোডের ব্যাংকটা লুট করি চল। ব্যাংকের এক ব্যাটা আমারে অপমান করসিল। লোন নিতে গেসি। কয় আপনি লোন নিয়ে কী করবেন? কইলাম ইয়াবার ব্যবসা করুম। কয় অবৈধ কাজে নাকি হেরা নাই। আরে হারামজাদা, কোন ব্যবসাটা বৈধ? আড়তদারও তো তরমুজে ভেজাল দেয়। তরমুজ খাইয়া পাবলিক মরে। হেরে লোন দিলে আমারে দিব না কেন?
: মাথা গরম করিস না। ব্যাংক লুটে ভেজাল অনেক। সুড়ঙ্গ কাটতে হইব। এই গরমের মধ্যে সুড়ঙ্গ কাটা ‘টাপ’ ব্যাপার। গুমটা তার চেয়ে ইজি না? দুই-একটারে ধরুম, থাবড়াইয়া গাড়িতে উঠামু। টাকাপয়সা নিয়া লাত্থি মাইরা ফালায় দিমু।
: তাইলে একজোড়া জুতা কিনতে হইব। ছিঁড়া জুতা পইরা লাত্থি দেওয়াটা খারাপ দেখায়।
: লাগব না। হুদা খরচ। আয়, একটা প্ল্যান কইরা ফালাই।

লিটন ও নান্নু গুমের পরিকল্পনা করতে বসল। কিছুক্ষণ পর তারা আবিষ্কার করল, কাজটা সহজ। মেইন রোড থেকে পছন্দমতো একজনকে ধরার সিদ্ধান্ত নিল তারা। লিটন অবশ্য আগেই বলে দিয়েছে, ‘মাইয়া মানুষ ধরিস না। কথা বেশি কয়। ভেজালও বেশি।’ এ কথায় নান্নুর মন একটু খারাপ হলেও চুপ থাকল সে। লিটন গাড়ির ব্যবস্থা করতে গেল। নান্নু অস্ত্র রেডি করতে লাগল।
সন্ধ্যা হতেই নির্ধারিত জায়গায় চলে এল ওরা। নান্নুর কোমরে পিস্তল গোঁজা। লিটন বলল, ‘আজকে ক্যারিয়ার শুরু করতাসি। যারে ধরুম, তার মুক্তিপণের ওপর ১০ পারসেন্ট ছাড় দিমু। কি কস?’
: দেওয়া যায়। ল যাই।
রাস্তাটা বেশ কয়েকবার রেকি করে নেয় তারা। কোথাও পুলিশ-ডিবি আছে কি না, গাড়ি নিয়ে কোন রুট দিয়ে যাবে এসব নিয়ে আলোচনা চলে। হঠাৎ প্রধান সড়ক থেকে একটু দূরে নির্জন গলির মাথায় একটা লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে লিটন। বারবার ঘড়ি দেখছে লোকটা। হাতে মলিন একটা ব্যাগ। নান্নুর ধারণা, ব্যাগে দামি কিছু আছে। নজর এড়াতে ময়লা

ব্যাগ আনা পাবলিক সে আগেও দেখেছে। একেই ধরার প্রস্তাব দেয় সে। প্রস্তাবটা লিটনেরও মনে ধরে। তারা দুজন ধীর পায়ে এগিয়ে আসে লোকটার দিকে। পেছন থেকে লোকটার গলার কাছে ক্ষুর ধরে লিটন বলে, ‘ভাইয়া, চিৎকার করবেন না। হার্টে সমস্যা আছে। বেশি আওয়াজ সহ্য হয় না। চুপ থাকেন।’ নান্নু তার শক্তিশালী হাত দিয়ে লোকটার মুখ চেপে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, ‘লিটইন্ন্যা, গাড়ি আইতে ক।’
সঙ্গে সঙ্গে একটা নীল মাইক্রোবাস এসে থামে ওদের পাশে। দ্রুত দরজা খুলে লোকটাকে নিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ে ওরা। গাড়ি স্টার্ট নিতেই লিটন বলে, ‘এই না হইলে ড্রাইভার, ডাকার আগেই হাজির...’
কথাটা শেষ হওয়ার আগেই প্রচণ্ড জোরে ঘুষি পড়ে লিটনের মুখে। এমন ঘুষি একমাত্র নান্নুর পক্ষেই মারা সম্ভব। সে একটা গালি দিয়ে তাকিয়ে দেখে একই রকম ঘুষি খেয়ে নান্নুর অবস্থাও ধরাশায়ী।
গাড়ির ভেতরের আলো জ্বলে ওঠে। নান্নু ও লিটন টের পায় পেছনের সিটে আরও কয়েকজন আছে। যে লোকটাকে ওরা ধরে এনেছে সে মুখে হাত বোলাতে বোলাতে বলে, ‘তোরা এত লেট করলি ক্যান, মজিদ? আর্মস নিয়া এতক্ষণ রাস্তায় থাকা যায়? আমি তো ভাবসিলাম এই গাধাগুলা পুলিশের লোক। দানব একটা, মুখটা ফুইলা গেসে রে!’
মজিদ যার নাম, সে পেছন থেকে বলে, ‘বস, এই দুইটারে কী করুম? মেইন লোকরে গুম করার পর গাড়িতে তো জায়গা হইব না।’
: বাইন্ধা রাখ আপাতত। দেখি কী করন যায়।
এতক্ষণে লিটন আর নান্নু বুঝতে পারে, গুম করতে এসে ওরা নিজেরাই গুম হওয়ার পথে।