সামাদ ভাইয়ের বিশ্বকাপ

আঁকা: তুলি
আঁকা: তুলি

২০০৬ বিশ্বকাপে সামাদ ভাই ছিলেন ইতালির সাপোর্টার। বিশ্বকাপ শুরুর আগে বাসার ছাদে ইতালির ইয়া বড় পতাকা উড়িয়ে দিলেন। সেই পতাকার কাছে এলাকার ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার সব পতাকা ফেল। সামাদ ভাই হলেন এলাকার বড় ভাই। বয়সে বড় হলেও আমাদের মধ্যে বন্ধুর মতো সম্পর্ক। মোড়ের দোকানে একসঙ্গে আড্ডা দিই আমরা। তাঁর আবার সমাজসেবামূলক কাজে অনেক আগ্রহ। এলাকায় বৃক্ষরোপণ থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক প্রোগ্রাম, ফুটবল, ক্রিকেট টুর্নামেন্ট আয়োজন, কোনো মেয়েকে কোনো ছেলে উত্ত্যক্ত করলে ছেলেটাকে প্যাঁদানি দেওয়া, কলেজগামী কোনো তরুণী রিকশা না পেলে রিকশা ডেকে দেওয়া, পড়াশোনার খোঁজখবর নেওয়া, যেচে পড়ে নোট সংগ্রহ করে দেওয়ার মতো কাজে তাঁর সরব অংশগ্রহণ।
এ ধরনের একজন করিতকর্মা লোককে আমরা ব্রাজিলের সাপোর্টাররা অনেক চেষ্টা করেছি নিজেদের দলে ভেড়াতে। কিন্তু তাঁকে ইতালি থেকে ফেরানো যায়নি। সামাদ ভাইয়ের অকাট্য যুক্তি, ‘শোন, চুরানব্বইয়ের বিশ্বকাপের কাহিনি, খেলা একটু একটু বুঝতে শুরু করেছি। ফাইনালে পেনাল্টি মিসের পর ব্যাজিওর কান্না দেখে ইতালির প্রতি মায়া লেগে গেল। তা ছাড়া আমার বাপ থাকে ইতালিতে। মাসে মাসে সেখান থেকে পাঠানো টাকা দিয়েই তো আরামসে দিন কাটাচ্ছি। তবে ইতালিকে সাপোর্ট করার প্রধান কারণ আমি বাংলাদেশকে ভালোবাসি।’
বাংলাদেশকে ভালোবাসার সঙ্গে ইতালি সাপোর্ট করার কী সম্পর্ক থাকতে পারে, তা ভেবে কূলকিনারা পেলাম না। সামাদ ভাই বলতে থাকলেন, ‘তোরা তো জানিস, বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান হাতিয়ার হলো কৃষি। এটা কি জানিস সেচকাজে ব্যবহূত প্রতি চারটি পাম্পের তিনটিই ইতালির তৈরি? ওই পাম্পগুলোর জন্যই কৃষি বেঁচে আছে, কৃষির কারণে আমরা বেঁচে আছি। বাড়ি-কলকারখানার ট্যাংকে পানি তোলার কথা না হয় বাদ দিলাম।’
এমন যুক্তির পর কিছু বলার থাকে না। ২০১০ বিশ্বকাপ শুরুর আগে সামাদ ভাইয়ের বাসার ছাদে দেখি আর্জেন্টিনার ইয়া বড় পতাকা। সামাদ ভাইয়ের বাসায় ইতালি বাদে অন্য পতাকা? তাও আর্জেন্টিনার? ব্রাজিলের সাপোর্টার বলে তা আমাদের কাছে আরও অসহ্য ঠেকল। বিকেলে সামাদ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করলাম, ‘স্যাম ভাই, কোন গাধা যেন আপনার বাসার ছাদে আর্জেন্টিনার পতাকা ঝুলায় দিছে!’
সামাদ ভাই একবার আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলেন। আরেকজন বলল, ‘নতুন ভাড়াটে কেউ দিছে নাকি? নামটা বলেন একবার, ওর পা ভেঙে যদি হাতে ধরায় না দিছি!’
সামাদ ভাই চুপ। আমার আবার বলি, ‘আচ্ছা, আপনাকে কিছু বলতে হবে না। আমরা খবর নিতেছি। আজকেই ওর দাদার নাম ভুলাইতেছি।’
‘আর্জেন্টিনার পতাকা আমিই উড়াইছি।’ কাঁপা গলায় সামাদ ভাই বলে উঠলেন।
অবাক দৃষ্টিতে আমরা একে অপরের দিকে তাকালাম। সামাদ ভাই বলতে লাগলেন, ‘দেখ, তোরা তো আমার

আর জেরিনের ব্যাপারটা জানিস। মাস ছয়েক হলো আমাদের রিলেশন। জেরিন আর্জেন্টিনার সাপোর্টার। ও শর্ত দিছে, ওর পছন্দের বাইরে যাওয়া যাবে না, গেলে রিলেশন থেকে লগ আউট। মতের এত অমিল হলে রিলেশন নাকি অসম্ভব। রিলেশন রাখতে চাইলে লাইনে আসতে হবে।’
: তাকেই লাইনে এসে ইতালি সাপোর্ট করতে বলতেন।
: বলেছি। কিন্তু ও বলেছে, মেসি অনেক কিউট। সে মেসির টিম ছাড়া অন্য কোনো টিম সাপোর্ট করবে না।
: তাহলে ইতালির পাম্পের কী হবে?
: কিছুই হবে না। আমি ইতালি সাপোর্ট না করলেও ইতালির পাম্পগুলো পানি তুলবে।
বেচারা নিতান্ত নিরুপায় হয়ে সেবার আর্জেন্টিনাকে সাপোর্ট করলেন। জেরিনকে খুশি করার জন্য ডেটিংয়ে আর্জেন্টিনার জার্সি পরে গেলেন। কোয়ার্টার ফাইনালে আর্জেন্টিনা হেরে যাওয়ার পর জেরিনের সামনে মন খারাপের অভিনয় করলেন।
বিশ্বকাপের পর মাস চারেক পরে হঠাৎ করে আমেরিকাপ্রবাসী এক পাত্রের সঙ্গে জেরিনের বিয়ে হয়ে গেল। জেরিনের বিরহে সামাদ ভাই কেমন জানি হয়ে গেলেন। জীবনের প্রতি একবুক বিতৃষ্ণা নিয়ে সামাদ ভাই দিন কাটান। সারা রাত ছাদে পায়চারি করেন। আবছা অন্ধকারে রং জ্বলে যাওয়া আর্জেন্টিনার পতাকাটার দিকে তাকিয়ে থাকেন। এরপর একদিন এলাকায় নতুন ভাড়াটে হিসেবে তানিয়ারা এল। কীভাবে কীভাবে জানি সামাদ ভাইয়ের সঙ্গে তানিয়ার প্রেমও হয়ে গেল!
এবার বিশ্বকাপের আগেই দেখছি, সামাদ ভাইয়ের বাসার ছাদে ইয়া বড় ব্রাজিলের পতাকা উড়ছে!