প্রবেশ ও প্রস্থান

.
.

এক প্রয়াত রেফারি স্বর্গের দুয়ারে পৌঁছে গেছেন। দ্বাররক্ষী হাতে হিসাবের খাতা নিয়ে একটু মিলিয়ে দেখছিলেন, ‘জীবনে কখনো এমন কিছু করেছেন, যে জন্য আপনি অনুতপ্ত?’
‘জি, করেছি।’
‘কী কাজ?’
‘জনাব, একবার বিশ্বকাপ ফাইনালে ভুল করে একটা লাল কার্ড দেখিয়ে দিয়েছিলাম হল্যান্ডের এক খেলোয়াড়কে।’
‘এটা কত আগের ঘটনা?’
‘এই তো, জনাব। তিরিশ-পঁয়ত্রিশ সেকেন্ড আগের...’
এটা পুরোনো কৌতুক। বহুবার শোনায় হাসি আপনার নাও আসতে পারে। তবে কোনো রেফারিকে গল্পটা শোনান; দেখবেন, মুখটা তার ঠিকই কালো হয়ে গেছে। কারণ লাল কার্ড দেখানো ও তার আগে-পরের ঘটনা সম্পর্কে আর কারও না হোক, রেফারির ঠিকই পরিষ্কার ধারণা আছে। এই তো বিশ্বকাপ চলে আসছে। চার বছর ধরে যা-ই হোক, এবার অন্তত এক্কেবারে চোখের সামনে দেখতে পাবেন এই রেফারি বনাম ফুটবলারদের যুদ্ধ। হ্যাঁ, যুদ্ধ ছাড়া কী? মাঝেমধ্যে দু-একটা ম্যাচ দেখলে আপনারও মনে হবে, খেলাটা মোটেও দুই দলের মধ্যে নয়; এটা আসলে রেফারির সঙ্গে খেলোয়াড়দের জমিজমা নিয়ে কোনো মারামারি হচ্ছে বুঝি! এই ২০০৬ বিশ্বকাপের নেদারল্যান্ডস ও পর্তুগাল ম্যাচে গুনে গুনে ২০ বার কার্ড দেখাতে হয়েছিল রেফারিকে। এর মধ্যে ১৬ জনকে হলুদ কার্ড দেখিয়ে রেহাই পেলেও চারজনকে একেবারে লাল কার্ড দেখিয়ে বের করে দিতে হয়েছিল। মনে রাখবেন, দল দুটোর পূর্বপুরুষেরা ওলন্দাজ ও পর্তুগিজ দস্যু হিসেবে একসময় সমুদ্র কাঁপিয়ে বেড়িয়েছে!
তবে এই কথা বললে আসলে ওই বিশ্বকাপের আরও সব দলের খেলোয়াড়েরা রাগ করতে পারেন। ২০০৬ বিশ্বকাপটা ছিল মারামারির জন্য এক স্মরণীয় উৎসব। অস্ট্রেলিয়া-ক্রোয়েশিয়া ম্যাচে এমন গন্ডগোল লেগে গিয়েছিল যে রেফারি গ্রাহাম পোল হিসাবটিসাব গুলিয়ে ফেলেছিলেন। নিয়ম অনুযায়ী দুটি হলুদ কার্ড দেখালে সেই খেলোয়াড়কে লাল কার্ড দেখিয়ে এমনিতেই বের করে দিতে হয়। কিন্তু ক্রোয়েশিয়ান খেলোয়াড় সিমুনিচকে দুবার হলুদ কার্ড দেখিয়েও লাল কার্ড দেখাতে ভুলে গিয়েছিলেন পোল। ব্যাপারটা এখানে শেষ হলেও কথা ছিল না। এরপর সিমুনিচ একেবারে খেলার শেষ দিকে এসে আবার ফাউল করে বসলেন। এবার আবার হলুদ কার্ড দেখাতে গিয়ে সংবিৎ ফিরে পেলেন রেফারি—তিন হলুদ কার্ড হয়ে গেছে যে!
তবে ব্যাপারটা অন্যভাবেও ভাবতে পারেন আপনি। মনে করতে পারেন, রেফারি পোল আসলে লাল কার্ড দেখাতে ভয় পাচ্ছিলেন। কারণ, লাল কার্ড দেখিয়ে পিটুনি খেয়ে স্বর্গে চলে যাওয়ার ব্যাপারটা শুনতে গল্প শোনালেও এমন ঘটনা দু-চারবার বিশ্বে ঘটেছে। আর্জেন্টাইন লিগে খুঁজলে অনেক নজির পাওয়া যাবে এমন। ইংলিশ লিগেই একবার গোলরক্ষককে এক রেফারি লাল কার্ড দেখিয়ে কী বিপদে পড়েছিলেন। গোলরক্ষক কড়া ফাউল করায় রেফারি দিলেন তাঁকে লাল কার্ড ও পেনাল্টি। ওই গোলরক্ষক মাঠ ছেড়ে যাওয়ার আগে রেফারিকে দুম করে নাকের ওপর এক ঘুষি বসিয়ে দিলেন! এখানেই শেষ নয়। লাল কার্ডের ওপরে যেহেতু আপাতত আর কিছু নেই, রেফারিও তাই নিজের হাত ও দাঁতের ওপর ভরসা করলেন। খামচে ধরে ওই গোলরক্ষককে কামড়ে দিলেন! চিন্তা করুন অবস্থাটা। এখন কী হবে? বলা হয়, এক লাইনসম্যান কোত্থেকে এক লাল কার্ড জোগাড় করে এনে রেফারিকেই দেখিয়ে দিয়েছিলেন সেবার!
রেফারিদের এমন মারপিট হজম করা ফুটবলে আসলে ডালভাত হয়ে গেছে। তবে স্রেফ বাঁশির শব্দের কারণে কেউ রেফারিকে গালি দিতে পারে, এটা বিশ্বাস করা কঠিন। কিন্তু এটাই করেছিলেন ইংল্যান্ডের সানতে লিগের এক খেলোয়াড়। খেলা শুরু করার জন্য রেফারি বাঁশিতে ফুঁ দিতেই টড নামের এক খেলোয়াড় অশ্লীল একটা গালি দিয়ে রেফারির বাঁশি কেড়ে নিয়ে বলেছিলেন, ‘এই বিকট বাঁশি কোথায় পেয়েছ?’ আর যায় কোথায়! রেফারি লাল কার্ড বের করে ফেললেন—ম্যাচের তখন বয়স মাত্র ১০ সেকেন্ড। লিখিত হিসাব থাকা ফুটবল ম্যাচের মধ্যে এটাই দ্রুততম লাল কার্ড দেখানোর নজির। আর বিশ্বকাপে রেকর্ডটা ৫৮ সেকেন্ডের। অবশ্য একেবারে ‘শূন্য’ সেকেন্ডেও লাল কার্ড দেখার ঘটনা আছে ফুটবলে। জ্যামাইকার এক খেলোয়াড় একবার খেলা শুরুর আগে টানেল ধরে নামার পথে প্রতিপক্ষের একজনের নাকে ঘুষি মেরে দিয়েছিলেন; ব্যস, লাল কার্ড। তবে এদের সবাইকে ছাপিয়ে গেছেন ক্লদিও ক্যানিজিয়া। ২০০২ বিশ্বকাপে বিস্ময়কর অন্তর্ভুক্তি হিসেবে আর্জেন্টিনা দলে এসেছিলেন। একটা ম্যাচও মাঠে নামেননি। সুইডেনের বিপক্ষে দলের শেষ ম্যাচে মাঠে নামবেন বলে মনে হচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই রেফারি ছুটে গিয়ে বেঞ্চে বসে থাকা ক্যানিজিয়াকে লাল কার্ড দেখিয়ে দিলেন! একেবারে মাঠে না নেমে, কিছু না করে ক্যানিজিয়া লাল কার্ড দেখলেন কেন? অনেক পরে ক্যানিজিয়া উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমি খুব ভদ্র ভাষায় রেফারিকে বলেছিলাম, ওহে অন্ধ ***র বাচ্চা।’ বুঝুন রেফারিদের ভাগ্য!