ফুটবল তোর জন্য

.
.

কোনো মেয়ে যে ফুটবলের জন্য এতটা পাগল হতে পারে, ময়নাকে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। রাত জেগে এই লিগ, সেই লিগ সব খেলা দেখে। লাইভ তো দেখেই, হাইলাইটসও দেখে। দেখেটেখে কে কেমন খেলল, সকাল-দুপুর এসব আমাকে শোনায়। আমার তো মাঝেমধ্যে সন্দেহ হয়, আমি ওর সঙ্গে প্রেম করছি, নাকি ফুটবলবিষয়ক টক শো করছি। যে টক শোতে আবার কথা শুধু একজনই বলে।
সেদিন ময়না বলল, ‘এই শোনো, বিশ্বকাপ তো চলে এল, কী করা যায় বলো তো?’
‘ও তাই তো! কিছু একটা অবশ্যই করা দরকার।’ বিজ্ঞের মতো মাথা দোলাতে দোলাতে বললাম, ‘আমাদের এলাকায় একটা ফুটবল ম্যাচ আয়োজন করলে কেমন হয়? আর্জেন্টিনা একাদশ বনাম ব্রাজিল একাদশ।’
‘খুবই ভালো হয়, অসাধারণ প্রস্তাব।’ ময়না খুশিতে বাকবাকুম হয়ে বলতে লাগল, ‘ব্রাজিল একাদশের অধিনায়ক থাকবে তুমি। ম্যাচ জিতে তুমি ট্রফি হাতে আমার সঙ্গে সেলফি তুলবে—ভাবতেই আনন্দ হচ্ছে।’
আমি চরম আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়লাম। ময়না এটা কী বলল, কীভাবে বলল! আমার মতো ১২০ কেজির পর্বত খেলবে ফুটবল! আরে আমি নিজেই তো একটা বড় সাইজের ফুটবল। তবে বলে যখন ফেলেছে, তখন আর কিচ্ছু করার নেই। বাসায় ফিরে এলাকার ছোট ভাই কুদ্দুসকে ফোন করলাম ম্যাচ আয়োজনের ব্যাপারে। ম্যাচের কথা শুনে যতটা উত্তেজিত হলো, আমার অধিনায়কত্বের কথা শুনে ততটাই ভীত হলো ও। তবে বলল কোনো চিন্তা না করতে, ও সব ব্যবস্থা করবে। ফোন রেখে আমি আয়োজন করে টেনশন করতে বসলাম। ফুটবল খেলেছিলাম সেই প্রাগৈতিহাসিক আমলে, যখন আমি সরলরৈখিক ছিলাম, বৃত্তাকার না। আমি মাঠের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত পর্যন্ত যেতে যেতেই তো খেলার হাফ টাইম হয়ে যাবে, খেলব কী! তার চেয়েও বড় কথা, মাঠে থাকবে দর্শক, ওরা নিশ্চয়ই হাতির খেলা না, ফুটবলই দেখতে চাইবে। এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে মাথাটা হঠাৎ ঘুরে উঠল, গা দিয়ে ঘাম ঝরতে লাগল। মনে হলো, চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসছে। চোখ বন্ধ করে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লাম।
খেলার আগে যত দিন সময় পেলাম, ঘুমিয়েই কাটালাম। ময়নার সঙ্গেও পারতপক্ষে কথা বললাম না। প্রেশার নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা আরকি। খেলার দিন সকাল থেকেই শুরু হলো প্রবল বৃষ্টি। ভাবলাম, বোধ হয় বেঁচে গেছি। কিন্তু বেলা দুইটার দিকে বৃষ্টি-টৃষ্টি উধাও, রোদ ঝলমল করে উঠল। কী আর করা, রওনা দিলাম। মাঠে ঢুকে যারপরনাই অবাক। এত দর্শক মোটেও আশা করিনি। পতাকা, বাদ্যবাজনা নিয়ে মোটামুটি হুলুস্থুল। কুদ্দুস কানে কানে জানাল, গফুর নাকি ওদের মোস্ট ডেঞ্জারাস প্লেয়ার। ঢাকার লিগে দ্বিতীয় বিভাগে খেলার অভিজ্ঞতা আছে। তাছাড়া ওরা গত কয়েক দিন নাকি একসঙ্গে কঠিন অনুশীলন করেছে। ঠিক তিনটায় খেলা শুরু হলো। মাঠের অবস্থা খুবই খারাপ, কাদায় ভর্তি। দর্শকসারিতে ময়নাকে খুঁজে পেলাম। ও আমাকে দেখে হাত নাড়ল। আমি খেলায় মনোযোগ দিলাম। ১০ মিনিট অতিবাহিত হলো। অদ্ভুত ব্যাপার, আমরা বলই পাচ্ছি না। আমি খেলছি ডিফেন্সে।
বলের কাছে যাওয়ার আগেই বল দিক পরিবর্তন করে অন্য দিকে চলে যাচ্ছে। ভাগ্যিস ডিফেন্সে আমাদের আরও তিনজন আছে, ওরা বল ক্লিয়ার করছে। হঠাৎ আমি গফুরের সামনে পড়ে গেলাম। ও বল নিয়ে আমাদের বক্সে ঢুকতে চাইছে। দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে ওকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করলাম, ও ভয় পেল বলে মনে হলো না। বরং আমাকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যেতে লাগল। শেষবারের মতো প্রাণপণ চেষ্টা করলাম ওকে আটকানোর। ফলস্বরূপ কাদায় পা হড়কে পড়লাম, পড়লাম তো পড়লাম একেবারে গফুরের ওপর। রেফারি কী মনে করে ফাউলের বাঁশি বাজালেন, দৌড়ে এসে গফুরকে লাল কার্ডও দেখিয়ে দিলেন। গফুর তখনো আমার নিচে, কাদায় মোটামুটি দেবে গেছে। স্ট্রেচার নিয়ে আসা ভলান্টিয়াররা কাদা ঘেঁটে গফুরকে আবিষ্কার করল। তারপর স্ট্রেচারে উঠিয়ে মাঠের বাইরে নিয়ে যেতে লাগল। ফুটবলের ইতিহাসে এই প্রথম বোধ হয় লাল কার্ড পাওয়া খেলোয়াড় স্ট্রেচারে শুয়ে মাঠ ছাড়ল। ততক্ষণে বুঝে গেছি আমার কী করণীয়। খেলা আবার শুরু হলো। যখনই ওদের কোনো খেলোয়াড় বল নিয়ে আমার সামনে এসে পড়ে, পা হড়কাবার ভঙ্গি করে তার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ি। আর যায় কোথায়, প্রথমে কাদা থেকে আবিষ্কার, তারপর স্ট্রেচারে করে মাঠ থেকে বহিষ্কার। শেষে অবস্থা এমন হলো, যেখানেই যাই, ওদের খেলোয়াড়রা বল-টল ফেলে ভোঁদৌড়। এই সুযোগে আমরা আধ ডজন গোল দিয়ে ফেললাম। খেলার অন্তিম মুহূর্ত। আমার পায়ে বল, সামনে শুধু প্রতিপক্ষের গোলরক্ষক। ময়নার চোখে নায়ক হওয়ার এর চেয়ে বড় সুযোগ আর হতে পারে না। আমি পজিশন নিলাম, সর্বশক্তি দিয়ে করলাম কিক। ঘটনা যা ঘটল তা বর্ণনাতীত। বলের সঙ্গে পায়ের কোনো সংযোগ ঘটল না। তবে কিকটা এত জোরে দিয়েছিলাম যে জুতা খুলে উড়ে গিয়ে পড়ল গোলরক্ষকের কপালে! বেচারা সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান, আর আমি ভারসাম্য হারিয়ে পড়লাম বলের ওপর। বিকট শব্দে বল গেল ফেটে। বোমা ভেবে চারদিকে শুরু হলো সেকি দৌড়ঝাঁপ!
জায়িদ-উস-সালেহীন, সোনাপুর, নোয়াখালী