বিশ্বকাপের একদিন

বিশ্বকাপের একদিন
বিশ্বকাপের একদিন

: আপু, দেখ, চুলগুলো মেসি করেছি, ভাল্লাগছে না?
আপু ল্যাপটপের স্ক্রিন থেকে চোখ না সরিয়ে বলল, ‘চুল মেসি করেছিস মানে? লিওনেল মেসির নামে হেয়ারকাট বের হয়েছে নাকি?’
: দূর, আউল-ফাউল কথা বলো, মেসি মানে যে চুল এলোমেলো করা। এটা জানো না?
: ও আচ্ছা। কিন্তু তোকে তো হাফ লেডিস লাগছে।
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আপুর রুম থেকে বের হলাম। ওর সঙ্গে কথা বলা অর্থহীন। সব সময়ই আমাকে নিয়ে আজেবাজে কথা বলে। রুমে এসে পত্রিকা নিয়ে বসলাম, খেলার পাতায় সুয়ারেজের উরুগুয়ে দলে থাকা না-থাকা নিয়ে খবর ছাপা হয়েছে। সুয়ারেজ আমার পছন্দের ফুটবলার। মনটাই খারাপ হয়ে গেল। আম্মু রুম গোছাচ্ছিল, আমি আপন মনে বললাম, ‘সুয়ারেজের ঠিক নাই।’ একটু জোরেই বললাম, কারণ ছাড়াই। আম্মু আমার কথা শুনে ঝড়ের বেগে রুম থেকে বেরিয়ে গেল, আমি বেশ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। আম্মুর মনে সুয়ারেজপ্রীতি হলো কবে থেকে? আম্মু তো ফুটবলের খবরই রাখে না!
চোখ লেগে এসেছে ঘুমে, এমন সময় আম্মুর বকুনিতে ঘুম ভাঙল, ‘কী বলিস এসব? কথার ঠিক নাই। ওদিকে মানুষ আমাকে পাগল ভাবে?’
: কী হয়েছে?
: কী হয়েছে মানে? তুই না বললি সুয়ারেজের ঠিক নাই? আমি বাড়িওয়ালার বাসায় সব ভাড়াটেকে নিয়ে অভিযোগ করলাম। দুই মাসের মাথায় কেন সুয়ারেজ লাইনে সমস্যা হবে? বাড়িওয়ালা আর সব ভাড়াটে ভাবিদের নিয়ে বাসায় এলাম চেক করতে। এসে দেখি সব ঠিক। সবাই আমাকে পাগল ভাবল। দুই তলার ভাবি কী বলেছে জানিস? আমার বাসায় নাকি অতিরিক্ত ডায়রিয়ার প্রকোপ। তাই সুয়ারেজের লাইনও সার্ভিস দিতে পারে না। সব দোষ তোর!
আম্মুর কথা হাঁ করে শুনছিলাম আমি। পুরো ব্যাপারটা বোঝাতে শুরু করতেই আম্মু গটগট করে হেঁটে চলে গেলেন। বিরক্ত হয়ে বাসা থেকে বের হয়ে সেলুনে ঢুকলাম। মেসি ভাবটা আর ভাল্লাগছে না। ফ্রেন্ডদের মতো ফুটবলারদের হেয়ারকাট দেব। সেলুনে বেশ ভিড়। সবাই মোটামুটি ফুটবলারদের হেয়ারকাট নিচ্ছে। আমি একটা জায়গা পেয়ে বসে পড়লাম। গম্ভীর মুখে একজন এসে জিজ্ঞেস করল, ‘কী ধরনের কাট নেবেন?’
: নেইমার।
কথাটা শুনেই ব্যাটা কাঁচি আনতে কোথায় যে পালাল, আর আসে না! ১০ মিনিট পর আরেকজন এসে বলল, ‘কী কাট?’ পাশেই দেখলাম আগের ওই লোকটা আরেকজনকে চুল কেটে দিচ্ছে। বিরক্তি ভাব নিয়ে বললাম, ‘ওরে জিগান।’ লোকটা ‘আচ্ছা’ বলে কাটা শুরু করল। ওই লোকটা মনে হয় একে বলে দিয়েছে যে আমি নেইমার কাট দিতে চাই। তাই নিশ্চিন্তে চোখ বুজে ঘুমিয়ে পড়লাম।
ঘুম থেকে উঠে দেখি আমার পুরো মাথা কামানো! একেবারে তেল চকচকে ন্যাড়া। নিজেকে পিটবুল মনে হচ্ছে। পাশে নাপিত ব্যাটা বিশ্বজয়ের ভঙ্গিতে দাঁত কেলিয়ে হাসছে। আমার খুব ইচ্ছা হলো চাবকে ব্যাটার পিঠের চামড়া তুলি। ইচ্ছা দমন করে বললাম, ‘এটা কী করলা?’
: কেন স্যার, আপনিই না বললেন জিদান।
: বুদ্ধু, আমি তো ‘ওরে জিগান’ বলেছি?
: সরি স্যার, তাহলে এই উইগটা নেন। কাজে দেবে।
আমি মেয়েদের চুলের মতো সামনে ঢেউ খেলানো উইগটা আর নাপিতের দিকে অগ্নিদৃষ্টি দিয়ে বেরিয়ে এলাম। বাসায় এসে দেখি ছোট চাচি আন্ডা-বাচ্চা নিয়ে হাজির। মা আর ছোট চাচি আমাকে দেখে চোখ কপালে তুললেন। আমি কিছু না বলে রুমে ঢুকে গেলাম। আমার তিন বছরের কাজিন এসে বলল, ‘ভাইয়া, তোমার মাথায় তবলা বাজাব।’ আমার আগুন বের হওয়া চোখকে পাত্তা না দিয়ে সে তবলা বাজানো শুরু করল। এবার বাজল ফোন, বন্ধু সুমনের।
: হ্যালো।
: হ্যালো, দোস্ত, আমি তো নেইমার কাট দিয়ে এলাম। হেব্বি লাগছে। তুই কোন কাট নিয়েছিস।
: জিদান কাট।
: জিদান কাট মানে? জিদান তো ওয়ার্ল্ডকাপে নেই। তা ছাড়া সে তো ন্যাড়া।
: হ্যাঁ, ওল্ড ইজ গোল্ড। আর অনেক ইউনিক।
আমি গম্ভীর মুখে ফোন নামিয়ে রাখলাম। মাথায় তবলা বেজেই চলেছে। হায়রে বিশ্বকাপ! একদিনের আমেজেই এত কিছু।
উম্মে মাবরুরা
সিদ্ধেশ্বরী, ঢাকা