রেফারি

.
.

ফুটবলে আমি আজীবনই রেফারি। রেফারি হলে দুদলের সদস্যরাই চা, ঝালমুড়ি খাওয়ায়। ভাবই আলাদা। আজও আমি রেফারির দায়িত্ব নিয়েছি। তবে মাঠে নয়, রেস্টুরেন্টে। সেদিন আবীরের সঙ্গে দেখা হতেই পশ্চিমা কায়দায় জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘হোয়াটস আপ?’ আবীরের গম্ভীর উত্তর, ‘ব্রেকআপ!’ আমি তো অবাক। আবীরের একমাত্র প্রেমিকা রিয়া আমাদের ক্লাসেই পড়ে। এত দিনের সম্পর্ক ভেঙে যাবে? ডেটিংয়ে গেলেই ওরা ট্যাক্স হিসেবে আমাদের মুরগি খাওয়াত, সেটার কী হবে? যেভাবেই হোক, ওদের সম্পর্ক পুনর্গঠন করতে হবে। তাই দুপক্ষকেই সংলাপের আমন্ত্রণ জানিয়েছি। তবে এসির বাতাসে ঘুম এলেও আবীর-রিয়া কেউই আসছে না। ওরা এলে কী কী খাব তা ভাবতে ভাবতেই আবীর এল। ব্রেক আপের কোনো চিহ্নই নেই চেহারায়। মনে হচ্ছে সম্পর্ক শেষ হওয়ায় সে খুব আনন্দিত। আবীর বসতেই খোঁচা দিয়ে বললাম, ‘নাইজেরিয়া!’
‘আমি ব্রাজিল।’
‘আরে তা তো জানি। কিন্তু এখন তো রিয়া নাই। নাই যে রিয়া। বুঝলি না?’
‘ধুর...ও আসে নাই, না? আসবে না। কমিটমেন্ট নামক বস্তুটা ওর মধ্যে নাই। আমি ওকে খুব ভালো করে চিনি।’
বলতে না বলতেই রিয়া চলে এল। বিরক্ত মুখে আবীরের উল্টো দিকে বসল সে। আবীরকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বলল, ‘কী বলবি দ্রুত বল। আমার কাজ আছে।’
আবীর উঠে গেল। হায় হায়, শুরুতেই সব শেষ নাকি? পরে বুঝলাম নাহ। ও খাবারের অর্ডার দিতে গিয়েছে। যাক, খাবার আসছে। এটা ভালো লক্ষণ। কিছুক্ষণের মধ্যেই খাবার চলে এল। কেউ কোনো কথা বলছে না দেখে আমিই শুরু করলাম। কথা নয়, খাওয়া। খেতে খেতে বললাম, ‘তোদের মধ্যে ফাউলটা করল কে?’
রিয়া বলল, ‘তোর বন্ধু। ফাউল একটা ছেলে।’ আমি মাথা নাড়লাম। কথা সত্য। আমার অ্যাসাইনমেন্ট এখনো করে দেয়নি। কথা চালিয়ে গেল রিয়া, ‘আমাকে কোনো কেয়ারই করে না ও। ফোনের পর ফোন দিই, ধরে না। রাত দুইটায়ও ওর ফোন ওয়েটিং পাই...’ কথা শেষ না হতেই আবীর গর্জে উঠল, ‘তুমি জানো না দুইটায় ব্রাজিলের খেলা থাকে? দোস্ত, ও আর্জেন্টিনার সাপোর্টার। আমি ব্রাজিল করি এটা ওর সহ্য হয় না। খেলা দেখতে বসলেই ফোন দিয়ে বিরক্ত করে। যাতে শান্তিমতো খেলা দেখতে না পারি! অথচ ও নিজে ফোন ধরে না...’
‘আর্জেন্টিনার খেলার সময় ফোন দিলে কেন ধরব? ও সব সময় আমাকে আর্জেন্টিনা নিয়ে খোঁটা দেয়। ও আমাকে ভালোবাসে না। ভালোবাসলে ব্রাজিল সাপোর্ট করত না। আর্জেন্টিনা সাপোর্ট করত। আসলে ব্রাজিলের সঙ্গে আর্জেন্টিনার মিল হতে পারে না।’ বলতে বলতে রিয়া টিস্যু দিয়ে চোখ মুছল। আবীর রাগটা ঝাড়ল মুরগির ওপর। কপ করে মুরগিতে সুয়ারেজমার্কা কামড় দিয়ে বলল, ‘তুই ভাবতে পারবি না ও কত স্বার্থপর! বললাম ব্রাজিলের খেলার সময় আমাকে ফোন করে উঠিয়ে দিয়ো। দেয়নি। এমন স্বার্থপর মেয়ে পুরো এশিয়া মহাদেশে আর এক পিসও নাই।’
‘ভালো করলে খারাপ হয়, না? আমি চাইনি ও রাত জাগুক। পরদিন ক্লাস আছে। তা ছাড়া ব্রাজিলের খেলা এমন কী যে রাত জেগে দেখতে হবে? রাত দুইটায় কোনো ভদ্র দল খেলে না!’
‘ও, তাই নাকি! তাহলে তুমি ভোর চারটায় আর্জেন্টিনার খেলা দেখলা কেন? তোমার ক্লাস নাই? আর দেখো ভালো কথা। ফার্মেসি গোল দিলে আমাকে ফোন দিয়ে জাগানোর মানে কী? মেসি গোল দিলে কি সরকার আমাকে ভাতা দেবে?’
‘ফার্মেসি! খবরদার! মেসিকে নিয়ে কোনো ফালতু কথা বলবা না। তুমি কেন ব্রাজিলের খেলা দেখো, আমি বুঝি না ভেবেছ? খেলা তো মুখ্য না, মুখ্য হলো সাম্বা নৃত্য না হাম্বা নৃত্য। আর প্লেয়ারের নামের কী ছিরি—অস্কার! আরে ব্যাটা তুই থাকবি হলিউডে, মাঠে কী করিস? আরেকজন আছে ফ্রেড। ওর তো নাম হওয়া উচিত ফ্রড। অফসাইড থেকে গোল দেয়!’
‘মুখ সামলে কথা বলো রিয়া! নইলে কিন্তু দুর্ঘটনার জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না।’
আমার খাওয়া শেষ। আর চুপ করে থাকা যায় না দেখে আমি ওদের সামনে একটা কার্ড ধরলাম। দুজনই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘এটা কী?’ ‘হলুদ কার্ড’—জবাব দিলাম আমি। ‘দুজনকেই হলুদ কার্ড দেখিয়ে সতর্ক করছি। রিয়া, গত বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার অধিনায়ক কে ছিল?’ রিয়া কপাল কুঁচকে বলল ‘আমি কী জানি!’ হো হো করে হাসল আবীর, ‘কী সাপোর্টার! দলের খবরই রাখে না।’ আমি বললাম, ‘আবীর, এবার বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে ব্রাজিল কয়টা ম্যাচ জিতেছে?’
‘ইয়ে...সব ম্যাচ। ব্রাজিল ম্যাচ হারে না।’
‘গাধা। স্বাগতিক হওয়ায় ব্রাজিল এবার বাছাইপর্বই খেলেনি।’
‘অ।’
‘তোরা তো গত চার বছরে আমাদের সঙ্গে বিবিএ ডিপার্টমেন্টের ফুটবল ম্যাচ ছাড়া কোনো ম্যাচ দেখিস নাই, দেখেছিস?’
‘না।’
‘মানে তোরা ফুটবলের খোঁজই রাখিস না। সিজনাল সাপোর্টার। অথচ এখন ফুটবল নিয়ে ঝগড়া করে ব্রেকআপ বাধিয়ে বসে আছিস। বেকুবের দল। যে দলের জন্য ব্রেকআপ করছিস, গত চার বছর তার কোনো খোঁজই রাখিসনি! আম-লিচু দেখে ভাত-তরকারির কথা ভুলে গেলে হবে?’ আবীর বলল, ‘দোস্ত, যৌক্তিক কথা বলেছিস। যুক্তি দিয়ে কথা বলিস বলেই তোর গার্লফ্রেন্ড নেই। প্রেম যুক্তি মানে না।’ রিয়াও দেখি সুর পাল্টে ফেলে বলে, ‘আসলে আমারই ভুল। ও ব্রাজিলের খেলা দেখলে দেখুক। আমার কী? ব্রাজিল জিতুক, আর্জেন্টিনা জিতুক আমার তো কোনো লাভ নাই। ইশ্, কী বোকা আমরা!..এই রে, বাসা থেকে ফোন দিচ্ছে। যাই আমি।’
‘চলো, তোমাকে রিকশায় উঠিয়ে দিই’ বলে আবীরও ওর পিছু পিছু গেল। সাধারণত প্রেমিক-প্রেমিকাদের মধ্যে যেকোনো একজন বোকা হয়। দুজনই বোকা এই প্রথম দেখলাম। একটু পর আবীরের ফোন, ‘দোস্ত, সন্ধ্যা হয়ে গেছে তো। আমি বরং বাসায় ওকে পৌঁছে দিয়ে আসি।’
বাহ্, দুজনের মিল হয়ে গেল, আর আমার কোনো পাত্তা নাই? দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠতে যাব, এমন সময় ওয়েটার এসে একটা কাগজ ধরিয়ে বলল, ‘স্যার বিলটা।’ মানে কী! বিল দিয়ে যায়নি? উপকারের এই প্রতিদান? কী আর করা, এই প্রথম রেফারি হয়েও আমি বিল দিলাম। আর জীবনে রেফারি হব না।