এমন যদি হতো

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

শহরের কোলাহল ছেড়ে দূরে কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে বেশ কিছুদিন ধরে মনের কোণে জমা হয়ে আছে। আজ কাল করে সেটা পরিণতি পায় না। কখনো আলসেমি ভর করে, আবার কখনো যান্ত্রিক জীবনে অনুরোধ-অনুযোগের দাবি মেটাতে গিয়ে আত্মিক চাওয়াগুলোকে দূরে ঠেলে দিতে হয়। এক সকালে বিছানা ছেড়ে সেই অজানার পথে পাড়ি দিলাম। উদ্দেশ্য কোনো গ্রামের মেঠো পথে প্রিয় দ্বিচক্র যানে ভ্রমণ। শহর ছেড়ে চলেছি। দূষণ মুক্ত বাতাসে মনপ্রাণ নতুন আনন্দে মাতোয়ারা। সেল ফোনটা অ্যাপার্টমেন্টে বন্দী করে আজ শুধু মনের দাবি মেটানো, কারও ফোন ধরাধরি নয়। রোদ প্রখর হয়নি এখনো। মিষ্টি বাতাস, মনে বসন্ত। এই মুহূর্তে বাইকের পেছনে কোনো ভালোবাসার মানুষ থাকলে কী আরও একটু ভালো লাগত? হয়তো, সেটা ভেবে এখন আর কী বা হবে!-প্রকৃতির এই নির্মল ভালোবাসাই কম কীসে! একপাশে কাশবন-অন্য পাশে ছোট ছোট ধানখেত। মাঝে মাটির গালিচা-চলছে বাইক। মনে মনে ভাবছি এই পথ শেষ না হোক...।
একটা জটলা দেখতে পাচ্ছি, কিছু মানুষের শব্দ পাচ্ছি, অস্পষ্ট! একবার ভাবলাম পাশ কাটিয়ে চলে যাই কিন্তু পর মুহূর্তে চোখে পড়ে গেল একটা চায়ের দোকান। জটলার খুব কাছেই। বাইক থামালাম। চায়ের নেশা আছে আমার। সেটা দিন কিংবা রাত, তাতে কিছু আসে যায় না! একটু তৃপ্তি করে চা পানের আনন্দ আমার কাছে অনেক বড়। একচালা টিনের ঘর। সামনে দুটো কাঠের বেঞ্চি। যেমনটা হয় আর কী। চা নিয়ে বসে পড়লাম তারই একটায়। সেই দোকান থেকে কিছু দূরে মানুষের জটলাটা একটু বড় হলো মনে হচ্ছে। একটু পরেই দেখলাম একটা পুলিশের ভ্যান এসে পড়ল। কিছু পরে আরও কিছু পুলিশ এল। এবার একটু নড়ে বসলাম আমি। দোকানির দিকে তাকাতেই সে যেন পড়ে নিল আমার কৌতূহলী চোখের ভাষা। নিজে থেকেই বলল, স্যার, মঙ্গল মুনশির পোলাডারে ভূতে মাইরা থুইসে! ব্যাটায় বদ আছিল। কোনো প্রসঙ্গ ছাড়া একটা মানুষের মৃত্যুর খবর দিচ্ছে আরেকটা মানুষ। আমি কোনো কিছু বলবার আগেই সে আবার বলল, গ্রামের সবে কয় যেইদিন থেইক্কা ওই জমিনে মনা মিয়ার মাইয়াডার লাশ পাওয়া গেছিল, ঠিক হেই রাত থেইক্কাই ওই মাইয়াডারে ওইহানে দ্যাহা যায়। মঙ্গল মুনশির পোলা করম মুনশি ওই মাইয়াডারে মারছে। এইডা সবেই জানে। তয় কেউ কয় না। মঙ্গল মুনশির তো অনেক জোর। ডরে কেউ মুখ খোলে না। আহারে মনা মিয়া কত কানছে। কোর্ট-কাচারিও করসে স্যার। কিন্তু বিচার পায়নায়গো স্যার...। থামল চা দোকানি। কী বলব বুঝতে পারছি না। ইতিমধ্যে দোকানে বসা অন্য লোকেরা মাথা নাড়িয়ে সায় দিল দোকানির কথায়। আর বেশিক্ষণ এখানে থাকা চলবে না। বেরিয়েই যাচ্ছিলাম। কী মনে করে আবার দোকানির কাছে ফিরে গেলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, আচ্ছা, মনা মিয়ার মেয়ের নামটা কি ছিল? দোকানি একবার মুখ তুলে চেয়ে বলল, সোনালি।

বাইক নিয়ে সেই ধানি জমিটার কাছের রাস্তাতেই চলছি। মানুষের জটলা নেই আর, লাশ নিয়ে চলে গেছে পুলিশ। নজরে পড়ল একটা কাকতাড়ুয়া। গাটা কেমন ছমছম করে উঠল। ধানখেতের ওপর কেমন অবজ্ঞা-বিদ্রূপের হাসি হাসছে।
রাতে ঘুমটা ভালো হলো না। ভাবলাম কাল আবার যাব সেই জায়গাটাই। আরেকটু বিশদভাবে জানতে ইচ্ছে করছে আসলে কী হয়েছিল। ভোর হয়ে আসছে। কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম মনেই নেই।
সকাল হয়েছে। সেল ফোনটা বাজছে। বাইক নিয়ে বেরিয়ে পরলাম। প্রথমেই গেলাম সেই দোকানির কাছে। জানতে চাইলাম মনা মিয়ার কথা। আমাকে মনা মিয়ার বাড়ির রাস্তা দেখিয়ে দিয়ে সে ব্যস্ত হয়ে পড়ল খদ্দের সামলাতে। আমাকে চিনতে পারল কিনা বুঝতে পারলাম না। বেশ নির্লিপ্তভাবে দেওয়া তার উত্তরগুলো শুনলাম। ধন্যবাদ বলে বাইকে বসলাম। গন্তব্য মনা মিয়ার বাড়ি।
আঁকাবাঁকা পথ ধরে চলছে বাইক। মাইল দু-এক পার হয়ে এসেছি। অনেক নারকেল-সুপারি গাছের সারি। আর বোধ হয় বেশি দূর না। রাতে ঘুম হয়নি। ক্লান্ত লাগছে বেশ। দূর থেকে কে যেন হেঁটে আসছে। সূর্যটা এই পথে তেমন আলো দিচ্ছে না। এর কারণটা বুঝতে পারছি না। তবে দূর থেকে আসা মানুষটা এই মুহূর্তে একটা মেয়ে বলে মনে হচ্ছে। দূরত্ব কমে আসছে আমার বাইক আর হেঁটে আসা মেয়েটার মধ্যে। হাত দেখিয়ে থামাল আমায় মেয়েটা! আমি বললাম, কিছু বলবে? মেয়েটা আমার দিকে না তাকিয়েই বলল, আপনি কার বাড়ি খোঁজেন? বললাম, মনা মিয়ার বাড়ি। মেয়েটা বলল, আপনি কি সাংবাদিক? না বললাম আমি। তাহলে মনা মিয়ার বাড়ি যেতে চান কেন? তাঁর কাছ থেকে জানতে চাইবেন কেমন করে সোনালি মরেছে? মেয়েটার কথায় বেশ ঝাঁঝ এবার। আমি বললাম, তুমি জানলে কী করে আমি সোনালির কথাই জানতে চাইব? এবার মেয়েটা মনে হয় আরও রেগে গেল! গত কয়েক বছর ধরেই তো তাই দেখে আসছি নানা লোকে এসে ওনাকে প্রশ্ন করে। কাঁদিয়ে যায়। মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে যায়। আজকাল চোখেও দেখেন না ঠিকভাবে উনি। তার ওপর আপনি তো সাংবাদিকও নন! একটু থামল মেয়েটা। তোমার পরিচয়টা জানতে পারি? আমি প্রশ্নটা করলাম ইতস্তত হয়ে। আমার পরিচয় পরে হবে। কি জানতে চান আমাকে বলতে পারেন। আমি এখানেই থাকি আর সব সত্যই জানি। ভাবলাম মেয়েটা যখন বলতেই চাইছে, একবার শুনে দেখতে দোষ কি। এই ফাঁকে বললাম ওকে আমি মাঝে মাঝে লিখি, গল্প কিনা জানি না। তবে জীবন থেকে যা পাই। তাই নিয়ে লেখার চেষ্টা করি। মেয়েটা আমার উত্তরে কোনো অভিব্যক্তি প্রকাশ করল না। সূর্য আস্তে আস্তে পশ্চিমে অগ্রসর হচ্ছে। তবে মোটামুটি আলো এখনো আছে। যদিও এখন পর্যন্ত আমি মেয়েটার মুখ পরিষ্কার করে দেখতে পাচ্ছি না। কারণ বাইক থেকে বেশ দূরে একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে সে। খানিকটা আড়াআড়ি ভাবে। মুখের একটা পাশ শুধু দেখতে পাচ্ছি। যাই হোক আচ্ছা বল তাহলে। খানিক নীরবতার পর আমিই সেটা ভাঙলাম, শুরু হলো সোনালির গল্প...।
মেয়েটা যেন অপেক্ষা করছিল।
সোনালি ছিল ১৭ বছরের, দেখতে ছিল বেশ। বাবা-মায়ের অনেক আদরের। ও বোধ হয় একটু বেশিই পেয়ে গেছিল। কী জানি হয়তো বেশি দিন সেটা পাবে না বলেই। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে পড়ছিল। গান গাইতো অনেক সুন্দর। বন্ধুরা ওকে অনেক পছন্দ করত। ওর বাবা মনা মিয়া এই গ্রামের পোস্ট অফিসে কাজ করত। কষ্ট করে মেয়েটাকে মানুষ করার চেষ্টা করে যাচ্ছিল। বাবাকে সাহায্য করতে গিয়ে গ্রামের কিছু শিশুদের ও গান শেখাত। সব খুব ভালোই চলছিল জানেন। কিন্তু একদিন সব শেষ হয়ে গেল। সেদিন ঠিক আজকের মতো ছিল! সূর্যটা কেমন মনমরা হয়ে ছিল। ওর মা অনেক করে বলল সেদিন বাইরে না যেতে। সোনালি বলেছিল দুই ঘণ্টার মধ্যে ফিরে আসবে...সেদিন রাতেই মঙ্গল মুনশির ধানখেতে ওর রক্তাক্ত লাশ পাওয়া গেল। ওই পথেই ও বাড়ি ফিরত। আপনি নিজেও তো এলেন। দেখলেন তো অন্য কোনো পথ নেই কিন্তু। হাতের ইশারায় থামতে বললাম মেয়েটাকে। কিন্তু সোনালির মৃত্যুর সঙ্গে মঙ্গল মুনশির ছেলের মৃত্যুর সম্পর্ক কি? সেটাতো বললে না। আমি প্রশ্ন শেষ করতেই পারলাম না। একটা অদ্ভুত হাসির শব্দ পেলাম। মেয়েটা হাসছে। মেয়েটাই হাসছে তো হাসছেই। একটা শীতল ধারা যেন আমার শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল।
বিচার হয়েছে। মেয়েটা হাসি থামিয়ে বলল। আমি একটা যোগসূত্র খোঁজার চেষ্টা করছি। মেয়েটা এবার আরও একটু দূরে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর আবার শুরু করল। সোনালি কোনো দিন কাউকে বলেনি। মঙ্গল মুনশির ছেলে করম, তার সাঙ্গপাঙ্গরা অনেক সময় ওকে উত্ত্যক্ত করত। এটা এলাকার কারও কারও চোখে পরলেও কেউ কিছু বলতে সাহস করত না। কেননা মঙ্গল মুনশি এলাকার অনেক প্রভাবশালী একজন। ওর ছেলের বিচার করবে বা তার নামে অভিযোগ করবে এমন কেউ ভাবতেই পারত না। সোনালিও একটা সময় এসব নিয়ে আর মাথা ঘামাত না। কেমন যেন গা সয়ে গেছিল ওরও। কিন্তু একদিন...থামল মেয়েটা। করম আর অর বন্ধু পশুরা একে একে...। তারপর যখন সোনালি বাড়ির দিকে ফিরে আসার চেষ্টা করছিল, তখন ওর মাথায় আঘাত করল। সম্ভ্রম নিয়েও ওদের মন ভরেনি...যখন ওরা বুঝল সব শেষ, তখন করম ওর সাঙ্গপাঙ্গদের বলেছিল লাশটা নদীতে ফেলে দিতে। কিন্তু হঠাৎ দেখতে পেল সাইকেল চালিয়ে দূর থেকে কেউ যেন আসছে। পাশের জঙ্গলে লুকিয়ে পড়ল ওরা। সোনালির লাশটা তখনো রাস্তার পাশের নিচু জমিতে পড়ে ছিল। জানেন সাইকেলে করে সেদিন কে বাড়ি ফিরছিল? আমি জানতে চাইলাম কে? উত্তরে মেয়েটা বলল, সোনালির বাবা। আমার পৃথিবীটা এক মুহূর্তে ঠিক কেমন বিমর্ষতায় ভরে গেল। সেটা শব্দে প্রকাশ করা কঠিন। শুধু কয়েক ফোঁটা অশ্রুবিন্দু এটা ভেবেই কপোল গড়িয়ে পড়ল যে, একজন বাবা জানলেন না তাঁর প্রিয় সন্তান তারই চলে যাওয়া পথে নিষ্প্রাণ তখন।
তারপর? আমার প্রশ্নে মেয়েটা আবার বলল, তারপর। ওরা লাশটা নিয়ে ওই ধানখেতে ফেলে শহরে পালিয়ে গেল। ওরা হয়তো রাতের অন্ধকারে বুঝতে পারেনি ওটা মঙ্গল মুনশির ধান খেত ছিল। যেখানে লাশটা ফেলে গেল ঠিক তার পাশেই ছিল একটা কাকতাড়ুয়া। যেটা দেখে আপনার গা ছমছম করে উঠেছিল গতকাল! মুহূর্তে যেন আমি বাস্তবে ফিরে এলাম। তুমি জানলে কেমন করে? সেটার উত্তর একটু পরেই দিচ্ছি। আগে বাকিটা শেষ করতে দিন। মেয়েটা যেন খুব তাড়ায় আছে। গ্রামের মানুষ সঙ্গে নিয়ে সোনালির লাশ খুঁজে পেল ওর বাবা। পুলিশ আসল, ময়না তদন্ত হলো, কত মানুষ আন্দোলন-অভিযোগ করল, প্রতিবাদ জানাল। কিন্তু দিন-মাস-বছর পেরিয়ে গেল। কেউ শাস্তি পেল না...কিন্তু সব অন্যায়ের তো একটা শেষ পরিণতি থাকে তাই না। সোনালির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সেই নিষ্প্রাণ কাকতাড়ুয়া একদিন যেন প্রাণ পেল। গ্রামের মানুষ ভাবল সোনালি বুঝি ফিরে এসেছে। শহরে পালিয়ে যাওয়া করমের ওই তিন বন্ধু কোথায় আছে কেউ জানে না। তবে করম গ্রামেই ছিল। এক রাতে মাতাল হয়ে ঠিক ধান খেতের পাশ দিয়ে বাড়ি ফিরছিল সে। সোনালির নিষ্প্রাণ কাকতাড়ুয়া বন্ধুটি বাতাসের খোঁচায় যেন নড়ে উঠল। আকাশে ঠিক ওই মুহূর্তে বিদ্যুৎ চমকাল। ততক্ষণে ভয়ে আধমরা করম। আর ঠিক তখনই ধীরে ধীরে সামনে এল সোনালি কাকতাড়ুয়ার পেছন থেকে। ব্যাস! পরদিন সকালে করমের লাশটা পাওয়া গেল সেখানে ঠিক যেখানে সোনালি পড়ে ছিল। ময়নাতদন্তে উঠে এল হৃদ্‌রোগে মরেছে করম! এই বলে আবার অনেকক্ষণ ধরে হাসল মেয়েটা।
এবার আমি বললাম, আচ্ছা, তুমি তো বেশ ভালোই গুছিয়ে বলতে পার? গল্প-টল্প লিখতে পারতে! এবার মেয়েটা আমার দিকে ঘুরে দাঁড়াল আর জিজ্ঞেস করল, এতক্ষণ যা বললাম, এগুলো কি আপনার কাছে গল্প মনে হলো? আমি বললাম, করমের মৃত্যুর ঘটনাটা অবশ্যই মনে হয়েছে'; মেয়েটা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থেকেই বলল, ও তাহলে আপনি বা আপনার মতোন বিবেকবান সুশীল মানুষরাও একজন অত্যাচারী অমানুষের ভৌতিক মৃত্যু মানতে পারছেন না! আমি কিছু বলতে যাব, সে আমাকে ইশারায় থামিয়ে দিয়ে বলল, আপনি শুরু থেকেই জানতে চাইছিলেন না আমি কে? আমি মাথা নাড়লাম আর বাইকটা স্টার্ট করলাম। আলো জ্বলতেই শুধু একটা কিন্নর কণ্ঠ শুনলাম, আমিই সোনালি!
চারপাশে কেউ নেই, কোথাও। একজন মধ্য বয়স্ক লোক এগিয়ে আসলেন এবার বাইকের দিকে। বাবা, আপনি কি কাউরে খোঁজেন? কারে খোঁজেন বাবা? সারা শরীর আমার ঘামে ভিজে গেছে। কোনো মতে বললাম, মনা মিয়া। তিনি বললেন, আমিই মনা মিয়া, এই পাশেই আমার মাইয়াডার কবর, একটু দেখবার আইসি বাবা...।
(লেখক কানাডার মন্ট্রিয়েলপ্রবাসী)