অর্থনীতির সামগ্রিক ব্যবস্থাপনায় জোর দিতে হবে
প্রথম আলোর আয়োজনে ‘কোন পথে অর্থনীতি ও আগামীর বাজেট’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ২৮ মে ২০২২। আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হলো।
অংশগ্রহণকারী
বিনায়ক সেন
মহাপরিচালক, বিআইডিএস
এ কে আজাদ
ব্যবস্থাপনা পরিচালক, হা-মীম গ্রুপ
ফাহমিদা খাতুন
নির্বাহী পরিচালক, সিপিডি
আবুল কাসেম খান
সাবেক সভাপতি, ঢাকা চেম্বার
সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর
ব্যবস্থাপনা পরিচালক, অ্যাপেক্স
মাসরুর আরেফিন
এমডি, সিটি ব্যাংক
রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর
চেয়ারম্যান, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সেলিম রায়হান
অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বিপ্লব ঘোষ
সহপ্রতিষ্ঠাতা, ই-কুরিয়ার
ইশরাত জাহান চৌধুরী
স্বত্বাধিকারী, তুলিকা
সঞ্চালক
শওকত হোসেন
হেড অব অনলাইন, প্রথম আলো
আলোচনা
শওকত হোসেন
বাজেটের আগে সাধারণত আমরা এ ধরনের আলোচনা করে থাকি। আমরা কেবল বাজেট নিয়েই আলোচনা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে অর্থনীতি অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তাই আজ বাজেট ও অর্থনীতি—দুটি বিষয় নিয়েই আলোচনা করব।
অর্থনীতির এখন যে সংকট, তা বাংলাদেশের একার নয়। বিশ্বের প্রায় সব দেশে এ সংকট দেখা দিয়েছে। সবাই নিজেদের মতো করে সমাধানের পথ খুঁজছে। আমাদের আজকের আলোচনার উদ্দেশ্য একটাই, অর্থনীতির সমস্যাগুলো যদি ভালো করে বুঝতে পারি, তাহলে সমাধানের পথ খুঁজে বের করা সহজ হবে। আজকের আলোচনায় এসব বিষয় উঠে আসবে বলে মনে করি।
সেলিম রায়হান
আজকের আলোচনার ব্যাপ্তিটা অনেক বড়। বিষয়টাকে দুভাবে দেখা যেতে পারে—প্রথমত, সামগ্রিকভাবে বৈশ্বিক পরিস্থিতি কী। আর আমাদের অবস্থাটা কী। আমরা জানি, বৈশ্বিক পরিস্থিতি মোটেই আমাদের জন্য অনুকূল নয়। বিশ্ববাজারে জ্বালানি, খাদ্যপণ্যসহ অনেক পণ্যের দাম বেড়েছে। আগে বাংলাদেশ বৈশ্বিক পরিস্থিতি এড়াতে পারত। কিন্তু এখন সেটা সম্ভব হচ্ছে না। গত এক দশকে আমরা যদি সামষ্টিক অর্থনীতির দিকে তাকাই, তাহলে এখন আমরা সবচেয়ে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।
দেশে ব্যাপক মূল্যস্ফীতি হচ্ছে। আমাদেরও একটা গবেষণা আছে। সরকারি হিসাবে যতটুকু মূল্যস্ফীতি বলা হচ্ছে, মানুষকে তার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ মূল্যস্ফীতির ভার নিতে হচ্ছে। কেন মূল্যস্ফীতি হচ্ছে, এ জন্য গভীরে যাওয়া দরকার। বাংলাদেশ ব্যাংক এ ক্ষেত্রে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারে।
প্রায় এক দশক ধরে দেশে মুদ্রার বিনিময় হার নিয়ে একধরনের স্বস্তি ছিল। কিন্তু এখন সেটি নেই। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ তৈরি হয়েছে। সামনের দিনগুলোতে বিনিময় হার ঠিক থাকবে বলে মনে হয় না। তাই এখনই বিনিময় হারের যথাযথ সমন্বয় দরকার। তা না হলে অনিশ্চয়তা বাড়তে থাকবে। বিনিময় হার সমন্বয়ে আমরা যত বেশি সময় নেব, সমস্যা তত বাড়বে। গত এক থেকে দুই দশকের অভিজ্ঞতা হলো, প্রবাসী আয়ের প্রবাহ কখনো স্থিতিশীল নয়। কত দিন আমরা প্রবাসী আয় ও পোশাকশিল্পের ওপর নির্ভর করব। রপ্তানি ও রপ্তানিবৈচিত্র্য নিয়ে বিভিন্ন সময় আলোচনা হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ খুব বেশি হয়নি। আমাদের শুধু বৈশ্বিক অর্থনীতিকে দায়ী করলে চলবে না। সামগ্রিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনার ওপর আমাদের নজর দিতে হবে। গত এক দশকে আমাদের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির যে হারে প্রবৃদ্ধি হয়েছে, কর সংগ্রহ সেভাবে বাড়েনি। তাহলে অতিরিক্ত যে জিডিপি আমাদের অর্থনীতিতে যুক্ত হয়েছে, সেটা কি করবিহীন? এ ধরনের করবিহীন প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে কাদের সুযোগ দিচ্ছি?
এই মুহূর্তে শ্রীলঙ্কার মতো অবস্থায় আমরা নেই। কিন্তু আমাদের সতর্ক হতে হবে। আমাদের অনেক বড় প্রকল্প ঋণনির্ভর। আবার কোনো কোনো প্রকল্পের সম্ভাব্যতাও যাচাই করা হয়নি। তাই সব কটি মেগা প্রকল্প নিয়ে আমাদের এখনই পর্যালোচনা করা উচিত। গত এক থেকে দেড় দশকে আমরা অর্থনীতিতে ভারসাম্য রাখতে পেরেছি। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সামাজিক খাতে অনেক কম ব্যয় করেছি। আগামী বাজেটে আমি সামাজিক খাতের জন্য বড় বড় মেগা প্রকল্প দেখতে চাই।
সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর
আমরা যারা পণ্য আমদানি ও রপ্তানি করি, তারা একটা বিশাল পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি। চীনে কোভিড সংকটের জন্য আমাদের দেশে অনেক ক্রয়াদেশ আসছে। কিন্তু কাঁচামালের সংকটসহ বিভিন্ন কারণে সময়মতো পণ্য সরবরাহ করতে পারছি না। অনেকে বলছেন, কোভিড থেকে বেরিয়ে গেছি। কিন্তু আমি বলি, আমরা কোভিডের মধ্যেই আছি। এখনো দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রতিদিন গড়ে ২০ হাজার মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন।
এখন চারটি বিষয় আমাদের ভীষণভাবে প্রভাবিত করছে। সাপ্লাই চেইনে চাপ পড়ছে। কাঁচামাল পাচ্ছি না। ডলারের বিনিময় হারের একটা চাপ আছে। দেশে প্রায় প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। যেটাকে আমরা মূল্যস্ফীতি বলছি। আরেকটা হলো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এ অবস্থায় কীভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যের ভারসাম্য বজায় রাখব, সেটা বড় চ্যালেঞ্জ।
আমার ব্যক্তিগত অভিমত হচ্ছে, ডলারের ক্রয় ও বিক্রয়মূল্যের মধ্যে অস্বাভাবিক পার্থক্য থাকা উচিত নয়। এটা নিয়ন্ত্রণের যথেষ্ট সুযোগ আছে। রপ্তানির সময় আমরা হিসাব করি ডলারের বিনিময় মূল্য ৮৬ টাকা ধরে। কিন্তু বিল পরিশোধের সময় ৯৬ টাকা দিতে হবে কেন? গত এক দশকে প্রবাসী আয় বেড়েছে প্রায় ৬১ শতাংশ।
আমরা আর কতকাল অদক্ষ শ্রমিক বিদেশে পাঠাব, এটি একটি বড় প্রশ্ন। অদক্ষ শ্রমিক পাঠিয়ে প্রবাসী আয় আর খুব বেশি বাড়ানোর সুযোগ নেই। তাই আগামী বাজেটে এ বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। আমাদের আমদানি খরচ প্রায় ৮০ বিলিয়ন বা ৮ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। তার বিপরীতে রপ্তানি আয় প্রায় ৫০ বিলিয়ন বা ৫ হাজার কোটি ডলার। প্রবাসী আয় আসে ২০ বিলিয়ন বা ২ হাজার কোটি ডলার। আর সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই থেকে আসে ৪ বিলিয়ন বা ৪০০ কোটি ডলার। বাকি থাকে মাত্র ৬ বিলিয়ন বা ৬০০ কোটি ডলার। তাই লেনদেনের ভারসাম্য নিয়ে ভয়ের পরিবেশ তৈরির বড় কোনো কারণ নেই। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে ডলারের সংকট মোকাবিলায় আমাদের আমদানি ও অবকাঠামোগত খরচের দিকে নজর দিতে হবে। সেখানে খরচ কিছু কমানো যায় কি না, তা দেখা দরকার। আমরা দেখলাম, ইন্দোনেশিয়া এ সংকটকালেও ২৪ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৪০০ কোটি ডলার জ্বালানিতে ভর্তুকি বাড়াচ্ছে। দক্ষিণ কোরিয়াও ভর্তুকি দিচ্ছে। তাই সব সময় আমাদের বিদেশিদের কথা শুনে কাজ না করে নিজেদের অগ্রাধিকার ঠিক করা দরকার।
সরাসরি জাহাজ চলাচলের সুবিধার কারণে এখন আমরা ইতালি, যুক্তরাজ্যসহ কিছু দেশে ১২ থেকে ১৫ দিনে সরাসরি পণ্য রপ্তানি করতে পারছি। এ ধরনের সরাসরি জাহাজ চলাচলের সুবিধা আরও বাড়াতে হবে। আমরা দেখলাম, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (বিএসসি) বিপুল মুনাফা করেছে। সংস্থাটি তাদের মুনাফা দিয়ে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর সঙ্গে সরাসরি জাহাজ চলাচলের সুবিধা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে পারে। তাহলে রপ্তানির ক্ষেত্রে বিরাট সুযোগ আসতে পারে। আমাদের যদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হয়, তাহলে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ভর্তুকি দিতে হবে।
যুক্তরাজ্য তাদের প্রত্যেক নাগরিককে ৪০০ পাউন্ড করে ভর্তুকি দিচ্ছে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধের জন্য। আমাদের দেশে যেসব মানুষ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে, আগামী বাজেটে তাদের জন্য এ ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে। মূল্যস্ফীতি চেপে ধরে রেখে যদি প্রবৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাতে তো লাভ হবে না। আমাদের প্রবৃদ্ধি যদি কমে যায়, তাহলে সংকট থেকে বেরোনোর পথ আরও কঠিন হয়ে যাবে।
মাসরুর আরেফিন
আমি অর্থনীতিবিদ নই। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে পত্রিকা পড়ে অর্থনীতি বোঝার চেষ্টা করতে হচ্ছে। বর্তমানে উচ্চ মূল্যে ডলার কেনাবেচা হচ্ছে। এ কারণে সবার খরচ বেড়ে গেছে। ব্যাংকগুলোকে ৮৮ টাকায় ডলার বিক্রি করতে বলা হচ্ছে। এখানে দেখতে হবে, আমাদের জন্য ডলারের উৎস কী কী। আমরা প্রবাসী আয় ও রপ্তানি খাত থেকে ডলারের বড় অংশ সংগ্রহ করে থাকি। আর পরে তা আমদানিকারকদের কাছে বিক্রি করি। এই বেচাকেনার মধ্যে এখন প্রায় ১০ টাকার পার্থক্য। রপ্তানিকারকেরা ৯৬ টাকার কমে ডলার দিচ্ছে না। আমি যদি ৯৬ টাকা না দিই, আরেক ব্যাংক দেওয়ার জন্য বসে আছে। যার দরকার, তাকে ডলার কিনতেই হবে। যে দামেই হোক, তিনি ডলার কিনবেন। কিন্তু বাজারে ডলার নেই। সংকটের সময় একজনের কাছ থেকে কমে কিনে অন্যজনের কাছে বেশি দামে বিক্রি করা হয়।
আমরা দেখছি, রপ্তানিকারকের খরচ সবদিক থেকে বেড়ে গেছে। তাদের পক্ষে কম দামে রপ্তানি বিল নিষ্পত্তি করা সম্ভব নয়। তবে ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা ও শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতিসহ বিভিন্ন কারণে আমাদের এখানে একধরনের ভয় তৈরি হয়েছে। যাঁরা প্রবাসী আয় পাঠান (রেমিটাররা), তাঁরা এ সুযোগ নিতে চাইছেন। আর হুন্ডি তো সিস্টেমে থাকে না। ডলার পাওয়া যায় ব্যাংকে আর খোলাবাজারে। বাংলাদেশে খোলাবাজারটি (কার্ব মার্কেট) কী। কয়টা মানি এক্সচেঞ্জ দেখা যায়। এটা খুবই ছোট বাজার। আসল লড়াইটা হচ্ছে ফরমাল ইকোনমি আর হুন্ডি বেজড ইনফরমাল ইকোনমির মধ্যে। আমাদের লেনদেন ভারসাম্যের ঘাটতি প্রায় ২৫ বিলিয়ন বা আড়াই হাজার কোটি ডলারের। এর মধ্যে চলতি হিসাবের ঘাটতি প্রায় ১৫ বিলিয়ন বা দেড় হাজার কোটি ডলারের। এটা হলো লেনদেনের হিসাব। এখানে ডলার আসবে-যাবে। মূলধনি হিসাব হচ্ছে বিনিয়োগ হিসাব। এখানে যদি টাকাকে শক্তিশালী করে রাখা হয়, তাহলে বিদেশি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। তাই জোর করে ডলারের দাম ধরে রাখার কিছু নেই। বাজারকে তার স্বাভাবিক গতিতে চলতে দিতে হবে। ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত। মূল্যস্ফীতি যা হওয়ার তা ইতিমধ্যে হয়ে গেছে। এটাকে আর চাপিয়ে রাখার সুযোগ নেই। ব্যাংকের সুদহারকেও সমন্বয় করতে হবে। তা না হলে সমস্যা আরও বাড়তে পারে। এ অবস্থায় সার্বিক বিষয়ে নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে গভীরভাবে ভাবতে হবে।
রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর
করোনার আগেই আমাদের কতকগুলো কাঠামোগত সীমাবদ্ধতা ছিল। দারিদ্র্য, বেকারত্ব বেড়ে যাচ্ছিল। কোভিড এসে আরও সংকটে ফেলে দিল। এর মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের প্রধান কাজ হলো সাশ্রয়ী হওয়া। সরকারের দিক থেকে অর্থনীতিকে স্লোডাউন করে দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে মুদ্রানীতি ভূমিকা রাখতে পারে, নাকি রাজস্বনীতির দরকার আছে। রাজস্বনীতি কেন প্রয়োজন, সেটা পরিষ্কার করা প্রয়োজন।
আমাদের অর্থনীতির খাতগুলোকে আরও বড় করতে হবে। এখানে প্রণোদনা দিতে হবে। বিশেষ করে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে প্রণোদনা বেশি দিতে হবে। পূর্ণ জীবনভিত্তিক সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি দরকার। কয়েক দশক ধরে যে উত্তরণ ঘটছে, যেকোনো ধাক্কায় যদি সেটা ভেঙে পড়ে, তাহলে তো এটা কোনো টেকসই উন্নয়ন হলো না। যেকোনো অভিঘাতেই আমাদের দেশে নতুন দারিদ্র্য তৈরি হয়। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে অবশ্যই শিল্পায়ন করতে হবে। এর জন্য কার্যকর পরিকল্পনা নিতে হবে।
যেকোনো মূল্যে সরবরাহ বাড়াতে হবে। কতকগুলো জায়গায় আমাদের ভাঙন ধরেছে। মধ্যবিত্ত নিম্নমধ্যবিত্ত হচ্ছে। নিম্নমধ্যবিত্ত দরিদ্র হচ্ছে। ভোগ বৃদ্ধি করতে হবে। ভোগ বৃদ্ধির পরিস্থিতিকে ধরে রাখতে হবে এবং সামনের দিকে নিয়ে যেতে হবে। সাধারণ মানুষকে বর্তমান অভিঘাত থেকে বাঁচাতে হলে পানি, গ্যাস, বিদ্যুতে সুরক্ষা দিতে হবে। এটার কোনো বিকল্প নেই।
বাংলাদেশের অর্থনীতি নাকি ৬০০ বিলিয়ন বা ৬০ হাজার কোটি ডলারের। আমি মনে করি, ২০৩৬ সালের মধ্যে অর্থনীতির আকার এক ট্রিলিয়ন বা এক লাখ কোটি ডলারের হতে পারে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আমদানি পণ্যের যে হিসাব ও বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবের মধ্যে ১২ বিলিয়ন বা ১ হাজার ২০০ কোটি ডলারের তফাত কেন? এই টাকা কে নিয়েছে। ভোগ্যপণ্য ও জ্বালানির জন্য আমরা মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারি। আমাদের এখন পূর্ব এশিয়ার দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। কিন্তু আমরা সেটি করছি না। এ ছাড়া সংকট মোকাবিলায় প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহি বাড়াতে হবে। প্রতিষ্ঠানের যদি জবাবদিহি না থাকে তাহলে সেগুলো কাজ করবে কীভাবে। তাই প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। আমরা দেখেছি, পৃথিবীর যেসব দেশে প্রতিষ্ঠান কার্যকরভাবে কাজ করেছে, সেখানে বাজার শক্তিশালী হয়েছে।
আবুল কাসেম খান
আমি অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, টেকসই কর্মসংস্থান, কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং চাহিদা তৈরি নিয়ে কথা বলব। আমাদের বাজেট আসলে একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। সরকারের কিছু লক্ষ্য আছে, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও প্রেক্ষিত পরিকল্পনা-এসবের ভিত্তিতে বাজেট করা হয়। বেসরকারি খাতের মূল বিষয় হচ্ছে সম্পদ তৈরি ও টেকসই কর্মসংস্থান। সবাই বলছে, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ ও করোনার ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া এখন চ্যালেঞ্জিং দুটি বিষয়। বাজেটে এ বিষয়ে অবশ্যই কিছু দিকনির্দেশনা থাকতে হবে।
আজকের আলোচনায় এসেছে, মূল্যস্ফীতি ও বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ তৈরি হয়েছে। এই মুহূর্তে এটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। এসব ক্ষেত্রে সরকার হয়তো তাদের নীতি অনুযায়ী আমাদের আর্থিক বা অন্য ধরনের সহযোগিতা করবে। আমি বাজেটের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাব রাখতে চাই। উদ্যোক্তাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা আসে কর প্রণোদনা থেকে। আমাদের করের হার কমাতে হবে। সরকার হয়তো সে উদ্যোগ নিচ্ছে। এখানে মূল বিষয় করহার নয়। বর্তমানে কার্যকর করহার অনেক বেশি, এ কারণে আমরা অনেকে ভোগান্তির শিকার হচ্ছি। অনেক ক্ষেত্রে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্য কার্যকর করহার ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ হয়ে যায়। তাই এখানে সমন্বয়ের দরকার আছে।
আমরা যেসব নিরীক্ষা প্রতিবেদন সরকারের কর বিভাগে জমা দিই, তাতে প্রদর্শিত ব্যয়গুলো না মেনে কর কর্তৃপক্ষ তাদের ইচ্ছেমতো কাটছাঁট করে বাড়তি কর আদায় করে। সরকারের ডকুমেন্টস ভেরিফিকেশন সিস্টেম বা ডিভিএস পদ্ধতি নিয়ে আরও কাজ করার আছে। যঁারা ডিভিএসে একবার নিরীক্ষা প্রতিবেদন জমা দেবেন, তা-ই কর বিভাগকে গ্রহণ করতে হবে। আমাদের জিডিপি-কর অনুপাত অনেক কম। এর অন্যতম কারণ কর আদায়ে হয়রানি ও অপ্রয়োজনীয় কর বসানো; বরং আমি মনে করি, উচ্চ হারে কর আদায় না করে করের পরিধি বাড়ানো হলে তাতে কর আদায় বেশি হবে।
এখানে ভোগের কথা এসেছে। আমার মনে হয় ভোগের বিষয়েও প্রণোদনা দিতে হবে। গৃহস্থালি পর্যায়ে, বেশি ভোগ করলে করের হারে একটা ছাড়ের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তাতে মানুষ ভোগ কমাবে না। কারণ, ভোগ কমলে চাহিদাও কমবে। এই মুহূর্তে চাহিদা কমানো ঠিক হবে না। তাই আমি মনে করি, এ বিষয়গুলো বাজেটে প্রতিফলিত হবে। উদ্যোক্তাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দিতে করপোরেট করহার কমাতে হবে। এতে নতুন উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে উৎসাহিত হবেন, কর্মসংস্থান হবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ক্ষেত্রে করমুক্ত লেনদেনের সীমা ৩ কোটি থেকে বাড়িয়ে ৪ কোটি টাকা করা যেতে পারে। আর নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য পাঁচ বছরের জন্য কর অব্যাহতির সুবিধা রাখতে হবে। আর বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারের খরচ কমাতে হবে। জ্বালানির দাম না বাড়িয়ে এ খাতে সরকারের ভর্তুকি বাড়াতে হবে।
ফাহমিদা খাতুন
বাংলাদেশ পৃথিবীর অল্প কয়েকটি দেশের একটি, যারা এখনো জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। এমনকি করোনাকালে ও করোনা–পরবর্তী সময়ে প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান ভালো। প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি অন্য কিছু সূচক রয়েছে, যা প্রবৃদ্ধিকে প্রভাবিত করে। এসব সূচক নিয়ে কিন্তু সন্দেহ রয়েছে। এ সন্দেহ এখন আরও ঘনীভূত হচ্ছে। বলা হচ্ছে, জিডিপি-প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, মাথাপিছু আয় বাড়ছে, তাহলে বৈষম্য কেন বাড়ছে? এসব ব্যত্যয় করোনার আগেও ছিল, এখন আরও ঘনীভূত হচ্ছে।
করোনার সময় সারা পৃথিবীতে চাহিদা বাড়াতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ, সরাসরি অর্থ প্রদানের মাধ্যমে মানুষের হাতে অর্থ দেওয়া হয়েছে, মানুষ যাতে বাজারে যায়। বাজারে গিয়ে কেনাকাটা করে এবং অর্থনীতিতে একটা চাঙা ভাব থাকে। সরকারি ব্যয় বাড়িয়ে চাহিদাকে ধরে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর সৃষ্ট সংকটের কারণে নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। কারণ, এ দুটি দেশের ভুট্টা, গম, জ্বালানি তেল ইত্যাদি পণ্যের ওপর সারা বিশ্ব অনেকাংশেই নির্ভরশীল। সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও একই পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে।
মূল্যস্ফীতির কথা বলা হচ্ছে। মূল্যস্ফীতি আসলে কত? সরকারি হিসাবে আমরা দেখছি ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ। কিন্তু আসলে কি তাই? আলোচনায় এসেছে, দরিদ্রদের ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশের মতো। মূল্যস্ফীতি কারও কারও ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশের ওপরে। সরকারি প্রতিষ্ঠান টিসিবিও বলছে, চাল, ডাল ও তেলের মতো কিছু পণ্যের মূল্য ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। ফলে প্রশ্ন উঠছে মূল্যস্ফীতির সরকারি তথ্য সঠিক কি না। এ তথ্য যদি সঠিক না হয়, তাহলে যত ধরনের নীতি গ্রহণ করা হোক না কেন, তা মানুষের উপকারে আসবে না।
বিশ্বের খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ে সবাই শঙ্কা অনুভব করছেন। বিশ্ব খাদ্য সংস্থা বলছে, সারা বিশ্বে খাদ্য উৎপাদন কমে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় খাদ্যসংকট বাড়ছে। আফ্রিকার অনেক দেশে খাদ্যসংকট মারাত্মক আকার ধারণ করবে। বাংলাদেশের কৃষি খাত বেশ ভালো করছে। কৃষকদের যে প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে, তঁারা তার সর্বোত্তম ব্যবহার করে আমাদের খাদ্য সরবরাহ করছেন। এরপরও যেটুকু ফারাক রয়েছে, তা পূরণে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।
দেশের কৃষকদের সম্ভাব্য সব ধরনের সহায়তা দিতে হবে। প্রয়োজনে আরও বেশি ভর্তুকি দিতে হবে। তঁাদের বাজারের সঙ্গে সংযোগের ব্যবস্থা করতে হবে। এতে করে তঁারা তঁাদের উৎপাদিত পণ্যের সঠিক দাম পাবেন।
আমরা সবাই বাজার অর্থনীতির কথা বলছি। কিন্তু এর বিপরীতে আবার কিছু কিছু সংরক্ষণবাদী নীতিমালা করছি। আসলে আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো তো শক্তিশালী হয়নি। প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি বৃদ্ধি না করলে ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার না করলে উন্মুক্তভাবে বাজার অর্থনীতির সুফল কিন্তু সবাই পাবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অন্যতম কাজ হচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা। কিন্তু সেই কাজ বাদ দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রবৃদ্ধি ও বেকারত্ব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে। আমরা সব সময় স্বল্পমেয়াদি বিষয়ের কথা বলি, কিন্তু মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি বিষয় এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা ও সক্ষমতার বিষয়টিও এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে।
এ কে আজাদ
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ যত দীর্ঘস্থায়ী হবে, আমাদের অর্থনীতির সমস্যাও তত দীর্ঘ হবে। বিশেষ করে আমরা যারা উন্নয়নশীল দেশ রয়েছি। আমরা কাঁচামাল আমদানি করি, আবার সেই কাঁচামাল দিয়ে উৎপাদিত পণ্যই রপ্তানি করে থাকি। যেসব দেশে আমরা রপ্তানি করি, সেসব দেশের অর্থনীতির ওপর নির্ভর করে আমাদের পণ্য তারা কীভাবে গ্রহণ করবে। ইতিমধ্যে আমাদের মূল বাজার ইউরোপ, আমেরিকা ও ইংল্যান্ডে অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হয়েছে। তারা পোশাকের আমদানি কমিয়ে দিয়েছে। রপ্তানির ওপর তার প্রভাব আমরা দেখব আগামী জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে।
ডলারের সংকট কাটাতে প্রবাসী আয় সংগ্রহের ক্ষেত্রে এক দর বেঁধে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। পাশাপাশি ব্যাংকে কত দামে রপ্তানি বিল নগদায়ন হবে ও আমদানিকারকদের কাছে কত দামে বিক্রি করবে, তা-ও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। তাতে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি আর হবে না। একই সঙ্গে কাঁচামাল আমদানিতেও আমরা মার খেয়ে যাব। এই জায়গায় বাংলাদেশ ব্যাংককে সতর্ক হতে হবে। না হলে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা সম্ভব হবে না।
ডলারের দর বেঁধে দেওয়ার সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী। এটা বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত। ব্যাংকের সুদহারও নিজস্ব গতিতে চলতে দেওয়া উচিত। এখন কথা হচ্ছে, পার্শ্ববর্তী দেশের তুলনায় আমাদের দেশে সুদের হার বেশি হচ্ছে কেন? কারণ, ব্যাংকিং খাতে তো শৃঙ্খলা নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের যে তদারকি ব্যবস্থা, তা দিয়ে তাদের একার পক্ষে এতগুলো ব্যাংক ও শাখা তদারকি করা সম্ভব নয়। সরকারি ব্যাংকগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। অর্থ মন্ত্রণালয় সেই কাজ করে। সরকারি ব্যাংক ভর্তুকি দিয়ে চালাতে হবে কেন? এ জন্য ব্যাংক খাতের সংস্কারটা খুবই জরুরি। আগামী বাজেটে এ-সংক্রান্ত একটা নীতিমালা থাকা দরকার।
সরকার ৬২ লাখ মানুষকে ৫ মাস ৩০ কেজি করে চাল দিচ্ছে। এ জন্য আগামী বাজেটে বরাদ্দ দ্বিগুণ করা দরকার, যাতে আরও বেশি লোককে সুরক্ষা দেওয়া যায়। পাশাপাশি নতুন কর্মসংস্থান তৈরিতে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। এ ছাড়া কর্মসংস্থান ধরে রাখতে বর্তমানে যেসব শিল্পকারখানা রয়েছে, সেগুলো যাতে ঝরে না যায়, সে ব্যবস্থাও বাজেটে থাকা উচিত।
ইশরাত জাহান চৌধুরী
বাংলাদেশের মোট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ৯৯ শতাংশ এসএমই খাতের। শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মোট কর্মসংস্থানের ৮৫ ভাগই এসএমই খাতের। তারপরও বাজেটে এসএমই খাতের জন্য সরাসরি কোনো বরাদ্দ থাকে না। আমাদের প্রতিবেশী কোনো কোনো দেশে এসএমই মন্ত্রণালয় আছে, আলাদা বিভাগ আছে। বাংলাদেশে এমন কিছুই নেই, একটি ফাউন্ডেশন ছাড়া। দেশের পুরো অর্থনীতিতে এসএমই খাতের অবদান এক–চতুর্থাংশ থেকে এক-তৃতীয়াংশ হবে। কিন্তু সে অর্থে সরকারের সুনির্দিষ্ট কোনো কর্মপরিকল্পনা নেই।
এসএমই নীতিমালার কিছু লক্ষ্য আছে। নীতিমালা প্রণয়নের তিন বছর হয়ে গেছে। এ তিন বছরে এসএমই নীতিমালা বাস্তবায়নের উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি নেই। একটি এসএমই ব্যাংক হওয়ার কথা ছিল। দক্ষতা উন্নয়ন, পণ্যের বাজারজাতকরণ, দেশের বাইরে পণ্যের রপ্তানি বাড়ানোর মতো নানা কার্যক্রমের কথা নীতিমালায় বলা আছে। কিন্তু সেগুলোর উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি নেই।
একজন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা সবকিছু একাই সামলান। কারণ, বেশির ভাগ উদ্যোক্তা যখন কাজ শুরু করেন, তখন তাঁর হাতে পর্যাপ্ত মূলধন থাকে না। এমনকি দেশে এমন কোনো ডেস্কও নেই, যেখানে একজন নবীন উদ্যোক্তা সব ধরনের সুবিধা পাবেন। ব্যবসার সব নিবন্ধনপ্রক্রিয়া ওয়ান–স্টপ সার্ভিসে করতে হবে। যেখানে একজন উদ্যোক্তা তার প্রয়োজনীয় সব নিবন্ধনের জন্য আবেদন করতে পারবেন।
বিপ্লব ঘোষ
আমরা দ্বিতীয় প্রজন্মের উদ্যোক্তা। আমাদের ৪০০ উদ্যোক্তার একটি গ্রুপ রয়েছে। এদের মধ্যে ৭৮ শতাংশ উদ্যোক্তাই ডিজিটাল ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। আমি ২০১৩ সালে দুটি সাইকেল নিয়ে যাত্রা শুরু করেছি। এখন আমার ২ হাজার ২০০ সাইকেল বা রাইডার আছে। আমি ৬৪ জেলায় হোম ডেলিভারি করে থাকি।
সরকারের নীতিমালা প্রণয়ন করার ক্ষেত্রে বিদ্যমান প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়িক কাঠামোকে চিন্তা করা হয়। এ ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের কথা তেমন মাথায় রাখা হয় না। ফলে উদ্যোক্তাদের জন্য কোনো নীতিমালা হয়নি। অবকাঠামোর ক্ষেত্রে উদ্যোক্তারা কোনো ধরনের সহায়তা পান না। বর্তমানে ব্যবসার কাঠামোর সঙ্গে চার বছর আগের ব্যবসা–কাঠামোর অনেক ফারাক আছে। করোনায় এ পার্থক্য আরও বেশি করে দৃশ্যমান হয়েছে। করোনায় অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ই-কমার্সে ঝুঁকেছে। কারণ, করোনায় একমাত্র হোম ডেলিভারি সেবাই চালু ছিল, হোক তা খাদ্য, ওষুধ কিংবা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য।
একজন উদ্যোক্তা যখন ব্যবসা শুরু করেন, তিনি তখন দেশি বাজারের কথা চিন্তা করেন। তাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হলো কর। গত তিন বছর আমরা অনেক বলেছি, এনবিআরের সঙ্গে বসার চেষ্টা করেছি। কিন্তু সফল হইনি। আমাদের মতো উদ্যোক্তাদের একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত করছাড় দিতে হবে।
বিনায়ক সেন
কৃষি, রপ্তানি, প্রবাসী আয় ও শিল্প খাত—এ চারটি হচ্ছে আমাদের অর্থনীতির মূল চালক। আমি সুনির্দিষ্টভাবে শিল্প খাতকে চালক বলতে চাই। ১৯৯০ থেকে ২০২০ সাল—এ সময়ে দেশের জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান ১০ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০ শতাংশ হয়েছে। ভারতে শিল্প খাতের জিডিপি কমেছে, পাকিস্তানে কমেছে। আমাদের শিল্প খাতের সফলতার বড় অংশ আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। আমরা কৃষিতেও ভালো করছি। বোরোর উৎপাদন ভালো হবে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। রপ্তানির ক্রয়াদেশও আসছে প্রচুর। তবে প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে আমাদের দুর্বলতা আছে। চারটি চালিকা শক্তির একটিও যদি দুর্বল হয়, তাহলে সামগ্রিকভাবে লেনদেন ভারসাম্যে প্রভাব পড়বে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে বেকারত্ব।
২০১৯ সালে ঢাকা শহরের একটা প্যানেল তথ্য ছিল। সাড়ে তিন হাজারের গৃহস্থালিকেন্দ্রিক লাইন সার্ভে ছিল। সেটি আমরা এই ফেব্রুয়ারি-মার্চে আবারও জরিপ করেছি। আমরা দেখতে চেয়েছিলাম নতুন দরিদ্র কত, অস্থায়ী দরিদ্র কত—এসব। আমরা দেখেছি, ২০২১ সালের প্রথম চতুর্থাংশে এরা ক্ষতি পুষিয়ে নিয়েছে। সুতরাং ৪০ শতাংশ দারিদ্র্য বেড়ে গেছে যেটা বলা হচ্ছে, এটি ঠিক নয়।
আমাদের দেশের আর্থিক খাতে কোনো সংস্কার হচ্ছে না। রাজস্ব খাতের সংস্কারের চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আর্থিক খাতের সংস্কার।
মুদ্রাবাজারে বাংলাদেশ ব্যাংক বিচক্ষণতার সঙ্গে হস্তক্ষেপ করছে। ফলে আমদানির প্রবৃদ্ধি কমেছে, চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর, ২০২১) যা ছিল ৬০ শতাংশ, তৃতীয় প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) তা কমে দাঁড়িয়েছে ২৮ শতাংশ। এই সময়ে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ৪৪-৪৭ শতাংশের মধ্যে স্থিতিশীল ছিল। এতে বাণিজ্য ঘাটতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে, চলতি হিসাবের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
প্রবাসী আয় এখনো নেতিবাচক ধারায় আছে, তবে হ্রাসের হার কমছে—দ্বিতীয় প্রান্তিকে যা ছিল ২৩ শতাংশ ঋণাত্মক, তৃতীয় প্রান্তিকে তা নেমে এসেছে ১০ দশমিক ৫ শতাংশে। চলতি হিসাবেও এর ইতিবাচক প্রভাব দেখা যাবে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মধ্যমেয়াদি সম্ভাবনা মন্দ নয়। বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ দেখে বিষয়টি বোঝা যায়, ২০২১ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে বেসরকারি ঋণপ্রবাহের হার ছিল ৮ দশমিক ৭ শতাংশ, যা একই বছরের অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে ছিল ১০ দশমিক ৭ শতাংশ। চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে এটি ১১ দশমিক ৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। আমি জেনেছি, ২০২২ সালের এপ্রিল মাস শেষে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ৫ শতাংশ। এই পরিসংখ্যান থেকে চলতি মূল্যে জিডিপি প্রবৃদ্ধির ধারণা পাওয়া যায়। এই সময়ে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬ থেকে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। তাতে ২০২১-২২ অর্থবছরে জিডিপির প্রকৃত প্রবৃদ্ধির হার ৬ থেকে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ ধরে নেওয়া যায়।
সংক্ষেপে আমার বক্তব্য হলো, অর্থনীতির মধ্যমেয়াদি স্বাস্থ্য নিয়ে আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। দ্বিতীয়ত আমি বলতে চাই, মূল্যস্ফীতির হার ১০-১৫ শতাংশে উঠেছে—এই দাবির কোনো ভিত্তি নেই। আবার দারিদ্র্যের হার ৪০ শতাংশে উঠেছে এবং দুই বছর ধরে তা সেখানেই আছে, এই দাবিরও কোনো ভিত্তি নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংক ২০০৩ সাল থেকে টাকার বিনিময় হার একরকম বাজারের সাপেক্ষেই নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। তারা এখন ধারাবাহিকভাবে বাজারভিত্তিক বিনিময় হারের দিকে এগোচ্ছে। বিনিময় হার রাতারাতি বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া যায় না। এতে বাজার ধাক্কা খাবে, ভীতি তৈরি হবে।
শওকত হোসেন
আজকের গোলটেবিল আলোচনায় অংশ নেওয়ার জন্য আপনাদের প্রথম আলোর পক্ষ থেকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
সুপারিশ
জরুরি ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
বাজেটে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষায় অনেকগুলো মেগা প্রকল্প দেখতে চাই।
ডলারের সঠিক বিনিময় হার নির্ধারণ করা জরুরি।
বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যাংকের সুদের হারে সমন্বয় করা অবশ্যই জরুরি।
গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির মূল্য বাড়ানো যাবে না।
পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে।
নীতিমালা প্রণয়নের ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত।
বর্তমানে ইন্টারনেট সেবাকে মৌলিক চাহিদা হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।
একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের কর ছাড় দেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
গত ১০ বছরে আর্থিক খাতের কোনো সংস্কারই হয়নি। আর্থিক খাতের সংস্কার অত্যন্ত জরুরি।