জনগণকে সম্পৃক্ত করে জনসচেতনতা ও প্রচার বাড়ালে বাল্যবিবাহ উল্লেখযোগ্য হারে কমে। বাল্যবিবাহকে অগ্রাধিকার দিয়ে বাজেটে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। বাল্যবিবাহ পরিস্থিতি বুঝতে জাতীয় ডেটাবেইস তৈরির বিকল্প নেই। গতকাল বুধবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ের সেমিনার কক্ষে আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে এসব কথা বলেন বক্তারা। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সরকারি-বেসরকারিভাবে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন তাঁরা।

‘বাল্যবিবাহ শিশু অধিকারের লঙ্ঘন, প্রতিরোধ ও সম্মুখযাত্রা’ শিরোনামে গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে যৌথভাবে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ, ঢাকার সুইডেন দূতাবাস এবং আরডিআরএস।

উন্নয়ন সংস্থা প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের সহায়তায় আরডিআরএস বাংলাদেশ মেয়েদের জন্য আরও ভালো ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে ‘বিল্ডিং বেটার ফিউচার ফর গার্লস’ প্রকল্পের আওতায় কুড়িগ্রাম জেলার ৯টি উপজেলা, ৭৩টি ইউনিয়ন পরিষদ, ৩টি পৌরসভায় একটি মডেল নিয়ে কাজ করে। গোলটেবিল বৈঠকে মডেলটি উপস্থাপন করে ওই প্রকল্পের ব্যবস্থাপক মো. নজরুল ইসলাম চৌধুরী জানান, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কমিটির মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা, আইন প্রয়োগ ও বিয়ের ডেটাবেইস করা, বাল্যবিবাহের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি যেমন কাজি, মা-বাবা এবং বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে থাকা মেয়েদের আত্মবিশ্বাসী হতে সচেতনতা সৃষ্টি করা এবং যুব ও কিশোরীদের সম্পৃক্ত করতে তাদের মধ্যে নেটওয়ার্ক গঠন এবং স্কুলে স্কুলে সচেতনতামূলক কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে বাল্যবিবাহ রোধে একটি কার্যকর মডেল তৈরি করা যায়। এই মডেলে ২০১৭ থেকে ২০১৯ সালে কুড়িগ্রাম জেলায় ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ের হার ২ বছরে ২২ শতাংশ কমানো গেছে। প্রতি মাসে বাল্যবিবাহের তথ্য সংগ্রহে দেখা গেছে, ২০১৯ সালে মাসে গড়ে ৯৪টি, ২০২০ সালে ৩৬টি এবং ২০২১ সালে ৩১টি বাল্যবিবাহ হয়েছে। জেলাটিতে ১২ হাজারের মতো মেয়ে বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে রয়েছে। এর মধ্যে সাড়ে তিন হাজার মেয়ে অতিঝুঁকিতে।

বৈঠকে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মেহের আফরোজ বলেন, বাল্যবিবাহ বন্ধে সরকারের শতভাগ সদিচ্ছা আছে এবং এ লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপও নেওয়া হচ্ছে। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সচেতনতা সৃষ্টিতে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ যার যার জায়গা থেকে সচেতনতা বাড়াতে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। গণমাধ্যমকেও এগিয়ে আসতে হবে। তিনি বলেন, শুধু মেয়েদের নয়, ছেলেদেরও বাল্যবিবাহকে ‘না’ বলতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন সাদেকা হালিম বলেন, দেশে এখনো ৫১ শতাংশ বাল্যবিবাহ হচ্ছে। সমাজে এমন একটি অবস্থা তৈরি হয়েছে যে মেয়েকে কম বয়সে বিয়ে দিতে উঠেপড়ে লাগেন মা-বাবা। আইনি নমনীয়তার কারণে একদিকে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ হচ্ছে না, অন্যদিকে বাল্যবিবাহের মাধ্যমে মেয়েটিকে আরও প্রান্তিক ও ক্ষমতাহীন করা হচ্ছে।

সুইডেন দূতাবাসের সেকেন্ড সেক্রেটারি এবং গণতন্ত্র ও জেন্ডার সমতাবিষয়ক (মানবাধিকার) কর্মসূচি বিশেষজ্ঞ পাওলা কাস্ট্রো নেইদারস্টাম মেয়েদের ক্ষমতায়নের ওপর জোর দিয়ে বলেন, বাল্যবিবাহ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ১৬টি লক্ষ্য পূরণের পথেই বাধা সৃষ্টি করে।

ছেলেশিশুদের বিয়ে প্রতিরোধ করার ওপরও জোর দিতে হবে বলে জানান শিশুসহায়ক জাতীয় হেল্পলাইন ১০৯৮-এর প্রকল্প ব্যবস্থাপক চৌধুরী মোহাম্মদ মোহাইমেন।

প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের পরিচালক (গার্লস রাইটস) কাশফিয়া ফিরোজ জানান, তাঁর সংস্থা পরিচালিত একটি সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, পরিবারের সুনাম হারানোর ভয়, কিশোরী মেয়েকে বাসায় একা রেখে যাওয়ার ভয়, যৌন হয়রানি-ধর্ষণের ভয়—এমন নানা শঙ্কা থেকে বাল্যবিবাহের মতো ঘটনা ঘটছে। পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মোখলেসুর রহমান বাল্যবিবাহ প্রতিরোধকে অগ্রাধিকার দিয়ে মেয়েদের ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত বৃত্তি দেওয়ার প্রস্তাব করেন।

আরডিআরএসের নির্বাহী পরিচালক তপন কুমার কর্মকার বলেন, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে জনসম্পৃক্ততা আনা গেলে কোনো প্রকল্প শেষ হয়ে গেলেও এলাকায় সচেতনতা রয়ে যায়। তাঁদের মডেল প্রকল্পটি সেই রকম জনসচেতনতা তৈরি করতে পেরেছে।

জিটিভির প্রধান সম্পাদক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বলেন, বাল্যবিবাহের পক্ষে ডিজিটাল মাধ্যমে একটি চক্র যেভাবে প্রচার চালায়, তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রকে সক্রিয় হতে হবে।

ঢাকা জেলার বাংলাদেশ মুসলিম নিকাহ রেজিস্ট্রার সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহেদ বলেন, কোভিড-১৯ টিকা নেওয়ার জন্য যেভাবে সুরক্ষা অ্যাপে নিবন্ধন করতে হয়, সেভাবে বাল্যবিবাহ ঠেকাতে বিয়ের আগে পাত্র-পাত্রী যেন বাধ্যতামূলকভাবে জন্মনিবন্ধন, পাসপোর্ট বা জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর ব্যবহার করে নিবন্ধন করতে পারে, তেমন অ্যাপ করা দরকার। ফরমটি পূরণ করে আনলেই কাজিরা বয়স দেখে বিয়ে করাবেন।

বৈঠকে আরও অংশ নেন ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক মনিরা নাজমী জাহান, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী তানজিলা তাসনিম, ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র সরদার আকিব লতিফ প্রমুখ।