মৎস্যজীবীদের উন্নয়নে নজর দিতে হবে

বিশ্বে ইলিশ আহরণকারী ১১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ শীর্ষে। ২৪ লাখের বেশি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এ খাতের সঙ্গে জড়িত।

বাংলাদেশে ইলিশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব রয়েছে। উপকূলীয় মৎস্যজীবীদের জীবিকার প্রধান উৎস হচ্ছে ইলিশ। শুধু ইলিশ নয়, সাগরকেন্দ্রিক অর্থনীতির উন্নয়নে অন্যান্য মাছের দিকেও নজর দিতে হবে। নজর দিতে হবে মৎস্যজীবী মানুষগুলোর জীবনমান উন্নয়নেও।

গতকাল রোববার ওয়ার্ল্ডফিশ বাংলাদেশ ও প্রথম আলো আয়োজিত ‘ইলিশ, সাগরকেন্দ্রিক অর্থনীতি ও জেলেদের জীবিকা’ শীর্ষক ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা এসব কথা বলেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা ইউএসএআইডির সহায়তায় এ গোলটেবিল বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়।

গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা বলেন, বিশ্বে ইলিশ আহরণকারী ১১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এখন শীর্ষে। প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ ইলিশ আহরণে সরাসরি জড়িত। ২৪ লাখের বেশি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ইলিশ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত।

আলোচনায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব তৌফিকুল আরিফ বলেন, ইলিশ উৎপাদন একটি নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ইলিশের উৎপাদন প্রতিনিয়ত না-ও বাড়তে পারে। এ বিষয়কেও আমলে নিতে হবে। তাই ইলিশের পাশাপাশি সমুদ্রের অন্যান্য মাছ ও সম্পদের দিকেও নজর বাড়াতে হবে। সব সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে। গভীর সমুদ্রে মৎস্য আহরণে ব্যক্তিগত ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগে এগিয়ে আসছে না। এ ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

তৌফিকুল আরিফ জানান, মাছ ধরা যখন নিষিদ্ধ থাকে, তখন সামাজিক নিরাপত্তা খাতের আওতায় জেলেদের খাদ্যসহায়তা দেওয়া হচ্ছে। সমুদ্রগামী জেলেদের দাদন ব্যবসা থেকে বের করে আনার জন্য সরকার ভাবছে। নারীরা জেলে হিসেবে রেজিস্ট্রেশন করতে পারছেন না, অনেক ক্ষেত্রে নারীর পরিবারও এতে আগ্রহী নয়। তবে নারীদের সহায়ক শক্তি হিসেবে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। জেলেদের সারা জীবন যাতে একটি পেশায় আটকে থাকতে না হয়, সে জন্য সরকার বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে।

আলোচকেরা জানান, ইউএসএআইডির সহায়তায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ইলিশ রক্ষায় নেওয়া জাতীয় প্রকল্প ‘ইকোফিশ-বাংলাদেশ’ প্রকল্পের আওতায় ইলিশ মাছের উৎপাদন বাড়াতে বৈজ্ঞানিক গবেষণা, মাছের আবাস ও প্রজননের স্থান রক্ষা, জাটকা ও মা মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা চলাকালে মৎস্যজীবীদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করাসহ বিভিন্ন সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।

আলোচনায় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক সদস্য আবদুস সাত্তার মণ্ডল বলেন, সাগরকেন্দ্রিক অর্থনীতি, জীবিকায়ন প্রভৃতি বিষয়ে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন ফোরামে বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা হচ্ছে। এসব নিয়ে সরকারের উন্নয়ন দলিলে অনেক ভালো ভালো কথা বলা আছে, অগ্রাধিকার নির্ধারণ করে সামনের দিকে অগ্রসর হতে হবে।

সাগরকেন্দ্রিক অর্থনীতিতে কৌশলগত অবস্থানের দিক থেকে বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে আছে এবং এটি একটি সম্ভাবনাময় খাত বলে উল্লেখ করে আবদুস সাত্তার মণ্ডল বলেন, আগামী ৫ থেকে ১০ বছরে এ খাতে অর্জনের ‘নীলনকশা’ প্রণয়ন জরুরি। আর জেলেদের শুধু জেলে পেশায় আবদ্ধ না রেখে ইলিশকেন্দ্রিক ব্যবসায় যুক্ত করতে হবে।

মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা সেলে ইলিশ নিয়ে স্বতন্ত্র একটি ইউনিট চালু করা, জাতীয় ইলিশ পদক প্রবর্তন, রপ্তানি বাজারে প্রক্রিয়াজাত ইলিশের বাজার ধরা এবং ইলিশ খেতে হলে একটু বাড়তি দাম দিতেই হবে—এ জন্য মনোজগৎ তৈরিরও সুপারিশ করেন তিনি।

ওয়ার্ল্ড ফিশ বাংলাদেশের টিম লিডার (ইকোফিশ-২) এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক মো. আবদুল ওহাব বলেন, দেশে বর্তমানে ২২ দিনের মা ইলিশ রক্ষা কার্যক্রম চলছে। ব্লু ইকোনমি মানেই হচ্ছে সাগর পানে চাও। ইলিশের উৎপাদন দ্বিগুণ হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশের মানুষই ইলিশ রক্ষা করছে। তিনি অন্যান্য সামুদ্রিক মাছের দিকে নজর বাড়ানোরও আহ্বান জানান।

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম মৎস্যজীবী পরিবারে, বিশেষ করে ছোট নৌকা দিয়ে মাছ ধরা জেলেদের পরিবারে নারীর প্রান্তিক অবস্থান তুলে ধরেন। তিনি বলেন, এই পরিবারের সদস্যরা স্বাস্থ্য-শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। এই পরিবারগুলোতে নারীরা সহযোগী হিসেবে কাজ করলেও তাঁদের কাজ দৃশ্যমান হয় না এবং এর জন্য কোনো মূল্যও পান না। তাই নারীদের বিষয়টি আলাদাভাবে গুরুত্ব দিয়ে মূল্যায়ন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, নারীরা মৎস্য খাতে সহায়তা না করলে এর ব্যবস্থাপনা এত সহজ হতো না।

ইউএসএআইডি বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক (পরিবেশ ও এন্টারপ্রাইজ) কিথ মেজনা জানান, ইউএসএআইডি ১৯৭১ সাল থেকে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কাজ করছে। বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করছে। ১৯৯৮ সাল থেকে বন, জলাশয় ও নদ-নদী সংরক্ষণে বাংলাদেশ সরকারকে সহযোগিতা করছে। ইলিশ রক্ষা বা ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ বিশ্বে ভালো অবস্থানে আছে।

মৎস্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক সৈয়দ আরিফ আজাদ বলেন, দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনে ইলিশের অবদান সর্বোচ্চ (প্রায় ১১ ভাগ) এবং মোট জিডিপিতে অবদান ১ শতাংশ। ইলিশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আছে। মিয়ানমার, আরব সাগরসহ বিভিন্ন জায়গায় বিচরণ ইলিশের। ইলিশ রক্ষার আঞ্চলিক উদ্যোগেও বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তবে এসব অর্জন ধরে রাখতে হবে। মাছ ধরা নিষিদ্ধের সময় ৪ লাখ মানুষ মাসিক ৪০ কেজি করে খাদ্যসহায়তা পাচ্ছেন, এটিও একটি অনন্য নজির।

ইউএসএআইডি বাংলাদেশের প্রজেক্ট ম্যানেজার স্পেশালিস্ট (এনভায়রনমেন্ট অফিস অব ইকোনমিক গ্রোথ) আশরাফুল হক বলেন, ইউএসএআইডির সহায়তায় ইলিশ ব্যবস্থাপনায় সরকারকে সহায়তা করা হচ্ছে। কমিউনিটি পর্যায়ে এ ব্যবস্থাপনায় নেতৃত্ব দিচ্ছে জেলে সম্প্রদায়। বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জেলে ও কমিউনিটির মানুষ ইকোসিস্টেম রক্ষায় ভূমিকা রাখছেন। নারীদের ব্যবসাসংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণের পাশাপাশি আর্থিক সহায়তা করা হচ্ছে, যাতে তাঁরা বিকল্প কর্মসংস্থানে ভূমিকা রাখতে পারেন। তিনি যেকোনো পরিকল্পনায় জেলেদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার বিষয়টিতে গুরুত্ব দেন।

গোলটেবিল বৈঠকে স্বাগত বক্তব্য দেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।