সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মেদ, মাহীন সুলতান, ওয়াজেদুল ইসলাম খান, খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম

শ্রমিকদের জন্য আইনি কাঠামোতে সুরক্ষাব্যবস্থা থাকলেও করোনাকালে তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা যায়নি। এ কারণে শ্রমিকেরা নানাভাবে বঞ্চনার শিকার হয়েছেন। শ্রমিকের অধিকার সুরক্ষায় শ্রম আদালতের সংখ্যা বৃদ্ধি, যোগ্য বিচারক নিয়োগ, আইনবিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধি, শ্রমিকের তথ্যভান্ডার করা ও অবাধ ট্রেড ইউনিয়নের সুযোগ দিতে হবে। এ ছাড়া সবক্ষেত্রে জবাবদিহি নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিতে হবে।

‘করোনাকালে শ্রমিকের আইনি সুরক্ষা ও করণীয়’ শীর্ষক ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন। সজাগ কোয়ালিশনের পক্ষে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) ও প্রথম আলো যৌথভাবে গোলটেবিল বৈঠকটি আয়োজন করে। ব্লাস্ট, ক্রিশ্চিয়ান এইড ও নারীপক্ষর একটি মিলিত উদ্যোগ হচ্ছে সজাগ কোয়ালিশন। আলোচনাটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।

মূল প্রবন্ধে ব্লাস্টের উপদেষ্টা মো. রাকিনুল হাকিম বলেন, ব্লাস্টে ১২৩ জন শ্রমিকের অভিযোগের ভিত্তিতে একটি গবেষণা করা হয়েছে। করোনাকালে তাঁরা ছাঁটাইয়ের শিকার হলেও বকেয়া পাওনা ও ক্ষতিপূরণ পাননি। এমনকি চাকরিচ্যুতির ৩০ দিন আগে নোটিশ দেওয়ার কথা থাকলেও সেটি করা হয়নি। তিনি আরও বলেন, সারা দেশে ১০টি শ্রম আদালত আছে। তবে শ্রমিকেরা যে আদালতে যাবেন, করোনাকালে সেটিও সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, অন্য আদালতে মামলা ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে শুনানির ব্যবস্থা থাকলেও শ্রম আদালতে সেই ব্যবস্থা করা হয়নি।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, করোনার প্রথম ধাক্কার সময় চার মাসের মজুরি দিতে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে সরকার। শর্ত ছিল, শ্রমিক ছাঁটাই করা যাবে না। স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। তবে প্রণোদনা তহবিল থেকে ঋণ পাওয়া এক-তৃতীয়াংশ কারখানা শ্রমিক ছাঁটাই করেছে। তার বাইরেও প্রচুর শ্রমিক ছাঁটাইয়ের শিকার হয়েছেন। সব মিলিয়ে প্রায় সাড়ে তিন লাখ শ্রমিক ছাঁটাইয়ের শিকার হয়েছেন। ছাঁটাইকালে আইনি সুরক্ষার বিষয়গুলোও সেভাবে পরিপালিত হয়নি।

নিজেদের গবেষণার কথা উল্লেখ করে সিপিডির এই গবেষক বলেন, ছাঁটাই হওয়া শ্রমিকদের ৪২ শতাংশ পূর্ণ মজুরি পেয়েছে। ৩৬ শতাংশ পেয়েছে আংশিক মজুরি। প্রণোদনা তহবিল থেকে ঋণ পাওয়া কারখানাগুলোর ছাঁটাই হওয়া শ্রমিকদের পাওনা কত, সেটি হিসাব হওয়া দরকার। তারপর ধাপে ধাপে তা পরিশোধের ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনে কাজ হারানো শ্রমিকদের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) ও জার্মান সরকারের দেওয়া ১ হাজার ১৩৫ কোটি টাকার তহবিল থেকেও সেই অর্থ দেওয়া যেতে পারে।

শ্রম বিশেষজ্ঞ সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, ‘আমাদের এমন ব্যবস্থা করা দরকার, যাতে জবাবদিহি নিশ্চিত করা যায়। কারণ, কারখানা খোলা থাকলেও শ্রম আদালত বন্ধ। আবার শ্রমিকেরা একদিকে না খেয়ে থাকলেও অন্যদিকে শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন তহবিলে কোটি কোটি টাকা পড়ে আছে। কীভাবে এই অর্থ খরচ হচ্ছে, সেটি নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলছে না।’

সজাগ কোয়ালিশনের পক্ষে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) ও প্রথম আলো যৌথভাবে গোলটেবিল বৈঠকটি আয়োজন করে। ব্লাস্ট, ক্রিশ্চিয়ান এইড ও নারীপক্ষর একটি মিলিত উদ্যোগ হচ্ছে সজাগ কোয়ালিশন

সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের সভাপতি রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, ‘করোনাকালে দেশের শ্রমিকেরা কীভাবে বেঁচে ছিল, সেটি আমরা খুব বেশি জানি না। সরকার মহামারিতে বিপদে থাকা ৫০ লাখ শ্রমজীবী মানুষকে আড়াই হাজার টাকা করে অর্থসহায়তা দেওয়ার পরিকল্পনা করলেও ৩৪ লাখের পর দেওয়া যায়নি। কারণ, তালিকা ও ব্যবস্থাপনার অভাব। তার মানে করোনা আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে, শ্রমিকদের একটি তথ্যভান্ডার থাকা দরকার। তা ছাড়া একটি দুর্যোগ মোকাবিলার তহবিল থাকা দরকার।’

বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সেন্টারের সাধারণ সম্পাদক ওয়াজেদুল ইসলাম খান বলেন, করোনাকালের শিক্ষা হচ্ছে, শ্রমজীবী সবাইকে সংঘবদ্ধ হতে হবে। না হলে কখনোই শ্রমিকদের অধিকার আদায় করা যাবে না। তিনি বলেন, কোম্পানির মুনাফার একটি অংশ সরকারের শ্রমিক কল্যাণ তহবিলে যাবে। মুনাফার আরেকটি অংশ দিয়ে মালিককে কল্যাণ তহবিল করতে হবে। সেই তহবিলের টাকা কীভাবে ব্যয় হবে, সেটি শ্রমিককে জানানোর ব্যবস্থা থাকতে হবে। কোনো কারখানার মালিক আইনের ঊর্ধ্বে নন, সেটি সরকারকে নিশ্চিত করা প্রয়োজন। পরিদর্শনের মাধ্যমে শ্রম আইনের বাস্তবায়নে ব্যবস্থা নিতে হবে।

ব্লাস্টের উপপরিচালক (আইন) মো. বরকত আলী বলেন, যেসব শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন করতে যাচ্ছেন, তাঁদের চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে। অনেক নারী শ্রমিক হয়রানির শিকারও হচ্ছেন। অবশ্য অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন করার সুযোগ দিলে এসব বন্ধ হবে।

শ্রম আদালতের প্যানেল আইনজীবী শারমিন সুলতানা বলেন, ‘শ্রম আদালত দুই বছর ধরে অচল অবস্থায় পড়ে আছে। শ্রমিকদের মামলা যেখানে ছিল, সেখানেই পড়ে আছে। এটি আমাদের ব্যর্থতা। দুর্যোগকালে ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে আদালত পরিচালনার সুযোগ থাকা দরকার।’ তিনি বলেন, অনেক সময় সাদা কাগজে সই রেখে শ্রমিকদের চাকরিচ্যুতি করা হয়। যদি শ্রমিকেরা সঙ্গে সঙ্গে তা থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন, তাহলে পরে তা মামলায় গুরুত্বপূর্ণ নথি হিসেবে কাজে দেয়।

খ্রিস্টিয়ান এইডের প্রোগ্রাম ম্যানেজার (জেন্ডার অ্যান্ড ইনক্লুশন) ফারহানা আফরোজ বলেন, ২০১৭ সালে নারীপক্ষ, ব্লাস্ট ও খ্রিস্টিয়ান এইডের সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠিত সজাগ কোয়ালিশন নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করছে। তা ছাড়া করোনায় সরকারের ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ শ্রমিকের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলেছে, সেটি নিয়েও গবেষণা করছে সজাগ কোয়ালিশন।

আলোচনায় স্বাগত বক্তব্যে প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম বলেন, ‘শ্রমিকেরা কাজ করার জন্য পাগল। জীবন দিয়েও তাঁরা কাজ করতে চান। তারপরও অনেক কারখানা নিয়মনীতি তোয়াক্কা না করেই শ্রমিক ছাঁটাই করে। মাতৃত্বকালীন সুবিধা নিয়েও ঝামেলা করে। মজুরিও অনেক সময় কারখানাগুলো বকেয়া রাখে। তিনি বলেন, ট্রেড ইউনিয়নগুলো যদি গঠনমূলকভাবে কাজ করে, তাহলে শ্রমিকেরা উপকৃত হবেন। শ্রমিকেরা উপকৃত হলে কারখানাও সুবিধা পায়। যদিও বিষয়টি আমরা অনেক সময় বুঝতে চাই না।’

সবশেষে সজাগ কোয়ালিশনের টিম লিডার মাহীন সুলতান বলেন, ‘করোনা মহামারি কবে শেষ হবে, আমরা জানি না। এ জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। তাই আজকের আলোচনার প্রস্তাবগুলো সরকার ও অন্যদের কাছে আমরা নিয়ে যাব। তা ছাড়া শ্রম আইন সংশোধনের সুযোগ আছে। সেখানেও প্রস্তাবগুলো দেওয়া হবে।’