দেশে অসংক্রামক রোগের মধ্যে হৃদ্‌রোগে আক্রান্তের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এ রোগের আধুনিক চিকিৎসা এখন দেশেই হচ্ছে। তবে এই চিকিৎসাব্যবস্থাকে একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া জরুরি। একই সঙ্গে প্রয়োজন হৃদ্‌রোগ ব্যবস্থাপনায় জাতীয়ভাবে কর্মকৌশল তৈরি করা।

বিশ্ব হার্ট দিবস উপলক্ষে হৃদ্‌রোগ বিশেষজ্ঞ এবং অংশীজনদের নিয়ে গোলটেবিল আলোচনায় এসব বিষয় উঠে এসেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয়ে বাংলাদেশ কার্ডিওভাসকুলার রিসার্চ ফাউন্ডেশন, এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড ও প্রথম আলোর আয়োজনে এ গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

২৯ সেপ্টেম্বর বিশ্ব হার্ট দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘হৃদয় দিয়ে হৃদ্‌যন্ত্রের যত্ন নিন’। গোলটেবিলের বিষয়বস্তুও ছিল একই। অনুষ্ঠানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলেছেন, হৃদ্‌রোগে সুস্থ থাকা সম্ভব, তবে এর জন্য প্রয়োজন সচেতনতা।

ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও জাতীয় অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুল মালিক গোলটেবিল বৈঠকে বলেন, দেশে হৃদ্‌রোগের উন্নত চিকিৎসাসহ অনেক ব্যবস্থাই হয়েছে। কিন্তু চাহিদার তুলনায় তা এখনো কম। হৃদ্‌রোগ ব্যবস্থাপনার জন্য দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হবে। রোগটি সম্পর্কে শুধু জানলেই হবে না। প্রতিরোধ করার জন্য আগে থেকেই নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের অভ্যাস করতে হবে।

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) কার্ডিওলজি বিভাগের ইউনিট প্রধান ও বাংলাদেশ কার্ডিওভাসকুলার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সভাপতি এম এম মোস্তফা জামান।

মোস্তফা জামান বলেন, প্রতিবছর বিশ্বে হৃদ্‌রোগের অসুখে ১ কোটি ৭৯ লাখ মানুষ মারা যায়। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, রক্তে চর্বি হওয়া, তামাক ও ধূমপান, স্থূলতা, কায়িক পরিশ্রমহীনতা, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এবং বংশগত কারণে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে। বাংলাদেশে অল্প বয়সে হৃদ্‌রোগ আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। দেশে অসংক্রামক রোগের মধ্যে হৃদ্‌রোগ ৩৬ দশমিক ১ শতাংশ। হৃদ্‌রোগীদের মধ্যে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি। এ ছাড়া হৃদ্‌রোগের আধুনিক চিকিৎসা–সুবিধা সব শহরকেন্দ্রিক।

হৃদ্‌রোগ নিয়ে জাতীয় কর্মকৌশল নেই উল্লেখ করে মোস্তফা জামান বলেন, জরুরি স্বাস্থ্যসেবা হিসেবে হৃদ্‌রোগ কর্মকৌশল নির্ধারণ করতে হবে। জনগণকে স্বাস্থ্যবিমার আওতায় আনারও পরামর্শ দেন তিনি।

গোলটেবিল অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও পরিচালক (অসংক্রামক রোগনিয়ন্ত্রণ বিভাগ) রোবেদ আমিন জানান, প্রতিবছর দেশে অসংক্রামক রোগে ১ লাখ ১২ হাজার মানুষ মারা যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৪০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয় হৃদ্‌রোগজনিত রোগে। হৃদ্‌রোগ নিয়ে জাতীয় পরিকল্পনা তৈরিতে সরকারকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও সহযোগিতা দিতে এ রোগ নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠনের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

বাংলাদেশ কার্ডিয়াক সোসাইটির মহাসচিব আবদুল্লাহ আল সাফি মজুমদার বলেন, শুধু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বাড়ালেই হবে না। দক্ষ নার্স, টেকনিশিয়ানও প্রয়োজন।

জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে প্রতিদিন শয্যাসংখ্যার চেয়ে বেশি মানুষ ভর্তি থাকে বলে জানান হাসপাতালটির পরিচালক অধ্যাপক মীর জামাল উদ্দিন। তিনি বলেন, এখানে আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। এমনকি শিশুদের হৃদ্‌রোগ নির্ণয়ের ব্যবস্থাও আছে। অসহায়দের জন্য বিনা মূল্যে এখানে চিকিৎসা দেওয়া হয়।

বছরে অন্তত একবার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে হৃদ্‌রোগের প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার বিষয়ে গুরুত্ব দেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান আবদুল ওয়াদুদ চৌধুরী।

বিএসএমএমইউর কার্ডিওলজি বিভাগের চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান বলেন, হৃদ্‌রোগ নিয়ে সচেতনতা শুধু মানুষের মধ্যেই নয়, সরকার ও নীতিনির্ধারকদের মধ্যেও থাকতে হবে। প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত মানুষকে সচেতন করতে হবে এবং চিকিৎসাসুবিধা পৌঁছাতে হবে।

সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিলে হৃদ্‌রোগ প্রতিরোধ করা যায় বলে জানান বিএসএমএমইউর কার্ডিওলজি বিভাগের অধ্যাপক সজল কে ব্যানার্জি।

গত ৩০ বছরে সারা বিশ্বে হৃদ্‌রোগের প্রকোপ বেড়েছে, কিন্তু মৃত্যু কমেছে বলে জানান ইউনাইটেড হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান এন এ এম মোমেনুজ্জামান। তিনি বলেন, চিকিৎসার আধুনিকায়নে মৃত্যু কমেছে। জেলা–উপজেলা পর্যায়ে অন্তত ইসিজি করার ব্যবস্থা এবং তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে ইসিজি প্রতিবেদন দ্রুত দেশের যেকোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে দেখানোর একটি ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা প্রয়োজন।

ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অধ্যাপক এম এ রশীদ বলেছেন, হৃদ্‌রোগের ৭০ থেকে ৮০ ভাগ প্রতিরোধযোগ্য। এ রোগ নিয়ে সচেতনতা তৈরিতে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে কাজে লাগানোর কথা বলেন তিনি।

নারীদের হৃদ্‌রোগ হওয়া নিয়ে মানুষের ধারণা কম বলে জানান ইউনাইটেড হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের সিনিয়র কনসালট্যান্ট ফাতেমা বেগম। তিনি বলেন, এর কারণ নারীদের হৃদ্‌রোগের লক্ষ্মণ ভিন্ন। যার কারণে অনেকে বুঝতে পারে না এবং সচেতনতাও কম। নারীদের চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার প্রবণতাও কম।

হৃদ্‌রোগ নিয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টির ওপর জোর দেন এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালসের নির্বাহী পরিচালক (বিপণন ও বিক্রয়) মোহাম্মদ মুজাহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, হৃদ্‌রোগ থেকে সুস্থ থাকার জন্য সুশৃঙ্খল জীবনযাপন প্রয়োজন।

এই গোলটেবিল বৈঠকের সঞ্চালক ছিলেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।

আলোচনায় বিএসএমএমইউর কার্ডিওলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক দিপল কৃষ্ণ অধিকারী বলেন, হৃদ্‌রোগ চিকিৎসা ব্যয়বহুল, তাই প্রতিরোধে জোর দেওয়া দরকার।

এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালসের নির্বাহী মহাব্যবস্থাপক (বিপণন) বিনয় দাস বলেন, দেশে মানসম্মত ওষুধ তৈরিসহ স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড আন্তরিকভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে।