
আবদুল্লাহ সাদের খোঁজ আমি প্রথম পাই একদিন ভোরবেলা, ঘুম ভাঙার পর। সিঙ্গাপুর চলচ্চিত্র উৎসবের পরিচালক ওয়েঞ্জি ঝাংগের মেসেজের মাধ্যমে। ওয়েঞ্জি উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন ওর ছবিটার। সিঙ্গাপুর চলচ্চিত্র উৎসবের প্রতিযোগিতায় নির্বাচিত হলো সাদের ছবি লাইভ ফ্রম ঢাকা। তখনো আমি সাদ সম্পর্কে কিছুই জানি না। কিন্তু আমি সিঙ্গাপুর উৎসবের মনোনয়ন সম্পর্কে জানি। ফলে আমি ধারণা করতে পারলাম, বাংলাদেশের ক্রম-অগ্রসরমাণ চলচ্চিত্রের মিছিলে আরেকটা সাহসী নাম যোগ হতে যাচ্ছে।
জন্ম ১৯৮৫, চট্টগ্রাম।
আবদুল্লাহ মোহাম্মাদ সাদের লাইভ ফ্রম ঢাকা সিনেমাটি কিনে নিয়েছে প্যারিসভিত্তিক আন্তর্জাতিক বিপণন সংস্থা ‘স্ট্রে ডগ’।
২০১৬ সালে সিঙ্গাপুর আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে লাইভ ফ্রম ঢাকার প্রিমিয়ার হয়। সেখানে সিলভার স্ক্রিন অ্যাওয়ার্ডে সেরা পরিচালক হিসেবে পুরস্কার পান। লাইভ ফ্রম ঢাকা ২০১৭ সালে অংশ নেয় পোল্যান্ড ও রটারডামের আরও দুটি চলচ্চিত্র উৎসবে।
আসলেই সাদ আমাদের চলচ্চিত্রের কাফেলায় এক সাহসী কবি। সিঙ্গাপুরে আমার ছবি এর আগে প্রতিযোগিতায় ছিল। সেই সূত্রে সেখানকার চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কারও কারও সঙ্গে আমার সামান্য যোগাযোগ ছিল। ছবিটার স্ক্রিনিংয়ের পর থেকেই সেখান থেকে খবর পেতে থাকলাম ছবিটা সম্পর্কে এবং ফিডব্যাকগুলো থেকে বুঝলাম, সাদের ছবি আমাদের নতুন দিনের ছবিরই একটা ভালো সংযোজন। মনে মনে আশা করতে থাকলাম সাদ কিছু একটা জিতুক এবং সে সত্যি সত্যিই জিতে গেল। সেরা পরিচালক ও সেরা অভিনেতার দুটো পুরস্কার জিতল লাইভ ফ্রম ঢাকা।
কিন্তু যদি ছবিটা সিঙ্গাপুরে কিছু না জিতত? হলফ করে বলছি, তবু ছবিটা আমাদের নতুন সিনেমার একটা উল্লেখযোগ্য সংযোজন হয়ে থাকত।

সাদের শক্তির জায়গাটা কোথায়? তার ছবির সততায়। তার ছবি দেখলে তার ব্যক্তিত্ব, বিশ্বাস, ক্রোধ, ক্ষোভ—সবই খুঁজে পাবেন এতে। এটাই তো অতর সিনেমার বৈশিষ্ট্য। সাদ সফলভাবে অতর ফিল্মমেকার হিসেবে তার স্বাক্ষর রেখে যাচ্ছে। সে তার সময়টাকে এঁকে যাচ্ছে। আকাশ থেকে কিছু পেড়ে আনতে হচ্ছে না ওর। আশপাশের জীবনের পাথর কেটে সাদ জীবনের নতুন প্রতিমা বানাচ্ছে। ওর ছবিটা কখন মুক্তি পায়, আমি সে অপেক্ষায় আছি। মুক্তি পাওয়ার পর ছবিটা দেখে আশা করি ওর শক্তির জায়গাটা খুঁজে পাবেন।
এখন সময় নাকি মার্কেটিংয়ের, অভিনব প্রচারণার। সাদ যে রকম লাজুক, মানুষ, আমি জানি না আদৌ তার ছবির প্রচারণা কেমন হবে। তা ছাড়া তার ছবির সঙ্গে এমন কেউ সংশ্লিষ্ট নেই, যার কল্যাণে ক্যাম্পেইন বাজেট বা ক্যাম্পেইন টুলসগুলো সে ব্যবহার করতে পারবে। দর্শকদের কাছে অনুরোধ থাকবে, আওয়াজ না থাকলেও ছবিটা দেখে নেবেন।
শেষ করব লাইভ ফ্রম ঢাকার একটা কথা বলে। ছোটবেলায় আমার আম্মা মাঝেমধ্যে বলতেন, মানুষ দুই রকম। কেউ দুধ বেচে মদ কেনে আর কেউ মদ বেচে কেনে দুধ। সাদের কথা ভাবতে গিয়ে আম্মার কথাটা মনে পড়ল। সাদ মদ বেচে দুধ কেনা মানুষ। পেশায় সে বিজ্ঞাপন নির্মাতা। বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন নির্মাতাদের প্রিয় হাহাকার—‘আমি একটা ছবি করতে চাই!’ কিন্তু সেই ছবিটা করার সময় ও সুযোগ বের করতে তাদের অনেক সময় লেগে যায়। কিন্তু সাদ বিজ্ঞাপন বানিয়ে হাহাকারের ফাঁদে না পড়ে ছবিটা বানিয়ে ফেলেছে এবং সেটা সে বানিয়েছে খুবই অল্প খরচে। নিজের জমানো টাকা, শিল্পী–কুশলীদের সহায়তা—সব মিলিয়ে সে নাকি ছবিটা দশ-বারো লাখ টাকায় বানিয়ে ফেলেছে। ছবিটা দেখলে আপনি টাকার দারিদ্র্য টের পাবেন না। চিত্রনাট্যটাই সে এমনভাবে সাজিয়েছে, যাতে খুব অল্প আয়োজনে, অল্প লোকেশনে কাজটা করতে পারে।
তারেক মাসুদ ঠাট্টা করে আমাকে বলতেন, ‘তোমরা কেমনে কী শুটিং করো, সব খবর আমি লই। কেন লই, জানো? কারণ, আমি শিং ভাইঙ্গা বাছুর হইতে চাই।’ সব সময় যে বড়রাই ছোটদের অনুপ্রেরণা হবেন তা নয়, কখনো কখনো ছোটরাও বড়দের অনুপ্রেরণা হতে পারে। আবদুল্লাহ সাদ আমাদের বড়-ছোট সবার কাছেই তেমনই এক অনুপ্রেরণা।
মোস্তফা সরয়ার ফারুকী চলচ্চিত্র পরিচালক