জ্যোতি মালহোত্রা ভারতের খ্যাতিমান সাংবাদিক। এ পেশায় আছেন ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে। বতর্মানে তিনি দিল্লিভিত্তিক ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। পেশাগত জীবনে ইন্ডিয়ানএক্সপ্রেস, টাইমসঅবইন্ডিয়া ও বিবিসি রেডিওতে কাজ করেছেন। ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, পররাষ্ট্র, সামাজিকসহ নানা বিষয় নিয়ে তিনি সাংবাদিকতা করেছেন। এখন নিয়মিত কলাম লিখছেন এনডিটিভিডটকম ও ইন্ডিয়াটুডেতে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পার্থ শঙ্কর সাহা
প্রথম আলো: তিন দশকের বেশি সময় ধরে সাংবাদিকতা করছেন। অনেক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে বলুন, ভারতের গণমাধ্যমের বর্তমান বাস্তবতা কী?
জ্যোতি মালহোত্রা: আমি বাংলাদেশে এসে এ দেশের গণমাধ্যমের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে পেরে একটি বিষয় উপলব্ধি করছি, ভারতের গণমাধ্যমের সামনে যে চ্যালেঞ্জগুলো আছে, তা কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশেও আছে। বাংলাদেশের মতো ভারতের গণমাধ্যমকেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এখানকার পত্রিকাগুলো ভারতের মতোই তাদের প্রচারসংখ্যা নিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। বাংলাদেশের মতো ভারতের সংবাদপত্রকেও চাপের মুখে পড়তে হয়েছে। সরকারের চাপ সামলানো ভারতের সংবাদপত্রের কাছে এখন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সাংবাদিকতায় আমাদের একটি বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে, যেন সরকার আমাদের কিনতে না পারে। গণমাধ্যমের মূল কাজ কী? মানুষকে তথ্য জানানো, তাদের শিক্ষিত করে তোলা, বিনোদন দেওয়া। মূল উদ্দেশ্য কোনো না কোনোভাবে সমাজের উন্নয়ন। এ জন্যই তো আমরা সাংবাদিক হয়েছি, তাই না? এই উদ্দেশ্যগুলো ভুলে গেলে চলবে না। ভারতের বিপদ আজ এখানেই। সরকারের পক্ষ থেকে এখন বলে দেওয়া হচ্ছে, এটা হলো সংবাদ, এটা সংবাদ নয়। এটা শুধু যে নরেন্দ্র মোদি সরকারের সময় হচ্ছে তা নয়, আগে থেকেই এটা চলছে। তবে সাংবাদিক হিসেবে আপনি তো কেবল এক পক্ষের কথা শুনতে পারেন না। কোনো কোনো সময় সরকার ঠিক তথ্য দিতেই পারে। আমাদের প্রধান কাজ হলো তথ্যের মধ্যে থাকা, এর নৈর্ব্যক্তিক বিশ্লেষণ। আর সত্যটা কী, তার নিরন্তর অনুসন্ধান। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ—আপনি যে দেশেরই সাংবাদিক হোন না কেন, এই মূলনীতিগুলো মেনে চলতেই হবে।
প্রথম আলো: ভারতের বর্তমান সরকারের আমলে গণমাধ্যম কি বেশি চাপে পড়েছে?
জ্যোতি মালহোত্রা: নরেন্দ্র মোদির সরকার সাংবাদিকদের ওপর অপেক্ষাকৃত কঠোর। ভারতে এখন সাংবাদিকদের ওপর নানা ধরনের চাপ আছে। কিছু কিছু গণমাধ্যম আছে, কিছু সাংবাদিক আছেন, যাঁরা এসব মেনে নিয়ে দিব্যি আছেন। আবার অনেকেই এসব চাপের পরও তাঁদের কাজটা করে যাচ্ছেন। তবে সাংবাদিক হিসেবে সরকারের সব কথা তো আপনি মেনে নিতে পারেন না। আমাদের কাজ হলো সত্য কী, তা তুলে ধরা। ঘটনার অনুপুঙ্খ বর্ণনা দেওয়া। কিন্তু সেই প্রচেষ্টা এখন বেশ বাধার মুখে।
প্রথম আলো: ব্যক্তিগতভাবে আপনি কোনো চাপ অনুভব করছেন?
জ্যোতি মালহোত্রা: দেখুন, সরাসরি আমার ওপর কোনো চাপ আসেনি। আমি সব সময় মুক্তভাবে কাজ করতে চেয়েছি। গণমাধ্যমে কাজ করতে গিয়ে আমি দেখেছি কিছু প্রতিষ্ঠান এসব চাপ মেনে নেয়। তারা সরকারের সহায়ক শক্তি বলে নিজেদের মনে করে। এসব চাপের মুখে যাতে না পড়তে হয়, সে জন্যই আমি ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকতা বেছে নিয়েছি।
প্রথম আলো: তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন গণমাধ্যমের ওপর এক প্রবল চাপ সৃষ্টি করেছে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় এই অঞ্চলের গণমাধ্যমের ভূমিকা কী হতে পারে?
জ্যোতি মালহোত্রা: আমাদের সমমনা গণমাধ্যম ও ব্যক্তিদের মধ্যে তথ্য বিনিময় করতে হবে। অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে হবে। এবারে প্রথম আলোর অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের গ্রামের কিছু মেয়ের ফুটবলে অসামান্য অর্জনের কথা শুনলাম।
প্রথম আলো: কলসিন্দুরের স্কুলের মেয়েদের কথা শুনেছেন আপনি?
জ্যোতি মালহোত্রা: ঠিক। এত বড় একটা খবর, আমরা কিন্তু জানিই না। আবার ত্রিপুরার একটি মেয়ে দীপা কর্মকার অলিম্পিকে গিয়ে এত সম্মান বয়ে আনল ভারতের জন্য। আমাদের চারদিকে এমন অসংখ্য ঘটনা ছড়িয়ে আছে পাঠকের জন্য। আমাদের রাজনীতি নিয়ে, সংস্কৃতি নিয়ে নানা তথ্য বিনিময় হতেই পারে। দক্ষিণ এশিয়ার সংবাদপত্রগুলোকে একে অপরের সঙ্গে তথ্য বিনিময় করতে হবে। অন্যের সংস্কৃতি, ঐতিহ্যও বিনিময় হওয়া দরকার। বাংলাদেশের প্রথম আলো বা ডেইলি স্টার ভারতের ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এর সঙ্গে তথ্য বিনিময় তো করতেই পারে। এভাবেই আমরা আমাদের পাঠকের আগ্রহ বাড়িয়ে তুলতে পারি। এ উদ্যোগ পাঠক বাড়াতে সহযোগিতা করতে পারে।
প্রথম আলো: সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম কি একটি বড় চ্যালেঞ্জ?
জ্যোতি মালহোত্রা: এখন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম অনেক ভালো করছে। তবে দেখুন, দিন শেষে মানুষকে কিন্তু গণমাধ্যমের কাছেই ফিরে আসতে হয়। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা ততটা নেই।
প্রথম আলো: দক্ষিণ এশিয়ার গণমাধ্যমের মধ্যে তথ্যের বিনিময়ের কথা বললেন। তবে দেশগুলোর মধ্যে নানা বিরোধ রয়ে গেছে। ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের, আবার পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের। এ পরিস্থিতিতে গণমাধ্যমের ঐক্য কীভাবে সম্ভব?
জ্যোতি মালহোত্রা: রাষ্ট্রগুলোর আন্তসম্পর্ক যা-ই হোক, গণমাধ্যমের ঐক্যটা থাকতেই হবে। ভারত-পাকিস্তান, পাকিস্তান-বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্কের বিরোধ রয়েছে। তা থাকতেই পারে। গণমাধ্যমের ঐক্যের জন্য, একে অন্যের সঙ্গে তথ্য বিনিময়ের কাজে এটি কোনো প্রতিবন্ধকতা নয়। আমি মনে করি, আমি ভারতের নাগরিক। তবে এর পাশাপাশি আমি এই দক্ষিণ এশিয়ারও নাগরিক। তাই আমি এই দক্ষিণ এশিয়ার নাগরিক হিসেবে কেন বাংলাদেশের সরকারের কোনো সিদ্ধান্তের সমালোচনা করতে পারব না। এটা করার অধিকার আমার আছে। শেখ হাসিনার সরকারের কোনো বিষয় নিয়ে কেন কথা বলতে পারব না? ঠিক উল্টো দিকে, বাংলাদেশের সাংবাদিকেরও অধিকার আছে ভারতের রাজনীতি নিয়ে কথা বলার। মোদি সরকারের কোনো সিদ্ধান্তের বিষয়ে আপনি আপনার মত দিতেই পারেন। রাহুল গান্ধীর কোনো কাজ নিয়ে মন্তব্য করার অধিকার আপনার আছে। এ অধিকার দক্ষিণ এশিয়ার সব নাগরিকের আছে। আর আমরা এভাবে একে অন্যের গণমাধ্যমের সঙ্গে নিজেদের মতামত শেয়ার করতে পারি। আমি অবশ্য পাকিস্তানের সেনানিয়ন্ত্রিত পত্রিকাগুলোর কথা বলছি না। সেসব পত্রিকার সবকিছুই সেনাবাহিনীর নির্দেশনায় চলে। এর বাইরে সে দেশের অনেক পত্রিকা আছে, যাদের সঙ্গে তথ্য বিনিময় হতে পারে। এখানে ডেইলি স্টার ও প্রথম আলোর বিরুদ্ধে বেশ কিছু রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হয়েছে। আমি এর প্রতিবাদ করতে পারব না কেন? আমাদের নিজেদের মধ্যে অনেক সময় ভয় কাজ করে। বোধ হয় কিছু লিখলেই সরকার আমাদের ওপর খড়্গহস্ত হবে। আমাদের এই ভয়ের বাইরে আসতে হবে।
প্রথম আলো: যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক নির্বাচনে ঘৃণার প্রচারণা চালিয়ে জয়ী হলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। দুই বছর আগে ভারতের নির্বাচনেও এই ঘৃণার প্রচারণাই জয়ী হয়েছিল। এই অসহিষ্ণুতা ভারত রাষ্ট্রের যে মূল ভিত্তি, সেই ধর্মনিরপেক্ষতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে কি না?
জ্যোতি মালহোত্রা: দেখুন, ট্রাম্প বা মোদি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। তাঁদের পেছনে জনরায় রয়েছে। এটা আমাদের স্মরণে রাখতেই হবে। তাঁরা নির্বাচিত হয়ে আসার পরও যদি উগ্রতা চলতে থাকে, তখন আমাদের কাজ হলো এই অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে নিয়মতান্ত্রিক অবস্থান নেওয়া, এর প্রতিবাদ করা। অস্বীকার করার উপায় নেই, ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তি খানিকটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হিন্দুত্ববাদ কিন্তু একধরনের দর্শন। হাজার বছর ধরে এটি টিকে আছে। একে এখন একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। এটা করা হচ্ছে রাজনৈতিক স্বার্থে। বলা হচ্ছে, আমরা এক জাতি, এক পতাকা। আমি বলি, আমরা এক দেশ হতে পারি, তবে এক জাতি কখনোই নই। ভারত বহু জাতির মানুষের দেশ। এর সংস্কৃতি বৈচিত্র্যপূর্ণ। এই বিশ্বাস থাকতেই হবে।
প্রথম আলো: আপনার লেখা সাম্প্রতিক এক নিবন্ধে পাকিস্তানি কবি ফেহমিদা রিয়াজের একটি কবিতা উদ্ধৃত করেছেন। কবিতাটি হলো ‘তুম বিলকুল হাম জ্যায়সে হ্যায়’। কবিতার মূল বিষয়, ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদ পাকিস্তানের উগ্র মৌলবাদী ভাবনার সমার্থক। আপনি কি একমত?
জ্যোতি মালহোত্রা: খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। যেকোনো উগ্রবাদের চরিত্র একই। তা সে হিন্দুত্ববাদ হোক বা মোল্লাতন্ত্র। ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদ যেভাবে কোনো প্রশ্ন শুনতে চায় না, পাকিস্তানের মোল্লাতন্ত্রও সেই একই রকম।