বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ খুব ভালো

>

নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। ছবি: প্রথম আলো
নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। ছবি: প্রথম আলো

২০০৪ সালে অমর্ত্য সেনের একটি সাক্ষাৎ​কার নেন প্রথম আলো সম্পাদক। সেই সাক্ষাৎ​কারে নোবেল বিজয়ী এই অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশের সামাজিক অগ্রগতির প্রশংসা করেছিলেন। পাশাপাশি কথা বলেছিলেন গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়েও। সাক্ষাৎ​কারটি প্রকাশ হয় ২০০৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর।

নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. অমর্ত্য সেন বলেছেন, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ​ খুব ভালো। বাংলাদেশের সামাজিক অগ্রগতির প্রশংসা করে তিনি বলেন, এ বিষয়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতের থেকে এগিয়ে গেছে। এ দেশকে নিজের দেশ হিসেবে আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, বাংলাদেশে না আসতে পারলেও এর সঙ্গে আত্মিক টান সব সময়ই অনুভব করেন। নানা সময় তঁার মনে হয় ঢাকার কথা।

সার্ক দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্কোন্নয়নের ব্যাপারে অমর্ত্য সেন বলেন, মতপার্থক্য থাকতে পারে, তর্ক চলতে পারে, তবে আলোচনাই একমাত্র পথ। আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে সবার অগ্রসর হওয়া দরকার বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।

সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ঢাকায় এসেছিলেন এই নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ। সে সময় প্রথম আলোর সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় ড. অমর্ত্য সেন বাংলাদেশ প্রসঙ্গ ছাড়াও উন্নয়ন, গণতন্ত্র, মানবিক অধিকারসহ বিভিন্ন বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন। আলাপচারিতার বিস্তারিত নিচে প্রকাশিত হলো।

প্রথম আলো: আপনার ডেভেলপমেন্ট ইজ ফ্রিডম বইয়ের মূল কথা স্বাধীনতা, অর্থা​ জনকল্যাণ নিশ্চিত করতে হলে জনগণকে ক্ষমতা দিতে হবে, স্বাধীনতা দিতে হবে—বলেছেন আপনি। তাদের ইচ্ছেগুলো পূরণের সুযোগ দিতে হবে, তো মানুষের কল্যাণে কাজ করতে হবে।

অমর্ত্য সেন: আপনি ঠিকই বলেছেন। আমার প্রধান বক্তব্য যে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নকে স্বাধীনতার দিক দিয়ে দেখতে হবে এবং স্বাধীনতার থেকেও একটা বড় অর্থ ধরতে হবে। এটা এই না যে, শুধু কিছু রাজনৈতিক অধিকার রইল কি না। যদিও সেটা তার মধ্যে একটা নগণ্য বিষয় নয় এবং সেটাই একমাত্র বিষয় নয়। সে জন্য লোকের খাওয়া-পরা জুটল কি না, তার খাওয়া-পরা না জুটলে যে পরাধীনতা দেখা দেয়, সেটাও তো একটা বড় জিনিস। যেমন, আমি আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই নিজের আলোচনায় একবার লিখেছিলাম, যখন প্রথম দাঙ্গায় একজন লোককে মরতে দেখলাম; একজন মুসলিম শ্রমিক। তিনি ওয়ারী হিন্দু অঞ্চলে এসেছেন দাঙ্গার সময়, তঁার বাড়িতে কোনো খাবার নেই। তিনি জানতেন যে একটা ঝুঁকি নিচ্ছেন। তা সত্ত্বেও তিনি এসেছিলেন এ জন্য যে, তঁার স্বাধীনতা ছিল না বাড়িতে বসে থাকার। কেননা বাড়িতে কোনো খাবার নেই। সে জন্য তঁাকে যখন একজন কাজের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তিনি তখন ঝুঁকি নিয়ে পথে নেমেছিলেন। ঠিক আমাদের বাড়ির সামনে ১৪ লারমিনি স্ট্রিটে, পথে তঁাকে ছুরি মারল কিছু হিন্দু গুণ্ডা। তিনি আমাদের বাড়ির ভেতরে ছুটে এলেন এবং আমি চিত্কার করে আমার বাবাকে ডাকার চেষ্টা করলাম ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু শ্রমিকটি যখন আমাদের সামনে পানি খাচ্ছেন, সেই সময় তিনি আমাদের সামনে বলছিলেন— আমি জানি যে এ মুহূর্তে এ অঞ্চলে আসাটা ঝুঁকিপূর্ণ, আমার স্ত্রীও এ কথা বলেছিলেন, তা সত্ত্বেও আমি এসেছি যে আমার একটা কাজ এবং একটা মজুরির সম্ভাবনা তৈরি হলো, সেটা না নেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই, স্বাধীনতাও আমার নেই। কেননা বাড়িতে বাচ্চারা কিছু খেতে পাচ্ছে না। কোনো খাবার নেই। অতএব আমাকে আসতেই হলো।

সেই শ্রমিকটির অর্থনৈতিক অস্বাধীনতা থেকে তার বেঁচে থাকার অস্বাধীনতা তৈরি হলো; এবং তারপর তো তাকে আমার বাবা হাসপাতালে নিয়ে গেলেন, সেখানে ওই শ্রমিক মারাও গেলেন। এটা থেকে আমার যেটা মনে হয়েছিল, তখন আমার ১১ বছর বয়স, যে আমাদের নানা স্বাধীনতা— অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক সবই একটির সঙ্গে আরেকটি যুক্ত এবং সে জন্য সামগ্রিকভাবে স্বাধীনতা সব দিক দিয়ে দেখে উন্নয়নের কথা ভাবতে হবে। এটাই আমার বইয়ের প্রধান বক্তব্য।

প্রথম আলো : পাশাপাশি ব্যক্তিস্বাধীনতাকেও আপনি বিশেষ গুরুত্ব দেন। আমাদের সামাজিক দায়বদ্ধতা, যেটাকে আপনি বলেছেন সোশ্যাল কমিটমেন্ট হিসেবে দেখেন...

অমর্ত্য সেন : আমার মনে হয় যে আমাদের যে মানবিক অধিকার, তার মধ্যে যেমন খাওয়া-পরা, অসুখ হলে চিকিত্সা পাওয়ার যে দাবি, সেটা যেমন আছে; তেমনি আমাদের মন খুলে কথা বলতে পারা, যা বলতে চাই তা প্রকাশ করতে পারা, অন্যদের সঙ্গে খোলা মনে কথা বলতে পারা— এই স্বাধীনতাটাও আমাদের মানবিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। আমার ধারণা, পৃথিবীর ইতিহাসের সমস্ত সভ্যতাতেই এ মানবিক অধিকার বিষয়ে কথা নানা সময়ে লোকে বলেছেন। এটা শুধু একটা পশ্চিমা ধারণা বললে অত্যন্ত ভুল করা হবে।

ভারতবর্ষে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। চীনেও হয়েছে। জাপানেও হয়েছে। পশ্চিম এশিয়াতে, আরব সভ্যতাতেও এ নিয়ে আলোচনা আছে অনেক। এ জন্য এই মূল্যবোধটা আমার ধারণা, একটা মানবিক মূল্যবোধ। অতএব মানবিক অধিকার আমাদের একটা সামগ্রিক মানবিক মূল্যবোধ, এটাও আমার একটা বক্তব্য।

প্রথম আলো : আপনি তো পাশাপাশি জনকল্যাণের জন্য মানুষের স্বাস্থ্য, শিক্ষা এগুলোর ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছেন। এবং আপনার নানা কথায় এগুলো জানছি আমরা। সেদিক থেকে আমাদের এ অঞ্চলে অগ্রগতিও আছে, সমস্যাও আছে। বাংলাদেশ বলেন, ভারত বলেন, রাষ্ট্রকে এই দায়িত্বগুলো পালন করতে হবে। রাষ্ট্রের একটা দায়বদ্ধতাও আছে। আবার দেখা যায় যে আমাদের রাজনীতিবিদ বা সরকার, তারা যে কথাগুলো বলেন, সেগুলো রক্ষা করেন না। এই যে একটা জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্রের ভাবনা বা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অধিকার প্রতিষ্ঠা করা— এ ব্যাপারে আপনার ভাবনা জানতে চাইছি।

অমর্ত্য সেন : আমার মনে হয় বিভিন্ন স্বাধীনতার যে অঙ্গাঙ্গি যোগ, সেইদিক থেকে এই সমস্যাটার বিচার করতে হবে। যদি সরকারের কাছে দাবি করা হলো যে কিছু করা হোক— ভারতে হোক, পাকিস্তান হোক বা বাংলাদেশে হোক, তারা সে দাবি শুনে যদি বলেন আমরা কিছু করব এবং তারপরে তারা যদি না করেন, তাহলে এটা নিয়ে আলোচনা করা যে তারা বলেছিলেন করবেন কিন্তু তারা করলেন না। তাতে যে গাফিলতির একটা প্রমাণ পাওয়া গেল, সেটা নিয়েও তো সামাজিক আলোচনা চলতে পারে। সে জন্য সমালোচনা করার স্বাধীনতা অর্থনৈতিক স্বাধীনতার সঙ্গে যুক্ত। খেতে না পেলে খাওয়া দেয়া হবে, চিকিত্সার জন্য ব্যবস্থা করা হবে। তারা বললেন, কিন্তু করলেন না। সেই স্বাধীনতাটাকে রূপ দিতে হলে আমাদের কথা বলা, প্রতিবাদ করা, আলোচনা করা, সংবাদ প্রকাশ করার স্বাধীনতাটা খুবই দরকার।

প্রথম আলো : তাহলে আপনি বলছেন, গণতন্ত্র সরাসরি উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত?

অমর্ত্য সেন : আমি তা-ই মনে করি। আমার বইতে খানিকটা আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। অনেক সময় লোকে প্রশ্ন করেন, গণতন্ত্রের ফলে উন্নয়ন হবে কি হবে না। প্রথমেই মানতে হবে, গণতন্ত্র উন্নয়নের একটা অংশ। যেমন ডিম সেদ্ধ করতে হলে জল ফোটানো দরকার। এই না যে, ফোটানো জলটা আমরা খাব। কিন্তু তাই দিয়ে ডিমটা সেদ্ধ হবে। কিন্তু গণতন্ত্র জিনিসটা তো ঠিক গরম জলের ব্যাপার না। গণতন্ত্র অবশ্যই উন্নয়নের একটা অংশ। যারা খুব ধনী হলেন কিন্তু কথা বলার স্বাধীনতা নেই; তারা যদি তাদের মতামত প্রকাশ করেন, তাদের জেলে দেওয়া হয়, সেই দেশ উন্নত দেশ— এ রকম কথা বলতে পারা যায় না।

প্রথম কথা হচ্ছে, উন্নয়নের একটা অংশ হচ্ছে গণতন্ত্র। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, অন্যান্য আমাদের যে স্বাধীনতা— অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, সামাজিক স্বাধীনতা সেগুলো গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার সঙ্গে ইতিবাচকভাবে যুক্ত। গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা দিয়ে আমরা জোর গলায় চাইতে থাকব এবং এ ক্ষেত্রে মৌনতা বোধ হয় অবিচারের এক প্রধান সহায়ক। মৌনতা দিয়ে মানবিক অধিকার পাওয়া যায় না।

মানবিক অধিকার পেতে হলে আমাদের জোর গলায় বলতে হবে, দাবি করতে হবে। সে জন্য গণতন্ত্রের ভূমিকা শুধু নিজের মূল্যের জন্য নয়। নিজের মূল্য তো আছেই। তার ওপরে যে স্বাধীনতার মূল্য আমরা দিই সামাজিক, অর্থনৈতিক, চিকিত্সা ইত্যাদি ক্ষেত্রে, সেগুলোকেও সাহায্য করবে। এদের সঙ্গে যোগাযোগগুলো ইতিবাচক, নেতিবাচক নয় বলে আমার ধারণা।

প্রথম আলো : আবার তো গণতন্ত্রে সংকট সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশে বলেন, ভারতে বলেন, গণতন্ত্রের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে আমাদের ত্রুটিমুক্ত একটা সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

অমর্ত্য সেন : এটা ঠিকই। অনেক সময় লোকে গণতন্ত্রের ভুলটা চট করে চোখে দেখেন। কিন্তু তারা যদি সময় নিয়ে দেখেন বা আমাদের গণতন্ত্রের ব্যবহারের যে সুযোগ, সে সুযোগ আমরা নিতে উদগ্রীব থাকি, তার ফলে যে সামাজিক উন্নতি হতে পারে, সেটা অনেক সময় তারা দেখেন না। আমি দুটো উদাহরণ দিচ্ছি— ভারতের সঙ্গে যদি চীনের তুলনা করেন, চীনে গণতন্ত্র নেই, ভারতের আছে। অথচ দেখা যায় চীন অনেক বেশি উন্নতি করেছে। এটা একদিকে ঠিক। গোড়ার দিকে যখন চীনে কমিউনিস্ট বিপ্লব হয়েছিল, তখন মাওয়ের নেতৃত্বে প্রাথমিক শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য নিয়ে যেভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, পরে সে তুলনায় কিছু হয়নি। ১৯৭৯ সালে দেং জিয়াও পিং যে সংস্কারটা করলেন, সেটা হলো চীনের জীবনপ্রত্যাশা বা গড় আয়ু তখন ভারতের চেয়ে ১৪ বছর বেশি। অর্থনৈতিক সংস্কারের পর থেকে চীনের অর্থনৈতিক প্রগতি অনেক বেশি দ্রুত হয়েছে। ভারতবর্ষেও মোটামুটি দ্রুত। তবে চীন এ ক্ষেত্রে অগ্রগামী। কিন্তু তা সত্ত্বেও আজকে যদি দেখেন চীনের সঙ্গে ভারতের গড় আয়ু ১৪ বছরের জায়গায় কমে হয়েছে ৭ বছর এবং ভারতবর্ষের কিছু কিছু অংশ আছে, যেমন কেরালা, যেখানে গড় আয়ু চীনের থেকে চার-পাঁচ বছর বেশি। চীনে যেখানে ৭১, সেখানে কেরালায় ৭৫ বা ৭৬ এবং আমার ধারণা, কেরালার দিকে যদি দেখেন, কেরালার গুণটা হচ্ছে বহুদলীয় ব্যবস্থা, বিভিন্ন পার্টি দিয়ে তৈরি গণতন্ত্র আছে। তার ফলে কমিউনিস্ট পার্টিকে কংগ্রেস সমালোচনা করে। কংগ্রেসকে কমিউনিস্ট পার্টি সমালোচনা করে। অন্যদিকে চীনের যে ধরনের রাজনৈতিক ভিশন বা দৃষ্টিভঙ্গি তা থেকে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের দিকে জোর দেওয়া হয়েছিল, কেরালায় সেটা গোড়া থেকেই ছিল। তার ফলে কেরালা চীনের অর্থনৈতিক সংস্কার-পূর্ববর্তী সময়ের যে রাজনৈতিক অঙ্গীকার, তার সঙ্গে গণতন্ত্রকে মেলাতে পেরেছে। এটা একটা উদাহরণ।

আরেকটা উদাহরণ আপনাকে দিচ্ছি। গুজরাটে যখন দাঙ্গা হলো, ২ হাজার মুসলমান মারা গেল। এটা আমাদের হিসাব। যদিও গুজরাটের রাজ্য সরকার তা মানে না। সেই দাঙ্গার মধ্যে যখন ওরা আবার নির্বাচন করলেন তখন সেই বিজেপি সরকারই জিতল। কিন্তু তাতে অনেকেই বললেন, গণতন্ত্র করে এটা বাঁচানো গেল না। এখন তো প্রমাণ হলো, ২০০৪ সালের এপ্রিল-মে মাসে নির্বাচন হলো, গুজরাটে যে হিংসাত্মক কাজ হয়েছে এবং খুনোখুনি যেগুলো হয়েছে তার ফলে বিজেপির মার খাওয়ার খুব একটা যোগ আছে এবং বাজপেয়ি হেরে যাওয়ার পর নিজেই বললেন, গুজরাটের রক্তবন্যার ফলে আমরা নির্বাচনে হেরে গেলাম।

 এই বলার পরে তার সহকর্মীরা সবাই সমালোচনা করলেন এবং তিনিও তার কথাটা প্রত্যাহার করলেন। কিন্তু কথাটা ফেরত নিয়ে নিলেও ব্যাপারটা তো সত্যি। সেই জন্য গণতন্ত্রে পরাজয়টা, সেটা নির্ভর করছে খানিকটা সময়ের ওপর। আর দ্বিতীয়ত, সেই সময়ে আমরা কী করছি। তার ফলে কংগ্রেস এবং বামপন্থি জোটগুলো যে রাজনৈতিক প্রচার করল তার মধ্যে বলা হলো, এ রকম কেন ন্যায়ের অভাব হবে, যাতে করে এত লোক মারা যেতে পারে, গুজরাটে যখন অর্থনৈতিক প্রগতি হচ্ছে ইত্যাদি। তার ফলে আমার ধারণা, গণতন্ত্রকে ব্যবহার করে যে মানবিক অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রকে আমরা বাড়ানোর চেষ্টা করতে পারি, সেটা অসত্য নয়।

প্রথম আলো : আপনি তো সংস্কারের কথাও বলেন, তবে নৈতিকতাবিহীন সংস্কার নয়। বর্তমান পৃথিবীতে সংস্কারের বাইরে কেউ থাকতে পারছে না। কিন্তু আপনি সংস্কারকে নিয়ে আসছেন, পাশাপাশি মানুষকে বাদ দিয়ে সংস্কার নয়, এ কথাও বলছেন?

অমর্ত্য সেন : সংস্কার শব্দটি আমার খুব পছন্দসই শব্দ নয়। সংস্কৃতি, সভ্যতা, সংস্কারটা অনেক সময় আমাদের মনে হয়, যেটা চিন্তা না করেই আমরা মানতে পারি। এখন এটা তো একটা কথাই আছে, আমাদের সবারই কিছু বিশ্বাস থাকবে। এ বিষয়ে সুন্দর কথা বলেছিলেন মোগল সম্রাট আকবর। তিনি বলতেন, রহি আকল (ঞযব ঢ়ড়ত্ঃ ড়ভ ত্বধংড়হ)। আরো বলতেন, আমার যে বিশ্বাস নেই তা নয়। কিন্তু আমার বিশ্বাসগুলো আমার চিন্তা এবং যুক্তির আগে নয়। যুক্তির পরে আমি ঠিক করব যে আমি কী বিশ্বাস করব।

এখন সংস্কারটা, আমার ধারণা অনেক সময় ব্যবহার করা হয় যে চিন্তার আগেই যেই বিশ্বাসগুলো এল, সংস্কৃতি কিন্তু ঠিক তা না। সংস্কৃতি হচ্ছে একটা সভ্যতা। তার মধ্যে চিন্তাও যেমন একটা সভ্যতার অঙ্গ, যুক্তিও একটা সভ্যতার অঙ্গ এবং তার থেকে যদি বিশ্বাস আসে এবং সে বিশ্বাসের ভিত্তি কোথায়, তার মধ্যে চিন্তা এবং আলোচনা ও যুক্তিবিচার, পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভূমিকা কী, এটা আমাদের ভাবা উচিত বলে মনে করি।

নীতিবোধের কথা যেটা বলছেন, নীতিবোধটাও আমার ধারণা, যুক্তির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। আমরা সমাজে বাস করি, প্রশ্নটা উঠতে পারে যে, কেন আমরা জিনিসটা করতে চাই অথবা অন্য জিনিস করতে চাই না। তাতেও একটা প্রশ্ন উঠবেই— যুক্তিটা কী? কী কারণে আমরা কাজটা করতে চাই এবং যুক্তিহীন বিশ্বাস— আমি মনে করি না কোনো রকম ভিত্তি আছে। আমার যে নতুন বই বের হচ্ছে, দ্য আরগুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়া এই নামে পেঙ্গুইন থেকে বের করছে, তার মধ্যে একটা বড় চরিত্র হচ্ছে সম্রাট আকবর। তাতে ওর কী বক্তব্য, তিনি তো ধার্মিক ছিলেন, কিন্তু তার ধর্ম বিশ্বাসটাকে তিনি যুক্তি দিয়ে সমর্থন করছেন। যুক্তি ছাড়া সমর্থন করছেন, এ রকম নয়।

প্রথম আলো : বাংলাদেশ সমের্ক কিছু কথা বলবেন? কী রকম দেখেন এ দেশের সম্ভাবনা?

অমর্ত্য সেন : বাংলাদেশ তো আমার নিজের দেশ। আমার পরিবার এখান থেকে গেছে। আমি ছেলেবেলায় এখানে ছিলাম। কিছুদিন এখানে পড়াশোনা করলাম। তারপর গেলাম শান্তিনিকেতনে। তাই বাংলাদেশে এলে আমার যে একটা আত্মিক সমর্ঙ্ক সঙ্গে সঙ্গে ফুটে বের হয়, সেটা বাংলাদেশে না এলে আসে না— এ রকম তো নয়। নানা সময়েই আমার মনে হয় ঢাকার কথা। মানিকগঞ্জে যে বাড়ি ছিল অথবা মামাবাড়ি বিক্রমপুরে অথবা বেড়াতে গেছি চট্টগ্রামে ইত্যাদি, এগুলো খুব মনে পড়ে। এই যে মানসিক একটা যোগাযোগ, সেটা তো খুব বড় একটা যোগাযোগ।

প্রথম আলো : বাংলাদেশের ভবিষ্যতের সম্ভাবনা কী রকম দেখেন?

অমর্ত্য সেন : আমার তো মনে হয় ভবিষ্যত্ খুব ভালো। যদি সামাজিক মাপকাঠিতে দেখেন, অনেক কথা, সামাজিক চিহ্নর কথা, যা এখন বলা হয়, তাতে তো বাংলাদেশ ভারত থেকে এগিয়ে গেছে। শিক্ষার কোনো কোনো সূচকে এগিয়ে গেছে। আয়ুতে এখনো এগোয়নি। তা ছাড়া আমাদের যে এনজিও বলা যেতে পারে, বেসরকারি কাজের যে গৌরবময় ইতিহাস বাংলাদেশে হয়েছে ব্র্যাক বা গ্রামীণ ব্যাংক ইত্যাদি, এগুলো পৃথিবীর কাছে বড় একটা জিনিস। আমার নিজের ধারণা, এটা শুধু দেখানোর জিনিস না, এতে করে সামাজিক একটা উন্নতি হচ্ছে এবং উন্নতির আরো সুযোগ-সুবিধা রয়েছে, সেগুলোকে আরো কীভাবে পূর্ণভাবে ব্যবহার করা যায় সেদিকে নজর দেওয়া।

প্রথম আলো : সামনে সার্ক সম্মেলন, আঞ্চলিক সহযোগিতা নিয়ে কোনো কিছুর সম্ভাবনা কি আপনি দেখেন?

অমর্ত্য সেন : আমার তো রিজিওনাল কো-অপারেশন নিয়ে একটা বক্তব্য আছে যে, আমাদের এই অঞ্চলে, বাংলাদেশ, ভারত বা পাকিস্তানেও যে একটা দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে বিচার, বুদ্ধি, তর্কের, তর্কটাকে আমি একটা ইতিবাচক বিষয় বলে মনে করি। খুনোখুনি তো তর্কের বিকল্প নয়। সে জন্য তর্কটা আমাদের করা দরকার। মতবিরোধ তো হবেই। মতবিরোধ হলে আলোচনা করা দরকার। আমার ধারণা, তর্ক করার ব্যাপারটাকে বাড়ানো দরকার এবং আমার যদি প্রধান একটা সমালোচনা থাকে বিজেপির হিন্দুত্ব সমের্ক, তারা এই আলোচনা যুক্তি-তর্ক বাদ দিয়ে বিশ্বাস, সংস্কার এবং কিছু লোকের প্রতি আত্মীয়তাবোধ এবং অন্য লোকের প্রতি অনীহা— এইদিকে জোর দিচ্ছে। সেদিকে আমরা সবার সঙ্গে বসে আলোচনা করতে পারি, তর্ক করতে পারি। আমার ধারণা, ভারতবর্ষের ভবিষ্যত্ এর ওপর নির্ভর করছে। তার ওপরে আমি যোগ করব, দক্ষিণ এশিয়ার ভবিষ্যত্ও নির্ভর করছে আমরা নিজেদের মধ্যে তর্ক করতে পারব কি না, এর ওপর।

বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের জল নিয়ে মতপার্থক্য হতে পারে। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে হতে পারে। পাকিস্তানের সঙ্গে তো নানা বিষয়ে ঝগড়া চলছে ভারতের। কিন্তু সব বিষয়ে আলোচনা করে কীভাবে এগুলোর সমাধান করা যেতে পারে, সেদিকে অগ্রসর হওয়া দরকার সবার।

আরও পড়ুন :